Skip to main content

Five Pillars of Islam

Five Pillars of Islam  The profession of Faith (Shahadah)  Prayer (Salah) Alms (Zakat) Fasting (Sawm) Pilgrimage (Hajj) What are The  Five Pillars of Islam Explained 5 pillars of Islam in English? 5 Pillars of Islam  Prophet Muhammad Sallallahu Alayhi Wa Sallam came to teach us many things and the most important of them are the five pillars of Islam do you know the five pillars let's say them together with number one a Shahada to say  ASH-HADU ANNA LA ILAHA ILLA ALLAHU WA ASH-HADU ANNA MUHAMMADAN ABDUHU WA RASULUHU which means there is no one worthy of worship except Allah and that Muhammad Sallallahu Alayhi Wa Sallam is his final messenger number two is salat the prayer the five daily prayers number three zakat to give the yearly charity number four ECM fast in the month of Ramadan and number five is Hajj going to Mecca and performing the pilgrimage Salah will be the first pillar that Allah will ask us about on the day of judgment so it is very important to pray on time and concen

Hazrat Muhammad Sallallahu alayhi salam a jibon kahani | হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনী জীবন কাহিনী - মাক্কী জীবন

হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী এখানে  মাক্কী জীবন এর  সম্পর্ণ কাহানি আসে তাই একটু লম্বা হয়ে গেছে আপনারা যদি বিশেষ কিস জানতে চান তাহলে বিষয় গোলো দেয়া আসে দেখে পড়তে পারেন

এবং এই কাহানি কে দুই ভাগে করা হয়েছে


হযরত মুহাম্মদ সাঃ জীবনী, শেষ নবীর জীবনী মাক্কী জীবন সম্পর্ণ


আরব জাতি (الشعب العربى وأقوامها)


মধ্যপ্রাচ্যের মূল অধিবাসী হ’লেন আরব জাতি। সেকারণ একে আরব উপদ্বীপ (جزيرة العرب) বলা হয়। আরবরা মূলতঃ তিনটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত। ১. আদি আরব (العربُ البائدةُ) যারা আদ, ছামূদ, আমালেক্বা প্রভৃতি আদি বংশের লোক। যাদের বিস্তৃত ইতিহাস পাওয়া যায় না। ২. ক্বাহত্বানী আরব (العربُ العارِبَةُ)। যারা ইয়ামনের অধিবাসী। এরা ইয়া‘রাব বিন ইয়াশজাব বিন ক্বাহত্বানের বংশধর। ৩. ‘আদনানী আরব (العربُ الْمُسْتَعْرِبَةُ)। এরা ইরাক থেকে আগত ইবরাহীম-পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশোদ্ভূত ‘আদনান-এর বংশধর। এদের বংশেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্ম হয়।


আরবের অবস্থানস্থল (موقع العرب)

তিনদিকে সাগর বেষ্টিত প্রায় ১৩ লক্ষ বর্গমাইল ব্যাপী বিশ্বসেরা আরব উপদ্বীপ কেবল পৃথিবীর মধ্যস্থলেই অবস্থিত নয়, বরং এটি তখন ছিল চতুর্দিকের সহজ যোগাযোগস্থল ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রভূমি। বর্তমান ফ্রান্সের প্রায় দ্বিগুণ এই বিশাল ভূখন্ডটির অধিকাংশ এলাকা মরুময়। অথচ এই ধূসর মরুর নীচে রয়েছে আল্লাহর রহমতের ফল্গুধারা বিশ্বের মধ্যে মূল্যবান তরল সোনার সর্বোচ্চ রিজার্ভ। এর পশ্চিমে লোহিত সাগর, পূর্বে আরব উপসাগর। যা গ্রীকদের নিকট পারস্য উপসাগর নামে খ্যাত। দক্ষিণে আরব সাগর (যা ভারত মহাসাগরের বিস্তৃত অংশ) এবং উত্তরে সিরিয়া ও ইরাকের ভূখন্ড। পানিপথ ও স্থলপথে আরব উপদ্বীপ এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ তিনটি মহাদেশের সাথে যুক্ত।


নবুঅতের কেন্দ্রস্থল (مركز النبوة)

আদি পিতা আদম, নূহ, ইদ্রীস, হূদ, ছালেহ, ইবরাহীম, লূত্ব, ইসমাঈল, ইসহাক্ব, ইয়াকূব, শু‘আয়েব, মূসা, দাঊদ, সুলায়মান, ইলিয়াস, যাকারিয়া, ইয়াহইয়া ও ঈসা (‘আলাইহিমুস সালাম) এবং সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহে ওয়া সাল্লাম) সহ সকল নবী ও রাসূলের আবির্ভাব ও কর্মস্থল ছিল মধ্যপ্রাচ্যের এই পবিত্র ভূখন্ড।


এর নানাবিধ কারণ থাকতে পারে। তবে আমাদের ধারণায় প্রথম কারণ ছিল অনুর্বর এলাকা হওয়ায় এখানকার অধিবাসীগণ ব্যবসায়ে অভ্যস্ত ছিল। ফলে পৃথিবীর অন্যান্য এলাকার সঙ্গে আরবদের নিয়মিত বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। সেকারণ খুব সহজেই এখান থেকে নবুঅতের দাওয়াত সারা বিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ত।


দ্বিতীয় কারণ হ’ল এই ভূখন্ডে ছিল দু’টি পবিত্র স্থানের অবস্থিতি। প্রথমটি ছিল মক্কায় বায়তুল্লাহ বা কা‘বাগৃহ। যা হযরত আদম (আঃ) কর্তৃক প্রথম নির্মিত হয়। অতঃপর ইবরাহীম ও তৎপুত্র ইসমাঈলের হাতে পুনর্নির্মিত হয়। দ্বিতীয়টি ছিল বায়তুল মুক্বাদ্দাস, যা কা‘বাগৃহের চল্লিশ বছর পর আদম-পুত্রগণের কারু হাতে প্রথম নির্মিত হয়, যা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। অতঃপর ইবরাহীম (আঃ)-এর পৌত্র ইয়াকূব বিন ইসহাক (আঃ) কর্তৃক নির্মিত হয়। অতঃপর দাউদ ও সুলায়মান (আঃ) কর্তৃক পুনর্নির্মিত হয়। ইবরাহীমপুত্র ইসমাঈল-এর বংশধরগণ মক্কা এলাকা আবাদ করেন। তাঁরাই বংশ পরম্পরায় বায়তুল্লাহর রক্ষণাবেক্ষণ, হাজী ছাহেবদের জান-মালের হেফাযত এবং তাদের পানি সরবরাহ, আপ্যায়ন ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করেন। অন্যদিকে ইবরাহীম (আঃ)-এর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আঃ)-এর বংশধরগণ বায়তুল মুক্বাদ্দাস তথা আজকের ফিলিস্তীন এলাকায় বসবাস করেন। ইসহাক-পুত্র ইয়াকূব (আঃ)-এর অপর নাম ছিল ‘ইস্রাঈল’ (إسرائيل বা ‘আল্লাহর দাস’)। সেকারণ তাঁর বংশধরগণ ‘বনু ইস্রাঈল’ নামে পরিচিত। এভাবে আরব উপদ্বীপের দুই প্রধান এলাকা সহ পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধর বনু ইসমাঈল ও বনু ইস্রাঈল কর্তৃক তাওহীদের দাওয়াত প্রসার লাভ করে। সাথে সাথে তাদের সম্মান ও প্রতিপত্তি সর্বত্র বিস্তৃত হয়। আল্লাহ বলেন,إِنَّ اللهَ اصْطَفَى آدَمَ وَنُوْحاً وَآلَ إِبْرَاهِيْمَ وَآلَ عِمْرَانَ عَلَى الْعَالَمِيْنَ- ذُرِّيَّةً بَعْضُهَا مِنْ بَعْضٍ وَاللهُ سَمِيْعٌ عَلِيْمٌ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মনোনীত করেছেন আদম ও নূহকে এবং ইবরাহীম পরিবার ও ইমরান পরিবারকে জগদ্বাসীর মধ্য হ’তে’। ‘তারা একে অপরের সন্তান। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (আলে ইমরান ৩/৩৩-৩৪; আনকাবূত ২৯/২৭)। ইমরান ছিলেন মূসা (আঃ)-এর পিতা অথবা মারিয়াম-এর পিতা। সকলের মূল পিতা হ’লেন আবুল আম্বিয়া ইবরাহীম (আঃ)। পৃথকভাবে ‘আলে ইমরান’ বলার মাধ্যমে মূসা ও ঈসা (আঃ)-এর বিশাল সংখ্যক উম্মতকে বুঝানো হয়েছে। আর ইবরাহীম (আঃ)-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশে শেষনবী ও শ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর আগমন ঘটেছে। যাঁর উম্মত সংখ্যা দুনিয়া ও আখেরাতে সর্বাধিক।


রাজনৈতিক অবস্থা (الحالة السياسية)

আরবভূমি মরুবেষ্টিত হওয়ায় তা সর্বদা বহিঃশক্তির আক্রমণ থেকে নিরাপদ ছিল। ফলে এরা জন্মগতভাবে স্বাধীন ছিল। এই সময় আরবের দক্ষিণাংশে ছিল হাবশার সাম্রাজ্য, পূর্বাংশে ছিল পারসিক সাম্রাজ্য এবং উত্তরাংশের ভূখন্ডসমূহ ছিল রোমক সাম্রাজ্যের করতলগত। সম্রাট শাসিত এইসব অঞ্চলের অধিবাসীরা সবাই ছিল ধর্মের দিক দিয়ে খ্রিষ্টান। যদিও প্রকৃত ধর্ম বলতে সেখানে কিছুই ছিল না। মক্কা ও ইয়াছরিব (মদীনা) সহ আরবের বাকী ভূখন্ডের লোকেরা স্বাধীন ছিল। তাদের কোন কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা ছিল না। তবে তারা গোত্রপতি শাসিত ছিল।


ধর্মীয় অবস্থা (الحالة الدينية)

এ ব্যাপারে জানার জন্য কুরআনই বড় উৎস। সে বর্ণনা অনুযায়ী জাহেলী যুগের আরবরা আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের জন্য মনগড়া উপাস্য সমূহ নির্ধারণ করেছিল (ইউনুস ১০/১৮)। তারা আল্লাহকে স্বীকার করত। সেই সাথে সুফারিশকারী হিসাবে অন্যদের উপাস্য মানত (আন‘আম ৬/১৯)। ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী তারা মূর্তিগুলিকে তাদের পূজিত ব্যক্তিদের ‘রূহের অবতরণ স্থল সমূহ’ (مَنَازِلُ الْأَرْوَاحِ) বলে মনে করত। মূর্তিপূজা তাদের আক্বীদা ও সমাজ-সংস্কৃতিতে মিশে গিয়েছিল। যুগ পরম্পরায় তারা এই আক্বীদায় বিশ্বাসী ও রীতি-নীতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল (যুখরুফ ৪৩/২২)। তারা কা‘বা গৃহে মূর্তি স্থাপন করেছিল এবং হজ্জের অনুষ্ঠানসমূহে পরিবর্তন এনেছিল। তাওয়াফের জন্য ‘হারামের পোষাক’ (ثِيَابُ الْحَرَمِ) নামে তারা নতুন পোষাক পরিধানের রীতি চালু করেছিল। নইলে লোকদের নগ্ন হয়ে তাওয়াফ করতে হ’ত। কুরায়েশরা মূর্তিপূজা করত। সেই সাথে নিজেদেরকে ইবরাহীম (আঃ)-এর একান্ত অনুসারী হিসাবে ‘হানীফ’ (حَنِيْف) ‘একনিষ্ঠ একত্ববাদী’ বলত। এছাড়া তারা নিজেদেরকে ‘হুম্স’ (حُمْس), ‘ক্বাত্বীনুল্লাহ’ (قَطِيْنُ اللهِ) ‘আহ্লুল্লাহ’ (أَهْلُ اللهِ) এবং ‘আল্লাহর ঘরের বাসিন্দা’ (أَهْلُ بَيْتِ اللهِ) বলে দাবী করত’।[1] সেকারণ তারা মুযদালিফায় হজ্জ করত, আরাফাতের ময়দানে নয়। কেননা মুযদালিফা ছিল হারামের অন্তর্ভুক্ত এবং আরাফাত ছিল হারাম এলাকার বাইরে। যেখানে বহিরাগত হাজীরা অবস্থান করত। ইসলাম আসার পর এই প্রথা নিষিদ্ধ করা হয় এবং সকলকে আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করতে বলা হয় (বাক্বারাহ ২/১৯৯)।


তারা হজ্জের মাস সমূহে ওমরাহ করাকে ‘সবচাইতে নিকৃষ্ট কাজ’ (أَفْجَرُ الْفُجُوْر) বলে ধারণা করত। তারা কা‘বাগৃহে ইবাদতের সময় শিস দিত ও তালি বাজাতো (আনফাল ৮/৩৫)। তারা আল্লাহর নাম ও গুণাবলীতে পরিবর্তন এনেছিল (আ‘রাফ ৭/১৮০)। তারা জিনদেরকে আল্লাহর শরীক নির্ধারণ করেছিল (আন‘আম ৬/১০০) এবং ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর কন্যা বলত (নাহল ১৬/৫৭)। তারা তাকদীরকে এবং কিয়ামতকে অস্বীকার করত (আন‘আম ৬/১৪৮; নাহল ১৬/৩৮)। তারা ইবাদত করত, কুরবানী করত বা মানত করত আখেরাতে মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে নয়, বরং দুনিয়াবী স্বার্থ হাছিলের জন্য। তারা মৃত্যু ও অন্য বিপদাপদকে আল্লাহর দিকে নয় বরং প্রকৃতির দিকে সম্বন্ধ করত (জাছিয়াহ ৪৫/২৩)। তারা মূর্তির সম্মানে কুরবানী চালু করেছিল (মায়েদাহ ৫/৩)। লাত ও ‘উযযার নামে কসম করত এবং নক্ষত্রের মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করত’ (বুখারী হা/৩৮৫০)।


আরবদের বিশ্বাস ছিল যে, প্রতি ১৩ দিন পর একটি নক্ষত্র পশ্চিমে অস্ত যায় এবং একই সাথে পূর্ব দিকে একটি নক্ষত্র উদিত হয়। তাদের বিশ্বাস মতে উক্ত নক্ষত্র অস্ত যাওয়ার সময় অবশ্যই বৃষ্টি হয় অথবা ঠান্ডা হাওয়া প্রবাহিত হয়। সেকারণ বৃষ্টি হ’লে তারা উক্ত নক্ষত্রের দিকে সম্বন্ধ করে বলত,مُطِرْنَا بِنَوْءٍ كَذَا ‘আমরা উক্ত নক্ষত্রের কারণে বৃষ্টি প্রাপ্ত হয়েছি’।[2] আল্লাহর হুকুমে যে বৃষ্টি হয় এটা তারা বিশ্বাস করত না। এভাবে তারা তাওহীদ বিশ্বাস থেকে বহু দূরে চলে গিয়েছিল। অথচ এটাই ছিল তাদের পিতা ইবরাহীমের মূল দাওয়াত।


তাদের চরিত্রে ও রীতি-নীতিতে এমন বহু কিছু ছিল যা ইসলামকে ধসিয়ে দিত। যেমন বংশগৌরব করা ও অন্য বংশকে তাচ্ছিল্য করা। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, أَرْبَعٌ فِى أُمَّتِى مِنْ أَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ لاَ يَتْرُكُونَهُنَّ الْفَخْرُ فِى الأَحْسَابِ وَالطَّعْنُ فِى الأَنْسَابِ وَالاِسْتِسْقَاءُ بِالنُّجُوْمِ وَالنِّيَاحَةُ ‘আমার উম্মতের মধ্যে চারটি বস্ত্ত রয়েছে জাহেলিয়াতের অংশ, যা তারা ছাড়েনি। আভিজাত্য গৌরব, বংশের নামে তাচ্ছিল্য করা, নক্ষত্রের মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করা এবং শোক করা’।[3] জাহেলী যুগের অন্যতম রীতি ছিল, পিতা-মাতার কাজের উপর বড়াই করা, মাসজিদুল হারামের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে গর্ব করা (তওবা ৯/১৯, ৫৫)। ধনশালী ব্যক্তিদের সম্মানিত মনে করা (যুখরুফ ৪৩/৩১) এবং দরিদ্র ও দুর্বল শ্রেণীকে হীন মনে করা (আন‘আম ৬/৫২)। যেকোন কাজে শুভাশুভ নির্ধারণ করা ও ভাগ্য গণনা করা (জিন ৭২/৬) ইত্যাদি।


পক্ষান্তরে অনেক জাহেলী কবির মধ্যে তাওহীদের আক্বীদা ছিল। যেমন মু‘আল্লাক্বা খ্যাত কবি যুহায়ের বিন আবী সুলমা ও কবি লাবীদ বিন রাবী‘আহ প্রমুখ।[4] কা‘বাগৃহে হজ্জ জারী ছিল। হারামের মাসগুলির পবিত্রতা বজায় ছিল। অদৃষ্টবাদের আধিক্য থাকলেও তাদের মধ্যে ক্বাযা ও ক্বদরের আক্বীদা মওজুদ ছিল। ইবরাহীমী দ্বীনের শিক্ষা ও ইবাদতের কিছু নমুনা মক্কা ও তার আশপাশে জাগরুক ছিল। তাদের মধ্যে সততা, বিশ্বস্ততা, সাহসিকতা, আতিথেয়তা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা প্রভৃতি অনন্য গুণাবলী অক্ষুণ্ণ ছিল।


[1]. তিরমিযী হা/৮৮৪; ইবনু হিশাম ১/৫৭; বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত ২/১২৬; ‘হুম্স’ অর্থ কঠোর ধার্মিক। ‘ক্বাত্বীনুল্লাহ’ ও ‘আহলু বায়তিল্লাহ’ অর্থ আল্লাহ্র ঘরের বাসিন্দা। ‘আহলুল্লাহ’ অর্থ আল্লাহওয়ালা।

[2]. মুসলিম হা/৭১; বুখারী হা/৮৪৬; মিশকাত হা/৪৫৯৬।

[3]. বুখারী, ফৎহসহ হা/৩৮৫০, ৭/১৫৬; মুসলিম হা/৯৩৪।

[4]. কবি যুহায়ের বলেন,


فَلاَ تَكْتُمُنَّ اللهَ مَا فِي نُفُوسِكُمْ + لِيَخْفَى وَمَهْمَا يُكْتَمِ اللهُ يَعْلَمِ

يُؤَخَّرْ فَيُوضَعْ فِي كِتَابٍ فَيُدَّخَرْ + لِيَوْمِ الحِسَابِ أَوْ يُعَجَّلْ فَيُنْقَمِ

‘অতএব (হে পরস্পরে সন্ধিকারী বনু ‘আবাস ও যুবিয়ান!) তোমাদের অন্তরে যা রয়েছে তা আল্লাহ থেকে অবশ্যই গোপন করো না। কেননা যখনই তোমরা আল্লাহ থেকে গোপন করবে, তখনই তিনি তা জেনে যাবেন’। ‘অতঃপর তিনি সেটাকে পিছিয়ে দিবেন এবং আমলনামায় রেখে বিচার দিবসের জন্য জমা রাখবেন। অথবা দ্রুত করা হবে এবং প্রতিশোধ নেওয়া হবে’ (মু‘আল্লাক্বা যুহায়ের বিন আবী সুলমা ২৭ ও ২৮ লাইন)। কবি লাবীদ বলেন, أَلاَ كلُّ شَيْء مَا خَلا اللهَ بَاطِلُ + وَكُلُّ نَعِيْمٍ لاَ مُحَالَةَ زَائِلُ ‘মনে রেখ, আল্লাহ ব্যতীত সকল বস্ত্তই বাতিল’ এবং সকল নে‘মত অবশ্যই বিদূরিত হবে’। তবে লাইনের দ্বিতীয় অংশটি লাবীদের নয় বলে অনেকে মত প্রকাশ করেন (দীওয়ানে লাবীদ; সিলসিলা যঈফাহ হা/৬৫০০; প্রথমাংশটি বুখারী হা/৩৮৪১; মুসলিম হা/২২৫৬; মিশকাত হা/৪৭৮৬)।


সামাজিক অবস্থা (الحالة الاجةماعية)

(ক) গোত্রীয় সমাজ ব্যবস্থা (المجتمع القبائلى) : আরবদের সামাজিক ব্যবস্থা ছিল গোত্রপ্রধান। যার কারণে বংশীয় ও আত্মীয়তার সম্পর্ককে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হ’ত। মারামারি ও হানাহানিতে জর্জরিত উক্ত সমাজে কেবল গোত্রীয় ঐক্যের সুদৃঢ় বন্ধনের উপর নির্ভর করেই তাদের টিকে থাকতে হ’ত। ন্যায়-অন্যায় সবকিছু নির্ণীত হ’ত গোত্রীয় স্বার্থের নিরিখে। আজকালকের কথিত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সমাজব্যবস্থায় যে উৎকট দলতন্ত্র আমরা লক্ষ্য করছি, তা জাহেলী আরবের গোত্রীয় সমাজব্যবস্থার সঙ্গে অনেকটা তুলনীয়। বরং অনেক ক্ষেত্রে তাদের চাইতে নিম্নতর অবস্থায় পৌঁছে গেছে। গোত্র সমূহের মধ্যে প্রায়ই যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগে থাকত। সেকারণ তারা অধিক সংখ্যায় পুত্র সন্তান কামনা করত। অধিক সংখ্যক ভাই ও পুত্র সন্তানের মালিককে সবাই সমীহ করত। যুদ্ধে পরাজিত হ’লে অন্যান্য সম্পদের সাথে নারীদের লুট করে নিয়ে যাওয়ার ভয়ে অথবা দরিদ্রতার কারণে অনেকে তাদের কন্যাসন্তানকে শিশুকালেই হত্যা করে ফেলত। তাদের কোন গোত্রীয় আর্থিক রিজার্ভ ছিল না। যুদ্ধ শুরু হ’লে সবাই প্রয়োজনীয় ফান্ড গোত্রনেতার কাছে জমা দিত ও তা দিয়ে যুদ্ধের খরচ মেটাত। তবে পূর্ব থেকে ধর্মীয় রীতি চলে আসার কারণে তারা বছরে চারটি সম্মানিত মাসে (যুল-ক্বা‘দাহ, যুলহিজ্জাহ, মুহাররম ও রজব) যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ রাখতো। এটা ছিল তাদের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি ধর্মীয় রক্ষাকবচ। গোত্রনেতাগণ একত্রে বসে সামাজিক শান্তি ও শৃংখলা রক্ষা করা, কোন গোত্রের সাথে যুদ্ধ শুরু বা শেষ করা কিংবা সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতেন। মক্কার ‘দারুন নাদওয়া’(دار الندوة) ছিল এজন্য বিখ্যাত।[1] তাদের মধ্যে মদ্যপানের ব্যাপক প্রচলন ছিল। যুদ্ধ ও পেশীশক্তিই ছিল বিজয় লাভের মানদন্ড। আরবের সামাজিক অবস্থাকে এক কথায় বলতে গেলে Might is Right তথা ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিতে পরিচালিত হ’ত। আজকের বিশ্ব ব্যবস্থা তার চাইতে মোটেও উন্নত নয়। পাঁচটি ‘ভেটো’ ক্ষমতাধারী রাষ্ট্রই বলতে গেলে বিশ্ব শাসন করছে।


(খ) অর্থনৈতিক অবস্থা (الاقتصاد) : ব্যবসা ছিল তাদের প্রধান অবলম্বন। ত্বায়েফ, সিরিয়া, ইয়ামন প্রভৃতি উর্বর ও উন্নত এলাকা ছাড়াও সর্বত্র পশু-পালন জনগণের অন্যতম প্রধান অবলম্বন ছিল। উট ছিল বিশেষ করে দূরপাল্লার সফরের জন্য একমাত্র স্থল পরিবহন। গাধা, খচ্চর মূলতঃ স্থানীয় পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত হ’ত। ঘোড়া ছিল যুদ্ধের বাহন। মক্কার ব্যবসায়ীরা শীতকালে ইয়ামনে ও গ্রীষ্মকালে সিরিয়ায় দূরপাল্লার ব্যবসায়িক সফর করত। আর্থিক লেনদেনে সূদের প্রচলন ছিল। তারা চক্রবৃদ্ধি হারে পরস্পরকে সূদভিত্তিক ঋণ দিত। রাস্তা-ঘাটে প্রায়ই ব্যবসায়ী কাফেলা লুট হ’ত। সেজন্য সশস্ত্র যোদ্ধাদল নিয়ে তারা রওয়ানা হ’ত। তবে কা‘বাগৃহের খাদেম হওয়ার সুবাদে মক্কার ব্যবসায়ী কাফেলা বিশেষভাবে সম্মানিত ছিল এবং সর্বত্র নিরাপদ থাকত। বছরের আট মাস লুটতরাজের ভয় থাকলেও হারামের চার মাসে তারা নিশ্চিন্তে ব্যবসা করত। এই সময় ওকায, যুল-মাজায, যুল-মাজান্নাহ প্রভৃতি বড় বড় বাজারে বাণিজ্যমেলা ছাড়াও আরবের বিভিন্ন প্রান্তে আরও অনেকগুলি বড় বড় মেলা বসত। এইসব বাণিজ্য মেলায় প্রচুর বেচাকেনার মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা লাভবান হ’ত। তাদের মধ্যে বস্ত্র, চর্ম ও ধাতব শিল্পের প্রচলন ছিল। ইয়ামন, হীরা, সিরিয়া প্রভৃতি অঞ্চল এইসব শিল্পে সমৃদ্ধ ছিল। তবে গৃহের আঙিনায় বসে সূতা কাটার কাজে অধিকাংশ আরব মহিলা নিয়োজিত থাকতেন। কোন কোন এলাকায় কৃষিকাজ হ’ত। ছোলা, ভুট্টা, যব ও আঙ্গুরের চাষ হ’ত। মক্কা-মদীনায় গমের আবাদ ছিল না। মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর খেলাফতকালে প্রথম সিরিয়া থেকে মদীনায় গম রফতানী হয়। খেজুর বাগান ব্যাপক হারে দেখা যেত। খেজুর ছিল তাদের অন্যতম প্রধান উপজীবিকা।


তাদের কোন গোত্রীয় অর্থনৈতিক ফান্ড ছিল না। সেকারণ সমাজের লোকদের দারিদ্র্য ও রোগ-ব্যধি দূরীকরণে ও স্বাস্থ্যসেবার কোন সমন্বিত কর্মসূচী ও কর্মপরিকল্পনা তাদের ছিল না। ফলে পারস্পরিক দান ও বদান্যতার উপরেই তাদের নির্ভর করতে হ’ত। নিখাদ পুঁজিবাদী অর্থনীতি চালু ছিল। যার ফলে সমাজে একদল উচ্চবিত্ত থাকলেও অধিকাংশ লোক ছিল বিত্তহীন। সাধারণ অবস্থা ছিল এই যে, আরবদের সহায়-সম্পদ তাদের জীবনমান উন্নয়নে ব্যয়িত না হয়ে সিংহভাগই ব্যয়িত হ’ত যুদ্ধ-বিগ্রহের পিছনে। ফলে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। আরবীয় সমাজে উচ্চবিত্ত লোকদের মধ্যে মদ-জুয়া ইত্যাদির ব্যাপক প্রচলন ছিল। সেখানে বিত্তহীনরা দাস ও দাসীরূপে বিক্রয় হ’ত ও মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হ’ত।


কুরায়েশরা পরস্পরে ব্যবসায়ে জড়িত ছিল। হাশেম বিন ‘আব্দে মানাফ গোত্রনেতাদের মধ্যে এই পারস্পরিক ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। যা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আবির্ভাবকালীন সময় পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। যাকে ‘ঈলাফ’ (إيلاف) বলা হয়। যারা শীতকালে ইয়ামনে ও গ্রীষ্মকালে শামে ব্যবসায়িক সফর করত। একথাটিই কুরআনে এসেছে সূরা কুরায়েশ-এ। তারা সমুদ্র পথে চীন ও হিন্দুস্থানেও ব্যবসা করত।


হাশেম বিন ‘আব্দে মানাফ তৎকালীন দুই বিশ্বশক্তি রোম ও পারস্য সম্রাটদের সাথে চুক্তিক্রমে তাদের দেশেও ব্যবসা পরিচালনা করেন। এভাবে মক্কার অর্থনীতির ভিত গড়ে ওঠে ব্যবসার উপরে। অস্ত্র শিল্প ও আসবাবপত্র শিল্প ব্যতীত তেমন কোন শিল্প তাদের মধ্যে ছিল না। অর্থনীতির অন্য একটি ভিত্তি ছিল পশু পালন। যা ছিল আপামর জনসাধারণের নাগালের মধ্যে। ব্যবসায়ী নেতারা সূদের ভিত্তিতে ঋণদান করত। ফলে সেখানে ধনী ও গরীবের মধ্যে পাহাড় প্রমাণ বৈষম্য সৃষ্টি হয়। মুষ্টিমেয় ধনিক শ্রেণী বিলাস-ব্যসনের মধ্যে বসবাস করলেও মক্কায় অধিকাংশ অধিবাসী ছিল নিম্নবিত্ত বা বিত্তহীন। মক্কার নেতৃবৃন্দ ও ব্যবসায়ীগণ সারা আরবে সম্মানিত ছিলেন। কা‘বাগৃহের কারণে তাদের মর্যাদা সর্বত্র সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। সেই সাথে মক্কা ছিল সর্বদা বহিঃশক্তির হামলা থেকে সুরক্ষিত।


(গ) নারীদের অবস্থা (حالة النساء) : তৎকালীন আরবে বিভিন্ন শ্রেণীর লোকজন বসবাস করত। সেখানকার অভিজাত শ্রেণীর লোকদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে খুবই উন্নত ছিল। পরিবারে পুরুষ ও মহিলাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল মর্যাদা ও ন্যায়ভিত্তিক ব্যবস্থার উপরে প্রতিষ্ঠিত। অভিজাত পরিবারের মহিলাদের মান-সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখার ব্যাপারে সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখা হ’ত। তাদের মর্যাদা হানিকর কোন অবস্থার উদ্ভব ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে তরবারি কোষমুক্ত হয়ে যেত। মহিলাদের মর্যাদা এতই উঁচুতে ছিল যে, বিবদমান গোত্রগুলিকে একত্রিত করে সন্ধিচুক্তি সম্পাদনেও তারা সক্ষম হ’ত। পক্ষান্তরে তাদের উত্তেজিত বক্তব্যে ও কাব্য-গাথায় যেকোন সময় দুই গোত্রের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারত। ওহোদের যুদ্ধে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা তার সাথী মহিলাদের নিয়ে মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে একাজটিই করেছিলেন। তাদের মধ্যে বিবাহ পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত উঁচু মানের। উভয় পক্ষের অভিভাবকগণের সম্মতি ও কনের স্বীকৃতি লাভের পর বর কনেকে নির্ধারিত মোহরানার বিনিময়ে বিয়ে করতে পারত। বিয়েতে ও সন্তানের আকীকাতে সমাজনেতাদের দাওয়াত দিয়ে ধুমধামের সাথে অনুষ্ঠান করা তাদের সামাজিক রেওয়াজ ছিল।


সাধারণ ও দরিদ্র শ্রেণীর আরবদের মধ্যে চার ধরনের বিবাহ চালু ছিল। এক ধরনের ছিল অভিজাত শ্রেণীর মত পারস্পরিক সম্মতি ও মোহরানার বিনিময়ে বিবাহ পদ্ধতি। কিন্তু বাকী তিনটি পদ্ধতিকে বিবাহ না বলে স্পষ্ট ব্যভিচার বলা উচিত। যা ভারতীয় হিন্দু সমাজে রাক্ষস বিবাহ, গান্ধর্ব্য বিবাহ ইত্যাদি নামে আধুনিক যুগেও চালু আছে বলে জানা যায়। আরবীয় সমাজে স্বাধীনা ও দাসী দু’ধরনের নারী ছিল। স্বাধীনাগণ ছিলেন সম্মানিত। কিন্তু দাসীরা বাজার-ঘাটে বিক্রয় হ’ত। মনিবের দাসীবৃত্তিই ছিল তাদের প্রধান কাজ।


(ঘ) নৈতিক অবস্থা (الأخلاق) : উদার মরুচারী আরবদের মধ্যে নৈতিকতার ক্ষেত্রে দু’টি ধারা একত্রে পরিলক্ষিত হ’ত। একদিকে যেমন তাদের মধ্যে মদ্যপান, ব্যভিচার, মারামারি ও হানাহানি লেগে থাকত। অন্যদিকে তেমনি দয়া, উদারতা, সততা, পৌরুষ, সৎসাহস, ব্যক্তিত্ববোধ, সরলতা ও অনাড়ম্বরতা, দানশীলতা, আমানতদারী, মেহমানদারী, প্রতিজ্ঞা পরায়ণতা ইত্যাদি সদগুণাবলীর সমাবেশ দেখা যেত। তাদের মধ্যে দুঃসাহসিকতা ও বেপরোয়া ভাবটা ছিল তুলনামূলকভাবে বেশী। তাদের মধ্যে যেমন অসংখ্য দোষ-ত্রুটি ছিল, তেমনি ছিল অনন্যসাধারণ গুণাবলী, যা অন্যত্র কদাচিৎ পাওয়া যেত। তাদের সৎসাহস, আমানতদারী, সত্যবাদিতা, কাব্য প্রতিভা, স্মৃতিশক্তি, অতিথিপরায়ণতা ছিল কিংবদন্তীর মত। তাদের কাব্যপ্রিয়তা এবং উন্নত কাব্যালংকারের কাছে আধুনিক যুগের আরবী কবি-সাহিত্যিকরা বলতে গেলে কিছুই নয়। তাদের স্মৃতিশক্তি এত প্রখর ছিল যে, একবার শুনলেই হুবহু মুখস্থ বলে দিত। বড় বড় ক্বাছীদা বা দীর্ঘ কবিতাগুলি তাদের মুখে মুখেই চালু ছিল। লেখাকে এজন্য তারা নিজেদের জন্য হীনকর মনে করত। দুর্বল স্মৃতির কারণে আজকের বিশ্ব লেখাকেই অধিক গুরুত্ব দেয়। অথচ লেখায় ভুল হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তৎকালীন আরবদের স্মৃতিতে ভুল কদাচিৎ হ’ত। সম্ভবতঃ এই সব সদগুণাবলীর কারণেই বিশ্বনবীকে আল্লাহ মক্কাতে প্রেরণ করেন। যাদের প্রখর স্মৃতিতে কুরআন ও হাদীছ অবিকৃত অবস্থায় নিরাপদ থাকে এবং পরবর্তীতে তা লিখিত আকারে সারা বিশ্বে প্রচারিত হয়। যদিও কুরআন ও হাদীছ লিখিতভাবেও তখন সংকলিত হয়েছিল।


উপরের আলোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল আরব ভূখন্ডের মরুচারী মানুষেরা বিভিন্ন দুর্বলতার অধিকারী হ’লেও তাদের মধ্যে উন্নত মানবিক গুণাবলীর বিকাশ ঈর্ষণীয়ভাবে পরিদৃষ্ট হ’ত। আদি পিতা-মাতা আদম ও হাওয়ার অবতরণস্থল হওয়ার কারণে এই ভূখন্ড থেকেই মানব সভ্যতা ক্রমে পৃথিবীর অন্যান্য ভূখন্ডে বিস্তার লাভ করেছে। এই ভূখন্ডে আরাফাত-এর না‘মান উপত্যকায় সৃষ্টির সূচনায় আল্লাহ পাক সমস্ত মানবকুলের নিকট হ’তে তাঁর প্রভুত্বের স্বীকৃতি ও তাঁর প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেন।[2] যা ‘আহ্দে আলাস্ত্ত’ নামে খ্যাত। একই সাথে তিনি সকল নবীর কাছ থেকে শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর উপরে ঈমান আনা ও তাঁকে সর্বতোভাবে সহযোগিতার অঙ্গীকার নেন (আলে ইমরান ৩/৮১)।


এই ভূখন্ডেই হাযার হাযার নবী ও রাসূলের আগমন ঘটেছে। এই ভূখন্ডেই আল্লাহর ঘর কা‘বাগৃহ এবং বায়তুল মুক্বাদ্দাস অবস্থিত। এই ভূখন্ড বাণিজ্যিক কারণে সারা বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। জান্নাতের ভাষা আরবী এই ভূখন্ডের কথিত ও প্রচলিত ভাষা ছিল। সহজ-সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা, প্রখর স্মৃতিশক্তি এবং সততা ও আমানতদারীর অনুপম গুণাবলীর প্রেক্ষাপটে আরবভূমির কেন্দ্রবিন্দু মক্কাভূমির অভিজাত বংশ কা‘বাগৃহের তত্ত্বাবধায়ক ও রক্ষণাবেক্ষণকারীদের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর নিকটেই আল্লাহ মানবজাতির কল্যাণে প্রেরিত সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠতম নে‘মত কুরআন ও সুন্নাহর পবিত্র আমানত সমর্পণ করেন। ফালিল্লা-হিল হাম্দ ওয়াল মিন্নাহ।


[1]. ‘দারুন নাদওয়া’ ছিল হারাম সংলগ্ন কুছাই বিন কেলাবের বাড়ী। বর্তমানে এটি মাসজিদুল হারামের মধ্যে শামিল হয়ে গেছে।

[2]. আ‘রাফ ৭/১৭২-১৭৩; আহমাদ হা/২৪৫৫; মিশকাত হা/১২১ ‘ঈমান’ অধ্যায় ‘তাক্বদীরে বিশ্বাস’ অনুচ্ছেদ।



শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ -১ (العبر-১)


(১) বিশ্বনবী ও শেষনবী হবার কারণেই বিশ্বকেন্দ্র মক্কাতে মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে প্রেরণ করা হয়।

(২) সারা বিশ্বে তাওহীদের দাওয়াত দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তৎকালীন বিশ্বের সেরা বাণিজ্য কেন্দ্র ও যোগাযোগ কেন্দ্র আরব ভূখন্ডে শেষনবী প্রেরিত হন।

(৩) জান্নাতের ভাষা আরবী। আর সেই ভাষাতেই কুরআন নাযিল হয়েছে। তাই আল্লাহর ঘরের তত্ত্বাবধায়ক শুদ্ধভাষী আরব তথা কুরায়েশ বংশে শেষনবীর আগমন ঘটে। যাতে তিনি জান্নাতী ভাষায় মানবজাতিকে তার মূল আবাস জান্নাতের পথে আহবান জানাতে পারেন।

(৪) আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র সে যুগে ছিল না। তাই প্রখর স্মৃতিধর আরবদের নিকটেই কুরআন ও সুন্নাহর অমূল্য নে‘মত সংরক্ষণের আমানত সোপর্দ করা হয়।

(৫) আরবরা ছিল আজন্ম স্বাধীন ও বীরের জাতি। সেকারণ বলা চলে যে, তৎকালীন রোমক ও পারসিক পরাশক্তির মুকাবিলায় ইসলামী খেলাফতের সফল বাস্তবায়নের জন্য শেষনবীর আগমনস্থল ও কর্মস্থল হিসাবে আরব ভূখন্ডকে বেছে নেওয়া হয়।


মক্কা ও ইসমাঈল বংশ (مكة وذرية اسماعيل)

মক্কায় প্রথম অধিবাসী ছিলেন মা হাজেরা ও তাঁর সন্তান ইসমাঈল। পরে সেখানে আসেন ইয়ামন থেকে ব্যবসায়ী কাফেলা বনু জুরহুম। তারা হাজেরার অনুমতিক্রমে যমযম কূপের পাশে বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে ইসমাঈল তাদের বংশে বিয়ে করেন। অতঃপর ইবরাহীম ও ইসমাঈলের হাতে কা‘বাগৃহ নির্মিত হয়। অতঃপর ইসমাঈলের বংশধরগণই মক্কাভূমি ও পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহ আবাদ করেন। তাদের মাধ্যমেই সর্বত্র তাওহীদের দাওয়াত ছড়িয়ে পড়ে।

ইসমাঈল (আঃ) আজীবন স্বীয় বংশের নবী ও শাসক ছিলেন। তাঁর পরে তাঁর পুত্র ও বংশধরগণই মক্কা ও পার্শ্ববর্তী এলাকা শাসন করেন এবং কা‘বাগৃহের তত্ত্বাবধানের পবিত্র দায়িত্ব পালন করেন।


ইসমাঈল-পুত্র নাবেত (نَابِت)-এর বংশধরগণ উত্তর হেজায শাসন করেন। তাদের বংশধর ছিলেন ইয়াছরিবের আউস ও খাযরাজ গোত্র। ইসমাঈলের অন্য পুত্র ক্বায়দার (قيدار)-এর বংশধরগণ মক্কায় বসবাস করেন এবং পরবর্তীতে তাদেরই অন্যতম বিখ্যাত নেতা ছিলেন ‘আদনান (عَدنان)। যিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ২১তম ঊর্ধ্বতন পুরুষ।[1]


[1]. ইবনু হিশাম ১/১-২; ছফিউর রহমান মুবারকপুরী (১৩৬২-১৪২৭ হিঃ/১৯৪২-২০০৬ খৃঃ), আর-রাহীকুল মাখতূম (কুয়েত : ২য় সংস্করণ ১৪১৬/১৯৯৬ খৃঃ) পৃঃ ৪৮।


মক্কার অবস্থান (موضع مكة)

মক্কাকে পৃথিবীর নাভিস্থল (وَسَطُ الْأَرْضِ) বলা হয়। কুরআনে একে ‘উম্মুল ক্বোরা’ (أُمُّ الْقُرَى) বা ‘আদি জনপদ’ বলা হয়েছে (আন‘আম ৬/৯২; শূরা ৪২/৭)। مَكَّة অর্থ ধ্বংসকারী। مَكَّ يَمُكُّ مَكًّا অর্থ ধ্বংস করা। মক্কাকে মক্কা বলার কারণ দু’টি। এক- জাহেলী যুগে এখানে কোন যুলুম ও অনাচার টিকতে পারতনা। যেই-ই কোন যুলুম করত, সেই-ই ধ্বংস হয়ে যেত। এজন্য এর অন্য একটি নাম ছিল ‘না-সসাহ’ (النَّاسَّةَ) অর্থ বিতাড়নকারী, বিশুদ্ধকারী। কোন রাজা-বাদশা যখনই একে ধ্বংস করতে গিয়েছে, সেই-ই ধ্বংস হয়েছে। এর অন্য একটি নাম হ’ল বাক্কা (بَكَّةٌ)। যার দু’টি অর্থ রয়েছে। এক- بَكَّ يَبُكُّ بَكًّا اى كَسَرَ ভেঙ্গে দেওয়া। সেকারণেই বলা হয়, لِأَنَّهَا تَبُكُّ أَعْنَاقَ الْجَبَابِرَةِ إذَا أَحْدَثُوا فِيْهَا شَيْئًا ‘এটি প্রতাপশালী অহংকারীদের ঘাড় মটকিয়ে দেয়, যখন তারা এখানে কিছু অঘটন ঘটাতে চায়’। দুই- এর অর্থ اِزْدَحَمَ ভিড় করা ও কান্নাকাটি করা। কেননা মানুষ এখানে এসে জমা হয় এবং আল্লাহর নিকট কান্নাকাটি করে’ (ইবনু হিশাম ১/১১৪)।


জাহেলী যুগে হামলাকারী কাফের নেতা ইয়ামনের খ্রিষ্টান গভর্ণর আবরাহাকে আল্লাহ সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস করেছেন। কিন্তু ইসলামী যুগে মুসলিম যালেমদের আল্লাহ সাথে সাথে ধ্বংস করেননি তাদের ঈমানের কারণে। তাদের কঠিন শাস্তি পরকালে হবে, যদি নাকি তারা তওবা না করে মৃত্যুবরণ করে। আজও যদি কোন কাফের শক্তি কা‘বা ধ্বংস করতে চায়, সে আল্লাহর গযবে সাথে সাথেই ধ্বংস হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। যেমন আল্লাহ বলেন, أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّا جَعَلْنَا حَرَمًا آمِنًا وَيُتَخَطَّفُ النَّاسُ مِنْ حَوْلِهِمْ ‘তারা কি দেখেনা যে, আমরা হারামকে নিরাপদ করেছি। অথচ তাদের চতুষ্পার্শ্বে যারা আছে তারা উৎখাত হয়’ (আনকাবূত ২৯/৬৭)। তিনি আরও বলেন, وَمَنْ يُرِدْ فِيْهِ بِإِلْحَادٍ بِظُلْمٍ نُذِقْهُ مِنْ عَذَابٍ أَلِيْمٍ ‘যে ব্যক্তি এখানে (হারামে) সীমালংঘনের মাধ্যমে পাপকার্যের সংকল্প করে, আমরা তাকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাবো’ (হজ্জ ২২/২৫)।[1]


চারপাশে পাহাড় ঘেরা উপত্যকায় অবস্থিত মক্কা নগরী। পূর্ব দিকে আবু কুবাইস (أبو قُبَيس) পাহাড় এবং পশ্চিম দিকে কু‘আইক্বা‘আন (قُعَيْقَعان) পাহাড় নতুন চাঁদের মত মক্কাকে বেষ্টন করে রেখেছে। এর নিম্নভূমিতে কা‘বাগৃহ অবস্থিত। যার চারপাশে কুরায়েশদের জনবসতি। নবচন্দ্রের দুই কিনারায় গরীব বেদুঈনদের আবাসভূমি। যারা যুদ্ধ-বিগ্রহে পটু ছিল।


কুরায়েশ বংশ কিনানাহর দিকে সম্পর্কিত। যারা মক্কার অনতিদূরে বসবাস করত। এভাবে এখানকার অধিবাসীরা পরস্পরে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ থাকায় মক্কা একটি সুরক্ষিত দুর্গের শহরে পরিণত হয়। সেকারণ মক্কায় আগত কাফেলা সমূহ সর্বদা নিরাপদ থাকত।


[1]. এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা দ্রষ্টব্য : লেখক প্রণীত তাফসীরুল কুরআন ৩০তম পারা, সূরা ফীল, শিরোনাম : ‘সংশয় নিরসন’ পৃঃ ৪৮৯-৯০।


মক্কার সামাজিক অবস্থা (مجتمع مكة)

খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর প্রথমভাগে কুছাই বিন কিলাব কুরায়েশ গোত্রনেতাদের জমা করে সমাজ ব্যবস্থাপনার একটা ভিত্তি দান করেন। অতঃপর হারামের আশ-পাশের গাছ-গাছালি কেটে সেখানে পাথর দিয়ে বাড়ী-ঘর তৈরীর সূচনা করেন। যা মক্কাকে একটি নগরীর রূপ দান করে। ইতিপূর্বে এখানকার বৃক্ষ সমূহকে অতি পবিত্র মনে করা হ’ত এবং তা কখনোই কাটা হ’ত না। কুছাই ছিলেন প্রথম নেতা, যিনি এখানকার বৃক্ষ কর্তন শুরু করেন। অতঃপর তিনি তার সন্তানদের নগরীর ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন দায়িত্ব প্রদান করেন। যেমন হিজাবাহ (الْحِجَابَةُ) অর্থ কা‘বা গৃহের তত্ত্বাবধান। সিক্বায়াহ (السِّقَايَةُ) অর্থ হাজীদের জন্য পানি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন। রিফাদাহ (الرِّفَادَةُ) অর্থ হাজীদের আপ্যায়ন ও মেহমানদারী। এজন্য সকল গোত্রের নিকট থেকে নির্দিষ্টহারে চাঁদা নেওয়া হ’ত। যা দিয়ে অভাবগ্রস্ত হাজীদের আপ্যায়ন করা হ’ত। লেওয়া (اللِّوَاءُ) অর্থ যুদ্ধের পতাকা বহন করা। নাদওয়া (النَّدْوَةُ) অর্থ পরামর্শ সভা। যেখানে বসে পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সমাজের সমস্যাবলীর সুষ্ঠু সমাধান করা হ’ত এবং সামাজিক ঐক্য বজায় রাখা হ’ত। কুছাই নিজেই এর দায়িত্বে ছিলেন এবং তিনি এর দরজাটি কা‘বামুখী করেন। বস্ত্ততঃপক্ষে দারুন নাদওয়া ছিল মক্কা নগররাষ্ট্রের পার্লামেন্ট স্বরূপ। কুছাই বিন কিলাব ছিলেন যার প্রেসিডেন্ট এবং প্রত্যেক গোত্রনেতা ছিলেন যার মন্ত্রীসভার সদস্য। বহিরাগত যেসব ব্যবসায়ী মক্কায় ব্যবসার জন্য আসতেন, কুছাই তাদের কাছ থেকে দশ শতাংশ হারে চাঁদা নির্ধারণ করেন। যা মক্কা নগরীর সমৃদ্ধির অন্যতম উৎসে পরিণত হয়। এভাবে কুছাই মক্কা নগরীকে একটি সুসংবদ্ধ সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ নগরীতে পরিণত করেন। পরবর্তীতেও যা অব্যাহত ছিল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আবির্ভাবকালে মক্কার নেতা ছিলেন তাঁর দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব বিন হাশেম এবং তাঁর মৃত্যুর পরে ছিলেন চাচা আবু ত্বালেব।


যমযম কূয়া ও মক্কার নেতৃত্ব (بئر زمزم وقيادة مكة)

মক্কার প্রধান আকর্ষণ হ’ল যমযম কূয়া ও কা‘বাগৃহ। দু’টিই আল্লাহর অপূর্ব কুদরতের জ্বলন্ত নিদর্শন। যমযম ও কা‘বাগৃহের সেবা ও তত্ত্বাবধান কার্যের মধ্যে যেমন তাদের উচ্চ মর্যাদা নিহিত ছিল, তেমনি উক্ত মর্যাদা লাভের প্রতিযোগিতাই ছিল তাদের মধ্যকার পারস্পরিক রেষারেষি ও হানাহানির অন্যতম প্রধান কারণ।


তৃষিত হাজেরা ও তার দুগ্ধপোষ্য সন্তান ইসমাঈলের স্বার্থে আল্লাহর হুকুমে সেখানে যমযম কূয়ার সৃষ্টি হয় (বুখারী হা/৩৩৬৪)। পরবর্তীতে এই পানিকে কেন্দ্র করেই ইয়ামন থেকে আগত ব্যবসায়ী কাফেলা বনু জুরহুমের মাধ্যমে মক্কায় জনবসতি গড়ে উঠে। এরপর ইবরাহীম ও ইসমাঈলের মাধ্যমে আল্লাহর হুকুমে সেখানে কা‘বাগৃহ নির্মিত হয় (বাক্বারাহ ২/১২৫)। ইসমাঈল তাদের মধ্যে বিবাহ করেন। অতঃপর তাঁর সন্তানেরা বংশ পরম্পরায় যমযম ও কা‘বার মর্যাদাপূর্ণ দায়িত্বে আসীন ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে বনু জুরহুম সেখানে বিপর্যয় সৃষ্টি করে এবং কিছু হারামকে হালাল করে। তারা বহিরাগতদের উপর যুলুম করে। এমনকি কা‘বার উদ্দেশ্যে প্রদত্ত উপঢৌকনাদি ভক্ষণ করে। ফলে আল্লাহ তাদের হাত থেকে দায়িত্ব ছিনিয়ে নেন এবং বনু বকর বিন ‘আবদে মানাত(عبد مناة) বিন কিনানাহ ও গুবশান বিন খোযা‘আহর মাধ্যমে তাদেরকে হটিয়ে দেন। বনু জুরহুম মক্কা থেকে বিতাড়িত হয়ে ইয়ামনে ফিরে যাওয়ার সময় যমযম কূয়া বন্ধ করে দিয়ে যায়। পরবর্তীতে বনু বকরকে হটিয়ে বনু খোয়া‘আহ মক্কার একক ক্ষমতায় আসে এবং তারা কয়েক যুগ ধরে উক্ত মর্যাদায় আসীন থাকে। এ সময় কুরায়েশ বংশ বিচ্ছিন্ন ও বিভক্ত ছিল। পরে তারা কুছাই বিন কিলাবের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং মক্কার ক্ষমতায় আসে। কুছাই ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পরদাদা হাশেমের দাদা। কুছাই খোযা‘আহ গোত্রের শেষ নেতা হুলাইল বিন হুবশিইয়াহ(حُلَيْلُ بْنُ حُبْشِيَّةَ) এর কন্যা হুববা (حُبَّى)-কে বিবাহ করেন বিধায় তারা পরবর্তীতে সর্বদা বনু হাশেমের মিত্র ছিল এবং তারা রাসূল (সাঃ)-কে তাদের ‘ভাগিনার সন্তান’ বলত। তাছাড়া বনু খোযা‘আহ ধারণা করত যে, তাদের নেতা হুলাইল তার জামাতা কুছাইকে পরবর্তী নেতা হিসাবে অছিয়ত করে গেছেন (ইবনু হিশাম ১/১১৩-১৮)। এভাবে মক্কার নেতৃত্বে ছিলেন প্রথমে বনু জুরহুম। অতঃপর বনু খুযা‘আহ। অতঃপর বনু কুরায়েশ। রাসূল (সাঃ)-এর আবির্ভাবকালে কুরায়েশ বংশ মক্কার নেতৃত্বে ছিল। অনুমান করা হয়ে থাকে যে, বনু জুরহুম ২১০০ বছর, বনু খুযা‘আহ ৩০০ বছর মক্কা শাসন করেন। তাদের পর থেকে কুরায়েশ বংশ মক্কা শাসন করে (আর-রাহীক্ব ২৮-২৯)।


পক্ষান্তরে বনু খোযা‘আহর হাতে ইতিপূর্বে বিতাড়িত বনু বকর সর্বদা রাসূল (সাঃ)-এর বিরোধী জোটের মিত্র ছিল। সেকারণ পরবর্তীতে বনু খোযা‘আহর উপর বনু বকরের হামলা ও হত্যাকান্ডের ফলেই হোদায়বিয়ার সন্ধি ভেঙ্গে যায় এবং মক্কা বিজয় ত্বরান্বিত হয়। কুরায়েশ বংশ ছিল বনু ইসমাঈলের শ্রেষ্ঠ শাখা এবং কুরায়েশ বংশের শ্রেষ্ঠ শাখা ছিল বনু হাশেম গোত্র।


আব্দুল মুত্ত্বালিবের স্বপ্ন (رؤيا عبد المطلب)

কুছাইয়ের পর পর্যায়ক্রমে যখন রাসূল (সাঃ)-এর দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব মক্কার নেতা হন। তিনি পরপর চার রাত্রি স্বপ্নে দেখেন যে, এক ব্যক্তি এসে তাঁকে কূয়া খনন করতে বলছে। চতুর্থ রাত্রিতে তাঁকে কূয়ার নাম ‘যমযম’ ও তার স্থান নির্দেশ করে দেওয়া হয়। তখন আব্দুল মুত্ত্বালিব তাঁর একমাত্র পুত্র হারেছকে সাথে নিয়ে স্থানটি খনন করেন। এ সময় তার অন্যকোন পুত্র সন্তান জন্মলাভ করেনি। কুরায়েশদের সকল গোত্র এই মহান কাজে তাঁর সাথে শরীক হ’তে চায়। তারা বলে যে, এটি পিতা ইসমাঈল-এর কূয়া। অতএব এতে আমাদের সবার অধিকার আছে। আব্দুল মুত্ত্বালিব বললেন, স্বপ্নে এটি কেবল আমাকেই খাছভাবে করতে বলা হয়েছে। অতএব আমি তোমাদের দাবী মেনে নিতে পারি না’। তখন ঝগড়া মিটানোর জন্য তারা এক গণৎকার মহিলার কাছে বিচার দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু হেজায ও শামের মধ্যবর্তী উক্ত দূরবর্তী স্থানে পৌঁছার আগেই যখন গোত্রনেতারা পানির সংকটে পড়ে যায় এবং তৃষ্ণায় মৃত্যুর আশংকায় পতিত হয়ে নিজেরা নিজেদের কবর খুঁড়তে শুরু করে, তখন আল্লাহর রহমতে আব্দুল মুত্ত্বালিবের উটের পায়ের তলার মাটি দিয়ে মিষ্ট পানি উথলে ওঠে। যা কওমের সকলে পান করে বেঁচে যায়। এতে তারা কূয়ার উপরে আব্দুল মুত্ত্বালিবের মালিকানা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে যায় এবং তারা সকলে মিলে তার নিকটেই এটি সোপর্দ করে। ঘটনাটি খুবই প্রসিদ্ধ ছিল যা হযরত আলী (রাঃ) হ’তে ‘হাসান’ সনদে ইবনু ইসহাক বর্ণনা করেছেন।[1]


এভাবে পানির মালিকানার সাথে সাথে বনু হাশিমের উচ্চ মর্যাদা ও নেতৃত্ব সকলের অন্তরে দৃঢ় আসন লাভ করে। তারা সবাই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন এবং গণৎকার মহিলার কাছে না গিয়েই ফিরে আসেন। যমযম কূপের মালিকানা নিয়ে আর কখনোই ঝগড়া করবেন না বলে তারা প্রতিজ্ঞা করেন। এরপর থেকে হাজীদের পানি পান করানো (সিক্বায়াহ) ও তাদের খাওয়ানো সহ আপ্যায়ন (রিফাদাহ) করার মর্যাদাপূর্ণ দায়িত্ব স্থায়ীভাবে বনু হাশেম-এর উপর ন্যস্ত হয়। উল্লেখ্য যে, ইতিপূর্বে কুরায়েশগণ কা‘বা থেকে দূরে বিভিন্ন কূপ খনন করে পানির চাহিদা মিটাতেন (ইবনু হিশাম ১/১৪২-৪৭)।


বনু জুরহুম মক্কা ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় যমযম কূয়ায় দু’টি সোনার হরিণ, বর্ম, তরবারি ইত্যাদি ফেলে যায়। অতঃপর উক্ত তরবারি উঠিয়ে আব্দুল মুত্ত্বালিব কা‘বাগৃহের দরজা ঢালাই করেন এবং হরিণ দু’টিকে দরজার সামনে রেখে দেন বলে যে সব কথা চালু আছে, তা বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়।[2]


[1]. ইবনু হিশাম ১/১৪২-৪৫, সনদ জাইয়িদ খবর ছহীহ, তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৪০।

[2]. ইবনু হিশাম ১/১৪৭; বর্ণনাটি যঈফ, তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৪৪; সীরাহ ছহীহাহ ১/৯২; আর-রাহীক্ব ২৮ পৃঃ।


আব্দুল মুত্ত্বালিবের মানত (نذر عبد المطلب)

আল্লাহর হুকুমে যমযম কূয়া খনন ও তার তত্ত্বাবধায়কের উচ্চ মর্যাদা লাভের পর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ আব্দুল মুত্ত্বালিব আল্লাহর নামে মানত করেন যে, যদি আল্লাহ তাঁকে দশটি পুত্রসন্তান দান করেন এবং তারা সবাই বড় হয়ে নিজেদের রক্ষা করার মত বয়স পায়, তাহ’লে তিনি তাদের একজনকে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যবহ করবেন। অতঃপর লটারীতে বারবার আব্দুল্লাহর নাম উঠতে থাকে। অথচ সেই-ই ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয় সন্তান। তখন তিনি বললেন, হে আল্লাহ! সে অথবা একশ’ উট। এরপর লটারীতে পরপর তিনবার একশ’ উট উঠে আসে। তখন তিনি তা দিয়ে মানত পূর্ণ করেন।[1] হাকীম বিন হেযাম (রাঃ) বর্ণিত যঈফ হাদীছে এসেছে যে, এটি ছিল রাসূল (সাঃ) জন্মের পাঁচ বছর পূর্বের ঘটনা’ (হাকেম হা/৬০৪৩, ৩/৫৪৯ পৃঃ)।


উক্ত ঘটনাটি প্রমানিত নয়। তবুও যদি সত্য হয়, তাহ’লে এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, আল্লাহ আব্দুল মুত্ত্বালিবের মানত পরিবর্তনের মাধ্যমে আব্দুল্লাহর ঔরসে তাঁর শেষনবীর জন্মকে নিরাপদ করেছেন। ফালিল্লাহিল হাম্দ। নিঃসন্দেহে আল্লাহর কৌশল বুঝা বান্দার পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। উল্লেখ্য যে,الذَّبِيْحَيْنِ أَنَا اِبْنُ ‘আমি দুই যবীহ-এর সন্তান’ অর্থাৎ যবীহ ইসমাঈল ও যবীহ আব্দুল্লাহর সন্তান’ বলে যে হাদীছ প্রচলিত আছে, তার কোন ভিত্তি নেই(لاَ أَصْلَ لَهُ)।[2]


[1]. ইবনু হিশাম ১/১৫১-৫৫; বর্ণনাটি যঈফ, তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৪৮। ড. আকরাম যিয়া ঘটনাটিকে ইবনু আববাস থেকে ‘ছহীহ’ বলেছেন (সীরাহ ছহীহাহ ১/৯২-৯৩)। কিন্তু সেটি প্রমাণিত হয়নি। কেননা ‘আব্দুল মুত্ত্বালিবের মানত’ শিরোনামে ইবনু ইসহাক বলেন, فِيمَا يَزْعُمُونَ وَاَللهُ أَعْلَمُ ‘যেমন তারা ধারণা করেন। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত’ (ইবনু হিশাম ১/১৫১)। এতেই বুঝা যায়, ঘটনাটি ভিত্তিহীন।

[2]. হাকেম হা/৪০৪৮, ২/৫৫৯; সিলসিলা যঈফাহ হা/৩৩১।


মক্কার ধর্মীয় অবস্থা (الحالة الدينية فى مكة)


কা‘বাগৃহের কারণে মক্কা ছিল সমগ্র আরব ভূখন্ডের ধর্মীয় কেন্দ্রবিন্দু এবং সম্মান ও মর্যাদায় শীর্ষস্থানীয়। সেকারণ খ্রিষ্টান রাজারা এর উপরে দখল কায়েম করার জন্য বারবার চেষ্টা করত। এক সময় ইয়ামনের খ্রিষ্টান নরপতি আবরাহা নিজ রাজধানী ছান‘আতে স্বর্ণ-রৌপ্য দিয়ে কা‘বাগৃহের আদলে একটি সুন্দর গৃহ নির্মাণ করেন এবং সবাইকে সেখানে হজ্জ করার নির্দেশ জারী করেন। কিন্তু জনগণ তাতে সাড়া দেয়নি। বরং কে একজন গিয়ে তার ঐ নকল কা‘বাগৃহে (?) পায়খানা করে আসে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি প্রায় ৬০ হাযার সৈন্য ও হস্তীবাহিনী নিয়ে মক্কায় অভিযান করেন কা‘বাগৃহকে ধ্বংস করার জন্য। অবশেষে আল্লাহর গযবে তিনি নিজে তার সৈন্য-সামন্ত সহ ধ্বংস হয়ে যান। এতে মক্কার সম্মান ও মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পায় এবং এ ঘটনা বণিকদের মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর জন্মের মাত্র ৫০ বা ৫৫ দিন পূর্বে এই অলৌকিক ঘটনা ঘটে। বস্ত্ততঃ এটা ছিল শেষনবীর আগমনের আগাম শুভ সংকেত (الْإِرْهَاصُ) মাত্র। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, উক্ত ঘটনার পরে মক্কাবাসীগণ দশ বছর যাবৎ পূর্ণ তাওহীদবাদী ছিল এবং মূর্তিপূজার শিরক পরিত্যাগ করেছিল’।[1]


সমগ্র আরব উপদ্বীপে মক্কা ছিল বৃহত্তম নগরী এবং মক্কার অধিবাসী ও ব্যবসায়ীদের মর্যাদা ছিল সবার উপরে। হারাম শরীফের উচ্চ মর্যাদার কারণে তাদের মর্যাদা আপামর জনগণের মধ্যে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল যে, চোর-ডাকাতেরাও তাদেরকে সমীহ করত।


এটাই যেখানে বাস্তবতা, সেখানে এই যুগটিকে ‘জাহেলী যুগ’(الْأَيَّامُ الْجَاهِلِيَّةُ) কেন বলা হয়? এর কারণ সম্ভবতঃ এটাই ছিল যে, তারা ইবরাহীম (আঃ)-এর অনুসারী এবং তাওহীদপন্থী হওয়া সত্ত্বেও শিরকে লিপ্ত হয়েছিল। তারা আল্লাহর বিধান সমূহকে অগ্রাহ্য করেছিল এবং খোদ আল্লাহর ঘরেই মূর্তিপূজার মত নিকৃষ্টতম শিরকের প্রবর্তন করেছিল। তারা শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে চিনতে পেরেও তাঁকে অস্বীকার করেছিল। নিঃসন্দেহে এটা ছিল তাদের সবচেয়ে বড় জাহেলিয়াত ও সবচেয়ে বড় মূর্খতা। আর একারণেই ‘জ্ঞানের পিতা’ আবুল হাকাম-কে ‘মূর্খতার পিতা’ আবু জাহল লকব দেওয়া হ’ল।[2] বস্ত্ততঃ ইসলামের বিরোধী যা কিছু, সবই জাহেলিয়াত। আল্লাহ বলেন,أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ ‘তবে কি তারা জাহেলিয়াতের বিচার-ফায়ছালা কামনা করে? অথচ দৃঢ় বিশ্বাসীদের নিকট আল্লাহর চাইতে উত্তম ফায়ছালাকারী আর কে আছে?’ (মায়েদাহ ৫/৫০)। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,مَنْ دَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ فَهُوَ مِنْ جُثَاءِ جَهَنَّمَ ‘যে ব্যক্তি জাহেলিয়াতের দিকে মানুষকে আহবান করে, সে ব্যক্তি জাহান্নামীদের দলভুক্ত’।[3] উল্লেখ্য যে, জাহেলী আরবী সাহিত্যের ইতিহাস ইসলাম আগমনের পূর্বে দেড়শ’ বছরের বেশী নয় (সীরাহ ছহীহাহ ১/৭৯)। এক্ষণে আমরা মক্কায় জাহেলিয়াত প্রসারের ইতিবৃত্ত সংক্ষেপে বর্ণনা করব।-

[1]. হাকেম হা/৩৯৭৫; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৯৪৪।

[2]. বুখারী, ফৎহসহ হা/৩৯৫০-এর আলোচনা, ‘মাগাযী’ অধ্যায় ২ অনুচ্ছেদ ৭/৩৩১ পৃঃ।

[3]. আহমাদ হা/১৭২০৯; তিরমিযী হা/২৮৬৩; মিশকাত হা/৩৬৯৪; সনদ ছহীহ।


শিরকের প্রচলন (إنشاء الشرك فى مكة)

মক্কার বাসিন্দারা মূলতঃ হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশধর ছিল এবং তারা জন্মগতভাবেই তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতে বিশ্বাসী ছিল। তারা কা‘বাগৃহকে যথার্থভাবেই আল্লাহর গৃহ বা বায়তুল্লাহ বলে বিশ্বাস করত এবং তার রক্ষণাবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধান করত। তারা এখানে নিয়মিতভাবে ত্বাওয়াফ, সাঈ তথা হজ্জ ও ওমরাহ করত এবং বহিরাগত হাজীদের নিরাপত্তা ও পানি সরবরাহের দায়িত্ব পালন করত। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবৎ কোন নবী না আসায় শয়তানী প্ররোচনায় তাদের সমাজনেতা ও ধনিক শ্রেণীর অনেকে পথভ্রষ্ট হয়ে যায় এবং এক সময় তাদের মাধ্যমেই মূর্তিপূজার শিরকের প্রচলন হয়, যেভাবে ইতিপূর্বে নূহ (আঃ)-এর কওমের মধ্যে হয়েছিল।


(১) কুরায়েশ বংশের বনু খোযা‘আহ গোত্রের সরদার ‘আমর বিন লুহাই (عَمرو بن لُحَى بن عامر الْخُزاعى) অত্যন্ত ধার্মিক, দানশীল ও দরবেশ স্বভাবের লোক ছিলেন। লোকেরা তাকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করত এবং তার প্রতি অন্ধভক্তি পোষণ করত। তাকে আরবের শ্রেষ্ঠ আলেম ও অলি-আউলিয়াদের মধ্যে গণ্য করা হ’ত। অতএব শয়তান তাকেই বেছে নিল তার কার্যসিদ্ধির জন্য। একবার তিনি শামের ‘বালক্বা’ (الْبَلْقَاء) অঞ্চলের ‘মাআব’ (مَآب) নগরীতে গিয়ে দেখেন যে, সেখানকার লোকেরা জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে ‘হুবাল’ (هُبَل) মূর্তির পূজা করে। তিনি তাদেরকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলে যে, আমরা এই মূর্তির অসীলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করলে বৃষ্টি হয় এবং সাহায্য প্রার্থনা করলে সাহায্য পাই’। এরা ছিল আমালেক্বা গোত্রের লোক এবং ইমলীক্ব বিন লাবেয বিন সাম বিন নূহ-এর বংশধর।[1] আমর ভাবলেন অসংখ্য নবী-রাসূলের জন্মভূমি ও কর্মভূমি এই শামের ধার্মিক লোকেরা যখন ‘হোবল’ মূর্তির অসীলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করে, তখন আমরাও এটা করলে উপকৃত হব। ফলে বহু মূল্যের বিনিময়ে আমর একটা হোবল মূর্তি খরীদ করে নিয়ে গেলেন এবং মক্কার নেতাদের রাযী করিয়ে কা‘বাগৃহে স্থাপন করলেন। কথিত আছে যে, একটা জিন আমরের অনুগত ছিল। সেই-ই তাকে খবর দেয় যে, নূহ (আঃ)-এর সময়কার বিখ্যাত অদ, সুওয়া‘, ইয়াগূছ, ইয়া‘ঊক্ব, নাসর (নূহ ৭১/২৩) প্রতিমাগুলি জেদ্দার অমুক স্থানে মাটির নীচে প্রোথিত আছে। আমর সেখানে গিয়ে সেগুলো উঠিয়ে এনে তেহামায় রেখে দিলেন। অতঃপর হজ্জ-এর মওসুমে সেগুলিকে বিভিন্ন গোত্রের হাতে সমর্পণ করলেন। এভাবে আমর ছিলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি ইসমাঈল (আঃ)-এর দ্বীনে পরিবর্তন আনেন এবং তাওহীদের বদলে শিরকের প্রবর্তন করেন (আর-রাহীক্ব ৩৫ পৃঃ)।


অতঃপর বনু ইসমাঈলের মধ্যে মূর্তিপূজার ব্যাপক প্রসার ঘটে। নূহ (আঃ


)-এর কওমের রেখে যাওয়া অদ, সুওয়া‘, ইয়াগূছ, ইয়া‘ঊক্ব, নাস্র (নূহ ৭১/২৩) প্রভৃতি মূর্তিগুলি এখন ইবরাহীমের বংশধরগণের দ্বারা পূজিত হ’তে থাকে। যেমন- বনু হুযায়েল কর্তৃক সুওয়া‘ (سُوَاع), ইয়ামনের বনু জুরাশ কর্তৃক ইয়াগূছ (يَغُوث), বনু খায়ওয়ান কর্তৃক ইয়া‘ঊক্ব (يَعُوق), যুল-কুলা‘ কর্তৃক নাসর (نَسْر), কুরায়েশ ও বনু কেনানাহ কর্তৃক হুবাল (هُبَل) ও উযযা (العُزَّى), ত্বায়েফের বনু ছাক্বীফ কর্তৃক লাত (اللاَّت), মদীনার আউস ও খাযরাজ কর্তৃক মানাত (مَنَاة), বনু ত্বাঈ কর্তৃক ফিল্স (فِلْسُ), ইয়ামনের হিমইয়ার গোত্র কর্তৃক রিয়াম (رِيَام), দাউস ও খাছ‘আম গোত্র কর্তৃক যুল-কাফফায়েন(ذُو الْكَفَّيْن) ও যুল-খালাছাহ(ذُو الْخَلَصَة) প্রভৃতি মূর্তি সমূহ পূজিত হ’তে থাকে (ইবনু হিশাম ১/৭৭-৮৭)।


এভাবে ক্রমে আরবের ঘরে ঘরে মূর্তিপূজার প্রসার ঘটে। ফলে মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কা‘বাগৃহের ভিতরে ও চারপাশে ৩৬০টি মূর্তি দেখতে পান। তিনি সবগুলোকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেন ও কা‘বাগৃহ পানি দিয়ে ধুয়ে ছাফ করে ফেলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘আমার সম্মুখে (স্বপ্নে) জাহান্নামকে পেশ করা হ’ল, ... অতঃপর আমাকে দেখানো হ’ল ‘আমর বিন ‘আমের আল-খুযাঈকে। জাহান্নামে সে তার নাড়ী-ভুঁড়ি টেনে বেড়াচ্ছে। এ ব্যক্তিই প্রথম তাদের উপাস্যদের নামে উট ছেড়ে দেওয়ার রেওয়াজ চালু করেছিল (যা লোকেরা রোগ আরোগ্যের পর কিংবা সফর থেকে আসার পর তাদের মূর্তির নামে ছেড়ে দিত)। ঐসব উট সর্বত্র চরে বেড়াত। কারু ফসল নষ্ট করলেও কিছু বলা যেত না বা তাদের মারা যেত না’।[2]


(২) তারা মূর্তির পাশে বসে তাকে উচ্চকণ্ঠে আহবান করত ও তাদের অভাব মোচনের জন্য অনুনয়-বিনয় করে প্রার্থনা জানাতো। তারা ধারণা করত যে, এই মূর্তি তাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যশীল করবে (যুমার ৩৯/৩) এবং তাদের জন্য আল্লাহর নিকটে সুফারিশ করবে (ইউনুস ১০/১৮)।


(৩) তারা মূর্তির উদ্দেশ্যে হজ্জ করত, ত্বাওয়াফ করত, তার সামনে নত হ’ত ও সিজদা করত। ত্বাওয়াফের সময় তারা শিরকী তালবিয়াহ পাঠ করত।لَبَّيْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ إِلاَّ شَرِيكًا هُوَ لَكَ تَمْلِكُهُ وَمَا مَلَكَ ‘হে আল্লাহ! আমি হাযির। তোমার কোন শরীক নেই, কেবল ঐ শরীক যা তোমার জন্য রয়েছে। তুমি যার মালিক এবং সে যা কিছুর মালিক)। মুশরিকরা ‘লাববাইকা লা শারীকা লাকা’ বলার পর রাসূল (সাঃ) তাদের উদ্দেশ্যে ক্বাদ ক্বাদ (থামো থামো) বলতেন।[3] এজন্যেই আল্লাহ বলেছেন,وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللهِ إِلاَّ وَهُمْ مُشْرِكُونَ ‘তাদের অধিকাংশ আল্লাহকে বিশ্বাস করে। অথচ সেই সাথে শিরক করে’ (ইউসুফ ১২/১০৬)। (৪) তারা মূর্তির জন্য নযর-নেয়ায নিয়ে আসত এবং মূর্তির নামে কুরবানী করত (মায়েদাহ ৫/৩)। (৫) তারা মূর্তিকে খুশী করার জন্য গবাদিপশু ও চারণক্ষেত্র মানত করত। যাদেরকে কেউ ব্যবহার করতে পারত না (আন‘আম ৬/১৩৮-১৪০)। (৬) তারা তাদের বিভিন্ন কাজের ভাল-মন্দ ফলাফল ও শুভাশুভ নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন প্রকারের তীর ব্যবহার করত (মায়েদাহ ৫/৯০-৯১)। যাতে হ্যাঁ, না, ভাল, মন্দ ইত্যাদি লেখা থাকত। হোবল দেবতার খাদেম সেগুলো একটি পাত্রের মধ্যে ফেলে তাতে ঝাঁকুনি দিয়ে তীরগুলি ঘুলিয়ে ফেলত। অতঃপর যে তীরটা বেরিয়ে আসত, সেটাকেই তারা ভাগ্য মনে করত এবং সে অনুযায়ী কাজ করত। (৭) এতদ্ব্যতীত তারা জ্যোতিষীদের কথা বিশ্বাস করত এবং বিশেষ বিশেষ নক্ষত্রকে মঙ্গলামঙ্গলের কারণ মনে করত।[4] (৮) তারা পাখি উড়িয়ে দিয়ে বা রেখা টেনে কাজের শুভাশুভ ও ভাল-মন্দ নির্ধারণ করত এবং পাখি ডাইনে গেলে শুভ ও বামে গেলে অশুভ ধারণা করত।[5] তারা ফেরেশতাদেরকে ‘আল্লাহর কন্যা’ বলত এবং জিনদের সাথে আল্লাহর আত্মীয়তা সাব্যস্ত করত (ছাফফাত ৩৭/১৫০-৫২, ১৫৮-৫৯)। তারা নিজেদের জন্য পুত্রসন্তান ও আল্লাহর জন্য কন্যাসন্তান নির্ধারণ করত (নাজম ৫৩/২১-২২)।


[1]. ইবনু হিশাম ১/৭৭। ভাষ্যকার সুহায়লী বলেন, বলা হয়ে থাকে যে, আমরই প্রথম কা‘বাগৃহে মূর্তি পূজার সূচনা করেন। এটি তখনকার ঘটনা, যখন বনু জুরহুমকে বিতাড়িত করে বনু খুযা‘আহ মক্কার উপরে দখল কায়েম করে। আমর বিন লুহাই এ সময় আরবদের নিকট রব-এর মর্যাদা লাভ করেন। তিনি ধর্মীয় বিধান হিসাবে যেটাই করতেন, লোকেরা সেটাকেই গ্রহণ করত। তিনি হজ্জের মৌসুমে লোকদের খানা-পিনা করাতেন ও বস্ত্র প্রদান করতেন। কখনো কখনো এ মৌসুমে দশ হাযার উট যবেহ করতেন ও দশ হাযার জোড়া বস্ত্র দান করতেন। সেখানে একটি পাথর ছিল। ত্বায়েফের ছাক্বীফ গোত্রের জনৈক ব্যক্তি তার উপরে হাজীদের জন্য ছাতু মাখাতেন। সেকারণ উক্ত পাথরটির নাম হয় ‘ছাতু মাখানোর পাথর’ (صَخْرَةُ اللاَّت)। পরে ঐ লোকটি মারা গেলে আমর বিন লুহাই বলেন, লোকটি মরেনি। বরং পাথরের মধ্যে প্রবেশ করেছে। অতঃপর তিনি লোকদের পাথরটিকে পূজা করতে বলেন। লোকেরা তার উপরে একটি ঘর তৈরী করে এর নাম দেয় ‘লাত’ (ইবনু হিশাম ১/৭৭ টীকা-২)। এভাবেই ‘লাত’ প্রতিমার পূজা চালু হয়। যা পরে ত্বায়েফে স্থানান্তরিত হয় এবং ছাক্বীফ গোত্র মুসলমান হওয়ার পরে যা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়’ (দ্রঃ ‘ছাক্বীফ প্রতিনিধি দল’) ।


[2]. বুখারী হা/৩৫২১; মুসলিম হা/৯০৪, ২৮৫৬; মিরক্বাত শরহ মিশকাত হা/৫৩৪১; সীরাহ ছহীহাহ ১/৮৩। ইনিই ছিলেন ‘আমর বিন লুহাই বিন ‘আমের, যিনি সর্বপ্রথম কা‘বাগৃহে ‘হোবল’ মূর্তির পূজা শুরু করেন (ইবনু হিশাম ১/৭৬)।


[3]. মুসলিম হা/১১৮৫, আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে; মিশকাত হা/২৫৫৪ ‘ইহরাম ও তালবিয়াহ’ অনুচ্ছেদ। পক্ষান্তরে ইসলামী তালবিয়াহ হ’ল, لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ لَبَّيْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ ‘আমি হাযির হে আল্লাহ আমি হাযির। আমি হাযির। তোমার কোন শরীক নেই, আমি হাযির। নিশ্চয়ই যাবতীয় প্রশংসা, অনুগ্রহ ও সাম্রাজ্য সবই তোমার; তোমার কোন শরীক নেই’ (বুখারী হা/৫৯১৫; মুসলিম হা/২৮৬৮)। দ্রঃ ‘হজ্জ ও ওমরাহ’ বই ৫৪ পৃঃ। বর্তমান যুগে বহু মুসলমান কবরে সিজদা করে ও কবরবাসীর নিকটে পানাহ চায়। অতঃপর মসজিদে গিয়ে ছালাত আদায় করে। একই সঙ্গে কবরপূজা ও আল্লাহ্র ইবাদত। যা স্পষ্ট শিরক এবং যা জাহেলী আরবের মুশরিকদের অনুকরণ মাত্র।


[4]. বুখারী হা/৮৪৬; মুসলিম হা/৭৩; মিশকাত হা/৪৫৯৬-৯৭।

[5]. মুসলিম হা/৫৩৭; মিশকাত হা/৪৫৯২।


বিদ‘আতের প্রচলন (إنشاء البدعة فى مكة)

মূর্তিপূজা সত্ত্বেও তারা ধারণা করত যে, তারা দ্বীনে ইবরাহীমের উপরে সঠিকভাবে কায়েম আছে। কেননা ‘আমর বিন লুহাই তাদের বুঝিয়েছিলেন যে, এগুলি ইবরাহীমী দ্বীনের বিকৃতি নয়, বরং ভাল কিছুর সংযোজন বা ‘বিদ‘আতে হাসানাহ’ মাত্র। এজন্য তিনি বেশকিছু ধর্মীয় রীতি-নীতি চালু করেছিলেন। যেমন-


(১) তারা হজ্জের মওসুমে ‘মুযদালিফায়’ অবস্থান করত, যা ছিল হারাম এলাকার অভ্যন্তরে। হারামের বাইরে হওয়ার কারণে তারা আরাফাতের ময়দানে যেত না বা সেখান থেকে মক্কায় ফিরে আসা অর্থাৎ ত্বাওয়াফে এফাযাহ করত না। যা ছিল হজ্জের সবচেয়ে বড় রুকন। তারা মুযদালেফায় অবস্থান করত ও সেখান থেকে মক্কায় ফিরে আসত। সেজন্য আল্লাহ নির্দেশ দেন,ثُمَّ أَفِيْضُواْ مِنْ حَيْثُ أَفَاضَ النَّاسُ ‘অতঃপর তোমরা ঐ স্থান থেকে ফিরে এসো ত্বাওয়াফের জন্য, যেখান থেকে লোকেরা ফিরে আসে (অর্থাৎ আরাফাত থেকে) (বাক্বারাহ ২/১৯৯)।[1]


(২) তারা নিজেরা ধর্মীয় বিধান রচনা করেছিল যে, বহিরাগত হাজীগণ মক্কায় এসে প্রথম ত্বাওয়াফের সময় তাদের পরিবেশিত ধর্মীয় পোষাক(ثِيَابُ الْحُمْس) পরিধান করবে। সম্ভবতঃ এটা তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থদুষ্ট বিদ‘আত ছিল। যদি কেউ (আর্থিক কারণে বা অন্য কারণে) তা সংগ্রহে ব্যর্থ হয়, তবে পুরুষেরা সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে এবং মেয়েরা সব কাপড় খুলে রেখে কেবল ছোট্ট একটা কাপড় পরে ত্বাওয়াফ করবে। এতে তাদের দেহ একপ্রকার নগ্নই থাকত। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, পুরুষেরা দিনের বেলায় ও মেয়েরা রাতের বেলায় ত্বাওয়াফ করত। তাদের এ অন্যায় প্রথা বন্ধ করার জন্য আল্লাহ আয়াত নাযিল করেন,يَا بَنِيْ آدَمَ خُذُوْا زِيْنَتَكُمْ عِنْدَ كُلِّ مَسْجِدٍ ‘হে আদম সন্তান! প্রতি ছালাতের সময় তোমরা সুন্দর পোষাক পরিধান কর’।[2]


তাদের কাছ থেকে ‘হুম্স’ পোষাক কিনতে বাধ্য করার জন্য তারা এ বিধানও করেছিল যে, যদি বহিরাগত কেউ উত্তম পোষাকে এসে ত্বাওয়াফ করে, তাহ’লে ত্বাওয়াফ শেষে তাদের ঐ পোষাক খুলে রেখে যেতে হবে। যার দ্বারা কেউ উপকৃত হ’ত না’ (ইবনু হিশাম ১/২০২)।


(৩) তাদের বানানো আরেকটা বিদ‘আতী রীতি ছিল এই যে, তারা এহরাম পরিহিত অবস্থায় স্ব স্ব বাড়ীর সম্মুখ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। কিন্তু বাকী আরবরা সকলে স্ব স্ব বাড়ীর পিছন দিক দিয়ে গৃহে প্রবেশ করবে। সম্মুখ দরজা দিয়ে নয়। এভাবে তারা তাদের ধার্মিকতার গৌরব সারা আরবের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,وَلَيْسَ الْبِرُّ بِأَنْ تَأْتُوْا الْبُيُوْتَ مِنْ ظُهُوْرِهَا وَلَـكِنَّ الْبِرَّ مَنِ اتَّقَى وَأْتُواْ الْبُيُوْتَ مِنْ أَبْوَابِهَا ‘পিছনের দরজা দিয়ে গৃহে প্রবেশ করার মধ্যে কোন কল্যাণ নেই। বরং কল্যাণ রয়েছে তার জন্য যে আল্লাহকে ভয় করে। অতএব তোমরা গৃহে প্রবেশ কর সম্মুখ দরজা দিয়ে’ (বাক্বারাহ ২/১৮৯)।[3]


উপরোক্ত আলোচনায় তৎকালীন আরবের ও বিশেষ করে মক্কাবাসীদের মধ্যে প্রচলিত শিরক ও বিদ‘আত সমূহের একটা চিত্র পাওয়া গেল। যা তারা ইবরাহীম (আঃ)-এর একত্ববাদী দ্বীনে হানীফের মধ্যে ধর্মের নামে চালু করেছিল। আর এটাই ছিল বড় জাহেলিয়াত এবং এজন্যেই এ যুগটিকে ‘জাহেলী যুগ’ বাالْأَيَّامُ الْجَاهِلِيَّةُ বলা হয়েছে।


আল্লাহ বলেন,اللهُ وَلِيُّ الَّذِينَ آمَنُوا يُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا أَوْلِيَاؤُهُمُ الطَّاغُوتُ يُخْرِجُونَهُمْ مِنَ النُّورِ إِلَى الظُّلُمَاتِ أُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ ‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে, আল্লাহ তাদের অভিভাবক। তিনি তাদেরকে অন্ধকার হ’তে আলোর দিকে বের করে আনেন। আর যারা অবিশ্বাস করেছে, শয়তান তাদের অভিভাবক। তারা তাদেরকে আলো থেকে বের করে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। ওরা হ’ল জাহান্নামের অধিবাসী। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে’ (বাক্বারাহ ২/২৫৭)।


[1]. বুখারী হা/১৬৬৫; মুসলিম হা/১২১৯-২০।

[2]. আ‘রাফ ৭/৩১; ইবনু কাছীর, তাফসীর উক্ত আয়াত।

[3]. বুখারী হা/১৮০৩; কুরতুবী, ইবনু কাছীর, তাফসীর বাক্বারাহ ১৮৯ আয়াত।


ইয়াছরিবে ইহূদী-নাছারাদের অবস্থা (حالة اليهود والنصارى فى يثرب)

ইতিপূর্বে বলা হয়েছে যে, ইয়াছরিবের অধিবাসী আউস ও খাযরাজগণ ইসমাঈল-পুত্র নাবেত-এর বংশধর ছিলেন। কিন্তু তারা পরে মূর্তিপূজারী হয়ে যায়। সিরিয়া ও ইরাকের পথে ব্যবসায়িক স্বার্থ এবং মিষ্ট পানি ও উর্বর অঞ্চল বিবেচনায় ইহূদীরা এখানে আগেই আগমন করে। তারা অত্যাচারী রাজা বুখতানছর কর্তৃক কেন‘আন (ফিলিস্তীন) থেকে উৎখাত হওয়ার পরে ইয়াছরিবে এসে বসবাস শুরু করেছিল এই উদ্দেশ্যে যে, তারা বায়তুল মুক্বাদ্দাস হারিয়েছে। অতএব তারা এখন বায়তুল্লাহর নিকটবর্তী থাকবে এবং নিয়মিত হজ্জ-ওমরাহর মাধ্যমে পরকালীন পাথেয় হাছিল করবে। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল এই যে, আখেরী নবীর আবির্ভাব যেহেতু মক্কায় হবে এবং তাঁর আবির্ভাবের সময় আসন্ন, অতএব তারা দ্রুত তাঁর দ্বীন কবুল করবে এবং তাঁর নেতৃত্বে আবার বায়তুল মুক্বাদ্দাস দখল করবে। তবে তাদের ধারণা ছিল যে, আখেরী নবী অবশ্যই তাদের নবী ইসহাক-এর বংশে হবেন। কিন্তু তা না হ’য়ে ইসমাঈল-এর বংশে হওয়াতেই ঘটল যত বিপত্তি।


মদীনায় ইহূদীদের আধিক্য ছিল এবং নাছারা ছিল খুবই কম। তাদের মূল অবস্থান ছিল মদীনা থেকে নাজরান এলাকায়। যা ছিল ৭৩টি পল্লী সমৃদ্ধ খ্রিষ্টানদের একটি বিরাট নগরীর নাম। বর্তমানে সড়কপথে এটি মদীনা থেকে ১২০৫ কি.মি. দক্ষিণে ইয়ামন সীমান্তে অবস্থিত।


ইহূদী ও নাছারাদের মধ্যে তাওরাত-ইনজীলের কোন শিক্ষা অবশিষ্ট ছিল না। তাদের ধর্ম ও সমাজনেতারা(الْأَحْبَارُ وَالرُّهْبَانُ) ভক্তদের কাছে ‘রব’-এর আসন দখল করেছিল। ইহূদীরা ওযায়েরকে ‘আল্লাহর বেটা’ বানিয়েছিল এবং নাছারারা মসীহ ঈসাকে একইভাবে ‘বেটা’ দাবী করেছিল (তওবাহ ৯/৩০-৩১)। বরং তারা মারিয়াম, ঈসা ও আল্লাহকে নিয়ে তিন উপাস্যের সমন্বয়ে ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছিল (মায়েদাহ ৫/৭৩)। তাদের পীর-দরবেশরা ধর্মের নামে বাতিল পন্থায় মানুষের অর্থ-সম্পদ লুণ্ঠন করত এবং তাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে ফিরিয়ে রাখতো (তওবাহ ৯/৩৪)। আল্লাহ যা হারাম করেছেন, তারা তা হারাম করত না (তওবাহ ৯/২৯)। এক কথায় তাওরাত-ইনজীলের বাহক হবার দাবীদার হ’লেও তারা ছিল পুরা স্বেচ্ছাচারী ও প্রবৃত্তিপূজারী দুনিয়াদার। ঠিক আজকের মুসলিম ধর্মনেতা ও সমাজনেতাদের অধিকাংশের অবস্থা যেমনটি হয়েছে।[1]


[1]. এ যুগের মুসলমানদের অবস্থা বর্ণনা করে ভারতের উর্দূ কবি হালী বলেন,

كرے غير گر بت كى پوجا تو كافر + جو ٹهراے بيٹا خدا كا تو كافر

كہے آگ كو قبلہ اپنا تو كافر + كو اكب ميں مانے كرشمہ تو كافر

مگر مومنوں پر كشاوه ہيں راہيں + پرستش كريں شوق سے جسكى چاہيں

نبى كو جو چاہيں خدا كر د كهائيں + اماموں كا رتبہ نبى سے بڑهائيں

مزاروں پہ دن رات نذريں چڑهائيں + شہيدوں سے جا جا كے مانگيں دعائيں

نہ توحيد ميں كچھ خلل اس سے آئے + نہ اسلام بگڑے نہ ايمان جاے


(১) অন্যেরা যদি মূর্তিপূজা করে, সে হয় কাফের। যে আল্লাহ্র বেটা আছে বলে, সে হয় কাফের। (২) আগুনকে ক্বিবলা বললে, সে হয় কাফের। তারকারাজির মধ্যে যে ক্ষমতা আছে বলে, সে কাফের। (৩) কিন্তু মুমিনদের জন্য রাস্তা রয়েছে খোলা। খুশীমনে সে করে পূজা যাকে সে চায়। (৪) নবীকে যে চায় আল্লাহ বলে দেখায়। ইমামদের সম্মান নবীদের উপর উঠায়। (৫) মাযারগুলিতে দিন-রাত নযর-নিয়ায চড়ায়। শহীদদের কাছে গিয়ে গিয়ে কেবলই দো‘আ চায়। (৬) এতে তাদের তাওহীদে না কোন ত্রুটি আসে। না ইসলাম বিকৃত হয়, না ঈমান যায়’ (আলতাফ হোসায়েন হালী (১২৫৩-১৩৩২ হিঃ/১৮৩৭-১৯১৪ খৃঃ), মুসাদ্দাসে হালী-উর্দূ ষষ্ঠপদী (লাক্ষ্ণৌ, ভারত : ১৩২০/১৯০২) ৪৮ পৃঃ)।



ইবনু কাছীর (রহঃ)-এর মন্তব্য (قول ابن كثير فى شعب العرب القديم)

হাফেয ইবনু কাছীর (রাহেমাহুল্লাহ) বলেন, আরবের লোকেরা প্রাচীনকালে ইবরাহীমী দ্বীনের অনুসারী ছিল। পরে তারা তাওহীদকে শিরকে এবং ইয়াক্বীনকে সন্দেহে রূপান্তরিত করে। এছাড়াও তারা বহু কিছু বিদ‘আতের প্রচলন ঘটায়। একই অবস্থা হয়েছিল তওরাত ও ইনজীলের অনুসারীদের। তারা তাদের কিতাবে পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। তাতে শাব্দিক যোগ-বিয়োগ করেছিল, রূপান্তর করেছিল ও দূরতম ব্যাখ্যা করেছিল। অতঃপর আল্লাহ মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে প্রেরণ করেন পূর্ণাঙ্গ শরী‘আত দিয়ে, যা সমস্ত সৃষ্টিজগতকে শামিল করে’ (ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা জুম‘আ ২ আয়াত)।


এক্ষণে আমরা নবীজীবনের মূল আলোচনায় অগ্রসর হব ইনশাআল্লাহ।-

রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মাক্কী জীবন - শৈশব থেকে নবুঅত (من الطفولية الى النبوة)

নবী জীবনকে আমরা প্রধান দু’টি ভাগে ভাগ করে নেব- মাক্কী জীবন ও মাদানী জীবন। মক্কায় তাঁর জন্ম, বৃদ্ধি ও নবুঅত লাভ এবং মদীনায় তাঁর হিজরত, ইসলামের বাস্তবায়ন ও ওফাত লাভ।


আরবের মরুদুলাল শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হেজাযের মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন ও সেখানে জীবনের ৫৩টি বছর কাটান। যার মধ্যে ১৩ বছর ছিল নবুঅতী জীবন। অতঃপর তিনি মদীনায় হিজরত করেন ও সেখানে জীবনের বাকী ১০ বছর কাটান। অতঃপর সেখানেই ৬৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।[1] এক্ষণে আমরা তাঁর বংশ পরিচয় ও জীবন বৃত্তান্ত পেশ করব।

[1]. বুখারী হা/৩৯০২; মুসলিম হা/২৩৫১; মিশকাত হা/৫৮৩৭ ‘অহীর সূচনা’ অনুচ্ছেদ।


পূর্বপুরুষ

ইবরাহীম (আঃ)-এর দুই পুত্র ছিলেন ইসমাঈল ও ইসহাক্ব। ইসমাঈলের মা ছিলেন বিবি হাজেরা এবং ইসহাকের মা ছিলেন বিবি সারা। দুই ছেলেই ‘নবী’ হয়েছিলেন। ছোট ছেলে ইসহাক্বের পুত্র ইয়াকূবও ‘নবী’ হন। তাঁর অপর নাম ছিল ‘ইস্রাঈল’ অর্থ ‘আল্লাহর দাস’। সে মতে তাঁর বংশ ‘বনু ইস্রাঈল’ নামে পরিচিত হয়। তাঁর বারো জন পুত্রের বংশধরগণের মধ্যে যুগ যুগ ধরে হাযার হাযার নবীর জন্ম হয়। ইউসুফ, মূসা, হারূণ, দাঊদ, সুলায়মান ও ঈসা (‘আলাইহিমুস সালাম) ছিলেন এই বংশের সেরা নবী ও রাসূল। বলা চলে যে, আদম (‘আলাইহিস সালাম) হ’তে ইবরাহীম (‘আলাইহিস সালাম) পর্যন্ত হযরত নূহ ও ইদরীস (আঃ) সহ ৮/৯ জন নবী ব্যতীত বাকী এক লক্ষ চবিবশ হাযার নবী-রাসূলের[1] প্রায় সকলেই ছিলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আঃ)-এর বংশধর অর্থাৎ বনু ইস্রাঈল। যাদের সর্বশেষ নবী ও রাসূল ছিলেন হযরত ঈসা (আঃ)। অন্যদিকে হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশে একজন মাত্র নবীর জন্ম হয় এবং তিনিই হ’লেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহে ওয়া সাল্লাম)। ফলে আদম (আঃ) যেমন ছিলেন মানবজাতির আদি পিতা, নূহ (আঃ) ছিলেন মানব জাতির দ্বিতীয় পিতা, তেমনি ইবরাহীম (আঃ) ছিলেন তাঁর পরবর্তী সকল নবীর পিতা এবং তাঁদের অনুসারী উম্মতে মুসলিমাহর পিতা (হজ্জ ২২/৭৮)। ইবরাহীম (আঃ) আল্লাহর হুকুমে দ্বিতীয়া স্ত্রী হাজেরা ও তার পুত্র ইসমাঈলকে মক্কায় রেখে আসেন ও মাঝে-মধ্যে গিয়ে তাদের খোঁজ-খবর নিতেন। তাঁরা সেখানেই আমৃত্যু বসবাস করেন। অন্যদিকে তাঁর প্রথমা স্ত্রী সারা ও তার পুত্র ইসহাক ও অন্যদের নিয়ে তিনি কেন‘আনে (ফিলিস্তীনে) বসবাস করতেন এবং এখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এভাবে ইবরাহীম (আঃ)-এর দুই পুত্রের মাধ্যমে মক্কা ও শাম (ফিলিস্তীন) দুই অঞ্চলে তাওহীদের প্রচার ও প্রসার ঘটে।


কুরআনে বর্ণিত পঁচিশ জন নবীর মধ্যে আদম, নূহ, ইদরীস ও মুহাম্মাদ (সাঃ) বাদে বাকী ২১ জন নবী ছিলেন বনু ইস্রাঈল এবং একমাত্র মুহাম্মাদ (সাঃ) হ’লেন বনু ইসমাঈল। বলা চলে যে, এই বৈমাত্রেয় পার্থক্য উম্মতে মুহাম্মাদীর বিরুদ্ধে ইহূদী-নাছারাদের স্থায়ী বিদ্বেষের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। সেজন্য তারা চিনতে পেরেও এবং তাদের কিতাবে শেষনবীর নাম, পরিচয় ও তাঁর আগমনের কথা লিখিত থাকা সত্ত্বেও তারা তাঁকে মানেনি।[2]


[1]. আহমাদ হা/২২৩৪২; ত্বাবারাণী, মিশকাত হা/৫৭৩৭ ‘ক্বিয়ামতের অবস্থা’ অধ্যায় ‘সৃষ্টির সূচনা ও নবীগণের আলোচনা’ অনুচ্ছেদ; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৬৬৮।

[2]. বাক্বারাহ ২/১৪৬; আন‘আম ৬/২০; আ‘রাফ ৭/১৫৭।


জন্ম ও মৃত্যু (الولادة والوفاة)

মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ১ম হস্তীবর্ষের ৯ই রবীউল আউয়াল[1] সোমবার ছুবহে ছাদিকের পর মক্কায় নিজ পিতৃগৃহে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১১ হিজরী সনের ১লা রবীউল আউয়াল সোমবার সকাল ১০টার দিকে মদীনায় মৃত্যুবরণ করেন।


রাসূল (সাঃ)-এর জন্ম ও মৃত্যু দু’টিই সোমবারে হয়েছিল’।[2] বিদায় হজ্জ হয়েছিল ৯ই যিলহজ্জ শুক্রবার। তিনি বিদায় হজ্জের পরে ৮০ বা ৮১ দিন বেঁচে ছিলেন। কেউ বলেছেন ৯০ বা ৯১ দিন (এটা ভুল)। আবু মিখনাফ ও কালবী ওফাতের তারিখ ২রা রবীউল আউয়াল বলেছেন। ইবনু হিশামের ভাষ্যকার সুহায়লী সেটাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। ইবনু হাজার বলেন,


فَالْمُعْتَمَدُ مَا قَالَ أَبُو مِخْنَفٍ وَكَأَنَّ سَبَبَ غَلَطِ غَيْرِهِ أَنَّهُمْ قَالُوا مَاتَ فِي ثَانِي شَهْرِ رَبِيعٍ الْأَوَّلِ فَتَغَيَّرَتْ فَصَارَتْ ثَانِي عَشَرَ وَاسْتَمَرَّ الْوَهْمُ بِذَلِكَ يَتْبَعُ بَعْضُهُمْ بَعْضًا مِنْ غَيْرِ تَأَمُّلٍ

‘আবু মিখনাফ যেটি বলেছেন, সেটিই নির্ভরযোগ্য। অন্যদের ভুলের কারণ সম্ভবতঃ এটাই যে, তারা বলেছিলেন, রাসূল (সাঃ) ২রা রবীউল আউয়াল মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু পরে সেটি পরিবর্তিত হয়ে ১২ই রবীউল আউয়াল হয়ে গেছে। পরবর্তীতে লোকেরা কোনরূপ চিন্তা-ভাবনা না করেই উক্ত ভুলের অনুসরণ করে গেছেন’।[3] অর্থাৎ ثَانِي شَهْرِ رَبِيعٍ الْأَوَّل পরে ثَانِي عَشَرَ হয়ে গেছে’। তবে এটি মক্কার চাঁদের হিসাবে হ’তে পারে। কেননা মক্কার চাঁদ মদীনার একদিন আগে ওঠে (আল-বিদায়াহ ৫/২২৪-২৫)। অতএব মদীনার হিসাবে ১লা রবীউল আউয়াল ওফাতের দিন হবে। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।


সুলায়মান মানছূরপুরীর হিসাব মতে সৌরবর্ষ হিসাবে রাসূল (সাঃ)-এর জন্ম ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২২শে এপ্রিল সোমবার এবং মৃত্যু ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই জুন সোমবার। চান্দ্রবর্ষ হিসাবে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর ৪দিন এবং সৌরবর্ষ হিসাবে ৬১ বছর ১ মাস ১৪ দিন। তাঁর জন্ম হয়েছিল আবরাহা কর্তৃক কা‘বা আক্রমণের ৫০ দিন পরে (ইবনু হিশাম ১/১৫৮-টীকা ৪)। এটা ছিল ইবরাহীম (আঃ) থেকে ২৫৮৫ বছর ৭ মাস ২০ দিন পরে এবং নূহ (আঃ)-এর প্লাবনের ৩৬৭৫ বছর পরের ঘটনা। রাসূল (সাঃ) দুনিয়াতে বেঁচে ছিলেন মোট ২২,৩৩০ দিন ৬ ঘণ্টা। তন্মধ্যে তাঁর নবুঅতকাল ছিল ৮১৫৬ দিন।[4] সঠিক হিসাব আল্লাহ জানেন।


[1]. ছহীহ হাদীছসমূহের বর্ণনা অনুযায়ী রাসূল (সাঃ)-এর জন্ম সোমবারে হয়েছে। কোন তারিখ সেটা বলা নেই। অতএব সোমবার ঠিক রাখতে গেলে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব মতে ৯ই রবীউল আউয়ালই সঠিক জন্ম তারিখ হয়, ১২ই রবীউল আউয়াল নয়, যা প্রসিদ্ধ আছে (সুলায়মান বিন সালমান মানছূরপুরী, (মৃ. ১৯৩০ খ্রিঃ) রহমাতুল্লিল ‘আলামীন (উর্দূ), দিল্লী : ১৯৮০ খ্রিঃ ১/৪০; আর-রাহীক্ব পৃঃ ৫৪; মা শা-‘আ ৫-৯ পৃঃ)।


তাঁর জন্মের কাহিনীতে প্রসিদ্ধ আছে যে, (১) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) খাৎনাকৃত ও নাড়ী কাটা অবস্থায় ভূমিষ্ট হন। (২) কেউ তার লজ্জাস্থান দেখেনি। (৩) শৈশবে বক্ষবিদারণের দিন জিব্রীল তাঁর খাৎনা করেন (যঈফাহ হা/৬২৭০)। (৪) জান্নাত থেকে আসিয়া ও মারিয়াম নেমে এসে ধাত্রীর কাজ করেন। (৫) আবু লাহাব মৃত্যুর পরে তার পরিবারের কোন একজনকে (বলা হয়ে থাকে, আববাসকে) স্বপ্ন দেখান। তাকে বলা হয় আপনার অবস্থা কি? তিনি বলেন, আমি জাহান্নামে। তবে প্রতি সোমবার আমার আযাব হালকা করা হয় এবং আমার এই দুই আঙ্গুল থেকে পানি চুষে পান করি। আর এটা এ কারণে যে, নবী (সাঃ)-এর জন্মের সুসংবাদ দানের ফলে আমি আমার দাসী ছুয়াইবাহকে মুক্ত করে দেই এবং সে নবীকে দুধ পান করায়।


উল্লেখ্য যে, আবু লাহাব ২য় হিজরীতে সংঘটিত বদর যুদ্ধের সপ্তাহকাল পরে মারা যান। আববাস তখন কাফের ছিলেন এবং ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের দিন মুসলমান হন।


(৬) রাসূল প্রসবের সময় তার মা বলছেন যে, আমার গুপ্তাঙ্গ দিয়ে ‘নূর’ অর্থাৎ জ্যোতি বিকশিত হয়। যা শামে প্রাসাদ সমূহকে আলোকিত করেছিল। উম্মাহাতুল মুমিনীন যা স্বচক্ষে দেখেছিলেন। এটি ছিল ভবিষ্যতে শাম এলাকা ইসলামের আলোকে আলোকিত হওয়ার আগাম সুসংবাদ (৭) পারস্যের কিসরা রাজপ্রাসাদ কেঁপে উঠেছিল এবং তার ১৪টি চূড়া ভেঙ্গে পড়েছিল। আর এটি ছিল তাঁর ভবিষ্যৎ নবী হওয়ার অগ্রিম সুসংবাদ (৮) এ সময় মজূসীদের পূজার আগুন নিভে গিয়েছিল (৯) ইরাকের সাওয়া হ্রদের পানি শুকিয়ে গিয়েছিল এবং তার পার্শ্ববর্তী গীর্জাসমূহ ধ্বসে পড়েছিল ইত্যাদি (আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নাজদী, মুখতাছার সীরাতুর রাসূল (সাঃ) (রিয়াদ: ১ম সংস্করণ ১৪১৪/১৯৯৪ খৃঃ ১৮-২০ পৃঃ; মুবারকপুরী, আর-রাহীকুল মাখতূম, কুয়েত : ২য় সংস্করণ ১৪১৬/১৯৯৬ খৃঃ ৫৪ পৃঃ)।


উল্লেখ্য যে, আর-রাহীক্বের বাংলা অনুবাদক ও সম্পাদকগণ তাঁদের অগণিত ভুল অনুবাদের মধ্যে ঐ সাথে এটাও যোগ করেছেন যে, (১০) ঐ সময় কা‘বাগৃহের ৩৬০টি মূর্তি ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়ে’ (বঙ্গানুবাদ, আগস্ট ১৯৯৫, ১০১ পৃঃ; সেপ্টেম্বর ২০০৯, ৭৬ পৃঃ)। যেকথা মূল আরবী, পৃঃ ৫৪ এবং লেখক কর্তৃক অনূদিত উর্দূ সংস্করণ, লাহোর : নভেম্বর ১৯৮৮, পৃঃ ১০১-এ নেই)। বলা বাহুল্য, উপরে বর্ণিত সকল বর্ণনাই ভিত্তিহীন কল্পকথা মাত্র।


[2]. মুসলিম হা/১১৬২; মিশকাত হা/২০৪৫; বুখারী হা/১৩৮৭।

[3]. বিস্তারিত দ্রঃ ফাৎহুল বারী হা/৪৪২৬-এর পরে ‘রাসূল (সাঃ)-এর অসুখ ও মৃত্যু’ অনুচ্ছেদ; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৫/২২৪-২৫; মোস্তফা চরিত ৮৬৭-৬৮ পৃঃ।

[4]. কাযী সুলায়মান বিন সালমান মানছূরপুরী (মৃ. ১৩৪৯/১৯৩০ খৃ:), রহমাতুল্লিল ‘আলামীন (দিল্লী : ১ম সংস্করণ ১৯৮০ খৃঃ) ২/১৬, ৩৬৮ পৃঃ; ১/৪০, ২৫১ পৃঃ।


বংশ (النسب)

তিনি মক্কার কুরায়েশ বংশের শ্রেষ্ঠ শাখা হাশেমী গোত্রে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল আব্দুল্লাহ, মাতার নাম আমেনা। দাদার নাম ছিল আব্দুল মুত্ত্বালিব, দাদীর নাম ফাতেমা। নানার নাম ছিল ওয়াহাব, নানীর নাম বাররাহ। নানার বংশসূত্র রাসূল (সাঃ)-এর ঊর্ধ্বতন দাদা কিলাব-এর সাথে এবং নানীর বংশসূত্র কুছাই বিন কিলাব-এর সাথে যুক্ত হয়েছে। দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব ছিলেন বনু হাশেম গোত্রের সরদার এবং নানা ওয়াহাব ছিলেন বনু যোহরা গোত্রের সরদার। দাদার হাশেমী গোত্র ও নানার যোহরা গোত্র কুরায়েশ বংশের দুই বৃহৎ ও সম্ভ্রান্ত গোত্র হিসাবে প্রসিদ্ধ ছিল।


রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, بُعِثْتُ مِنْ خَيْرِ قُرُونِ بَنِى آدَمَ قَرْنًا فَقَرْنًا، حَتَّى كُنْتُ مِنَ الْقَرْنِ الَّذِى كُنْتُ فِيهِ ‘আমি যুগ পরম্পরায় বনু আদমের শ্রেষ্ঠ যুগে প্রেরিত হয়েছি। অবশেষে আমি সেই যুগে এসেছি, যে যুগে আমি রয়েছি’ (বুখারী হা/৩৫৫৭)। (২) রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস আবু সুফিয়ানকে হোদায়বিয়া সন্ধির পরে তার কুফরী অবস্থায় প্রশ্ন করেছিলেন, তোমাদের মধ্যে নবী দাবীকারী ব্যক্তির বংশ কেমন? উত্তরে আবু সুফিয়ান বলেছিলেন, هُوَ فِينَا ذُو حَسَبٍ ‘তিনি আমাদের মধ্যে উচ্চ বংশীয়’। হেরাক্লিয়াস বলেছিলেন, كَذَلِكَ الرُّسُلُ تُبْعَثُ فِى أَحْسَابِ قَوْمِهَا ‘এভাবেই নবী-রাসূলগণ তার সম্প্রদায়ের সেরা বংশে জন্ম গ্রহণ করে থাকেন’।[1]


(৩) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,إِنَّ اللهَ اصْطَفَى مِنْ وَلَدِ إِبْرَاهِيْمَ إِسْمَاعِيْلَ وَاصْطَفَى مِنْ وَلَدِ إِسْمَاعِيْلَ بَنِي كِنَانَةَ وَاصْطَفَى مِنْ بَنِي كِنَانَةَ قُرَيْشًا وَاصْطَفَى مِنْ قُرَيْشٍ بَنِي هَاشِمٍ وَاصْطَفَانِى مِنْ بَنِي هَاشِمٍ- ‘আল্লাহ ইবরাহীমের সন্তানগণের মধ্য থেকে ইসমাঈলকে বেছে নিয়েছেন। অতঃপর ইসমাঈলের সন্তানগণের মধ্য থেকে বনু কেনানাহকে বেছে নিয়েছেন। অতঃপর বনু কেনানাহ থেকে কুরায়েশ বংশকে বেছে নিয়েছেন। অতঃপর কুরায়েশ থেকে বনু হাশেমকে এবং বনু হাশেম থেকে আমাকে বেছে নিয়েছেন।[2] এভাবে আল্লাহর অনুগ্রহে শেষনবী (সাঃ) বনু আদমের সেরা বংশের সেরা গোত্রে সেরা সন্তান হিসাবে জন্মগ্রহণ করেন।


(৪) তিনি বলতেন, أَنَا دَعْوَةُ أَبِي إِبْرَاهِيْمَ، وَبُشْرَى عِيْسَى عَلَيْهِمَا السَّلاَم ‘আমি আমার পিতা ইবরাহীমের দো‘আ ও ঈসার সুসংবাদ’।[3] কেননা ইবরাহীম ও ইসমাঈল বায়তুল্লাহ নির্মাণের সময় দো‘আ করেছিলেন, যা কুরআনে বর্ণিত হয়েছে নিম্নোক্ত ভাষায়-


رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيْهِمْ رَسُوْلاً مِّنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيْهِمْ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ- (بقرة ১২৯)-


‘হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি তাদের মধ্য হ’তে একজনকে তাদের প্রতি রাসূল হিসাবে প্রেরণ কর, যিনি তাদের নিকটে তোমার আয়াতসমূহ পাঠ করে শুনাবেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত (সুন্নাহ) শিক্ষা দিবেন ও তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন’ (বাক্বারাহ ২/১২৯)।


পিতা-পুত্রের এই মিলিত দো‘আ দুই হাযারের অধিক বছর পরে শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর আগমনের মাধ্যমে বাস্তবে রূপ লাভ করে। ফালিল্লাহিল হাম্দ।


উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বংশের উচ্চ মর্যাদা ও পবিত্রতা বর্ণনায় ছহীহ হাদীছসমূহ থাকা সত্ত্বেও অনেক বানোয়াট হাদীছ তৈরী করা হয়েছে। যেমন, (১) আমি পিতা-মাতার মাধ্যমে দুনিয়াতে এসেছি। আদম থেকে শুরু করে জাহেলী যুগের কোনরূপ ব্যভিচারের মাধ্যমে কখনো দুই পিতা আমাকে স্পর্শ করেনি’ (বায়হাক্বী, দালায়েল ১/১৭৪ পৃঃ)। (২) ‘যদি আল্লাহ জানতেন যে, আমার বংশের চাইতে উত্তম কোন বংশ আছে, তাহ’লে আমাকে সেখান থেকেই ভূমিষ্ট করাতেন’। (৩) ‘জিব্রীল আমার উপরে অবতীর্ণ হ’য়ে বললেন, আল্লাহ জাহান্নামকে হারাম করেছেন ঐ ব্যক্তির জন্য, যার ঔরসে আপনাকে পাঠান হয়েছে এবং ঐ গর্ভকে, যা আপনাকে ধারণ করেছে এবং ঐ ক্রোড়কে, যা আপনাকে প্রতিপালন করেছে’ (ইবনুল জাওযী, মাওযূ‘আত ১/২৮১-৮৩)। এগুলি সবই ‘জাল’ এবং অতিশয়োক্তি ছাড়া কিছুই নয়।


[1]. বুখারী হা/৪৫৫৩; মুসলিম হা/১৭৭৩; মিশকাত হা/৫৮৬১।

[2]. মুসলিম হা/২২৭৬; ওয়াছেলাহ ইবনুল আসক্বা‘ হ’তে; মিশকাত হা/৫৭৪০ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল অধ্যায়।

[3]. আহমাদ, ছহীহ ইবনু হিববান, আবু উমামাহ হ’তে; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৫৪৫।


বংশধারা (شجرة النسب)

তাঁর বংশধারাকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। ১ম ভাগে মুহাম্মাদ (সাঃ) থেকে ঊর্ধ্বতন পুরুষ ‘আদনান পর্যন্ত ২২টি স্তর। যে ব্যাপারে কারু কোন দ্বিমত নেই। এর উপরে ২য় ভাগে ‘আদনান থেকে ইবরাহীম (আঃ) পর্যন্ত ৪১টি স্তর এবং তার উপরে তৃতীয় ভাগে ইবরাহীম (আঃ) থেকে আদম (আঃ) পর্যন্ত ১৯টি স্তর।[1] সর্বমোট ৮২টি স্তর। যেখানে নাম ও স্তরের ব্যাপারে বিদ্বানগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। আমরা নিম্নে ‘আদনান পর্যন্ত বংশধারা উল্লেখ করলাম। যেখানে কোন মতভেদ নেই এবং এতেও কোন মতভেদ নেই যে, ‘আদনান নবী ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশধর ছিলেন’।[2]


(১) মুহাম্মাদ বিন (২) আব্দুল্লাহ বিন (৩) আব্দুল মুত্ত্বালিব বিন (৪) হাশেম বিন (৫) ‘আবদে মানাফ বিন (৬) কুছাই বিন (৭) কিলাব বিন (৮) মুররাহ বিন (৯) কা‘ব বিন (১০) লুওয়াই বিন (১১) গালিব বিন (১২) ফিহর (লকব কুরায়েশ) বিন (১৩) মালেক বিন (১৪) নাযার বিন (১৫) কিনানাহ বিন (১৬) খুযায়মা বিন (১৭) মুদরেকাহ বিন (১৮) ইলিয়াস বিন (১৯) মুযার বিন (২০) নিযার বিন (২১) মা‘দ বিন (২২) ‘আদনান।[3]


এর মধ্যে পরদাদা হাশেম-এর নামে হাশেমী গোত্র এবং দ্বাদশতম পুরুষ ফিহর যার উপাধি ছিল কুরায়েশ, তাঁর নামানুসারে ‘কুরায়েশ’ বংশ প্রসিদ্ধি লাভ করে। কুরায়েশ অর্থ তিমি মাছ। যা হ’ল সাগরের বৃহত্তম ও অপরাজেয় প্রাণী (বায়হাক্বী, দালায়েল ১/১৮১ পৃঃ)। ইয়ামনের বাদশাহ হাসসান মক্কা আক্রমণ করে কা‘বা উঠিয়ে নিজ দেশে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। ফিহর তাকে যুদ্ধে হারিয়ে তিন বছর বন্দী করে রাখেন। অতঃপর মুক্তি দেন। হাসসান ইয়ামনে ফেরার পথে রাস্তায় মারা যান। এই ঘটনার পর থেকে ফিহর ‘আরবের কুরায়েশ’ (قُرَيْشُ الْعَرَبِ) বলে খ্যাতি লাভ করেন’।[4]


ইবনু কাছীর বলেন, আরবদের সকল গোত্র ‘আদনানে এসে জমা হয়েছে। যেকারণে আল্লাহ স্বীয় নবীকে বলেন, قُلْ لاَ أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلاَّ الْمَوَدَّةَ فِي الْقُرْبَى ‘তুমি বল, আমি আমার দাওয়াতের জন্য তোমাদের কাছে কোন বিনিময় চাইনা, কেবল আত্মীয়তাসূলভ ভালবাসা ব্যতীত’... (শূরা ৪২/২৩)। উক্ত আয়াত নাযিলের কারণ হিসাবে ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, لَمْ يَكُنْ بَطْنٌ مِنْ قُرَيْشٍ إِلاَّ وَلَهُ فِيهِ قَرَابَةٌ، فَنَزَلَتْ عَلَيْهِ إِلاَّ أَنْ تَصِلُوا قَرَابَةً بَيْنِى وَبَيْنَكُمْ ‘কুরায়েশদের এমন কোন গোত্র ছিল না, যার সাথে রাসূল (সাঃ)-এর আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল না। অতএব নাযিল হয়, তোমরা কেবল আত্মীয়তার সম্পর্ক ঠিক রাখ’।[5]


[1]. ছফিউর রহমান মুবারকপুরী, আর-রাহীকুল মাখতূম ৪৮-৪৯ পৃঃ; সুলায়মান মানছূরপুরী, রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২৫-৩১ পৃঃ; ইবনু হিশাম ১/১-৪; ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ ১/৭০ পৃঃ।-


الْجُزْءُ الْأَوَّلُ : هُوَ مُحَمّدُ بْنُ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَبْدِ الْمُطّلِبِ- اسْمُه شَيْبَةُ- بْنِ هَاشِمٍ- اسْمُه عَمْرُو- بْنِ عَبْدِ مَنَافِ- اسْمُه الْمُغِيرَةُ- بْنِ قُصَيٍّ- اسْمُه زَيْدُ- بْنِ كِلاَبِ بْنِ مُرَّةَ بْنِ كَعْبِ بْنِ لُؤَيِّ بْنِ غَالِبِ بْنِ فِهْرِ- الْمُلَقَّبُ بِقُرَيْشٍ- بْنِ مَالِكِ بْنِ النَّضْرِ- اسْمُه قَيْسٌ- بْنِ كِنَانَةَ بْنِ خُزَيْمَة َ بْنَ مُدْرِكَةَ- اسْمُه عَامِرُ- بْنِ إلْيَاسَ بْنِ مُضَرَبْنِ نِزَارِ بْنِ مَعْدِ بْنِ عَدْنَانَ- (زاد المعاد لابن القيم ১/৭০، سيرة ابن هشام ১/১-২، الرحيق المختوم ص ৪৮)-


الْجُزْءُ الثَّانِيُ : ما فوق عدنان، هو بْنُ أُدٍّ- او أُدَدُ- بن هَمَيْسَع بن سلامان بن عوص بن بوز بن قموال بن أُبَيّ بن عَوَّام بن ناشد بن حزا بن بلداس بن يدلاف بن طابخ بن جاحم بن ناحش بن ماخي بن عيض بن عبقر بن عبيد بن الدعا بن حمدان بن سَنْبَر بن يثربي بن يحزن بن يلحن بن أرعويِ بن عيض بن ديشان بن عِيْصَر بن أَفْنَاد بن أيهام بن مقصر بن ناحث بن زارح بن سمي بن مَزِّي بن عوضة بن عَرَّام بن قَيْدَار بن إِسْمَاعِيْلُ بن إِبْرَاهِيْمُ عليهما السلام- (قد جمع العلامة محمد سليمان المنصور فوري هذا الجزء من النسب برواية الكلبي وابن سعد بعد تحقيق دقيق. انظر رحمة للعالمين ২/ ১৪، ১৫، ১৬، ১৭ وفيه اختلاف كبير بين المصادر الةاريخية. (الرحيق ৪৮)-


الْجُزْءُ الثَّالِثُ : ما فوق إبراهيم عليه السلام، وهو ابن تارح- واسمه آزر- بن ناحور بن ساروع- أو ساروغ- بن راعو بن فَالَخ بن عابر بن شالخ بن أَرْفَخْشَد بن سام بن نوح- عليه السلام- بن لامك بن مَتَوَشْلَخ بن أخنوخ- يقال هو إدريس عليه السلام- ابن يَرْد بن مَهْلائيل بن قَيْنَان بن يَانِشَ بن شِيْث بن آدم عليهما السلام- (ابن هشام ১/ ২، ৩، ৪، تلقيح فهوم أهل الأثر ص ৬، خلاصة السير للطبري ص ৬، ورحمة للعالمين ২/ ১৮ واختلفت هذه المصادر في تلفظ بعض هذه الأسماء، وكذا سقط من بعض المصادر بعض الأسماء- (الرحيق ৪৯ حاشية-১)


[2]. যাদুল মা‘আদ ১/৭০; ইবনু কাছীর, সীরাতুর রাসূল (সাঃ) ১৩ পৃঃ।

[3]. বুখারী, ‘আনছারদের মর্যাদা’ অধ্যায়, ২৮ অনুচ্ছেদ ‘নবী (সাঃ)-এর আগমন’।


প্রসিদ্ধ আছে যে, রাসূল (সাঃ) স্বীয় বংশধারা বর্ণনার ক্ষেত্রে ‘আদনান পর্যন্ত উল্লেখ করার পর উপরের স্তরসমূহের ব্যাপারে চুপ থাকতেন এবং বলতেন, كَذَبَ النَّسَّابُونَ ‘বংশবিদরা মিথ্যা বলেছে’ (আর-রাহীক্ব ২০ পৃঃ)। বর্ণনাটি ‘মওযূ’ বা জাল (আলবানী, সিলসিলা যঈফাহ হা/১১১)।


[4]. মানছূরপুরী, রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/৫৯ পৃঃ।

[5]. বুখারী হা/৩৪৯৭; ইবনু কাছীর, সীরাতুর রাসূল (সাঃ) ১৩ পৃঃ।


আব্দুল্লাহ্র মৃত্যু (وفاة عبد الله)

পিতা আব্দুল্লাহ ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে তদীয় পিতা আব্দুল মুত্ত্বালিবের হুকুমে ইয়াছরিব (মদীনা) গেলে সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মাত্র ২৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। সেখানে তিনি নাবেগা জা‘দীর গোত্রে সমাধিস্থ হন। এভাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্মের পূর্বে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়ে যায়। উল্লেখ্য যে, মদীনার বনু নাজ্জার গোত্রে আব্দুল মুত্ত্বালিবের পিতা হাশেম বিবাহ করেন। ফলে তারা ছিলেন আব্দুল মুত্ত্বালিবের নানার গোষ্ঠী।


মৃত্যুকালে আব্দুল্লাহ যেসব সহায়-সম্পদ রেখে গিয়েছিলেন তা ছিল যথাক্রমে পাঁচটি উট, এক পাল ছাগল এবং একটি নাবালিকা হাবশী দাসী বারাকাহ ওরফে উম্মে আয়মান। যিনি রাসূল (সাঃ)-কে শিশুকালে লালন-পালন করেন। ইনি পরে যায়েদ বিন হারেছার সাথে বিবাহিতা হন এবং উসামা বিন যায়েদ তাঁর পুত্র ছিলেন। তিনি রাসূল (সাঃ)-এর মৃত্যুর পাঁচ মাস পরে মৃত্যুবরণ করেন’।[1]

[1]. আর-রাহীক্ব ৫৩ পৃঃ; আল-ইস্তী‘আব; মুসলিম হা/১৭৭১।


হাশেম ও হাশেমী বংশ (هاشم وبنو هاشم)

নবী (সাঃ)-এর বংশ হাশেমী বংশ হিসাবে পরিচিত। যা তাঁর দাদা হাশেম বিন ‘আব্দে মানাফের দিকে সম্পর্কিত। হাশেম পূর্ব থেকেই ‘সিক্বায়াহ’ ও ‘রিফাদাহ’ অর্থাৎ হাজীদের পানি পান করানো ও মেহমানদারীর দায়িত্বে ছিলেন। হাশেম ছিলেন ধনী ও উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি। তিনিই প্রথম কুরায়েশদের জন্য শীতকালে ইয়ামানে ও গ্রীষ্মকালে শামে দু’টি ব্যবসায়িক সফরের নিয়ম চালু করেন। তিনি এক ব্যবসায়িক সফরে শাম যাওয়ার পথে মদীনায় যাত্রা বিরতি করেন এবং সেখানে বনু ‘আদী বিন নাজ্জার গোত্রে সালমা বিনতে আমরকে বিবাহ করেন। অতঃপর সেখানে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে রেখে ফিলিস্তীনের গাযায় চলে যান এবং সেখানে মৃত্যুবরণ করেন। এদিকে তার স্ত্রী একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেন ৪৯৭ খ্রিষ্টাব্দে (আর-রাহীক্ব ৪৯ পৃঃ)। সাদা চুল নিয়ে ভূমিষ্ট হওয়ার কারণে মা তার নাম রাখেন শায়বাহ (شَيْبَةٌ)। এভাবে তিনি ইয়াছরিবে মায়ের কাছে প্রতিপালিত হন। মক্কায় তার পরিবারের লোকেরা যা জানতে পারেনি। যৌবনে পদার্পণের কাছাকাছি বয়সে উপনীত হ’লে তার জন্মের খবর জানতে পেরে চাচা কুরায়েশ নেতা মুত্ত্বালিব বিন ‘আব্দে মানাফ তাকে মক্কায় নিয়ে আসেন। লোকেরা তাকে মুত্ত্বালিবের ক্রীতদাস মনে করে তাকে ‘আব্দুল মুত্ত্বালিব’ বলেছিল। সেই থেকে তিনি উক্ত নামে পরিচিত হন। যদিও তাঁর আসল নাম ছিল ‘শায়বাহ’ অর্থ ‘সাদা চুল ওয়ালা’ (ইবনু হিশাম ১/১৩৭-৩৮)।


মুত্ত্বালিব ও আব্দুল মুত্ত্বালিব (المطلب وعبد المطلب)

ইয়ামনের ‘বিরাদমান’ (بِرَدْمَانَ) এলাকায় চাচা গোত্রনেতা মুত্ত্বালিব পরলোক গমন করলে ভাতিজা আব্দুল মুত্ত্বালিব তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন (ইবনু হিশাম ১/১৩৮, ১৪২)। কালক্রমে আব্দুল মুত্ত্বালিব নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে এত উঁচু মর্যাদা লাভ করেন যে, তাঁর পিতা বা পিতামহ কেউই উক্ত মর্যাদায় পৌঁছতে পারেননি। সম্প্রদায়ের লোকেরা সবাই তাঁকে আন্তরিকভাবে ভালোবাসত ও সমীহ করে চলত’ (ইবনু হিশাম ১/১৪২)।


আব্দুল মুত্ত্বালিবের উচ্চ মর্যাদা লাভের অন্যতম কারণ ছিল আল্লাহর পক্ষ হ’তে স্বপ্নযোগে তাঁকে ‘যমযম’ কূয়া খননের দায়িত্ব প্রদান করা এবং তাঁর নেতৃত্বকালে আল্লাহর বিশেষ রহমতে ইয়ামনের খ্রিষ্টান গবর্ণর ‘আবরাহা’ কর্তৃক কা‘বা আক্রমণ ব্যর্থ হওয়া। এই মর্যাদা তাঁর বংশের পরবর্তী নেতা আবু ত্বালিব-এর যুগেও অব্যাহত ছিল। যা রাসূল (সাঃ)-এর আগমনে আরও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্ব মর্যাদায় উন্নীত হয়।


 আব্দু মানাফ, হাশেম ও আব্দুল মুত্ত্বালিব (عبد مناف، هاشم وعبد المطلب)

কুছাই-পুত্র আব্দু মানাফের প্রকৃত নাম ছিল মুগীরাহ। তাঁর ৪টি পুত্র সন্তান ছিল : হাশেম, প্রকৃত নাম আমর। আব্দু শাম্স, মুত্ত্বালিব ও নওফাল। হাশেম ও মুত্ত্বালিবকে সৌন্দর্যের কারণে ‘দুই পূর্ণচন্দ্র’ (الْبَدْرَان) বলা হ’ত (ইবনুল আছীর)। হাশেমের ৪ পুত্র ছিল : আব্দুল মুত্ত্বালিব, আসাদ, আবু ছায়ফী ও নাযলাহ। আব্দুল মুত্ত্বালিবের ছিল ১০টি পুত্র ও ৬টি কন্যা। পুত্রগণের মধ্যে আববাস, হামযাহ, আব্দুল্লাহ, আবু ত্বালিব, যুবায়ের, হারেছ, হাজলা, মুক্বাউভিম, যেরার ও আবু লাহাব। কন্যাদের মধ্যে ছাফিয়া, বায়যা, আতেকাহ, উমাইমাহ, আরওয়া ও বার্রাহ’। ভাষ্যকার সুহায়লী বলেন, যুবায়ের ছিলেন রাসূল (সাঃ)-এর বড় চাচা। তাঁর ছেলে আব্দুল্লাহ ছাহাবী ছিলেন। তাঁর সমর্থনেই নবুঅত লাভের ২০ বছর পূর্বে ‘হিলফুল ফুযূল’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে’ (ইবনু হিশাম ১/১০৬-০৮, ১/১৩৩ টীকা-১)। তবে ইবনু ইসহাক বলেন, স্বপ্নে আদেশ প্রাপ্ত হয়ে যমযম কূপ খননের সময় আব্দুল মুত্ত্বালিবের সাথে তাঁর পুত্র হারেছ ছিলেন। কারণ তিনি ব্যতীত তখন তাঁর অন্য কোন পুত্র সন্তান ছিল না’ (ইবনু হিশাম ১/১৪৩)। এতে বুঝা যায় যে, হারেছ-ই আব্দুল মুত্ত্বালিবের প্রথম পুত্র ছিলেন।


আবু ত্বালিব (ابو طالب)

আবু ত্বালিবের নাম ছিল আব্দু মানাফ। কিন্তু তিনি আবু ত্বালিব নামেই প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তাঁর ৪ পুত্র ও ২ কন্যা ছিল : ত্বালিব, ‘আক্বীল, জা‘ফর ও আলী। ত্বালিব ‘আক্বীলের চাইতে দশ বছরের বড় ছিলেন।[1] তাঁর মৃত্যুর অবস্থা জানা যায় না। বাকী সকলেই ছাহাবী ছিলেন। দুই কন্যা উম্মে হানী ও জুমানাহ দু’জনেই ইসলাম কবুল করেন’ (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/৭৫-৮৩ পৃঃ)। আব্দুল মুত্ত্বালিবের পরে আবু ত্বালিব বনু হাশিমের নেতা হন। তিনি আমৃত্যু রাসূল (সাঃ)-এর অকৃত্রিম অভিভাবক ছিলেন। তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে বয়কটকালের তিন বছরসহ সর্বদা বনু মুত্ত্বালিব ও বনু হাশিম রাসূল (সাঃ)-এর সহযোগী ছিলেন। যদিও আবু ত্বালিব ও অন্য অনেকে ইসলাম কবুল করেন নি।


রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আপন চাচাদের মধ্যে তিন ধরনের মানুষ ছিলেন। ১. যারা তাঁর উপরে ঈমান এনেছিলেন ও তাঁর সাথে জিহাদ করেছিলেন। যেমন হামযাহ ও আববাস (রাঃ)। ২. যারা তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু জাহেলিয়াতের উপর মৃত্যুবরণ করেন। যেমন আবু ত্বালিব। ৩. যারা শুরু থেকে মৃত্যু অবধি শত্রুতা করেন। যেমন আবু লাহাব। উল্লেখ্য যে, আবু সুফিয়ান ছিলেন বনু ‘আব্দে শামস গোত্রের, আবু জাহল ছিলেন বনু মাখযূম গোত্রের এবং উমাইয়া বিন খালাফ ছিলেন বনু জুমাহ গোত্রের। যদিও সকলেই ছিলেন কুরায়েশ বংশের অন্তর্ভুক্ত এবং সবাই ছিলেন রাসূল (সাঃ)-এর সম্পর্কীয় চাচা।


[1]. ইবনু সা‘দ ১/৯৭। উল্লেখ্য যে, আলী (রাঃ)-এর বড় ভাই ত্বালিব বিন আবু ত্বালিব বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও জনৈক কুরায়েশ নেতার সাথে বাদানুবাদের প্রেক্ষিতে প্রত্যাবর্তনকারীদের সাথে মক্কায় ফিরে যান (ইবনু হিশাম ১/৬১৯)। তিনি বদরের যুদ্ধে বিজয় লাভে রাসূল (সাঃ)-এর প্রশংসা করে এবং নিহত নেতাদের স্মরণে শোক প্রকাশ করে কবিতা বলেন’ (ইবনু হিশাম ২/২৬)। ইবনু সা‘দ বলেন, অন্যান্যদের সাথে তিনিও বদর যুদ্ধে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। অতঃপর যখন কুরায়েশরা পরাজিত হয়, তখন তাঁকে নিহত বা বন্দীদের মধ্যে পাওয়া যায়নি। তিনি মক্কায়ও ফিরে যাননি। তাঁর কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাঁর কোন সন্তানাদিও ছিল না’ (ইবনু সা‘দ ১/৯৭)। অতএব তিনি ঈমান এনে মৃত্যুবরণ করেছিলেন কি না, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।


খাৎনা ও নামকরণ (الخةان والعقيقة)

প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী সপ্তম দিনে নবজাতকের খাৎনা ও নামকরণ করা হয়।[1] পিতৃহীন নবজাতককে কোলে নিয়ে স্নেহশীল দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব কা‘বাগৃহে প্রবেশ করেন। তিনি সেখানে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন ও প্রাণভরে দো‘আ করেন। আকীকার দিন সমস্ত কুরায়েশ বংশের লোককে দাওয়াত করে খাওয়ান। সকলে জিজ্ঞেস করলে তিনি বাচ্চার নাম বলেন, ‘মুহাম্মাদ’। এই অপ্রচলিত নাম শুনে লোকেরা বিস্ময়ভরে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি চাই যে, আমার বাচ্চা সারা দুনিয়ায় ‘প্রশংসিত’ হৌক (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/৪১)। ওদিকে স্বপ্নের মাধ্যমে ফেরেশতার দেওয়া প্রস্তাব অনুযায়ী মা আমেনা তার নাম রাখেন ‘আহমাদ’ (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/৩৯)। উভয় নামের অর্থ প্রায় একই। অর্থাৎ ‘প্রশংসিত’ এবং ‘সর্বাধিক প্রশংসিত’।[2]


[1]. যাদুল মা‘আদ ১/৮০-৮১। খাৎনা ও আক্বীক্বা করার বিষয়টি যে আরবদের মাঝে পূর্ব থেকেই প্রচলিত ছিল, তা ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত (বুখারী হা/৭, আবুদাঊদ হা/২৮৪৩)। তবে রাসূল (সাঃ)-এর খাৎনা যে সপ্তম দিনেই হয়েছিল (আর-রাহীক্ব ৫৪ পৃঃ) একথার কোন প্রমাণ নেই (ঐ, তা‘লীক্ব ৩৯-৪৪ পৃঃ)। ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ)-এর খাৎনা সম্পর্কে তিনটি কথা চালু আছে। ১. তিনি খাৎনা ও নাড়ি কাটা অবস্থায় ভূমিষ্ট হয়েছিলেন। ইবনুল জাওযী এটাকে মওযূ‘ বা জাল বলেছেন। ২. হালীমার গৃহে থাকার সময় প্রথম বক্ষবিদারণকালে ফেরেশতা জিব্রীল তাঁর খাৎনা করেন। ৩. দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব তাঁকে সপ্তম দিনে খাৎনা করান ও নাম রাখেন এবং লোকজনকে দাওয়াত করে খাওয়ান। এগুলি সম্পর্কে যেসব বর্ণনা এসেছে, তার কোনটিই ছহীহ নয়। এ বিষয়ে বিপরীতমুখী দু’জন মুহাক্কিকের একজন কামালুদ্দীন বিন ‘আদীম বলেন, আরবদের রীতি অনুযায়ী তাঁকে খাৎনা করা হয়েছিল। এটি এমন একটি রীতি, যা প্রমাণের জন্য কোন নির্দিষ্ট বর্ণনার প্রয়োজন নেই’ (যাদুল মা‘আদ ১/৮০-৮১)।


[2]. উভয় নামই কুরআনে এসেছে। যেমন ‘মুহাম্মাদ’ নাম এসেছে চার জায়গায়। যথাক্রমে- সূরা আলে ইমরান ৩/১৪৪, আহযাব ৩৩/৪০; মুহাম্মাদ ৪৭/২ এবং ফাৎহ ৪৮/২৯। তাছাড়া ‘মুহাম্মাদ’ নামেই একটি সূরা নাযিল হয়েছে সূরা মুহাম্মাদ (৪৭ নং সূরা)। অনুরূপভাবে ‘আহমাদ’ নাম এসেছে এক জায়গায় (ছফ ৬১/৬)।


সীরাতে ইবনু হিশামের ভাষ্যকার সুহায়লী (মৃ. ৫৮১ হি.) বলেন, ঐ সময় সারা আরবে মাত্র তিনজন ব্যতীত অন্য কারু নাম ‘মুহাম্মাদ’ ছিল বলে জানা যায় না। যাদের প্রত্যেকের পিতা তার পুত্র আখেরী নবী হবেন বলে ভবিষ্যদ্বাণী করে যান। যাদের একজন হ’লেন বিখ্যাত উমাইয়া কবি ফারাযদাক্ব (৩৮-১১০ হি.)-এর প্রপিতামহ মুহাম্মাদ বিন সুফিয়ান বিন মুজাশি‘। অন্যজন হলেন মুহাম্মাদ বিন উহাইহাহ বিন জুলাহ। আরেকজন হলেন মুহাম্মাদ বিন হুমরান বিন রাবী‘আহ। এদের পিতারা বিভিন্ন সম্রাটের দরবারে গিয়ে জানতে পারেন যে, আখেরী নবী হেজাযে জন্মগ্রহণ করবেন। ফলে তারা মানত করে যান যে, তাদের পুত্র সন্তান হ’লে যেন তার নাম ‘মুহাম্মাদ’ রাখা হয় (ইবনু হিশাম ১/১৫৮ -টীকা-১)।


রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নাম সমূহ

জুবাইর বিন মুত্ব‘ইম (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেন, إِنَّ لِى أَسْمَاءً أَنَا مُحَمَّدٌ وَأَنَا أَحْمَدُ وَأَنَا الْمَاحِى الَّذِى يَمْحُو اللهُ بِىَ الْكُفْرَ وَأَنَا الْحَاشِرُ الَّذِى يُحْشَرُ النَّاسُ عَلَى قَدَمَىَّ وَأَنَا الْعَاقِبُ الَّذِى لَيْسَ بَعْدَهُ أَحَدٌ- ‘আমার অনেকগুলি নাম রয়েছে। আমি মুহাম্মাদ (প্রশংসিত), আমি আহমাদ (সর্বাধিক প্রশংসিত), আমি ‘মাহী’ (বিদূরিতকারী)। আমার মাধ্যমে আল্লাহ কুফরীকে বিদূরিত করেছেন। আমি ‘হাশের’ (জমাকারী)। কেননা সমস্ত লোক ক্বিয়ামতের দিন আমার কাছে জমা হবে (এবং শাফা‘আতের জন্য অনুরোধ করবে)। আমি ‘আক্বেব’ (সর্বশেষে আগমনকারী)। আমার পরে আর কোন নবী নেই’।[1] সুলায়মান মানছূরপুরী বলেন, উক্ত নাম সমূহের মধ্যে মুহাম্মাদ ও আহমাদ হ’ল তাঁর মূল নাম এবং বাকীগুলো হ’ল তাঁর গুণবাচক নাম। সেজন্য তিনি সেগুলির ব্যাখ্যা করেছেন। এই গুণবাচক নামের সংখ্যা মানছূরপুরী গণনা করেছেন ৫৪টি। তিনি ৯২টি করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন।[2]


‘মুহাম্মাদ’ নামের প্রশংসায় চাচা আবু তালিব বলতেন,


وَشَقَّ لَهُ مِنَ اسْمِهِ لِيُجِلَّهُ + فَذُو الْعَرْشِ مَحْمُودٌ وَهَذَا مُحَمَّدُ


‘তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য আল্লাহ নিজের নাম থেকে তার নাম বের করে এনেছেন। তাই আরশের মালিক হ’লেন মাহমূদ এবং ইনি হ’লেন মুহাম্মাদ’।[3]

[1]. বুখারী হা/৪৮৯৬; মুসলিম হা/২৩৫৪; মিশকাত হা/৫৭৭৬-৭৭, ‘ফাযায়েল’ অধ্যায় ‘রাসূল (সাঃ)-এর নাম সমূহ’ অনুচ্ছেদ।

[2]. মানছূরপুরী, রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ৩/১৯৮ পৃঃ।

[3]. বুখারী, তারীখুল আওসাত্ব ১/১৩ (ক্রমিক ৩১); যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ১/১৫৩। উল্লেখ্য যে, উক্ত কবিতাটি হাসসান বিন ছাবিত আনছারী (রাঃ)ও তার দীওয়ানের মধ্যে যুক্ত করেছেন (দীওয়ানে হাসসান পৃঃ ৪৭)।


লালন-পালন

জন্মের পর শিশু মুহাম্মাদ কিছুদিন চাচা আবু লাহাবের দাসী ছুওয়াইবার দুধ পান করেন। তাঁর পূর্বে চাচা হামযা বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব এবং তাঁর পরে আবু সালামাহ তার দুধ পান করেন।[1] ফলে তাঁরা সকলে পরস্পরে দুধভাই ছিলেন।


এ সময় পিতা আব্দুল্লাহ্র রেখে যাওয়া একমাত্র মুক্তদাসী উম্মে আয়মন রাসূল (সাঃ)-কে শৈশবে লালন-পালন করেন। এরপর ধাত্রী হালীমা সা‘দিয়াহ তাঁকে প্রতিপালন করেন। অতঃপর হালীমার গৃহ থেকে আসার পর মা আমেনা তাকে সাথে নিয়ে মদীনায় স্বামীর কবর যিয়ারত করতে যান এবং ফেরার পথে মৃত্যুবরণ করলে কিশোরী উম্মে আয়মন শিশু মুহাম্মাদকে সাথে নিয়ে মক্কায় ফেরেন। পরে খাদীজা (রাঃ)-এর মুক্তদাস যায়েদ বিন হারেছাহ্র সাথে তার বিয়ে হয়। অতঃপর তার গর্ভে উসামা বিন যায়েদের জন্ম হয়। রাসূল (সাঃ) উম্মে আয়মানকে ‘মা’ (يَا أُمَّهْ) বলে সম্বোধন করতেন এবং নিজ পরিবারভুক্ত (بَقِيَّةُ أَهْلِ بَيْتِي) বলতেন। তিনি তাকে ‘মায়ের পরে মা’ (أُمِّي بَعْدَ أُمِّي) বলে সম্মানিত করতেন।[2]


সে সময়ে শহরবাসী আরবদের মধ্যে এই ধারণা প্রচলিত ছিল যে, শহরের জনাকীর্ণ পংকিল পরিবেশ থেকে দূরে গ্রামের নিরিবিলি উন্মুক্ত পরিবেশে শিশুদের লালন-পালন করলে তারা বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি হ’তে মুক্ত থাকে এবং তাদের স্বাস্থ্য সুঠাম ও সবল হয়। সর্বোপরি তারা বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত হয়। সে হিসাবে দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত ধাত্রী হিসাবে পরিচিত বনু সা‘দ গোত্রের হালীমা সা‘দিয়াহকে নির্বাচন করেন এবং তার হাতেই প্রাণাধিক পৌত্রকে সমর্পণ করেন। হালীমার গৃহে দু’বছর দুগ্ধপানকালীন সময়ে তাদের পরিবারে সচ্ছলতা ফিরে আসে। তাদের ছাগপালে এবং অন্যান্য সকল বিষয়ে আল্লাহর তরফ থেকে বরকত নেমে আসে। নিয়মানুযায়ী দু’বছর পরে বাচ্চাকে ফেরত দেওয়ার জন্য তাঁকে মা আমেনার কাছে আনা হয়। কিন্তু হালীমা তাকে ছাড়তে চাচ্ছিলেন না। তিনি আমেনাকে বারবার অনুরোধ করেন আরও কিছুদিন বাচ্চাকে তার কাছে রাখার জন্য। ঐ সময় মক্কায় মহামারী দেখা দিয়েছিল। ফলে মা রাযী হয়ে যান এবং বাচ্চাকে পুনরায় হালীমার কাছে অর্পণ করেন (আর-রাহীক্ব ৫৬ পৃঃ)।


[1]. আল-ইছাবাহ, ছুওয়াইবাহ ক্রমিক ১০৯৬৪; ইবনু হিশাম ২/৯৬।

[2]. আল-ইছাবাহ, উম্মে আয়মন ক্রমিক সংখ্যা ১১৮৯৮; ঐ, আল-ইস্তী‘আবসহ (কায়রো ছাপা : ক্রমিক সংখ্যা ১১৪১, ১৩/১৭৭-৮০ পৃঃ, ১৩৯৭/১৯৭৭ খ্রিঃ)।


প্রসিদ্ধ আছে যে, যায়েদ বিন হারেছাহ তেহামার বনু ফাযারাহ কর্তৃক বন্দী হয়ে ওকায বাজারে বিক্রয়ের জন্য নীত হন। সেখান থেকে হাকীম বিন হিযাম তার ফুফু খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ-এর জন্য তাকে খরীদ করেন। রাসূল (সাঃ) নবী হওয়ার পূর্বে তার সম্পর্কে স্বপ্ন দেখেন। অতঃপর খাদীজার সাথে বিবাহের পর তিনি তাকে তাঁর উদ্দেশ্যে হেবা করে দেন।... সেখানে এ কথাও আছে যে, যায়েদের পিতা হারেছাহ এবং তার চাচাসহ পরিবারের কিছু লোক তাকে নেওয়ার জন্য আসেন। তখন আল্লাহর নবী যায়েদকে তার পিতার সঙ্গে যাওয়ার এখতিয়ার দেন’ (ইবনু সা‘দ ৩/৪২)। ইবনু হাজার বলেন, বর্ণনাটি ‘খুবই অপরিচিত’ (منكر جدا)। (মা শা-‘আ ২৩ পৃঃ)।


উল্লেখ্য যে, যায়েদ বিন হারেছাহ তার পিতার ৩ সন্তান জাবালাহ, আসমা ও যায়েদ-এর মধ্যে তৃতীয় ও কনিষ্ঠ ছিলেন। এক সময় যায়েদ হারিয়ে যান। পিতা তার জন্য কেঁদে আকুল হন। পরে রাসূল (সাঃ) তাকে লালন-পালন করেন এবং তিনি ‘মুহাম্মাদের পুত্র’ (زَيْدُ ابْنُ مُحَمَّدٍ) হিসাবে পরিচিত হন (বুখারী হা/৪৭৮২)। পরবর্তীতে সন্ধান পেয়ে তার বড় ভাই জাবালাহ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট আসেন এবং বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! যায়েদকে আমার সাথে পাঠিয়ে দিন। তিনি বললেন, এই তো যায়েদ। তুমি ওকে নিয়ে যাও। আমি মানা করব না। তখন যায়েদ বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার উপর কাউকে প্রাধান্য দিব না। জাবালাহ বলেন, (পরবর্তীতে) আমি দেখলাম আমার ভাইয়ের সিদ্ধান্ত আমার চাইতে উত্তম ছিল’ (হাকেম হা/৪৯৪৭-৪৮; তিরমিযী হা/৩৮১৫; মিশকাত হা/৬১৬৫)।


বক্ষ বিদারণ (شق الصدر)

দ্বিতীয় দফায় হালীমার নিকটে আসার পর জন্মের চতুর্থ কিংবা পঞ্চম বছরে শিশু মুহাম্মাদের সীনা চাক বা বক্ষ বিদারণের বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। ব্যাপারটি ছিল এই যে, মুহাম্মাদ তার সাথীদের সাথে খেলছিলেন। এমন সময় জিবরাঈল ফেরেশতা এসে তাকে কিছু দূরে নিয়ে বুক চিরে ফেলেন। অতঃপর কলীজা বের করে যমযমের পানি দিয়ে ধুয়ে কিছু জমাট রক্ত ফেলে দেন এবং বলেন,هَذَا حَظُّ الشَّيْطَانِ مِنْكَ ‘এটি তোমার মধ্যেকার শয়তানের অংশ’। অতঃপর বুক পূর্বের ন্যায় জোড়া লাগিয়ে দিয়ে তিনি অদৃশ্য হয়ে যান। পুরা ব্যাপারটি খুব দ্রুত সম্পন্ন হয়। সাথী বাচ্চারা ছুটে গিয়ে হালীমাকে খবর দিল যে, মুহাম্মাদ নিহত হয়েছে। তিনি ছুটে এসে দেখেন যে, মুহাম্মাদ মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে’।[1] হালীমা তাকে বুকে তুলে বাড়ীতে এনে সেবা-যত্ন করতে থাকেন। এই অলৌকিক ঘটনায় হালীমা ভীত হয়ে পড়েন এবং একদিন তাঁকে তার মায়ের কাছে ফেরত দিয়ে যান। তখন তার বয়স ছিল ছয় বছর। তাঁর দ্বিতীয়বার বক্ষবিদারণ হয় মি‘রাজে গমনের পূর্বে মক্কায়।[2]


[1]. মুসলিম হা/১৬২, আনাস (রাঃ) হ’তে; মিশকাত হা/৫৮৫২ ‘নবুঅতের নিদর্শন সমূহ’ অনুচ্ছেদ।

[2]. বুখারী হা/৩৮৮৭, ৩৪৯; মুসলিম হা/১৬৪, ১৬৩; মিশকাত হা/৫৮৬২, ৫৮৬৪, ‘মি‘রাজ’ অনুচ্ছেদ।


বক্ষবিদারণ পর্যালোচনা (بحث فى شق الصدر)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বক্ষবিদারণ সম্পর্কে শী‘আগণ ও অন্যান্য আপত্তিকারীগণ মূলতঃ তিনটি প্রশ্ন উত্থাপন করে থাকেন। (১) বক্ষবিদারণের ঘটনাটি মানব প্রকৃতির বিরোধী (২) এটি জ্ঞান ও যুক্তি বিরোধী (৩) এটি আল্লাহর সৃষ্টিবিধান পরিবর্তনের শামিল।


এর জবাবে বলা যায় : (১) শৈশবে বক্ষবিদারণের বিষয়টি ভবিষ্যত নবুঅতের আগাম নিদর্শন। (২) শৈশবে ও মি‘রাজ গমনের পূর্বে বক্ষবিদারণের ঘটনা অন্ততঃ ২৫ জন ছাহাবী কর্তৃক অবিরত ধারায় বর্ণিত ছহীহ হাদীছসমূহ দ্বারা প্রমাণিত (ইবনু কাছীর, তাফসীর ইসরা ১ আয়াত)। অতএব এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। (৩) যাবতীয় মানবীয় কলুষ থেকে পরিচ্ছন্ন করা। যাকে ‘শয়তানের অংশ’ বলা হয়েছে। এটা তাঁর জন্য খাছ এবং পৃথক একটি বৈশিষ্ট্য। (৪) প্রত্যেক নবীরই কিছু মু‘জেযা থাকে। সে হিসাবে এটি শেষনবী (সাঃ)-এর বিশেষ মু‘জেযা সমূহের অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে মানবীয় জ্ঞানের কোন প্রবেশাধিকার নেই। (৫) শেষনবী ও শ্রেষ্ঠনবী হিসাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহর সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে ও বিশেষ ব্যবস্থাধীনে পরিচালিত ছিলেন। অতএব বক্ষবিদারণের ঘটনা সাধারণ মানবীয় রীতির বিরোধী হ’লেও তা আল্লাহর অনন্য সৃষ্টি কৌশলের অধীন। যেমন শিশুকালে মূসা (আঃ) সাগরে ভেসে গিয়ে ফেরাঊনের গৃহে লালিত-পালিত হন’ (ত্বোয়াহা ২০/৩৮-৩৯)। ঈসা (আঃ) মাতৃক্রোড়ে স্বীয় সম্প্রদায়ের সাথে বাক্যালাপ করেন’ (মারিয়াম ১৯/৩০-৩৩) ইত্যাদি।


দুঃখের বিষয় স্কটিশ প্রাচ্যবিদ উইলিয়াম মূর (১৮১৯-১৯০৫) তাঁর লিখিত নবীজীবনী Life of Mahomet (1857 & 1861) গ্রন্থে বক্ষবিদারণের এ ঘটনাটিকে মূর্ছা (Epilepsy) রোগের ফল বলেছেন। শৈশব থেকেই এ রোগগ্রস্ত হওয়ার কারণে তিনি মাঝে-মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়তেন। অতঃপর সেই বিকারের মধ্যে তিনি মনে করতেন যে, আল্লাহর নিকট থেকে তিনি বাণী প্রাপ্ত হয়েছেন (নাঊযুবিল্লাহ)।[1] জার্মান প্রাচ্যবিদ ড. স্প্রেঙ্গার (১৮১৩-১৮৯৩) আরেকটি অদ্ভুত তথ্য পেশ করেছেন যে, অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় বিবি আমেনার কণ্ঠদেশে ও বাহুতে এক এক খন্ড লোহা ঝুলানো ছিল’। এর দ্বারা তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, তিনি মৃগীরোগী ছিলেন’ (ঐ, ২৪০ পৃঃ)।


উইলিয়াম মূর মুহাম্মাদকে চঞ্চলমতি প্রমাণ করার জন্য একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন যে, ‘পাঁচ বছর বয়সে মায়ের নিকট রেখে যাওয়ার জন্য হালীমা তাকে নিয়ে মক্কায় আসছিলেন। কাছাকাছি আসার পর বালকটি হঠাৎ হালীমার সঙ্গছাড়া হয়ে উধাও হয়ে যায়। তখন আব্দুল মুত্ত্বালিব তার কোন ছেলেকে পাঠিয়ে দেখেন যে, বালকটি এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারপর তিনি তাঁকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যান’। কেবল মূর নন বৃটিশ প্রাচ্যবিদ স্যামুয়েল মার্গোলিয়থ (১৮৫৮-১৯৪০) লিখেছেন, পিতৃহীন এই বালকের অবস্থা মোটেও প্রীতিকর ছিল না। মুহাম্মাদের শেষ বয়সে তাঁর চাচা হামযা (মাতাল অবস্থায়) তাকে নিজ পিতার দাস বলে বিদ্রুপ করেছিলেন’ (ঐ, ২৫৮-৫৯ পৃঃ)। মাওলানা আকরম খাঁ (১৮৬৮-১৯৬৮) বলেন, এই শ্রেণীর বিদ্বেষ-বিষ জর্জরিত অসাধু লোকদিগের কথার প্রতিবাদ করিয়া শ্রম ও সময়ের অপব্যয় করা উচিৎ নহে’ (ঐ, ২৪০ পৃঃ)।

[1]. মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মোস্তফা চরিত (ঢাকা : ঝিনুক পুস্তিকা ১৯৭৫), ২৫০ পৃঃ।


আমেনার ইয়াছরিব গমন ও মৃত্যুবরণ (رحلة إلى يثرب ووفاة آمنة)

প্রাণাধিক সন্তানকে কাছে পেয়ে আমেনা তার প্রাণপ্রিয় স্বামীর কবর যেয়ারত করার মনস্থ করেন। শ্বশুর আব্দুল মুত্ত্বালিব সব ব্যবস্থা করে দেন। সেমতে পুত্র মুহাম্মাদ ও পরিচারিকা উম্মে আয়মনকে সাথে নিয়ে তিনি মক্কা থেকে প্রায় ৪৬০ কিঃ মিঃ উত্তরে মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। অতঃপর যথাসময়ে মদীনায় পৌঁছে নাবেগা আল-জা‘দীর পারিবারিক গোরস্থানে স্বামীর কবর যেয়ারত করেন। অতঃপর সেখানে এক মাস বিশ্রাম নেন। এরপর পুনরায় মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। কিন্তু কিছু দূর এসেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ‘আবওয়া’ (الأَبْوَاء) নামক স্থানে মৃত্যুবরণ করেন। যা বর্তমানে মদীনা থেকে মক্কার পথে ২৫০ কিঃ মিঃ দূরে অবস্থিত একটি শহরের নাম। উম্মে আয়মন শিশু মুহাম্মাদকে মক্কায় নিয়ে আসেন। এভাবে জন্ম থেকে পিতৃহারা ইয়াতীম মুহাম্মাদ মাত্র ৬ বছর বয়সে মাতৃহারা হ’লেন (ইবনু হিশাম ১/১৬৮)।


দাদার স্নেহনীড়ে মুহাম্মাদ (محمد إلى جده العطوف)

পিতৃ-মাতৃহীন ইয়াতীম মুহাম্মাদ এবার এলেন প্রায় ৮০ বছরের বৃদ্ধ দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিবের স্নেহনীড়ে। আব্দুল মুত্ত্বালিব নিজেও ছিলেন জন্ম থেকে ইয়াতীম। সেই শিশুকালের ইয়াতীম আব্দুল মুত্ত্বালিব আজ বৃদ্ধ বয়সে নিজ ইয়াতীম পৌত্রের অভিভাবক হন। কিন্তু এ স্নেহনীড় বেশী দিন স্থায়ী হয়নি।


মাত্র দু’বছর পরে শিশু মুহাম্মাদের বয়স যখন ৮ বছর, তখন তার দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব ৮২ বছর বয়সে মক্কায় ইন্তেকাল করেন। ফলে তাঁর অছিয়ত অনুযায়ী আপন চাচা আবু ত্বালিব তার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং আমৃত্যু প্রায় চল্লিশ বছর যাবৎ তিনি ভাতীজার যোগ্য অভিভাবক হিসাবে জীবনপাত করেন।[1]

[1]. ইবনু হিশাম ১/২২৩, ২৩৫, ত্বাবাক্বাত ইবনে সা‘দ ১/১১৭-১৮। বর্ণনাটির সনদ ‘যঈফ’ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৭০)।



শিশু মুহাম্মাদের কিছু বরকতমন্ডিত নিদর্শন


(১) ধাত্রীমাতা হালীমা সা‘দিয়াহ বলেন, ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় আমার বুকের দুধ শুকিয়ে গিয়েছিল। বাহন মাদী গাধাটির অবস্থাও ছিল করুণ। কেননা এ সময় আরব ভূমিতে দুর্ভিক্ষের বছর চলছিল। ফলে বেশী অর্থ পাবে না বলে ইয়াতীম মুহাম্মাদকে কেউ নিতে চাচ্ছিল না। অবশেষে আমি তাকে নিতে সম্মত হ’লাম। অতঃপর যখন তাকে বুকে রাখলাম, তখন সে এবং আমার গর্ভজাত সন্তান দু’জনে পেট ভরে আমার বুকের দুধ খেয়ে ঘুমিয়ে গেল। ওদিকে উটনীর পালান দুধে ভরে উঠল। যার দুধ আমরা সবাই তৃপ্তির সাথে পান করলাম। তখন আমার স্বামী হারেছ বললেন, ‘হালীমা! আল্লাহর কসম! তুমি এক মহা ভাগ্যবান সন্তান লাভ করেছ’। তারপর বাড়ীতে ফিরে আসার সময় দেখা গেল যে, আমাদের সেই দুর্বল মাদী গাধাটি এত তেযী হয়ে গেছে যে, কাফেলার সবাইকে পিছনে ফেলে সে এগিয়ে যাচ্ছে। যা দেখে সবাই বিস্মিত হয়ে গেল।


(২) বাড়ীতে ফিরে এসে দেখা গেল আমাদের রাখাল যে চারণভূমিতে পশুপাল নিয়ে যেত অন্যান্য রাখালরাও সেখানে তাদের পশুপাল নিয়ে যেত। কিন্তু তাদের পশুগুলো ক্ষুধার্ত অবস্থায় ফিরত। অথচ আমাদের পশুপাল তৃপ্ত অবস্থায় এবং পালানে দুধভর্তি অবস্থায় বাড়ী ফিরত। এভাবে আমরা প্রতিটি ব্যাপারেই বরকত লক্ষ্য করলাম এবং আমাদের সংসারে সচ্ছলতা ফিরে এল।[1]


(৩) কা‘বা চত্বরের যে নির্দিষ্ট স্থানটিতে দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব বসতেন, সেখানে তার জন্য নির্দিষ্ট আসনে কেউ বসতো না। কিন্তু শিশু মুহাম্মাদ ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি এসে সরাসরি দাদার আসনেই বসে পড়তেন। তার চাচারা তাকে সেখান থেকে নামিয়ে দিতে চাইলে দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব তাকে নিজের কাছেই বসাতেন ও গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলতেন,دَعُوا ابْنِي فَوَاللهِ إنَّ لَهُ لَشَأْنًا ‘আমার এ বেটাকে ছেড়ে দাও। আল্লাহর কসম এর মধ্যে বিশেষ কিছু শুভ লক্ষণ আছে’।[2]


উল্লেখ্য যে, ভাতীজার প্রশংসায় পঠিত আবু তালিবের কবিতা,


وَأَبْيَضَ يُسْتَسْقَى الْغَمَامُ بِوَجْهِهِ + ثِمَالَ الْيَتَامَى عِصْمَةً لِلأَرَامِلِ


‘শুভ্র দর্শন (মুহাম্মাদ) যার চেহারার অসীলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করা হয়ে থাকে। সে যে ইয়াতীমদের আশ্রয়স্থল ও বিধবাদের রক্ষক’ যা তিনি পাঠ করেছিলেন মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নবুঅত লাভের পর কুরাইশদের চরম হুমকির সময়। এর মাধ্যমে তিনি মক্কার নেতাদেরকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করতে চেয়েছিলেন এবং বলতে চেয়েছিলেন যে, কোন অবস্থাতেই তিনি মুহাম্মাদকে তাদের দাবী মতে তাদের হাতে ছেড়ে দিবেন না। ইবনু হিশাম বলেন, উক্ত প্রসঙ্গে আবু তালিব ৮০ লাইনের যে দীর্ঘ কবিতা পাঠ করেন, তা আমার নিকটে বিশুদ্ধভাবে এসেছে। তবে কোন কোন বিদ্বান এর অধিকাংশ কবিতা সম্পর্কে অজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন’ (ইবনু হিশাম ১/২৭২-৮০)।


এক্ষণে শিশুকালে তাঁকে নিয়ে চাচা কা‘বাগৃহে গিয়ে তাঁর অসীলায় এই দো‘আ করেছিলেন বলে ত্বাবাক্বাতে ইবনে সা‘দ, বায়হাক্বী দালায়েলুন নবুঅত প্রভৃতি গ্রন্থে যে বর্ণনা এসেছে তার সনদ ‘যঈফ’ (মা শা-‘আ ১৪-১৫ পৃঃ)। বরং মদীনাতে গিয়ে অনাবৃষ্টির সময় লোকদের দাবীর প্রেক্ষিতে জুম‘আর খুৎবায় মিম্বরে দাঁড়িয়ে রাসূল (সাঃ) বৃষ্টি প্রার্থনা করেছেন এবং সে বৃষ্টিতে মদীনা সিক্ত হয়েছে।[3] রাসূল (সাঃ)-এর বৃষ্টি প্রার্থনার সময় আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) আবু ত্বালিবের পঠিত উপরোক্ত কবিতার লাইনটি পাঠ করতেন’।[4] ইবনু কাছীর (রহঃ) আবু ত্বালিবের পঠিত দীর্ঘ কবিতাকে বহুবিশ্রুত সাব‘আ মু‘আল্লাক্বার কবিতাসমূহের চাইতে অধিক উত্তম ও সারগর্ভ বলে মত প্রকাশ করেছেন’।[5] জনৈক বেদুঈন ব্যক্তির আবেদনক্রমে রাসূল (সাঃ) মিম্বরে উঠে আল্লাহর নিকট বৃষ্টি প্রার্থনা করে বলেন, اللَّهُمَّ اسْقِنَا ‘হে আল্লাহ! আমাদের প্রতি বৃষ্টি বর্ষণ কর’। উক্ত হাদীছে এ কথাও রয়েছে, রাসূল (সাঃ) বলেন, لَوْ كَانَ أَبُو طَالِبٍ حَيًّا لَقَرَّتْ عَيْنَاهُ ‘যদি আজ আবু ত্বালিব বেঁচে থাকতেন, তাহ’লে তার দু’চক্ষু শীতল হয়ে যেত’। অতঃপর তিনি বলেন, কে আমাদেরকে তাঁর সেই কথাগুলি শুনাবে? তখন আলী (রাঃ) দাঁড়িয়ে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! সম্ভবতঃ আপনি তাঁর কবিতার সেই কথা বলছেন। যেখানে তিনি বলেছেন, وَأَبْيَضَ يُسْتَسْقَى الْغَمَامُ بِوَجْهِهِ (বায়হাক্বী, দালায়েল হা/২৩৮)। ইবনু হাজার বলেন, وَإِنْ كَانَ فِيهِ ضَعْفٌ لَكِنَّهُ يَصْلُحُ لِلْمُتَابَعَةِ আনাস (রাঃ) বর্ণিত উক্ত হাদীছটির মধ্যে কিছু দুর্বলতা থাকলেও এটিকে সহযোগী হিসাবে গ্রহণ করা যায়’।[6]


উক্ত দীর্ঘ কবিতা সম্পর্কে সীরাতে ইবনে হিশামের ভাষ্যকার আব্দুর রহমান সুহায়লী (মৃ. ৫৮১ হি.) বলেন, আবু তালেব স্বীয় পিতা আব্দুল মুত্ত্বালিবের সময়ে এটা দেখেছেন যে, অনাবৃষ্টিতে কাতর মক্কাবাসীদের জন্য বৃষ্টি প্রার্থনার উদ্দেশ্যে তিনি নারী-পুরুষ সবাইকে নিয়ে কা‘বাগৃহে জমা হন এবং আল্লাহর নিকট বৃষ্টি প্রার্থনা করেন। এ সময় শিশু মুহাম্মাদ তাঁর পাশে ছিল এবং তিনি তাকে কাঁধে তুলে নেন। অতঃপর মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষিত হয় (ইবনু হিশাম ১/২৮১, টীকা-২)। তবে উক্ত প্রার্থনায় আব্দুল মুত্ত্বালিব উপস্থিত নারী-পুরুষ সকলের দোহাই দিয়েছেন। অতএব উক্ত ঘটনায় মুহাম্মাদের পৃথক বৈশিষ্ট্য প্রমাণিত হয় না।


[1]. ইবনু হিশাম ১/১৬২-১৬৪; বিষয়টি সকল সীরাত গ্রন্থে এবং মুসনাদে আহমাদ, সুনানে দারেমী, মুস্তাদরাকে হাকেম (২/৬১৬-১৭) প্রভৃতি গ্রন্থে ছহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে (আকরাম যিয়া, সীরাহ ছহীহাহ ১/১০৩ পৃঃ)।

[2]. ইবনু হিশাম ১/১৬৮; আল-বিদায়াহ ২/২৮১; বর্ণনাটির সনদ মুনক্বাতি‘ (ছিন্ন সূত্র) হওয়ায় ‘যঈফ’ (মা শা-‘আ ১০ পৃঃ)। তবে শিশুদের এমন আচরণ এবং তা দেখে মুরববীদের এমন শুভ আশাবাদ ব্যক্ত করার মধ্যে বিস্ময়ের কিছু নেই।

[3]. বুখারী, ফাৎহসহ হা/১০২১, ১০২৯; ইবনু হিশাম ১/২৮০ পৃঃ।

[4]. বুখারী, ফাৎহসহ হা/১০০৮, ১০০৯ ‘ইস্তিসক্বা’ অনুচ্ছেদ, ২/৫৭৬ পৃঃ; বায়হাক্বী, দালায়েল হা/২৩৮।

[5]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৩/৫৭; (قلت: هَذِهِ قَصِيْدَةٌ عَظِيْمَةٌ بَلِيْغَةٌ جِدَّا لاَ يَسْتَطِيْعُ يَقُولَهَا إِلَّا مَنْ نُسِبَتْ إِلَيْهِ، وَهِيَ أَفْحَلُ مِنَ الْمُعَلَّقَاتِ السَّبْعِ، وَأَبْلَغُ فِي تَأْدِيَةِ الْمَعْنَى فيها جَمِيعًا) أَنْ

[6]. ফাৎহুল বারী হা/১০০৮-এর আলোচনা দ্রঃ; মা শা-‘আ ১১-১৫ পৃঃ।


কিশোর মুহাম্মাদ ও ব্যবসায় গমন (محمد المراهق والذهاب الى الةجارة)


১০ বা ১২ বছর বয়সে চাচার সাথে ব্যবসা উপলক্ষে তিনি সর্বপ্রথম সিরিয়ার বুছরা (بُصْرَى) শহরে গমন করেন। সেখানে জিরজীস (جِرْجِيْس) ওরফে বাহীরা (بَحِيرَى) নামক জনৈক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাহেব অর্থাৎ খ্রিষ্টান পাদ্রীর সাথে সাক্ষাৎ হ’লে তিনি মক্কার কাফেলাকে আন্তরিক আতিথেয়তায় আপ্যায়িত করেন এবং কিশোর মুহাম্মাদের হাত ধরে কাফেলা নেতা আবু ত্বালেবকে বলেন,هَذَا سَيِّدُ الْعَالَمِيْنَ هَذَا يَبْعَثُهُ اللهُ رَحْمَةً لِِّلْعَالَمِيْنَ ‘এই বালক বিশ্ব জাহানের নেতা। একে আল্লাহ বিশ্ব চরাচরের রহমত হিসাবে প্রেরণ করবেন’। আবু ত্বালেব বললেন, কিভাবে আপনি একথা বুঝলেন? তিনি বললেন, গিরিপথের অপর প্রান্ত থেকে যখন আপনাদের কাফেলা দৃষ্টি গোচর হচ্ছিল, তখন আমি খেয়াল করলাম যে, সেখানে এমন কোন প্রস্তরখন্ড বা বৃক্ষ ছিল না, যে এই বালকের প্রতি সিজদায় পতিত হয়নি। আর নবী ব্যতীত এরা কাউকে সিজদা করে না। তাছাড়া মেঘ তাঁকে ছায়া করছিল। গাছ তার প্রতি নুইয়ে পড়ছিল। এতদ্ব্যতীত ‘মোহরে নবুঅত’ দেখে আমি তাকে চিনতে পেরেছি, যা তার (বাম) স্কন্ধমূলে ছোট্ট ফলের আকৃতিতে উঁচু হয়ে আছে। আমাদের ধর্মগ্রন্থে আখেরী নবীর এসব আলামত সম্পর্কে আমরা আগেই জেনেছি। অতএব হে আবু ত্বালেব! আপনি সত্বর একে মক্কায় পাঠিয়ে দিন। নইলে ইহূদীরা জানতে পারলে ওকে মেরে ফেলতে পারে’। অতঃপর চাচা তাকে কিছু গোলামের সাথে মক্কায় পাঠিয়ে দিলেন। এ সময় পাদ্রী তাকে পিঠা ও তৈল উপহার দেন।[1]


ইবনু ইসহাক বলেন, পাদ্রী বাহীরা তাকে পৃথকভাবে ডেকে নিয়ে লাত ও ‘উযযার দোহাই দিয়ে কিছু প্রশ্ন করেন। তখন তরুণ মুহাম্মাদ তাকে বলেন, আমাকে লাত ও ‘উযযার নামে কোন প্রশ্ন করবেন না। আল্লাহর কসম! আমি এদু’টির চাইতে কোন কিছুর প্রতি অধিক বিদ্বেষ পোষণ করি না। অতঃপর তিনি তাকে তার নিদ্রা, আচরণ-আকৃতি ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। সেগুলিতে তিনি তাদের কিতাবে বর্ণিত গুণাবলীর সাথে মিল পান। অতঃপর তিনি আবু তালিবকে বলেন, ছেলেটি কে? আবু তালিব বলেন, এটি আমার বেটা। তিনি বললেন, না। এটি আপনার পুত্র নয়। এই ছেলের বাপ জীবিত থাকতে পারেন না। তখন আবু তালিব বললেন, এটি আমার ভাতিজা। বাহীরা বললেন, তার পিতা কি করেন? জবাবে আবু তালিব বলেন, তিনি মারা গেছেন এমতাবস্থায় যে তার মা গর্ভবতী ছিলেন। বাহীরা বললেন, আপনি সত্য বলেছেন। আপনি ভাতিজাকে নিয়ে আপনার শহরে চলে যান এবং ইহূদীদের থেকে সাবধান থাকবেন। ... আপনার ভাতিজার মহান মর্যাদা রয়েছে’ (ইবনু হিশাম ১/১৮২)।


কিছু কিছু খ্রিষ্টান প্রাচ্যবিদ এই ঘটনা থেকে নবী চরিত্রের উপরে অপবাদ দিতে চেষ্টা করেছেন যে, তিনি পাদ্রী বাহীরা-র নিকট থেকে তাওরাত শিখেছিলেন। যা থেকে তিনি কুরআন বর্ণনা করেছেন।[2] অথচ তখন তাওরাত বা ইনজীল আরবীতে অনূদিত হয়নি। তাছাড়া মুহাম্মাদ (সাঃ) তখন ছিলেন মাত্র ১০/১২ বছরের বালক। যিনি মাতৃভাষা আরবীতেই লেখাপড়া জানতেন না (আনকাবুত ২৯/৪৮)। তিনি ও তাঁর বংশের সবাই ছিলেন উম্মী বা নিরক্ষর। তাহ’লে কিভাবে এই সংক্ষিপ্ত সাক্ষাতে তিনি পাদ্রীর নিকট থেকে তাওরাত শিখলেন, যা হিব্রু ভাষায় লিখিত। কিভাবে তিনি তার অর্থ বুঝলেন? অতঃপর সেগুলি কিভাবে সাক্ষাতের ২৮/৩০ বছর পর আরবীতে পরিবর্তন করে ‘কুরআন’ আকারে পেশ করলেন?


[1]. ইবনু হিশাম ১/১৮০-৮৩; তিরমিযী হা/৩৬২০; অত্র হাদীছে বেলালের সাথে তাঁকে মক্কায় ফেরৎ পাঠানোর কথা এসেছে, যেটা ‘মুনকার’ (منكر وغير محفوظ)। এ অংশটুকু বাদে হাদীছ ছহীহ। আলবানী, মিশকাত হা/৫৯১৮ টীকা-১। রাযীন-এর বর্ণনায় এসেছে যে, আলী (রাঃ) তাঁর পিতা আবু ত্বালিব সূত্রে বলেন যে, আমি তাকে একদল লোক সহ মক্কায় ফেরৎ পাঠাই, যাদের মধ্যে বেলাল ছিল’ (মিরক্বাত হা/৫৯১৮-এর আলোচনা)।

[2]. সীরাহ নববিইয়াহ ছহীহাহ ১/১১০; গৃহীত : গোস্তাফ লুবূন, আরব সভ্যতা পৃঃ ১০২; মন্টোগোমারী ওয়াট, মক্কায় মুহাম্মাদ পৃঃ ৭৫।


তরুণ মুহাম্মাদ ও ‘ফিজার’ যুদ্ধ (محمد الناشئ وحرب الفِجَار)


তিনি যখন পনের কিংবা বিশ বছর বয়সে উপনীত হন, তখন ‘ফিজার যুদ্ধ’(حَرْبُ الْفِجَارِ) শুরু হয়। এই যুদ্ধে একপক্ষে ছিল কুরায়েশ ও তাদের মিত্র বনু কিনানাহ এবং অপর পক্ষে ছিল ক্বায়েস আয়লান। যুদ্ধে কুরায়েশ পক্ষের জয় হয়। কিন্তু এ যুদ্ধের ফলে ‘হারাম’ মাস (যে মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ) এবং কা‘বার পবিত্রতা বিনষ্ট হয় বলে একে ‘হারবুল ফিজার’ বা দুষ্টুদের যুদ্ধ বলা হয়। তরুণ মুহাম্মাদ এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং চাচাদের তীর যোগান দেবার কাজে সহায়তা করেন বলে যে বর্ণনা বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থে রয়েছে, তা বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়।[1] বরং এটাই সঠিক যে, আল্লাহপাক তাঁকে হারাম মাসে যুদ্ধে অংশগ্রহণের পাপ থেকে রক্ষা করেন। যেমন জন্ম থেকেই আল্লাহ তাঁকে সকল মন্দকর্ম থেকে রক্ষা করেছেন (সীরাহ ছহীহাহ ১/১১৪)।


[1]. ইবনু হিশাম ১/১৮৬; আর-রাহীক্ব ৫৯ পৃঃ; সীরাহ ছহীহাহ ১/১১১; মা শা-‘আ ১৬ পৃঃ।


নবীর নিষ্পাপত্ব (فى عصمة )

বিদ্বানগণ এ বিষয়ে একমত যে, সকল নবীই নিষ্পাপ ছিলেন। আর শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ) নবী হওয়ার আগে ও পরে যাবতীয় কুফরী থেকে এবং অহী প্রাপ্তির পরে কবীরা গোনাহের সংকল্প থেকেও নিষ্পাপ ছিলেন। ইচ্ছাকৃতভাবে ছগীরা গোনাহ জায়েয ছিল। তাঁদের এই বক্তব্য থেকে বুঝা যায় যে, কুফরী ও কবীরা গোনাহ থেকে তিনি নবুঅত লাভের পূর্ব হ’তেই নিষ্পাপ ছিলেন। যেমন


(১) তিনি কুরায়েশদের নিয়ম অনুযায়ী হজ্জের সময় কখনো তাদের সাথে মুযদালিফায় অবস্থান করেননি। বরং অন্যদের সাথে আরাফাতে অবস্থান করতেন। তাঁকে সেখানে দেখে একবার জুবায়ের বিন মুত্ব‘ইম আশ্চর্য হয়ে বলে উঠেছিলেন, وَاللهِ مِنَ الْحُمْسِ فَمَا شَأْنُهُ هَا هُنَا ‘আল্লাহর কসম! এ তো হুম্স-দের সন্তান। তার কি হয়েছে যে, সে এখানে অবস্থান করছে?[1]


(২) তিনি কখনো মূর্তি স্পর্শ করেননি। একবার তিনি স্বীয় মুক্তদাস যায়েদ বিন হারেছাহকে নিয়ে কা‘বাগৃহ তাওয়াফ করছিলেন। সে সময় যায়েদ মূর্তিকে স্পর্শ করলে তিনি তাকে নিষেধ করেন। দ্বিতীয়বার যায়েদ আরেকটি মূর্তিকে স্পর্শ করেন বিষয়টির নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য। তিনি পুনরায় তাকে নিষেধ করেন। এরপর থেকে নবুঅত লাভের আগ পর্যন্ত যায়েদ কখনো মূর্তি স্পর্শ করেননি। তিনি কসম করে বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কখনোই মূর্তি স্পর্শ করেননি। অবশেষে আল্লাহ তাকে অহী প্রেরণের মাধ্যমে সম্মানিত করেন।[2]


(৩) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কখনোই মূর্তির উদ্দেশ্যে উৎসর্গীত পশুর গোশত কিংবা যার উপরে আল্লাহর নাম নেওয়া হয়নি, এমন কোন গোশত ভক্ষণ করেননি’ (বুখারী ফৎহসহ হা/৫৪৯৯)।


(৪) কা‘বা পুনর্নির্মাণ কালে দূর থেকে পাথর বহন করে আনার সময় চাচা আববাসের প্রস্তাবক্রমে তিনি কাপড় খুলে ঘাড়ে রাখেন। ফলে তিনি সাথে সাথে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান। অতঃপর হুঁশ ফিরলে তিনি পাজামা কঠিনভাবে বেঁধে দিতে বলেন’ (বুখারী, মুসলিম)। যদিও বিষয়টি সেযুগে কোনই লজ্জাকর বিষয় ছিল না। ইবনু হাজার আসক্বালানী উক্ত হাদীছের আলোচনায় বলেন, ‘এতে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ স্বীয় নবী-কে নবুঅতের পূর্বে ও পরে সকল মন্দকর্ম থেকে হেফাযত করেন’।[3]


(৫) আল্লাহ তাঁর আগে-পিছের সকল গোনাহ মাফ করে দিয়েছেন (বুখারী হা/৭৪১০)। তাই তিনি ছিলেন আল্লাহর মনোনীত নিষ্পাপ রাসূল[4]- ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম (আল্লাহ তাঁর উপরে অনুগ্রহ করুন ও শান্তি বর্ষণ করুন!)।

[1]. বুখারী হা/১৬৬৪; মুসলিম হা/১২২০।

[2]. ত্বাবারাণী কাবীর হা/৪৬৬৮; হাকেম হা/৪৯৫৬, ৩/২১৬; সনদ ছহীহ।

[3]. মুসলিম হা/৩৪০; বুখারী ফৎহসহ হা/৩৬৪-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।

[4]. ড. আকরাম যিয়া উমারী, সীরাহ নববিইয়াহ ছহীহাহ ১/১১৪-১৭।


হিলফুল ফুযূল (حلف الفضول)


ফিজার যুদ্ধের ভয়াবহতা স্বচক্ষে দেখে দয়াশীল মুহাম্মাদের মনে দারুণ প্রতিক্রিয়া হয়। যাতে ভবিষ্যতে এরূপ ধ্বংসলীলা আর না ঘটে, সেজন্য তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন হন। এই সময় হঠাৎ একটি ঘটনা ঘটে যায়। যুবায়েদ (زُبَيْد) গোত্রের জনৈক ব্যক্তি ব্যবসা উপলক্ষে মক্কায় এসে অন্যতম কুরায়েশ নেতা ‘আছ বিন ওয়ায়েল-এর নিকটে মালামাল বিক্রয় করেন। কিন্তু তিনি মূল্য পরিশোধ না করে মাল আটকে রাখেন। তখন লোকটি অন্য নেতাদের কাছে সাহায্য চাইলে কেউ এগিয়ে আসেনি। ফলে তিনি ভোরে আবু কুবায়েস পাহাড়ে উঠে সবাইকে উদ্দেশ্য করে উচ্চকণ্ঠে হৃদয় বিদারক কবিতা আবৃত্তি করতে থাকেন। রাসূল (সাঃ)-এর চাচা যুবায়ের বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব এই আওয়ায শুনে ছুটে যান এবং ঘটনা অবহিত হয়ে তিনি অন্যান্য গোত্র প্রধানদের নিকটে গমন করেন। অতঃপর তিনি সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রবীণ নেতা আব্দুল্লাহ বিন জুদ‘আন তায়মীর গৃহে গোত্রপ্রধানদের নিয়ে বৈঠক করেন। উক্ত বৈঠকে রাসূল (সাঃ)-এর দাদা ও নানার গোত্র সহ পাঁচটি গোত্র যোগদান করে। তারা হ’ল বনু হাশেম, বনু মুত্ত্বালিব, বনু আসাদ, বনু যোহরা ও বনু তাইম বিন মুররাহ। উক্ত বৈঠকে তরুণ মুহাম্মাদ কতগুলি কল্যাণমূলক প্রস্তাব পেশ করেন, যা নেতৃবৃন্দের প্রশংসা অর্জন করে। অতঃপর চাচা যুবায়েরের দৃঢ় সমর্থনে সর্বসম্মতিক্রমে চারটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। মূলতঃ ভাতিজা মুহাম্মাদ ছিলেন উক্ত কল্যাণচিন্তার উদ্ভাবক এবং পিতৃব্য যোবায়ের ছিলেন তার প্রথম ও প্রধান সমর্থক। চুক্তিগুলি ছিল নিম্নরূপ :


(১) আমরা সমাজ থেকে অশান্তি দূর করব (২) মুসাফিরদের হেফাযত করব (৩) দুর্বল ও গরীবদের সাহায্য করব এবং (৪) যালেমদের প্রতিরোধ করব’। হারবুল ফিজারের পরে যুলক্বা‘দাহ্র ‘হারাম’ মাসে আল্লাহর নামে এই চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তি সম্পাদনের পরপরই তারা ‘আছ বিন ওয়ায়েল-এর নিকট যান এবং তার কাছ থেকে উক্ত মযলূম যুবায়দী ব্যবসায়ীর প্রাপ্য হক বুঝে দেন। এরপর থেকে সারা মক্কায় শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করে এবং কুরাইশগণ এই কল্যাণকামী সংগঠনকে ‘হিলফুল ফুযূল’ (حِلْفُ الْفُضُولِ) বা ‘কল্যাণকামীদের সংঘ’ বলে আখ্যায়িত করেন।[1] একে (حِلْفَ الْمُطَيَّبِينَ) ‘পবিত্রাত্মাদের সংঘ’ বলেও অভিহিত করা হয়েছে (আহমাদ হা/১৬৫৫)। অথচ ইতিপূর্বে নিয়ম ছিল গোত্রীয় বা দলীয় কোন ব্যক্তি শত অন্যায় করলেও তাকে পুরা গোত্র মিলে সমর্থন ও সহযোগিতা করতেই হ’ত। যেমন আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজে ন্যায়-অন্যায় বাছ-বিচার ছাড়াই দলীয় ব্যক্তির সমর্থনে নেতা-কর্মীরা করে থাকেন। এমনকি আদালতও প্রভাবিত হয়।


হিলফুল ফুযূল-এর গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, شَهِدْتُ حِلْفَ الْمُطَيَّبِينَ مَعَ عُمُومَتِى وَأَنَا غُلاَمٌ، فَمَا أُحِبُّ أَنَّ لِى حُمْرَ النَّعَمِ وَأَنِّى أَنْكُثُهُ ‘আমি আমার চাচাদের সঙ্গে হিলফুল ফুযূলে অংশগ্রহণ করি, যখন আমি বালক ছিলাম। অতএব আমি মূল্যবান লাল উটের বিনিময়েও উক্ত চুক্তি ভঙ্গ করতে রাযী নই’ (আহমাদ হা/১৬৫৫, ১৬৭৬; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৯০০)।


[1]. ইবনু হিশাম ১/১৩৩-৩৪; সীরাহ ছহীহাহ ১/১১১-১১২।


প্রসিদ্ধ আছে যে, জনৈক ইরাশী ব্যক্তি মক্কায় উট নিয়ে আসেন। আবু জাহল তার নিকট থেকে একটি উট খরীদ করেন। কিন্তু তার মূল্য পরিশোধে টাল-বাহানা করেন। তখন উক্ত ব্যক্তি কুরায়েশদের ভরা মজলিসে দাঁড়িয়ে অভিযোগ পেশ করে বলেন, আমি একজন গরীব পথিক। অথচ আমার হক নষ্ট করা হয়েছে। লোকেরা তাকে রাসূল (সাঃ)-কে দেখিয়ে বলল, তুমি কি ঐ ব্যক্তিকে চেন? তাঁর কাছে যাও। তখন লোকটি অনতিদূরে বসা রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে এল এবং উক্ত অভিযোগ পেশ করে বলল, আপনি আমার হক আদায় করে দিন। আল্লাহ আপনার উপর রহম করুন! তখন রাসূল (সাঃ) তাকে নিয়ে আবু জাহল-এর বাড়িমুখে চললেন। মুশরিকদের পক্ষ হ’তে একজন তাদের পিছু নিল, ঘটনা কোন দিকে গড়ায় তা দেখার জন্য। অতঃপর রাসূল (সাঃ) এসে আবু জাহলের দরজায় করাঘাত করলেন। তখন আবু জাহল বেরিয়ে এলেন। রাসূল (সাঃ) তাকে বললেন, আপনি এই ব্যক্তিকে তার হক বুঝে দিন। আবু জাহল বললেন, হ্যাঁ। আমি এখনই দিয়ে দিচ্ছি। অতঃপর তিনি ঘরে প্রবেশ করলেন ও টাকা এনে ইরাশীকে দিয়ে দিলেন।... একথা জানতে পেরে লোকেরা আবু জাহলের কাছে এসে ধিক্কার দিয়ে বলল, আপনার কি হয়েছে? কখনই তো আপনার কাছ থেকে এরূপ আচরণ আমরা দেখিনি। আবু জাহল বললেন, তোমাদের ধ্বংস হৌক! আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদ আমার দরজায় করাঘাত করার পর তাঁর কণ্ঠ শুনে আমি ভয়ে কম্পিত হয়ে পড়ি। অতঃপর বেরিয়ে এসে দেখি তাঁর মাথার উপরে ভয়ংকর একটি উট। যার চোয়াল ও দাঁতসমূহের মতো আমি কখনো দেখিনি। আল্লাহর কসম! যদি আমি অস্বীকার করতাম, তাহ’লে সে আমাকে খেয়ে ফেলত’ (ইবনু হিশাম ১/৩৮৯-৯০)। ঘটনাটির সনদ যঈফ (মা শা-‘আ ১৪৮-৪৯ পৃঃ)।


আল-আমীন মুহাম্মাদ (محمد الأمين)

হিলফুল ফুযূল গঠন ও তার পরপরই যবরদস্ত কুরায়েশ নেতার কাছ থেকে বহিরাগত মযলূমের হক আদায়ের ঘটনায় চারিদিকে তরুণ মুহাম্মাদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। সবার মুখে মুখে তিনি ‘আল-আমীন’ অর্থাৎ বিশ্বস্ত ও আমানতদার বলে অভিহিত হ’তে থাকেন। অল্পবয়স হওয়া সত্ত্বেও কেউ তার নাম ধরে ডাকতো না। সবাই শ্রদ্ধাভরে ‘আল-আমীন’ বলে ডাকত।[1]


[1]. ইবনু হিশাম ১/১৯৮। প্রসিদ্ধ আছে যে, আব্দুল্লাহ বিন আবুল হামসা বলেন, নবুঅত পূর্বকালে আমি রাসূল (সাঃ)-এর নিকট থেকে কিছু খরীদ করেছিলাম। সেখানে মূল্য পরিশোধে আমি কিছু বাকী রাখি। অতঃপর আমি তাকে ওয়াদা করি যে, এই স্থানেই আমি উক্ত মূল্য নিয়ে আসছি। পরে আমি বিষয়টি ভুলে যাই। তিন দিন পরে স্মরণ হ’লে আমি এসে দেখি রাসূল (সাঃ) সেখানেই দাঁড়িয়ে আছেন। অতঃপর তিনি আমাকে বললেন, তুমি আমাকে কষ্ট দিলে। তিন দিন ধরে আমি এখানে তোমার অপেক্ষায় আছি’ (আবুদাঊদ হা/৪৯৯৬)। হাদীছটি যঈফ (আলবানী, সনদ যঈফ; মা শা-‘আ ২০ পৃঃ)।


যুবক ও ব্যবসায়ী মুহাম্মাদ (محمد الشاب والتاجر)

১২ বছর বয়সে পিতৃব্য আবু ত্বালিবের সাথে সর্বপ্রথম ব্যবসা উপলক্ষে শাম বা সিরিয়া সফর করেছিলেন। কিন্তু ‘বাহীরা’ রাহেবের কথা শুনে চাচা তাকে সাথে সাথেই মক্কায় ফেরৎ পাঠিয়েছিলেন।[1] এখন তিনি পঁচিশ বছরের পরিণত যুবক। কুরায়েশ বংশে অনেকে ছিলেন, যারা নির্দিষ্ট লভ্যাংশের বিনিময়ে ব্যবসায়ে পুঁজি বিনিয়োগ করতেন। কিন্তু নিজেরা সরাসরি ব্যবসায়িক সফরে যেতেন না। এজন্য তারা সর্বদা বিশ্বস্ত ও আমানতদার লোক তালাশ করতেন। খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ ছিলেন এমনই একজন বিদুষী ব্যবসায়ী মহিলা। মুহাম্মাদের সততা ও আমানতদারীর কথা শুনে তিনি তার নিকটে অন্যদের চেয়ে অধিক লভ্যাংশ দেওয়ার অঙ্গীকারে ব্যবসায়ের প্রস্তাব পাঠান। চাচার সাথে পরামর্শক্রমে তিনি এতে রাযী হয়ে যান। অতঃপর খাদীজার গোলাম মায়সারাকে সাথে নিয়ে প্রথম ব্যবসায়িক সফরে তিনি সিরিয়া গমন করেন।[2] ব্যবসা শেষে মক্কায় ফিরে আসার পরে হিসাব-নিকাশ করে মূল পুঁজি সহ এত বেশী লাভ হস্তগত হয় যে, খাদীজা ইতিপূর্বে কারু কাছ থেকে এত লাভ পাননি।


[1]. হাকেম হা/৪২২৯; তিরমিযী হা/৩৬২০; মিশকাত হা/৫৯১৮।

[2]. ইবনু ইসহাক এখানে বিনা সনদে উল্লেখ করেন যে, শামে গিয়ে রাসূল (সাঃ) একজন পাদ্রীর উপাসনালয়ের পাশে একটি গাছের ছায়ায় অবতরণ করেন। তখন পাদ্রীটি গোলাম মায়সারাকে এসে বলেন, এ ব্যক্তি কে? তিনি বলেন, ইনি হারামের অধিবাসী কুরায়েশ বংশের একজন ব্যক্তি। পাদ্রী বলেন, এই গাছের নীচে নবী ব্যতীত কেউ কখনো অবতরণ করেন না’ (ইবনু হিশাম ১/১৮৮)। এই পাদ্রীর নাম নাস্তূরা (نَسْطُورا)। সুহায়লী বলেন, ঈসা (আঃ) থেকে এত দীর্ঘ বছর পর্যন্ত ঐ গাছটি বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। অতএব এক্ষেত্রে সঠিক বর্ণনা এটাই হ’তে পারে যে, ঈসা (আঃ)-এর পরে এ যাবৎ কেউ এর নীচে অবতরণ করেন নি। ইবনু ইসহাক ব্যতীত অন্য কেউ উক্ত বর্ণনা করেছেন’ (ঐ, টীকা-৩)।


ইতিপূর্বে বাহীরা পাদ্রী এবং এখন নাস্তূরা পাদ্রীর ভবিষ্যদ্বাণী সমূহ বর্ণনা করে গল্পকারগণ প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, খাদীজা উক্ত কারণেই মুহাম্মাদ-এর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন (মোস্তফা চরিত ২৮৬-৮৮ পৃঃ)। অথচ এগুলি একেবারেই ভিত্তিহীন কল্পকথা মাত্র।


বিবাহ (زواج النبى صــ)

ব্যবসায়ে অভাবিত সাফল্যে খাদীজা দারুণ খুশী হন। অন্যদিকে গোলাম মায়সারার কাছে মুহাম্মাদের মিষ্টভাষিতা, সত্যবাদিতা, আমানতদারী এবং উন্নত চিন্তা-চেতনার কথা শুনে বিধবা খাদীজা মুহাম্মাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়েন। ইতিপূর্বে পরপর দু’জন স্বামী মৃত্যুবরণ করায় মক্কার সেরা নেতৃবৃন্দ তাঁর নিকটে বিয়ের পয়গাম পাঠান। কিন্তু তিনি কোনটাই গ্রহণ করেননি। এবার তিনি নিজেই বান্ধবী নাফীসার মাধ্যমে নিজের বিয়ের পয়গাম পাঠালেন যুবক মুহাম্মাদ-এর কাছে। তখন উভয় পক্ষের মুরববীদের সম্মতিক্রমে শাম থেকে ফিরে আসার মাত্র দু’মাসের মাথায় সমাজনেতাদের উপস্থিতিতে ধুমধামের সাথে তাদের বিবাহ সম্পন্ন হয়। মুহাম্মাদ স্বীয় বিবাহের মোহরানা স্বরূপ ২০টি উট প্রদান করেন। এ সময় খাদীজা ছিলেন মক্কার শ্রেষ্ঠ ধনী ও সম্ভ্রান্ত মহিলা এবং সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারিণী হিসাবে ‘ত্বাহেরা’ (পবিত্রা) নামে খ্যাত। তখন তাঁর বয়স ছিল ৪০ এবং মুহাম্মাদের বয়স ছিল ২৫। মুহাম্মাদ ছিলেন খাদীজার তৃতীয় স্বামী। অন্যদিকে খাদীজা ছিলেন মুহাম্মাদের প্রথমা স্ত্রী।[1] উভয়ের দাম্পত্য জীবন পঁচিশ বছর স্থায়ী হয়। মৃত্যুকালে খাদীজার বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। তবে উভয়ের বয়স নিয়ে মতভেদ আছে।[2]

[1]. ইবনু হিশাম ১/১৮৭-৮৯; আল-বিদায়াহ ২/২৯৩-৯৪।

[2]. অধিকাংশ জীবনীকারের নিকট প্রসিদ্ধ মতে বিয়ের সময় উভয়ের বয়স ছিল যথাক্রমে ২৫ ও ৪০ (ইবনু হিশাম ১/১৮৭)। তবে কেউ কেউ ঐ সময় রাসূল (সাঃ)-এর বয়স সম্পর্কে বলেছেন ২১, ৩০ ও ৩৭ এবং খাদীজার বয়স সম্পর্কে বলেছেন ২৫, ২৮, ৩৫ ও ৪৫। মৃত্যুকালে খাদীজার বয়স সম্পর্কে বলা হয়েছে ৫০ ও ৬৫। দ্রঃ ইবনু হিশাম ১/১৮৭, টীকা ১-২; হাকেম হা/৪৮৩৮, ৩/২০০; বায়হাক্বী দালায়েল হা/৪০৪; মা শা-‘আ ১৮-১৯ পৃঃ।


খ্রিষ্টান ঐতিহাসিক উইলিয়াম মূর (১৮১৯-১৯০৫) ভিত্তিহীন কিছু বক্তব্য তাঁর প্রণীত নবী জীবনীতে উল্লেখ করেছেন। যেমন খাদীজার পিতা খুওয়াইলিদ এই বিয়েতে আদৌ সম্মত ছিলেন না। তাই খাদীজা তাঁর পিতাকে মদ পান করিয়ে মাতাল করেন। অতঃপর তাঁর অজ্ঞান অবস্থায় বিয়ের কাজ সম্পন্ন করে নেন’। এছাড়া এখানে উভয়ের সম্পর্ক নিয়েও কিছু বাজে কথা লেখা হয়েছে (ঐ, নবীজীবনী পৃঃ ২৪)। অন্যতম লেখক মার্গোলিয়থ (১৮৫৮-১৯৪০) খাদীজার বয়স যে ৪০ ছিল, তা মানতে রাযী হননি। কেবল এতটুকুই স্বীকার করেছেন যে, খাদীজার বয়স মুহাম্মাদের চেয়ে কিছুটা বেশী ছিল (ঐ, নবীজীবনী পৃঃ ৬৬; দ্রঃ মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মোস্তফা চরিত ২৯০-৯১ পৃঃ)।


উল্লেখ্য যে, রাসূল (সাঃ)-এর অভিভাবকদের পক্ষ থেকে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে বিয়েতে যান তাঁর চাচা হামযা বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব। তিনি খাদীজার পিতা খুওয়াইলিদ বিন আসাদ-এর নিকটে বিয়ের পয়গাম পেশ করেন। অতঃপর উভয় পক্ষের সম্মতিতে বিবাহ হয়। বিয়েতে খুৎবা পাঠ করেন গোত্রনেতা চাচা আবু ত্বালিব (ইবনু হিশাম ১/১৮৯-৯০ ও টীকা ১)। তবে যুহরী (৫০-১২৪ হিঃ) বর্ণনা করেন যে, খুওয়াইলিদ ঐ সময় মাতাল ছিলেন। অতঃপর হুঁশ ফিরলে তিনি বিয়েতে অস্বীকার করেন। অবশেষে রাযী হন এবং বিয়ের কাজ সম্পন্ন করেন। পক্ষান্তরে ইবনু ইসহাক ব্যতীত অন্যেরা বলেন যে, খুওয়াইলিদ ঐ সময় জীবিত ছিলেন না। ফলে খাদীজার বিয়ে দেন তাঁর চাচা ‘আমর বিন আসাদ। কেউ বলেন, তাঁর ভাই ‘আমর বিন খুওয়াইলিদ (ইবনু হিশাম ১/১৯০, টীকা ২)। দুষ্টু ঐতিহাসিক মূর যুহরীর অপ্রমাণিত বক্তব্যকে পুঁজি করে তাতে আরও রং চড়িয়েছেন।


সন্তান-সন্ততি (اولاد النبى صــ)

তাঁর মোট ৩ পুত্র ও ৪ কন্যা ছিল। ইবরাহীম ব্যতীত বাকী ৬ সন্তানের সবাই ছিলেন খাদীজার গর্ভজাত। তিনি বেঁচে থাকা অবধি রাসূল (সাঃ) দ্বিতীয় বিবাহ করেননি।[1] মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর সাথে বিয়ের সময় খাদীজা পূর্ব স্বামীদ্বয়ের কয়েকজন জীবিত সন্তানের মা ছিলেন। তাঁর গর্ভজাত ও পূর্বস্বামীর সন্তানেরা সকলে ইসলাম কবুল করেন ও সকলে ছাহাবী ছিলেন। খাদীজার গর্ভে রাসূল (সাঃ)-এর প্রথম সন্তান ছিল ক্বাসেম। তার নামেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপনাম ছিল আবুল ক্বাসেম। অতঃপর কন্যা যয়নব, পুত্র আব্দুল্লাহ; যার লকব ছিল ত্বাইয়িব ও ত্বাহের। কারণ তিনি নবুঅত লাভের পর জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অতঃপর রুক্বাইয়া, উম্মে কুলছূম ও ফাতেমা। ক্বাসেম ছিলেন সন্তানদের মধ্যে সবার বড়। যিনি ১৭ মাস বয়সে মারা যান। নবুঅত লাভের পর আব্দুল্লাহ জন্ম গ্রহণের কিছু দিনের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করায় ‘আছ বিন ওয়ায়েল প্রমুখ কুরায়েশ নেতারা রাসূল (সাঃ)-কে ‘আবতার’ বা নির্বংশ বলে অভিহিত করেন। কেননা সে যুগে কারু পুত্র সন্তান মারা গেলে এবং পরে পুত্র সন্তান হ’তে দেরী হ’লে আরবরা ঐ ব্যক্তিকে ‘আবতার’ বলত। অতঃপর চার কন্যার মধ্যে কে সবার বড় ও কে সবার ছোট এ নিয়ে মতভেদ আছে। তবে প্রসিদ্ধ মতে যয়নব বড় ও ফাতেমা ছিলেন ছোট।


রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মোট সাত সন্তানের ছয় জনই তাঁর জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণ করেন। তাদের মধ্যে পুত্রগণ শৈশবে মারা যান। কন্যাগণ সকলে বিবাহিতা হন ও হিজরত করেন। কিন্তু ফাতেমা ব্যতীত বাকী তিন কন্যা রাসূল (সাঃ)-এর জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর ছয় মাস পরে ফাতেমা (রাঃ) মারা যান। রাসূল (সাঃ)-এর সর্বশেষ সন্তান ছিলেন পুত্র ‘ইবরাহীম’। তিনি ছিলেন মিসরীয় দাসী মারিয়া ক্বিবতীয়ার গর্ভজাত। যিনি মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন এবং দুধ ছাড়ার আগেই মাত্র ১৮ মাস বয়সে ১০ম হিজরীর ২৯শে শাওয়াল মোতাবেক ৬৩২ খৃষ্টাব্দের ২৭ অথবা ৩০শে জানুয়ারী সূর্য গ্রহণের দিন সোমবার মদীনায় ইন্তেকাল করেন।[2]


[1]. ইবনু হিশাম ১/১৯০; মুসলিম হা/২৪৩৬।

[2]. বুখারী হা/১০৬০; মুসলিম হা/৯০৬; রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/৯৮ পৃঃ।


জামাতাগণ (أختانه صــ)

(১) আবুল ‘আছ বিন রাবী‘ : ইনি খাদীজার আপন বোন হালার পুত্র ছিলেন। কন্যা যয়নবকে তিনি এই ভাগিনার সাথে বিবাহ দেন। আলী ও উমামাহ নামে তাঁদের একটি পুত্র ও একটি কন্যা সন্তান হয়। যয়নব (রাঃ) ৮ম হিজরীতে এবং আবুল ‘আছ (রাঃ) ১২ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। (২-৩) উৎবা ও উতাইবাহ : আবু লাহাবের এই দুই পুত্রের সাথে রুক্বাইয়া ও উম্মে কুলছূমের বিবাহ হয়। কিন্তু সূরা লাহাব নাযিলের পর তাদেরকে তালাক দিতে আবু লাহাব বাধ্য করেন। এদের ঔরসে কোন সন্তানাদি হয়নি। পরে রুক্বাইয়া হযরত ওছমান (রাঃ)-এর সাথে বিবাহিতা হন। হাবশায় হিজরতকালীন সময়ে ‘আব্দুল্লাহ’ নামে তাঁর একটি পুত্র সন্তান হয়। যিনি ১ম হিজরীতে মদীনায় ৬ বছর বয়সে মারা যান। তার পরের বছর ২য় হিজরীতে বদরের যুদ্ধ থেকে ফেরার দিন রুক্বাইয়া মৃত্যুবরণ করেন। অতঃপর উম্মে কুলছূমকে ওছমানের সাথে বিবাহ দেওয়া হয়। রাসূল (সাঃ)-এর দুই মেয়ের স্বামী হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করায় ওছমানকে ‘যুন-নূরাইন’(ذُوْ النُّورَين) বলা হয়।[1] উম্মে কুলছূম নিঃসন্তান ছিলেন। তিনি ৯ম হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। (৪) আলী ইবনু আবী ত্বালেব : ২য় হিজরীর ছফর মাসে তাঁর সাথে ফাতেমা (রাঃ)-এর বিবাহ হয়। হাসান, হোসায়েন, উম্মে কুলছূম ও যয়নব নামে তাঁর গর্ভজাত চারটি সন্তান ছিল। অনেকে মুহসিন ও রুক্বাইয়া নামে আরও দু’টি সন্তানের কথা বলেছেন। যারা শিশু অবস্থায় মারা যায়। ১১ হিজরীর ৩রা রামাযান মঙ্গলবার রাতে ৩০ অথবা ৩৫ বছর বয়সে ফাতেমা (রাঃ) মৃত্যুবরণ করেন।[2]


[1]. এ লকবটি তাঁর সম্পর্কে আবুবকর (রাঃ)-এর মন্তব্য দ্বারা প্রমাণিত (আলবানী, যিলালুল জান্নাহ হা/১১৫৩, সনদ ছহীহ)।

[2]. সন্তান-সন্ততি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা দেখুন : আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৫/২৬৭-৭০; রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/৯৫-১১১ পৃঃ; আল-ইছাবাহ, আব্দুল্লাহ বিন ওছমান ক্রমিক সংখ্যা ৬১৮৯।


কা‘বাগৃহ পুনর্নির্মাণ ও মুহাম্মাদের মধ্যস্থতা (إعادة البناء للكعبة ووساطة محمد)

আল-আমীন মুহাম্মাদ-এর বয়স যখন ৩৫ বছর, তখন কুরায়েশ নেতাগণ কা‘বাগৃহ ভেঙ্গে পুনর্নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। ইবরাহীম ও ইসমাঈলের হাতে গড়া ন্যূনাধিক আড়াই হাযার বছরের স্মৃতিধন্য এই মহা পবিত্র গৃহ সংস্কারের ও পুনর্নির্মাণের পবিত্র কাজে সকলে অংশীদার হ’তে চায়।


ইবরাহীমী যুগ থেকেই কা‘বাগৃহ ৯ হাত উঁচু চার দেওয়াল বিশিষ্ট ঘর ছিল, যার কোন ছাদ ছিল না। কা‘বা অর্থই হ’ল চতুর্দেওয়াল বিশিষ্ট ঘর। চার পাশের উঁচু পাহাড় থেকে নামা বৃষ্টির স্রোতের আঘাতে কা‘বার দেওয়াল ভঙ্গুর হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া সে বছরের তীব্র বন্যায় কা‘বা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়। অধিকন্তু একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঐ সময় ঘটে যায়, যা ইতিপূর্বে কখনো ঘটেনি এবং যা কা‘বা পুনর্নির্মাণে প্রত্যক্ষ কারণ হিসাবে কাজ করে। ঘটনাটি ছিল এই যে, কিছু চোর দেওয়াল টপকে কা‘বা গৃহে প্রবেশ করে এবং সেখানে রক্ষিত মূল্যবান মালামাল ও অলংকারাদি চুরি করে নিয়ে যায়।


কা‘বাগৃহ পুনর্নির্মাণের উদ্দেশ্যে কুরায়েশ নেতৃবৃন্দ বৈঠকে বসে স্থির করেন যে, এর নির্মাণ কাজে কারু কোনরূপ হারাম মাল ব্যয় করা হবে না। তারা বলেন, হে কুরায়েশগণ! তোমরা এর নির্মাণ কাজে তোমাদের পবিত্র উপার্জন থেকে ব্যয় কর। এর মধ্যে ব্যভিচারের অর্থ, সূদের অর্থ, কারু প্রতি যুলুমের অর্থ মিশ্রিত করোনা’ (ইবনু হিশাম ১/১৯৪)। অতঃপর কোন কোন গোত্র মিলে কোন পাশের দেওয়াল নির্মাণ করবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। সাথে সাথে এবার ছাদ নির্মাণের প্রস্তাব গৃহীত হয়, যা ইতিপূর্বে ছিল না। কিন্তু কে আগে দেওয়াল ভাঙ্গার সূচনা করবে? অবশেষে অলীদ বিন মুগীরাহ মাখযূমী সাহস করে প্রথম ভাঙ্গা শুরু করেন। তারপর সকলে মিলে দেওয়াল ভাঙ্গা শেষ করে ইবরাহীম (আঃ)-এর স্থাপিত ভিত পর্যন্ত গিয়ে ভাঙ্গা বন্ধ করে দেন। অতঃপর সেখান থেকে নতুনভাবে সর্বোত্তম পাথর দিয়ে ‘বাকূম’ (باقوم بنّاء رومى) নামক জনৈক রোমক কারিগরের তত্ত্বাবধানে নির্মাণকার্য শুরু হয়। কিন্তু গোল বাঁধে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ‘হাজারে আসওয়াদ’ স্থাপনের পবিত্র দায়িত্ব কোন গোত্র পালন করবে সেটা নিয়ে। এই বিবাদ অবশেষে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে গড়াবার আশংকা দেখা দিল। তখন প্রবীণ নেতা আবু উমাইয়া মাখযূমী প্রস্তাব করলেন যে, আগামীকাল সকালে যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম ‘হারামে’ প্রবেশ করবেন, তিনিই এই সমস্যার সমাধান করবেন। সবাই এ প্রস্তাব মেনে নিল।


আল্লাহর অপার মহিমা। দেখা গেল যে, বনু শায়বাহ ফটক দিয়ে সকালে সবার আগে মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করলেন সকলের প্রিয় ‘আল-আমীন’। কা‘বা নির্মাণে অংশগ্রহণকারী ও প্রত্যক্ষদর্শী রাবী আব্দুল্লাহ বিন সায়েব আল-মাখযূমীর বর্ণনা মতে তাকে দেখে সবাই বলে উঠলো- هَذَا الْأَمِينُ، رَضِينَا، هَذَا مُحَمَّدٌ ‘এই যে আল-আমীন। আমরা তাঁর উপর সন্তুষ্ট। এই যে মুহাম্মাদ’। অতঃপর তিনি ঘটনা শুনে একটা চাদর চাইলেন এবং সেটা বিছিয়ে নিজ হাতে ‘হাজারে আসওয়াদ’ উঠিয়ে তার মাঝখানে রেখে দিলেন। অতঃপর নেতাদের বললেন, আপনারা সকলে মিলে চাদরের চারপাশ ধরে নিয়ে চলুন। তাই করা হ’ল। কা‘বার নিকটে গেলে তিনি পাথরটি উঠিয়ে যথাস্থানে রেখে দিলেন।[1] এই দ্রুত ও সহজ সমাধানে সবাই সন্তুষ্ট হয়ে মুহাম্মাদের তারীফ করতে করতে চলে গেল। আরবরা এমন এক যুদ্ধ থেকে বেঁচে গেল, যা ২০ বছরেও শেষ হ’ত কি-না সন্দেহ। এ ঘটনায় সমগ্র আরবে তাঁর প্রতি ব্যাপক শ্রদ্ধাবোধ জেগে উঠলো। নেতাদের মধ্যে তাঁর প্রতি একটা স্বতন্ত্র সম্ভ্রমবোধ সৃষ্টি হ’ল।


উল্লেখ্য যে, নবুঅত লাভের পূর্ব পর্যন্ত কুরায়েশগণ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে শ্রদ্ধাভরে আল-আমীন (الْأَمِينُ) বলেই ডাকত’ (ইবনু হিশাম ১/১৯৮)।


কা‘বাগৃহ নির্মাণের এক পর্যায়ে উত্তরাংশের দায়িত্বপ্রাপ্ত বনু ‘আদী বিন কা‘ব বিন লুওয়াই তাদের হালাল অর্থের কমতি থাকায় কাজ সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়। ফলে মূল ভিতের ঐ অংশের প্রায় সাত হাত জায়গা বাদ রেখেই দেওয়াল নির্মাণ করা হয়। যা হাত্বীম (الْحَطِيم) বা পরিত্যক্ত নামে আজও ঐভাবে আছে। সেকারণ হাতীমের বাহির দিয়েই ত্বাওয়াফ করতে হয়, ভিতর দিয়ে নয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মক্কা বিজয়ের পরে ঐ অংশটুকু কা‘বার মধ্যে শামিল করে মূল ইবরাহীমী ভিতের উপর কা‘বা পুনর্নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নওমুসলিম কুরায়েশরা সেটা মেনে নিবে না ভেবে বিরত থাকেন’ (বুখারী হা/১৫৮৬)। একারণেই বলা হয়ে থাকে, دَرْءُ الْمَفَاسِدِ أَوْلَى مِنْ جَلْبِ الْمَصَالِحِ ‘মন্দ প্রতিরোধ অধিক উত্তম কল্যাণ আহরণের চাইতে’। উল্লেখ্য যে, হিজরতের ১৮ বছর পূর্বে কা‘বাগৃহ পুনর্নির্মাণ সমাপ্ত হয়’ (ইবনু হিশাম ১/১৯৭-এর টীকা-৩)।


[1]. ইবনু হিশাম ১/১৯৭; আহমাদ হা/১৫৫৪৩; হাকেম হা/১৬৮৩; সনদ ছহীহ।


কা‘বার আকৃতি (شكل الكعبة)

কুরায়েশ নির্মিত চতুষ্কোণ বিশিষ্ট কা‘বা (যার রূপ বর্তমানে রয়েছে), তার দেওয়ালের উচ্চতা প্রায় ১৫ মিটার। উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়াল দশ দশ মিটার এবং পূর্ব ও পশ্চিম দেওয়াল বারো বারো মিটার করে প্রশস্ত। ৬টি খাম্বার উপরে নির্মিত ছাদ। মাত্বাফ থেকে দেড় মিটার উচ্চতায় দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ‘হাজারে আসওয়াদ’ এবং দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ‘রুকনে ইয়ামানী’ অবস্থিত। দরজার নীচের চৌকাঠ ২ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত (আর-রাহীক্ব পৃঃ ৬২)। অথচ রাসূল (সাঃ)-এর ইচ্ছা ছিল, হাত্বীমকে অন্তর্ভুক্ত করে মূল ভিতের উপর কা‘বাগৃহ নির্মাণ করা, যা মাটি সমান হবে। যার পূর্ব দরজা দিয়ে মুছল্লী প্রবেশ করবে ও ছালাত শেষে পশ্চিম দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু কুরায়েশরা তা না করে অনেক উঁচুতে দরজা নির্মাণ করে। যাতে তাদের ইচ্ছার বাইরে কেউ সেখানে প্রবেশ করতে না পারে’।[1]


খালা আয়েশা (রাঃ)-এর নিকট এ হাদীছ শোনার পর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের (রাঃ) স্বীয় খেলাফতকালে (৬৪-৭৩ হিঃ) ৬৪ হিজরী সনে কা‘বাগৃহ ভেঙ্গে রাসূল (সাঃ)-এর ইচ্ছানুযায়ী তা পুনর্নির্মাণ করেন। কিন্তু ৭৩ হিজরী সনে তিনি যুদ্ধে নিহত হ’লে উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ানের নির্দেশে গভর্ণর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তা পুনরায় ভেঙ্গে আগের মত হাত্বীমকে বাইরে রেখে নির্মাণ করেন। যা আজও রয়েছে। পরবর্তীতে আববাসীয় খলীফা মাহদী ও হারূণ এটি পুনর্নির্মাণ করে রাসূল (সাঃ)-এর ইচ্ছা পূরণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইমাম মালেক (৯৩-১৭৯ হি.) তাদের বলেন,لاَ تَجْعَلْ كَعْبَةَ اللهِ مَلْعَبَةً لِلْمُلُوْكِ ‘আপনারা কা‘বাগৃহকে রাজা-বাদশাহদের খেল-তামাশার বস্ত্ততে পরিণত করবেন না’।[2] ফলে কা‘বাগৃহ ঐ অবস্থায় রয়ে যায়। ইবরাহীমী ভিতে আজও ফিরে আসেনি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আকাংখাও পূর্ণ হয়নি।


[1]. বুখারী হা/১২৬; মুসলিম হা/১৩৩৩।

[2]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা বাক্বারাহ ১২৭-২৮ আয়াত; ঐ, আল-বিদায়াহ ৮/২৫৩; সুহায়লী, আর-রাউযুল উনুফ ২/১৭৩।


নবুঅতের দ্বারপ্রান্তে নিঃসঙ্গপ্রিয়তা (حب التحنث قبيل النبوة)

নবুঅত লাভের সময়কাল যতই ঘনিয়ে আসতে লাগল, ততই তাঁর মধ্যে নিঃসঙ্গপ্রিয়তা বাড়তে থাকল। এক সময় তিনি কা‘বাগৃহ থেকে প্রায় ৬ কিঃ মিঃ উত্তর-পূর্বে হেরা পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত ১২*৫১/৪*৭ বর্গফুট আকারের ছোট গুহার নিরিবিলি স্থানকে বেছে নিলেন। বাড়ী থেকে তিনি পানি ও ছাতু নিয়ে যেতেন। ফুরিয়ে গেলে আবার আসতেন। কিন্তু বাড়ীতে তার মন বসতো না। কখনো কখনো সেখানে একটানা কয়েকদিন কাটাতেন। তাঁর এই ইবাদত কতদিন ছিল, সেটির ধরন কেমন ছিল, সে বিষয়ে তেমন কিছু জানা যায় না। অতঃপর রবীউল আউয়ালের জন্ম মাস থেকে শুরু হয় ‘সত্যস্বপ্ন’ (الرُّؤْيَا الصَّادِقَةُ) দেখা। তিনি স্বপ্নে যাই-ই দেখতেন তাই-ই দিবালোকের ন্যায় (مِثْلَ فَلَقِ الصُّبْحِ) সত্য হয়ে দেখা দিত’ (বুখারী ফৎহসহ হা/৪৯৫৩)। এভাবে চলল প্রায় ছয় মাস। যা ছিল ২৩ বছরের নবুঅতকালের ৪৬ ভাগের এক ভাগ। হাদীছে সম্ভবতঃ একারণেই সত্যস্বপ্নকে নবুঅতের ৪৬ ভাগের এক ভাগ বলা হয়েছে।[1]


এসে গেল রামাযান মাস। পূর্বের ন্যায় এবারেও তিনি পুরা রামাযান সেখানে ই‘তিকাফে কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। স্বগোত্রীয় লোকদের পৌত্তলিক ও বস্ত্তবাদী ধ্যান-ধারণা তাঁকে পাগল করে তুলত। কিন্তু তাদের ফিরানোর কোন পথ তাঁর জানা ছিল না।


মূলতঃ হেরা গুহায় নিঃসঙ্গ অবস্থানের বিষয়টি ছিল আল্লাহর দূরদর্শী পরিকল্পনা ও মহতী ব্যবস্থাপনারই অংশ। ইবনু আবী জামরাহ (ابن أبي جَمْرَة) বলেন, এর মধ্যে তিনটি ইবাদত এক সাথে ছিল। (১) নির্জনবাস (২) আল্লাহর ইবাদত এবং (৩) সেখান থেকে কা‘বাগৃহ দেখতে পাওয়া। ইবনু ইসহাক বলেন, ‘এভাবে নিঃসঙ্গ ইবাদত জাহেলিয়াতের রীতি ছিল। তাঁর কওম পূর্ব থেকেই যেমন আশূরার ছিয়াম পালন করত, তেমনি হেরা গুহায় নিঃসঙ্গ ইবাদত করত। আব্দুল মুত্ত্বালিব এটি প্রথম করেন’।[2] বরং এটি ছিল ইবরাহীমী ইবাদতের (فَالتَّحَنُّثُ مِنْ بَقَايَا الِْإِبْرَاهِيْمِيَّةِ) অবশিষ্টাংশ’ (সীরাহ ছহীহাহ ১/১২৩-টীকা)। যার মাধ্যমে আল্লাহভীরু বান্দার মধ্যে অধ্যাত্ম চেতনার সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটা সম্ভব হয়। এভাবে হেরা গুহায় থাকা অবস্থায় একদিন আল্লাহর পক্ষ থেকে অহী নিয়ে জিব্রীল (আঃ) এসে হাযির হন।


[1]. বুখারী ফৎহসহ হা/৬৯৮৩-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।

[2]. বুখারী ফৎহসহ হা/৬৯৮২-এর আলোচনা; ইবনু হিশাম ১/২৩৫।


শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ -২ (العبر -২)

(১) শ্রেষ্ঠ বংশের জগতশ্রেষ্ঠ রাসূল ইয়াতীম অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেন। এর দ্বারা আল্লাহ তাঁকে ইয়াতীম ও অসহায় শ্রেণীর দুঃখ-বেদনা অনুভবের অভিজ্ঞতা অর্জন করান।

(২) তাঁকে উম্মী বা নিরক্ষর নবী করা হয়। যাতে কেউ বলতে না পারে যে, তিনি নিজের ইলম দিয়ে কুরআন তৈরী করেছেন। এছাড়া দুনিয়ার কোন মানুষ যেন তাঁর উস্তাদ হওয়ার বড়াই করতে না পারে।

(৩) ভবিষ্যতে তিনি যে নবী হবেন, তার নমুনা দুগ্ধপানকাল থেকেই বিভিন্ন মু‘জেযা ও শুভ লক্ষণের মাধ্যমে ফুটে ওঠে। যাবতীয় কুসংস্কার ও অন্যায়-অনাচারের প্রতি ঘৃণাবোধ, যুলুম প্রতিরোধে ‘হিলফুল ফুযূল’ সংগঠন প্রতিষ্ঠা, কা‘বাগৃহ পুনর্নির্মাণকালে সাক্ষাৎ রক্তারক্তি থেকে সম্প্রদায়কে রক্ষা, সর্বত্র আল-আমীন হিসাবে প্রশংসিত হওয়া, অতঃপর মানুষের মঙ্গল চিন্তায় নিঃসঙ্গপ্রিয়তা ও হেরা গুহায় আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হওয়া ও সত্যস্বপ্ন লাভ প্রভৃতি ছিল ভবিষ্যৎ নবুঅত প্রাপ্তির অভ্রান্ত পূর্ব নিদর্শন। এতে প্রমাণিত হয় যে, শ্রেষ্ঠতম আমানত সমর্পণের জন্য শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি আবশ্যক।


নুযূলে কুরআন ও নবুঅত লাভ (نزول القرآن والحصول على النبوة)

২১শে রামাযান সোমবার ক্বদরের রাত্রি।[1] ফেরেশতা জিবরীলের আগমন হ’ল। ধ্যানমগ্ন মুহাম্মাদকে বললেন, إِقْرَأْ ‘পড়’। বললেন,مَا أَنَا بِقَارِئٍ ‘আমি পড়তে জানিনা’। অতঃপর তাকে বুকে চেপে ধরলেন ও বললেন, পড়। কিন্তু একই জবাব, ‘পড়তে জানিনা’। এভাবে তৃতীয়বারের চাপ শেষে তিনি পড়তে শুরু করলেন,

إِقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِيْ خَلَقَ- خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ- إِقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ- الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ- عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ- (العلق ১-৫)-


(১) ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’ (২) ‘সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে’ (৩) ‘পড় এবং তোমার প্রভু বড়ই দয়ালু’ (৪) ‘যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দান করেছেন’ (৫) ‘তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না’ (আলাক্ব ৯৬/১-৫)।


এটাই হ’ল পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে মানবজাতির প্রতি আল্লাহর প্রথম প্রত্যাদেশ। হে মানুষ! তুমি পড় এবং লেখাপড়ার মাধ্যমে জ্ঞানার্জন কর। যা তোমাকে তোমার সৃষ্টিকর্তার সন্ধান দেয় এবং তাঁর প্রেরিত বিধান অনুযায়ী তোমার জীবন পরিচালনার পথ বাৎলে দেয়। কুরআনের অত্র আয়াতগুলি প্রথম নাযিল হ’লেও সংকলনের পরম্পরা অনুযায়ী তা ৯৬তম সূরার প্রথমে আনা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, এই তারতীব আল্লাহর হুকুমে হয়েছে, যা অপরিবর্তনীয়। এর মধ্যে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য আল্লাহর নিদর্শন রয়েছে।


মাত্র পাঁচটি আয়াত নাযিল হ’ল। তারপর ফেরেশতা অদৃশ্য হয়ে গেল। প্রথম কুরআন নাযিলের এই দিনটি ছিল ৬১০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই আগষ্ট সোমবার। ঐ সময় রাসূল (সাঃ)-এর বয়স ছিল চান্দ্রবর্ষ হিসাবে ৪০ বছর ৬ মাস ১২ দিন এবং সৌরবর্ষ হিসাবে ৩৯ বছর ৩ মাস ২২ দিন।[2] উল্লেখ্য, সকল ছহীহ হাদীছে এটি প্রমাণিত যে, সর্বদা অহি নাযিল হয়েছে জাগ্রত অবস্থায়, ঘুমন্ত অবস্থায় নয়’ (সীরাহ ছহীহাহ ১/১২৯)।


ভারতের উর্দূ কবি আলতাফ হোসায়েন হালী (১৮৩৭-১৯১৪ খৃঃ) বলেন,


اوتر كر حراسے سوئے قوم آيا + اور اك نسخۂ كيميا ساتھ لايا


‘হেরা থেকে নেমে জাতির কাছে এলেন এবং একটি পরশমণির টুকরা সাথে নিয়ে এলেন’ (মুসাদ্দাসে হালী ১৩ পৃঃ)।


[1]. আর-রাহীক্ব ৬৬ পৃঃ। উক্ত অহী রাতের বেলায় নাযিল হয়েছিল (ইবনু হিশাম ১/২৩৬; সূরা ক্বদর ৯৭/১-৫)। দিনের বেলা নয়। যেমনটি ড. আকরাম যিয়া ধারণা করেন (সীরাহ ছহীহাহ ১/১২৫)।

[2]. আর-রাহীক্ব ৬৬ পৃঃ। নুযূলে কুরআনের উক্ত তারিখ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা দ্রষ্টব্য : আর-রাহীক্বব পৃঃ ৬৬-৬৭, টীকা-২।


নতুনের শিহরণ ও খাদীজার বিচক্ষণতা (اهتزاز الجِدَّة وكِياسةُ خديجةَ)

নতুন অভিজ্ঞতায় শিহরিত মুহাম্মাদ (সাঃ) দ্রুত বাড়ী ফিরলেন। স্ত্রী খাদীজাকে বললেন, زَمِّلُوْنِى زَمِّلُوْنِى ‘শিগগীর আমাকে চাদর মুড়ি দাও। চাদর মুড়ি দাও’। কিছুক্ষণ পর ভয়ার্তভাব কেটে গেলে সব কথা স্ত্রীকে খুলে বললেন। রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে খাদীজা কেবল স্ত্রী ছিলেন না, তিনি ছিলেন তাঁর নির্ভরতার প্রতীক ও সান্ত্বনার স্থল। ছিলেন বিপদের বন্ধু। তিনি অভয় দিয়ে বলে উঠলেন, এটা খারাব কিছুই হ’তে পারে না।كَلاَّ وَاللهِ لاَيُخْزِيْكَ اللهُ اَبَدًا إِنَّكَ لَتَصِلُ الرَّحِمَ وَتَحْمِلُ الْكَلَّ وَتَكْسِبُ الْمَعْدُوْمَ وَتَقْرِى الضَّيْفَ وَتُعِيْنُ عَلَى نَوَائِبِ الْحَقِّ- ‘কখনোই না। আল্লাহর কসম! তিনি কখনোই আপনাকে অপদস্থ করবেন না। আপনি আত্মীয়দের সঙ্গে সদাচরণ করেন, দুস্থদের বোঝা বহন করেন, নিঃস্বদের কর্মসংস্থান করেন, অতিথিদের আপ্যায়ন করেন এবং বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করেন’। বস্ত্ততঃ সে যুগে কেউ কোন মর্যাদাবান ব্যক্তিকে আশ্রয় দিলে তার উদ্দেশ্যে এরূপ প্রশংসাসূচক বাক্য বলা হ’ত। যেমন বলেছিলেন সে সময় মক্কার নিম্নভূমি অঞ্চলের নেতা ইবনুদ দুগুন্না (ابْنُ الدُّغُنَّة) গোপনে হাবশায় গমনরত আবুবকর (রাঃ)-কে আশ্রয় দিয়ে ফেরাবার সময় (ইবনু হিশাম ১/৩৭৩)।


অতঃপর খাদীজা স্বামীকে সাথে নিয়ে চাচাতো ভাই অরাক্বা বিন নওফালের কাছে গেলেন। যিনি ইনজীল কিতাবের পন্ডিত ছিলেন এবং ঐ সময় বার্ধক্যে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি সব কথা শুনে বললেন, هَذَا النَّامُوْسُ الَّذِيْ نَزَّلَهُ اللهُ عَلَى مُوْسَى، يَا لَيْتَنِىْ فِيْهَا جَذْعًا، يَا لَيْتَنِىْ أَكُوْنُ حَيًّا إِذْ يُخْرِجُكَ قَوْمُكَ ‘এ তো সেই ফেরেশতা যাকে আল্লাহ মূসার প্রতি নাযিল করেছিলেন। হায়! যদি আমি সেদিন তরুণ থাকতাম। হায়! যদি আমি সেদিন জীবিত থাকতাম, যেদিন তোমার কওম তোমাকে বহিষ্কার করবে’। একথা শুনে চমকে উঠে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, اَوَ مُخْرِجِىَّ هُمْ؟ ‘ওরা কি আমাকে বের করে দিবে’? অরাক্বা বললেন, نَعَمْ لَمْ يَأْتِ رَجُلٌ قَطُّ بِمِثْلِ مَا جِئْتَ بِهِ إِلاَّ عُوْدِىَ ‘হ্যাঁ! তুমি যা নিয়ে আগমন করেছ, তা নিয়ে ইতিপূর্বে এমন কেউ আগমন করেননি, যার সাথে শত্রুতা করা হয়নি’। অতঃপর অরাক্বা তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, إِنْ يُدْرِكْنِيْ يَوْمُكَ أَنْصُرْكَ نَصْرًا مُؤَزَّرًا ‘যদি তোমার সেই দিন আমি পাই, তবে আমি তোমাকে সাধ্যমত সাহায্য করব’।[1]


[1]. বুখারী হা/৪৯৫৩, মুসলিম হা/১৬০, মিশকাত হা/৫৮৪১ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়, ‘অহি-র সূচনা’ অনুচ্ছেদ।


এখানে প্রসিদ্ধ আছে যে, রাসূল (সাঃ)-এর কাছে ফেরেশতা আসে না শয়তান আসে, তা যাচাই করার জন্য একদিন খাদীজা তাঁকে নিজের বাম উরু অতঃপর ডান উরু অতঃপর কোলের উপর বসান এবং বলেন, আপনি কি ফেরেশতাকে দেখতে পাচ্ছেন? রাসূল (সাঃ) বললেন হ্যাঁ। অতঃপর খাদীজা মাথার কাপড় ফেলে দিয়ে বললেন, এবার কি দেখতে পাচ্ছেন? তিনি বললেন, না। তখন খাদীজা বলে উঠলেন,اُثْبُتْ وَأَبْشِرْ فَوَاللهِ إنّهُ لَمَلَكٌ وَمَا هَذَا بِشَيْطَانٍ ‘আপনি নিশ্চিত থাকুন ও সুসংবাদ গ্রহণ করুন! আল্লাহর কসম! এটি মহান ফেরেশতা। এটি কোন শয়তান নয়’ (ইবনু হিশাম ১/২৩৮-৩৯; বায়হাক্বী দালায়েল, ২/১৫১)। বর্ণনাটি যঈফ’ (আলবানী, সিলসিলা যঈফাহ হা/৬০৯৭; মা শা-‘আ ২৭-২৮ পৃঃ)।



অহি ও ইলহাম (الوحى والإلهام)

‘অহি’ (الْوَحْىُ) অর্থ প্রত্যাদেশ এবং ‘ইলহাম’ (الْإِلْهَامُ) অর্থ প্রক্ষেপণ। ‘অহি’ আল্লাহর পক্ষ হ’তে নবীগণের নিকটে হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে ‘ইলহাম’ আল্লাহর পক্ষ থেকে যেকোন ব্যক্তির প্রতি হ’তে পারে। আল্লাহ মানুষের অন্তরে ভাল-মন্দ দু’টিই ‘ইলহাম’ করে থাকেন (আশ-শামস ৯১/৮)। আভিধানিক অর্থে ‘অহি’ অনেক সময় ‘ইলহাম’ অর্থে আসে। যেমন মূসার মা, খিযির, ঈসার মা ও নানী প্রমুখ নির্বাচিত বান্দাদের প্রতি আল্লাহ অহি করেছেন, যা কুরআনে বর্ণিত হয়েছে।[1] কিন্তু তা নবুঅতের অহি ছিলনা। অনুরূপভাবে জিন বা মানুষরূপী শয়তান যখন পরস্পরকে চাকচিক্যপূর্ণ যুক্তি দিয়ে পথভ্রষ্ট করে, ওটাকেও কুরআনে ‘অহি’ বলা হয়েছে (আন‘আম ৬/১১২) আভিধানিক অর্থে। তবে পারিভাষিক অর্থে ‘অহি’ বলতে কেবল তাকেই বলা হয়, যা মানবজাতির হেদায়াতের জন্য আল্লাহ তাঁর মনোনীত নবীগণের নিকট ফেরেশতা জিব্রীলের মাধ্যমে প্রেরণ করে থাকেন (বাক্বারাহ ২/৯৭)।


উল্লেখ্য যে, ইলহাম ও অহি এক নয়। প্রথমটি যেকোন ব্যক্তির মধ্যে হ’তে পারে। কিন্তু অহি কেবল নবী-রাসূলদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। নবী হওয়ার জন্য আধ্যাত্মিকতা শর্ত নয়। বরং আল্লাহর মনোনয়ন শর্ত। যদিও নবীগণ আধ্যাত্মিকতার সর্বোচ্চ নমুনা হয়ে থাকেন। অন্যদের আধ্যাত্মিকতায় শয়তানী খোশ-খেয়াল সম্পৃক্ত হ’তে পারে। যেমন বহু কাফের-মুশরিক যোগী-সন্ন্যাসীদের মধ্যে দেখা যায়।


এখানে এসে অনেক ইসলামী চিন্তাবিদের পদস্খলন ঘটে গেছে। তাঁরা ইলহাম ও অহীকে একত্রে গুলিয়ে ফেলেছেন। যেমন মাওলানা আব্দুর রহীম (১৯১৮-১৯৮৭ খৃ.) বলেন, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার অনেকাংশেই এক ধরনের ‘ইলহাম’-এর সাহায্যে হয়ে থাকে। এ ইলহাম বা অহীরই বাস্তবতা আমরা দেখতে পাই সেইসব লোকের জীবনেও, যাঁদের আমরা বলি নবী ও রাসূল।... বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (স.)-এর প্রতি বিশ্বলোক ও বিশ্ব মানবতার সমস্যার সঠিক সমাধান অনুরূপ পদ্ধতিতে ও আকস্মিকভাবে মক্কার এক পর্বত গুহায় উদ্ঘাটিত হয়ে পড়ে। তাঁকে নির্দেশ করা হয় : ‘পড় তোমার সেই রবের নামে...। এই দু’টি ক্ষেত্রের জন্যই সেই একই মহাসত্যের নিকট থেকে ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি’ আসার এ ঘটনাবলী অত্যন্ত বিষ্ময়কর হ’লেও এতে পারস্পরিক বৈপরিত্য বলতে কিছুই নেই’।[2]


আমরা বলব, এ যুগের আইনস্টাইন বলে খ্যাত স্টিফেন হকিং (জন্ম : ১৯৪২)[3] যিনি বলেন, ঈশ্বর ও পরকাল বলে কিছু নেই, তিনিও কি তাহ’লে আল্লাহর অহী পেয়ে এগুলো বলছেন, নাকি শয়তানের ধোঁকায় পড়ে এগুলি বলছেন? নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানী ও নবী কখনোই এক নন। আধ্যাত্মিক ব্যক্তি ও চিন্তাবিদ মানুষ চিরকাল থাকবেন। কিন্তু তারা কখনোই নবী হবেন না। আর নবুঅতের সিলসিলা শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ) পর্যন্ত এসে সমাপ্ত হয়ে গেছে।


[1]. ক্বাছাছ ২৮/৭; কাহফ ১৮/৮২; মারিয়াম ১৯/২৪; আলে ইমরান ৩/৩৫-৩৬।

[2]. মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম, মহাসত্যের সন্ধানে (ঢাকা : খায়রুন প্রকাশনী ৫ম প্রকাশ ১৯৯৮) লেখকের ‘ভূমিকা’ জুলাই ১৯৭৫।

[3]. Stephen William Hawking একজন বৃটিশ তাত্ত্বিক পদার্থবিদ। যিনি কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে Centre for Theoretical Cosmology-এর প্রধান গবেষণা পরিচালক। ২১ বছর বয়সে ১৯৬৩ সাল থেকে তিনি মাথা ব্যতীত সর্বাঙ্গ প্যারালাইজড অবস্থায় শয্যাশায়ী আছেন। বর্তমানে তাঁর বয়স ৭৩ বছর।


অহি-র প্রকারভেদ (أقسام الوحى)

আল্লাহ কিভাবে ‘অহি’ প্রেরণ করেন, সে বিষয়ে তিনি বলেন,وَمَا كَانَ لِبَشَرٍ أَنْ يُكَلِّمَهُ اللهُ إِلاَّ وَحْيًا أَوْ مِنْ وَرَاءِ حِجَابٍ أَوْ يُرْسِلَ رَسُولاً فَيُوحِيَ بِإِذْنِهِ مَا يَشَاءُ إِنَّهُ عَلِيٌّ حَكِيْمٌ ‘মানুষের জন্য এটি অসম্ভব যে, আল্লাহ তার সাথে সরাসরি কথা বলবেন অহি-র মাধ্যম ছাড়া অথবা পর্দার অন্তরাল ব্যতিরেকে অথবা এমন দূত প্রেরণ ব্যতীত, যে তাঁর অনুমতিক্রমে তিনি যা চান তা ব্যক্ত করে। নিশ্চয়ই তিনি সর্বোচ্চ ও প্রজ্ঞাময়’ (শূরা ৪২/৫১)। হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) নবীদের নিকটে ‘অহি’ প্রেরণের সাতটি প্রকারভেদ বর্ণনা করেছেন। যেমন-


(১) সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে। যা রাসূল (সাঃ) ৪০ বছর বয়সে রবীউল আউয়াল মাস থেকে রামাযান মাস পর্যন্ত প্রথম ছয়মাস প্রাপ্ত হয়েছিলেন। যা প্রভাত সূর্যের ন্যায় সত্য হয়ে দেখা দিত (বুখারী হা/৩)।

(২) অদৃশ্য থেকে হৃদয়ে অহি-র প্রক্ষেপণ, যা জিব্রীল মাঝে-মধ্যে রাসূল (সাঃ)-এর উপরে করতেন।[1]

(৩) মানুষের রূপ ধারণ করে জিব্রীলের আগমন। যেমন একবার দেহিয়াতুল কালবীর রূপ ধারণ করে ছাহাবীগণের মজলিসে এসে তিনি রাসূল (সাঃ)-কে ইসলাম, ঈমান, ইহসান ও ক্বিয়ামতের আলামত সম্পর্কে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে শিক্ষা দেন।[2] যাকে ‘হাদীছে জিব্রীল’ বলা হয়।

(৪) কখনো ঘণ্টাধ্বনির আওয়ায করে ‘অহি’ নাযিল হ’ত। এ সময় রাসূল (সাঃ) খুব কষ্ট অনুভব করতেন। প্রচন্ড শীতের দিনেও দেহে ঘাম ঝরত (বুখারী হা/২)। উটের পিঠে থাকলে অধিক ভার বহনে অক্ষম হয়ে উট বসে পড়ত (হাকেম হা/৩৮৬৫)। রাসূল (সাঃ)-এর উরুর চাপে একবার এ অবস্থায় যায়েদ বিন ছাবিতের উরুর হাড় ভেঙ্গে যাবার উপক্রম হয়েছিল (বুখারী হা/২৮৩২)।

(৫) জিব্রীল (আঃ) স্বরূপে এসে ‘অহি’ প্রদান করতেন। এটি দু’বার ঘটেছে। যেমন সূরা নাজমে (৫-১৪) বর্ণিত হয়েছে।[3]

(৬) সরাসরি আল্লাহর ‘অহি’। যেমন মে‘রাজ রজনীতে সিদরাতুল মুনতাহায় অবস্থানকালে পর্দার অন্তরাল থেকে আল্লাহ সরাসরি অহি-র মাধ্যমে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয করেন।[4]

(৭) ফেরেশতার মাধ্যম ছাড়াই দুনিয়াতে আল্লাহ পর্দার অন্তরাল থেকে স্বীয় নবীর সঙ্গে কথা বলেন। যেমন মূসা (আঃ)-এর সঙ্গে তূর পাহাড়ে তিনি কথা বলেছিলেন (ত্বোয়াহা ২০/১১-২৩; নিসা ৪/১৬৪)। অনেকে অষ্টম আরেকটি ধারা বলেছেন যে, কোনরূপ পর্দা ছাড়াই দুনিয়াতে আল্লাহ তাঁর সাথে সরাসরি কথা বলেছেন। এটি প্রমাণিত নয়।[5]


[1]. ছহীহাহ হা/২৮৬৬; মিশকাত হা/৫৩০০।

[2]. মুসলিম হা/৮; নাসাঈ হা/৪৯৯১; মিশকাত হা/২।

[3]. মুসলিম হা/১৭৭; তিরমিযী হা/৩২৭৭।

[4]. বুখারী হা/৩২০৭; মুসলিম হা/১৬২।

[5]. যা-দুল মা‘আদ ১/৭৭-৭৯; আর-রাহীক্ব ৭০ পৃঃ।


শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ -৩ (العبر -৩)

১. সর্বপ্রথম নাযিলকৃত সূরা ‘আলাক্বের প্রথম পাঁচটি আয়াতে পড়া ও লেখা এবং তার মাধ্যমে এমন জ্ঞান অর্জনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা আধ্যাত্মিক ও বৈষয়িক উভয় জ্ঞানের সমন্বয় সাধন করে। আর সেটাই হ’ল প্রকৃত মানবীয় শিক্ষা।

২. আলাক্ব-এর চাহিদা পূরণে গৃহীত বস্ত্তগত শিক্ষা যেন মানুষকে তার খালেক-এর সন্ধান দেয় এবং তাঁর প্রতি দাসত্ব, আনুগত্য ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশে উদ্বুদ্ধ করে, সে বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

৩. সসীম মানবীয় জ্ঞানের সাথে অসীম এলাহী জ্ঞানের হেদায়াত যুক্ত না হওয়া পর্যন্ত মানুষ কখনোই প্রকৃত জ্ঞানী হ’তে পারে না এবং সে কখনোই প্রকৃত সত্য খুঁজে পাবে না- সেকথা স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে। যেমন মানুষের নিজস্ব দৃষ্টিশক্তির সাথে চশমা, অনুবীক্ষণ বা দূরবীক্ষণ যন্ত্র যুক্ত হ’লে তার দৃষ্টিসীমা প্রসারিত হয়। বলা বাহুল্য তাওহীদের জ্ঞান অর্জনের আহবানই ছিল মানবজাতির প্রতি কুরআনের সর্বপ্রথম আহবান।

৪. কয়েকদিনের বিরতির পর সূরা মুদ্দাছছিরে নাযিলকৃত পাঁচটি আয়াতে পূর্বোক্ত অভ্রান্ত জ্ঞানের তথা তাওহীদের প্রচার ও প্রসারের গুরু দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছে এক অপূর্ব অলংকারসমৃদ্ধ ভাষায়। উঠো! ভোগবাদী মানুষকে শয়তানের ধোঁকা থেকে বাঁচাও। সর্বত্র আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা কর। শিরকী জাহেলিয়াতের কলুষময় পোষাক ঝেড়ে ফেল এবং সকল অপবিত্রতা হ’তে মুক্ত হও। অর্থাৎ মানুষের মনোজগতে ও কর্মজগতে আমূল সংস্কার সাধনের প্রতিজ্ঞা নিয়ে হে চাদরাবৃত মুহাম্মাদ! উঠে দাঁড়াও!!

৫. যার পরপরই একই দরদভরা ভাষায় সূরা মুযযাম্মিল নাযিল করে রাসূল (সাঃ) ও ছাহাবীগণের জন্য তাহাজ্জুদ ছালাত তথা নৈশ ইবাদতের নির্দেশ দেওয়া হয় (মুযযাম্মিল ৭৩/১-৪)। কেননা পরবর্তী সমাজ বিপ্লবের গুরুদায়িত্ব পালনের জন্য নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি সম্পন্ন মানুষ তৈরী করাই ছিল প্রধান কাজ। আর আধ্যাত্মিক মানস গঠনে তাহাজ্জুদ ছালাতের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

৬. দুনিয়াপূজারী অধঃপতিত জাতিকে উদ্ধারের যে পথ মুহাম্মাদ (সাঃ) তালাশ করছিলেন, তা তিনি পেয়ে গেলেন আল্লাহর অহি-র মাধ্যমে। আর তা হ’ল জীবনের লক্ষ্য পরিবর্তন। অর্থাৎ দুনিয়াপূজারী মানুষকে আল্লাহমুখী করা এবং সার্বিক জীবনে অহি-র বিধান অনুসরণের মাধ্যমে আখেরাতে মুক্তিই হবে মানুষের পার্থিব জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। অন্য কোন পথে মানবতার মুক্তি নেই।

৭. সসীম জ্ঞানের ঊর্ধ্বে অসীম জ্ঞানের উৎস আল্লাহর সন্ধান পাওয়াই ছিল প্রথম নুযূলে অহি-র অমূল্য অবদান।



ইকবাল বলেন,

الله سے كرے دور تو تعليم بهى فتنہ + أملاك بهى اولاد بهى جاگير بهى فتنہ

ناحق كے لئے اٹهے تو شمشير بهى فتنہ + شمشير ہى كيا نعرۂ تكبير بهى فتنہ


(১) আল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে, সে শিক্ষা হ’ল ফিৎনা।

(২) সম্পদ, সন্তান এমনকি জাগীরও ফিৎনা।

(৩) অসত্যের জন্য যদি তরবারি ওঠে, তবে সেটিও ফিৎনা।

(৪) তরবারি কিসের, নারায়ে তাকবীরও ফিৎনা।


শেষনবী (خاتم الأنبياء)

(ক) আল্লাহ মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে শেষনবী হিসাবে মনোনীত করেন। তিনি বলেন, مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِنْ رِجَالِكُمْ وَلَكِنْ رَسُولَ اللهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ ‘মুহাম্মাদ তোমাদের কোন ব্যক্তির পিতা নন। বরং তিনি আল্লাহর রাসূল ও শেষনবী’ (আহযাব ৩৩/৪০)।[1] তিনি বলেন, اللهُ أَعْلَمُ حَيْثُ يَجْعَلُ رِسَالَتَهُ ‘আল্লাহ সর্বাধিক অবগত কার নিকটে তিনি রিসালাত সমর্পণ করবেন’ (আন‘আম ৬/১২৪)। কেননা وَاللهُ يَخْتَصُّ بِرَحْمَتِهِ مَن يَّشَاءُ ‘আল্লাহ স্বীয় অনুগ্রহের জন্য যাকে চান তাকে খাছ করে নেন’ (বাক্বারাহ ২/১০৫)।


রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, إِنَّ مَثَلِى وَمَثَلَ الأَنْبِيَاءِ مِنْ قَبْلِى كَمَثَلِ رَجُلٍ بَنَى بَيْتًا فَأَحْسَنَهُ وَأَجْمَلَهُ إِلاَّ مَوْضِعَ لَبِنَةٍ مِنْ زَاوِيَةٍ فَجَعَلَ النَّاسُ يَطُوفُونَ بِهِ وَيَعْجَبُونَ لَهُ وَيَقُولُونَ هَلاَّ وُضِعَتْ هَذِهِ اللَّبِنَةُ قَالَ فَأَنَا اللَّبِنَةُ وَأَنَا خَاتِمُ النَّبِيِّينَ ‘আমি ও আমার পূর্বেকার নবীগণের তুলনা ঐ ব্যক্তির ন্যায় যিনি একটি গৃহ নির্মাণ করেছেন। অতঃপর সেটিকে খুবই সুন্দর ও আকর্ষণীয় করেছেন। কিন্তু কোণায় একটি জায়গা খালি রেখেছেন। তখন লোকেরা ঐ স্থানটি ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে এবং বিস্ময় প্রকাশ করতে থাকে ও বলতে থাকে, কেন এখানে একটি ইট দেওয়া হয়নি? রাসূল (সাঃ) বলেন, আমিই সেই ইট এবং আমিই শেষনবী’।[2] لاَ نَبِىَّ بَعْدِى ‘আমার পরে আর কোন নবী নেই’।[3] তিনি বলেন, بُعِثْتُ إِلَى الأَحْمَرِ وَالأَسْوَدِ، وَكَانَ النَّبِىُّ يُبْعَثُ إِلَى قَوْمِهِ خَاصَّةً وَبُعِثْتُ إِلَى النَّاسِ عَامَّةً- ‘আমি লাল ও কালো সকলের প্রতি প্রেরিত হয়েছি। অন্য নবীগণ নির্দিষ্টভাবে স্ব স্ব গোত্রের জন্য প্রেরিত হয়েছেন। কিন্তু আমি মানবজাতির সকলের জন্য প্রেরিত হয়েছি’।[4] আল্লাহ বলেন, وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلاَّ كَافَّةً لِلنَّاسِ ‘আমরা তোমাকে পুরা মানবজাতির প্রতি প্রেরণ করেছি’ (সাবা ৩৪/২৮)­। অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, فَأَرْسَلَهُ إِلَى الْجِنِّ وَالإِنْسِ ‘অতঃপর আল্লাহ তাঁকে জিন ও ইনসানের প্রতি প্রেরণ করেন’।[5] আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত অন্য হাদীছে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, وَأُرْسِلْتُ إِلَى الْخَلْقِ كَافَّةً وَخُتِمَ بِىَ النَّبِيُّونَ ‘আমাকে পুরা সৃষ্টি জগতের প্রতি প্রেরণ করা হয়েছে এবং আমাকে দিয়েই নবীদের সিলসিলা সমাপ্ত করা হয়েছে’।[6]


বর্তমান পৃথিবীর সকল জিন ও ইনসান শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর উম্মত। যারা তাঁর দ্বীন কবুল করেছে, তারা হ’ল ‘উম্মাতুল ইজাবাহ’ (أُمَّةُ الْإِجَابَةِ) অর্থাৎ মুসলিম। আর যারা তাঁর দ্বীন কবুল করেনি, তারা হ’ল ‘উম্মাতুদ দা‘ওয়াহ’ (أُمَّةُ الدَّعْوَةِ) অর্থাৎ কাফির-মুশরিকগণ, যাদেরকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দিতে হবে। যেহেতু আর কোন শরী‘আত নিয়ে আর কোন নবী আসবেন না, সেকারণ ক্বিয়ামত পর্যন্ত সকল জিন-ইনসান শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর উম্মত। মুসলমানের কর্তব্য হ’ল শেষনবী (সাঃ)-এর আনীত ইসলামী শরী‘আত নিজেরা মেনে চলা এবং দুনিয়াবাসীকে তা মেনে চলার আহবান জানানো। কেননা হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন,وَالَّذِى نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لاَ يَسْمَعُ بِى أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الأُمَّةِ يَهُودِىٌّ وَلاَ نَصْرَانِىٌّ ثُمَّ يَمُوْتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِى أُرْسِلْتُ بِهِ إِلاَّ كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ ‘যাঁর হাতে মুহাম্মাদের জীবন তাঁর কসম করে বলছি, ইহূদী হৌক বা নাছারা হৌক এই উম্মতের যে কেউ আমার আগমনের খবর শুনেছে, অতঃপর মৃত্যুবরণ করেছে, অথচ আমি যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছি, তার উপরে ঈমান আনেনি, সে ব্যক্তি অবশ্যই জাহান্নামী হবে’।[7]


মূলতঃ খতমে নবুঅতের আক্বীদার মধ্যেই বিশ্ব মুসলিম ও বিশ্ব মানবতার ঐক্য ও অগ্রগতি নির্ভর করে। এই ঐক্য বিনষ্ট করার জন্য শয়তান শুরু থেকেই চেষ্টা চালিয়েছে এবং এখনও চালিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উম্মতকে সাবধান করে বলেন, ‘অতদিন ক্বিয়ামত হবে না, যতদিন না আমার উম্মতের কিছু গোত্র মুশরিকদের সঙ্গে মিশে যাবে এবং মূর্তিপূজা করবে। আর সত্ত্বর আমার উম্মতের মধ্যে ত্রিশ জন মিথ্যাবাদীর জন্ম হবে। যাদের প্রত্যেকে ধারণা করবে যে, সে নবী (كَذَّابُونَ ثَلاَثُونَ كُلُّهُمْ يَزْعُمُ أَنَّهُ نَبِىٌّ)। অথচ আমি শেষনবী। আমার পরে কোন নবী নেই। আর আমার উম্মতের মধ্যে চিরদিন একটি দল হক-এর উপরে বিজয়ী থাকবে, বিরোধীরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এভাবেই আল্লাহর নির্দেশ (ক্বিয়ামত) এসে যাবে’ (আবুদাঊদ হা/৪২৫২)। রাসূল (সাঃ)-এর জীবদ্দশায় ছান‘আর আসওয়াদ ‘আনাসী ও ইয়ামামার মুসায়লামা কাযযাব (মুসলিম হা/২২৭৪) এবং তাঁর মৃত্যুর পরে আরও কয়েকজন সহ এ যুগে মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী (১৮৩৯-১৯০৮ খৃ.) তাদের অন্যতম।


(খ) নবীগণের অঙ্গীকার (ميثاق الأنبياء) :

আখেরী নবীর প্রতি ঈমান আনা ও তাঁকে সর্বতোভাবে সাহায্য করার জন্য পূর্বেই আল্লাহ নবীগণের নিকট থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন। যেমন তিনি বলেন,وَإِذْ أَخَذَ اللهُ مِيْثَاقَ النَّبِيِّينَ لَمَا آتَيْتُكُمْ مِنْ كِتَابٍ وَحِكْمَةٍ ثُمَّ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مُصَدِّقٌ لِمَا مَعَكُمْ لَتُؤْمِنُنَّ بِهِ وَلَتَنْصُرُنَّهُ قَالَ أَأَقْرَرْتُمْ وَأَخَذْتُمْ عَلَى ذَلِكُمْ إِصْرِي قَالُوا أَقْرَرْنَا قَالَ فَاشْهَدُوا وَأَنَا مَعَكُمْ مِنَ الشَّاهِدِيْنَ- ‘আর যখন আল্লাহ নবীগণের নিকট থেকে অঙ্গীকার নিলেন এই মর্মে যে, আমি তোমাদের কিতাব ও হিকমত যা দান করেছি, এরপরে যদি কোন রাসূল আসেন, যিনি তোমাদেরকে প্রদত্ত কিতাবের সত্যায়ন করবেন, তাহ’লে অবশ্যই তোমরা তার প্রতি ঈমান আনবে এবং অবশ্যই তাকে সাহায্য করবে। তিনি বললেন, তোমরা কি এতে স্বীকৃতি দিচ্ছ এবং তোমাদের স্বীকৃতির উপর আমার অঙ্গীকার নিচ্ছ? তারা বলল, আমরা স্বীকৃতি দিলাম। তিনি বললেন, তাহ’লে তোমরা সাক্ষী থাক এবং আমিও তোমাদের সাথে অন্যতম সাক্ষী রইলাম’ (আলে ইমরান ৩/৮১)।[8]


(গ) আহলে কিতাব পন্ডিতদের অঙ্গীকার (ميثاق أحبار أهل الكتاب للإيمان على محمد):

আহলে কিতাব পন্ডিতগণের নিকট থেকে অঙ্গীকার নেওয়া হয় এই মর্মে যে, তারা যেন সত্য গোপন না করে এবং শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর আগমন ও তাঁর প্রতি ঈমান আনার বিষয়টি লোকদের নিকট প্রকাশ করে। যেমন আল্লাহ বলেন,وَإِذْ أَخَذَ اللهُ مِيثَاقَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ لَتُبَيِّنُنَّهُ لِلنَّاسِ وَلاَ تَكْتُمُونَهُ فَنَبَذُوهُ وَرَاءَ ظُهُورِهِمْ وَاشْتَرَوْا بِهِ ثَمَنًا قَلِيلاً فَبِئْسَ مَا يَشْتَرُونَ ‘আর আল্লাহ যখন আহলে কিতাবদের নিকট থেকে অঙ্গীকার নিলেন যে, তোমরা অবশ্যই (শেষনবী মুহাম্মাদের আগমন ও তার উপর ঈমান আনার বিষয়টি) লোকদের নিকট বর্ণনা করবে এবং তা গোপন করবে না। অতঃপর তারা তা পশ্চাতে নিক্ষেপ করল এবং গোপন করার বিনিময়ে তা স্বল্পমূল্যে বিক্রয় করল। কতই না নিকৃষ্ট তাদের ক্রয়-বিক্রয়’ (আলে-ইমরান ৩/১৮৭)।


ইবনু কাছীর বলেন, অত্র আয়াতে ইহূদী-নাছারা পন্ডিতদের ধমক দেওয়া হয়েছে ও ধিক্কার জানানো হয়েছে এ কারণে যে, তারা নিকৃষ্ট দুনিয়াবী স্বার্থে পূর্বেকার সেই অঙ্গীকার ভুলে গেছে এবং লোকদের নিকট উক্ত অঙ্গীকারের কথা চেপে গেছে। এই অঙ্গীকারের কথা তাদের নবীগণের মাধ্যমে তাদের ধর্মনেতাদের জানিয়ে দেওয়া হয়। কতই না নিকৃষ্ট ছিল তাদের হাতের উপর হাত রাখা এবং কতই না নিকৃষ্ট ছিল তাদের বায়‘আত গ্রহণ করা। তিনি বলেন, এর মধ্যে মুসলিম আলেমদের জন্য সতর্কবাণী রয়েছে, যেন তারা আহলে কিতাবদের মত না হন এবং তারা যেন সৎকর্মের কোন ইলম গোপন না করেন (ঐ, তাফসীর)।


(ঘ) ঈসা (আঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী (بشارة عيسى ) :

পূর্বের নবীগণের ন্যায় আহলে কিতাবগণের শেষনবী ঈসা (আঃ) স্বীয় কওমকে উদ্দেশ্য করে সর্বশেষ নবী ও রাসূল মুহাম্মাদের আগমনের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন, وَإِذْ قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ إِنِّي رَسُولُ اللهِ إِلَيْكُم مُّصَدِّقاً لِّمَا بَيْنَ يَدَيَّ مِنَ التَّوْرَاةِ وَمُبَشِّراً بِرَسُولٍ يَأْتِي مِن بَعْدِي اسْمُهُ أَحْمَدُ فَلَمَّا جَاءهُم بِالْبَيِّنَاتِ قَالُوا هَذَا سِحْرٌ مُّبِينٌ ‘স্মরণ কর, যখন মরিয়ম-তনয় ঈসা বলেছিল, হে বনু ইস্রাঈলগণ! আমি তোমাদের প্রতি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল, আমার পূর্ববর্তী তওরাতের আমি সত্যায়নকারী এবং আমি এমন একজন রাসূল-এর সুসংবাদ দানকারী, যিনি আমার পরে আগমন করবেন, তার নাম হবে ‘আহমাদ’। অতঃপর যখন তিনি তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শনাবলীসহ আগমন করলেন, তখন তারা বলল, এটাতো প্রকাশ্য জাদু মাত্র’ (ছফ ৬১/৬)।


(ঙ) তাওরাত ও ইনজীলে ভবিষ্যদ্বাণী(بشارته صـ فى التوراة والإنجيل) :

রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আগমন সংবাদ তাওরাত-ইনজীলেও লিপিবদ্ধ ছিল। যেমন আল্লাহ বলেন, الَّذِيْنَ يَتَّبِعُوْنَ الرَّسُوْلَ النَّبِيَّ الْأُمِّيَّ الَّذِي يَجِدُوْنَهُ مَكْتُوبًا عِنْدَهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيْلِ ‘(এই কল্যাণ কেবল তাদেরই প্রাপ্য) যারা এই রাসূলের আনুগত্য করে যিনি নিরক্ষর নবী, যার বিষয়ে তারা তাদের কিতাব তাওরাত ও ইনজীলে লিপিবদ্ধ পেয়েছে’ (আ‘রাফ ৭/১৫৭)। সেকারণ তাঁর আগমন বিষয়ে ইহূদী-নাছারা পন্ডিতগণ আগেভাগেই জানতেন (বাক্বারাহ ২/৮৯)। তারা তাঁকে চিনতেন যেমন নিজের সন্তানদের তারা চিনতেন’।[9]


(চ) আহলে কিতাবগণের প্রতীক্ষিত নবী (نبى منتظر لأهل الكتاب) :

মক্কায় অরাক্বা বিন নওফাল, শামে বাহীরা প্রমুখ পন্ডিতগণ তাঁকে দেখেই চিনতে পেরেছিলেন। সেকারণ হাবশার সম্রাট নাজাশী, রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস ও মিসররাজ মুক্বাউক্বিস সকলেই তাঁকে সসম্মানে গ্রহণ করেছিলেন। যারা সবাই খ্রিষ্টান ছিলেন। শেষনবীর সন্ধানেই সুদূর পারস্যের ইছফাহান হ’তে অগ্নিপূজক সালমান ফারেসী খ্রিষ্টান পাদ্রীদের কাছে শুনে দীর্ঘদিন সন্ধান শেষে মদীনায় এসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট ১ম হিজরীতে ইসলাম কবুল করেন।[10] ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, আহলে কিতাবদের নিকটে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর পরিচিতি অবিরত ধারায় বর্ণিত ছিল।[11] আহলে কিতাবদের নিকট থেকে ইয়াছরিবের অধিবাসীরা আগে থেকেই শেষনবীর আগমন ও তাঁর নাম-চেহারা ও পরিচিতি সম্পর্কে জানত (ইবনু হিশাম ১/২৩২)। এমনকি তারা শেষনবীর আগমনের পর তাকে সাথে নিয়ে অবাধ্য ইয়াছরেবীদের উপর জয়লাভ করবে ও তাদের হত্যা করবে বলে হুমকি দিত।[12] আর সেকারণেই তারা মক্কায় এসে আগেই ইসলাম কবুল করে এবং তাদের আহবানে সাড়া দিয়ে রাসূল (সাঃ) মদীনায় হিজরত করেন।


তাদের উক্ত আকাংখার বিষয়টি প্রকাশ করে আল্লাহ বলেন, وَلَمَّا جَاءَهُمْ كِتَابٌ مِنْ عِنْدِ اللهِ مُصَدِّقٌ لِمَا مَعَهُمْ وَكَانُوا مِنْ قَبْلُ يَسْتَفْتِحُونَ عَلَى الَّذِينَ كَفَرُوا فَلَمَّا جَاءَهُمْ مَا عَرَفُوا كَفَرُوا بِهِ فَلَعْنَةُ اللهِ عَلَى الْكَافِرِينَ ‘আর যখন তাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ হ’তে কিতাব (কুরআন) এসে গেল, যা সত্যায়নকারী ছিল (তওরাত-ইনজীলের), যা তাদের কাছে রয়েছে। অথচ ইতিপূর্বে তারা (শেষনবীর মাধ্যমে) কাফেরদের উপর বিজয় কামনা করত। অবশেষে যখন তাদের নিকট পরিচিত সেই কিতাব (কুরআন) এসে গেল তারা তাকে অস্বীকার করল। অতএব কাফেরদের উপরে আল্লাহর অভিসম্পাৎ’ (বাক্বারাহ ২/৮৯)।


এক্ষণে আমরা রাসূল (সাঃ)-এর দীর্ঘ তেইশ বছরের নবুঅতী জীবন বিবৃত করব। যার মধ্যে মাক্কী জীবনের তের বছর ছিল নিরবচ্ছিন্নভাবে দাওয়াতী জীবন এবং শেষ দশ বছরের মাদানী জীবন ছিল তাওহীদ ভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য দাওয়াত ও জিহাদের সমন্বিত কষ্টকর জীবন।


[1]. পালিত পুত্র যায়েদ বিন হারেছাহ্র তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী যয়নাব বিনতে জাহশকে আল্লাহর হুকুমে বিয়ে করার পর কাফির ও মুনাফিকদের অপপ্রচারের প্রতিবাদে অত্র আয়াত নাযিল হয়। এর মাধ্যমে যায়েদ বিন হারেছাহকে ‘যায়েদ বিন মুহাম্মাদ’ বলতে নিষেধ করা হয় (ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা আহযাব ৪০ আয়াত)। দুর্ভাগ্য এটি এখন বিদ‘আতীদের নিকট মীলাদের আয়াতে পরিণত হয়েছে।


[2]. বুখারী হা/৩৫৩৫; মুসলিম হা/২২৮৬; মিশকাত হা/৫৭৪৫, আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে।

[3]. বুখারী হা/৩৪৫৫; মুসলিম হা/১৮৪২; আবুদাঊদ হা/৪২৫২ মিশকাত/৩৬৭৫, ৫৪০৬, ছাওবান (রাঃ) হ’তে।

[4]. আহমাদ হা/১৪৩০৩; বুখারী হা/৩৩৫; মুসলিম হা/ ৫২১; মিশকাত হা/৫৭৪৭।

[5]. দারেমী, ‘ভূমিকা’ হা/৪৬, সনদ ছহীহ; মিশকাত হা/৫৭৭৩।

[6]. মুসলিম হা/৫২৩; মিশকাত হা/৫৭৪৮।

[7]. মুসলিম হা/১৫৩; মিশকাত হা/১০।

[8]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা আলে ইমরান ৮১ আয়াত; ইবনু হিশাম ১/২৩২-৩৪।

[9]. বাক্বারাহ ২/১৪৬; ইবনু হিশাম ১/২০৪।

[10]. ইবনু হিশাম ১/২১৪-২২২; আহমাদ হা/২৩৭৮৮, সনদ হাসান।

[11]. ইবনু তায়মিয়াহ, আল-জাওয়াবুছ ছহীহ লেমান বাদ্দালা দীনাল মাসীহ ১/৩৪০।

[12]. ইবনু হিশাম ১/২১১, সনদ হাসান; সীরাহ ছহীহাহ ১/১২২; ইবনু কাছীর, তাফসীর বাক্বারাহ ৮৯ আয়াত।


দাওয়াতী জীবন (الحياة الدعوية)

নবীদের দাওয়াতকে গোপনে ও প্রকাশ্যে দু’ভাগে ভাগ করার কোন সুযোগ নেই। কেননা তাঁরা নিজ সম্প্রদায়ের নিকট প্রকাশ্যভাবেই নবুঅতের দাবী নিয়ে দাওয়াত শুরু করেন। প্রত্যেক নবীই তার কওমকে বলেছেন,يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ ‘হে আমার কওম! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন উপাস্য নেই’।[1] আমাদের নবীও বলেছেন,يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا ‘হে মানবজাতি! আমি তোমাদের সকলের প্রতি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল..’ (আ‘রাফ ৭/১৫৮)। তবে এটাই স্বাভাবিক যে, আপনজনদের নিকটেই প্রথমে দাওয়াত দেওয়া হয়। আর এই দাওয়াত স্থান-কাল-পাত্রভেদে কখনো গোপনে কখনো প্রকাশ্যে কখনো সর্বসমক্ষে হয়ে থাকে। ইবনু ইসহাক বিনা সনদে উল্লেখ করেন, তার নিকটে এই মর্মে খবর পৌঁছেছে যে, আল্লাহ তাকে প্রকাশ্যে দাওয়াত দেওয়ার নির্দেশ দানের আগ পর্যন্ত রাসূল (সাঃ) তিন বছর গোপনে দাওয়াত দিয়েছেন’ (ইবনু হিশাম ১/২৬২)। ইবনু সা‘দ এবং ওয়াক্বেদীও সে কথা বলেছেন। বালাযুরী এটাকে চার বছর বলেছেন। অনেক জীবনীকার এই মেয়াদের উপর ভিত্তি করে শেষনবী (সাঃ)-এর দাওয়াতের মেয়াদ নির্দিষ্ট করেছেন। অথচ দাওয়াতের এইরূপ সীমা নির্ধারণ করার কোন দলীল নেই’ (মা শা-‘আ ২৯ পৃঃ)।


যেকোন সংস্কার আন্দোলন শুরু করতে গেলে প্রথমে তা গোপনেই শুরু করতে হয়। পুরা সমাজ যেখানে ভোগবাদিতায় ডুবে আছে, সেখানে ভোগলিপ্সাহীন আখেরাতভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার দাওয়াত নিয়ে অগ্রসর হওয়া সাগরের স্রোত পরিবর্তনের ন্যায় কঠিন কাজ। এ পথের দিশা দেওয়া এবং এ পথে মানুষকে ফিরিয়ে আনা দু’টিই কঠিন বিষয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সেকাজের জন্যই আদিষ্ট হয়েছিলেন। অহী প্রাপ্ত হওয়ার পরেই খাদীজার সাথে তিনি সে সময়ে মক্কার বয়োবৃদ্ধ সেরা বিদ্বান অরাক্বা বিন নওফাল-এর কাছে যান। তিনি সবকিছু অবগত হওয়ার পর তাঁকে ভবিষ্যৎ বিরোধিতা ও আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সাবধান করে দেন। ফলে তিনি প্রথমে গোপনে দাওয়াত শুরু করেন। যদিও খাদীজা, আলী, আবুবকর, ওছমান প্রমুখদের মত মক্কার সেরা ও প্রসিদ্ধ ব্যক্তিগণের ইসলাম কবুলের পর এই দাওয়াত আদৌ গোপন থাকেনি।

[1]. আ‘রাফ ৭/৫৯, ৬৫, ৭৩, ৮৫; হূদ ১১/৫০, ৬১, ৮৪; মুমিনূন ২৩/২৩; আনকাবূত ২৯/৩৬।


প্রাথমিক মুসলমানগণ (المسلمون الأولون)

প্রথমেই তাঁর দাওয়াত কবুল করেন মহিলাদের মধ্যে তাঁর পুণ্যশীলা স্ত্রী খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ (রাঃ)। অতঃপর গোলামদের মধ্যে তাঁর মুক্তদাস যায়েদ বিন হারেছাহ, শিশু-কিশোরদের মধ্যে আলী ইবনু আবী তালিব এবং বয়স্কদের মধ্যে নিকটতম বন্ধু আবুবকর ইবনু আবী কুহাফাহ (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম)।


অতঃপর আবুবকর (রাঃ)-এর দাওয়াতে ইসলাম কবুল করেন একে একে ওছমান, যুবায়ের, আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ, সা‘দ বিন আবু ওয়াক্কাছ ও তালহা বিন ওবায়দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম)। এছাড়া আবুবকরের স্ত্রী উম্মে রূমান ও মা বার্রাহ এবং দুই মেয়ে আসমা ও আয়েশা। এছাড়া আবুবকর (রাঃ) কর্তৃক ৭ জন মুক্তদাস-দাসী হ’লেন, ‘আমের বিন ফুহাইরা, উম্মে উবাইস, যিন্নীরাহ, নাহদিয়াহ ও তার মেয়ে এবং বনু মুআম্মাল-এর জনৈকা দাসী এবং বেলাল বিন রাবাহ।[1]


অতঃপর একে একে ইসলাম কবুল করেন আবু ওবায়দাহ ইবনুল জার্রাহ, আবু সালামাহ, আরক্বাম, ওছমান বিন মায‘ঊন ও তাঁর দুই ভাই কুদামাহ ও আব্দুল্লাহ, ওবায়দুল্লাহ বিন হারেছ, সাঈদ বিন যায়েদ ও তাঁর স্ত্রী ফাতেমা বিন খাত্ত্বাব (ওমরের বোন), খাববাব ইবনুল আরাত, ওমায়ের বিন আবু ওয়াক্কাছ, আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ, মাসঊদ বিন রাবী‘আহ আল-ক্বারী, সালীত্ব বিন আমর ও তাঁর ভাই হাতেব বিন আমর, ‘আইয়াশ বিন আবু রাবী‘আহ ও তাঁর স্ত্রী আসমা বিনতে সালামাহ, খুনাইস বিন হুযাফাহ, ‘আমের বিন রবী‘আহ, আব্দুল্লাহ বিন জাহশ, জা‘ফর বিন আবু তালিব ও তাঁর স্ত্রী আসমা বিনতে উমায়েস, নু‘আইম বিন আব্দুল্লাহ, খালেদ বিন সাঈদ ইবনুল ‘আছ ও তাঁর স্ত্রী উমাইনাহ বিনতে খালাফ, হাতেব বিন আমর, আবু হুযায়ফা বিন উৎবা, ওয়াক্বিদ বিন আব্দুল্লাহ, খালেদ বিন বুকায়ের ও তার ভাইগণ ‘আমের, ‘আক্বিল ও ইয়াস, ‘আম্মার, পিতা ইয়াসির ও মাতা সুমাইয়া, ছুহায়েব রূমী, আমর বিন আবাসাহ, মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ, ‘আফীফ বিন ক্বায়েস।


খাদীজা (রাঃ)-এর পরে রাসূল (সাঃ)-এর চাচা আববাস-এর স্ত্রী উম্মুল ফযল ও তাঁর গোলাম আবু রাফে‘ ইসলাম কবুল করেন। ইবনু ইসহাকের বর্ণনা মতে প্রথম তিন বছরে উপরোক্ত ব্যক্তিগণ ইসলাম গ্রহণের পর মক্কায় ইসলাম প্রকাশ্য হয়ে পড়ে ও তা নিয়ে লোকদের মধ্যে আলোচনা হ’তে থাকে’।[2]


উপরে যাদের নামের তালিকা দেওয়া হ’ল, তারা কুরায়েশ বংশের প্রায় সকল শাখা-প্রশাখার সাথে সরাসরি কিংবা আত্মীয়তাসূত্রে যুক্ত ছিলেন। কুরায়েশ নেতাদের কাছে এঁদের খবর পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু তারা এটাকে স্রেফ ব্যক্তিগত ধর্মাচার মনে করেছিলেন।[3] ফলে তাদের অনেকেই কুরায়েশ নেতাদের হাতে চরমভাবে নির্যাতিত হন।


[1]. হাকেম হা/৫২৪১, হাদীছ ছহীহ; ইবনু হিশাম ১/৩১৭-১৯।

[2]. ইবনু হিশাম ১/২৪৫-৬২; আল-বিদায়াহ ৩/২৪-৩২; আর-রাহীক্ব ৭৬ পৃঃ।


প্রসিদ্ধ আছে যে, আলীকে রাসূল (সাঃ) নিজে লালন-পালন করার কারণেই তিনি প্রথম ইসলাম কবুল করেন। কারণ আবু ত্বালিব ছিলেন বহু পোষ্য বিশিষ্ট একটি বড় পরিবারের অধিকারী। এটা দেখে রাসূল (সাঃ) তাঁর চাচা আববাসকে বললেন, যিনি ছিলেন বনু হাশিমের মধ্যে অধিকতর সচ্ছল ব্যক্তি। হে আববাস! আপনার ভাই আবু ত্বালিব বড় পরিবারের অধিকারী। তার উপরে কি বিপদ নাযিল হয়েছে তা তো আপনি দেখছেন। অতএব চলুন! আমরা গিয়ে তাঁর পরিবারের বোঝা কিছুটা হালকা করি। অতঃপর তারা গেলেন এবং রাসূল (সাঃ) আলীকে ও আববাস জা‘ফরকে স্ব স্ব দায়িত্বে গ্রহণ করলেন’ (ইবনু হিশাম ১/২৪৬)। ঘটনাটি বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয় (মা শা-‘আ ২১ পৃঃ)। ইবনু আববাস বলেন, খাদীজার পরে আল্লাহর উপর প্রথম ঈমান আনেন আলী’ (আল-ইস্তী‘আব, আলী বিন আবী ত্বালিব ক্রমিক ১৮৫৫; মা শা-‘আ ২২ পৃঃ)।

[3]. ইবনু হিশাম ১/২৪৭, আর-রাহীক্ব ৭৭ পৃঃ।


ছালাতের নির্দেশনা (الأمر للصلاة)

যেকোন সংস্কার আন্দোলনের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন আক্বীদার মযবুতী। আর এই মযবুতীর জন্য চাই নিয়মিত আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ। যা সর্বদা সংস্কারককে তার আদর্শমূলে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখে। সেকারণ অধ্যাত্ম সাধনার প্রাথমিক কাজ হিসাবে মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে নবুঅতের শুরু থেকেই সকাল ও সন্ধ্যায় দু’বার ছালাত আদায়ের নির্দেশনা দান করা হয়। যেমন আল্লাহ বলেন,وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ بِالْعَشِيِّ وَالْإِبْكَارِ ‘তুমি তোমার প্রভুর প্রশংসা জ্ঞাপন কর সন্ধ্যায় ও সকালে’ (মুমিন/গাফের ৪০/৫৫)।


প্রথম কুরআন নাযিলের পর জিব্রীলের মাধ্যমে তিনি ওযূ ও ছালাত শিখেন।[1] হিজরতের স্বল্পকাল পূর্বে মে‘রাজ সংঘটিত হবার আগ পর্যন্ত ফজরের দু’রাক‘আত ও আছরের দু’রাক‘আত করে ছালাত আদায়ের নিয়ম জারী থাকে। আয়েশা (রাঃ) বলেন, শুরুতে ছালাত বাড়ীতে ও সফরে ছিল দু’ দু’ রাক‘আত করে।[2] এছাড়া রাসূল (সাঃ)-এর জন্য ‘অতিরিক্ত’ (نَافِلَةً) ছিল তাহাজ্জুদের ছালাত (ইসরা/বনু ইস্রাঈল ১৭/৭৯)। সেই সাথে ছাহাবীগণও নিয়মিতভাবে রাত্রির নফল ছালাত আদায় করতেন।[3] অতঃপর মি‘রাজের রাত্রিতে নিয়মিতভাবে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয করা হয়।[4] উল্লেখ্য যে, পূর্বেকার সকল নবীর সময়ে ছালাত, ছিয়াম ও যাকাত ফরয ছিল। তবে সেসবের ধরন ও পদ্ধতি ছিল কিছুটা পৃথক।


রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও তাঁর সাথীগণ প্রথম দিকে গোপনে এই ছালাত আদায় করতেন এবং লোকদেরকে গাছ, পাথর, চন্দ্র, সূর্য ইত্যাদির উপাসনা পরিত্যাগ করে আল্লাহর ইবাদত শিক্ষা দিতেন। তিনি কখনো কখনো সাথীদের নিয়ে পাহাড়ের গুহাতে গোপনে ছালাত আদায় করতেন। একদিন আবু ত্বালিব স্বীয় পুত্র আলী ও ভাতিজা মুহাম্মাদকে এটা আদায় করতে দেখে কারণ জিজ্ঞেস করেন। সবকিছু শুনে বিষয়টির আধ্যাত্মিক গুরুত্ব উপলব্ধি করে তিনি তাদেরকে উৎসাহিত করেন।[5]


উর্দূ কবি বলেন,

ہوا كو پهرانا دشور ، موج كو الٹانا دشور

ليكن اتنا نہ جتنا، بهٹكى ہوئى قوم كو راه پر لانا دشور


‘বায়ু প্রবাহ ফিরানো কঠিন, স্রোতকে উল্টানো কঠিন’। ‘কিন্তু অত কঠিন নয়, যত না কঠিন একটা পথভ্রষ্ট জাতিকে সুপথে ফিরিয়ে আনা’।


[1]. আহমাদ হা/১৭৫১৫, দারাকুৎনী হা/৩৯৯, মিশকাত হা/৩৬৬ ‘পবিত্রতা’ অধ্যায় ৩ অনুচ্ছেদ; ছহীহাহ হা/৮৪১।

[2]. মুসলিম হা/৬৮৫; আবুদাঊদ হা/১১৯৮; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২১১।

[3]. মুযযাম্মিল ৭৩/২০; তাফসীরে কুরতুবী।

[4]. বুখারী হা/৩২০৭; মুসলিম হা/১৬২; মিশকাত হা/৫৮৬২-৬৫ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়-২৯, ‘মি‘রাজ’ অনুচ্ছেদ-৬।

[5]. ইবনু হিশাম ১/২৪৬-৪৭। তবে বর্ণনাটির সূত্র যঈফ; মাজদী ফাৎহী সাইয়িদ, তাহকীক ইবনু হিশাম (দারুছ ছাহাবা লিত তুরাছ, তান্তা, কায়রো, ১ম সংস্করণ ১৪১৬ হিঃ/১৯৯৫ খৃঃ) ক্রমিক ২৪৫।


দাওয়াতের সারবস্ত্ত (حقيقة الدعوة)

এই সময় দাওয়াতের সারবস্ত্ত ছিল পাঁচটি। (১) তাওহীদ (২) রিসালাত (৩) আখেরাত বিশ্বাস (৪) তাওয়াক্কুল তথা আল্লাহর উপরে ভরসা এবং উক্ত বিশ্বাসসমূহের আলোকে (৫) তাযকিয়াহ বা আত্মশুদ্ধি অর্জন করা।


বস্ত্ততঃ রাসূল (সাঃ)-এর সরাসরি নির্দেশনায় এই প্রশিক্ষণ পরিচালিত হ’ত। এভাবে তিনি আত্মিক শক্তিতে বলীয়ান একদল নিবেদিতপ্রাণ মানুষ গড়ে তুলতে সমর্থ হন। যাঁদের হাতেই পরবর্তীকালে ইসলামের বস্ত্তগত বিজয় সাধিত হয়।


কয়েক বছর যাবৎ সীমিতভাবে দাওয়াত দেওয়ার পর এবার আল্লাহর হুকুম হ’ল বৃহত্তর পরিসরে প্রকাশ্য দাওয়াত দেওয়ার জন্য। নাযিল হ’ল,فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ- إِنَّا كَفَيْنَاكَ الْمُسْتَهْزِئِينَ ‘অতএব তুমি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছ, তা প্রকাশ্যে ব্যক্ত কর এবং মুশরিকদের উপেক্ষা কর’। ‘বিদ্রুপকারীদের বিরুদ্ধে আমরাই তোমার জন্য যথেষ্ট’ (হিজর ১৫/৯৪-৯৫)। আরও নাযিল হ’ল, وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ‘তুমি তোমার নিকটাত্মীয়দের সতর্ক কর’ (শো‘আরা ২৬/২১৪)।


কিন্তু এতে কুরায়েশ নেতাদের প্রতিক্রিয়া যে অত্যন্ত কষ্টদায়ক হবে, সে বিষয়ে আগেভাগেই স্বীয় নবীর মন-মানসিকতাকে প্রস্ত্তত করে নেন সূরা শো‘আরা নাযিল করে। ২২৭ আয়াত বিশিষ্ট এই বিরাট সূরার শুরুতেই আল্লাহ স্বীয় নবীকে বলেন,لَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَّفْسَكَ أَلاَّ يَكُونُوا مُؤْمِنِينَ، إِنْ نَشَأْ نُنَزِّلْ عَلَيْهِم مِّنَ السَّمَاء آيَةً فَظَلَّتْ أَعْنَاقُهُمْ لَهَا خَاضِعِينَ- (الشعراء ৩-৪) ‘লোকেরা এতে বিশ্বাস স্থাপন করছে না দেখে তুমি হয়ত মর্মবেদনায় নিজেকে শেষ করে ফেলবে’। ‘আমরা চাইলে আকাশ থেকে তাদের উপরে এমন নিদর্শন (শাস্তি) নাযিল করতাম, যার সামনে তাদের গর্দান অবনত হয়ে যেত’ (শো‘আরা ২৬/৩-৪)। এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, অহংকারী সমাজনেতাদের আচরণে বেদনাহত হয়ে তাওহীদের দাওয়াত থেকে পিছিয়ে আসা যাবে না। বরং আল্লাহর উপরে ভরসা রেখে বুকে বল নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।


এরপর আল্লাহ অতীতের সাতজন শ্রেষ্ঠ নবীর দাওয়াতী জীবন ও তাদের স্ব স্ব কওমের অবাধ্যাচরণ ও তাদের মন্দ পরিণতি সংক্ষেপে আবেগময় ভাষায় বর্ণনা করেছেন। যাতে আগামীতে বৃহত্তর দাওয়াতের রূঢ় প্রতিক্রিয়া সহ্য করতে শেষনবীর কোনরূপ মনোকষ্ট না হয়। শুরুতেই হযরত মূসা (আঃ)-এর জীবনালেখ্য ১০-৬৮ আয়াত পর্যন্ত, অতঃপর ইবরাহীম (আঃ) ৬৯-১০৪, তারপর নূহ (আঃ) ১০৫-১২২, অতঃপর হূদ (আঃ)-এর কওমে ‘আদ ১২৩-১২৪, তারপর হযরত ছালেহ (আঃ)-এর কওমে ছামূদ ১৪১-১৫৯, তারপর লূত্ব (আঃ)-এর কওম ১৬০-১৭৫, অতঃপর হযরত শু‘আয়েব (আঃ)-এর কওম আছহাবুল আইকাহ ১৭৬-১৯১ পর্যন্ত তাদের স্ব স্ব কওমের উপর আসমানী গযবসমূহ নাযিল হওয়ার ঘটনাবলী বর্ণনা করার পর সবশেষে আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে উদ্দেশ্য করে বলেন,


فَلاَ تَدْعُ مَعَ اللهِ إِلَهاً آخَرَ فَتَكُوْنَ مِنَ الْمُعَذَّبِيْنَ- وَأَنذِرْ عَشِيْرَتَكَ الْأَقْرَبِيْنَ- وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ- فَإِنْ عَصَوْكَ فَقُلْ إِنِّيْ بَرِيءٌ مِّمَّا تَعْمَلُوْنَ- وَتَوَكَّلْ عَلَى الْعَزِيْزِ الرَّحِيْمِ- (الشعراء ২১৩-২১৭)-

‘অতএব তুমি আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্যকে আহবান করো না। তাতে তুমি শাস্তিপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’। ‘তুমি তোমার নিকটাত্মীয়দের সতর্ক কর’। ‘এবং তোমার অনুসারী মুমিনদের প্রতি সদয় হও’। ‘অতঃপর যদি তারা তোমার অবাধ্যতা করে, তবে বলে দাও, তোমরা যা কর, তা থেকে আমি মুক্ত’। আর তুমি ভরসা কর মহাপরাক্রমশালী দয়ালু সত্তার উপরে’ (শো‘আরা ২৬/২১৩-১৭)।


উল্লেখ্য যে, কুরআনে বর্ণিত নবীগণের উপরোক্ত ক্রমধারায় আগপিছ রয়েছে। প্রকৃত ক্রমধারা হবে প্রথমে নূহ (আঃ), অতঃপর হূদ, অতঃপর ছালেহ, অতঃপর ইবরাহীম, লূত্ব, শু‘আয়েব ও মূসা (‘আলাইহিমুস সালাম)। কুরআনের বর্ণনাভঙ্গি অনুযায়ী বিভিন্ন স্থানে এরূপ আগপিছ হয়েছে। কেননা ধারাবাহিক ইতিহাস বর্ণনা করা নয়, বরং বিষয়বস্ত্ত পেশ করাই হ’ল কুরআনের মূল উদ্দেশ্য।


 এলাহী নির্দেশের সারকথা (خلاصة الأمر الإلهى)

বর্ণিত পাঁচটি আয়াতের প্রথমটিতে (২১৩) রাসূল (সাঃ)-কে তাওহীদের উপরে দৃঢ় থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং সম্প্রদায়ের ভয়ে শিরকের সাথে আপোষ করলে এলাহী গযবের ধমকি প্রদান করা হয়েছে। দ্বিতীয় আয়াতে (২১৪) নিজ নিকটাত্মীয়দেরকে জাহান্নাম হ’তে সতর্ক করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে’। এতে অবশ্যই একদল তাঁর পক্ষে আসবে, একদল তার বিপক্ষে যাবে। এটা নিশ্চিত জেনেই বলা হয়েছে, তোমার অনুসারী মুমিনদের প্রতি তুমি সদয় হও এবং বিরোধীদের বলে দাও যে, তোমাদের কর্মের ব্যাপারে আমি দায়মুক্ত। কেননা আমার দায়িত্ব ছিল তোমাদেরকে আল্লাহর পথে ডাকা। সে দায়িত্ব আমি পালন করেছি। না মানলে তার ফল ভোগ করবে তোমরাই। শেষে বলা হয়েছে, তাদের বিরোধিতায় তুমি মোটেই ঘাবড়াবেনা। বরং সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপরে ভরসা করবে।


শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ -৪ (العبر -৪)

(১) সমাজ পরিবর্তনের মত কঠিন দায়িত্ব পালনের জন্য সবার আগে প্রয়োজন সংস্কারকদের স্ব স্ব আক্বীদা-বিশ্বাস দৃঢ় করণ। নবুঅত লাভের পরপরই ছালাত ফরযের মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ হ’তে সে ব্যবস্থাই করা হয়েছে।

(২) আল্লাহর যিকরের প্রধান অনুষ্ঠান হ’ল ছালাত। এর বাইরে বিভিন্ন বানোয়াট যিকরের অনুষ্ঠানাদি বিদ‘আতের অন্তর্ভুক্ত।

(৩) বৈরী পরিবেশে প্রথমে গোপন দাওয়াতের মাধ্যমে সমর্থক সৃষ্টি ও মানুষ তৈরীই যুক্তিযুক্ত। রাসূল (সাঃ)-এর দাওয়াতী নীতিতে সেটাই দেখা যায়।

(৪) সমাজে সর্বদা ভাল ও মন্দ দু’ধরনের লোকের অস্তিত্ব থাকে। সংস্কারকের দাওয়াতে প্রথমে ভাল লোকেরা সাড়া দেয়। যদিও তারা সংখ্যায় কম হয় এবং দুষ্টু সমাজনেতাদের চাপে সমাজে কোনঠাসা হয়ে থাকে।

(৫) কেবলমাত্র আখেরাতমুখী দাওয়াতই মানুষকে দুনিয়া ত্যাগে উদ্বুদ্ধ করে এবং সংস্কার আন্দোলনকে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়।


ছাফা পাহাড়ের দাওয়াত (الدعوة على جبل الصفا)

নিকটাত্মীয়দের প্রতি প্রকাশ্যে দাওয়াত দেওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কুরায়েশ বংশের সকল গোত্রকে একত্রিত করে তাদের সামনে দাওয়াত দেবার মনস্থ করলেন। তৎকালীন সময়ে নিয়ম ছিল যে, বিপদসূচক কোন খবর থাকলে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে চিৎকার দিয়ে আহবান করতে হ’ত। আসন্ন কোন বিপদের আশংকা করে তখন সবাই সেখানে ছুটে আসত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সেমতে একদিন ছাফা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে চিৎকার দিয়ে ডাক দিলেন,يَا صَبَاحَاه (প্রত্যুষে সবাই সমবেত হও!)। কুরায়েশ বংশের সকল গোত্রের লোক দ্রুত সেখানে জমা হয়ে গেল। অতঃপর তিনি বললেন, হে কুরায়েশগণ! আমি যদি বলি, এই পাহাড়ের অপর পার্শ্বে একদল শক্তিশালী শত্রুসৈন্য তোমাদের উপরে হামলার জন্য অপেক্ষা করছে, তাহ’লে কি তোমরা সে কথা বিশ্বাস করবে? সকলে সমস্বরে বলে উঠল, অবশ্যই করব। কেননাمَا جَرَّبْنَا عَلَيْكَ إِلاَّ صِدْقًا ‘আমরা এযাবৎ তোমার কাছ থেকে সত্য ব্যতীত কিছুই পাইনি’। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন,فَإِنِّىْ نَذِيْرٌ لَكُمْ بَيْنَ يَدَىْ عَذَابٍ شَدِيْدٍ ‘আমি ক্বিয়ামতের কঠিন আযাবের প্রাক্কালে তোমাদের নিকটে সতর্ককারী রূপে আগমন করেছি’।[1]


অতঃপর তিনি আবেগময় কণ্ঠে এক একটি গোত্রের নাম ধরে ধরে ডেকে বলতে থাকলেন,يَامَعْشَرَ قُرَيْشٍ! أَنْقِذُوْا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ ‘হে কুরায়েশগণ! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! হে বনু কা‘ব বিন লুওয়াই! হে বনু ‘আব্দে মানাফ!... হে বনু ‘আব্দে শাম্স!.. হে বনু হাশেম!... হে বনু আব্দিল মুত্ত্বালিব! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও। অতঃপর ব্যক্তির নাম ধরে ধরে বলেন, হে (চাচা) আববাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব! তুমি নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! হে (ফুফু) ছাফিইয়াহ! তুমি নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও। অবশেষেيَا فَاطِمَةَ بِنْتَ مُحَمَّدٍ! أَنْقِذِىْ نَفْسَكِ مِنَ النَّارِ، سَلِيْنِىْ مَا شِئْتِ مِنْ مَالِىْ، وَاللهِ لاَ أُغْنِيْ عَنْكِ مِنَ اللهِ شَيْئًا ‘হে মুহাম্মাদের কন্যা ফাতেমা! তুমি নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! তুমি আমার মাল-সম্পদ থেকে যা খুশী নাও! কিন্তু আল্লাহর কসম! আমি তোমাকে আল্লাহর পাকড়াও হ’তে রক্ষা করতে পারব না’।


এই মর্মস্পর্শী আবেদন গর্বোদ্ধত চাচা আবু লাহাবের অন্তরে দাগ কাটেনি। তিনি মুখের উপর বলে দিলেন-تَبًّا لَكَ سَائِرَ الْيَوْمِ، أَلِهَذَا جَمَعْتَنَا؟ ‘সকল দিনে তোমার উপরে ধ্বংস আপতিত হৌক! এজন্য তুমি আমাদের জমা করেছ?’ অতঃপর সূরা লাহাব নাযিল হয়تَبَّتْ يَدَا أَبِي لَهَبٍ وَتَبَّ ‘ধ্বংস হৌক আবু লাহাবের দু’হাত এবং ধ্বংস হৌক সে নিজে’।[2]


এভাবে নিজ সম্প্রদায়কে এবং বাজারে-ঘাটে সর্বত্র বিশেষ করে হজ্জের মৌসুমে সকলকে উদ্দেশ্য করে তিনি প্রকাশ্যে দাওয়াত দিতে থাকেন এই মর্মে যে,قُوْلُوْا لآ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ تُفْلِحُوْا ‘তোমরা বল আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই, তাহ’লে তোমরা সফলকাম হবে’।[3]


[1]. বুখারী হা/৪৭৭০; মুসলিম হা/২০৮; মিশকাত হা/৫৩৭২, ৫৮৪৬।

[2]. বুখারী হা/২৭৫৩, মুসলিম হা/২০৮; মিশকাত হা/৫৩৭২-৭৩।

[3]. আহমাদ হা/১৬০৬৬, সনদ হাসান; হাকেম হা/৩৯, ৪২১৯ সনদ ছহীহ।


উল্লেখ্য যে, নিকটাত্মীয়দের দাওয়াত দেওয়ার আদেশ পালন করতে গিয়ে রাসূল (সাঃ) প্রথমে বনু হাশেম ও বনু আব্দুল মুত্ত্বালিবের ৪৫জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে বাড়িতে দাওয়াত দেন। কিন্তু আবু লাহাবের বিরোধিতার কারণে উক্ত দাওয়াত ব্যর্থ হ’লে পুনরায় দ্বিতীয়বার তাদেরকে দাওয়াত দেন। তখন আবু লাহাব প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেন এবং আবু ত্বালেব তাঁকে আমৃত্যু সাহায্য করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন (আর-রাহীক্ব ৭৮-৭৯ পৃঃ) মর্মে বক্তব্যগুলির কোন বিশুদ্ধ ভিত্তি নেই (সীরাহ ছহীহাহ ১/১৪২-৪৩)।


আবু লাহাবের পরিচয় (تعارف أبى لهب)

(১) আবু লাহাব ছিলেন আব্দুল মুত্ত্বালিবের অন্যতম পুত্র। তার নাম ছিল আব্দুল ‘উযযা। গৌর-লাল বর্ণ ও সুন্দর চেহারার অধিকারী হওয়ার কারণে তাকে ‘আবু লাহাব’ অর্থাৎ ‘অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ওয়ালা’ বলা হ’ত। আল্লাহ তার জন্য এই নামই পসন্দ করেছেন। কেননা এর মধ্যে তার জাহান্নামী হওয়ার দুঃসংবাদটিও লুকিয়ে ছিল। তাছাড়া আব্দুল ‘উযযা নাম কুরআনে থাকাটা তাওহীদের সাথে সাংঘর্ষিক। আবু লাহাব ছিলেন রাসূল (সাঃ)-এর আপন চাচা এবং নিকটতম প্রতিবেশী। (২) তার দুই ছেলে উৎবা ও উতাইবার সাথে নবুঅত-পূর্বকালে রাসূল (সাঃ)-এর দুই মেয়ে রুক্বাইয়া ও উম্মে কুলছূমের বিবাহ হয়। কিন্তু নবী হওয়ার পরে তিনি তার ছেলেদেরকে তাদের স্ত্রীদের তালাক দিতে বাধ্য করেন। এই দুই মেয়েই পরবর্তীতে একের পর এক হযরত ওছমান (রাঃ)-এর সাথে বিবাহিতা হন। (৩) নবুঅত লাভের পর দ্বিতীয় পুত্র আব্দুল্লাহ (যার লকব ছিল ত্বাইয়েব ও ত্বাহের) মারা গেলে তিনি খুশীতে বাগবাগ হয়ে সবার কাছে গিয়ে বলেন, মুহাম্মাদ এখন লেজকাটা নির্বংশ (الْأَبْتَرُ) হয়ে গেল। যার প্রেক্ষিতে সূরা কাওছার নাযিল হয়। কেননা সেযুগে কারু ছেলে সন্তান না থাকলে তাকে উক্ত নামে অভিহিত করা হ’ত।[1] (৪) হজ্জের মৌসুমে তিনি রাসূল (সাঃ)-এর পিছে লেগে থাকতেন। যেখানেই রাসূল (সাঃ) দাওয়াত দিতেন, সেখানেই তিনি তাঁকে গালি দিয়ে লোকদের ভাগিয়ে দিতেন।[2]


[1]. কুরতুবী, তাফসীর সূরা কাওছার ৩ আয়াত।

[2]. আহমাদ হা/১৬০৬৬; ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/১৫৯, হাকেম হা/৪২১৯, ২/৬১১।


 আবু লাহাবের স্ত্রী (امرأة أبى لهب)

তার স্ত্রী ছিলেন আবু সুফিয়ানের বোন আরওয়া (أروى) অথবা ‘আওরা’ (العوراء) ওরফে উম্মে জামীল বা ‘সুন্দরের উৎস’। তবে একচক্ষু দৃষ্টিহীন হওয়ায় ইবনুল ‘আরাবী উক্ত মহিলাকে ‘আওরা উম্মে ক্বাবীহ’(عوراء ام قبيح) ‘এক চক্ষু সকল নষ্টের মূল’ বলেন’ (কুরতুবী)। তিনিও স্বামীর অকপট সহযোগী ছিলেন এবং সর্বদা রাসূল (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে গীবত-তোহমত ও নিন্দাবাদে মুখর থাকতেন। চোগলখুরী ও মিথ্যাচারের মাধ্যমে সংসারে বা সমাজে অশান্তির আগুন ধরিয়ে দেওয়া ব্যক্তিকে আরবদের পরিভাষায়حَمَّالَةُ الْحَطَبِ ইন্ধন বহনকারী বা ‘খড়িবাহক’ বলা হ’ত। অর্থাৎ ঐ শুষ্ককাঠ যাতে আগুন লাগালে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আবু লাহাবের স্ত্রী একাজটিই করতেন পিছনে থেকে। সেকারণ আল্লাহ তাকেও স্বামীর সাথে জাহান্নামে প্রেরণ করবেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে হেন অপপ্রচার নেই, যা আবু লাহাব ও তার স্ত্রী করতেন না।


তার স্ত্রী উম্মে জামীল রাসূল (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে নানাবিধ দুষ্কর্মে পটু ছিলেন। তিনি রাসূল (সাঃ)-এর যাতায়াতের পথে বা তাঁর বাড়ীর দরজার মুখে কাঁটা বিছিয়ে বা পুঁতে রাখতেন। যাতে রাসূল (সাঃ) কষ্ট পান। তিনি ছিলেন কবি। ফলে নানা ব্যঙ্গ কবিতা পাঠ করে তিনি লোকদের ক্ষেপিয়ে তুলতেন। সূরা লাহাব নাযিল হ’লে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উক্ত মহিলা হাতে প্রস্তরখন্ড নিয়ে রাসূল (সাঃ)-কে মারার উদ্দেশ্যে কা‘বা চত্বরে গমন করেন। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় রাসূল (সাঃ) সামনে থাকা সত্ত্বেও তিনি তাঁকে দেখতে পাননি’।[1] তাই পাশে দাঁড়ানো আবুবকরের কাছে তার মনের ঝাল মিটিয়ে কুৎসাপূর্ণ কবিতা বলে ফিরে আসেন। উক্ত কবিতায় তিনি ‘মুহাম্মাদ’ (প্রশংসিত) নামকে বিকৃত করে ‘মুযাম্মাম’ (নিন্দিত) বলেন। যেমন-مُذَمَّمًا عَصَيْنَا + وَأَمْرَهُ أَبَيْنَا + وَدِيْنَهُ قَلَيْنَا ‘নিন্দিতের আমরা অবাধ্যতা করি’। ‘তার নির্দেশ আমরা অমান্য করি’। ‘তার দ্বীনকে আমরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি’।[2]


[1]. মুসনাদে বাযযার হা/১৫; বাযযার বলেন, এর চাইতে উত্তম সনদে বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে বলে আমরা জানতে পারিনি; মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১১৫২৯।

[2]. ইবনু হিশাম ১/৩৫৬; হাকেম হা/৩৩৭৬, ২/৩৬১ সনদ ছহীহ; আলবানী, ছহীহ সীরাহ নববিইয়াহ ১৩৭ পৃঃ; তাফসীর কুরতুবী, ইবনু কাছীর; সীরাহ ছহীহাহ ১/১৪৭।


আবু লাহাবের পরিণতি (عاقبة أبى لهب)

বদর যুদ্ধের এক সপ্তাহ পরে আবু লাহাবের গলায় প্লেগ মহামারীর ফোঁড়া দেখা দেয়। আজকের ভাষায় যাকে ‘গুটি বসন্ত’ (Small Pox) বলা যায়। যার প্রভাবে তার সারা দেহে পচন ধরে ও তাতেই তিনি মারা যান। সংক্রামক ব্যাধি হওয়ার কারণে তার পরিবারের লোকেরা তাকে ছেড়ে চলে যায়। তিনদিন সেখানে লাশ পড়ে থাকার পর দুর্গন্ধের হাত থেকে বাঁচার জন্য কুরায়েশ-এর এক ব্যক্তির সহায়তায় আবু লাহাবের দুই ছেলে লাশটি মক্কার উচ্চ ভূমিতে নিয়ে যায় এবং সেখানেই একটি গর্তে লাঠি দিয়ে ঠেলে ফেলে দেয়। অতঃপর দূর থেকে পাথর ছুঁড়ে গর্ত বন্ধ করে দেয়।[1] যিনি একদিন রাসূল (সাঃ)-কে পাথর ছুঁড়ে মারতে উদ্যত হয়েছিলেন, তাকেই আজ মরণের পর তার ছেলেরাই পাথর ছুঁড়ে মেরে অনাদরে পুঁতে দিল। তার বিপুল ধন-সম্পদ ও সন্তান- সন্ততি তার কোনই কাজে আসল না। অহংকারের পরিণাম চিরদিন এরূপই হয়ে থাকে।


[1]. ইবনু হিশাম ১/৬৪৬; বায়হাক্বী দালায়েলুন নবুঅত ৩/১৪৫-১৪৬; আল-বিদায়াহ ৩/৩০৯; আর-রাহীক্ব পৃঃ ২২৫-২৬; কুরতুবী, তাফসীর সূরা লাহাব।


 স্ত্রীর পরিণতি (عاقبة امرأة أبى لهب)

মুররাহ আল-হামদানী বলেন, আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল প্রতিদিন কাঁটাযুক্ত ঝোপের বোঝা এনে মুসলমানদের চলার পথে ছড়িয়ে দিতেন। ইবনু যায়েদ ও যাহহাক বলেন, তিনি রাতের বেলায় একাজ করতেন। একদিন তিনি গলায় বোঝা বহন করে আনতে অপারগ হয়ে একটা পাথরের উপরে বসে পড়েন। তখন ফেরেশতা এসে তাকে পিছন থেকে টেনে ধরে হালাক করে দেয়’ (কুরতুবী, তাফসীর সূরা লাহাব)।


তার সন্তানাদি (أولاد أبى لهب)

আবু লাহাবের উৎবা, উতাইবা ও মু‘আত্তাব নামে তিন পুত্র এবং দুর্রাহ, খালেদা ও ইযযাহ নামে তিন কন্যা ছিল। তন্মধ্যে উৎবা ও উতাইবা রাসূল (সাঃ) দুই কন্যা রুক্বাইয়া ও উম্মে কুলছূমের স্বামী ছিল। সূরা লাহাব নাযিলের পর আবু লাহাবের নির্দেশে ছেলেরা তাদের স্ত্রীদের তালাক দেয়। পরবর্তীতে তাঁরা ওছমান (রাঃ)-এর সাথে পরপর বিবাহিতা হন। উম্মে কুলছূমের স্বামী উতাইবা রাসূল (সাঃ)-এর বদদো‘আ প্রাপ্ত হয়ে আবু লাহাবের জীবদ্দশায় কুফরী হালতে বাঘের হামলায় নিহত হয়। বাকী দু’জন পুত্র ও তিন কন্যা মক্কা বিজয়ের পর মুসলমান হন। পুত্রদ্বয় হোনায়েন ও ত্বায়েফ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। হোনায়েন যুদ্ধে সংকটকালে তারা রাসূল (সাঃ)-এর নিরাপত্তায় দৃঢ় ছিলেন। মু‘আত্তাব এই যুদ্ধে একটি চোখ হারান। মক্কা বিজয়ের পরে অন্যেরা মদীনায় হিজরত করলেও তারা দু’ভাই আমৃত্যু মক্কায় অবস্থান করেন।[1]


[1]. ইবনু সা‘দ, ত্বাবাক্বাতুল কুবরা ক্রমিক ৩৫৫, ৩৫৬ (৪/৪৪-৪৫ পৃঃ), ৪০৯৯-৪১০০ (৮/২৯-৩১ পৃঃ), ৪১২১-২৩ (৮/৪০ পৃঃ), হাকেম হা/৩৯৮৪; মুহিববুদ্দীন ত্বাবারী (মৃ. ৬৯৪ হি.), যাখায়েরুল ‘উক্ববা (কায়রো : ১৩৫৬ হি.) ২৪৯ পৃঃ।


সর্বস্তরের লোকদের নিকট দাওয়াত (الدعوة إلى العوام)

ছাফা পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে কুরায়েশদের নিকটে দাওয়াত পৌঁছানোর পর রাসূল (সাঃ) এবার সর্বস্তরের মানুষের নিকটে দাওয়াত পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।


উল্লেখ্য যে, ঐ সময় মক্কায় বিদ্রূপকারীদের নেতা ছিল পাঁচ জন: বনু সাহম গোত্রের ‘আছ বিন ওয়ায়েল, বনু আসাদ গোত্রের আসওয়াদ বিন মুত্ত্বালিব, বনু যোহরা গোত্রের আসওয়াদ বিন ‘আব্দে ইয়াগূছ, বনু মাখযূম গোত্রের অলীদ বিন মুগীরাহ এবং বনু খুযা‘আহ গোত্রের হারিছ বিন তুলাত্বিলা। এই পাঁচ জনই আল্লাহর হুকুমে একই সময়ে মৃত্যুবরণ করে। এভাবেই আল্লাহর ওয়াদা সত্যে পরিণত হয় (ইবনু হিশাম ১/৪০৯-১০)। কেননা আল্লাহ আগেই স্বীয় নবীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন,إِنَّا كَفَيْنَاكَ الْمُسْتَهْزِئِينَ ‘তোমাকে বিদ্রুপকারীদের জন্য আমরাই যথেষ্ট’ (হিজর ১৫/৯৫)।


রাসূল (সাঃ) মক্কার হাটে-মাঠে-ঘাটে, বাজারে ও বস্তিতে সর্বত্র দাওয়াত ছড়িয়ে দিতে থাকলেন। তিনি ও তাঁর সাথীরা নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। এ সময় তাঁরা মূর্তিপূজার অসারতা, শিরকী আক্বীদার অনিষ্টকারিতা এবং তাওহীদের উপকারিতা বুঝাতে থাকেন। সাথে সাথে মানুষকে আখেরাতে জবাবদিহিতার বিষয়ে সজাগ করতে থাকেন।


স্মর্তব্য যে, মাক্কী জীবনে যে ৮৬টি সূরা নাযিল হয়েছে, তার প্রায় সবই ছিল আখেরাত ভিত্তিক। এর মাধ্যমে দুনিয়াপূজারী ভোগবাদী মানুষকে আখেরাতমুখী করার চেষ্টা করা হয়েছে। আর এটাই হ’ল যুগে যুগে ইসলামী সমাজ গঠনের প্রধান মাধ্যম। সেই সাথে আরবদের পারস্পরিক গোত্রীয় হিংসা, দলাদলি ও হানাহানির অবসানকল্পে এবং দাস-মনিব ও সাদা-কালোর উঁচু-নীচু ভেদাভেদ চূর্ণ করার লক্ষ্যে তিনি এক আল্লাহর দাসত্বের অধীনে সকল মানুষের সমানাধিকার ঘোষণা করেন।


শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ -৫ (العبر -৫)


(১) নিকটাত্মীয়গণ হ’ল মানুষের প্রধান আশ্রয়স্থল। যেকোন সংস্কার আন্দোলনে তাই তাদের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা সর্বাগ্রে প্রয়োজন হয়। সেজন্যেই রাসূল (সাঃ)-কে প্রথমে তাদের প্রতি দাওয়াত দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়।

(২) নিজেদের ছেলে হিসাবে নিকটাত্মীয়গণ সাধারণভাবে সংস্কারকের প্রতি অনীহা প্রদর্শন করে থাকে। যা অনেক সময় দারুণ মনোকষ্ট এমনকি দৈহিক কষ্টের কারণ হয়ে দেখা দেয়। সে অবস্থায় যাতে রাসূল (সাঃ) ভেঙ্গে না পড়েন, সেজন্য আগেভাগে বিগত যুগের সাত জন নবীর কষ্ট ভোগের কাহিনী শুনানো হয় সূরা শো‘আরা নাযিল করার মাধ্যমে। এতে বুঝা যায় যে, সংস্কারককে গভীর ধৈর্যশীল হ’তে হয়।

(৩) প্রকাশ্য দাওয়াতের ফলে নিকটাত্মীয়গণের সকলে না এলেও তাদের মধ্যে কেউ ঘোর সমর্থক হবেন, আবার কেউ ঘোর বিরোধী হবেন, এটাই স্বাভাবিক। আবু ত্বালিব ও আবু লাহাব দুই ভাইয়ের দ্বিমুখী অবস্থান তার বাস্তব প্রমাণ বহন করে।


দু’টি দাওয়াত দু’টি আনুগত্যের প্রতি (الدعوتان إلى الطاعتين)

মুহাম্মাদ (সাঃ) ও তাঁর চাচা কুরায়েশ নেতা আবু লাহাবের দু’টি দাওয়াত ছিল দু’টি আনুগত্যের প্রতি ও দু’টি সার্বভৌমত্বের প্রতি দাওয়াত। দু’টি ছিল সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী দাওয়াত। একটিতে ছিল আল্লাহর সার্বভেŠমত্বের অধীনে সকল মানুষের অধিকার সমান। অন্যটিতে ছিল মানুষের সার্বভৌমত্বের অধীনে মানুষ মানুষের গোলাম। নিম্নের হাদীছ দু’টি তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ।-


عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ الْمُنْكَدِرِ أَنَّهُ سَمِعَ رَبِيعَةَ بْنَ عِبَادٍ الدُّؤَلِيَّ يَقُولُ: رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِمِنًى فِي مَنَازِلِهِمْ قَبْلَ أَنْ يُهَاجِرَ إِلَى الْمَدِينَةِ يَقُولُ: يَا أَيُّهَا النَّاسُ، إِنَّ اللهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تَعْبُدُوهُ وَلاَ تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا. قَالَ: وَوَرَاءَهُ رَجُلٌ يَقُولُ: يَا أَيُّهَا النَّاسُ، إِنَّ هَذَا يَأْمُرُكُمْ أَنْ تَتْرُكُوا دَيْنَ آبَائِكُمْ، فَسَأَلْتُ مَنْ هَذَا الرَّجُلُ؟ قِيلَ: أَبُو لَهَبٍ-


وفى رواية عنه قَالَ: رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الْجَاهِلِيَّةِ بِسُوقِ ذِي الْمَجَازِ وَهُوَ يَقُولُ: يَا أَيُّهَا النَّاسُ، قُولُوا لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ تُفْلِحُوا قَالَ: يُرَدِّدُهَا مِرَارًا وَالنَّاسُ مُجْتَمِعُونَ عَلَيْهِ يَتَّبِعُونَهُ، وَإِذَا وَرَاءَهُ رَجُلٌ أَحْوَلُ ذُو غَدِيرَتَيْنِ وَضِيءُ الْوَجْهِ يَقُولُ: إِنَّهُ صَابِئٌ كَاذِبٌ، فَسَأَلْتُ: مَنْ هَذَا؟ فَقَالُوا: عَمُّهُ أَبُو لَهَبٍ-


‘মু‏হাম্মাদ ইবনুল মুনকাদির বলেন, তিনি রাবী‘আহ বিন এবাদ আদ-দুআলী-কে বলতে শুনেছেন তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে মদীনায় হিজরতের পূর্বে মিনাতে লোকদের তাঁবু সমূহে গিয়ে বলতে শুনেছি, হে লোকসকল! আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাঁর ইবাদত কর এবং তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না’। রাবী বলেন, এ সময় তাঁর পিছনে আর একজন ব্যক্তিকে বলতে শুনলাম, হে লোকসকল! নিশ্চয় এই ব্যক্তি তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যাতে তোমরা তোমাদের বাপ-দাদার ধর্ম পরিত্যাগ কর’। রাবী বলেন, আমি লোকদের জিজ্ঞেস করলাম এ ব্যক্তিটি কে? তারা বলল, আবু লাহাব’ (হাকেম হা/৩৮, হাদীছ ছহীহ)।


একই রাবী কর্তৃক অন্য বর্ণনায় এসেছে, জাহেলী যুগে আমি রাসূল (সাঃ)-কে যুল-মাজায বাজারে লোকদের উদ্দেশ্যে বার বার বলতে শুনেছি, قُولُوا لآ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ تُفْلِحُوا ‘তোমরা বল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তাহ’লে তোমরা সফলকাম হবে’। তাঁর পিছে পিছে আর একজন চোখ ট্যারা, দুই ঝুটি চুল ওয়ালা উজ্জ্বল গৌর বর্ণের ব্যক্তি বলছেন,إِنَّهُ صَابِئٌ كَاذِبٌ ‘লোকটি ধর্মত্যাগী ও মিথ্যাবাদী’। আমি লোকদের জিজ্ঞেস করলাম, এই ব্যক্তিটি কে? লোকেরা বলল, উনার চাচা আবু লাহাব’।[1]


ত্বারেক আল-মাহারেবী বলেন, আমি জাহেলী যুগে যুল-মাজায বাজারে লাল জুববা পরিহিত অবস্থায় রাসূল (সাঃ)-কে দাওয়াত দিতে শুনেছি যে,يَا أَيُّهَا النَّاسُ، قُولُوا: لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ تُفْلِحُوا ‘হে জনগণ! তোমরা বল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তাহ’লে তোমরা সফলকাম হবে’। তাঁর পিছে পিছে একজন লোককে তাঁর পায়ে পাথর ছুঁড়ে মারতে দেখলাম। যা তাঁর দুই গোঁড়ালী ও গোঁড়ালীর উপরাংশ রক্তাক্ত করে দিচ্ছে। আর সে বলছে,يَا أَيُّهَا النَّاسُ لَا تُطِيعُوهُ فَإِنَّهُ كَذَّابٌ ‘হে জনগণ! তোমরা এর আনুগত্য করো না। কারণ সে মহা মিথ্যাবাদী’ (ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/১৫৯)।[2]


ভাতিজা ও চাচার দ্বিমুখী দাওয়াত, দ্বিমুখী সার্বভৌমত্বের ও দ্বিমুখী আনুগত্যের প্রতি দাওয়াত। যা সদা সাংঘর্ষিক। ক্বিয়ামত পর্যন্ত সত্য ও মিথ্যার এই দ্বন্দ্ব চলবে। জান্নাত পিয়াসী মানুষ সর্বদা সত্যের উপাসী হবে ও পরকালে জান্নাত লাভে ধন্য হবে। আর প্রকৃত প্রস্তাবে তারাই হ’ল ইহকালে ও পরকালে সফলকাম।


বর্তমান যুগে মুসলমানদের মধ্যে কুরায়েশদের ন্যায় তাওহীদের দাবী আছে। কিন্তু বাস্তবে নেই। যাকে ‘তাওহীদে রুবূবিয়াত’ বলা হয়। অর্থাৎ রব হিসাবে আল্লাহকে স্বীকার করা। পক্ষান্তরে রাসূল (সাঃ)-এর দাওয়াত ছিল জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর আনুগত্য করা। যাকে ‘তাওহীদে ইবাদাত’ বা ‘উলূহিয়াত’ বলা হয়। আল্লাহ বলেন, ‘আমি জিন ও ইনসানকে সৃষ্টি করেছি কেবলমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য’ (যারিয়াত ৫১/৫৬)। কুরায়েশদের মধ্যে আল্লাহর স্বীকৃতি ছিল। কিন্তু আল্লাহর ইবাদত ছিল না এবং তাদের সার্বিক জীবনে আল্লাহর আনুগত্য ছিল না। এ যুগের মুসলমানদের মধ্যেও একই অবস্থা কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। অতএব জান্নাত পিয়াসী মুমিনগণ সাবধান!


[1]. হাকেম হা/৩৯, ১/১৫ পৃঃ, হাদীছ ছহীহ, আহমাদ হা/১৬০৬৬।

[2]. হাকেম হা/৪২১৯, ২/৬১১; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৬৫৬২; ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/১৫৯,; দারাকুৎনী হা/২৯৫৭, সনদ ছহীহ।


জনগণের প্রতিক্রিয়া(التأثير فى العوام)

প্রথমে ছাফা পর্বতচূড়ার আহবান মক্কা নগরী ও তার আশপাশ এলাকার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার মধ্যে এক নতুনের শিহরণ জাগিয়ে তুলেছিল। অতঃপর সর্বত্র প্রকাশ্য দাওয়াতের প্রতিক্রিয়ায় সকলের মুখে মুখে একই কথার অনুবৃত্তি হ’তে থাকে, কি শুনছি আজ আব্দুল্লাহ্র পুত্রের মুখে। এ যে নির্যাতিত মানবতার প্রাণের কথা। এ যে মযলূমের হৃদয়ের ভাষা। যে ক্রীতদাস ভাবত এটাই তার নিয়তি, সে এখন নিজেকে স্বাধীন মানুষ ভাবতে লাগল। যে নারী ভাবত, সবলের শয্যাসঙ্গিনী হওয়াই তার নিয়তি, সে এখন নিজেকে অধিকার সচেতন সাহসী নারী হিসাবে ভাবতে লাগল। যে গরীব ভাবত সূদখোর মহাজনের করাল গ্রাস হ’তে মুক্তির কোন পথ নেই, সে এখন মুক্তির দিশা পেল। সর্বত্র একটা জাগরণের ঢেউ। একটা নতুনের শিহরণ। এ যেন নিদ্রাভঙ্গের পূর্বে জাগৃতির অনুরণন।


সমাজনেতাদের প্রতিক্রিয়া (رد عمل من القادة المجتمع)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আহবানের সত্যতা ও যথার্থতার বিষয়ে সমাজনেতাদের মধ্যে কোনরূপ দ্বিমত ছিল না। কিন্তু ধুরন্ধর নেতারা তাওহীদের এ অমর আহবানের মধ্যে তাদের দুনিয়াবী স্বার্থের নিশ্চিত অপমৃত্যু দেখতে পেয়েছিল। এক আল্লাহকে মেনে নিলে শিরক বিলুপ্ত হবে। দেব-দেবীর পূজা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে সারা আরবের উপর তাদের ধর্মীয় নেতৃত্ব ও পৌরহিত্যের মর্যাদা শেষ হয়ে যাবে। এছাড়া লোকেরা যে পূজার অর্ঘ্য সেখানে নিবেদন করে, তা ভোগ করা থেকে তারা বঞ্চিত হবে। আল্লাহর বিধানকে মানতে গেলে তাদের মনগড়া সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিধানসমূহ বাতিল হয়ে যাবে। ঘরে বসে দাদন ব্যবসার মাধ্যমে চক্রবৃদ্ধি হারে সূদ নিয়ে তারা যেভাবে জোঁকের মত গরীবের রক্ত শোষণ করছিল, তা বন্ধ হয়ে যাবে। যে নারীকে তারা কেবল ভোগের সামগ্রী হিসাবে মনে করে, তাকে পূর্ণ সম্মানে অধিষ্ঠিত করতে হবে। এমনকি তাকে নিজ কষ্টার্জিত সম্পত্তির উত্তরাধিকার দিতে হবে। কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের ‘ভাই’ হিসাবে সমান ভাবতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা যুগ যুগ ধরে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্ব তারা দিয়ে আসছিল, তা নিমেষে হারিয়ে যাবে এবং মুহাম্মাদকে নবী মেনে নিলে কেবল তারই আনুগত্য করতে হবে। অতএব মুহাম্মাদ দিন-রাত কা‘বাগৃহে বসে ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত থাকুক, আমরাও তার সাথী হ’তে রাযী আছি। কিন্তু তাওহীদের সাম্য ও মৈত্রীর আহবান আমরা কোনমতেই মানতে রাযী নই। এইভাবে প্রধানতঃ সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের বিপরীত ধারণা করেই তারা রাসূল (সাঃ)-এর বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত নেয়। আল্লাহ বলেন,قَدْ نَعْلَمُ إِنَّهُ لَيَحْزُنُكَ الَّذِي يَقُولُوْنَ فَإِنَّهُمْ لاَ يُكَذِّبُونَكَ وَلَكِنَّ الظَّالِمِيْنَ بِآيَاتِ اللهِ يَجْحَدُوْنَ ‘তারা যেসব কথা বলে তা যে তোমাকে খুবই কষ্ট দেয়, তা আমরা জানি। তবে ওরা তোমাকে মিথ্যাবাদী বলে না। বরং যালেমরা আল্লাহর আয়াত সমূহকে অস্বীকার করে’ (আন‘আম ৬/৩৩)। যুগে যুগে সকল নবী-রাসূল ও তাঁদের সনিষ্ঠ অনুসারীদের একই অবস্থার সম্মুখীন হ’তে হয়েছে এবং হবে।


সম্প্রদায়ের নেতাদের মন্দ প্রতিক্রিয়ার অন্যতম কারণ ছিল গোত্রীয় হিংসা এবং ভালোর প্রতি হিংসা। যেমন অন্যতম নেতা আখনাস বিন শারীক্ব-এর প্রশ্নের উত্তরে আবু জাহ্ল বলেছিলেন,تَنَازَعْنَا نَحْنُ وَبَنُو عَبْدِ مَنَافٍ الشَّرَفَ... قَالُوا: مِنَّا نَبِيٌّ يَأْتِيهِ الْوَحْيُ مِنَ السَّمَاءِ، فَمَتَى نُدْرِكُ مِثْلَ هَذِهِ؟ وَاللهِ لاَ نُؤْمِنُ بِهِ أَبَدًا وَلاَ نُصَدِّقُهُ ‘বনু ‘আব্দে মানাফের সাথে আমাদের বংশ মর্যাদাগত ঝগড়া আছে’।... তারা বলবে, আমাদের বংশে একজন নবী আছেন, যার নিকটে আসমান থেকে ‘অহি’ আসে। আমরা কিভাবে ঐ মর্যাদায় পৌঁছব? অতএব আল্লাহর কসম! আমরা কখনোই তার উপর ঈমান আনব না বা তাকে সত্য বলে বিশ্বাস করব না’।[1]


উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ছিলেন ‘আব্দে মানাফের পুত্র হাশেম-এর বংশধর। পক্ষান্তরে আবু জাহল ছিলেন বনু মাখযূম গোত্রের। বনু হাশেম গোত্রে নবীর আবির্ভাব হওয়ায় বনু মাখযূম গোত্র তাদের প্রতি হিংসা পরায়ণ ছিল। যদিও সকলে ছিলেন কুরায়েশ বংশীয়।


উর্দূ কবি হালী এই সময়কার অবস্থা বর্ণনা করেন নিম্নোক্ত ভাষায়-

وه بجلى كا كڑكا تها يا صوت ہادى + عرب كى زمين جس نے سارى ہلا دى

نئى اك لگن دل ميں سب كے لگا دى + اك آواز ميں سوتى بستى جگا دى

پڑا ہر طرف غل يہ پيغام حق سے + كہ گوبخ اوٹھے دشت وجبل نام حق سے

(১) এটি বজ্রের ধবনি ছিল, না পথ প্রদর্শকের কণ্ঠ ছিল, আরবের সমগ্র যমীন যা কাঁপিয়ে দিল। (২) নতুন এক বন্ধন সকলের অন্তরে লাগিয়ে দিল, এক আওয়াযেই ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে দিল। (৩) সত্যের এ আহবানে সর্বত্র হৈ চৈ পড়ে গেল, সত্যের নামে ময়দান ও পাহাড় সর্বত্র গুঞ্জরিত হ’ল’ (মুসাদ্দাসে হালী -উর্দূ ষষ্ঠপদী, ১৪ পৃঃ)।


[1]. ইবনু হিশাম ১/৩১৫-১৬; সনদ মুনক্বাতি‘ বা যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৩০৪)। বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত ২/২০৬; আল-বিদায়াহ ৩/৬৪।


বিরোধিতার কৌশল সমূহ (المكائد فى)

কুরায়েশ নেতারা মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে ঠেকানোর জন্য বিভিন্ন পথ-পন্থা উদ্ভাবন করলেন। যেমন-


(১) প্রথম পন্থা হিসাবে তারা বেছে নিলেন মুহাম্মাদের আশ্রয়দাতা আবু ত্বালেবকে দলে টানা। সেমতে নেতৃবৃন্দ সেখানে গেলেন এবং তাঁর নিকটে বাপ-দাদার ধর্মের দোহাই দিয়ে ও সামাজিক ঐক্যের কথা বলে মুহাম্মাদকে বিরত রাখার দাবী জানালেন। আবু ত্বালিব স্থিরভাবে তাদের সব কথা শুনলেন। অতঃপর ধীরকণ্ঠে নরম ভাষায় তাদেরকে বুঝিয়ে বিদায় করলেন।


(২) হজ্জের সময় দাওয়াতে বাধা দেওয়া। হারামের এ মাসে কোন ঝগড়া-ফাসাদ নেই। অতএব এই সুযোগে মুহাম্মাদ বহিরাগতদের নিকটে তার দ্বীনের দাওয়াত পেশ করবেন এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, এমন একটা অপবাদ মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে তৈরী করতে হবে এবং তা সকলের মধ্যে রটিয়ে দিতে হবে, যাতে কোন লোক তার কথায় কর্ণপাত না করে। অলীদ বিন মুগীরাহ্র গৃহে বৈঠক বসল। এক একজন এক এক প্রস্তাব পেশ করল। কেউ বলল, তাকে ‘গণৎকার’ (كَاهِنٌ) বলা হউক। কেউ বলল, ‘পাগল’ (مَجْنُوْنٌ) বলা হউক। কেউ বলল, ‘কবি’ (شَاعِرٌ) বলা হউক। সব শুনে অলীদ বললেন, আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদ-এর কথাবার্তা বড়ই সুন্দর ও মিষ্ট-মধুর। তার কাছে কিছুক্ষণ বসলেই লোকেদের নিকট তোমাদের দেওয়া ঐসব অপবাদ মিথ্যা প্রতিপন্ন হবে। তারা বলল, তাহ’লে আপনিই বলুন, কী বলা যায়। অলীদ অনেকক্ষণ ভেবে-চিন্তে বললেন, তার সম্পর্কে যদি কিছু বলতেই হয়, তবে বেশীর বেশী তাকে ‘জাদুকর’ (سَاحِرٌ) বলা যায়। কেননা তার কথা যেই-ই মন দিয়ে শোনে তার মধ্যে জাদুর মত আছর করে (মুদ্দাছছির ৭৪/২৪) এবং লোকেরা তার দলে ভিড়ে যায়। ফলে আমাদের পিতা-পুত্রের মধ্যে, ভাই-ভাইয়ের মধ্যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে, আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে এমনকি গোত্রে-গোত্রে বিভক্তি সৃষ্টি হয়ে গেছে। আর এসবই হচ্ছে তার কথার জাদুকরী প্রভাবে। অতএব তাকে ‘জাদুকর’ বলাই যুক্তিযুক্ত। অতঃপর সবাই একমত হয়ে আসন্ন হজ্জের মৌসুমে শতমুখে তাঁকে ‘জাদুকর’ বলে প্রচার করার সিদ্ধান্ত নিয়ে বৈঠক ভঙ্গ করল। অতঃপর মক্কার পথে পথে হাজীদের নিকট এই মিথ্যা অপবাদ প্রচার করার জন্য লোক নিয়োগ করল, যেন তারা রাসূল (সাঃ)-এর ব্যাপারে সবাইকে সাবধান করে’ (ইবনু হিশাম ১/২৭০)।


বস্ত্ততঃ যুগে যুগে সমাজ সংস্কারক নেতাদের বিরুদ্ধে স্বার্থপর সমাজ ও রাজনৈতিক নেতারা এবং মিডিয়ার দুষ্টু লোকেরা পরিকল্পিতভাবে মিথ্যাচার করেছে, আজও করে যাচ্ছে। কেবল যুগের পরিবর্তন হয়েছে। মানসিকতার কোন পরিবর্তন হয়নি।


অলীদ কে ছিলেন? (من هو الوليد؟)

অলীদ বিন মুগীরা আল-মাখযূমী ছিলেন মক্কার অন্যতম সেরা ধনী। আল্লাহ তাকে ধনৈশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততির প্রাচুর্য দান করেছিলেন। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, তিনি নিজেকে বলতেন ‘অহীদ ইবনুল অহীদ’ (আমি অদ্বিতীয়ের পুত্র অদ্বিতীয়)। সারা আরবে আমার ও আমার পিতার কোন তুলনা নেই। তার এই ধারণা বিষয়ে আল্লাহ বলেন,ذَرْنِي وَمَنْ خَلَقْتُ وَحِيدًا ‘ছাড় আমাকে এবং যাকে আমি সৃষ্টি করেছি অদ্বিতীয় করে’ (মুদ্দাছছির ৭৪/১১)। তার ফসলের ক্ষেত, পশু চারণ ক্ষেত্র ও বাগ-বাগিচা মক্কা হ’তে ত্বায়েফ পর্যন্ত (প্রায় ৯০ কি. মি.) বিস্তৃত ছিল (তাফসীর কুরতুবী)। শীত-গ্রীষ্ম উভয় মৌসুমে তার ক্ষেতের ফসল ও বাগানের আয়-আমদানী অব্যাহত থাকত। তার সন্তান-সন্ততি তার সাথেই থাকত। এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন,وَجَعَلْتُ لَهُ مَالاً مَمْدُودًا- وَبَنِينَ شُهُودًا- وَمَهَّدْتُ لَهُ تَمْهِيدًا ‘তাকে আমি দিয়েছিলাম প্রচুর ধন-সম্পদ’। ‘এবং সদাসঙ্গী পুত্রগণ’। ‘আর তাকে দিয়েছিলাম প্রচুর সচ্ছলতা’ (মুদ্দাছছির ৭৪/১২-১৪)।


একদিন তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকটে আসেন। তখন তিনি তাকে কুরআন শুনান। তাতে তার অন্তর গলে যায়। একথা আবু জাহ্লের কানে পৌঁছে যায়। তখন তিনি তার কাছে এসে বলেন, হে চাচা! আপনার সম্প্রদায়ের লোকেরা আপনার জন্য অনেক টাকা জমা করতে মনস্থ করেছে আপনাকে দেওয়ার জন্য। কেননা আপনি মুহাম্মাদের কাছে গিয়েছিলেন। জবাবে তিনি বললেন, কুরায়েশরা ভালো করেই জানে যে আমি তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ধনী। তখন আবু জাহ্ল বললেন, আপনি তার ব্যাপারে এমন কিছু কথা বলুন যাতে আপনার সম্প্রদায়ের লোকেরা বোঝে যে আপনি মুহাম্মাদ যা বলেছে, তা অস্বীকারকারী। জবাবে তিনি বললেন, আমি তার সম্পর্কে কি বলব? আল্লাহর কসম! তোমাদের মধ্যে কবিতা বিষয়ে আমার চাইতে বিজ্ঞ কেউ নেই। আল্লাহর কসম! তিনি যা বলেন, তা  


কোন কিছুর সাথেই তুলনীয় নয়। ক্বাতাদাহ বলেন, লোকেরা ধারণা করত যে, তিনি বলেছিলেন,وَاللهِ لَقَدْ نَظَرْتُ فِيمَا قَالَ الرَّجُلُ فَإِذَا هُوَ لَيْسَ بِشِعْرٍ، وَإِنَّ لَهُ لَحَلاَوَةٌ، وَإِنَّ عَلَيْهِ لَطَلاَوَةٌ، وَإِنَّهُ لَيَعْلُوَ وَمَا يُعْلَى، وَمَا أَشُكُّ أَنَّهُ سِحْرٌ ‘আল্লাহর কসম! লোকটি যা বলেন সে বিষয়ে আমি গভীরভাবে চিন্তা করেছি। এটি কোন কবিতা নয়। নিশ্চয়ই এর রয়েছে বিশেষ মাধুর্য। এর উপরে রয়েছে বিশেষ অলংকার। নিশ্চয়ই এটি বিজয়ী হবে, বিজিত হবে না। আর আমি যা সন্দেহ করি তা এই যে, এটি জাদু।[1]


এভাবে সবকিছু স্বীকার করার পরও অহংকার বশে ও কুরায়েশ নেতাদের চাপে তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নবুঅতকে স্বীকৃতি না দিয়ে বিরুদ্ধাচরণের পথ বেছে নিলেন। ওইদিন অলীদের গৃহে অনুষ্ঠিত বৈঠকে রাসূল (সাঃ)-কে ‘জাদুকর’ বলে প্রচার করার সিদ্ধান্তের ঘটনা এবং অলীদের বাকভঙ্গী আল্লাহ নিজস্ব রীতিতে বর্ণনা করেন নিম্নোক্ত ভাবে-


إِنَّهُ فَكَّرَ وَقَدَّرَ- فَقُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ- ثُمَّ قُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ- ثُمَّ نَظَرَ- ثُمَّ عَبَسَ وَبَسَرَ- ثُمَّ أَدْبَرَ وَاسْتَكْبَرَ- فَقَالَ إِنْ هَذَا إِلاَّ سِحْرٌ يُّؤْثَرُ- إِنْ هَذَا إِلاَّ قَوْلُ الْبَشَرِ-


‘সে চিন্তা করল ও মনস্থির করল’। ‘ধ্বংস হৌক সে কিরূপ মনস্থির করল’? ‘ধ্বংস হৌক সে কিরূপ মনস্থির করল’? ‘অতঃপর সে তাকাল’। ‘অতঃপর ভ্রুকুঞ্চিত করল ও মুখ বিকৃত করল’। ‘অতঃপর পৃষ্ঠ প্রদর্শন করল ও অহংকার করল’। ‘তারপর বলল, অর্জিত জাদু বৈ কিছু নয়’। ‘এটা মানুষের উক্তি বৈ কিছু নয়’ (মুদ্দাছছির ৭৪/১৮-২৫)।


অত্র সূরায় ১১ হ’তে ২৬ পর্যন্ত ১৬টি আয়াত কেবল অলীদ সম্পর্কেই নাযিল হয়েছে। দেখা যাচ্ছে যে, অলীদ রাসূল (সাঃ)-কে ‘মিথ্যাবাদী’ বলতে সাহস করেননি। তাই অবশেষে কালামে পাকের জাদুকরী প্রভাবের কথা চিন্তা করে তিনি রাসূল (সাঃ)-কে ‘জাদুকর’ বলে অপবাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এতে আল্লাহ তাকে পরপর দু’বার অভিসম্পাৎ দিয়ে বলেন,فَقُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ- ثُمَّ قُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ ‘ধ্বংস হৌক সে কিরূপ মনস্থির করল’? ‘ধ্বংস হৌক সে কিরূপ মনস্থির করল’? অতঃপর বললেন,سَأُصْلِيْهِ سَقَرَ ‘সত্বর আমি তাকে ‘সাক্বার’ নামক জাহান্নামে প্রবেশ করাবো’ (মুদ্দাছছির ৭৪/২৬)।


অলীদ বিন মুগীরাহ হিজরতের তিনমাস পর ৯৫ বছর বয়সে কাফির অবস্থায় মক্কায় মৃত্যুবরণ করেন এবং হাজূনে সমাহিত হন।[2]


[1]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা মুদ্দাছছির ১৮-২৪ আয়াত; ইবনু হিশাম ১/২৭০-৭১।

[2]. ইবনুল আছীর, আল-কামিল ফিত তারীখ (বৈরূত : ১ম সংস্করণ ১৪১৭/১৯৯৭) ১/৬৬৯।



হজ্জের মৌসুমে রাসূল (সাঃ)-এর দাওয়াত (دعوة الرسول صـ فى موسم الحج)

যথাসময়ে হজ্জের মৌসুম এসে গেল। হজ্জের মাসের আগে-পিছে দু’মাস হ’ল হারামের মাস। এ তিন মাস মারামারি-কাটাকাটি নিষিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হজ্জে আগত মেহমানদের তাঁবুতে গিয়ে দ্বীনের দাওয়াত দিতে থাকেন। ওদিকে অলীদের পরামর্শ মতে আবু লাহাবের নেতৃত্বে পরিচালিত গীবতকারী দল সবার কাছে গিয়ে রাসূল (সাঃ) সম্পর্কে বিভিন্ন অপবাদ প্রচার করতে থাকে এবং শেষে বলে আসে যে, সে একজন জাদুকর। তার কথা শুনলেই জাদুগ্রস্ত হয়ে যেতে হবে। অতএব কেউ যেন তার ধারে-কাছে না যায়। খোদ আবু লাহাব নির্লজ্জের মত রাসূল (সাঃ)-এর পিছে পিছে ঘুরতে লাগল। রাসূল (সাঃ) যেখানেই যান, সেখানেই সে গিয়ে বলেيَا أَيُّهَا النَّاسُ لاَ تُطِيعُوهُ فَإِنَّهُ صَابِىءٌ كَذَّابٌ ‘হে জনগণ! তোমরা এর কথা শুনো না। সে ধর্মত্যাগী মহা মিথ্যুক’।[1] শুধু তাই নয়, সে উপরোক্ত গালি দিয়ে হজ্জ মৌসুমের বাইরে যুল-মাজায বাজারে রাসূল (সাঃ)-এর পায়ে পাথর ছুঁড়ে মেরেছিল। যাতে তাঁর দু’গোড়ালী রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল।[2]


যুগে যুগে বাতিলপন্থীরা এভাবে হকপন্থীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ রটনা করেছে। আজও করে যাচ্ছে। যাতে লোকেরা হক কবুল করা হ’তে বিরত থাকে।


[1]. ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/১৫৯, সনদ ছহীহ; আহমাদ হা/১৬০৬৬, ১৬০৬৯, সনদ হাসান।

[2]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৬৫৬২; হাকেম ২/৬১১; দারাকুৎনী হা/২৯৫৭, ১৮৬ ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়, সনদ হাসান।


লাভ ও ক্ষতি (نفع الدعوة وضررها)

এই ব্যাপক অপপ্রচারের ফলে রাসূল (সাঃ)-এর জন্য লাভ ও ক্ষতি দু’টিই হ’ল। লাভ হ’ল এই যে, তাঁর নবুঅত দাবীর কথা সর্বত্র প্রচারিত হ’ল। যা সুদূর ইয়াছরিবের কিতাবধারী ইহূদী-নাছারাদের কানে পৌঁছে গেল। এতে তারা বুঝে নিল যে, তাওরাত-ইনজীলের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী আখেরী নবীর আগমন ঘটেছে। ফলে দ্বীনদার লোকদের মধ্যে তাঁর প্রতি ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হ’ল।


পক্ষান্তরে ক্ষতি হ’ল এই যে, কেউ তাঁর দাওয়াতে সাড়া দিল না। বরং অনেকের মধ্যে তাঁর সম্পর্কে বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হ’ল। সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক ছিল আবু লাহাবের কুৎসা রটনা ও নোংরা প্রচারণা। কেননা তিনি ছিলেন রাসূল (সাঃ)-এর আপন চাচা, নিকটতম প্রতিবেশী, তাঁর দুই মেয়ের সাবেক শ্বশুর এবং সুপরিচিত নেতা ও বড় ব্যবসায়ী। তার কথা সবাই বিশ্বাস করে নিল। যে কারণে দীর্ঘ প্রায় তিন মাসব্যাপী দিন-রাতের দাওয়াত বাহ্যতঃ নিষ্ফল হ’ল।


শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ -৬ (العبر -৬)

(১) ইসলাম বিশ্বধর্ম। অতএব বিশ্ব মানবতার কল্যাণে তার প্রকাশ্য দাওয়াত অপরিহার্য ছিল। ক্বিয়ামত অবধি এর প্রকাশ্য দাওয়াত অব্যাহত থাকবে। কেননা এর অকল্যাণকর কোন দিক নেই, যা গোপন রাখতে হবে। বরং যত সুন্দরভাবে ইসলামের প্রতিটি দিক জগত সমক্ষে তুলে ধরা যাবে, মানবজাতি তা থেকে তত দ্রুত কল্যাণ লাভে ধন্য হবে।

(২) কল্যাণময় কোন দাওয়াত প্রকাশিত হ’লে অকল্যাণের অভিসারীরা তার বিরোধিতায় উঠে পড়ে লাগবে এটাই স্বাভাবিক। রাসূল (সাঃ)-এর জীবনে সেটাই ঘটেছিল।

(৩) বাধা সত্ত্বেও দাওয়াত দানকারীকে প্রচারের সকল সুযোগ গ্রহণ করতে হবে। কেননা বহু অচেনা মানব সন্তান রয়েছে, যারা দাওয়াত পেলেই গ্রহণ করার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। সেকারণ রাসূল (সাঃ) দাওয়াত প্রসারের সামান্যতম সুযোগকেও হাতছাড়া করেননি।

(৪) ইসলামের দাওয়াত হবে উদার ও বিশ্বধর্মী। এখানে রং, বর্ণ, ভাষা, অঞ্চল ও গোষ্ঠীগত সংকীর্ণতার কোন অবকাশ থাকবে না।

(৫) তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত তথা আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীনে সকল মানুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করা, রাসূল (সাঃ) প্রদর্শিত পথের অনুসরণ করা এবং আখেরাতে জওয়াবদিহিতার তীব্র অনুভূতি, এই মৌলিক তিনটি বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করা ব্যতীত ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে প্রকৃত কল্যাণ ও উন্নয়ন সম্ভব নয়। ইসলামের এই দাওয়াত সেযুগের ন্যায় এযুগেও মযলূম মানবতার মুক্তিদূত হিসাবে গ্রহণীয়।


অপবাদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও অন্যান্য কৌশল সমূহ (تكثير عدد الافتراء ومكائد أخري) ১. নানাবিধ অপবাদ রটনা (الإفةراءاة المخةلفة)


হজ্জের মৌসুম শেষে নেতারা পুনরায় হিসাব-নিকাশে বসে গেলেন। দেখা গেল যে, অপবাদ রটনায় কাজ হয়েছে সবচেয়ে বেশী। এর দ্বারা যেমন প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবে দুর্বল করা যায়। তেমনি সাধারণ মানুষ দ্রুত সেটা লুফে নেয়। কেউ যাচাই-বাছাই করতে চাইলে তো আমাদের কাছেই আসবে। কেননা আমরাই সমাজের নেতা এবং আমরাই তার নিকটতম আত্মীয় ও প্রতিবেশী। অতএব আমরাই যখন তার বিরুদ্ধে বলছি, তখন কেউ আর এ পথ মাড়াবে না। অতএব অপবাদের সংখ্যা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হ’ল। ফলে রাসূল (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে তারা অনেকগুলি অপবাদ তৈরী করল। যেমন-


তিনি (১) পাগল (২) কবি وَيَقُولُونَ أَئِنَّا لَتَارِكُوا آلِهَتِنَا لِشَاعِرٍ مَّجْنُونٍ ‘তারা বলল, আমরা কি একজন কবি ও পাগলের জন্য আমাদের উপাস্যদের পরিত্যাগ করব? (ছাফফাত ৩৭/৩৬)। (৩) জাদুকর (৪) মহা মিথ্যাবাদী وَقَالَ الْكَافِرُونَ هَذَا سَاحِرٌ كَذَّابٌ ‘কাফেররা বলল, এ লোকটি একজন জাদুকর ও মহা মিথ্যাবাদী’ (ছোয়াদ ৩৮/৪)। (৫) পুরাকালের উপাখ্যান বর্ণনাকারী إِنْ هَـذَا إِلاَّ أَسَاطِيْرُ الأوَّلِيْنَ ‘এটা পূর্ববর্তীদের মিথ্যা উপাখ্যান ব্যতীত কিছুই নয়’ (আনফাল ৮/৩১)। (৬) অন্যের সাহায্যে মিথ্যা রচনাকারী يَقُولُونَ إِنَّمَا يُعَلِّمُهُ بَشَرٌ ‘তারা বলে যে, তাকে শিক্ষা দেয় একজন মানুষ’ (নাহল ১৬/১০৩), (৭) মিথ্যা রটনাকারী وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا إِنْ هَذَا إِلاَّ إِفْكٌ افْتَرَاهُ وَأَعَانَهُ عَلَيْهِ قَوْمٌ آخَرُونَ ‘কাফেররা বলে, এটা বানোয়াট ছাড়া কিছুই নয় যা সে উদ্ভাবন করেছে এবং অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরা তাকে এব্যাপারে সাহায্য করেছে’ (ফুরক্বান ২৫/৪)। (৮) গণৎকার فَذَكِّرْ فَمَا أَنتَ بِنِعْمَتِ رَبِّكَ بِكَاهِنٍ وَلاَ مَجْنُونٍ ‘অতএব তুমি উপদেশ দিতে থাকো। তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহে তুমি গণক নও, উন্মাদও নও’ (তূর ৫২/২৯)। (৯) ইনি তো সাধারণ মানুষ, ফেরেশতা নন وَقَالُوا مَالِ هَذَا الرَّسُولِ يَأْكُلُ الطَّعَامَ وَيَمْشِي فِي الْأَسْوَاقِ لَوْلاَ أُنزِلَ إِلَيْهِ مَلَكٌ فَيَكُونَ مَعَهُ نَذِيراً ‘তারা বলে যে, এ কেমন রাসূল যে খাদ্য ভক্ষণ করে ও হাট-বাজারে চলাফেরা করে? তার প্রতি কেন ফেরেশতা নাযিল করা হলো না, যে তার সাথে থাকতো সদা সতর্ককারী রূপে? (ফুরক্বান ২৫/৭)। (১০) পথভ্রষ্ট وَإِذَا رَأَوْهُمْ قَالُوا إِنَّ هَؤُلاَء لَضَالُّونَ ‘যখন তারা ঈমানদারগণকে দেখত, তখন বলত, নিশ্চয়ই এরা পথভ্রষ্ট’ (মুত্বাফফেফীন ৮৩/৩২)। (১১) ধর্মত্যাগী قَالَ ابو لهب: لاَتُطِيْعُوْهُ فَإِنَّهُ صَابِىءٌ كَذَّابٌ ‘আবু লাহাব বলত, তোমরা এর আনুগত্য করো না। কেননা সে ধর্মত্যাগী মহা মিথ্যাবাদী’ (আহমাদ)। (১২) পিতৃধর্ম বিনষ্টকারী (১৩) জামা‘আত বিভক্তকারী (ইবনু হিশাম ১/২৯৫) (১৪) জাদুগ্রস্ত يَقُوْلُ الظَّالِمُوْنَ إِنْ تَتَّبِعُوْنَ إِلاَّ رَجُلاً مَّسْحُوْراً ‘যালেমরা বলে, তোমরা তো কেবল একজন জাদুগ্রস্ত ব্যক্তির অনুসরণ করছ’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/৪৭)। (১৫) ‘মুযাম্মাম’। আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল ‘মুহাম্মাদ’ (প্রশংসিত) নামের বিপরীতে ‘মুযাম্মাম’ (নিন্দিত) নামে ব্যঙ্গ কবিতা বলত (ইবনু হিশাম ১/৩৫৬)। (১৬) রা‘এনা। মদীনায় হিজরত করার পর সেখানকার দুরাচার ইহূদীরা রাসূল (সাঃ)-কে ‘রা‘এনা’ (رَاعِنَا) বলে ডাকত (বাক্বারাহ ২/১০৪)। তাদের মাতৃভাষা হিব্রুতে যার অর্থ ছিল شَرِيْرُنَا ‘আমাদের মন্দ লোকটি’।[1]


এইসব অপবাদের জওয়াবে আল্লাহ বলেন, اُنْظُرْ كَيْفَ ضَرَبُوْا لَكَ الأَمْثَالَ فَضَلُّوْا فَلاَ يَسْتَطِيْعْوْنَ سَبِيْلاً ‘দেখ ওরা কিভাবে তোমার নামে (বাজে) উপমাসমূহ প্রদান করছে। ওরা পথভ্রষ্ট হয়েছে। অতএব ওরা আর পথ পেতে সক্ষম হবে না’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/৪৮; ফুরক্বান ২৫/৯)। কুৎসা রটনাকারীদের বিরুদ্ধে যুগে যুগে এটাই হ’ল সর্বোত্তম জবাব।


[1]. মুজাম্মা‘ লুগাতুল ‘আরাবিইয়াহ (মিসর : ১৪০৯/১৯৮৮) ১/৫০৬; আরবী ভাষায় رَاعِنَا অর্থ ‘আমাদের তত্ত্বাবধায়ক’। মাদ্দাহ الرعاية والحفظ এই লকবে ডেকে তারা বাহ্যতঃ মুসলমানদের খুশী করত। কিন্তু এর দ্বারা তারা নিজেদের ভাষা অনুযায়ী গালি (الرُّعُونَةُ) অর্থ নিত। সেকারণ আল্লাহ এটাকে নিষিদ্ধ করে انظُرْنَا (‘আমাদের দেখাশুনা করুন’) লকবে ডাকার নির্দেশ দিলেন (ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা বাক্বারাহ ১০৪ আয়াত)।


২. নাচ-গানের আসর করা (احتفال الرقص والغناء)

গল্পের আসর জমানো এবং গান-বাজনা ও নৃত্য-গীতের অনুষ্ঠান করা, যাতে মানুষ মুহাম্মাদের কথা না শোনে। এজন্য অন্যতম কুরায়েশ নেতা ও বিত্তশালী ব্যবসায়ী নযর বিন হারেছ তৎকালীন সমৃদ্ধ শহর ইরাকের ‘হীরা’ নগরীতে চলে যান এবং সেখান থেকে পারস্যের প্রাচীন রাজা-বাদশাদের কাহিনী, রুস্তম ও ইস্ফিনদিয়ারের বীরত্বের কাহিনী শিখে এসে মক্কায় বিভিন্ন স্থানে গল্পের আসর বসাতে শুরু করেন। যেখানেই রাসূল (সাঃ) মানুষকে জাহান্নামের ভয় ও জান্নাতের সুখ-শান্তির কথা শুনিয়ে দ্বীনের দাওয়াত দিতেন, সেখানেই নযর বিন হারেছ গিয়ে উক্ত সব কল্প-কাহিনী শুনিয়ে বলতেন, এগুলো কি মুহাম্মাদের কাহিনীর চেয়ে উত্তম নয়? এতেও তিনি ক্ষান্ত না হয়ে অনেকগুলি সুন্দরী দাসী খরিদ করেন, যারা নৃত্য-গীতে পারদর্শী ছিল। তিনি তাদের নিয়ে বিভিন্ন স্থানে নাচ-গানের আসর বসাতেন এবং মানুষকে সেখানে আকৃষ্ট করতেন। এমনকি কোন লোক মুহাম্মাদের অনুসারী হয়েছে জানতে পারলে তিনি ঐসব সুন্দরীদের তার পিছনে লাগিয়ে দিতেন এবং তাকে ফিরিয়ে আনার যেকোন পন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দিতেন’ (ইবনু হিশাম ১/৩০০)।


উপরোক্ত ঘৃণ্য ক্রিয়া-কলাপের প্রেক্ষিতেই নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়-


وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيْثِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيْلِ اللهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَّيَتَّخِذَهَا هُزُواً أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُّهِيْنٌ- (لقمان ৬)-


‘লোকেদের মধ্যে একটা শ্রেণী আছে, যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য অজ্ঞতাবশে অলীক কল্প-কাহিনী খরীদ করে এবং আল্লাহর পথকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। এদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি’ (লোকমান ৩১/৬)।


আধুনিক যুগের মিথ্যাচার ও খেল-তামাশার বাহন স্বরূপ ইসলাম বিরোধী প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া সমূহ এ আয়াতের আওতাভুক্ত। সেযুগের চেয়ে এ যুগে এসবের ক্ষতি শতগুণ বেশী। কেননা সে যুগে এসব যে স্থানে প্রদর্শিত হ’ত, সে স্থানের দর্শক ও শ্রোতারাই কেবল সংক্রমিত হ’ত। কিন্তু আধুনিক যুগে এর মন্দ প্রতিক্রিয়া হয় সাথে সাথে বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি দর্শক ও শ্রোতার মধ্যে। সেকারণ জাহান্নামের কঠিন শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য মিডিয়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের এবং পরিবারপ্রধান ও সমাজ ও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দের এ বিষয়ে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক।


৩. ব্যঙ্গ কবিতা রচনা (إنشاء الشعر الهجاء)

আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল রাসূল (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ কবিতা লিখতেন। যাতে রাসূল (সাঃ) কষ্ট পান। এর মাধ্যমে তিনি লোকদের ক্ষেপিয়ে তুলতেন। সূরা লাহাব নাযিল হ’লে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে তিনি হাতে প্রস্তরখন্ড নিয়ে রাসূল (সাঃ)-কে মারার উদ্দেশ্যে কা‘বা চত্বরে গমন করেন এবং নিম্নোক্ত কবিতা পাঠ করেন।-

مُذَمَّمًا عَصَيْنَا + وَأَمْرَهُ أَبَيْنَا + وَدِيْنَهُ قَلَيْنَا

‘নিন্দিতের আমরা অবাধ্যতা করি’। ‘তার নির্দেশ আমরা অমান্য করি’। ‘তার দ্বীনকে আমরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি’।[1] উক্ত কবিতায় তিনি ‘মুহাম্মাদ’ (প্রশংসিত) নামকে বিকৃত করে ‘মুযাম্মাম’ (নিন্দিত) বলেন। কুরায়েশরাও রাসূল (সাঃ)-কে গালি দিয়ে ‘মুযাম্মাম’ (নিন্দিত) বলত। জবাবে রাসূল (সাঃ) কত সুন্দরই না বলতেন, أَلاَ تَعْجَبُوْنَ كَيْفَ يَصْرِفُ اللهُ عَنِّى شَتْمَ قُرَيْشٍ وَلَعْنَهُمْ يَشْتِمُوْنَ مُذَمَّمًا وَيَلْعَنُوْنَ مُذَمَّمًا وَأَنَا مُحَمَّدٌ ‘তোমরা কি বিস্মিত হও না কিভাবে আল্লাহ আমার থেকে কুরাইশদের গালি ও লা‘নতকে ফিরিয়ে দিয়েছেন? তারা আমাকে ‘মুযাম্মাম’ (مُذَمَّمٌ) ‘নিন্দিত’ বলে গালি দিয়েছে ও লা‘নত করেছে, অথচ আমি হ’লাম ‘মুহাম্মাদ’ (مُحَمَّدٌ) ‘প্রশংসিত’।[2] যুগে যুগে সংস্কারপন্থী আলেম ও সংগঠনের বিরুদ্ধে কটূক্তিকারীদের জন্য এটাই হবে সর্বোত্তম জওয়াব।


[1]. ইবনু হিশাম ১/৩৫৬; হাকেম হা/৩৩৭৬, ২/৩৬১ সনদ ছহীহ; আলবানী, ছহীহ সীরাহ নববিইয়াহ ১৩৭ পৃঃ; তাফসীর কুরতুবী, ইবনু কাছীর; সীরাহ ছহীহাহ ১/১৪৭।

[2]. ইবনু হিশাম ১/৩৫৬; বুখারী হা/৩৫৩৩; মিশকাত হা/৫৭৭৮।


৪. অতীতে সংঘটিত বিভিন্ন কাহিনী সম্পর্কে প্রশ্ন করা (السؤال عن القصص الماضية)

(ক) আছহাবে কাহফ ও যুল-ক্বারনায়েন(السؤال عن اصحاب الكهف وذى القرنين) : তাঁকে ভন্ডনবী প্রমাণের জন্য কুরায়েশ নেতারা ইহূদীদের পরামর্শ মতে বিভিন্ন অতীত কাহিনী সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিল। যেমন- (১) আছহাবে কাহফের সেই যুবকদের ঘটনা, যারা প্রাচীনকালে শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিল এবং ৩০৯ বছর ঘুমিয়ে থেকে আবার জেগে উঠেছিল। (২) যুল-ক্বারনায়েন-এর ঘটনা, যিনি পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিমে সফর করেছিলেন। (৩) রূহ কি?


উক্ত প্রেক্ষিতে সূরা কাহফ নাযিল হয়। তবে এ বিষয়ে ইবনু ইসহাক থেকে যে বর্ণনা এসেছে, তা যঈফ। সেখানে বলা হয়েছে যে, রাসূল (সাঃ) নেতাদেরকে পরদিন জবাব দিবেন বলে ওয়াদা করেন। কিন্তু ‘ইনশাআল্লাহ’ বলেন নি। ফলে ১৫ দিন যাবৎ অহী নাযিল বন্ধ থাকে। পরে জিব্রীল এসে তাঁকে এজন্য তিরষ্কার করেন এবং সূরা কাহফ নাযিল করেন। কথাগুলির মধ্যে যেমন অযৌক্তিকতা রয়েছে, সনদেও রয়েছে তেমনি চরম দুর্বলতা।[1]


(খ) রূহ সম্পর্কে প্রশ্ন(السؤال عن الروح) : হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, একবার কুরায়েশ নেতারা ইহূদী পন্ডিতদের বলল, তোমরা আমাদের এমন কিছু শিখিয়ে দাও, যেটা আমরা এই ব্যক্তিকে প্রশ্ন করব (এবং সে জবাব দিতে পারবে না)। তখন তারা বলল, তোমরা তাকে ‘রূহ’ সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর। সেমতে তারা জিজ্ঞেস করল। তখন আল্লাহ তা‘আলা নাযিল করেন,وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الرُّوحِ قُلِ الرُّوحُ مِنْ أَمْرِ رَبِّي وَمَا أُوتِيتُمْ مِنَ الْعِلْمِ إِلاَّ قَلِيلاً ‘আর ওরা তোমাকে প্রশ্ন করছে ‘রূহ’ সম্পর্কে। তুমি বলে দাও, রূহ আমার প্রতিপালকের একটি আদেশ মাত্র। আর এ বিষয়ে তোমাদের প্রতি সামান্যই জ্ঞান দেওয়া হয়েছে (ইসরা ১৭/৮৫)।[2] ‘রূহ’ সম্পর্কিত প্রশ্নটি পুনরায় মদীনায় ইহূদীরা করলে সেখানে একই জবাব দেওয়া হয়, যা মক্কায় সূরা বনু ইস্রাঈল ৮৫ আয়াত নাযিলের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছিল।[3]


[1]. ইবনু জারীর, কুরতুবী, ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা কাহফ ৫ আয়াত; ত্বাবারী হা/২২৮৬১, ১৫/১২৭-২৮; বায়হাক্বী দালায়েলুন নবুঅত ২/২৭০; ইবনু হিশাম ১/৩০৮; সনদ যঈফ।

[2]. তিরমিযী হা/৩১৪০, আহমাদ হা/২৩০৯, সনদ ছহীহ।

[3]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৪৭২১-এর আলোচনা; মুসলিম হা/২৭৯৪; তিরমিযী হা/৩১৪০।


৫. ইহূদী পন্ডিতদের মাধ্যমে সরাসরি নবীকে পরীক্ষা করা (اختبار النبى مباشرة بعلماء اليهود)

মদীনার কপট ইহূদী পন্ডিতরা মক্কায় এসে রাসূল (সাঃ)-কে প্রশ্ন করল, বলুন তো শামে বসবাসকারী কোন নবীর ছেলেকে মিসরে বহিষ্কার করা হয় এবং তিনি সেই শোকে কেঁদে অন্ধ হয়ে যান? ইহূদীরা এঘটনা জানত তাওরাতের মাধ্যমে যা ছিল হিব্রু ভাষায়। মক্কার লোকেরা হিব্রু জানত না। এমনকি তারা আরবীতেও লেখাপড়া জানত না। তারা ইউসুফ নবী সম্পর্কে কিছুই জানত না। এ প্রশ্ন ছিল রাসূল (সাঃ)-এর জন্য একটি কঠিন পরীক্ষা। ফলে ইউসুফের কাহিনী পূরাটাই একত্রে একটি সূরায় নাযিল হয়। যা অন্য নবীদের বেলায় হয়নি (তাফসীর ইবনু জারীর হা/১৮৭৮৬; কুরতুবী প্রভৃতি)।


৬. চাঁদ দ্বিখন্ডিত করণের প্রস্তাব (اقتراح شق القمر)

সবকিছুতে ব্যর্থ হয়ে সবশেষে ইহূদী পন্ডিতেরা কুরায়েশ নেতাদের একটা বিস্ময়কর কৌশল শিখিয়ে দিল। তারা বলল, মুহাম্মাদ জাদুকর কি-না, যাচাইয়ের একটা প্রকৃষ্ট পন্থা এই যে, জাদুর প্রভাব কেবল যমীনেই সীমাবদ্ধ থাকে। আসমানে এর কোন প্রতিক্রিয়া হয় না। অতএব তোমরা মুহাম্মাদকে বল, সে চাঁদকে দ্বিখন্ডিত করুক। সম্ভবতঃ হযরত মূসা (আঃ) কর্তৃক লাঠির সাহায্যে নদী বিভক্ত হওয়ার মু‘জেযা থেকেই চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করার চিন্তাটি ইহূদীদের মাথায় এসে থাকবে। অথচ নদী বিভক্ত করার চাইতে চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করা কতই না কঠিন বিষয়। কেননা এটি দুনিয়ার এবং অন্যটি আকাশের। কুরায়েশ নেতারা মহা খুশীতে বাগবাগ হয়ে গেল এই ভেবে যে, এবার নির্ঘাত মুহাম্মাদ কুপোকাৎ হবে। তারা দল বেঁধে রাসূল (সাঃ)-এর কাছে গিয়ে এক চন্দ্রোজ্জ্বল রাত্রিতে উক্ত প্রশ্ন করল। ঐ সময় সেখানে হযরত আলী, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ, জুবায়ের ইবনু মুত্ব‘ইম প্রমুখ ছাহাবীগণ উপস্থিত ছিলেন। এতদ্ব্যতীত বহু ছাহাবী উক্ত বিষয়ে হাদীছ বর্ণনা করেছেন। যে কারণে হাফেয ইবনু কাছীর এতদসংক্রান্ত হাদীছসমূহকে ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ভুক্ত বলেছেন (ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা ক্বামার)।


কুরায়েশ নেতাদের দাবী মোতাবেক আল্লাহর হুকুমে রাসূল (সাঃ)-এর উক্ত মু‘জেযা প্রদর্শিত হ’ল। মুহূর্তের মধ্যে চাঁদ দ্বিখন্ডিত হয়ে পূর্ব ও পশ্চিমে ছিটকে পড়ল। উভয় টুকরার মাঝখানে ‘হেরা’ পর্বত আড়াল হয়ে গেল। অতঃপর পুনরায় দুই টুকরা এসে যুক্ত হ’ল। এ সময় আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মিনা-তে ছিলেন। ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) কর্তৃক ছহীহায়নের বর্ণনায় এসেছে যে, এরপর রাসূল (সাঃ) উপস্থিত নেতাদের বললেন, إشْهَدُوْا ‘তোমরা সাক্ষী থাক’।[1] ইবনু মাস‘ঊদ ও ইবনু ওমর (রাঃ) কর্তৃক ছহীহ মুসলিম-এর বর্ণনায় এসেছে যে, ঐসময় আল্লাহকে সাক্ষী রেখে রাসূল (সাঃ) বলেন,اللَّهُمَّ اشْهَدْ ‘হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক’।[2] এতে অনুমিত হয় যে, ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর সাথে ঐ সময় ইবনু ওমর (রাঃ) হাযির ছিলেন এবং উভয়ে উক্ত ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। এ সময় তাঁর বয়স ছিল ১৩ বছরের মত। ঘটনাটি ৯ম নববী বর্ষে ঘটে।[3] উক্ত ঘটনার প্রেক্ষিতে সূরা ক্বামার নাযিল হয়। যার শুরু হ’লاقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ وَانْشَقَّ الْقَمَرُ ‘ক্বিয়ামত আসন্ন। চন্দ্র বিদীর্ণ হয়েছে’ (ক্বামার ৫৪/১)।


এত বড় ঘটনা চাক্ষুষ দেখা সত্ত্বেও কুরায়েশ নেতারা ঈমান আনলেন না। পরে বিভিন্ন এলাকা হ’তে আগত লোকদের কাছেও তারা একই ঘটনা শোনেন। ইবনু মাসঊদ বলেন, তারা বললেন, এটা আবু কাবশার পুত্রের (মুহাম্মাদের) জাদু। সে তোমাদের জাদু করেছে। অতএব তোমরা বহিরাগত লোকদের জিজ্ঞেস কর। কেননা মুহাম্মাদ একসঙ্গে সবাইকে জাদু করতে পারবে না। অতএব বহিরাগতরা বললে সেটাই ঠিক। নইলে এটা স্রেফ জাদু মাত্র। অতঃপর চারদিক থেকে আসা মুসাফিরদের জিজ্ঞেস করলেন। তারা সবাই এ দৃশ্য দেখেছেন বলে সাক্ষ্য দেন’।[4] কিন্তু যিদ ও অহংকার তাদেরকে ঈমান আনা হ’তে বিরত রাখলো। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,وَإِن يَّرَوْا آيَةً يُعْرِضُوا وَيَقُولُوا سِحْرٌ مُّسْتَمِرٌّ، وَكَذَّبُوا وَاتَّبَعُوا أَهْوَاءَهُمْ وَكُلُّ أَمْرٍ مُّسْتَقِرٌّ ‘তারা যদি কোন নিদর্শন (যেমন চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করণ) দেখে, তবে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে যে, এটা তো চলমান জাদু’। ‘তারা মিথ্যারোপ করে এবং নিজেদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে। অথচ প্রত্যেক কাজের ফলাফল (ক্বিয়ামতের দিন) স্থিরীকৃত হবে (ক্বামার ৫৪/২-৩)।


তারীখে ফিরিশতায় বর্ণিত হয়েছে যে, চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হওয়ার এই দৃশ্য ভারতের মালাবারের জনৈক মহারাজা স্বচক্ষে দেখেন এবং তা নিজের রোজনামচায় লিপিবদ্ধ করেন। পরে আরব বণিকদের মুখে ঘটনা শুনে তখনকার রাজা ‘সামেরী’ উক্ত রোজনামচা বের করেন। অতঃপর তাতে ঘটনার সত্যতা দেখে তিনি মুসলমান হয়ে যান। যদিও সামরিক নেতা ও সমাজনেতাদের ভয়ে তিনি ইসলাম গোপন রাখেন’।[5] ১৯৬৯ সালের ২০শে জুলাই চন্দ্রে প্রথম পদাপর্ণকারী দলের নেতা নেইল আর্মষ্ট্রং স্বচক্ষে চন্দ্রপৃষ্ঠের বিভক্তি রেখা দেখে বিস্ময়াভিভূত হন এবং ইসলাম কবুল করেন। কিন্তু মার্কিন প্রশাসনের ভয়ে তিনি একথা কয়েক বছর পরে প্রকাশ করেন।[6]


চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করা ছাড়াও রাসূল (সাঃ)-এর জীবনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মু‘জেযা প্রদর্শিত হয়েছে। কিন্তু এগুলি ছিল কেবল হঠকারীদের অহংকার চূর্ণ করার জন্য। এর দ্বারা তারা কখনোই হেদায়াত লাভ করেনি। যদিও এর ফলে দ্বীনদারগণের ঈমান বৃদ্ধি পেয়েছে।


[1]. বুখারী হা/৩৮৬৮; মুসলিম হা/২৮০০ (৪৩-৪৪); মিশকাত হা/৫৮৫৪-৫৫।

[2]. মুসলিম হা/২৮০০ (৪৫) ‘মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্যাবলী’ অধ্যায়, ‘চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করণ’ অনুচ্ছেদ।

[3]. মানছূরপুরী, রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ৩/১৫৫ পৃঃ।

[4]. তাফসীর ইবনু জারীর হা/৩২৬৯৯ প্রভৃতি; সনদ ছহীহ; কুরতুবী হা/৫৭৩৭।

[5]. মুহাম্মাদ ক্বাসেম হিন্দুশাহ ফিরিশতা, তারীখে ফিরিশতা (ফার্সী হ’তে উর্দূ অনুবাদ : লাক্ষ্ণৌ ছাপা, ১৩২৩/১৯০৫) ১১শ অধ্যায় ‘মালাবারের শাসকদের ইতিহাস’ ২/৪৮৮-৮৯ পৃঃ।

[6]. লেখক নিজে উক্ত চন্দ্র বিজয়ী দলের ঢাকা সফরকালে নিকট থেকে তাদের স্বচক্ষে দেখেছেন এবং অনেক পরে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় উক্ত খবরটি পড়েছেন। -লেখক।


৭. আপোষমুখী প্রস্তাব সমূহ পেশ (تقديم الاقتراحات للمصالحة الى النبى صـــ)

বুদ্ধিবৃত্তিক ও অলৌকিক সকল পন্থায় পরাজিত হয়ে কুরায়েশ নেতারা এবার আপোষমুখী পদ্ধতি গ্রহণ করল। ‘কিছু গ্রহণ ও কিছু বর্জন’-এর নীতিতে তারা রাসূল (সাঃ)-এর সাথে আপোষ করতে চাইল। কুরআনের ভাষায়وَدُّوْا لَوْ تُدْهِنُ فَيُدْهِنُوْنَ ‘তারা চায় যদি তুমি কিছুটা শিথিল হও, তাহ’লে তারাও নমনীয়তা দেখাবে’ (ক্বলম ৬৮/৯)। এ বিষয়ে তাদের প্রস্তাবগুলি ছিল নিম্নরূপ :

(ক) একদিন রাসূল (সাঃ) কা‘বায় তাওয়াফ করছিলেন। এমতাবস্থায় আসওয়াদ বিন আবদুল মুত্ত্বালিব, অলীদ বিন মুগীরাহ, উমাইয়া বিন খালাফ, ‘আছ বিন ওয়ায়েল প্রমুখ মক্কার বিশিষ্ট নেতৃবর্গ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকটে এসে আপোষ প্রস্তাব দিয়ে বলেন,


يَا مُحَمَّدُ، هَلُمَّ فَلْنَعْبُدْ مَا تَعْبُدُ، وَتَعْبُدُ مَا نَعْبُدُ، فَنَشْتَرِكُ نَحْنُ وَأَنْتَ فِي الْأَمْرِ، فَإِنْ كَانَ الَّذِي تَعْبُدُ خَيْرًا مِمَّا نَعْبُدُ، كُنَّا قَدْ أَخَذْنَا بِحَظِّنَا مِنْهُ، وَإِنْ كَانَ مَا نَعْبُدُ خَيْرًا مِمَّا تَعْبُدُ، كُنْتَ قَدْ أَخَذْتَ بِحَظِّكَ مِنْهُ


‘হে মুহাম্মাদ! এসো আমরা ইবাদত করি তুমি যার ইবাদত কর এবং তুমি পূজা কর আমরা যার পূজা করি। আমরা এবং তুমি আমাদের কাজে পরস্পরে শরীক হই। অতঃপর তুমি যার ইবাদত কর, তিনি যদি উত্তম হন আমরা যাদের পূজা করি তাদের চাইতে, তাহ’লে আমরা তার ইবাদতে পুরাপুরি অংশ নিব। আর আমরা যাদের পূজা করি, তারা যদি উত্তম হয় তুমি যার ইবাদত কর তাঁর চাইতে, তাহ’লে তুমি তাদের পূজায় পুরাপুরি অংশ নিবে’ (ইবনু হিশাম১/৩৬২)।[1] ইবনু জারীর-এর বর্ণনায় এসেছে,ونُشركُكَ في أَمرِنا كُلِّهِ، فإن كان الذي جِئتَ به خيرًا مما بأيدينا، كنا قد شَرِكناكَ فيه ‘আমরা তোমাকে আমাদের সকল কাজে শরীক করব। অতঃপর তুমি যে দ্বীন নিয়ে এসেছ, তা যদি আমাদের দ্বীনের চাইতে উত্তম হয়, তাহ’লে আমরা সবাই তোমার সাথে তাতে শরীক হব। আর যদি আমাদেরটা উত্তম হয়, তাহ’লে তুমি আমাদের কাজে শরীক হবে এবং তাতে পুরোপুরি অংশগ্রহণ করবে’। তখন অত্র সূরা নাযিল হয়।


(খ) যদি তুমি আমাদের কোন একটি মূর্তিকে চুমু দাও, তাহ’লে আমরা তোমাকে সত্য বলে মেনে নিব। (গ) তারা একথাও বলেছিল যে, তুমি চাইলে আমরা তোমাকে এত মাল দেব যে, তুমি সেরা ধনী হবে। তুমি যাকে চাও, তার সাথে তোমাকে বিয়ে দেব। আর আমরা সবাই তোমার অনুসারী হব। কেবল তুমি আমাদের দেব-দেবীদের গালি দেওয়া বন্ধ কর। যদি তাতেও তুমি রাযী না হও, তাহ’লে একটি প্রস্তাবে তুমি রাযী হও, যাতে আমাদের ও তোমার মঙ্গল রয়েছে। আর তা হ’ল, (ঘ) তুমি আমাদের উপাস্য লাত-উযযার এক বছর পূজা কর এবং আমরা তোমার উপাস্যের এক বছর পূজা করব। এইভাবে এক বছর এক বছর করে সর্বদা চলবে’। তখন সূরা কাফেরূন নাযিল হয় (কুরতুবী) এবং তাদের সাথে চূড়ান্ত বিচ্ছেদ ঘোষণা করা হয়।[2]


সূরা কাফেরূন নাযিলের কারণ হিসাবে বর্ণিত উপরোক্ত বিষয়গুলির সূত্র যথার্থভাবে ছহীহ নয়। তবে এগুলির প্রসিদ্ধি অতি ব্যাপক। যা ইবনু জারীর, কুরতুবী, ইবনু কাছীরসহ প্রায় সকল প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থে এসেছে। অতএব সূত্র দুর্বল হ’লেই ঘটনা সঠিক নয়, তা বলা যাবে না। কেননা সূরা কাফেরূনের বক্তব্যেই ঘটনার যথার্থতা প্রতীয়মান হয়।


[1]. ইবনু জারীর, কুরতুবী; ইবনু হিশাম ১/৩৬২ ‘সূরা কাফেরূন নাযিলের কারণ’ অনুচ্ছেদ; আলবানী, ছহীহুস সীরাহ ২০১-২০২ পৃঃ ।

[2]. আর-রাহীক্ব পৃঃ ৮৪-৮৫; তাফসীর ইবনু জারীর, কুরতুবী, ইবনু কাছীর প্রভৃতি; ইবনু হিশাম ১/৩৬২। বর্ণনাটির সনদ ‘মুরসাল’ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৩৫৪); মা শা-‘আ ৫১ পৃঃ।


৮. লোভনীয় প্রস্তাবসমূহ পেশ (تقديم الاقتراحات المشةهية للمسلمين)

অতঃপর তারা সাধারণ মুসলমানদের ফিরিয়ে আনার জন্য লোভনীয় প্রস্তাব সমূহ পেশ করল। সেরা ধনী অলীদ বিন মুগীরাহ্র নেতৃত্বে তারা নির্যাতিত-নিপীড়িত নওমুসলিমদের বলতে লাগলো যে, তোমরা পিতৃধর্মে ফিরে এলে তোমাদের জীবনে সচ্ছলতা ও সুখ-সাচ্ছন্দ্য ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এমনকি পরকালে তোমাদের পাপের বোঝা আমরাই বহন করব। যেমন আল্লাহ বলেন,


وَقَالَ الَّذِيْنَ كَفَرُوا لِلَّذِيْنَ آمَنُوا اتَّبِعُوْا سَبِيْلَنَا وَلْنَحْمِلْ خَطَايَاكُمْ وَمَا هُمْ بِحَامِلِيْنَ مِنْ خَطَايَاهُمْ مِنْ شَيْءٍ إِنَّهُمْ لَكَاذِبُوْنَ- وَلَيَحْمِلُنَّ أَثْقَالَهُمْ وَأَثْقَالاً مَعَ أَثْقَالِهِمْ وَلَيُسْأَلُنَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَمَّا كَانُوا يَفْتَرُونَ- (العنكبوت ১২-১৩)-


‘কাফিররা মুমিনদের বলে, তোমরা আমাদের পথ অনুসরণ কর, আমরা তোমাদের পাপভার বহন করব। অথচ তারা তাদের পাপভার কিছুই বহন করবে না। নিশ্চয়ই তারা মিথ্যাবাদী’। ‘তারা নিজেদের পাপের বোঝা বহন করবে এবং তাদের বোঝার সাথে অন্যদের বোঝা সমূহ। আর তারা যেসব মিথ্যা উদ্ভাবন করে, সেবিষয়ে তাদেরকে ক্বিয়ামতের দিন অবশ্যই প্রশ্ন করা হবে’ (আনকাবূত ২৯/১২-১৩; তাফসীর ইবনু কাছীর)। বস্ত্ততঃ কুফর ও নিফাকের অনুসারী বাতিলপন্থীরা সর্বযুগে উক্ত কপট নীতি অনুসরণ করে থাকে।


৯. উদ্ভট দাবী সমূহ পেশ (تقديم الدعاوى الغريبة عند النبى صـــ)

যেমন (ক) উৎবা, শায়বাহ, আবু সুফিয়ান, নযর বিন হারেছ, আবুল বাখতারী, আসওয়াদ বিন মুত্ত্বালিব, অলীদ বিন মুগীরাহ, আবু জাহল, উমাইয়া বিন খালাফ, আব্দুল্লাহ ইবনু আবী উমাইয়া সহ ১৪জন কুরায়েশ নেতা রাসূল (সাঃ)-কে মাগরিবের পর কা‘বা চত্বরে ডাকিয়ে এনে বললেন, হে মুহাম্মাদ! তুমি তোমার বংশের উপরে যে বিপদ ডেকে এনেছ, সমগ্র আরবে কেউ তা আনেনি।لَقَدْ شَتَمْتَ الْآبَاءَ، وَعِبْتَ الدِّينَ، وَشَتَمْتَ الْآلِهَةَ، وَسَفَّهْتَ الْأَحْلاَمَ، وَفَرَّقْتَ الْجَمَاعَةَ ‘তুমি তোমার বাপ-দাদাকে গালি দিয়েছ, তাদের দ্বীনকে দোষারোপ করেছ, উপাস্যদের গালি দিয়েছ, জ্ঞানীদের বোকা ধারণা করেছ এবং আমাদের জামা‘আতকে বিভক্ত করেছ’। এক্ষণে যদি তুমি এগুলো পরিত্যাগের বিনিময়ে মাল চাও, মর্যাদা চাও, নেতৃত্ব চাও, শাসন ক্ষমতা চাও, তোমার জিন ছাড়ানোর চিকিৎসক চাও, সবই তোমাকে দিব। জবাবে রাসূল (সাঃ) বললেন, আল্লাহ আমাকে আপনাদের নিকট রাসূল হিসাবে পাঠিয়েছেন। আমি আপনাদের নিকট রিসালাত পৌঁছে দিয়েছি। যদি আপনারা সেটা কবুল করেন, তাহ’লে দুনিয়া ও আখেরাতে আপনাদের কল্যাণ হবে। আর যদি অস্বীকার করেন, তাহ’লে আমি আল্লাহর আদেশের অপেক্ষায় ধৈর্য ধারণ করব। যতক্ষণ না তিনি আমার ও আপনাদের মধ্যে ফায়ছালা করে দেন’। তখন নেতারা বললেন, তুমি যদি আমাদের কোন কথাই না শোন, তাহ’লে তোমার প্রভুকে বল যেন (১) তিনি মক্কার পাহাড়গুলি সরিয়ে এস্থানটিকে সমতল ভূমিতে পরিণত করে দেন। কেননা তুমি জান মক্কার চাইতে সংকীর্ণ শহর আর নেই। (২) তোমার প্রভু যেন এখানে নদীসমূহ প্রবাহিত করে দেন, যেমন শাম ও ইরাকে রয়েছে। (৩) আমাদের সাবেক নেতা কুছাই বিন কিলাবকে জীবিত করে এনে দাও। যার কাছে শুনব তোমাকে যে আল্লাহ রাসূল করে পাঠিয়েছেন, তা সত্য কি-না। (৪) তোমার প্রভু যেন তোমার সঙ্গে একজন ফেরেশতা পাঠান, যিনি তোমার ব্যাপারে সত্যায়ন করবেন। (৫) তুমি তাঁর নিকটে প্রার্থনা কর, যেন তোমার জন্য বাগ-বাগিচা এবং স্বর্ণ ও রৌপ্য মন্ডিত প্রাসাদ বানিয়ে দেন। (৬) আমরা তোমার উপরে ঈমান আনিনি বিধায় তোমার প্রভু যেন আমাদের উপর আকাশকে টুকরা-টুকরা করে গযব হিসাবে নামিয়ে দেন, যেমনটি তুমি ধারণা করে থাক। (৭) তাদের একজন বলল, আমরা কখনই তোমার উপরে ঈমান আনবো না, যতক্ষণ না আল্লাহ ও ফেরেশতাদেরকে আমাদের সামনে না নিয়ে আসবে। (৮) আরেকজন নেতা রাসূল (সাঃ)-এর ফুফাতো ভাই আব্দুল্লাহ ইবনু আবী উমাইয়া বললেন, আল্লাহর কসম! আমরা কখনই তোমার উপরে ঈমান আনবো না, যতক্ষণ না তুমি আসমান থেকে সিঁড়ি নামিয়ে দিবে। অতঃপর তুমি তাতে আরোহন করবে ও আল্লাহর কাছে চলে যাবে। অতঃপর সেখান থেকে চারজন ফেরেশতাকে সাথে নিয়ে আসবে, যে তোমার বিষয়ে সাক্ষ্য দিবে যে, তুমি যা বল, তা সত্য।[1]


দাবীগুলির বর্ণনা এবং তার সনদ যঈফ হ’লেও এগুলির বর্ণনা ও এসবের জবাব কুরআনে এসেছে। এতেই বুঝা যায় যে, ঘটনা সঠিক ছিল। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَقَالُوْا لَنْ نُؤْمِنَ لَكَ حَتَّى تَفْجُرَ لَنَا مِنَ الْأَرْضِ يَنْبُوعًا- أَوْ تَكُونَ لَكَ جَنَّةٌ مِنْ نَخِيلٍ وَعِنَبٍ فَتُفَجِّرَ الْأَنْهَارَ خِلاَلَهَا تَفْجِيرًا- أَوْ تُسْقِطَ السَّمَاءَ كَمَا زَعَمْتَ عَلَيْنَا كِسَفًا أَوْ تَأْتِيَ بِاللهِ وَالْمَلاَئِكَةِ قَبِيلاَ- أَوْ يَكُونَ لَكَ بَيْتٌ مِنْ زُخْرُفٍ أَوْ تَرْقَى فِي السَّمَاءِ وَلَنْ نُؤْمِنَ لِرُقِيِّكَ حَتَّى تُنَزِّلَ عَلَيْنَا كِتَابًا نَقْرَؤُهُ قُلْ سُبْحَانَ رَبِّي هَلْ كُنْتُ إِلاَّ بَشَرًا رَسُولاً-

‘তারা বলল, আমরা কখনোই তোমার উপর বিশ্বাস স্থাপন করব না যতক্ষণ না তুমি আমাদের জন্য ভূমি থেকে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত করে দিবে’ (৯০)। ‘অথবা তোমার জন্য খেজুর ও আঙ্গুরের বাগিচা হবে। যার মধ্যে তুমি ব্যাপকভাবে (শাম ও ইরাকের ন্যায়) নদী-নালা প্রবাহিত করাবে’ (৯১)। ‘অথবা আকাশকে টুকরা টুকরা করে আমাদের উপরে নিক্ষেপ করবে যেমনটা তুমি ধারণা ব্যক্ত করে থাক। অথবা আল্লাহ ও ফেরেশতাদেরকে আমাদের সামনে নিয়ে আসবে’ (৯২)। ‘অথবা তোমার একটি স্বর্ণমন্ডিত প্রাসাদ হবে। অথবা তুমি আকাশে আরোহণ করবে। অবশ্য আমরা তোমার আকাশে আরোহণে বিশ্বাস করব না যতক্ষণ না তুমি সেখান থেকে (তোমার সত্যতার পক্ষে) আমাদের উপর কোন কিতাব নাযিল করাবে, যা আমরা পড়ে দেখব। তুমি বল, আমার প্রভু (এইসব থেকে) পবিত্র। আমি একজন মানুষ রাসূল ব্যতীত কিছুই নই’ (ইসরা ১৭/৯০-৯৩)। কাফেররা মানুষ রাসূল চায়নি, ফেরেশতা রাসূল চেয়েছিল। যার প্রতিবাদে এক আয়াত পরেই আল্লাহ বলেন,قُلْ لَوْ كَانَ فِي الْأَرْضِ مَلَائِكَةٌ يَمْشُونَ مُطْمَئِنِّينَ لَنَزَّلْنَا عَلَيْهِمْ مِنَ السَّمَاءِ مَلَكًا رَسُولاً ‘যদি ফেরেশতারা যমীনে স্বচ্ছন্দে পদচারণা করতে পারত, তাহ’লে আমরা তাদের জন্য ফেরেশতা রাসূল পাঠাতাম’ (ইসরা ১৭/৯৫)।

মুসলমানদের মধ্যে যারা রাসূল (সাঃ)-কে ‘নূরের নবী’ বলেন, তারা কি কাফেরদের ‘ফেরেশতা রাসূল’ দাবীর সাথে সুর মিলাচ্ছেন না? অতএব আল্লাহ নিরাকার। তিনি সর্বত্র বিরাজমান। প্রত্যেক সৃষ্টিই আল্লাহর অংশ। রাসূল (সাঃ) মানুষ নবী নন, তিনি নূরের নবী ইত্যাদি নষ্ট আক্বীদা থেকে প্রথমেই তওবা করা আবশ্যক।

ইবনু কাছীর বলেন, কুরায়েশ নেতারা রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে এগুলি দাবী করেছিল। যদি আল্লাহ এর মধ্যে তাদের কোন কল্যাণ আছে বলে জানতেন, তাহলে অবশ্যই তা কবুল করতেন। কিন্তু তিনি ভালভাবেই অবহিত ছিলেন যে, তারা এসব প্রশ্ন করছে স্রেফ কুফরী ও হঠকারিতা বশে। সেকারণ তিনি তা কবুল করেননি (ইবনু কাছীর, তাফসীর উক্ত আয়াত)।


ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, কুরায়েশরা রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে দাবী করল যে, আপনি আপনার প্রতিপালকের নিকটে দো‘আ করুন। যেন তিনি ছাফা পাহাড়কে আমাদের জন্য স্বর্ণ বানিয়ে দেন। তাহ’লে আমরা ঈমান আনব। রাসূল (সাঃ) তাদের দাবী মোতাবেক দো‘আ করলেন। অতঃপর জিব্রীল (আঃ) রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে এসে তাঁর প্রতি আল্লাহ তা‘আলার সালাম পৌঁছে দিয়ে বললেন, আল্লাহ বলেছেন, ‘আপনি চাইলে আমি তাদের জন্য ছাফা পাহাড়কে স্বর্ণে রূপান্তরিত করব। কিন্তু এরপর যারা কুফরী করবে, তাদেরকে আমি এমন শাস্তির সম্মুখীন করব, যা আমি পৃথিবীর অন্য কাউকে দেইনি। আর যদি তুমি চাও তবে আমি তওবা ও রহমতের দুয়ার খুলে দিব। তখন রাসূল (সাঃ) তওবা ও রহমতই কামনা করলেন। অতঃপর আল্লাহ নাযিল করলেন,وَمَا مَنَعَنَا أَنْ نُرْسِلَ بِالْآيَاتِ إِلاَّ أَنْ كَذَّبَ بِهَا الْأَوَّلُونَ وَآتَيْنَا ثَمُودَ النَّاقَةَ مُبْصِرَةً فَظَلَمُوا بِهَا وَمَا نُرْسِلُ بِالْآيَاتِ إِلاَّ تَخْوِيفًا ‘পূর্ববর্তী উম্মতসমূহ কর্তৃক নিদর্শন সমূহকে অস্বীকার করাই আমাদেরকে (তোমাদের প্রতি) নিদর্শন প্রেরণ করা হ’তে বিরত রেখেছে। আমরা ছামূদ কওমের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন স্বরূপ উষ্ট্রী পাঠিয়েছিলাম। অতঃপর তারা তার প্রতি অত্যাচার করেছিল (অর্থাৎ হত্যা করেছিল)। আর আমরা কেবল ভয় প্রদর্শনের জন্যেই নিদর্শন সমূহ প্রেরণ করে থাকি’ (ইসরা ১৭/৫৯)।[2]


[1]. ইবনু জারীর, ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা বাক্বারাহ ১০৮; কুরতুবী হা/৪০৭৯, সনদ যঈফ; ইবনু হিশাম ১/২৯৫-২৯৮।

[2]. আহমাদ হা/২১৬৬; হাকেম হা/৩৩৭৯; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৩৮৮।


১০. দুনিয়াবী স্বার্থ লাভের দাবী পেশ (تقديم الدعاوى لنيل الغرض الدنيوي)


এক সময় তারা তিনটি দাবী নিয়ে উপস্থিত হয়।

(ক) যদি তুমি সত্যই নবী হয়ে থাক, তাহ’লে সারা পৃথিবীর ধন-ভান্ডার আমাদের কাছে এনে দাও।

(খ) আমাদের ভবিষ্যৎ ভাল-মন্দের বিষয়গুলি বলে দাও। যাতে আমরা আগেভাগে সাবধান হ’তে পারি।

(গ) তুমি একজন ফেরেশতাকে নবী হিসাবে এনে দাও, আমরা তাকে নেতা রূপে মেনে নেব। কেননা তুমি তো আমাদেরই মত একজন মানুষ মাত্র। জবাবে আল্লাহ নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করেন,


قُل لآ أَقُولُ لَكُمْ عِنْدِيْ خَزَآئِنُ اللهِ وَلا أَعْلَمُ الْغَيْبَ وَلا أَقُولُ لَكُمْ إِنِّي مَلَكٌ إِنْ أَتَّبِعُ إِلاَّ مَا يُوحَى إِلَيَّ قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الأَعْمَى وَالْبَصِيرُ أَفَلاَ تَتَفَكَّرُونَ- (الأنعام 50)


‘তুমি বলে দাও, আমি তোমাদের একথা বলিনা যে, আমার কাছে আল্লাহর ধন-ভান্ডার সমূহ রয়েছে। আর আমি অদৃশ্য বিষয় অবগত নই। আমি একথাও বলি না যে, আমি ফেরেশতা। আমি তো কেবল তারই অনুসরণ করি, যা আমার নিকটে ‘অহি’ করা হয়। তুমি বল, অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি কখনো সমান হয়? তোমরা কি চিন্তা করবে না? (আন‘আম ৬/৫০)।


১১. বিভিন্ন অপযুক্তি প্রদর্শন (إظهار الحجج الغير المعقولة)

যেমন- (ক) আল্লাহ প্রেরিত রাসূল হ’লে উনি কখনো মানুষের মত খাওয়া-দাওয়া ও বাজার-ঘাট করতেন না। আল্লাহ বলেন,وَقَالُوا مَالِ هَذَا الرَّسُوْلِ يَأْكُلُ الطَّعَامَ وَيَمْشِي فِي الْأَسْوَاقِ لَوْلاَ أُنزِلَ إِلَيْهِ مَلَكٌ فَيَكُونَ مَعَهُ نَذِيراً ‘তারা বলে, এ কেমন রাসূল যে খাদ্য ভক্ষণ করে ও হাট-বাজারে চলাফেরা করে? কেন তার নিকটে ফেরেশতা নাযিল হ’ল না যে তার সাথে সর্বদা সতর্ককারী হিসাবে থাকত’ (ফুরক্বান ২৫/৭)।[1] জবাবে আল্লাহ বলেন,وَلَوْ جَعَلْنَاهُ مَلَكاً لَّجَعَلْنَاهُ رَجُلاً وَلَلَبَسْنَا عَلَيْهِم مَّا يَلْبِسُونَ ‘যদি আমরা কোন ফেরেশতাকে রাসূল করে পাঠাতাম, তবে সে মানুষের আকারেই হ’ত এবং তাকে ঐ ধরনের পোষাক পরাতাম, যা তারা পরিধান করে’ (আন‘আম ৬/৯)। তিনি বলেন,اُنْظُرْ كَيْفَ ضَرَبُوْا لَكَ الْأَمْثَالَ فَضَلُّوْا فَلاَ يَسْتَطِيْعُوْنَ سَبِيْلاً ‘দেখ ওরা কিভাবে তোমার নামে (বাজে) উপমা সমূহ প্রদান করছে। ওরা পথভ্রষ্ট হয়েছে। অতএব ওরা আর পথ পেতে সক্ষম হবে না’ (ইসরা/বনু ইস্রাঈল ১৭/৪৮; ফুরক্বান ২৫/৯)।


(খ) তারা বলল, যদি নিতান্তই কোন মানুষকে নবী করার ইচ্ছা ছিল, তাহ’লে মক্কা ও ত্বায়েফের বিত্তবান প্রভাবশালী কোন নেতাকে কেন নবী করা হ’ল না? যেমন আল্লাহ বলেন,وَقَالُوْا لَوْلاَ نُزِّلَ هَذَا الْقُرْآنُ عَلَى رَجُلٍ مِّنَ الْقَرْيَتَيْنِ عَظِيْمٍ ‘তারা বলে, কুরআন কেন দুই জনপদের কোন প্রধান ব্যক্তির উপরে অবতীর্ণ হ’ল না? (যুখরুফ ৪৩/৩১)। জবাবে আল্লাহ বলেন,أَهُمْ يَقْسِمُوْنَ رَحْمَةَ رَبِّكَ ‘তারা কি তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ বণ্টন করবে? (যুখরুফ ৪৩/৩২)। অর্থাৎ আল্লাহ কাকে অনুগ্রহ করে নবুঅত দান করবেন এটা কেবল তাঁরই এখতিয়ার। এতে অন্যদের কিছুই করার নেই।


(গ) কোন যুক্তিতে কাজ না হওয়ায় অবশেষে তারা অজুহাত দিল, যদি আল্লাহ চাইতেন, তাহ’লে আমরা শিরক করতাম না। যেমন আল্লাহ বলেন,


سَيَقُوْلُ الَّذِيْنَ أَشْرَكُواْ لَوْ شَآء اللهُ مَا أَشْرَكْنَا وَلاَ آبَاؤُنَا وَلاَ حَرَّمْنَا مِن شَيْءٍ كَذَلِكَ كَذَّبَ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِم حَتَّى ذَاقُوا بَأْسَنَا قُلْ هَلْ عِندَكُم مِّنْ عِلْمٍ فَتُخْرِجُوهُ لَنَا إِن تَتَّبِعُونَ إِلاَّ الظَّنَّ وَإِنْ أَنتُمْ إَلاَّ تَخْرُصُوْنَ- (الأنعام ১৪৮)-


‘সত্বর মুশরিকরা বলবে, যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তাহ’লে না আমরা শিরক করতাম, না আমাদের বাপ-দাদারা। আর না আমরা কোন বস্ত্তকে হারাম করতাম। বস্ত্ততঃ এভাবেই তাদের পূর্ব যুগের কাফিররা (রাসূলদের) মিথ্যা সাব্যস্ত করেছিল। অবশেষে তারা আমাদের শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করেছিল। তুমি বল, তোমাদের কাছে কি কোন প্রমাণ আছে, যা আমাদের দেখাতে পার? তোমরা কেবল ধারণার অনুসরণ কর এবং কেবল অনুমান ভিত্তিক কথা বলে থাক’ (আন‘আম ৬/১৪৮)। বস্ত্ততঃ এ আয়াতটিই হ’ল অদৃষ্টবাদী ভ্রান্ত ফের্কা জাবরিয়াদের প্রধান দলীল। অথচ বান্দা শিরক ও কুফরীতে লিপ্ত হউক, এটা কখনোই আল্লাহ চান না। যেমন তিনি বলেন,وَلاَ يَرْضَى لِعَبِادِهِ الْكُفْرَ ‘তিনি তার বান্দাদের কুফরীতে সন্তুষ্ট হন না’ (যুমার ৩৯/৭)।


[1]. কাফের নেতাদের ধন্যবাদ দিতে হয় যে, তাদের মাথায় রাসূল (সাঃ)-কে ‘নূর’ বলার যুক্তিটির উদয় হয়নি। কেননা ‘নূর’ হ’লে তার খাওয়া-পরা ও বাজার-ঘাট কিছুই লাগে না। যেমন একদল পীর ও মুফতী তাঁকে ‘নূর’ বানিয়েছেন এবং ‘তিনি মরেননি’ বলে প্রচার করেন। সেই সাথে ‘আওলিয়ারা মরেন না’ বলে চুটিয়ে কবরপূজার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এভাবে স্বাধীন মানুষকে তারা মৃত মানুষের গোলামে পরিণত করেছেন। আর ভক্তদের পকেট ছাফ করছেন।


শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ -৭ (العبر -৭)


(১) স্বার্থান্ধ ব্যক্তি ও সমাজনেতারা সত্যকে চিনতে পেরেও তাকে মেনে নিতে পারে না।

(২) সত্যকে গলা টিপে হত্যা করার জন্য হেন অপকৌশল নেই, যা তারা অবলম্বন করে না।


রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপর নানামুখী অত্যাচার - ১. ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা (الاسةهزاء والسخرية)

সমস্ত যুক্তি, কৌশল ও আপোষ প্রস্তাব ব্যর্থ হওয়ার পর কুরায়েশ নেতারা এবার রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপরে সরাসরি অত্যাচারের সিদ্ধান্ত নিল। যেমন-

রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দিক থেকে লোকদের ফিরিয়ে আনার জন্য কুরায়েশ নেতারা বিদ্রুপ করে বলে, আমরাও এরূপ বলতে পারি। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন,وَإِذَا تُتْلَى عَلَيْهِمْ آيَاتُنَا قَالُوْا قَدْ سَمِعْنَا لَوْ نَشَاءُ لَقُلْنَا مِثْلَ هَـذَا إِنْ هَـذَا إِلاَّ أَسَاطِيْرُ الْأَوَّلِيْنَ ‘যখন তাদের নিকটে আমাদের আয়াত সমূহ পাঠ করা হয়, তখন তারা বলে, আমরা শুনেছি। ইচ্ছা করলে আমরাও এরূপ বলতে পারি। এসব তো পূর্ববর্তীদের উপকথা ভিন্ন কিছুই নয়’ (আনফাল ৮/৩১)।


উক্ত আয়াতে কাফেররা ‘কুরআনকে পুরাকালের কাহিনী এবং ইচ্ছা করলে আমরাও এরূপ বলতে পারি’ বলে দম্ভ প্রকাশ করেছে। অথচ অনুরূপ একটি কুরআন বা তার মত দু’একটি সূরা বা আয়াত জিন-ইনসান সকলকে একত্রিত হয়ে রচনা করে আনার জন্য মক্কায় পাঁচবার[1] এবং মদীনায় একবার (বাক্বারাহ ২/২৩-২৪) সহ মোট ছয়বার কাফেরদের চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। কিন্তু সে যুগে ও এ যুগে কেউ সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেনি। বরং দেখা গেছে যে, সে যুগে ঐসব নেতারাই গোপনে রাতের অন্ধকারে বাইরে দাঁড়িয়ে তাহাজ্জুদের ছালাতে রাসূল (সাঃ)-এর কুরআন তেলাওয়াত শুনত। আবু সুফিয়ান, নযর বিন হারেছ, আখনাস বিন শারীক্ব, আবু জাহল প্রমুখ নেতারা একে অপরকে না জানিয়ে গোপনে একাজ করত’ (ইবনু হিশাম ১/৩১৫-১৬)। কিন্তু যখন তারা তাদের জনগণের সামনে যেত, তখন তাদের মন্তব্য পাল্টে যেত। কারণ তখন দুনিয়াবী স্বার্থ তাদেরকে সত্যভাষণ থেকে ফিরিয়ে রাখত। একই অবস্থা আজকালকের মুসলিম-অমুসলিম নেতাদের। যাদের অধিকাংশ রাসূল (সাঃ) ও কুরআনের সত্যতাকে স্বীকার করে। কিন্তু বাস্তবে তা মানতে রাযী হয় না স্রেফ দুনিয়াবী স্বার্থের কারণে।


এভাবে কাফেররা তাঁকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগ পর্যন্ত নানারূপ মানসিক কষ্ট দেয়। এ সময় আল্লাহ তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন,وَاصْبِرْ عَلَى مَا يَقُوْلُوْنَ وَاهْجُرْهُمْ هَجْرًا جَمِيْلاً ‘তারা যেসব কথা বলে, তাতে তুমি ছবর কর এবং তাদেরকে সুন্দরভাবে পরিহার করে চল’ (মুযযাম্মিল ৭৩/১০)। তিনি আরও বলেন,إِنَّا كَفَيْنَاكَ الْمُسْتَهْزِئِيْنَ ‘বিদ্রূপকারীদের বিরুদ্ধে আমরাই তোমার জন্য যথেষ্ট’ (হিজর ১৫/৯৫)।

[1]. ইউনুস ১০/৩৮; হূদ ১১/১৩; ইসরা ১৭/৮৮; ক্বাছাছ ২৮/৪৯, তুর ৫২/৩৪।


২. প্রতিবেশীদের অত্যাচার (اضطهاد الجيران)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকটতম প্রতিবেশী ছিলেন তাঁর চাচা আবু লাহাব। তিনি ও তার স্ত্রী ছাড়াও কষ্টদানকারী অন্যান্য প্রতিবেশী ছিল হাকাম বিন আবুল ‘আছ বিন উমাইয়া, উক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব, ‘আদী বিন হামরা ছাক্বাফী, ইবনুল আছদা আল-হুযালী। প্রতিবেশীদের মধ্যে কেবল হাকাম বিন আবুল ‘আছ বিন উমাইয়া ইসলাম কবুল করেছিলেন (ইবনু হিশাম ১/৪১৫-১৬)। ইনিই ছিলেন উমাইয়া বংশের অন্যতম খলীফা মারওয়ানের পিতা। বস্ত্ততঃ মু‘আবিয়া (রাঃ) ও ইয়াযীদ বাদে মারওয়ানের বংশধরগণই ছিলেন উমাইয়া খেলাফতের পরপর খলীফা। অন্যান্য প্রতিবেশীরাও রাসূল (সাঃ)-এর উপর নানাবিধ অত্যাচার চালায়। তাতে সান্ত্বনা দিয়ে আল্লাহ বলেন,وَلَقَدْ كُذِّبَتْ رُسُلٌ مِنْ قَبْلِكَ فَصَبَرُوا عَلَى مَا كُذِّبُوا وَأُوْذُوا حَتَّى أَتَاهُمْ نَصْرُنَا وَلاَ مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِ اللهِ وَلَقَدْ جَاءَكَ مِنْ نَبَإِ الْمُرْسَلِيْنَ ‘তোমার পূর্বের বহু রাসূলকে মিথ্যা বলা হয়েছে। কিন্তু এ মিথ্যারোপে তারা ছবর করেছেন এবং তারা নির্যাতিত হয়েছেন যতক্ষণ না তাদের কাছে আমাদের সাহায্য এসে পৌঁছেছে। আর আল্লাহর বাণীসমূহের পরিবর্তনকারী কেউ নেই। এ বিষয়ে নবীগণের কিছু খবর তোমার নিকটে পৌঁছে গেছে (যার মধ্যে তোমার জন্য অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে)’ (আন‘আম ৬/৩৪)।[1]


[1]. প্রসিদ্ধ আছে যে, প্রতিবেশীরা যবেহ করা দুম্বা-ভেড়ার নাড়ি-ভুঁড়ি রাসূল (সাঃ)-এর বাড়ীর মধ্যে ছুঁড়ে মারত। রাসূল (সাঃ) সেগুলি কুড়িয়ে নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে ডাক দিয়ে বলতেন يَا بَنِي عَبْدِ مَنَافٍ، أَيُّ جِوَارٍ هَذَا؟ ‘হে বনু ‘আব্দে মানাফ! এটা কেমন প্রতিবেশী সূলভ আচরণ? এরপর তিনি সেগুলি দূরে ফেলে আসতেন’ (ইবনু হিশাম ১/৪১৬; আর-রাহীক্ব পৃঃ ৮৭)। বর্ণনাটি মওযূ‘ বা জাল (সিলসিলা যঈফাহ হা/৪১৫১)।


৩. কা‘বাগৃহে ছালাতরত অবস্থায় কষ্টদান (ايذاء النبى صــ فى الصلاة عند الكعبة)

(ক) আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন যে, একদিন রাসূল (সাঃ) বায়তুল্লাহ্র পাশে ছালাত আদায় করছিলেন। এমন সময় আবু জাহল ও তার সাথীরা অদূরে বসে বলাবলি করতে লাগল, কে উটের নাড়ি-ভুঁড়ি এনে এই ব্যক্তির উপর চাপাতে পারে, যখন সে সিজদায় যাবে? তখন ওক্ববা বিন আবী মু‘আইত্ব উটের ভুঁড়ি এনে সিজদারত রাসূলের দুই কাঁধের মাঝখানে চাপিয়ে দিল, যাতে ঐ বিরাট ভুঁড়ির চাপে ও দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান। এতে শত্রুরা হেসে লুটোপুটি খেয়ে একে অপরের উপর গড়িয়ে পড়তে থাকে। ইবনু মাসঊদ বলেন, আমি সব দেখছিলাম। কিন্তু এই অবস্থায় আমার কিছুই করার ছিল না। এই সময় ফাতেমার কাছে খবর পৌঁছলে তিনি দৌঁড়ে এসে ভুঁড়িটি সরিয়ে দিয়ে পিতাকে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেন। ইবনু হাজার বলেন, সম্ভবতঃ খবরটি রাবী নিজেই দিয়েছিলেন (বুখারী ফৎহসহ হা/৫২০-এর আলোচনা)। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মাথা উঁচু করে তিনবার বলেন,

اللهُمَّ عَلَيْكَ بِقُرَيْشٍ، اللهُمَّ عَلَيْكَ بِقُرَيْشٍ، اللهُمَّ عَلَيْكَ بِقُرَيْشٍ- ثُمَّ سَمَّى- اللهُمَّ عَلَيْكَ بِعَمْرِو بْنِ هِشَامٍ، وَعُتْبَةَ بْنِ رَبِيعَةَ، وَشَيْبَةَ بْنِ رَبِيعَةَ، وَالْوَلِيدِ بْنِ عُتْبَةَ، وَأُمَيَّةَ بْنِ خَلَفٍ، وَعُقْبَةَ بْنِ أَبِى مُعَيْطٍ، وَعُمَارَةَ بْنِ الْوَلِيدِ، قَالَ عَبْدُ اللهِ فَوَاللهِ لَقَدْ رَأَيْتُهُمْ صَرْعَى يَوْمَ بَدْرٍ، ثُمَّ سُحِبُوا إِلَى الْقَلِيبِ قَلِيبِ بَدْرٍ- متفق عليه-

‘হে আল্লাহ তুমি কুরায়েশকে ধর (তিনবার)! হে আল্লাহ তুমি আমর ইবনে হেশাম (আবু জাহল)-কে ধর। হে আল্লাহ তুমি উৎবা ও শায়বাহ বিন রাবী‘আহ, অলীদ বিন উৎবা, উমাইয়া বিন খালাফ, ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব এবং উমারাহ বিন অলীদকে ধর’। ইবনু মাস‘ঊদ বলেন, আমি তাদের (উক্ত ৭ জনের) সবাইকে বদর যুদ্ধে নিহত হয়ে কূয়ায় নিক্ষিপ্ত অবস্থায় দেখেছি’।[1] উটের ভুঁড়ি চাপানোর এই নির্দেশ আবু জাহলই দিয়েছিলেন এবং অন্যেরা তা মেনে নিয়েছিল। সেমতে তার আগের দিন উটসমূহ নহর করা হয়েছিল।[2]


এর দ্বারা বুঝা যায় যে, নেককার ব্যক্তির দো‘আ বা বদ দো‘আ অবশ্যই আল্লাহর নিকটে কবুল হয়। তার বাস্তবায়ন সঙ্গে সঙ্গে হ’তে পারে অথবা আল্লাহ তার থেকে অনুরূপ একটি কষ্ট দূর করে দেন অথবা সেটি আখেরাতে প্রদানের জন্য রেখে দেন’ (আহমাদ হা/১১১৪৯)। কিন্তু আখেরাতের জন্য রেখে দেওয়ার কারণে বদকারগণ ঐ বদ দো‘আর কোন গুরুত্ব দেয় না। বরং পুনরায় কঠিনভাবে শত্রুতা করতে থাকে। যেমন আবু জাহ্ল গং রাসূল (সাঃ)-এর বদ দো‘আ শুনে ঘাবড়ে গেলেও পরক্ষণে তা ভুলে যায় এবং বিপুল উৎসাহে শত্রুতা করতে থাকে। ফলে এই ঘটনার প্রায় দশ বছর পর বদর যুদ্ধে তাদের উপরে উক্ত বদ দো‘আর বাস্তবায়ন ঘটে ও সব নেতা একত্রে নিহত হয়। আর বদর যুদ্ধের পর এক সপ্তাহের মধ্যে আরেক নেতা আবু লাহাব গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে পচে-গলে দুর্গন্ধযুক্ত অবস্থায় মক্কায় নিজ গৃহে মারা যায়। এভাবে মযলূম নবী বিজয়ী হন ও যালেম নেতারা ধ্বংস হয়।


উল্লেখ্য যে, রাবী আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) উক্ত হাদীছে বর্ণিত মুশরিক নেতাদের সবাইকে বদরের যুদ্ধে নিহত হয়ে কূয়ায় নিক্ষিপ্ত হ’তে দেখেছেন’ বলে যে কথা বর্ণনায় এসেছে, তার অর্থ হ’ল তিনি এদের ‘অধিকাংশ’কে দেখেছেন। কেননা ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব বদরে যুদ্ধাবস্থায় নিহত হননি। বরং তাকে বন্দী করে মদীনায় নিয়ে যাওয়ার পথে হত্যা করে ফেলে দেওয়া হয়। উমাইয়া বিন খালাফ বদরে নিহত হ’লেও উক্ত কূয়ায় নিক্ষিপ্ত হননি। বরং অধিক স্থূলদেহী হওয়ায় ও ফুলে যাওয়ার কারণে কূয়ায় ফেলা সম্ভব হয়নি। ফলে তাকে কূয়ার অদূরে একটি গর্তে ফেলে মাটি ও পাথর চাপা দেওয়া হয়।[3] অতঃপর ‘উমারাহ বিন অলীদ বিন মুগীরাহ মাখযূমী, যাকে কুরায়েশরা দূত হিসাবে বাদশাহ নাজাশীর দরবারে পাঠিয়েছিল। সেখানে গিয়ে সে জাদুর ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে। অতঃপর হাবশার জঙ্গলে কাফের অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ঘটনাটি খুবই প্রসিদ্ধ। তখন ছিল দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতকাল।[4]


(খ) একদিন ছালাতরত অবস্থায় ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব এসে গলায় জোরে কাপড় পেঁচিয়ে ধরল, যাতে রাসূল (সাঃ) নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যান। জনৈক ব্যক্তি চিৎকার করে গিয়ে এ খবর দিলে আবুবকর (রাঃ) ছুটে এসে পেঁচানো কাপড় খুলে দিলেন ও বদমায়েশগুলিকে ধিক্কার দিয়ে বললেন,أَتَقْتُلُونَ رَجُلاً أَنْ يَقُولَ رَبِّىَ اللهُ؟ وَقَدْ جَاءَكُمْ بِالْبَيِّنَاتِ مِنْ رَبِّكُمْ ‘তোমরা কি এমন একজন মানুষকে হত্যা করছ, যিনি বলেন আমার প্রভু আল্লাহ। অথচ তিনি তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণাদি সহ তোমাদের কাছে আগমন করেছেন?’ এ সময় তারা রাসূল (সাঃ)-কে ছেড়ে আবুবকরকে বেদম প্রহার করে’ (বুখারী, হা/৬৩৭৮, ৪৮১৫)।


ওরওয়া বিন যুবায়ের বলেন, আমি আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, মুশরিকরা রাসূল (সাঃ)-এর সাথে সবচাইতে কষ্টদায়ক আচরণ কোনটি করেছিল, আমাকে বলুন। তখন তিনি ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্বের অত্র ঘটনাটি বর্ণনা করেন’ (বুখারী হা/৩৮৫৬)।


রাসূল (সাঃ)-এর জীবনের অত্র ঘটনায় তার প্রিয় আবুবকরের উপরোক্ত বক্তব্য অন্যূন দু’হাযার বছর পূর্বে মূসা (আঃ)-কে হত্যার পরিকল্পনাকারীদের সম্মুখে তাঁর জনৈক গোপন ভক্ত যে কথা বলেছিলেন, তার কুরআনী বর্ণনার সাথে শব্দে শব্দে মিলে যায়। যেমন আল্লাহ বলেন,


وَقَالَ رَجُلٌ مُّؤْمِنٌ مِّنْ آلِ فِرْعَوْنَ يَكْتُمُ إِيْمَانَهُ أَتَقْتُلُوْنَ رَجُلاً أَنْ يَّقُوْلَ رَبِّيَ اللهُ وَقَدْ جَاءَكُمْ بِالْبَيِّنَاتِ مِنْ رَّبِّكُمْ- (مؤمن ২৮)-


‘ফেরাঊন গোত্রের জনৈক মুমিন ব্যক্তি, যে তার ঈমান গোপন রাখত, লোকদের বলল, তোমরা কি এমন একজন মানুষকে হত্যা করবে, যিনি বলেন, আমার পালনকর্তা আল্লাহ এবং তিনি তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণাদি সহ তোমাদের কাছে আগমন করেছেন?’ (গাফের/মুমিন ৪০/২৮)।


আবুবকর (রাঃ)-এর উক্ত ঘটনা স্মরণ করে একদিন হযরত আলী (রাঃ) লোকদের বলেন, বল তো সবচেয়ে বড় বীর কে? তারা বলল, আপনি। তিনি বললেন, না। বরং আবুবকর। আমি দেখেছি কুরায়েশরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে কাপড় ধরে টানাটানি করছে ও গালি দিয়ে বলছে, তুমি আমাদেরকে বহু উপাস্য ছেড়ে এক উপাস্য গ্রহণ করতে বলে থাক’। সেই কঠিন সময়ে কেউ এগিয়ে যায়নি আবুবকর ছাড়া। তিনি একে ধরেন ওকে ঠেলেন, আর বলতে থাকেন, তোমাদের ধ্বংস হৌক। তোমরা কি এমন একজন মানুষকে হত্যা করবে যিনি বলেন, আমার প্রতিপালক আল্লাহ? অতঃপর আলী (রাঃ) কাঁদতে থাকেন। অতঃপর বলেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি, তোমরা বল ফেরাঊন কওমের ঈমান গোপনকারী মুমিন ব্যক্তি উত্তম না আবুবকর? লোকেরা চুপ থাকল। তখন তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! ঐ সময়ের ঘটনায় আবুবকর উত্তম। কেননা ফেরাঊন কওমের মুমিন ঈমান গোপন করেছিল। কিন্তু আবুবকর তার ঈমান প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন’।[5]


[1]. বুখারী হা/৫২০; মুসলিম হা/১৭৯৪; মিশকাত হা/৫৮৪৭; ‘রাসূল (সাঃ)-এর আবির্ভাব ও অহি-র সূচনা’ অনুচ্ছেদ।

[2]. মুসলিম হা/১৭৯৪; বুখারী ফৎহসহ হা/২৪০, ১/৪১৭ পৃঃ; মা শা-‘আ ৫০ পৃঃ।

[3]. বুখারী ফৎহসহ হা/৩৯৮১-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।

[4]. বুখারী ফৎহসহ হা/২৪০-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য; আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৬৮৩৩।

[5]. মুসনাদে বাযযার হা/৭৬১। ইবনু হাজার এটিকে বুখারী হা/৩৮৫৬-এর ‘সমর্থক’ (شاهد) হিসাবে এনেছেন। হায়ছামী বলেন, এর সনদে একজন রাবী আছেন, যাকে আমি চিনি না (মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৪৩৩৩)।


৪. সম্মুখে ও পশ্চাতে নিন্দা করা ও অভিশাপ দেওয়া (الهمز واللمز واللعن)

এ ব্যাপারে অন্যতম প্রতিবেশী উমাইয়া বিন খালাফ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি পশ্চাতে সর্বদা নিন্দা করতেন। তাছাড়া রাসূল (সাঃ)-কে দেখলেই তাঁর সামনে গিয়ে যাচ্ছে-তাই বলে নিন্দা ও ভৎর্সনা করতেন এবং তাঁকে অভিশাপ দিতেন। এ প্রসঙ্গেই নাযিল হয়,وَيْلٌ لِّكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةٍ ‘দুর্ভোগ প্রত্যেক সম্মুখে নিন্দাকারী ও পশ্চাতে নিন্দাকারীর জন্য’ (হুমাযাহ ১০৪/১)।[1]


[1]. ইবনু হিশাম ১/৩৫৬; কেউ অন্য নেতাদের নামও বলেছেন। সনদ ‘মুরসাল’ (তাফসীর কুরতুবী, তাহকীক উক্ত আয়াত)।


৫. রাসূল (সাঃ)-এর মুখে থুথু নিক্ষেপ করা (القاء البصاق على فم النبى صــ)


(ক) উমাইয়া বিন খালাফের ভাই উবাই বিন খালাফ ছিল আরেক দুরাচার। সে যখন শুনতে পেল যে, তার সাথী ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব রাসূল (সাঃ)-এর কাছে বসে কিছু আল্লাহর বাণী শুনেছে, তখন ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে ওক্ববাকে বাধ্য করল যাতে সে তৎক্ষণাৎ গিয়ে রাসূল (সাঃ)-এর মুখে থুথু নিক্ষেপ করে আসে। ওক্ববা তাই-ই করল’। এ প্রসঙ্গে নাযিল হয়,وَيَوْمَ يَعَضُّ الظَّالِمُ عَلَى يَدَيْهِ يَقُولُ يَا لَيْتَنِي اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُولِ سَبِيلاً (27) يَا وَيْلَتَى لَيْتَنِي لَمْ أَتَّخِذْ فُلاَنًا خَلِيلاً (28) لَقَدْ أَضَلَّنِي عَنِ الذِّكْرِ بَعْدَ إِذْ جَاءَنِي وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِلْإِنْسَانِ خَذُولاً- (الفرقان 27-29) ‘যালেম সেদিন নিজের দু’হাত কামড়ে বলবে, হায়! যদি (দুনিয়াতে) রাসূলের পথ অবলম্বন করতাম’। ‘হায় দুর্ভোগ আমার! যদি আমি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম’। ‘আমার কাছে উপদেশ (কুরআন) আসার পর সে আমাকে পথভ্রষ্ট করেছিল। বস্ত্ততঃ শয়তান মানুষের জন্য পথভ্রষ্টকারী’ (ফুরক্বান ২৫/২৭-২৯)।[1]


(খ) অনুরূপ এক ঘটনায় একদিন আবু লাহাবের পুত্র উতাইবা বিন আবু লাহাব এসে রাসূল (সাঃ)-কে বলল, আমি সূরা নাজমের ১ ও ৮ আয়াত(وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَى...ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى) দু’টিকে অস্বীকার করি, বলেই সে হেঁচকা টানে রাসূল (সাঃ)-এর গায়ের জামা ছিঁড়ে ফেলল এবং তাঁর মুখে থুথু নিক্ষেপ করল। অথচ এই হতভাগা ছিল রাসূল (সাঃ)-এর জামাতা। যে তার পিতার কথা মত রাসূল (সাঃ)-এর কন্যা উম্মে কুলছূমকে তালাক দেয়। তার ভাই উৎবা একইভাবে রাসূল (সাঃ)-এর অপর কন্যা রুক্বাইয়াকে তালাক দেয়। পরে যার বিয়ে হযরত ওছমান (রাঃ)-এর সাথে হয়। তাঁর মৃত্যুর পরে উম্মে কুলছূমের সাথে ওছমান (রাঃ)-এর বিবাহ হয়। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তখন তাকে বদ দো‘আ করে বললেন,اللهُمَّ سَلِّطْ عَلَيْهِ كَلْبًا مِنْ كِلاَبِكَ ‘হে আল্লাহ! তুমি এর উপরে তোমার কোন একটি কুকুরকে বিজয়ী করে দাও’।[2]


উক্ত ঘটনা সম্পর্কে কবি হাসসান বিন ছাবিত (রাঃ) কবিতা রচনা করেন। কিছুদিন পরে উতাইবা সিরিয়ায় ব্যবসায়িক সফরে গেলে সেখানে যারক্বা (الزرقاء) নামক স্থানে রাত্রি যাপন করে। এমন সময় হঠাৎ একটা বাঘকে সে তাদের চারপাশে ঘুরতে দেখে ভয়ে বলে উঠে,هَذَا وَاللهِ آكِلِي كَمَا قَالَ مُحَمَّدٌ، قَاتِلِي ابْنُ أَبِي كَبْشَةَ وَهُوَ بِمَكَّةَ وَأَنَا بِالشَّامِ ‘আল্লাহর কসম! এ আমাকে খেয়ে ফেলবে। এভাবেই তো মুহাম্মাদ আমার বিরুদ্ধে বদ দো‘আ করেছিল। সে আমাকে হত্যাকারী। অথচ সে মক্কায় আর আমি শামে’। অতঃপর বাঘ এসে সবার মধ্য থেকে তাকে ধরে নিয়ে ঘাড় মটকে হত্যা করল’।[3]


[1]. মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/৯৭৩১; ইবনু হিশাম ১/৩৬১; তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক-৩৫২, আছার ছহীহ; আর-রাহীক্ব ৮৮ পৃঃ।

[2]. আর-রাহীক্ব পৃঃ ৯৮; হাকেম হা/৩৯৮৪, হাকেম ছহীহ বলেছেন, যাহাবী তা সমর্থন করেছেন।

[3]. কুরতুবী হা/৫৬৯০; আবু নু‘আইম ইছফাহানী, দালায়েলুন নবুঅত হা/৩৮১; মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/৯৮২০; কুরতুবীর মুহাক্কিক বলেন, হাদীছটি একদল তাবেঈ কর্তৃক ‘মুরসাল’ সূত্রে বর্ণিত। তবে এগুলির সমষ্টি বর্ণনাটিকে শক্তিশালী করে’ (দ্রঃ কুরতুবী, তাফসীর সূরা নাজম ১ আয়াত)।


৬. মুখে পচা হাড়ের গুঁড়া ছুঁড়ে মারা (نفخ العظم الرميم نحو الرسول صــ)

উবাই বিন খালাফ নিজে একবার পচা হাড্ডি চূর্ণ করে রাসূল (সাঃ)-এর কাছে গিয়ে বলল, হে মুহাম্মাদ! তুমি কি ধারণা কর যে, একটা মানুষ মরে পচে-গলে যাওয়ার পর পুনরায় জীবিত হবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন সে হাতে রাখা পচা হাড়ের গুঁড়া তাঁর মুখের উপরে ছুঁড়ে মারে’ (ইবনু হিশাম ১/৩৬১-৬২)। যেমন আল্লাহ বলেন,وَضَرَبَ لَنَا مَثَلاً وَنَسِيَ خَلْقَهُ قَالَ مَنْ يُحْيِ الْعِظَامَ وَهِيَ رَمِيمٌ؟ قُلْ يُحْيِيهَا الَّذِي أَنْشَأَهَا أَوَّلَ مَرَّةٍ وَهُوَ بِكُلِّ خَلْقٍ عَلِيمٌ ‘মানুষ আমাদের সম্পর্কে নানা উপমা দেয়। অথচ সে নিজের সৃষ্টির কথা ভুলে যায়। সে বলে, হাড়গুলিতে কে প্রাণ সঞ্চার করবে যখন ওটা পচে-গলে যাবে?’ ‘বলে দাও, ওগুলিকে জীবিত করবেন তিনি, যিনি প্রথমবার সেগুলিকে সৃষ্টি করেছেন। আর তিনি সকল বিষয়ে সুবিজ্ঞ’ (ইয়াসীন ৩৬/৭৮-৭৯)। এছাড়া এ প্রেক্ষিতে সূরা মারিয়াম ৬৬, ক্বাফ ৩ ও অন্যান্য আয়াত সমূহ নাযিল হয়। যদিও শানে নুযূল হিসাবে বর্ণিত ঘটনাসমূহের সনদ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘মুরসাল’। তবে এটা নিশ্চিত যে, বিভিন্ন প্রশ্ন ও ঘটনার প্রেক্ষিতেই কুরআনের অধিকাংশ আয়াত নাযিল হয়েছে, যাতে রাসূল (সাঃ)-এর অন্তরে প্রশান্তি আসে। যেমন আল্লাহ বলেন,وَقَالَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لَوْلاَ نُزِّلَ عَلَيْهِ الْقُرْآنُ جُمْلَةً وَاحِدَةً كَذَلِكَ لِنُثَبِّتَ بِهِ فُؤَادَكَ وَرَتَّلْنَاهُ تَرْتِيْلاً- وَلاَ يَأْتُوْنَكَ بِمَثَلٍ إِلاَّ جِئْنَاكَ بِالْحَقِّ وَأَحْسَنَ تَفْسِيْرًا ‘কাফেররা বলে যে, কেন কুরআন তাঁর প্রতি একসাথে নাযিল হল না? এমনিভাবেই আমরা এটি নাযিল করেছি এবং ক্রমে ক্রমে আবৃত্তি করেছি, যাতে আমরা তোমার অন্তরকে দৃঢ় করতে পারি’। ‘তারা তোমার নিকটে কোন সমস্যা উত্থাপন করলেই আমরা তার সঠিক জওয়াব ও সুন্দর ব্যাখ্যা দান করে থাকি’ (ফুরক্বান ২৫/৩২-৩৩)।


৭. তাঁর সামনে এসে মিথ্যা শপথ করা এবং পরে চোগলখুরী করা(الحلف الكاذب أمامه والنميمة خلفه)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে নির্যাতনকারীদের মধ্যে অন্যতম সেরা একজন ব্যক্তি ছিল, যে ছিল জারজ সন্তান। সে ভাল মানুষ সেজে রাসূল (সাঃ)-এর সামনে মিথ্যা শপথ করে কথা বলত এবং পরে লোকদের কাছে গিয়ে চোগলখুরী করত। ঐ নেতার নাম সম্বন্ধে মতভেদ আছে। কেউ বলেছেন, আখনাস বিন শারীক্ব ছাক্বাফী, কেউ বলেছেন, অলীদ বিন মুগীরাহ মাখযূমী ইত্যাদি (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)। তবে শেষোক্ত নামটিই অধিক প্রসিদ্ধ। সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব ও ইকরিমা বলেন, এই ব্যক্তি ছিল ব্যভিচারের সন্তান। সে কুরায়েশ বংশজাত ছিল না। ১৮ বছর পরে জনৈক ব্যক্তি তার পিতৃদাবী করে’ (কুরতুবী)। আল্লাহপাক তার নয়টি বদ স্বভাবের কথা বর্ণনা করেছেন। যেমন,

وَلاَ تُطِعْ كُلَّ حَلاَّفٍ مَّهِينٍ- هَمَّازٍ مَّشَّاءٍ بِنَمِيْمٍ- مَنَّاعٍ لِّلْخَيْرِ مُعْتَدٍ أَثِيْمٍ- عُتُلٍّ بَعْدَ ذَلِكَ زَنِيْمٍ- (القلم ১০-১৩)-

‘তুমি কথা শুনবে না ঐ ব্যক্তির, যে অধিক শপথকারী ও হীন স্বভাব বিশিষ্ট’। ‘যে সম্মুখে নিন্দা করে এবং একের কথা অন্যকে লাগিয়ে চোগলখুরী করে’। ‘সে ভালকাজে অধিক বাধাদানকারী, সীমালংঘনকারী ও পাপিষ্ঠ’। ‘রুক্ষ স্বভাবী এবং এরপরেও সে একজন জারজ সন্তান’ (ক্বলম ৬৮/১০-১৩)।

তার এই বাড়াবাড়ির কারণ ছিল তার অতুল বিত্ত-বৈভবের অহংকার। যেমন আল্লাহ বলেন,


أَنْ كَانَ ذَا مَالٍ وَّ بَنِيْنَ- إِذَا تُتْلَى عَلَيْهِ آيَاتُنَا قَالَ أَسَاطِيْرُ الْأَوَّلِيْنَ- سَنَسِمُهُ عَلَى الْخُرْطُوْمِ-


‘আর এটা এ কারণে যে, সে ছিল বহু মাল-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির মালিক’। ‘যখন তার সম্মুখে আমাদের আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন সে বলে, এসব পুরাকালের কাহিনী’। ‘সত্বর আমরা তার নাসিকা দাগিয়ে দেব’ (ক্বলম ৬৮/১৪-১৬)। হাতী বা শূকরের শুঁড়কে আরবীতে ‘খুরতূম’ বলা হয়। এখানে ঐ ব্যক্তির নাম সম্পর্কে এই বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে তার হীনতা ও নিকৃষ্টতা প্রকাশ করার জন্য। ক্বিয়ামতের দিন তার নাকে খৎ দিয়ে নাসিকা দাগিয়ে দিয়ে চিহ্নিত করা হবে এজন্য যে, অন্যের সামনে তার লাঞ্ছনা যেন পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে। দুনিয়াতে সে রাসূল (সাঃ)-এর দাওয়াত থেকে নাক সিঁটকিয়েছিল। ফলে ক্বিয়ামতের দিন তার বদলা হিসাবে তার নাসিকা দাগানো হবে। একাজ অন্যেরা করলেও তার পাপ ছিল বেশী। কেননা সে ছিল নেতা। তাই তাকে সেদিন সর্বসমক্ষে চিহ্নিত করা হবে। نعوذ بالله من غضبه وقهره


৮. রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সামনে বসে কুরআন শোনার পর তাঁকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে গর্বের সাথে বুক ফুলিয়ে চলে যাওয়া بعد استماع القرآن منه والذهاب مختالا فخورا)


এ কাজটা প্রায়ই আবু জাহ্ল করত, আর ভাবত আমি মুহাম্মাদকে ও তার কুরআনকে গালি দিয়ে একটা দারুণ কাজ করলাম। অথচ তার এই কুরআন শোনাটা ছিল কপটতা এবং লোককে একথা বুঝানো যে, আমার মত আরবের সেরা জ্ঞানী ব্যক্তির নিকটেই যখন কুরআনের কোন মূল্য নেই, তখন তোমরা কেন এর পিছনে ছুটবে? এ যুগের বামপন্থী ধর্মনিরপেক্ষ পন্ডিত ও জ্ঞানপাপী মুসলমানদের অবস্থাও ঠিক অনুরূপ। যারা দিনরাত রাসূল (সাঃ) কুরআন ও ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলে মূলতঃ অন্যকে ইসলাম থেকে ফিরিয়ে রাখার জন্য। লোকেরা ভাবে, তারা বড় বড় জ্ঞানী। তারা কি কিছুই বুঝেন না? অথচ তারা এ ব্যাপারে একেবারেই গোমূর্খ। আবু জাহ্লের এই কপট ও উদ্ধত আচরণের কথা বর্ণনা করেন আল্লাহ এভাবে-فَلاَ صَدَّقَ وَلاَ صَلَّى- وَلَكِنْ كَذَّبَ وَتَوَلَّى- ثُمَّ ذَهَبَ إِلَى أَهْلِهِ يَتَمَطَّى ‘সে বিশ্বাস করেনি এবং ছালাত আদায় করেনি’। ‘পরন্তু সে মিথ্যারোপ করেছে ও পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছে’। ‘অতঃপর সে দম্ভভরে নিজ পরিবারের কাছে ফিরে গিয়েছে’ (ক্বিয়ামাহ ৭৫/৩১-৩৩)। এক বর্ণনায় এসেছে যে, এক পর্যায়ে রাসূল (সাঃ) আবু জাহ্লকে লক্ষ্য করে নিম্নোক্ত আয়াতটি পাঠ করেন,أَوْلَى لَكَ فَأَوْلَى- ثُمَّ أَوْلَى لَكَ فَأَوْلَى ‘তোমার দুর্ভোগের উপরে দুর্ভোগ’। ‘অতঃপর তোমার দুর্ভোগের উপরে দুর্ভোগ’ (ক্বিয়ামাহ ৭৫/৩৪-৩৫)।[1]

[1]. কুরতুবী, ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা ক্বিয়ামাহ ৩৪-৩৫ আয়াত।


৯. কা‘বাগৃহে ছালাত আদায়ে বাধা সৃষ্টি (منع النبى صـ من الصلاة فى بيت الله)

(ক) নবুঅত প্রাপ্তির পর থেকেই ছালাত ফরয হয়। তবে তখন ছালাত ছিল কেবল ফজরে ও আছরে দু’ দু’ রাক‘আত করে (কুরতুবী)। যেমন আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন,وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ بِالْعَشِيِّ وَالْإِبْكَارِ ‘তুমি তোমার প্রভুর প্রশংসা জ্ঞাপন কর সন্ধ্যায় ও সকালে (অর্থাৎ সূর্যাস্তের পূর্বে ও সূর্যোদয়ের পূর্বে)’।[1] আয়েশা (রাঃ) বলেন, শুরুতে ছালাত বাড়ীতে ও সফরে ছিল দু’ দু’ রাক‘আত করে।[2] এছাড়া রাসূল (সাঃ)-এর জন্য ‘অতিরিক্ত’ (نَافِلَةً) ছিল তাহাজ্জুদের ছালাত (ইসরা/বনু ইস্রাঈল ১৭/৭৯)। সেই সাথে ছাহাবীগণও নিয়মিতভাবে রাত্রির নফল ছালাত আদায় করতেন।[3]


প্রথম দিকে সবাই সেটা গোপনে আদায় করতেন। পরবর্তীতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এটা প্রকাশ্যে কা‘বাগৃহে আদায় করতে থাকেন। একদিন তিনি ছালাত আদায় করছেন। এমন সময় আবু জাহ্ল গিয়ে তাঁকে ধমকের সুরে বলল,يَا مُحَمَّدُ، أَلَمْ أَنْهَكَ عَنْ هَذَا؟ ‘হে মুহাম্মাদ! আমি কি তোমাকে এসব থেকে নিষেধ করিনি?’


তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে পাল্টা ধমক দেন। এতে সে বলে,يَا مُحَمَّدُ بِأَيِّ شَيْءٍ تُهَدِّدُنِي؟ أَمَا وَاللهِ إِنِّي لَأَكْثَرُ هَذَا الْوَادِي نَادِيًا ‘কিসের জোরে তুমি আমাকে ধমকাচ্ছ হে মুহাম্মাদ? আল্লাহর কসম! মক্কার এই উপত্যকায় আমার বৈঠক সবচেয়ে বড়’। অর্থাৎ আমার দল সবচেয়ে ভারি। তখন আল্লাহ সূরা ‘আলাক্ব-এর নিম্নোক্ত আয়াতগুলি নাযিল করেন।[4]


كَلاَّ إِنَّ الْإِنسَانَ لَيَطْغَى- أَن رَّآهُ اسْتَغْنَى- إِنَّ إِلَى رَبِّكَ الرُّجْعَى- أَرَأَيْتَ الَّذِي يَنْهَى- عَبْداً إِذَا صَلَّى- أَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ عَلَى الْهُدَى- أَوْ أَمَرَ بِالتَّقْوَى- أَرَأَيْتَ إِنْ كَذَّبَ وَتَوَلَّى- أَلَمْ يَعْلَمْ بِأَنَّ اللهَ يَرَى- كَلاَّ لَئِن لَّمْ يَنتَهِ لَنَسْفَعاً بِالنَّاصِيَةِ- نَاصِيَةٍ كَاذِبَةٍ خَاطِئَةٍ- فَلْيَدْعُ نَادِيَه- سَنَدْعُ الزَّبَانِيَةَ- كَلاَّ لاَ تُطِعْهُ وَاسْجُدْ وَاقْتَرِبْ- (العلق ৬-১৯)-

‘কখনোই না। নিশ্চয়ই মানুষ সীমালংঘন করে’ (৬)। ‘এ কারণে যে, সে নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করে’ (৭)। ‘নিশ্চয় তোমার প্রতিপালকের নিকটেই প্রত্যাবর্তন স্থল’ (৮)। ‘তুমি কি দেখেছ ঐ ব্যক্তিকে (আবু জাহলকে) যে নিষেধ করে?’ (৯)। ‘এক বান্দাকে (রাসূলকে), যখন সে ছালাত আদায় করে’ (১০)। ‘তুমি কি দেখেছ যদি সে সৎপথে থাকে’ (১১)। ‘অথবা আল্লাহভীতির আদেশ দেয়’ (১২)। ‘তুমি কি দেখেছ যদি সে মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়’ (১৩)। ‘সে কি জানেনা যে, আল্লাহ তার সবকিছুই দেখেন’ (১৪)। ‘কখনোই না। যদি সে বিরত না হয়, তবে আমরা অবশ্যই তার মাথার সামনের কেশগুচ্ছ ধরে সজোরে টান দেব’(১৫)। ‘মিথ্যুক পাপিষ্ঠের কেশগুচ্ছ’ (১৬)। ‘অতএব সে তার পারিষদবর্গকে ডাকুক’ (১৭)। ‘আমরাও অচিরে ডাকব আযাবের ফেরেশতাদের’ (১৮)। ‘কখনোই না। তুমি তার কথা শুনবে না। তুমি সিজদা কর এবং আল্লাহর নৈকট্য তালাশ কর’ (‘আলাক্ব ৯৬/৬-১৯)।


আবু জাহ্ল ও রাসূল (সাঃ)-এর মধ্যকার এই ঘটনা স্মরণ করে এই আয়াত পাঠের পর পাঠক ও শ্রোতাকে একটি সিজদা করার বিধান দেওয়া হয়েছে’।[5] আর এটাই হ’ল কুরআনের ১৫তম ও সর্বশেষ সিজদার আয়াত’ (দারাকুৎনী হা/১৫০৭)। উল্লেখ্য যে, এই সিজদার জন্য ওযূ, কিবলা বা সালাম করা শর্ত নয়।


উপরোক্ত ঘটনায় শিক্ষণীয় বিষয় এই যে, দূরদর্শী কাফের-মুশরিক ও ধর্মনিরপেক্ষ নেতারা মুসলমানদের ব্যক্তিগত ইবাদতকেই বেশী ভয় পায়। যদিও তারা মুখে বলে যে, ধর্মের ব্যাপারে আমাদের কোন আপত্তি নেই। কেননা তাদের মতে ধর্ম হ’ল আল্লাহ ও বান্দার মধ্যকার ব্যক্তিগত সম্পর্কের নাম। অথচ নেতারা ভালভাবেই জানেন যে, ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতেই মানুষের জীবন পরিচালিত হয়। ব্যক্তির রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি সবকিছু তার বিশ্বাসকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। আবু জাহ্ল ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী নেতা। তাই তিনি মূল জায়গাতেই বাধা সৃষ্টি করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, কা‘বাতে একবার আল্লাহর জন্য সিজদা চালু হ’লে পাশেই রক্ষিত দেব-দেবীর সম্মুখে কেউ আর মাথা নীচু করবে না। তাদের অসীলায় কেউ আর মুক্তি চাইবে না এবং সেখানে কেউ আর নযর-নেয়ায দিবে না। অথচ অসীলাপূজার এই শিরকের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাদের অর্থবল, জনবল, সামাজিক সম্মান সবকিছুর চাবিকাঠি। বর্তমান যুগের কবরপূজারী ও ওরস ব্যবসায়ী মুসলমানদের অবস্থা সেযুগের আবু জাহ্লদের চাইতে ভিন্ন কিছুই নয়। সেদিন যেমন কা‘বার পাশেই মূর্তিপূজা হ’ত, এখন তেমনি মসজিদের পাশেই কবরপূজা হয় ও সেখানে নযর-নেয়ায দেওয়া হয়। ধর্মের নামে এইসব ধর্মনেতারা ধার্মিক মুসলমানদের তাওহীদ থেকে ফিরিয়ে শিরকমুখী করে। একইভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ও বস্ত্তবাদী নেতারা চাকুরী, ব্যবসা, শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রে সুকৌশলে দ্বীনদার মুসলিম নর-নারীকে তাদের ব্যক্তিগত ধর্ম পালনে বাধার সৃষ্টি করে থাকে।


(খ) সূরা ‘আলাক্ব-এর উপরোক্ত আয়াতসমূহ নাযিল হওয়ার পর আবু জাহ্ল মনে মনে ভীত হ’লেও বাইরে ঠাট বজায় রেখেই চলেন। একদিন তিনি কুরায়েশ নেতাদের সামনে বলে বসেন, লাত ও উয্যার কসম! যদি মুহাম্মাদকে পুনরায় সেখানে ছালাতরত দেখি, তাহ’লে নিশ্চিতভাবেই আমি তার ঘাড়ের উপরে পা দিয়ে তার নাকমুখ মাটিতে আচ্ছামত থেৎলে দেব’ (মুসলিম)। পরে একদিন তিনি রাসূল (সাঃ)-কে সেখানে ছালাতরত অবস্থায় দেখলেন। তখন নেতারা তাকে তার প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে উসকে দিল। ফলে তিনি খুব আস্ফালন করে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দিকে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু না। হঠাৎ দেখা গেল যে, তিনি ভয়ে পিছিয়ে আসছেন। আর দুই হাত শূন্যে উঁচু করে কি যেন এড়াতে চেষ্টা করছেন’। পিছিয়ে এসে তিনি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, আমার ও তার মধ্যে একটা বিরাট অগ্নিকুন্ড দেখলাম, যা আমার দিকে ধেয়ে আসছিল’। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,لَوْ دَنَا مِنِّى لاَخْتَطَفَتْهُ الْمَلاَئِكَةُ عُضْوًا عُضْوًا ‘যদি সে আমার কাছে পৌঁছত, তাহ’লে ফেরেশতারা তার এক একটা অঙ্গ ছিন্ন করে উঠিয়ে নিয়ে যেত’।[6] আশ্চর্যের বিষয়, এতবড় দৃশ্য স্বচক্ষে দেখেও এবং রাসূল (সাঃ)-এর উপর আল্লাহর সরাসরি সাহায্য প্রত্যক্ষ করেও আবু জাহ্ল তার হঠকারিতা থেকে পিছিয়ে আসেননি কেবলমাত্র নেতৃত্বের অহংকারে স্ফীত হওয়ার কারণে। নমরূদ, ফেরাঊন ও আবু জাহল সহ যুগে যুগে সকল হঠকারী নেতাদের চরিত্র একই।


(গ) শিস দেওয়া ও তালি বাজানো(المكاء والةصدية عند الصلاة فى الكعبة) : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন কা‘বায় গিয়ে ছালাত আদায় করতেন, তখন কাফের নেতারা তাদের লোকজন নিয়ে কা‘বাগৃহে আসত। অতঃপর ইবাদতের নাম করে তারা সেখানে জোরে জোরে তালি বাজাত ও শিস্ দিত। যাতে রাসূল (সাঃ)-এর ছালাত ও ইবাদতে বিঘ্ন ঘটানো যায়। এ বিষয়টি উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন,وَمَا كَانَ صَلاَتُهُمْ عِنْدَ الْبَيْتِ إِلاَّ مُكَاءً وَّتَصْدِيَةً فَذُوْقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْفُرُوْنَ ‘আর বায়তুল্লাহ্র নিকটে তাদের ইবাদত বলতে শিস দেওয়া ও তালি বাজানো ছাড়া আর কিছুই ছিল না। অতএব (ক্বিয়ামতের দিন তাদের বলা হবে) তোমরা অবিশ্বাসের শাস্তি আস্বাদন কর’ (আনফাল ৮/৩৫)।


(ঘ) ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এতদ্ব্যতীত আবু জাহ্ল অন্যান্যদেরকে প্ররোচিত করেছিলেন যে, মুহাম্মাদ যখন কুরআন তেলাওয়াত করে তখন তোমরা হৈ-হুল্লোড় ও হট্টগোল করবে, যাতে কেউ তার তেলাওয়াত শুনতে না পায়। এ প্রসঙ্গে আয়াত নাযিল হয়-


وَقَالَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لاَ تَسْمَعُوْا لِهَذَا الْقُرْآنِ وَالْغَوْا فِيْهِ لَعَلَّكُمْ تَغْلِبُوْنَ- فَلَنُذِيْقَنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا عَذَاباً شَدِيْداً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَسْوَأَ الَّذِيْ كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ- (فصلت ২৬-২৭)-


‘আর কাফেররা বলে, তোমরা এ কুরআন শুনোনা এবং এর তেলাওয়াত কালে হট্টগোল কর, যাতে তোমরা বিজয়ী হও’। ‘আমরা অবশ্যই কাফিরদের কঠিন শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাব এবং আমরা অবশ্যই তাদের কৃতকর্মের নিকৃষ্টতম বদলা দেব’ (ফুছসালাত/হা-মীম সাজদাহ ৪১/২৬-২৭)। এছাড়াও তারা নানাবিধ গালি দিত। তখন নাযিল হয়-وَلاَ تَجْهَرْ بِصَلاَتِكَ وَلاَ تُخَافِتْ بِهَا وَابْتَغِ بَيْنَ ذَلِكَ سَبِيْلاً ‘আর তুমি তোমার ছালাতের ক্বিরাআতে স্বর অধিক উঁচু করো না বা একেবারে নীচু করো না। বরং দু’য়ের মধ্যবর্তী পথ অবলম্বন কর’ (ইসরা ১৭/১১০)।[7]


[1]. গাফির/মুমিন ৪০/৫৫; মির‘আত ২/২৬৯।

[2]. মুসলিম হা/৬৮৫; আবুদাঊদ হা/১১৯৮; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২১১।

[3]. মুযযাম্মিল ৭৩/২০; তাফসীরে কুরতুবী।

[4]. ত্বাবারী, তাফসীর ‘আলাক্ব ১৮ আয়াত; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৭৫; তিরমিযী হা/৩৩৪৯।

[5]. মুসলিম হা/৫৭৮; বুখারী হা/১০৭৪; মিশকাত হা/১০২৪ ‘সুজূদুল কুরআন’ অনুচ্ছেদ।

[6]. ইবনু হিশাম ১/২৯৯ টীকা -৪; মুসলিম হা/২৭৯৭, মিশকাত হা/৫৮৫৬।


ইবনু ইসহাকের অন্য এক বর্ণনায় এসেছে যে, রাসূল (সাঃ) সিজদায় গেলে আবু জাহ্ল পাথর উঠিয়ে এগিয়ে গেল। কিন্তু কিছু দূর এগোতেই দ্রুত ভয়ে পিছিয়ে এল। এ সময় তার হাতের পাথরখন্ডটা এমনভাবে চিমটি লেগে গেল যে, সে তা হাত থেকে ছাড়াতে পারছিল না। লোকেরা তার অবস্থা কি জিজ্ঞেস করলে সে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, একটা ভয়ংকর উট আমাকে খেতে আসছিল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, জিব্রীল স্বয়ং উষ্ট্রের রূপ ধারণ করে তাকে ভয় দেখিয়েছিল। কাছে এলে তাকে ধরে নিত’ (ইবনু হিশাম ১/২৯৮; বায়হাক্বী দালায়েল ৪/১৩; আর-রাহীক্ব পৃঃ ৯৯)। বর্ণনাটি যঈফ (মা শা-‘আ পৃঃ ৪৮-৪৯)। এ ব্যাপারে ছহীহ বর্ণনা সেটাই যা উপরে বর্ণিত হয়েছে।

[7]. বুখারী হা/৭৪৯০; মুসলিম হা/৪৪৬; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা বনু ইস্রাঈল ১১০ আয়াত।


১০. সত্যনবী হ’লে তাকে অমান্য করায় গযব নাযিল হয় না কেন বলে যুক্তি প্রদর্শন (إظهار الحجة على النبى صــ بإتيان العذاب)

নযর বিন হারিছ প্রমুখ কুরায়েশ নেতারা নও মুসলিমদের সম্মুখে এবং নিজেদের লোকদের সম্মুখে জোরে-শোরে একথা প্রচার করত যে, যদি মুহাম্মাদ সত্যনবী হ’তেন ও তার আনীত কুরআন সত্য কিতাব হ’ত, তাহ’লে তা অমান্য করার অপরাধে আমাদের উপরে লূতের কওমের মত গযব নাযিল হয় না কেন? বস্ত্ততঃ তাদের এসব কথা দ্বারা দুর্বলদের মন আরও দুর্বল হয়ে যেত এবং ইসলাম কবুল করা হ’তে পিছিয়ে যেত। তাদের এই দাবী ও তার জওয়াবে আল্লাহ বলেন,

وَإِذْ قَالُوْا اللهُمَّ إِنْ كَانَ هَـذَا هُوَ الْحَقَّ مِنْ عِنْدِكَ فَأَمْطِرْ عَلَيْنَا حِجَارَةً مِّنَ السَّمَاءِ أَوِ ائْتِنَا بِعَذَابٍ أَلِيْمٍ- وَمَا كَانَ اللهُ لِيُعَذِّبَهُمْ وَأَنْتَ فِيْهِمْ وَمَا كَانَ اللهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُوْنَ- (الأنفال ৩২-৩৩)-

‘আর স্মরণ কর, যখন তারা প্রার্থনা করেছিল, যদি এই ব্যক্তি (মুহাম্মাদ) সত্য (নবী) হয়ে থাকে তোমার পক্ষ হতে, তাহ’লে তুমি আমাদের উপর আকাশ থেকে প্রস্তর বর্ষণ কর অথবা আমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দাও’। ‘অথচ আল্লাহ কখনো তাদের উপর শাস্তি নাযিল করবেন না যতক্ষণ তুমি (হে মুহাম্মাদ!) তাদের মধ্যে অবস্থান করবে। আর আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দিবেন না যতক্ষণ তারা (অর্থাৎ মক্কার দুর্বল মুসলিমরা) ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে’।[1]

অথচ একবার গযব নেমে এলে সবকিছু নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। যেমন পূর্ববতী নবীগণের অবাধ্য উম্মতসমূহের অবস্থা হয়েছে। শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ) নিজ উম্মতের জন্য সেটা কখনোই চাননি।


আয়াত দু’টির মর্মকথা (مغزى الآييتين المذكورتين) :

প্রথম আয়াতে কাফের নেতাদের একটি কূট কৌশল বর্ণিত হয়েছে যে, মুহাম্মাদ সত্যনবী হ’লে তাকে অমান্য করার কারণে আমাদের উপরে গযব নাযিল হয় না কেন? অথচ তারা ভালভাবেই জানত যে, আল্লাহ তার বান্দাদের বুঝার ও তওবা করার অবকাশ দিয়ে থাকেন। প্রতিটি অপরাধের কারণে যখন-তখন গযব নাযিল করে তাদের ধ্বংস করেন না। যেমন আল্লাহ ফেরাঊনের মত দুরাচারকেও অন্যূন বিশ বছরের মত সময় দিয়েছিলেন এবং নানা প্রকার গযব নাযিল করেও যখন সে তওবা করেনি, তখন তাকে সদলবলে ডুবিয়ে মারেন। মক্কার কাফিররাও ভেবেছিল যেহেতু গযব নাযিল হচ্ছে না, অতএব আমরা ঠিক পথে আছি। মুহাম্মাদ নিজে ধর্মত্যাগী হয়েছে এবং সে আমাদের জামা‘আতের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করেছে।


বস্ত্ততঃ যুগে যুগে কায়েমী স্বার্থবাদী রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতারা নিজেদেরকে সঠিক এবং সংস্কারবাদী নেতাদেরকে পথভ্রষ্ট বলে দাবী করেছে। মূসা (আঃ)-এর বিরুদ্ধে ফেরাঊন তার লোকদের একই কথা বলে বুঝিয়েছিল যে,وَمَا أَهْدِيْكُمْ إِلاَّ سَبِيْلَ الرَّشَادِ ‘আমি তোমাদেরকে সর্বদা কেবল মঙ্গলের পথই দেখিয়ে থাকি’ (মুমিন/গাফের ৪০/২৯)। আর মূসা (আঃ) সম্পর্কে সে বলল,وَإِنِّيْ لاَظُنُّهُ كَاذِباً ‘আমি তাকে মিথ্যাবাদী মনে করি’ (মুমিন/গাফের ৪০/৩৭)। সে ধর্ম রক্ষা ও দেশে শান্তি রক্ষার দোহাই দিয়ে তাকে হত্যা করার অজুহাত সৃষ্টি করে বলেছিল,ذَرُوْنِيْ أَقْتُلْ مُوْسَى وَلْيَدْعُ رَبَّهُ إِنِّيْ أَخَافُ أَنْ يُّبَدِّلَ دِيْنَكُمْ أَوْ أَنْ يُّظْهِرَ فِي الْأَرْضِ الْفَسَادَ ‘তোমরা আমাকে ছাড়, আমি মূসাকে হত্যা করব। ডাকুক, সে তার রবকে। আমি আশংকা করি যে, সে তোমাদের দ্বীনকে পরিবর্তন করে দেবে এবং সে দেশময় বিপর্যয় সৃষ্টি করবে’ (মুমিন/গাফের ৪০/২৬)। মক্কার নেতারা একই কথা বলেছিল। তারা রাসূল (সাঃ)-কে ‘ছাবেঈ’ (صابئ) অর্থাৎ ‘ধর্মত্যাগী এবং ‘কাযযাব’ (كذَّاب) অর্থাৎ ‘মহা মিথ্যাবাদী’ এবং ‘সমাজে বিভক্তি সৃষ্টিকারী’ বলেছিল।[2] আর সেকারণ তারা তাঁকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।


যুগে যুগে ইসলামের শত্রুরা দ্বীনের সত্যিকারের সেবকদের বিরুদ্ধে একই অপবাদ ও একই কূট কৌশল অবলম্বন করে। তারাও আল্লাহর গযব সঙ্গে সঙ্গে নাযিল না হওয়াকে তাদের সত্যতার পক্ষে দলীল হিসাবে পেশ করে এবং সমাজ সংস্কারক দ্বীনদার আলেমদের অত্যাচারিত হওয়াকে তাদের ভ্রান্ত হওয়ার প্রমাণ হিসাবে যুক্তি পেশ করে থাকে।


দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ কাফেরদের কথার জওয়াবে বলেন, যতক্ষণ হে মুহাম্মাদ! তুমি তাদের মধ্যে অবস্থান করবে অথবা তোমার হিজরতের পরেও যতদিন মক্কার দুর্বল ঈমানদারগণ আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে, ততদিন আমরা তাদের উপর গযব নাযিল করব না। কারণ একজন নবী বা ঈমানদারের মূল্য সমস্ত আরববাসী এমনকি সকল বিশ্ববাসীর চাইতে বেশী। এ কারণেই হাদীছে এসেছে,لاَ تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى لاَ يُقَالَ فِى الأَرْضِ اللهُ اللهُ ‘অতদিন ক্বিয়ামত হবে না, যতদিন পৃথিবীতে একজন আল্লাহ বলার মত (প্রকৃত তাওহীদপন্থী ঈমানদার) লোক বেঁচে থাকবে’।[3]


বস্ত্ততঃ ৮ম হিজরীর ১৭ই রামাযান মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে তাদের উপরে সে গযবই নাযিল হয়েছিল। কেননা যে দুনিয়ার লোভে তারা ইসলামকে সত্য জেনেও তার বিরোধিতায় জীবনপাত করেছিল, সেই দুনিয়াবী নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব সবই তাদের হাতছাড়া হয়ে যায় মক্কা বিজয়ের দিন এবং সেদিন তারা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ইসলাম কবুল করতে বাধ্য হয়। নিজেদের জীবদ্দশায় বিনা যুদ্ধে এরূপ মর্মান্তিক পতন প্রত্যক্ষ করা তাদের জন্য সবচেয়ে বড় দুনিয়াবী শাস্তি নয় কি? বরং আসমান থেকে প্রস্তর বর্ষণে নিহত হওয়ার চাইতে এটিই ছিল কুরায়েশ নেতাদের জন্য আরও কঠিন গযব ও হৃদয়বিদারক শাস্তি। যুগে যুগে সত্য এভাবেই বিজয়ী হয়েছে। আজও হওয়া মোটেই অসম্ভব নয়। প্রয়োজন কেবল ঈমানদার ও নিঃস্বার্থ নেতা এবং যোগ্য ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মী দল।


আল্লাহর সান্ত্বনা বাণী (كلماة الةسلية من الله تعالى) :

আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় রাসূলকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন,فَاصْبِرْ كَمَا صَبَرَ أُولُو الْعَزْمِ مِنَ الرُّسُلِ وَلاَ تَسْتَعْجِلْ لَهُمْ كَأَنَّهُمْ يَوْمَ يَرَوْنَ مَا يُوعَدُونَ لَمْ يَلْبَثُوا إِلاَّ سَاعَةً مِنْ نَهَارٍ بَلاَغٌ فَهَلْ يُهْلَكُ إِلاَّ الْقَوْمُ الْفَاسِقُونَ ‘অতএব তুমি ধৈর্যধারণ কর যেমন ধৈর্যধারণ করেছিল (তোমার পূর্বেকার) দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাসূলগণ। আর অবিশ্বাসীদের জন্য (শাস্তি প্রার্থনায়) ব্যস্ততা প্রদর্শন করো না। তাদেরকে যে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে, তা সেদিন তারা প্রত্যক্ষ করবে। সেদিন তাদের মনে হবে যেন তারা দিবসের কিছুক্ষণের বেশী পৃথিবীতে অবস্থান করেনি। এটি তাদের জন্য খবর পৌঁছানো হ’ল মাত্র। আর পাপাচারী সম্প্রদায় ব্যতীত কেউ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় কি?’(আহক্বাফ ৪৬/৩৫)।

[1]. আনফাল ৮/৩২-৩৩; ইবনু হিশাম ১/৬৭০।

[2]. ইবনু হিশাম ১/২৬৭; আর-রাহীক্ব পৃঃ ৮২, ৯৭।

[3]. মুসলিম হা/১৪৮; আহমাদ হা/১৩৮৬০ ‘মুসনাদে আনাস’; মিশকাত হা/৫৫১৬ ‘ফিৎনাসমূহ’ অধ্যায়, ৭ অনুচ্ছেদ।


শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ -৮ (العبر -৮)


১. সত্য প্রতিষ্ঠায় মূল নেতাকেই আদর্শ হিসাবে সম্মুখে এগিয়ে আসতে হয়।

২. সংস্কারক নেতা উচ্চ বংশের ও সৎকর্মশীল নেককার পিতা-মাতার সন্তান হয়ে থাকেন।

৩. সংস্কারক নিজ ব্যক্তিজীবনে তর্কাতীতভাবে সৎ হন।

৪. সংস্কারক কখনোই অলস ও বিলাসী হন না।

৫. সংস্কারের প্রধান বিষয় হ’ল মানুষের ব্যক্তিগত আক্বীদা ও আমল।

৬. শিরকের সঙ্গে আপোষ করে কখনোই তাওহীদ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।

৭. সংস্কার প্রচেষ্টা শুরু হ’লেই তার বিরোধিতা অপরিহার্য হবে।

৮. ইসলামী সংস্কারের বিরুদ্ধে প্রধান বিরোধী হবে স্বার্থান্ধ ধর্মনেতা ও সমাজ নেতারা।

৯. যাবতীয় গীবত-তোহমত ও অত্যাচার-নিপীড়ন সহ্য করার জন্য সংস্কারককে মানসিকভাবে প্রস্ত্তত থাকতে হবে।

১০. সংস্কারককে পুরোপুরি মানবহিতৈষী হ’তে হবে।

১১. স্রেফ আল্লাহর উপরে ভরসা করে ময়দানে নামতে হবে।

১২. আল্লাহ প্রেরিত অহীর বিধান সার্বিকভাবে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই কেবল মানবতার প্রকৃত কল্যাণ সম্ভব- দৃঢ়ভাবে এ বিশ্বাস পোষণ করতে হবে।

১৩. নেতাকে অবশ্যই নৈশ ইবাদতে অভ্যস্ত হ’তে হবে এবং ফরয ও সুন্নাত সমূহ পালনে আন্তরিক হ’তে হবে।

১৪. নেতাকে যাবতীয় দুনিয়াবী লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থাকতে হবে।

১৫. সকল কাজে সর্বদা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করতে হবে ও তাঁর কাছেই বিনিময় চাইতে হবে।


ছাহাবীগণের উপরে অত্যাচার (مظالم على الصحابة)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপরে মানসিক ও দৈহিক অত্যাচারের কিছু ঘটনা আমরা ইতিপূর্বে জেনেছি। এক্ষণে আমরা তাঁর সাথীদের উপরে অত্যাচারের কিছু নমুনা পেশ করব।-


হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, প্রথম সাতজন ব্যক্তি তাদের ইসলাম প্রকাশ করেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ), আবুবকর, ‘আম্মার ও তার মা সুমাইয়া, ছোহায়েব, বেলাল ও মিক্বদাদ। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে আল্লাহ নিরাপত্তা দেন তাঁর চাচা আবু ত্বালেবের মাধ্যমে, আবুবকরকে নিরাপত্তা দেন তার গোত্রের মাধ্যমে। আর বাকীদের মুশরিকরা পাকড়াও করে। তাদেরকে তারা লোহার পোষাক পরিয়ে প্রচন্ড দাবদাহের মধ্যে ফেলে রাখে। তারা যেভাবে খুশী নির্যাতন করে। কিন্তু বেলালের ব্যাপারটি ছিল ভিন্ন। সে নিজেকে আল্লাহর উপর সঁপে দিয়েছিল। লোকেরা তার পিছনে ছোকরাদের লেলিয়ে দেয়। তারা তাকে মক্কার অলি-গলিতে ঘুরায়। আর সে বলতে থাকে আহাদ, আহাদ’।[1] এখানে সাতজনের মধ্যে সুমাইয়ার স্বামী ইয়াসিরকে ধরা হয়নি। যদিও তিনিও ছিলেন একই সময়ের নির্যাতিত ছাহাবী’ (আল-ইছাবাহ, ‘আম্মার ক্রমিক ৫৭০৮)।


উল্লেখ্য যে, মুসলমানদের উপরে কাফিরদের এই অত্যাচারের কোন ধরাবাঁধা নিয়ম ছিল না কিংবা উঁচু-নীচু ভেদাভেদ ছিল না। তবে স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী সচ্ছল ও উঁচু স্তরের লোকদের চাইতে গরীব ও ক্রীতদাস শ্রেণীর মুসলমানদের উপরে অত্যাচার ও নির্যাতনের মাত্রা ছিল অনেক বেশী, যা অবর্ণনীয়। নিম্নে উদাহরণ স্বরূপ জাহেলী যুগে ছাহাবীগণের উপর নির্যাতনের কিছু নমুনা পেশ করা হ’ল।-

[1]. আহমাদ হা/৩৮৩২, সনদ হাসান; বায়হাক্বী সুনান হা/১৭৩৫১; মা শা-‘আ ৩৪ পৃঃ।


(১) বেলাল বিন রাবাহ (بِلاَلُ بْنُ رَبَاحٍ)


যিনি কুরায়েশ নেতা উমাইয়া বিন খালাফের হাবশী ক্রীতদাস ছিলেন। ইসলাম কবুল করার অপরাধে তাকে তার মনিব অবর্ণনীয় নির্যাতন করে। তার গলায় দড়ি বেঁধে গরু-ছাগলের মত ছেলে-ছোকরাদের দিয়ে পাহাড়ে ও প্রান্তরে টেনে-হিঁচড়ে ঘুরানো হ’ত। তাতে তার গলার চামড়া রক্তাক্ত হয়ে যেত। খানাপিনা বন্ধ রেখে তাকে ক্ষুৎ-পিপাসায় কষ্ট দেওয়া হ’ত। কখনো উত্তপ্ত কংকর-বালুর উপরে হাত-পা বেঁধে ফেলে রেখে বুকে পাথর চাপা দেওয়া হ’ত আর বলা হ’তلاَ تَزَالُ هَكَذَا حَتَّى تَمُوتَ أَوْ تَكْفُرَ بِمُحَمَّدِ وَتَعْبُدَ اللاَّتَ وَالْعُزَّى ‘মুহাম্মাদের দ্বীন পরিত্যাগ এবং লাত-‘উযযার পূজা না করা পর্যন্ত তোকে আমৃত্যু এভাবেই পড়ে থাকতে হবে’। কিন্তু বেলাল শুধুই বলতেন ‘আহাদ’ ‘আহাদ’ (ইবনু হিশাম ১/৩১৭-১৮)। একদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পাশ দিয়ে যাবার সময় এই দৃশ্য দেখে বললেনأَحَدٌ يُنْجِيكَ ‘আহাদ’ অর্থাৎ ‘আল্লাহ তোমাকে মুক্তি দেবেন’। অতঃপর তিনি এসে আবুবকরকে বললেন, يَا أَبَا بَكْرٍ إِنَّ بِلاَلاً يُعَذَّبُ فِي اللهِ ‘হে আবুবকর। বেলাল আল্লাহর পথে শাস্তি ভোগ করছে’। আবুবকর ইঙ্গিত বুঝলেন। অতঃপর উমাইয়ার দাবী অনুযায়ী নিজের কাফের গোলাম নিসতাস (نِسْطَاسٌ)-এর বিনিময়ে এবং একটি মূল্যবান চাদর ও দশটি উক্বিয়ার (স্বর্ণমুদ্রা) বিনিময়ে তাকে খরীদ করে মুক্ত করে দেন।[1] ওমর (রাঃ) বলেন,أَبُو بَكْرٍ سَيِّدُنَا، وَأَعْتَقَ سَيِّدَنَا، يَعْنِى بِلاَلاً ‘আবুবকর আমাদের নেতা এবং মুক্ত করেছেন আমাদের নেতাকে’। এর দ্বারা তিনি বেলালকে বুঝাতেন।[2] ওমর (রাঃ)-এর এই কথার মধ্যে ইসলামী সাম্যের প্রকৃষ্ট প্রমাণ মেলে। যেখানে মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই তাক্বওয়া ব্যতীত। বেলাল (রাঃ) ইসলামের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ মুওয়াযযিন ছিলেন। তিনি ২০ হিজরী সনে ৬৩ বছর বয়সে দামেষ্কে মৃত্যুবরণ করেন’ (আল-ইছাবাহ ক্রমিক সংখ্যা ৭৭৬)।


[1]. কুরতুবী তাফসীর সূরা লায়েল ১৯-২০ আয়াত; হা/৬৩৫৮ সনদ হাসান; ২০/৭৯-৮০ পৃঃ।

[2]. বুখারী হা/৩৭৫৪; মিশকাত হা/৬২৫০ ‘মর্যাদা সমষ্টি’ অনুচ্ছেদ।


(২) ‘আমের বিন ফুহায়রাহ (عَامِرُ بْنُ فُهَيْرَةَ)

আবুবকরের মুক্তদাস ছিলেন। হিজরতের রাতে ইনি সার্বিক খিদমতে ছিলেন। বদর ও ওহোদের যুদ্ধে যোগদান করেন। তিনি ৪র্থ হিজরীর ছফর মাসে সংঘটিত বি’রে মাঊনার মর্মান্তিক ঘটনায় ৭০জন শহীদের অন্যতম ছিলেন (ইবনু হিশাম ১/৩১৮)।


(৩) উম্মে উবাইস, যিন্নীরাহ, নাহদিয়াহ ও তার মেয়ে..

(৩) উম্মে উবাইস, যিন্নীরাহ, নাহদিয়াহ ও তার মেয়ে এবং বনু মুআম্মাল-এর জনৈকা দাসী মুসলমান হ’লে তারা সবাই বর্বরতম নির্যাতনের শিকার হন। ইবনু ইসহাক বলেন, যিন্নীরাহকে যখন তিনি মুক্ত করেন, তখন সে অন্ধ ছিল। কুরায়েশরা বলল, লাত-‘উযযার অভিশাপে সে অন্ধ হয়ে গেছে। তখন যিন্নীরাহ বলল, ওরা মিথ্যা বলেছে। আল্লাহর ঘরের কসম![1] লাত-‘উযযা কারু কোন ক্ষতি করতে পারেনা, উপকারও করতে পারেনা’। তখনই আল্লাহ তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন’।[2]


এভাবে সর্বশেষ বেলালকে নিয়ে হিজরতের পূর্বে মোট ৭জন দাস-দাসীকে আবুবকর মুক্ত করেন (হাকেম হা/৫২৪১ হাদীছ ছহীহ)। এবিষয়ে একদিন তার পিতা আবু কুহাফা তাকে বলেন, বেটা! আমি দেখছি তুমি যত দুর্বল দাস-দাসী মুক্ত করছ। যদি তুমি শক্তিশালী ও সাহসী কিছু লোককে মুক্ত করতে, তাহ’লে তারা তোমাকে রক্ষা করত এবং তোমার পক্ষে যুদ্ধ করত! জবাবে আবুবকর বলেন, হে পিতা! আমি তো কেবল আল্লাহর জন্যই এগুলি করেছি। অতঃপর তাঁর সম্পর্কে ‘সূরা লায়েল’ নাযিল হয় (ইবনু হিশাম ১/৩১৮-৩১৯)। উল্লেখ্য যে, এসময় আবু কুহাফা ইসলাম কবুল করেননি। মক্কা বিজয়ের দিন তিনি মুসলমান হন’ (মুসলিম হা/২১০২ (৭৯)।


এভাবে কুরায়েশ নেতারা মুসলিম দাস-দাসী ও তাদের পরিবারের উপরে সর্বাধিক নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করত। আবুবকর (রাঃ) এইসব নির্যাতিত দাস-দাসীকে বহু মূল্যের বিনিময়ে তাদের নিষ্ঠুর মনিবদের নিকট থেকে খরীদ করে নিয়ে মুক্ত করে দিতেন।


[1]. আল্লাহর ঘরের কসম করা জায়েয নয়। বরং রববুল কা‘বা (কা‘বার রবের) কসম করা যাবে (আহমাদ হা/২৭১৩৮; নাসাঈ হা/৩৭৭৩; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১১৬৬)।

[2]. ইবনু হিশাম ১/৩১৮; আল-ইছাবাহ ক্রমিক ১১২১৬; মুহাক্কিক বলেন, যিন্নীরাহ্র ঘটনাটি বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হওয়ার কারণে এর সনদ ‘হাসান’ স্তরে উন্নীত হ’তে পারে (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৩০৯)।


(৪) মুছ‘আব বিন উমায়ের (مُصْعَبُ بْنُ عُمَيْرٍ)


ইনি ছিলেন মক্কার শ্রেষ্ঠ তরুণদের অন্যতম। তিনি অত্যন্ত বিলাস-ব্যসনে মানুষ হন। রাসূল (সাঃ) যখন দারুল আরক্বামে দ্বীনের দাওয়াত দিতেন, তখন তিনি ইসলাম কবুল করেন। কিন্তু মা ও গোত্রের লোকদের ভয়ে তা প্রকাশ করেননি। পরে ওছমান বিন ত্বালহার মাধ্যমে খবরটি প্রকাশ হয়ে পড়ে। তখন তার গোত্রের লোকেরা তাকে হাত-পা বেঁধে তার ঘরের মধ্যে আটকে রাখে। এক সময় তিনি কৌশলে পালিয়ে যান ও হাবশায় হিজরত করেন। পরে সেখান থেকে ফিরে রাসূল (সাঃ)-এর নির্দেশে মদীনায় প্রেরিত হন। তিনিই ছিলেন মদীনায় প্রেরিত ইসলামের প্রথম দাঈ। প্রধানতঃ তাঁরই প্রচেষ্টায় মদীনার আউস ও খাযরাজ নেতারা ইসলাম কবুল করেন। যা হিজরতের পটভূমি তৈরী করে। ওহোদের যুদ্ধে তিনি ইসলামী বাহিনীর পতাকাবাহী ছিলেন। অতঃপর শহীদ হন’ (আল-ইছাবাহ ক্রমিক সংখ্যা ৮০০৮)।


(৫) ইয়াসির পরিবার (آلُ يَاسِرٍ)

ইয়ামন থেকে মক্কায় হিজরতকারী এই পরিবার মক্কার বনু মাখযূমের সাথে চুক্তিবদ্ধ মিত্র (حَلِيفٌ) ছিল। পরিবার প্রধান ইয়াসির বিন মালিক এবং তার স্ত্রী সুমাইয়া ও পুত্র ‘আম্মার সকলে মুসলমান হন। ফলে তাদের উপরে যে ধরনের অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছিল, ইতিহাসে তার তুলনা বিরল। বনু মাখযূম নেতা আবু জাহ্লের নির্দেশে তাদেরকে খোলা ময়দানে নিয়ে উত্তপ্ত বালুকার উপরে শুইয়ে রেখে প্রতিদিন নানাভাবে নির্যাতন করা হ’ত। একদিন চলার পথে তাদের শাস্তির দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের উদ্দেশ্যে বলেন,صَبْرًا آلَ يَاسِر فَإِنَّ مَوْعِدَكُمُ الْجَنَّةُ ‘ধৈর্য ধর হে ইয়াসির পরিবার! তোমাদের ঠিকানা হ’ল জান্নাত’। অবশেষে ইয়াসিরকে কঠিন নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়।[1]


অতঃপর পাষাণহৃদয় আবু জাহ্ল নিজ হাতে ইয়াসিরের বৃদ্ধা স্ত্রী সুমাইয়ার গুপ্তাঙ্গে বর্শা বিদ্ধ করে তাকে হত্যা করে। তিনিই ছিলেন ইসলামে প্রথম মহিলা শহীদ।[2] অতঃপর তাদের পুত্র ‘আম্মারের উপরে শুরু হয় নির্যাতনের পালা। তাকেও বেলালের ন্যায় কঠিন নির্যাতন করা হয় যতক্ষণ না সে রাসূল (সাঃ)-কে গালি দিতে রাযী হয়। অবশেষে বাধ্য হয়ে তিনি তাদের কথা মেনে নেন। পরে মুক্তি পেয়েই তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দরবারে গিয়ে সব ঘটনা খুলে বলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করেন كََيْفَ تَجِدُ قَلْبَكَ؟ ‘ঐ সময় তোমার অন্তর কিরূপ ছিল’? তিনি বললেন,مُطْمَئِنًّا بِالْإِيْمَانِ ‘ঈমানের উপর অবিচল’। রাসূল (সাঃ) বললেনإِنْ عَادُوا فَعُدْ ‘যদি ওরা আবার বলতে বলে, তাহ’লে তুমি আবার বল’। তখন নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়,[3] مَنْ كَفَرَ بِاللهِ مِنْ بَعْدِ إِيمَانِهِ إِلاَّ مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالْإِيمَانِ وَلَكِنْ مَنْ شَرَحَ بِالْكُفْرِ صَدْرًا فَعَلَيْهِمْ غَضَبٌ مِنَ اللهِ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ ‘ঈমান আনার পরে যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কুফরী করে, তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর ক্রোধ এবং কঠিন শাস্তি। কিন্তু যাকে বাধ্য করা হয়, অথচ তার অন্তর বিশ্বাসে অটল থাকে (তার কোন চিন্তা নেই)’ (নাহল ১৬/১০৬)। ইবনু কাছীর বলেন, সকল বিদ্বান এ বিষয়ে একমত যে, কুফরীতে বাধ্য করা হ’লে বাধ্যকারীর কথামত কাজ করা জায়েয (ইবনু কাছীর)। একমাত্র বেলাল ছিলেন, যিনি তাদের কথা মত কাজ করতেন না, বরং কেবলি বলতেন আহাদ, আহাদ।

পরে হযরত আবুবকর (রাঃ) ‘আম্মার বিন ইয়াসিরকে তার মনিবের কাছ থেকে খরীদ করে মুক্ত করে দেন। ‘আম্মার ঐ সময় আবুবকর (রাঃ)-এর প্রশংসায় যে কবিতা বলেন, তার শুরু ছিল নিম্নরূপ :

جَزَى اللهُ خَيْرًا عَنْ بَلاَلٍ وَصَحْبِهِ + عَتِيْقًا وَأَخْزَى فَاكِهًا وَأَبَا جَهْلِ

‘আল্লাহ উত্তম পুরস্কার দান করুন আবুবকর (রাঃ)-কে বেলাল ও তার সাথীদের পক্ষ হ’তে এবং লাঞ্ছিত করুন আবু ফাকীহাহ (উমাইয়া বিন খালাফ) ও আবু জাহ্লকে’।[4]


‘আম্মার রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলতেন, যে ব্যক্তি ‘আম্মারের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে আল্লাহ তার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেন’। খালিদ বিন অলীদ (রাঃ) বলেন, এই হাদীছ শোনার পর থেকে আমি সর্বদা তাকে ভালোবাসতাম’।[5] আবুবকর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ভন্ডনবীদের বিরুদ্ধে ইয়ামামাহ্র যুদ্ধে তার কান বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ওমর (রাঃ) তাকে কূফার গবর্ণর নিযুক্ত করেন। রাসূল (সাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে,تَقْتُلُهُ الْفِئَةُ الْبَاغِيَةُ ‘তাকে বিদ্রোহী দল হত্যা করবে’ (বুখারী হা/৪৪৭)। ৩৭ হিজরীতে ছিফফীনের যুদ্ধে তিনি আলী (রাঃ)-এর পক্ষে যোগদান করেন এবং শহীদ হন। এসময় তাঁর বয়স ছিল ৯৩ বছর। আলী (রাঃ) তাঁকে গোসল ও কাফন না দিয়েই দাফন করেন।[6]


[1]. ইবনু হিশাম ১/৩১৯-২০; হাকেম হা/৫৬৪৬; আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ ১০৩ পৃঃ, সনদ ছহীহ; ত্বাবারাণী আওসাত্ব হা/৩৮৪৬; আল-ইছাবাহ, ইয়াসির ‘আনাসী ক্রমিক ৯২১৪; আল-ইস্তী‘আব ক্রমিক ২৮২২।

[2]. আল-ইছাবাহ, সুমাইয়া, ক্রমিক ১১৩৩৬।

[3]. হাকেম হা/৩৩৬২, ২/৩৫৭ পৃঃ সনদ ছহীহ; কুরতুবী হা/৩৯৫৫; বায়হাক্বী হা/১৭৩৫০, ৮/২০৮-০৯ পৃঃ; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা নাহল ১০৬ আয়াত।

[4]. আবু নু‘আইম, হিলইয়াতুল আউলিয়া ১/১৪৮; তানতাভী, তাফসীর সূরা লায়েল ১৯-২০ আয়াত, ১৩/২০৪ পৃঃ।

[5]. হাকেম হা/৫৬৭৪; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৩৮৬।

[6]. আল-ইছাবাহ, ‘আম্মার ক্রমিক ৫৭০৮; আল-ইস্তী‘আব ক্রমিক ১৮৬৩।


(৬) আবু জাহলের অভ্যাস ছিল এই যে,

(ক) যখন কোন অভিজাত বংশের লোক ইসলাম কবুল করতেন, তখন সে গিয়ে তাকে গালি-গালাজ করত ও তার ধন-সম্পদের ক্ষতি সাধন করবে বলে হুমকি দিত। নিজ আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে গরীব ও দুর্বল কেউ মুসলমান হয়েছে জানতে পারলে তাকে ধরে নির্দয়ভাবে পিটাতো এবং অন্যকে মারার জন্য প্ররোচিত করত। কোন ব্যবসায়ী ইসলাম কবুল করলে তাকে গিয়ে ধমক দিয়ে বলত, তোমার ব্যবসা বন্ধ করে দেব এবং তোমার মাল-সম্পদ ধ্বংস করে দেব’ (ইবনু হিশাম ১/৩২০)। এইভাবে সম্মানিত ব্যক্তিকে ইসলাম কবুলের অপরাধে অসম্মানিত করা মক্কার নেতাদের নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। আজকের সভ্য যুগেও যা চলছে বরং আরও জোরে-শোরে।


(খ) পবিত্র কুরআনেعَلَيْهَا تِسْعَةَ عَشَرَ ‘জাহান্নামের প্রহরী হ’ল ১৯জন ফেরেশতা’ (মুদ্দাছছির ৭৪/৩০) নাযিল হ’লে আবু জাহ্ল অহংকার বশে তার লোকদের বলে, ‘হে কুরায়েশ যুবকেরা! তোমাদের ১০জনে কি জাহান্নামের ১জন ফেরেশতাকে কাবু করতে পারবে না? (ইবনু কাছীর)। কেননা মুহাম্মাদ বলে, এরা তোমাদেরকে জাহান্নামে আটকে রেখে নির্যাতন করবে। অথচ তোমরা হ’লে সংখ্যায় ও শক্তিতে অনেক বেশী। তোমরা তাদের একশ’ জনের সমান’ (ইবনু হিশাম ১/৩১৩)। আবু জাহল অত্র আয়াতের ব্যাখ্যা বুঝেনি। অথবা বুঝেও দল ঠিক রাখার জন্য আসল কথা বলেনি। সেকারণ পরবর্তী আয়াতেই আল্লাহ বলে দিয়েছেন যে,


وَمَا جَعَلْنَا أَصْحَابَ النَّارِ إِلاَّ مَلاَئِكَةً وَمَا جَعَلْنَا عِدَّتَهُمْ إِلاَّ فِتْنَةً لِلَّذِيْنَ كَفَرُوْا لِيَسْتَيْقِنَ الَّذِيْنَ أُوْتُوْا الْكِتَابَ وَيَزْدَادَ الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِيْمَانًا وَلاَ يَرْتَابَ الَّذِيْنَ أُوْتُوْا الْكِتَابَ وَالْمُؤْمِنُوْنَ وَلِيَقُوْلَ الَّذِيْنَ فِي قُلُوْبِهِمْ مَرَضٌ وَالْكَافِرُوْنَ مَاذَا أَرَادَ اللهُ بِهَذَا مَثَلاً- (مدثر ৩১)-

‘আমরা ফেরেশতাদের এই সংখ্যা নির্ধারণ করেছি কাফেরদের পরীক্ষা করার জন্য। যাতে কিতাবীরা (রাসূলের সত্যতার ব্যাপারে) দৃঢ় বিশ্বাসী হয়, মুমিনদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং কিতাবীগণ ও মুমিনগণ সন্দেহ পোষণ না করে। আর যাতে যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে (মুনাফিকরা) ও কাফেররা বলে যে, এর (এই সংখ্যা) দ্বারা আল্লাহ কি বুঝাতে চেয়েছেন’? (মুদ্দাছছির ৭৪/৩১)। বর্তমান যুগেও অনেকে আবু জাহলের মত ঊনিশ-এর ব্যাখ্যায় বহু মনগড়া বিষয় উদঘাটন করে ফিৎনায় পড়েছে।[1]


[1]. লেখক প্রণীত তাফসীরুল কুরআন ৩০তম পারা (রাজশাহী, ২য় সংস্করণ : মে ২০১৩ খ্রিঃ) ১৭-১৮ পৃঃ।


(৭) আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (عَبْدُ اللهِ بْنُ مَسْعُودٍ)

উরওয়া বিন যুবায়ের স্বীয় পিতা যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন যে, আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) ছিলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পরে মক্কায় কাফেরদের সম্মুখে প্রথম প্রকাশ্যে কুরআন পাঠ করেন। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূলের ছাহাবীগণ একদিন একত্রিত হয়ে বললেন, আল্লাহর কসম! কুরায়েশরা কখনো প্রকাশ্যে কুরআন শুনেনি। অতএব কে আছে যে তাদেরকে কুরআন শুনাতে পারে? তখন আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ বললেন, আমি। এতে সবাই বলল, আমরা তোমার ব্যাপারে ভয় পাচ্ছি। বরং আমরা এমন একজন ব্যক্তিকে চাচ্ছি, যাদের গোত্র আছে। যারা তাকে রক্ষা করবে। তখন তিনি বললেন, আমাকে ছাড়ুন! আল্লাহ আমাকে রক্ষা করবেন। অতঃপর ইবনু মাসঊদ পরদিন সকালে কিছু বেলা উঠার পর কুরায়েশদের ভরা মজলিসে এসে দাঁড়ান। অতঃপর উচ্চ কণ্ঠে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে সূরা রহমান পড়তে শুরু করেন। তখন তারা বলে উঠল,مَاذَا قَالَ ابْنُ أُمِّ عَبْدٍ؟ ‘গোলামের মায়ের বেটা কি বলছে’? তাদের কেউ বলল, সে মুহাম্মাদ যা নিয়ে এসেছে, তার কিছু পাঠ করছে। তখন সবাই তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং তার মুখে মারতে শুরু করল। এভাবে প্রহৃত হয়ে ইবনু মাসঊদ তার সাথীদের নিকটে ফিরে এলেন। তখন সাথীরা তাকে বললেন, তোমার ব্যাপারে আমরা এটাই ভয় করেছিলাম। ইবনু মাসঊদ বললেন, আল্লাহর শত্রুরা এখন আমার কাছে সহজ হয়ে গেছে। যদি আপনারা চান কাল সকালে আবার গিয়ে আমি তাদের কুরআন শুনাব। সাথীরা বললেন, না। যথেষ্ট হয়েছে। তারা যা পসন্দ করেনা তুমি তাদেরকে তাই শুনিয়েছ’।[1] উল্লেখ্য যে, ইবনু মাসঊদ (রাঃ) মক্কায় ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্বের বকরীর রাখাল ছিলেন (আল-বিদায়াহ ৬/১০২)।


[1]. ইবনু হিশাম ১/৩১৪-১৫; আছার ছহীহ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৩০৩)।


(৮) খাববাব ইবনুল আরাত (خَبَّابُ بْنُ الْأَرَتِّ)

বনু খোযা‘আহ গোত্রের জনৈকা মহিলা উম্মে আনমার-এর গোলাম ছিলেন। তিনি ষষ্ঠ মুসলমান ছিলেন এবং দুর্বলদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রথম ইসলাম প্রকাশকারী এবং আললাহ্র পথে কঠিন নির্যাতন ভোগকারী’ (আল-ইছাবাহ ক্রমিক ২২১২)। মুসলমান হওয়ার অপরাধে মুশরিক নেতারা তার উপরে লোমহর্ষক নির্যাতন চালায়। নানাবিধ অত্যাচারের মধ্যে সবচাইতে মর্মান্তিক ছিল এই যে, তাকে জ্বলন্ত লোহার উপরে চিৎ করে শুইয়ে বুকের উপরে পাথর চাপা দেওয়া হয়েছিল। ফলে পিঠের চামড়া ও গোশত গলে লোহার আগুন নিভে গিয়েছিল। বারবার নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি একদিন রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে গমন করেন। তখন তিনি কা‘বা চত্বরে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছিলেন। তিনি রাসূল (সাঃ)-কে কাফেরদের বিরুদ্ধে বদ দো‘আ করার জন্য আকুলভাবে দাবী করেন। তখন উঠে রাগতঃস্বরে রাসূল (সাঃ) তাকে দ্বীনের জন্য বিগত উম্মতগণের কঠিন নির্যাতন ভোগের কথা স্মরণ করিয়ে দেন এবং বলেন,


كَانَ الرَّجُلُ فِيمَنْ قَبْلَكُمْ يُحْفَرُ لَهُ فِى الأَرْضِ فَيُجْعَلُ فِيهِ، فَيُجَاءُ بِالْمِنْشَارِ، فَيُوضَعُ عَلَى رَأْسِهِ فَيُشَقُّ بِاثْنَتَيْنِ، وَمَا يَصُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِينِهِ، وَيُمْشَطُ بِأَمْشَاطِ الْحَدِيدِ، مَا دُونَ لَحْمِهِ مِنْ عَظْمٍ أَوْ عَصَبٍ، وَمَا يَصُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِينِهِ، وَاللهِ لَيُتِمَّنَّ هَذَا الأَمْرَ حَتَّى يَسِيرَ الرَّاكِبُ مِنْ صَنْعَاءَ إِلَى حَضْرَمَوْتَ، لاَ يَخَافُ إِلاَّ اللهَ أَوِ الذِّئْبَ عَلَى غَنَمِهِ، وَلَكِنَّكُمْ تَسْتَعْجِلُوْنَ


‘তোমাদের পূর্বেকার জাতিসমূহের লোকদের দ্বীনের কারণে গর্ত খোঁড়া হয়েছে। অতঃপর তাতে নিক্ষেপ করে তাদের মাথার মাঝখানে করাত রেখে দেহকে দ্বিখন্ডিত করা হয়েছে। তথাপি তাদেরকে তাদের দ্বীন থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। লোহার চিরুনী দিয়ে গোশত ও শিরাসমূহ হাড্ডি থেকে পৃথক করে ফেলা হয়েছে। তথাপি এগুলি তাদেরকে তাদের দ্বীন থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। আল্লাহর কসম! অবশ্যই তিনি এই ইসলামী শাসনকে এমনভাবে পূর্ণতা দান করবেন যে, একজন আরোহী (ইয়ামনের রাজধানী) ছান‘আ থেকে হাযরামাউত পর্যন্ত একাকী ভ্রমণ করবে। অথচ সে আল্লাহ ব্যতীত কাউকে ভয় করবে না। অথবা তার ছাগপালের উপরে নেকড়ের ভয় করবে। কিন্তু তোমরা বড়ই ব্যস্ততা দেখাচ্ছ’।[1] এ হাদীছ শোনার পরে তার ঈমান আরও বৃদ্ধি পায়।


খাববাব কর্মকারের কাজ করতেন। তিনি কুরাইশ নেতা ‘আছ বিন ওয়ায়েল-এর জন্য একটি তরবারী তৈরী করে দেন। পরে তার মূল্য নিতে গেলে ‘আছ বলেন, আমি তোমাকে মূল্য দিব না, যতক্ষণ না তুমি মুহাম্মাদের সাথে কুফরী করবে। জবাবে খাববাব বললেন, বরং যতক্ষণ না আপনি মরবেন ও পুনরুত্থিত হবেন’। ‘আছ তাকে বিদ্রুপ করে বললেন, ‘ঠিক আছে ক্বিয়ামতের দিনেও আমার নিকটে মাল-সম্পদ ও সন্তানাদি থাকবে, সেখানে তোমার পাওনা পরিশোধ করে দিব’। তখন নাযিল হয়,أَفَرَأَيْتَ الَّذِي كَفَرَ بِآيَاتِنَا وَقَالَ لَأُوتَيَنَّ مَالاً وَوَلَدًا- أَطَّلَعَ الْغَيْبَ أَمِ اتَّخَذَ عِنْدَ الرَّحْمَنِ عَهْدًا ‘তুমি কি দেখেছ ঐ ব্যক্তিকে, যে আমার আয়াতসমূহ প্রত্যাখান করে এবং বলে, আমাকে অবশ্যই ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দেওয়া হবে’। ‘সে কি অদৃশ্য জ্ঞান সম্পর্কে অবহিত হয়েছে, না-কি দয়াময়ের নিকট থেকে সে কোন প্রতিশ্রুতি লাভ করেছে?’ (মারিয়াম ১৯/৭৭-৭৮)।[2]


এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, তারা মুসলমানদের কেবল দৈহিক নির্যাতনই করেনি, বরং জাহেলী যুগের বিখ্যাত হিলফুল ফুযূল-এর চুক্তিনামাও তারা ভঙ্গ করেছিল, যা ছিল কুরাইশদের চিরাচরিত রীতির বিরোধী। কেননা মুসলমানদের ক্ষেত্রে তারা সকল প্রকার যুলুমকে সিদ্ধ মনে করত। আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) বলেন, মুসলমানের সংখ্যা যখন কম ছিল, তখন তারা দ্বীনের কারণে ফিৎনায় পতিত হ’ত। হয় তাদেরকে হত্যা করা হ’ত, নয় তাদেরকে চরমভাবে নির্যাতন করা হ’ত। অবশেষে মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেল, তখন আর ফিৎনা রইল না’ (বুখারী হা/৪৬৫০)।


ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) একদিন খাববাবকে ডেকে বলেন, তোমার উপরে নির্যাতনের কাহিনী আমাকে একটু শুনাও। তখন তিনি নিজের পিঠ দেখিয়ে বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আমার পিঠ দেখুন। আমাকে জ্বলন্ত লোহার গনগনে আগুনের উপরে চাপা দিয়ে রাখা হ’ত। আমার পিঠের গোশত গলে উক্ত আগুন নিভে যেত’। তখন ওমর (রাঃ) বলেন, এরূপ দৃশ্য আমি ইতিপূর্বে কখনো দেখিনি’। তিনি খারেজীদের বিরুদ্ধে নাহরাওয়ানের যুদ্ধে এবং পরে ছিফফীনের যুদ্ধে আলী (রাঃ)-এর পক্ষে ছিলেন। তিনি রাসূল (সাঃ)-এর সাথে বদর-ওহোদসহ সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।


আলী (রাঃ) ৩৭ হিজরীতে ছিফফীন যুদ্ধে রওয়ানার পর ৬৩ বছর বয়সে খাববাব (রাঃ) মৃত্যুবরণ করেন। যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে আলী (রাঃ) তাঁর কবর যিয়ারত করেন। অতঃপর বলেন,رَحِمَ اللهُ خَبَّابًا، لَقَدْ أَسْلَمَ رَاغِبًا، وَهَاجَرَ طَائِعًا، وَعَاشَ مُجَاهِدًا، وَابْتُلِيَ فِي جِسْمِهِ أَحْوَالاً، وَلَنْ يُضَيِّعَ اللهُ أَجْرَهُ ‘আল্লাহ রহম করুন খাববাবের উপর, তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন আগ্রহের সাথে, হিজরত করেছিলেন আনুগত্যের সাথে, জীবন যাপন করেছেন মুজাহিদ হিসাবে, নির্যাতিত হয়েছেন দৈহিকভাবে বিভিন্ন অবস্থায়। অতএব কখনোই আল্লাহ তার পুরস্কার বিনষ্ট করবেন না’। সম্ভবতঃ যৌবনকালে লোহার আগুনে পিঠ পুড়িয়ে দেওয়ার যন্ত্রণাদায়ক ঘা থেকে পরবর্তীতে তিনি কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। যেকারণ মাঝে-মধ্যে বলতেন, মৃত্যু কামনা নিষিদ্ধ না হ’লে আমি সেটাই কামনা করতাম।[3]


ওমর ও ওছমান (রাঃ)-এর আমলে যখন মুসলমানদের সম্পদ বৃদ্ধি পায়, তখন অগ্রবর্তী মুহাজির হিসাবে খাববাব (রাঃ)-এর জন্য বড় অংকের রাষ্ট্রীয় ভাতা নির্ধারণ করা হয়। যাতে তিনি বহু সম্পদের অধিকারী হন এবং কূফাতে বাড়ি করেন। এসময় তিনি একটি কক্ষে অর্থ জমা রাখতেন। যা তার সাথীদের জানিয়ে দিতেন। অতঃপর অভাবগ্রস্তরা সেখানে যেত এবং প্রয়োজনমত নিয়ে নিত। তিনি বলতেন,وَلَقَدْ رَأَيْتُنِي مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، مَا أَمْلِكُ دِينَارًا وَلا دِرْهَمًا وَإِنَّ فِي نَاحِيَةِ بَيْتِي فِي تَابُوتِي لأَرْبَعِينَ أَلْفٍ وَافٍ وَلَقَدْ خَشِيتُ أَنْ تَكُونَ قَدْ عُجِّلَتْ لَنَا طَيِّبَاتُنَا فِي حَيَاتِنَا الدُّنْيَا ‘আমি যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে ছিলাম, তখন আমি একটি দীনার বা দিরহামেরও মালিক ছিলাম না। আর এখন আমার সিন্দুকের কোণায় চল্লিশ হাযার দীনার জমা আছে। আমি ভয় পাচ্ছি আল্লাহ আমার সকল নেক আমলের ছওয়াব আমার জীবদ্দশায় আমার ঘরেই দিয়ে দেন কি-না!’। মৃত্যুর সময় তাকে পরিচর্যাকারী জনৈক সাথী বললেন,أَبْشِرْ يَا أَبَا عَبْدِ اللهِ، فَإِنَّكَ مُلاَقٍ إِخْوَانَكَ غَدًا ‘হে আবু আব্দুল্লাহ! সুসংবাদ গ্রহণ করুন। কেননা কালই আপনি আপনার সাথীদের সঙ্গে মিলিত হবেন’। জবাবে তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন,ذَكَّرتموني أقواماً، وإخواناً مَضَوْا بِأُجُورهم كُلِّهَا لَمْ يَنالُوا مِنَ الدُّنيا شَيْئًا ‘তোমরা আমাকে এমন ভাইদের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে, যারা তাদের সম্পূর্ণ নেকী নিয়ে বিদায় হয়ে গেছেন। দুনিয়ার কিছুই তারা পাননি’। আর আমরা তাঁদের পরে বেঁচে আছি। অবশেষে দুনিয়ার অনেক কিছু পেয়েছি। অথচ তাঁদের জন্য আমরা মাটি ব্যতীত কিছুই পাইনি। এসময় তিনি তার বাড়ি এবং বাড়ির সম্পদ রাখার কক্ষের দিকে ইঙ্গিত করেন। তিনি বলেন, মদীনায় প্রথম দাঈ ও ওহোদ যুদ্ধের পতাকাবাহী মুছ‘আব বিন উমায়ের শহীদ হওয়ার পর কিছুই ছেড়ে যায়নি একটি চাদর ব্যতীত। অতঃপর তিনি তার কাফনের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, রাসূল (সাঃ)-এর চাচা হামযার জন্য এতটুকু কাফনও জুটেনি। মাথা ঢাকলে পা ঢাকেনি। পা ঢাকলে মাথা ঢাকেনি। অতঃপর সেখানে ইযখির ঘাস দিয়ে ঢাকা হয়েছিল’।[4]


[1]. বুখারী হা/৩৬১২, ৬৯৪৩; মিশকাত হা/৫৮৫৮ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়।

[2]. ইবনু হিশাম ১/৩৫৭; আহমাদ হা/২১১০৫, ২১১১২; সনদ ছহীহ -আরনাঊত্ব।

[3]. ত্বাবারাণী কাবীর হা/৩৬১৮; মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৫৬৩২; আল-ইছাবাহ, খাববাব ক্রমিক ২২১২।

[4]. ইবনু সা‘দ, ত্বাবাক্বাতুল কুবরা ৩/১২২-২৩; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৮৪।


উল্লেখ্য যে, ছাহাবীগণের উপর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে ইবনু ইসহাক সাঈদ বিন জুবায়ের হ’তে বর্ণনা করেন যে, আমি আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ)-কে বললাম, মুশরিকরা কি ছাহাবীগণকে দ্বীন ত্যাগ করার শর্তে শাস্তি দিত? জবাবে তিনি বললেন, হ্যাঁ, আল্লাহর কসম! যখন তারা মুসলমানদের কাউকে মারপিট করত, তাদেরকে ক্ষুধার্ত রাখত ও পিপাসায় কাতর করে ফেলত এবং অবশেষে অবস্থা এমন হ’ত যে, তারা উঠে বসার ক্ষমতা রাখত না। তখন তাদের বলা হ’ত, আল্লাহকে ছেড়ে লাত-‘উযযাকে উপাস্য ধর। তারা না বললে আরও কঠিনভাবে অত্যাচার করা হ’ত। ফলে তারা বলতেন, হ্যাঁ। এমনকি গোবরের বড় কালো পোকা তাদের কারু সামনে এনে বলা হ’ত এই পোকা কি তোমার উপাস্য? কঠিন কষ্টের কারণে তিনি বলতেন, হ্যাঁ’ (ইবনু হিশাম ১/৩২০; ফাৎহুল বারী হা/৩৮৫৬-এর আলোচনা)। এ বক্তব্য যঈফ (মা শা-‘আ ৩৪ পৃঃ)। বরং সঠিক সেটাই যা ইবনু মাসঊদ (রাঃ) কর্তৃক ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে (আহমাদ হা/৩৮৩২)।


দুর্বলদের প্রতি নির্দেশনা (توجيهات إلى الضعفاء)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনায় গিয়ে মক্কার দুর্বল ছাহাবীদের জন্য দো‘আ করতে থাকেন এবং তাদেরকে নির্দেশ দেন, যেন তারা ছবর করে’ (নিসা ৪/৭৭)। তারা যেন শক্তির বিপরীতে শক্তি প্রদর্শন না করে ও শত্রুতার বিপরীতে শত্রুতা না করে। যাতে তারা বেঁচে থাকে এবং ভবিষ্যতে দ্বীনের শক্তি বৃদ্ধি করতে পারে। অবশেষে আল্লাহ মক্কা বিজয় দান করেন এবং সবাইকে নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত করেন (সীরাহ ছহীহাহ ১/১৫৮)।


নির্যাতিত মুহাজির মুসলমানদের সুসংবাদ দিয়ে আল্লাহ বলেন,


فَاسْتَجَابَ لَهُمْ رَبُّهُمْ أَنِّي لاَ أُضِيعُ عَمَلَ عَامِلٍ مِنْكُمْ مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى بَعْضُكُمْ مِنْ بَعْضٍ فَالَّذِينَ هَاجَرُوا وَأُخْرِجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ وَأُوذُوا فِي سَبِيلِي وَقَاتَلُوا وَقُتِلُوا لَأُكَفِّرَنَّ عَنْهُمْ سَيِّئَاتِهِمْ وَلَأُدْخِلَنَّهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ ثَوَابًا مِنْ عِنْدِ اللهِ وَاللهُ عِنْدَهُ حُسْنُ الثَّوَابِ- (آل عمران 195)-

‘অতঃপর তাদের প্রতিপালক তাদের দো‘আ কবুল করলেন এই মর্মে যে, পুরুষ হৌক বা নারী হৌক আমি তোমাদের কোন কর্মীর কর্মফল বিনষ্ট করব না। তোমরা পরস্পরে এক (অতএব কর্মফল প্রাপ্তিতে সবাই সমান)। অতঃপর যারা হিজরত করেছে ও নিজ বাড়ী থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে এবং আমার রাস্তায় নির্যাতিত হয়েছে। যারা লড়াই করেছে ও নিহত হয়েছে, অবশ্যই আমি তাদের দোষ-ত্রুটিসমূহ মার্জনা করব এবং অবশ্যই আমি তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবো, যার তলদেশ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত। এটি আল্লাহর নিকট হতে প্রতিদান। বস্ত্ততঃ আল্লাহর নিকটেই রয়েছে সর্বোত্তম পুরস্কার’ (আলে ইমরান ৩/১৯৫)।


বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী (تنبؤ الفتح)

ছাহাবায়ে কেরামের মধ্যে বিশেষ করে দুর্বলদের উপরে কাফের নেতাদের পক্ষ হ’তে যখন অবর্ণনীয় নির্যাতনসমূহ করা হচ্ছিল। তখন একদিন অন্যতম নির্যাতিত ছাহাবী খাববাব ইবনুল আরাত এসে রাসূল (সাঃ)-কে কাফেরদের বিরুদ্ধে বদদো‘আ করার আহবান জানান। রাসূল (সাঃ) তখন কা‘বাগৃহের ছায়ায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিলেন।[1] খাববাবের কথা শুনে তিনি উঠে বসেন এবং রাগতস্বরে বলেন, যা ইতিপূর্বে বলা হয়েছে।


মদীনায় হিজরতের পরেও ৯ম হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে ইসলাম কবুল করতে আসা খ্রিষ্টান নেতা ‘আদী বিন হাতেমকে তিনি একই ধরনের জবাব দিয়ে বলেছিলেন, يَا عَدِىُّ هَلْ رَأَيْتَ الْحِيرَةَ؟ قُلْتُ لَمْ أَرَهَا وَقَدْ أُنْبِئْتُ عَنْهَا. قَالَ فَإِنْ طَالَتْ بِكَ حَيَاةٌ لَتَرَيَنَّ الظَّعِينَةَ تَرْتَحِلُ مِنَ الْحِيرَةِ حَتَّى تَطُوفَ بِالْكَعْبَةِ، لاَ تَخَافُ أَحَدًا إِلاَّ اللهَ، ‘হে ‘আদী! তুমি কি (ইরাকের) হীরা নগরী চেন? তিনি বললেন, আমি দেখিনি। তবে তার সম্পর্কে শুনেছি। রাসূল (সাঃ) বললেন, যদি তোমার হায়াত দীর্ঘ হয়, তাহ’লে তুমি দেখবে, একজন হাওদানশীন মহিলা একাকী সেখান থেকে গিয়ে কা’বাগৃহ তাওয়াফ করে ফিরে আসবে। অথচ সে কাউকে ভয় পাবে না আল্লাহ ব্যতীত’। ... ‘আদী বলেন, আমি পর্দানশীন মহিলাকে হীরা নগরী থেকে একাকী সফর করে কা‘বাগৃহ তাওয়াফ করে ফিরে আসতে দেখেছি। সে আল্লাহ ব্যতীত কাউকে ভয় করেনি। আমি পারস্য সম্রাট কিসরার অর্থ ভান্ডার বিজয়ে শরীক হয়েছি। এরপর যদি তোমাদের হায়াত দীর্ঘ হয়, তাহ’লে তোমরা অবশ্যই বাস্তবে দেখতে পাবে, যা নবী আবুল ক্বাসেম (সাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছেন যে, তোমরা অঞ্জলী ভরা অর্থ নিয়ে বের হবে। অথচ তা দান করার মত কোন গ্রহিতা খুঁজে পাবে না’।[2]


[1]. বুখারী হা/৩৬১২; মিশকাত হা/৫৮৫৮।

[2]. বুখারী হা/৩৫৯৫; আহমাদ হা/১৮২৮৬; মিশকাত হা/৫৮৫৭, ‘নবুঅতের নিদর্শনসমূহ’ অনুচ্ছেদ।


আরক্বামের গৃহে প্রচার কেন্দ্র (دار الأرقم دار الدعوة)

মুসলমানগণ পাহাড়ের পাদদেশে ও বিভিন্ন গোপন স্থানে মিলিত হয়ে জাম‘আতের সাথে ছালাত আদায় করতেন এবং দ্বীনের তা‘লীম নিতেন। একদিন কতিপয় মুশরিক এটা দেখে ফেলে এবং মুসলমানদের অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিতে দিতে তাদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তখন হযরত সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ (রাঃ) তাদের একজনকে উটের চোয়ালের শুকনো হাড্ডি দিয়ে মেরে রক্তাক্ত করেন। ফলে তারা পালিয়ে যায়। এটিই ছিল ইসলামের জন্য প্রথম রক্ত প্