Five Pillars of Islam The profession of Faith (Shahadah) Prayer (Salah) Alms (Zakat) Fasting (Sawm) Pilgrimage (Hajj) What are The Five Pillars of Islam Explained 5 pillars of Islam in English? 5 Pillars of Islam Prophet Muhammad Sallallahu Alayhi Wa Sallam came to teach us many things and the most important of them are the five pillars of Islam do you know the five pillars let's say them together with number one a Shahada to say ASH-HADU ANNA LA ILAHA ILLA ALLAHU WA ASH-HADU ANNA MUHAMMADAN ABDUHU WA RASULUHU which means there is no one worthy of worship except Allah and that Muhammad Sallallahu Alayhi Wa Sallam is his final messenger number two is salat the prayer the five daily prayers number three zakat to give the yearly charity number four ECM fast in the month of Ramadan and number five is Hajj going to Mecca and performing the pilgrimage Salah will be the first pillar that Allah will ask us about on the day of judgment so it is very important to pray on time and concen
রাসুল সাঃ এর: স্ত্রীগণ (الأزواج المطهرات)
বিভিন্ন সময়ে রাসূল (সাঃ)-এর মোট ১১ জন স্ত্রী ছিলেন। তন্মধ্যে হযরত খাদীজা ও যয়নব বিনতে খুযায়মা (রাঃ) রাসূল (সাঃ)-এর জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণ করেন। বাকী ৯ জন স্ত্রী রেখে তিনি মারা যান। যারা হ’লেন যথাক্রমে হযরত সওদা, আয়েশা, হাফছাহ, উম্মে সালামাহ, যয়নব বিনতে জাহশ, জুওয়াইরিয়াহ, উম্মে হাবীবাহ, ছাফিইয়াহ ও মায়মূনা বিনতুল হারেছ (রাঃ)।
এতদ্ব্যতীত আরও দু’জন মহিলার সাথে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু সহবাসের পূর্বেই তারা পরিত্যক্ত হন। প্রথমজন আসমা বিনতে নু‘মান আল-কিনদিয়াহ। যিনি ‘জাউনিয়াহ’ (الْجَوْنِيَّةُ) বলেও পরিচিত (ফাৎহুল বারী হা/৫২৫৫-এর ব্যাখ্যা)। তাকে কিছু মাল-সম্পদ দিয়ে বিদায় করা হয়। দ্বিতীয়জন ‘আমরাহ বিনতে ইয়াযীদ আল-কিলাবিয়াহ।[1]
এছাড়াও তাঁর দু’জন দাসী ছিল। একজন খ্রিষ্টান কন্যা মারিয়া ক্বিবত্বিয়াহ। যাকে মিসররাজ মুক্বাউক্বিস হাদিয়াস্বরূপ পাঠিয়েছিলেন। অন্যজন ইহূদী কন্যা রায়হানা বিনতে যায়েদ আল-কুরাযিয়াহ। ইনি বনু কুরায়যার যুদ্ধে বন্দী হন। আবু ওবায়দাহ আরও দু’জন দাসীর কথা বলেছেন। যাদের একজন জামীলা। যিনি কোন এক যুদ্ধের বন্দীনী ছিলেন। অন্যজন তাঁর স্ত্রী যয়নব বিনতে জাহ্শ (রাঃ) কর্তৃক হেবাকৃত।[2]
তাঁর স্ত্রীগণের মধ্যে কুরায়শী ছিলেন ৬ জন। যারা ছিলেন বিভিন্ন কুরায়েশ গোত্রের। যেমন খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ আল-আসাদী, আয়েশা বিনতে আবুবকর আত-তামীমী, হাফছাহ বিনতে ওমর আল-‘আদাভী, উম্মে হাবীবাহ রামলাহ বিনতে আবু সুফিয়ান আল-উমুভী, উম্মু সালামাহ বিনতে আবু উমাইয়া মাখযূমী ও সাওদা বিনতে যাম‘আহ আল-‘আমেরী (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুন্না)।[3] স্ত্রীদের মধ্যে একমাত্র ইহূদী কন্যা ছিলেন ছাফিইয়াহ বিনতে হুয়াই বিন আখত্বাব। ইহূদী ও খ্রিষ্টান কন্যারা সবাই ইসলাম কবুল করেন।
[1]. বুখারী হা/৫২৫৪-৫৫; ইবনু হিশাম ২/৬৪৭।
[2]. আর-রাহীক্ব ৪৭৩-৭৫ পৃঃ; যাদুল মা‘আদ ১/১০২।
[3]. ইবনু হিশাম ২/৬৪৮। সুহায়লী আরও ৫জন স্ত্রীর নাম বলেছেন। যা প্রসিদ্ধ নয় (ঐ, টীকা)।
নবীপত্নীগণের মর্যাদা (مناقب أمهات المؤمنين) :
১. পবিত্র কুরআনে তাঁদেরকে يَا نِسَاءَ النَّبِيِّ ‘হে নবীপত্নীগণ’ বলে সম্বোধন করে সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে (আহযাব ৩৩/৩০, ৩২)। অন্যত্র أَزْوَاجِكَ ‘তোমার স্ত্রীগণ’ (আহযাব ৩৩/২৮, ৫৯; তাহরীম ৬৬/১-২) বলা হয়েছে। ‘যাওজ’ (زَوْجٌ) অর্থ জোড়া, সমতুল্য, সমপর্যায়ভুক্ত বস্ত্ত। যেমন বলা হয়, زَوْجَا خُفٍّ ‘মোযার দু’টি জোড়া’। রাসূল (সাঃ)-এর স্ত্রীগণকে তাঁর أَزْوَاج বলার মাধ্যমে তাঁদেরকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছে। অথচ امْرَأَةٌ (স্ত্রী) শব্দ বলা হয়নি, যা অন্যান্য নবী এবং নবী নন এমন সকলের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে (তাহরীম ৬৬/১০)। যেমন- হযরত নূহ ও লূত (আঃ)-এর স্ত্রীদের ক্ষেত্রে امْرَأَتَ نُوْحٍ وَامْرَأَتَ لُوْطٍ ‘নূহের স্ত্রী, লূত্বের স্ত্রী’ বলা হয়েছে। অন্যদিকে ফেরাঊনের স্ত্রীর ক্ষেত্রে, امْرَأَتَ فِرْعَوْنَ (তাহরীম ৬৬/১১) এবং আবু লাহাবের স্ত্রীর ক্ষেত্রে امْرَأَتُهُ (লাহাব ১১১/৪) বলা হয়েছে। ইবরাহীমের স্ত্রীর ক্ষেত্রে امْرَأَتُهُ বা ‘তার স্ত্রী’ (যারিয়াত ৫১/২৯) এবং أَهْلَ الْبَيْتِ বা ‘পরিবার’ (হূদ ১১/৭৩) বলে দু’ধরনের শব্দ এসেছে। তবে যাকারিয়ার স্ত্রীর ক্ষেত্রে امْرَأَتِيْ (মারিয়াম ১৯/৫) এবং زَوْجَهُ (আম্বিয়া ২১/৯০) দু’টি শব্দ এসেছে। কিন্তু শেষনবীর স্ত্রীগণের ক্ষেত্রে কেবল أَزْوَاج শব্দ খাছ করার মাধ্যমে তাঁদের মর্যাদাকে অন্য সকলের উপর বিশেষভাবে উন্নীত করা হয়েছে।
২. নবীপত্নীগণের মর্যাদা পৃথিবীর সকল মহিলার উপরে। যেমন আল্লাহ বলেন, لَسْتُنَّ كَأَحَدٍ مِنَ النِّسَاءِ ‘তোমরা অন্য কোন মহিলার মত নও’ (আহযাব ৩৩/৩২)। এখানে كَأَحَدٍ শব্দ ব্যবহার করায় নবী ও নবী নন, সকলের স্ত্রী ও সকল মহিলাকে বুঝানো হয়েছে। নবীপত্নীগণের উচ্চ মর্যাদায় স্বয়ং আল্লাহ প্রদত্ত এই অনন্য সনদ নিঃসন্দেহে গৌরবের এবং একই সাথে মুসলিম উম্মাহর জন্য নিঃসন্দেহে ঈর্ষণীয় বিষয়।
৩. আল্লাহ নবীপত্নীগণকে নিষ্কলংক ঘোষণা করেছেন এবং তাদের গৃহকে সকল প্রকারের আবিলতা ও পংকিলতা হ’তে মুক্ত বলেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন,إِنَّمَا يُرِيدُ اللهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا ‘হে নবী পরিবার! আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পূত-পবিত্র করতে’ (আহযাব ৩৩/৩৩)।
৪. আল্লাহ নবীপত্নীগণের গৃহগুলিকে ‘অহীর অবতরণ স্থল’ (مَهْبِطُ الْوَحْيِ) হিসাবে ঘোষণা করেছেন। যা তাঁদের মর্যাদাকে শীর্ষ স্থানে পৌঁছে দিয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَاذْكُرْنَ مَا يُتْلَى فِي بُيُوتِكُنَّ مِنْ آيَاتِ اللهِ وَالْحِكْمَةِ إِنَّ اللهَ كَانَ لَطِيفًا خَبِيرًا ‘আল্লাহর আয়াতসমূহ এবং হিকমতের (হাদীছের) কথাসমূহ, যা তোমাদের গৃহে পঠিত হয়, সেগুলি তোমরা স্মরণ রাখ। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতীব সূক্ষ্মদর্শী ও সকল বিষয়ে অবহিত’ (আহযাব ৩৩/৩৪)।
৫. নবীর মৃত্যুর পরে তাঁরা সকলের জন্য ‘হারাম’ এবং তাঁরা ‘উম্মতের মা’(وَأَزْوَاجُهُ أُمَّهَاتُهُمْ) হিসাবে চিরদিনের জন্য বরণীয় হয়েছেন (আহযাব ৩৩/৫৩; ৩৩/৬)। সরাসরি আল্লাহ কর্তৃক ঘোষিত এই মর্যাদা পৃথিবীর কোন মহিলার ভাগ্যে হয়নি। অতএব সত্যিকারের মুমিন সেই ব্যক্তি যিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে নিজের জীবনের চাইতে ভালবাসেন এবং তাঁর স্ত্রীগণকে মায়ের মর্যাদায় সম্মান প্রদর্শন করেন।
৬. প্রথমা স্ত্রী খাদীজা (রাঃ) ছিলেন বিশ্বসেরা চারজন সম্মানিতা মহিলার অন্যতম। যেমন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,أَفْضَلُ نِسَاءِ أَهْلِ الْجَنَّةِ خَدِيجَةُ بِنْتُ خُوَيْلِدٍ وَفَاطِمَةُ بِنْتُ مُحَمَّدٍ وَمَرْيَمُ بِنْتُ عِمْرَانَ وَآسِيَةُ بِنْتُ مُزَاحِمٍ امْرَأَةُ فِرْعَوْنَ ‘জান্নাতী মহিলাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হ’লেন খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মাদ, মারিয়াম বিনতে ইমরান ও ফেরাঊনের স্ত্রী আসিয়া বিনতে মুযাহিম’।[1]
(ক) খাদীজা (রাঃ) ছিলেন সেই মহীয়সী মহিলা যাকে জিব্রীল নিজের পক্ষ হ’তে ও আল্লাহর পক্ষ হ’তে রাসূল (সাঃ)-এর মাধ্যমে সালাম দেন এবং জান্নাতে তাঁর জন্য বিশেষভাবে নির্মিত মুক্তাখচিত প্রাসাদের সুসংবাদ দেন।[2] (খ) স্ত্রী আয়েশা (রাঃ)-কে জিব্রীল (আঃ) রাসূল (সাঃ)-এর মাধ্যমে সালাম পাঠান এবং তিনিও তার সালামের জওয়াব দেন (বুখারী হা/৬২০১)। তিনি ছিলেন রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে সর্বাধিক প্রিয় (বুখারী হা/৩৬৬২)।
[1]. আহমাদ হা/২৬৬৮, সনদ ছহীহ; তিরমিযী হা/৩৮৭৮; মিশকাত হা/৬১৮১।
[2]. বুখারী হা/১৭৯২, ৩৮২০; মুসলিম হা/২৪৩৩; মিশকাত হা/৬১৭৬।
আলী, ফাতেমা ও তাদের সন্তানগণের মর্যাদা (مناقب على وفاطمة و أولادهما)
(ক) আলী (রাঃ) সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,أَنْتَ مِنِّى بِمَنْزِلَةِ هَارُونَ مِنْ مُوسَى إِلاَّ أَنَّهُ لاَ نَبِىَّ بَعْدِى ‘তুমি আমার নিকট মূসার নিকটে হারূনের ন্যায়। কেবল এটুকুই যে, আমার পরে কোন নবী নেই (মুসলিম হা/২৪০৪)। তিনি বলেন, مَنْ كُنْتُ مَوْلاَهُ فَعَلِىٌّ مَوْلاَهُ ‘আমি যার বন্ধু, আলী তার বন্ধু’ (তিরমিযী হা/৩৭১৩)। নাজরানের খ্রিষ্টান নেতাদের সাথে মুবাহালার জন্য রাসূল (সাঃ) আলী, ফাতেমা ও হাসান-হোসায়েনকে সাথে নিয়ে বের হন এবং বলেন, اللَّهُمَّ هَؤُلاَءِ أَهْلِى ‘হে আল্লাহ! এরাই আমার পরিবার’ (মুসলিম হা/২৪০৪)।
(খ) কন্যা ফাতেমা (রাঃ) ছিলেন বিশ্বসেরা চারজন সম্মানিতা মহিলার অন্যতম (তিরমিযী হা/৩৮৭৮)। তাঁকে রাসূল (সাঃ) سَيِّدَةُ نِسَاءِ أَهْلِ الْجَنَّةِ ‘জান্নাতী মহিলাদের নেত্রী’ বলেছেন (বুখারী হা/৩৬২৪)।
(গ) দুই নাতি হাসান ও হোসাইন (রাঃ)-কে রাসূল (সাঃ) رَيْحَانَتَاىَ مِنَ الدُّنْيَا ‘দুনিয়াতে আমার সুগন্ধি’ (বুখারী হা/৩৭৫৩) এবং سَيِّدَا شَبَابِ أَهْلِ الْجَنَّةِ ‘জান্নাতী যুবকদের নেতা’ বলেছেন (তিরমিযী হা/৩৭৮১)।
বস্ত্ততঃ নবীগণ বেঁচে থাকেন তাঁদের উম্মতের মধ্যে। সন্তানদের মাধ্যমে বেঁচে থাকাটা আবশ্যক নয়। শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর জীবনেও আমরা সেটাই দেখতে পাই। বিশ্বের সর্বত্র তাঁর উম্মত রয়েছে এবং ক্বিয়ামতের দিন তাঁর উম্মত সংখ্যাই হবে সর্বাধিক।[1] এমনকি তারা জান্নাতবাসীদের অর্ধেক হবে। আর তাদের তুলনা হবে সমস্ত মানুষের মধ্যে কালো বলদের দেহে একটি সাদা লোমের ন্যায়’।[2]
[1]. মুসলিম হা/১৯৬, মিশকাত হা/৫৭৪২; বুখারী হা/৪৯৮১; মুসলিম হা/১৫২; মিশকাত হা/৫৭৪৬।
[2]. বুখারী হা/৩৩৪৮; মুসলিম হা/২২১; মিশকাত হা/৫৫৪১।
নবী পরিবারের মর্যাদা সর্বোচ্চ হ’লেও তাঁদের মৃত্যুর পরে তাঁদের অসীলায় আল্লাহর নিকটে রোগমুক্তি কামনা করা শিরক। যে বিষয়ে কুরআন ও হাদীছে কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে। শী‘আরা পাঁচ জনের অসীলায় বিপদমুক্তি কামনা করে থাকেন। যেমন তারা বলেন,لِىْ خَمْسةٌ أُطْفِئُ بِهَا البَلاءَ القَاتِمَةَ + الْمُصْطَفَى والْمُرْتَضَى وإِبنَاهِمَا والفَاطِمَةَ ‘আমার জন্য পাঁচজন ব্যক্তি রয়েছেন। যাদের মাধ্যমে আমি কঠিন বিপদ সমূহ নির্বাপিত করি। মুছত্বফা, মুর্তাযা, তাঁর দুই পুত্র এবং ফাতেমা’। সুন্নী নামধারী বহু কবরপূজারী তাদের ভক্তি ভাজন কবরস্থ ব্যক্তির নাম ধরে তার অসীলায় অনুরূপ বিপদমুক্তি কামনা করে থাকেন। যেগুলি পরিষ্কারভাবে শিরক। কুরায়েশ কাফেররাও এরূপ করত। যার প্রতিবাদে আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যকে অভিভাবক রূপে গ্রহণ করে, (তারা যুক্তি দেখায় যে,) আমরা ওদের পূজা করিনা কেবল এজন্য যে ওরা আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছে দিবে’ (যুমার ৩৯/৩)। ‘তারা বলে, ওরা আমাদের জন্য আল্লাহর নিকট সুফারিশকারী’ (ইউনুস ১০/১৮)।
এক নযরে উম্মাহাতুল মুমিনীন (أمهاة المؤمنين فى لمحة)
১. খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ (خَدِيجَةُ بِنْتُ خُوَيْلِدٍ) : বিবাহকালে রাসূল (সাঃ)-এর বয়স ছিল ২৫ ও তাঁর বয়স ৪০; মৃত্যুসন- রামাযান ১০ম নববী বর্ষ; দাফন- মক্কার ‘হাজূনে’; মৃত্যুকালে বয়স ৬৫। রাসূল (সাঃ)-এর সাথে তাঁর দাম্পত্যকাল- ২৪ বছর ৬ মাস বা প্রায় ২৫ বছর। তিনি বেঁচে থাকা অবধি রাসূল (সাঃ) দ্বিতীয় বিয়ে করেননি।
জ্ঞাতব্য : পূর্বে তিনি দুই স্বামী হারান। প্রথম স্বামী ছিলেন উতাইয়িক্ব বিন ‘আবেদ বিন আব্দুল্লাহ মাখযূমী। তাঁর ঔরসে এক ছেলে আব্দুল্লাহ ও এক মেয়ে জন্ম নেয় (ইবনু হিশাম ২/৬৪৩-৪৪)। তার মৃত্যুর পর ২য় স্বামী আবু হালাহ বিন মালেক তামীমী-এর ঔরসে হালাহ, তাহের ও হিন্দ নামে ৩ পুত্র ছিল। যারা সবাই পরে ছাহাবী হন’ (আল-ইছাবাহ ক্রমিক ১১০৮৬, ৮৯১৯, ৪২৩৮, ৯০১৩)। মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ছিলেন তাঁর তৃতীয় স্বামী এবং তিনি ছিলেন তাঁর প্রথমা স্ত্রী। রাসূল (সাঃ)-এর ঔরসে তাঁর দুই ছেলে ক্বাসেম ও আব্দুল্লাহ ও চার মেয়ে যয়নব, রুক্বাইয়াহ, উম্মে কুলছূম ও ফাতেমা জন্মগ্রহণ করেন। প্রথম সন্তান ক্বাসেমের নামেই তাঁর উপনাম ছিল আবুল ক্বাসেম। পুত্র আব্দুল্লাহর লক্বব ছিল ত্বাইয়িব ও ত্বাহের’ (ইবনু হিশাম ১/১৯০)। জাহেলী যুগে খাদীজা ‘ত্বাহেরাহ’ (طَاهِرَةٌ) অর্থ ‘পবিত্রা’ নামে এবং ইসলামী যুগে ‘ছিদ্দীক্বাহ’ (صِدِّيْقَةٌ) অর্থ ‘নবুঅতের সত্যতায় প্রথম বিশ্বাস স্থাপনকারিণী’ নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন।[1] প্রথমা ও বড় স্ত্রী হিসাবে তিনি ‘খাদীজাতুল কুবরা’ নামেও পরিচিত।
২. সওদা বিনতে যাম‘আহ (سَوْدَةُ بِنْتُ زَمْعَةَ) : রাসূল (সাঃ)-এর বয়স ৫০, তাঁর বয়স ৫০, বিবাহ সন- শাওয়াল ১০ম নববী বর্ষ, মৃত্যুসন- ১৯ হি.; দাফন- মদীনা; বয়স ৭২। রাসূল (সাঃ)-এর সাথে দাম্পত্য জীবন- ১৪ বছর। রাসূল (সাঃ)-এর মৃত্যুর পর স্ত্রীদের মধ্যে তিনিই প্রথম মৃত্যুবরণ করেন।
জ্ঞাতব্য : ইনি প্রথমদিকে ইসলাম কবুল করেন। পরে তাঁর উৎসাহে স্বামী সাকরান বিন ‘আমর মুসলমান হন। অতঃপর উভয়ে হাবশায় হিজরত করেন। সাকরান সেখান থেকে মক্কায় ফিরে এসে মুসলিম অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তখন সন্তানদের নিয়ে তার বিধবা স্ত্রী সওদা চরম বিপাকে পড়েন। একই সময়ে খাদীজাকে হারিয়ে বিপদগ্রস্ত রাসূল (সাঃ) বাধ্য হয়ে সংসারে পটু সওদাকে বিয়ে করেন ও তার হাতে সদ্য মাতৃহারা সন্তানদের দায়িত্ব অর্পণ করেন। তাঁর বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা ৫টি। তন্মধ্যে ১টি বুখারীতে ও ৪টি সুনানে আরবা‘আহতে।
উল্লেখ্য যে, সাকরান হাবশায় গিয়ে ইসলাম ত্যাগ করে নাছারা হন ও সেখানে মৃত্যুবরণ করেন মর্মে ত্বাবারী ও ইবনুল আছীর যে বর্ণনা করেছেন, তা ছহীহ বা যঈফ কোনভাবেই প্রমাণিত নয় (মা শা-‘আ পৃঃ ৪৪-৪৫)।
৩. আয়েশা বিনতে আবুবকর (عَائِشَةُ بِنْتُ أَبى بَكْرٍ) : রাসূল (সাঃ)-এর বয়স ৫৪, বিবাহ সন- শাওয়াল ১১ নববী বর্ষ। বিয়ের সময় বয়স ৬, স্বামীগৃহে আগমনের বয়স ৯, শাওয়াল ১ হিজরী, মৃত্যুসন- ৫৭ হি.; দাফন- মদীনা; বয়স- ৬৩। দাম্পত্য জীবন-১০ বছর।
জ্ঞাতব্য : ইনিই একমাত্র কুমারী স্ত্রী ছিলেন। কোন সন্তানাদি হয়নি। নবীপত্নীগণের মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বাধিক জ্ঞানী, বুদ্ধিমতী ও হাদীছজ্ঞ মহিলা। জ্যেষ্ঠ ছাহাবীগণ বিভিন্ন ফাৎওয়ায় তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করতেন ও তাঁর সিদ্ধান্তকে অগ্রাধিকার দিতেন (যাদুল মা‘আদ ১/১০৩)। আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) বলেন, আমরা কোন বিষয়ে আটকে গেলে আয়েশা (রাঃ)-এর নিকটে গিয়ে তার সমাধান নিতাম (তিরমিযী হা/৩৮৮৩)। তাঁর বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা ২২১০টি। তন্মধ্যে ১৭৪টি মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, ৫৪টি এককভাবে বুখারী ও ৯টি এককভাবে মুসলিম। বাকী ১৯৭৩টি মুসনাদে আহমাদ সহ অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে।[2]
উল্লেখ্য যে, আয়েশা (রাঃ)-এর পিতা আবুবকর (রাঃ) ছিলেন একমাত্র ছাহাবী, যাঁর পরিবারে চারটি স্তরের সবাই মুসলমান ছিলেন। যা অন্য কোন ছাহাবীর মধ্যে পাওয়া যায় না’ (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/১৫৯)। অর্থাৎ আবুবকর (রাঃ) নিজে, তাঁর পিতা-মাতা ও পুত্র-কন্যাগণ এবং তাদের সন্তানগণ।
৪. হাফছাহ বিনতে ওমর(حَفْصَةُ بِنْتُ عُمَرَ) : রাসূল (সাঃ)-এর বয়স ৫৫, তাঁর বয়স ২২, বিবাহ শা‘বান ৩ হিজরী; মৃত্যুসন-৪১হি.; দাফন- মদীনা; বয়স-৫৯। দাম্পত্য জীবন- ৮ বছর।
জ্ঞাতব্য : তাঁর পূর্ব স্বামী খুনায়েস বিন হুযাফাহ সাহ্মী প্রথমে হাবশা ও পরে মদীনায় হিজরত করেন। বদর ও ওহোদ যুদ্ধে শরীক ছিলেন। ওহোদে যখমী হয়ে মারা যান। পরে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে হাফছার বিয়ে হয়। তিনি মোট ৬০টি হাদীছ বর্ণনা করেন। তন্মধ্যে মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ ৪টি, এককভাবে মুসলিম ৬টি। বাকী ৫০টি অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে। প্রখ্যাত ছাহাবী আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) ছিলেন তাঁর সহোদর ভাই।
৫. যয়নব বিনতে খুযায়মা (زَيْنَبُ بِنْتُ خُزَيْمَةَ) : রাসূল (সাঃ)-এর বয়স ৫৫; তাঁর বয়স প্রায় ৩০; বিবাহ সন ৩ হিজরী; মৃত্যুসন ৩ হি., বয়স ৩০; দাফন- মদীনা; দাম্পত্য জীবন ২ অথবা ৩ মাস।
জ্ঞাতব্য : পরপর দুই স্বামী হারিয়ে রাসূল (সাঃ)-এর ফুফাতো ভাই আব্দুল্লাহ বিন জাহশের সাথে তৃতীয় বিবাহ হয়। কিন্তু তিনি ওহোদ যুদ্ধে শহীদ হলে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে চতুর্থ বিবাহ হয়। অধিক দানশীল ও গরীবের দরদী হিসাবে তিনি ‘উম্মুল মাসাকীন’ বা ‘মিসকীনদের মা’ নামে খ্যাত ছিলেন। তিনি কোন হাদীছ বর্ণনা করেননি।
৬. উম্মে সালামাহ হিন্দ বিনতে আবু উমাইয়াহ (أُمُّ سَلَمَةَ هِنْدٌ بِنْتُ أَبِي أُمَيَّةَ) : রাসূল (সাঃ)-এর বয়স ৫৬; তাঁর বয়স ২৬; বিবাহ সন ৪ হি.; মৃত্যুসন ৬০ হি.; দাফন- মদীনা; বয়স ৮০ বছর। দাম্পত্য জীবন- ৭ বছর। স্ত্রীদের মধ্যে তিনি সবশেষে মৃত্যুবরণ করেন।
জ্ঞাতব্য : রাসূল (সাঃ)-এর আপন ফুফাতো ভাই ও দুধভাই আবু সালামাহর স্ত্রী ছিলেন। স্বামী-স্ত্রী উভয়ে হাবশায় হিজরত করেন। আবু সালামাহ বদর ও ওহোদ যুদ্ধে শরীক হন। ওহোদে যখমী হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে উম্মে সালামাহ রাসূল (সাঃ)-এর সাথে বিবাহিতা হন। তাঁর দূরদর্শিতাপূর্ণ পরামর্শ হোদায়বিয়ার সন্ধিকালে খুবই ফলপ্রসু প্রমাণিত হয় (বুখারী হা/২৭৩২)। তাঁর বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা ৩৭৮। তন্মধ্যে মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ ১৩, এককভাবে বুখারী ৩টি, মুসলিম ১৩টি। বাকী ৩৪৯টি অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে।
৭. যয়নব বিনতে জাহশ (زَيْنَبُ بِنْتُ جَحْشٍ) : রাসূল (সাঃ)-এর বয়স ৫৭; তাঁর বয়স ৩৬; বিবাহ সন ৫হি. মৃত্যুসন ২০হি.; দাফন- মদীনা; বয়স ৫১ বছর। দাম্পত্য জীবন- ৬ বছর।
জ্ঞাতব্য : রাসূল (সাঃ)-এর ফুফাতো বোন ছিলেন। প্রথমে রাসূল (সাঃ)-এর পোষ্যপুত্র যায়েদ বিন হারেছাহর সাথে বিবাহ হয়। পরে যায়েদ তালাক দিলে আল্লাহর হুকুমে তিনি তাকে বিয়ে করেন প্রচলিত দু’টি কুসংস্কার দূর করার জন্য। এক- সে যুগে পোষ্যপুত্রকে নিজ পুত্র এবং তার স্ত্রীকে নিজ পুত্রবধু মনে করা হ’ত ও তার সাথে বিবাহ নিষিদ্ধ মনে করা হ’ত। দুই- ইহূদী ও নাছারাগণ ওযায়ের ও ঈসাকে আল্লাহর পুত্র গণ্য করত (তওবা ৯/৩০)। অথচ সৃষ্টি কখনো সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সন্তান হ’তে পারে না। যেমন অপরের ঔরসজাত সন্তান কখনো নিজের সন্তান হ’তে পারে না।
তিনি মোট ১১টি হাদীছ বর্ণনা করেন। তন্মধ্যে মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ ২টি। বাকী ৯টি অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে (সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ২/২১৮)।
৮. জুওয়াইরিয়া বিনতুল হারেছ (جُوَيْرِيَةُ بِنْتُ الْحَارِثِ) : রাসূল (সাঃ)-এর বয়স ৫৭; তাঁর বয়স ২০; বিবাহ শা‘বান ৫হি.; মৃত্যু সন ৫৬হি.; দাফন- মদীনা; বয়স ৭১। দাম্পত্য জীবন- ৬ বছর।
জ্ঞাতব্য : ইনি বনু মুছত্বালিক্ব নেতা হারেছ বিন আবু যাররাবের কন্যা ছিলেন। ৫ম হিজরীতে বনু মুছত্বালিক্ব যুদ্ধে বন্দী হয়ে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে বিবাহিতা হন এবং রাসূল (সাঃ)-এর শ্বশুরকুল হওয়ার সুবাদে একশ’-এর অধিক যুদ্ধবন্দীর সবাইকে মুক্তি দেওয়া হয়। ফলে তারা সবাই মুসলমান হয়ে যায়। জুওয়াইরিয়ার প্রথম স্বামী ছিলেন মুসাফিহ বিন সুফিয়ান মুছতালিক্বী। তিনি মোট ৭টি হাদীছ বর্ণনা করেন। তন্মধ্যে বুখারী ২টি, মুসলিম ২টি। বাকী ৩টি অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে।
৯. উম্মে হাবীবাহ রামলাহ বিনতে আবু সুফিয়ান (أُمُّ حَبِيبَةَ رَمْلَةُ بِنْتِ أبي سُفْيَانَ) : রাসূল (সাঃ)-এর বয়স ৫৮; তাঁর বয়স ৩৬; বিবাহ মুহাররম ৭হি.; মৃত্যু সন- ৪৪হি.; দাফন- মদীনা; বয়স ৭২। দাম্পত্য জীবন- ৪ বছর।
জ্ঞাতব্য : কুরায়েশ নেতা আবু সুফিয়ানের কন্যা ছিলেন। ওবায়দুল্লাহ বিন জাহশ আসাদী তার প্রথম স্বামী ছিলেন। উভয়ে মুসলমান হয়ে হাবশায় হিজরত করেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে স্বামী মারা যান। তিনি একটি কন্যা সন্তান নিয়ে বিধবা হন। রাসূল (সাঃ) তার চরম বিপদের কথা জানতে পেরে ৭ম হিজরীর মুহাররম মাসে ‘আমর বিন উমাইয়া যামরীর মাধ্যমে বাদশাহ নাজাশীর নিকট পত্র প্রেরণ করেন ও তার সাথে বিবাহের পয়গাম পাঠান। নাজাশী স্বয়ং তার বিবাহের খুৎবা পাঠ করেন। তিনি রাসূল (সাঃ)-এর পক্ষে ৪০০ দীনার মোহরানা পরিশোধ করেন ও সবাইকে দাওয়াত খাওয়ান। পরে তাঁকে রাসূল (সাঃ)-এর প্রেরিত দূত শুরাহবীল বিন হাসানাহ (রাঃ)-এর মাধ্যমে মদীনায় পাঠিয়ে দেন (আল-ইছাবাহ, রামলাহ ক্রমিক ১১১৮৫)। তিনি ৬৫টি হাদীছ বর্ণনা করেন। তন্মধ্যে মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ ২টি ও মুসলিম ১টি। বাকী ৬২টি অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে।
উল্লেখ্য যে, ওবায়দুল্লাহ বিন জাহশ হাবশায় গিয়ে ‘মুরতাদ’ ও ‘নাছারা’ হয়ে গিয়েছিলেন ও উক্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন’ বলে যে ঘটনা প্রসিদ্ধ আছে, তা প্রমাণিত নয়। এ বিষয়ে ইবনু সা‘দ যে বর্ণনা এনেছেন তা ‘মুরসাল’ বা যঈফ (মা শা-‘আ পৃঃ ৩৭-৪৩)। মুবারকপুরীও তার ‘মুরতাদ’ ও ‘নাছারা’ হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন, যা যঈফ (আর-রাহীক্ব ৪৭৪ পৃঃ, ঐ, তা‘লীক্ব ১৮৬-৯২ পৃঃ)।
১০. ছাফিইয়াহ বিনতে হুয়াই বিন আখত্বাব (صَفِيَّةُ بِنْتُ حُيَىِّ بنِ أَخْطَبَ) : রাসূল (সাঃ)-এর বয়স ৫৯; তাঁর বয়স ১৭; বিবাহ ছফর ৭হি.; মৃত্যুর সন ৫০ হি.; বয়স ৬০; দাফন- মদীনা; দাম্পত্য জীবন- ৪ বছর।
জ্ঞাতব্য : খায়বর যুদ্ধে বন্দী হন। পরে ইসলাম কবুল করে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে বিবাহিতা হন। মদীনা থেকে বিতাড়িত ইহূদী বনী নাযীর গোত্রের সর্দার হুয়াই বিন আখত্বাব-এর কন্যা এবং অন্যতম সর্দার কেনানাহ বিন আবুল হুক্বাইক্ব-এর স্ত্রী ছিলেন। উভয়ে নিহত হন। হযরত হারূণ (আঃ)-এর বংশধর ছিলেন। তিনি ১০টি হাদীছ বর্ণনা করেন। তন্মধ্যে মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ ১টি। বাকী ৯টি অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। স্ত্রীদের মধ্যে ইনিই ছিলেন একমাত্র ইহূদী কন্যা।
১১. মায়মূনা বিনতুল হারেছ (مَيْمُونَةُ بِنْتُ الْحَارِثِ) : রাসূল (সাঃ)-এর বয়স ৫৯; তাঁর বয়স ৩৬; বিবাহ যুলক্বা‘দাহ ৭ হি.; মৃত্যুর সন ৫১ হি.; দাফন মক্কার নিকটবর্তী ‘সারিফে’; বয়স ৮০। দাম্পত্য জীবন- সোয়া তিন বছর।
জ্ঞাতব্য : ইনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) ও খালেদ বিন অলীদ (রাঃ)-এর আপন খালা ছিলেন এবং উম্মুল মুমিনীন হযরত যয়নব বিনতে খুযায়মার সহোদর বৈপিত্রেয় বোন ছিলেন। যিনি ইতিপূর্বে ৩ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পূর্বের দুই স্বামী মারা গেলে ভগ্নিপতি হযরত আববাস (রাঃ) রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে তার বিবাহের প্রস্তাব দেন। ফলে ৭ম হিজরীতে ক্বাযা ওমরাহ শেষে ফেরার সময় মক্কা থেকে ৬ কি.মি. উত্তরে তান‘ঈম-এর নিকটবর্তী ‘সারিফ’ (السَرِف) নামক স্থানে উক্ত বিবাহ সম্পন্ন হয়। এটিই ছিল রাসূল (সাঃ)-এর সর্বশেষ বিবাহ। তিনি মোট ৭৬টি হাদীছ বর্ণনা করেন। তন্মধ্যে মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ ৭টি, এককভাবে বুখারী ১টি, মুসলিম ৫টি। বাকী ৬৩টি অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে।[3]
[1]. মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৫২৫০; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৮১৮।
[2]. প্রসিদ্ধ আছে যে, রাসূল (সাঃ) বলতেন, خُذُوا شَطْرَ دِينِكُمْ عَنِ الْحُمَيْرَاءِ ‘তোমরা দ্বীনের অর্ধাংশ আয়েশার নিকট থেকে গ্রহণ করো’ (আল-বিদায়াহ ৩/১২৮)। হাদীছটি মওযূ‘ বা জাল (আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ১/১০)।
[3]. মানছূরপুরী, রহমাতুল্লিল ‘আলামীন, নকশা ২/১৮২, বিস্তারিত ২/১৪৪-৮১; ইবনু হিশাম ২/৬৪৩-৪৮; শাযাল ইয়াসমীন ফী ফাযায়েলে উম্মাহাতিল মুমিনীন, (কুয়েত : ওয়াক্ফ মন্ত্রণালয়, তাবি) ৩১-৩৪ পৃঃ।
এক নযরে উম্মাহাতুল মুমিনীন বর্ণিত হাদীছ সমূহ (الاحاديث المروية من امهاة المؤمنين فى لمحة)
১. সওদাহ বিনতে যাম‘আহ
এককভাবে বুখারী - ১
অন্যান্য হাদীছগ্রন্থ - ৪
মোট -৫
২. আয়েশা বিনতে আবুবকর
মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ - ১৭৪
এককভাবে বুখারী - ৫৪
এককভাবে মুসলিম - ৯
অন্যান্য হাদীছগ্রন্থ - ১৯৭৩
মোট -২২১০
৩. হাফছাহ বিনতে ওমর
মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ - ৪
এককভাবে মুসলিম - ৬
অন্যান্য হাদীছগ্রন্থ - ৫০
মোট -৬০
৪. উম্মে সালামাহ
মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ - ১৩
এককভাবে বুখারী - ৩
এককভাবে মুসলিম - ১৩
অন্যান্য হাদীছগ্রন্থ - ৩৪৯
মোট -৩৭৮
৫. যয়নব বিনতে জাহশ
মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ - ২
অন্যান্য হাদীছগ্রন্থ - ৯
মোট -১১
৬. জুওয়াইরিয়া
এককভাবে বুখারী - ২
এককভাবে মুসলিম - ২
অন্যান্য হাদীছগ্রন্থ - ৩
মোট -৭
৭. উম্মে হাবীবাহ
মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ - ২
এককভাবে মুসলিম - ১
অন্যান্য হাদীছগ্রন্থ - ৬২
মোট -৬৫
৮. ছাফিইয়াহ
মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ - ১
অন্যান্য হাদীছগ্রন্থ - ৯
মোট -১০
৯. মায়মূনাহ
মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ - ৭
এককভাবে বুখারী - ১
এককভাবে মুসলিম - ৫
অন্যান্য হাদীছগ্রন্থ - ৬৩
মোট -৭৬
------------------
সর্বমোট
মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ -২০৩
এককভাবে বুখারী - ৬১
এককভাবে মুসলিম - ৩৬
অন্যান্য হাদীছগ্রন্থ - ২৫২২
মোট -২৮২২
বি.দ্র. খাদীজা (রাঃ) থেকে কোন হাদীছ বর্ণিত হয়নি। যাহাবী মায়মূনা বিনতুল হারেছ (রাঃ) বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা ১৩টি বলেছেন (সিয়ারু আ‘লাম ২/২৪৫)। মানছূরপুরী আয়েশা (রাঃ) কর্তৃক মুসলিমে বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা ৬৭টি সহ মোট ২৩১২টি লিখেছেন (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/১৫৫)। আমরা অধিকাংশ বিদ্বানের গৃহীত সংখ্যাগুলি উল্লেখ করলাম।
ইসলামে তাঁদের অবদান (إسهامهن فى الإسلام)
মুসলিম উম্মাহর জন্য উম্মাহাতুল মুমিনীন-এর সবচাইতে বড় অবদান এই যে, তাঁদের মাধ্যমে আল্লাহর এই শ্রেষ্ঠ জাতি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পারিবারিক জীবন সম্পর্কে জানতে পেরেছে। সেই সাথে পেয়েছে অন্যূন ২৮২২টি হাদীছ। সেগুলির মধ্যে একা আয়েশা (রাঃ) ২২১০টি হাদীছ বর্ণনা করেছেন। যা মুসলিম উম্মাহর জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দিক নির্দেশিকা ধ্রুবতারার ন্যায় সর্বদা পথ দেখিয়ে থাকে। ফালিল্লাহিল হাম্দ।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর একাধিক বিবাহ পর্যালোচনা (ملاحظة على تعدد الزوجات للنبى صــ)
জানা আবশ্যক যে, ২৫ বছরের টগবগে যৌবনে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বিবাহ করেন পরপর দুই স্বামী হারা বিধবা ও কয়েকটি সন্তানের মা ৪০ বছরের একজন প্রৌঢ়া মহিলাকে। এই স্ত্রীর মৃত্যুকাল অবধি দীর্ঘ ২৫ বছর তিনি তাকে নিয়েই সংসার করেছেন। অতঃপর ৬৫ বছর বয়স্কা বৃদ্ধা স্ত্রী খাদীজার মৃত্যু হ’লে তিনি নিজের ৫০ বছর বয়সে দ্বিতীয় বিয়ে করলেন আর এক ৫০ বছর বয়সী কয়েকটি সন্তানের মা একজন বিধবা মহিলা সাওদাকে নিতান্তই সাংসারিক প্রয়োজনে। এরপর মক্কা হ’তে হিজরত করে তিনি মদীনায় চলে যান। যেখানে শুরু হয় ইসলামী সমাজ গঠনের জীবন-মরণ পরীক্ষা। ফলে মাদানী জীবনের দশ বছরে বিভিন্ন বাস্তব কারণে ও ইসলামের বিধানসমূহ বাস্তবায়নের মহতী উদ্দেশ্যে আল্লাহর হুকুমে তাঁকে আরও কয়েকটি বিবাহ করতে হয়। উল্লেখ্য যে, চারটির অধিক স্ত্রী একত্রে রাখার অনুমতি আল্লাহপাক স্রেফ তাঁর রাসূলকে দিয়েছিলেন। অন্য কোন মুসলিমের জন্য নয় (আহযাব ৩৩/৫০)।
আরও উল্লেখ্য যে, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) নিজেই নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন যে, مَا لِى فِى النِّسَاءِ مِنْ حَاجَةٍ ‘আমার জন্য মহিলার কোন প্রয়োজন নেই’ (বুখারী হা/৫০২৯)। প্রশ্ন হ’ল, তাহ’লে কেন তিনি এতগুলো বিয়ে করলেন? এর জওয়াবে আমরা নিম্নোক্ত বিষয়গুলি পেশ করব।-
(১) শত্রু দমনের স্বার্থে (لدفع الأعداء) : গোঁড়া ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন আরবীয় সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন রীতির মধ্যে একটি রীতি ছিল এই যে, তারা জামাতা সম্পর্ককে অত্যন্ত গুরুত্ব দিত। জামাতার সঙ্গে যুদ্ধ করা কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ব্যাপারটি ছিল তাদের নিকটে দারুণ লজ্জা ও অসম্মানের ব্যাপার। তাই আল্লাহ পাক স্বীয় নবীকে একাধিক বিবাহের অনুমতি দেন বর্বর বিরুদ্ধবাদী শক্তিকে ইসলামের সহায়ক শক্তিতে পরিণত করার কৌশল হিসাবে। যা দারুণ কার্যকর প্রমাণিত হয়। উদাহরণ স্বরূপ।-
(ক) ৪র্থ হিজরীতে উম্মে সালামাহকে বিবাহ করার পর তাঁর গোত্র বনু মাখযূমের স্বনামধন্য বীর খালেদ বিন অলীদের যে দুর্ধর্ষ ভূমিকা ওহোদ যুদ্ধে দেখা গিয়েছিল, তা পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং ৭ম হিজরীর শুরুতে তিনি মদীনায় এসে ইসলাম কবুল করেন।
(খ) ৫ম হিজরীতে জুওয়াইরিয়া বিনতুল হারেছকে বিবাহ করার ফলে বনু মুছত্বালিক্ব গোত্রের যুদ্ধবন্দী একশত জন ব্যক্তি সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান হয়ে যান এবং চরম বিরুদ্ধবাদী এই গোত্রটি মিত্রশক্তিতে পরিণত হয়। জুওয়াইরিয়া (রাঃ) তার কওমের জন্য বড় ‘বরকত মন্ডিত মহিলা’ (كَانَتْ أَعْظَمَ بَرَكَةً) হিসাবে বরিত হন এবং তাঁর গোত্র রাসূল (সাঃ)-এর শ্বশুর গোত্র (أَصْهَارُ رَسُولِ اللهِ) হিসাবে সম্মানজনক পরিচিতি লাভ করে’ (আবুদাঊদ হা/৩৯৩১)।
(গ) ৭ম হিজরীর মুহাররম মাসে উম্মে হাবীবাহকে বিবাহ করার পর তাঁর পিতা কুরায়েশ নেতা আবু সুফিয়ান আর রাসূল (সাঃ)-এর প্রতিদ্বন্দ্বী থাকলেন না। বরং ৮ম হিজরীর রামাযান মাসে মক্কা বিজয়ের পূর্বরাতে তিনি ইসলাম কবুল করেন।
(ঘ) ৭ম হিজরীর ছফর মাসে ছাফিয়াকে বিবাহ করার ফলে রাসূল (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে ইহূদীদের যুদ্ধ তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়। রাসূল (সাঃ)-এর সঙ্গে সন্ধি করে তারা খায়বরে বসবাস করতে থাকে।
(ঙ) ৭ম হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাসে সর্বশেষ মায়মূনা বিনতুল হারেছকে বিবাহ করার ফলে নাজদবাসীদের অব্যাহত শত্রুতা ও ষড়যন্ত্র থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায়। কেননা মায়মূনার এক বোন ছিলেন নাজদের সর্দারের স্ত্রী। এরপর থেকে উক্ত এলাকায় ইসলামের প্রচার ও প্রসার বাধাহীনভাবে চলতে থাকে। অথচ ইতিপূর্বে এরাই ৪র্থ হিজরীতে ৭০ জন ছাহাবীকে দাওয়াত দিয়ে ডেকে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। যা ‘বি’রে মা‘ঊনার ঘটনা’ নামে প্রসিদ্ধ।
২য় কারণ : ইসলামী বন্ধন দৃঢ়করণ (تقوية صلة الإسلام) :
আয়েশা ও হাফছাকে বিবাহ করার মাধ্যমে হযরত আবুবকর ও ওমরের সঙ্গে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব দৃঢ়তর ভিত্তি লাভ করে। ওছমান ও আলীকে জামাতা করার পিছনেও রাসূল (সাঃ)-এর অনুরূপ উদ্দেশ্য থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। এর ফলে ইসলাম জগত চারজন মহান খলীফা লাভে ধন্য হয়।
৩য় কারণ : কুপ্রথা দূরীকরণ (إزالة الرسم الجاهلى) :
পোষ্যপুত্র নিজের পুত্রের ন্যায় এবং তার স্ত্রী নিজের পুত্রবধুর ন্যায় হারাম- এ মর্মে যুগ যুগ ধরে চলে আসা সামাজিক কুপ্রথার অপনোদনের জন্য আল্লাহর হুকুমে তিনি স্বীয় পালিত পুত্র যায়েদ বিন হারেছাহর তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী যয়নব বিনতে জাহশকে বিবাহ করেন। এ বিষয়ে সূরা আহযাবের ৩৭ ও ৪০ আয়াত দু’টি নাযিল হয়। বস্ত্ততঃ এ বিষয়গুলি এমন ছিল যে, এসব কুপ্রথা ভাঙার জন্য কেবল উপদেশই যথেষ্ট ছিল না। তাই আল্লাহর হুকুমে স্বয়ং নবীকেই সাহসী পদক্ষেপে এগিয়ে আসতে হয়েছিল।
৪র্থ কারণ : মহিলা সমাজে ইসলামের বিস্তার (انتشار الإسلام بين النساء) :
শিক্ষা-দীক্ষাহীন জাহেলী সমাজে মহিলারা ছিল পুরুষের তুলনায় আরো পশ্চাদপদ। তাই তাদের মধ্যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা যোরদার করার জন্য মহিলা প্রশিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা ছিল সর্বাধিক। পর্দা ফরয হওয়ার পর এর প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়ে যায়। ফলে রাসূল (সাঃ)-এর স্ত্রীগণ তাঁর সহযোগী হিসাবে একাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অধিক স্ত্রী অর্থই ছিল অধিক প্রশিক্ষিকা। কেবল মহিলারাই নন, পুরুষ ছাহাবীগণও বহু বিষয়ে পর্দার আড়াল থেকে তাঁদের নিকট হ’তে হাদীছ জেনে নিতেন। রাসূল (সাঃ)-এর মৃত্যুর পরেও মা আয়েশা, হাফছাহ, উম্মে সালামাহ প্রমুখের ভূমিকা ছিল এ ব্যাপারে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পরিশেষে আমরা বলতে চাই যে, একাধিক বিবাহ ব্যবস্থাকে যারা কটাক্ষ করতে চান, তাদের জানা উচিত যে, ইসলাম তার অনুসারীদের জন্য সবার প্রতি সমান ব্যবহারের শর্তে সর্বোচ্চ চার জন স্ত্রী রাখার অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু বাধ্য করেনি। পক্ষান্তরে আধুনিক সভ্যতার দাবীদার পাশ্চাত্যের ফ্রি ষ্টাইল যৌন জীবনে অভ্যস্ত হতাশাগ্রস্ত সমাজ জীবনের গভীরে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে যে, সেখানে অশান্তির আগুন আর মনুষ্যত্বের খোলস ব্যতীত কিছুই নেই। অথচ প্রকৃত মুসলিমের পারিবারিক জীবন পরকালীন কল্যাণ লাভের উদ্দেশ্যে পারস্পরিক সহানুভূতি ও নিষ্কাম ভালোবাসায় আপ্লুত থাকে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পারিবারিক জীবন যার বাস্তব দৃষ্টান্ত।
নবী পরিবারে উত্তম আচরণ (حسن السلوك فى بيت النبى صــ)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لأَهْلِهِ وَأَنَا خَيْرُكُمْ لأَهْلِى ‘তোমাদের মধ্যে সেই-ই উত্তম, যে তার পরিবারের নিকটে উত্তম। আর আমি আমার পরিবারের নিকটে তোমাদের চেয়ে উত্তম’।[1] এখানে পরিবার বলতে স্ত্রী বুঝানো হয়েছে।
‘সতীনের সংসার জাহান্নামের শামিল’ বলে একটা কথা সাধারণ্যে চালু আছে। কথাটি কমবেশী সত্য এবং বাস্তব। তবে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে নিবেদিতপ্রাণ পরিবারে তা কিভাবে শান্তির বাহনে পরিণত হয়, রাসূল-পরিবার ছিল তার অনন্য দৃষ্টান্ত। অন্য সকল ক্ষেত্রের ন্যায় পারিবারিক জীবনেও আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ছিলেন উম্মতের জন্য উত্তম আদর্শ। কিছু দৃষ্টান্তের মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আমরা নিম্নে তা তুলে ধরার চেষ্টা পাব।-
১. স্ত্রীগণের সাথে সমান ব্যবহার (تسوية السلوك مع الزوجات) :
খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান সহ যাবতীয় আচার-আচরণে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাঁর সকল স্ত্রীর সঙ্গে সমান ব্যবহার করতেন। সাধারণতঃ আছর ছালাতের পর তিনি প্রত্যেক স্ত্রীর ঘরে গিয়ে তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় বিষয় সমূহ জেনে নিতেন।[2]
২. স্ত্রীদের পালা নির্ধারণ (القسم بين الزوجات) : তিনি স্ত্রীদের মধ্যে তাদের সম্মতিক্রমে সমভাবে পালা নির্ধারণ করতেন।[3] তিনি বলতেন, কারু নিকট দু’জন স্ত্রী থাকলে যদি তাদের মধ্যে সে ন্যায় বিচার না করে, তাহ’লে ক্বিয়ামতের দিন ঐ ব্যক্তি এক অঙ্গ পতিত অবস্থায় আগমন করবে’।[4]
৩. সফরকালে লটারি করণ (القرعة عند السفر) : কোন অভিযানে বা সফরে যাওয়ার সময় লটারীর মাধ্যমে স্ত্রী বাছাই করে একজনকে সাথে নিতেন।[5]
৪. স্ত্রীর বান্ধবীদের সাথে উত্তম আচরণ (المعاملة الحسنة مع صديقات الزوجات) : স্ত্রীগণের বান্ধবী ও আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সদ্ব্যবহার করতেন ও তাদের নিকট উপঢৌকনাদি প্রেরণ করতেন।[6]
৫. স্ত্রীদের কক্ষ পৃথককরণ (فصل غرفات الزوجات) : স্ত্রীগণের প্রত্যেকের কক্ষ পৃথক ছিল। যেগুলিকে আল্লাহ পাক ‘হুজুরাত’ (কক্ষ সমূহ) ‘বুয়ূত’ (ঘর সমূহ) ইত্যাদি নামে অভিহিত করেছেন (হুজুরাত ৪৯/৪; আহযাব ৩৩/৩৩)।
৬. অল্পে তুষ্ট থাকার নীতি অবলম্বন (اةخاذ مبدأ القناعة) : স্ত্রীগণের অধিকাংশ বড় বড় ঘরের মেয়ে হ’লেও রাসূল (সাঃ)-এর শিক্ষাগুণে তাঁরা সবাই হয়ে উঠেছিলেন অল্পে তুষ্ট ও সহজ-সরল জীবন যাপনে অভ্যস্ত।
৭. দানশীলতায় অভ্যস্তকরণ (التعويد على السخاء) : অন্যের স্বার্থকে নিজের স্বার্থের উপরে স্থান দেওয়ার অনন্য গুণে গুণান্বিতা ছিলেন এই সকল মহিয়সী নারীগণ। সম্পদ পায়ে লুটালেও তাঁরা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করতেন না। দানশীলতায় তারা ছিলেন উদারহস্ত। উম্মুল মুমিনীন হযরত যয়নব বিনতে খুযায়মা (রাঃ) তো ‘উম্মুল মাসাকীন’ (মিসকীনদের মা) হিসাবে অভিহিত ছিলেন (মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৫৩৫৭)। খায়বর বিজয়ের পর বিপুল গণীমত হস্তগত হয়। তখন রাসূল (সাঃ)-এর প্রাপ্য অংশ হ’তে প্রত্যেক স্ত্রীর জন্য বছরে ৮০ অসাক্ব খেজুর এবং ২০ অসাক্ব যব বরাদ্দ করা হয়।[7] সেই সাথে একটি করে দুগ্ধবতী উষ্ট্রী প্রদান করা হয়। কিন্তু দেখা গেল যে, পবিত্রা স্ত্রীগণ যতটুকু না হ’লে নয়, ততটুকু রেখে বাকী সব দান করে দিয়েছেন।[8]
৮. স্ত্রীগণের মধ্যে পারস্পরিক সহমর্মিতা (التعاطف بين الزوجات) : সপত্নীগণের মধ্যে পরস্পরের ভালোবাসা ছিল গভীর ও নিঃস্বার্থ। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের প্রতি ছিলেন সহানুভূতিশীল ও দয়ার্দ্রচিত্ত। এরপরেও যদি কখনো কারু প্রতি কারু কোন রূঢ় আচরণ প্রকাশ পেত, তাহ’লে দ্রুত তা মিটিয়ে ফেলা হ’ত। যেমন (ক) একবার রাসূল (সাঃ)-এর একমাত্র ইহূদীজাত স্ত্রী ছাফিয়াকে কুরায়শী স্ত্রী যয়নব বিনতে জাহ্শ ‘ইহূদী’ বলে সম্বোধন করেন, যার মধ্যে তাচ্ছিল্যের ভাব ছিল। এতে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এতই ক্ষুব্ধ হন যে, যয়নব তওবা করে অনুতপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তার গৃহে পা রাখেননি।[9] (খ) আরেকদিন রাসূল (সাঃ) ঘরে এসে দেখেন যে, ছাফিয়া কাঁদছেন। কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন যে, হাফছা আমাকে ‘ইহূদীর মেয়ে’ বলেছেন। একথা শুনে রাসূল (সাঃ) ছাফিয়াকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, বরং তুমি নিশ্চয়ই নবী (ইসহাকের) কন্যা। তোমার চাচা (ইসমাঈল) একজন নবী এবং তুমি একজন নবীর স্ত্রী। তাহ’লে কিসে তোমার উপরে সে গর্ব করছে? অতঃপর তিনি হাফছাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আল্লাহকে ভয় কর হে হাফছা’![10]
(গ) আয়েশা (রাঃ) বলেন, লোকেরা আয়েশার পালার দিন ঠিক রাখত। ঐদিন তারা রাসূল (সাঃ)-কে খুশী করার জন্য নানাবিধ হাদিয়া পাঠাতো। স্ত্রীগণ দু’দলে বিভক্ত ছিলেন। সওদা, আয়েশা, হাফছা. ও ছাফিয়া এক দলে এবং উম্মে সালামাহ ও বাকীগণ আরেক দলে। শেষোক্ত দলের স্ত্রীগণের অনুরোধে উম্মে সালামাহ রাসূল (সাঃ)-কে একদিন বললেন, আপনি লোকদের বলে দিন, তারা যেন আপনি যেদিন যে স্ত্রীর কাছে থাকেন, সেদিন সেখানে হাদিয়া পাঠায়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, হে উম্মে সালামাহ! তুমি আমাকে আয়েশার ব্যাপারে কষ্ট দিয়ো না। উম্মে সালামা তওবা করলেন। পরে তারা উক্ত বিষয়ে ফাতেমাকে রাসূল (সাঃ)-এর কাছে পাঠালেন। সেখানেও রাসূল (সাঃ) একই জবাব দিলেন এবং বললেন, ফাতেমা! আমি যা পসন্দ করি, তুমি কি তা পসন্দ করো না? তাহ’লে তুমি আয়েশাকে ভালোবাস।[11]
৯. যুহদ ও দুনিয়াত্যাগী জীবন (الزهد والتعبد فى العائلة) : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অত্যন্ত সরল-সহজ ও সাধাসিধা জীবন যাপন করতেন। তিনি স্বেচ্ছায় দরিদ্রতা অবলম্বন করেছিলেন। তিনি বলতেন, اللَّهُمَّ أَحْيِنِىْ مِسْكِيْنًا وَأَمِتْنِىْ مِسْكِيْنًا وَاحْشُرْنِىْ فِىْ زُمْرَةِ الْمَسَاكِيْنِ ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে মিসকীনী হালে বাঁচিয়ে রাখো ও মিসকীনী হালে মৃত্যু দান কর এবং আমাকে মিসকীনদের সাথে পুনরুত্থিত কর’।[12] তিনি বলতেন, اللَّهُمَّ ارْزُقْ آلَ مُحَمَّدٍ قُوتًا ‘হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদের পরিবারকে পরিমিত আহার দান কর। যা ক্ষুধা নিবৃত্ত করে’ (বুখারী হা/৬৪৬০)। অভাবে-অনটনে, দুঃখে-বেদনায়, সর্বাবস্থায় তিনি কঠিন ধৈর্য অবলম্বন করতেন। এমনকি ক্ষুধার যন্ত্রণা হ্রাস করার জন্য তিনি কখনো কখনো পেটে পাথর বেঁধে রাখতেন’ (ছহীহাহ হা/১৬১৫)। তিনদিন না খেয়ে পেটে পাথর বেঁধে সৈন্যদের সাথে অবর্ণনীয় কষ্টে খন্দক খোঁড়ার কাজে তিনি অংশ নিয়েছেন (বুখারী হা/৪১০১)। রাসূল (সাঃ)-এর খাদেম হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, فَمَا أَعْلَمُ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَأَى رَغِيْفًا مُرَقَّقًا حَتَّى لَحِقَ بِاللهِ، وَلاَ رَأَى شَاةً سَمِيْطًا بِعَيْنِهِ قَطُّ ‘আমি জানি না, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার আগ পর্যন্ত কখনো কোন পাতলা নরম রুটি দেখেছেন কিংবা কোন আস্ত ভুনা বকরী দেখেছেন’।[13] আয়েশা ছিদ্দীকা (রাঃ) বলেন, মদীনায় আসার পর থেকে রাসূল (সাঃ)-এর মৃত্যু পর্যন্ত মুহাম্মাদের পরিবার কখনো তিনদিন একটানা রুটি খেতে পায়নি।[14] অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘পরপর দু’মাস অতিবাহিত হয়ে তৃতীয় মাসের চাঁদ উদিত হ’ত, অথচ নবীগৃহে কোন (চুলায়) আগুন জ্বলতো না’ (অর্থাৎ মাসভর চুলা জ্বলতো না)। ভগিনীপুত্র উরওয়া বিন যুবায়ের (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, খালাম্মা! مَا كَانَ يُعِيشُكُمْ ‘তাহ’লে কি খেয়ে আপনারা জীবন ধারণ করতেন? তিনি বলেন, الْأَسْوَدَانِ التَّمْرُ وَالْمَاءُ ‘দু’টি কালো বস্ত্ত দিয়ে- খেজুর ও পানি’।[15] রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলতেন, قَدْ أَفْلَحَ مَنْ أَسْلَمَ وَرُزِقَ كَفَافًا وَقَنَّعَهُ اللهُ بِمَا آتَاهُ ‘ঐ ব্যক্তি সফলকাম, যে মুসলমান হ’ল। যে পরিমিত আহার পেল এবং তাকে আল্লাহ যা দিয়েছেন, তাতে সন্তুষ্ট থাকল’।[16]
একবার আবু হুরায়রা (রাঃ) একদল লোকের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। যাদের সামনে একটা ভুনা বকরী ছিল। তারা তাঁকে খাওয়ার জন্য দাওয়াত দিলেন। কিন্তু তিনি অস্বীকার করে বললেন, خَرَجَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مِنَ الدُّنْيَا وَلَمْ يَشْبَعْ مِنَ الْخُبْزِ الشَّعِيرِ ‘রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে গেছেন। অথচ কখনো একটি যবের রুটি দিয়েও পরিতৃপ্ত হননি’।[17] আনাস (রাঃ) বলেন, ‘রাসূল (সাঃ)-এর পরিবারের নিকট কোন সন্ধ্যাতেই এক ছা‘ গম বা কোন খাদ্য দানা (&আগামীকালের জন্য) অবশিষ্ট থাকত না। অথচ তাঁর স্ত্রী ছিলেন নয় জন’ (অর্থাৎ যা পেতেন সবই দান করে দিতেন। জমা রাখতেন না)।[18] মৃত্যুর সময় রাসূল (সাঃ)-এর লৌহবর্মটি এক ইহূদীর নিকটে ৩০ ছা‘ (৭৫ কেজি) যবের বিনিময়ে বন্ধক ছিল।[19] নবীজীবনের সর্বশেষ রাতেও স্ত্রী আয়েশাকে চেরাগ জ্বালাতে তার সতীনদের নিকট থেকে তৈল চেয়ে নিতে হয়েছিল।[20]
ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন, ‘আমি একদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে দেখলাম, তিনি একটা খেজুর পাতার চাটাইয়ের উপর শুয়ে আছেন। যাতে কোন ফরাশ বা চাদর নেই। তাঁর দেহে চাটাইয়ের দাগ বসে গিয়েছিল। তাঁর মাথার নীচে খেজুর গাছের ছোবড়া ভর্তি একটি চামড়ার বালিশ। তাঁর দেহে চাটাইয়ের দাগ দেখে আমি কাঁদতে লাগলাম। তিনি বললেন, তুমি কেন কাঁদছ? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! পারসিক ও রোমকরা কোন অবস্থায় আছে। আর আপনি কোন অবস্থায়? তখন তিনি বললেন, أَمَا تَرْضَى أَنْ تَكُونَ لَهُمُ الدُّنْيَا وَلَنَا الآخِرَةُ ‘তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তাদের জন্য দুনিয়া এবং আমাদের জন্য আখেরাত? (বুখারী হা/৪৯১৩)। আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একটি চাটাইয়ের উপরে শুতেন। অতঃপর যখন দাঁড়াতেন, তখন তাঁর পার্শ্বদেশে ঐ চাটাইয়ের দাগ পড়ে যেত। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি আপনার জন্য একটি তোষক বানিয়ে দেব না? জবাবে তিনি বললেন, مَا لِى وَمَا لِلدُّنْيَا مَا أَنَا فِى الدُّنْيَا إِلاَّ كَرَاكِبٍ اسْتَظَلَّ تَحْتَ شَجَرَةٍ ثُمَّ رَاحَ وَتَرَكَهَا ‘আমার জন্য বা দুনিয়ার জন্য কি প্রয়োজন? দুনিয়াতে আমি একজন সওয়ারীর ন্যায়। যে একটি গাছের ছায়ায় বিশ্রাম করছে। অতঃপর রওয়ানা হবে এবং ঐ গাছটিকে ছেড়ে যাবে’ (তিরমিযী হা/২৩৭৭)। মূলতঃ এসবই ছিল তাঁর যুহ্দ বা দুনিয়াত্যাগী চরিত্রের অনন্য পরিচয়।
ইবাদত (التعبد): তিনি ফরয ছালাত ছাড়াও নফল ছালাতে গভীরভাবে নিমগ্ন হ’তেন। শেষ রাত্রিতে তাহাজ্জুদ ছালাত তাঁর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত ছিল (মুযযাম্মিল ৭৩/২-৩; ইসরা ১৭/৭৯)। দীর্ঘক্ষণ ছালাতে দাঁড়ানোর ফলে তাঁর দুই পা ফুলে যেত। তা দেখে তাঁকে বলা হ’ল, হে আল্লাহর রাসূল! غَفَرَ اللهُ لَكَ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ ‘আল্লাহ আপনার আগে-পিছের সকল গোনাহ মাফ করে দিয়েছেন। জবাবে তিনি বলতেন, أَفَلاَ أَكُونُ عَبْدًا شَكُورًا ‘আমি কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হব না? (বুখারী হা/১১৩০)। এছাড়া যখনই তিনি কোন কষ্টে পড়তেন, তখনই নফল ছালাতে রত হ’তেন (আবুদাঊদ হা/১৩১৯)।
তিনি নিয়মিত নফল ছিয়াম রাখতেন। যেমন প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার,[21] প্রতি চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ আইয়ামে বীযের নফল ছিয়াম (তিরমিযী হা/৭৬১), আরাফাহ ও আশূরার ছিয়াম (মুসলিম হা/১১৬২), শা‘বানের প্রায় পুরা মাস (মুসলিম হা/১১৫৬) এবং রামাযানের এক মাস ফরয ছিয়াম শেষে শাওয়ালের ৬টি নফল ছিয়াম (মুসলিম হা/১১৬৪)। তিনি বলতেন, مَنْ صَامَ يَوْمًا فِى سَبِيلِ اللهِ بَعَّدَ اللهُ وَجْهَهُ عَنِ النَّارِ سَبْعِينَ خَرِيفًا ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় একদিন ছিয়াম রাখে, আল্লাহ তার চেহারাকে জাহান্নামের আগুন থেকে ৭০ বছরের পথ দূরে রাখেন’।[22] তিনি বলতেন, তুমি ঘুমাও ও ইবাদত কর। নিশ্চয় তোমার উপর তোমার দেহের হক রয়েছে। চোখের হক রয়েছে। স্ত্রীর হক রয়েছে। সাক্ষাৎপ্রার্থীর হক রয়েছে। আর যে ব্যক্তি প্রতিদিন ছিয়াম রাখে, সেটি কোন ছিয়ামই নয়’। অর্থাৎ তার ছিয়াম কবুল হয় না।[23] এর মধ্যে সন্ন্যাসবাদের প্রতিবাদ রয়েছে। যা খ্রিষ্টানদের আবিষ্কার (হাদীদ ৫৭/২৭)।
উপরের বিস্তারিত আলোচনায় রাসূল (সাঃ)-এর দুনিয়াত্যাগী চরিত্র এবং অতুলনীয় সংযম সাধনার পরিচয় পাওয়া যায়।
১০. পারিবারিক কিছু শিক্ষণীয় ঘটনাবলী (بعض الوقائع العائلية الاعةبارية) :
কঠিন সংযম ও কৃচ্ছতা সাধনের মধ্যে জীবন যাপন করেও পবিত্রা স্ত্রীগণ কখনো অসন্তুষ্টি ভাব প্রকাশ করতেন না। বরং সর্বদা মহান স্বামীর সাহচর্যে হাসিমুখে দাম্পত্য জীবন যাপন করতেন। তবে দু’একটি ঘটনা এমন ছিল যা রাসূল (সাঃ)-এর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ছিল এবং তাতে তিনি দুঃখিত হয়েছিলেন। শরী‘আতী বিধান চালু করার লক্ষ্যে আল্লাহর বিশেষ ইচ্ছায় এরূপ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। যার মধ্যে রয়েছে উম্মতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ। যেমন-
(১) ৫ম হিজরীতে খন্দক যুদ্ধের পর বনু কুরায়যার বিজয় এবং গণীমতের বিপুল মালামাল প্রাপ্তির ফলে মুসলমানদের মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে আসে। এ প্রেক্ষিতে পবিত্রা স্ত্রীগণ রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে তাদের ভরণ-পোষণের পরিমাণ বৃদ্ধির আবেদন জানান। এতে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মর্মাহত হন এবং তাদেরকে তালাক গ্রহণের এখতিয়ার প্রদান করেন। উক্ত মর্মে আয়াতে ‘তাখয়ীর’ (آية التخيير) নাযিল হয় (আহযাব ৩৩/২৮-২৯)।
উক্ত আয়াত নাযিলের পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আয়েশাকে তার পিতা-মাতার সঙ্গে পরামর্শ করতে বললে তিনি বলে ওঠেন, فَفِى أَىِّ هَذَا أَسْتَأْمِرُ أَبَوَىَّ فَإِنِّى أُرِيدُ اللهَ وَرَسُولَهُ وَالدَّارَ الآخِرَةَ، قَالَتْ ثُمَّ فَعَلَ أَزْوَاجُ النَّبِىِّ- صلى الله عليه وسلم- مِثْلَ مَا فَعَلْتُ- ‘এজন্য পিতা-মাতার সাথে পরামর্শের কি আছে? আমি তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং আখেরাতকে কবুল করে নিয়েছি’। তিনি বলেন, অতঃপর অন্যান্য স্ত্রীগণ সকলেই আমার পথ অনুসরণ করলেন’।[24]
(২) একবার দু’জন স্ত্রীর উপর কোন কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে রাসূল (সাঃ) কসম করেন যে, তাদের থেকে একমাস বিরত থাকবেন এবং তা যথারীতি কার্যকর হয়। যা ঈলা-র ঘটনা (قصة الإيلاء) নামে প্রসিদ্ধ।[25]
(৩) একবার মধু খাওয়ার ঘটনায় স্ত্রীদের কাউকে খুশী করার জন্য তা আর খাবেন না বলে কসম করেন। এভাবে হালালকে হারাম করায় আল্লাহপাক তাকে সতর্ক করে দিয়ে সূরা তাহরীম ১ম আয়াতটি (آية التحريم) নাযিল করেন।[26]
উপরোক্ত ঘটনাবলীতে পুণ্যবতী স্ত্রীগণের এই বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে যে, তারা সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় পুণ্যবান স্বামীর একনিষ্ঠ অনুসারী হয়ে থাকেন। এর দ্বারা আরেকটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মানুষ হিসাবে মানবীয় রাগ-অভিমান ও দুঃখ-বেদনার অধিকারী ছিলেন। স্বামী-স্ত্রীর প্রেমের সম্পর্ক এসবের মাধ্যমে ঝালাই হয়ে আরও দৃঢ়তর হয়। রাসূল (সাঃ) ও তাঁর পবিত্রা স্ত্রীগণের মধ্যকার এ ধরনের ঘটনা তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। ভবিষ্যতে কোন মুমিন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এরূপ ঘটনা ঘটলে তারা যেন রাসূল-পত্নীদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেন এবং সংসার ভেঙ্গে না দিয়ে আরও মযবুত করেন, সেদিকে পথপ্রদর্শনের জন্যই দৃষ্টান্ত হিসাবে আল্লাহর ইচ্ছায় উক্ত ঘটনা সমূহ সংঘটিত হয়।
বস্ত্ততঃ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও তাঁর পুণ্যবতী স্ত্রীগণের মধ্যকার সম্পর্ক ছিল উন্নত আদর্শ চেতনার উপরে প্রতিষ্ঠিত। দুনিয়া ও আখেরাতে সর্বাবস্থায় তাঁরা নবীপত্নী হিসাবে বরিত।[27] তাই দুনিয়াবী ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য তাঁরা কখনোই আখেরাতের বৃহত্তর স্বার্থ বিকিয়ে দিতে পারেন না। দুনিয়াতে তাঁরা ছিলেন রাসূল (সাঃ)-এর পারিবারিক জীবনের বিশ্বস্ততম সাক্ষী এবং তাদের মাধ্যমেই উম্মতে মুহাম্মাদী ইসলামের পারিবারিক ও অন্যান্য বিধানসমূহ জানতে পেরে ধন্য হয়েছে। এদিক দিয়ে বিবেচনা করলে তাঁরা কেবল নবীপত্নী ছিলেন না, বরং তারা ছিলেন উম্মতের শিক্ষিকা ও নক্ষত্রতুল্য দৃষ্টান্ত। নিঃসন্দেহে নবীর সঙ্গে নবীপত্নীগণের সম্পর্ক ও আচার-আচরণ ছিল অতীব মধুর এবং আখেরাতের চেতনায় উজ্জীবিত।
[1]. তিরমিযী হা/৩৮৯৫; দারেমী হা/২২৬০; মিশকাত হা/৩২৫২।
[2]. বুখারী হা/৫২১৬; মুসলিম হা/১৪৭৪।
[3]. হাকেম হা/২৭৬০; আবুদাঊদ হা/২১৩৪-৩৫; ইরওয়া হা/২০১৮-২০; বুখারী হা/৫২১২; মুসলিম হা/১৪৬৩ (৪৭); তিরমিযী তুহফাসহ হা/১১৪০; মিশকাত হা/৩২২৯-৩০, ৩২৩৫ ‘বিবাহ’ অধ্যায় ‘পালা বণ্টন’ অনুচ্ছেদ।
[4]. (جَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَشِقُّهُ سَاقِطٌ) তিরমিযী হা/১১৪১; ইবনু মাজাহ হা/১৯৬৯; মিশকাত হা/৩২৩৬।
[5]. বুখারী হা/২৫৯৩; মুসলিম হা/২৭৭০; মিশকাত হা/৩২৩২।
[6]. বুখারী হা/৩৮১৮; মুসলিম হা/২৪৩৫; মিশকাত হা/৬১৭৭।
[7]. মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/১৪৪৬৯; মুসলিম হা/১৫৫১ (২); আড়াই কেজিতে এক মাদানী ছা‘ এবং ৬০ ছা‘-তে এক অসাক্ব। যার পরিমাণ ১৫০ কেজি।
[8]. রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/১৪২।
[9]. আবুদাঊদ হা/৪৬০২; মিশকাত হা/৫০৪৯; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/২৮৩৫, সনদ হাসান।
[10]. তিরমিযী হা/৩৮৯৪; নাসাঈ হা/৩২৫২; মিশকাত হা/৬১৮৩, সনদ ছহীহ।
[11]. বুখারী হা/২৫৮১; মুসলিম হা/২৬০৩; মিশকাত হা/৬১৮০ ‘মর্যাদা সমূহ’ অধ্যায়-৩০, ‘নবীপত্নীগণের মর্যাদা’ অনুচ্ছেদ-১১।
[12]. তিরমিযী হা/২৩৫২; বায়হাক্বী-শু‘আবুল ঈমান হা/১৪৫৩; মিশকাত হা/৫২৪৪; ছহীহাহ হা/৩০৮।
[13]. বুখারী হা/৫৪২১; মিশকাত হা/৪১৭০ ‘খাদ্য সমূহ’ অধ্যায়।
[14]. বুখারী হা/৫৪১৬ ‘খাদ্য সমূহ’ অধ্যায়-৭০ অনুচ্ছেদ-২৩; মুসলিম হা/২৯৭০।
[15]. বুখারী হা/৬৪৫৯ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায় ‘রাসূল ও ছাহাবীদের জীবন যাপন কেমন ছিল’ অনুচ্ছেদ-১৭।
[16]. মুসলিম হা/১০৫৪; মিশকাত হা/৫১৬৫।
[17]. বুখারী হা/৫৪১৪; মিশকাত হা/৫২৩৮।
[18]. বুখারী হা/২০৬৯; মিশকাত হা/৫২৩৯।
[19]. বুখারী হা/২৯১৬; মিশকাত হা/২৮৮৫ ‘বন্ধক’ অনুচ্ছেদ।
[20]. ত্বাবারাণী কাবীর হা/৫৯৯০; ছহীহ আত-তারগীব হা/৯২৭।
[21]. তিরমিযী হা/৭৪৫; নাসাঈ হা/২৩৬৪; মিশকাত হা/২০৫৫।
[22]. বুখারী হা/২৮৪০; মিশকাত হা/২০৫৩।
[23]. বুখারী হা/১৯৭৫; মিশকাত হা/২০৫৪।
[24]. বুখারী হা/৪৭৮৫-৮৬; মুসলিম হা/১৪৭৫; মিশকাত হা/৩২৪৯; আহযাব ৩৩/২৮-২৯।
[25]. বুখারী হা/১৯১১; মুসলিম হা/১০৮৩, ১৪৭৯; মিশকাত হা/৩২৪৮; বাক্বারাহ ২/২২৬; তাহরীম ৬৬/৪।
[26]. তাহরীম ৬৬/১; বুখারী হা/৪৯১২।
[27]. আহযাব ৩৩/৩৩, ৫৩; যুখরুফ ৪৩/৭০ আয়াতের মর্মার্থ।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দেহ সৌষ্ঠব (الصفات الْخَلقية للرسول صـــ)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দেহাবয়ব ছিল (১) মধ্যম গড়নের অতীব সুন্দর ও সুঠাম এবং গায়ের রং ছিল উজ্জ্বল ও গৌর-গোলাপী।[1] (২) প্রশস্ত মুখমন্ডল এবং ঘন পাপড়িযুক্ত কিঞ্চিত রক্তাভ পটলচেরা সুরমা চক্ষু।[2] (৩) দীর্ঘ গ্রীবাবিশিষ্ট বড় আকৃতির মাথা।[3] যা ছিল ঘনকৃষ্ণ কেশশোভিত। যা না অধিক কোঁকড়ানো, না অধিক খাড়া।[4] যা বাবরী ছিল।[5] (৪) মৃত্যু অবধি মাথার মাঝখানের কিছু চুল, ঠোটের নিম্ন দেশের এবং চোখ ও কানের মধ্যবর্তী দাড়ির ও কানের মধ্যকার কিছু চুল শ্বেতবর্ণ ধারণ করেছিল।[6] সেকারণ তিনি চুলে খেযাব লাগাতেন না।[7] আনাস (রাঃ) বলেন, মৃত্যুকালে রাসূল (সাঃ)-এর চুল ও দাড়ির বিশটি চুলও পাকেনি’।[8] তিনি নিয়মিত চিরুনী ব্যবহার করতেন এবং মাথার চুল দু’দিকে ভাগ করে দিতেন (তাতে মাঝখানে সিঁথি হয়ে যেত)[9] (৫) গোফ ছোট ও দাড়ি ছিল দীর্ঘ ও ঘন সন্নিবেশিত।[10] (৬) তিনি ছিলেন প্রশস্ত কাঁধ বিশিষ্ট।[11] যার বাম স্কন্ধমূলে ছিল কবুতরের ডিম্বাকৃতির ছোট্ট গোশতপিন্ড, যা ‘মোহরে নবুঅত’ বলে খ্যাত। যা ছিল গাত্রবর্ণ থেকে পৃথক সবুজ বা কালচে চর্মতিল সমষ্টি।[12] (৭) প্রসারিত বক্ষপুট হতে নাভিদেশ পর্যন্ত ছিল স্বল্প লোমের প্রলম্বিত রেখা।[13] (৮) দেহের জোড় সমূহ ছিল বড় আকারের এবং পায়ের পাতা ও হস্ত তালুদ্বয় ছিল মাংসল।[14] (৯) এছাড়া হাতের তালুদ্বয় ছিল প্রশস্ত ও মোলায়েম।[15] আর পায়ের গোড়ালি ছিল পাতলা।[16] চলার সময় সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে চলতেন। যেন কোন ঢালু স্থানে অবতরণ করছেন।[17] (১১) দেহ নিঃসৃত স্বেদবিন্দু সমূহ মুক্তার ন্যায় পরিদৃষ্ট হ’ত। যা ছিল মিশকে আম্বরের চাইতে সুগন্ধিময়।[18] (১২) প্রফুল্ল অবস্থায় তাঁর মুখমন্ডল চন্দ্রের ন্যায় চমকিত হ’ত।[19] রাগান্বিত হ’লে তাঁর চেহারার গন্ডদ্বয় ডালিমের ন্যায় রক্তিম বর্ণ ধারণ করত।[20] (১৩) শক্ত, সমর্থ ও শক্তিশালী দেহ সৌষ্ঠবের অধিকারী এই সুন্দর মানুষটির দেহ বৃদ্ধ বয়সে কিছুটা ভারি হয়ে গিয়েছিল।[21]
(ক) রাসূল (সাঃ)-এর সুন্দর চেহারার প্রশংসায় আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) বলতেন,
أَمِينٌ مُصْطَفًى لِلْخَيْرِ يَدْعُو + كَضَوْءِ الْبَدْرِ زَايَلَهُ الظَّلاَمُ
‘বিশ্বস্ত, মনোনীত, কল্যাণের দিকে যিনি সদা আহবান করেন। পূর্ণচন্দ্রের জ্যোতির ন্যায় যা অন্ধকার দূরীভূত করে’।[22]
(খ) ওমর ফারূক (রাঃ) রাসূল (সাঃ)-এর চেহারা দেখে মু‘আল্লাক্বাখ্যাত জাহেলী কবি যুহায়ের বিন আবু সুলমার নিম্নোক্ত কবিতা পাঠ করতেন, যা কবি তার নেতা হারাম বিন সেনানের প্রশংসায় বলেছিলেন।-
لَوْ كُنْتَ مِنْ شَيْءٍ سِوَى بَشَرٍ + كُنْتَ الْمُضِيَّ لِلَيْلَةِ الْبَدْرِ
‘যদি আপনি মানুষ ব্যতীত অন্য কিছু হ’তেন, তাহ’লে আপনিই পূর্ণিমার রাত্রির জন্য আলো দানকারী হ’তেন’।[23]
(গ) কা‘ব বিন মালেক (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন আনন্দিত হ’তেন, তখন তাঁর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে যেন চন্দ্রের টুকরা (قِطْعَةُ قَمَرٍ) হয়ে যেত’।[24]
(ঘ) হযরত আলী (রাঃ) এবং অন্যান্য প্রশংসাকারীর ভাষায় রাসূল (সাঃ) ছিলেন, لَمْ أَرَ قَبْلَهُ وَلاَ بَعْدَهُ مِثْلَهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘তাঁর পূর্বে ও পরে তাঁর ন্যায় সুন্দর কাউকে আমি দেখিনি’।[25] ফারসী কবির ভাষায়,
حسن يوسف دم عيسى يد بيضا دارى + آنچہ خوبہ ہم دارند توتنها دارى
‘ইউসুফের রূপ, ঈসার ফুঁক ও মূসার শুভ্র তালু
সবই আছে তোমার মাঝে হে প্রিয় রাসূল’।
[1]. বুখারী হা/৩৫৪৭; মুসলিম হা/২৩৪০, ২৩৪৭। আনাস ও আবুত তুফায়েল (রাঃ) হ’তে।
[2]. মুসলিম হা/২৩৩৯; মিশকাত হা/৫৭৮৪। জাবের (রাঃ) হ’তে। বায়হাক্বী, ছহীহুল জামে‘ হা/৪৬২১। আলী (রাঃ) হ’তে।
[3]. তিরমিযী হা/৩৬৩৭, মিশকাত হা/৫৭৯০। আনাস (রাঃ) হ’তে।
[4]. বুখারী হা/৩৫৪৭; মুসলিম হা/২৩৪৭। আনাস (রাঃ) হ’তে।
[5]. মুসলিম হা/২৩৩৮, মিশকাত হা/৫৭৮২। জাবের (রাঃ) হ’তে।
[6]. বুখারী হা/৩৫৪৫, মুসলিম হা/২৩৪১, নাসাঈ হা/৫০৮৭। আনাস (রাঃ) হ’তে।
[7]. আহমাদ হা/১৩৩৯৬, সনদ ছহীহ। আনাস (রাঃ) হ’তে।
[8]. বুখারী হা/৩৫৪৭; মুসলিম হা/২৩৪৭। আনাস (রাঃ) হ’তে।
[9]. বুখারী হা/৩৫৫৮; মুসলিম হা/২৩৩৬; মিশকাত হা/৪৪২৫, ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে।
[10]. মুসলিম হা/২৩৪৪, নাসাঈ হা/৫২৩২, মিশকাত হা/৫৭৭৯। জাবের (রাঃ) হ’তে।
[11]. বুখারী হা/৩৫৫১, মুসলিম হা/২৩৩৭, মিশকাত হা/৫৭৮৩। বারা বিন ‘আযেব (রাঃ) হ’তে।
[12]. মুসলিম হা/২৩৪৪, ২৩৪৬, মিশকাত হা/৫৭৮০, আব্দুল্লাহ বিন সারজিস (রাঃ) হ’তে।
[13]. তিরমিযী হা/৩৬৩৭, মিশকাত হা/৫৭৯০। আলী (রাঃ) হ’তে।
[14]. তিরমিযী হা/৩৬৩৭, মিশকাত হা/৫৭৯০। আলী (রাঃ) হ’তে।
[15]. বুখারী হা/৩৫৬১, ৫৯০৭। আনাস (রাঃ) হ’তে।
[16]. মুসলিম হা/২৩৩৯। জাবের (রাঃ) হ’তে।
[17]. তিরমিযী হা/৩৬৩৭, মুসলিম হা/২৩৩০; মিশকাত হা/৫৭৮৭, ৫৭৯০। আলী ও আনাস (রাঃ) হ’তে।
[18]. বুখারী হা/১৯৭৩, মুসলিম হা/২৩৩০, মিশকাত হা/৫৭৮৭। আনাস (রাঃ) হ’তে।
একবার গ্রীষ্মের দুপুরে ঘুমন্ত রাসূল (সাঃ)-এর দেহনিঃসৃত ঘর্মসমূহ বাটিতে জমা করেছিলেন খালা উম্মে সুলায়েম (রাঃ)। রাসূল (সাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি এগুলি আমাদের সুগন্ধির সাথে মিশাবো। কেননা এগুলি অধিক সুগন্ধিময়’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এর ব্যবহারের দ্বারা আমরা আমাদের বাচ্চাদের জন্য বরকত আশা করি। রাসূল (সাঃ) বললেন, তুমি ঠিকই করেছ’ (মুসলিম হা/২৩৩১, মিশকাত হা/৫৭৮৮, উম্মে সুলায়েম (রাঃ) হ’তে)।
[19]. বুখারী হা/৩৫৫৬, মুসলিম হা/২৭৬৯, মিশকাত হা/৫৭৯৮।
[20]. তিরমিযী হা/২১৩৩, মিশকাত হা/৯৮।
[21]. মুসলিম হা/৭৩২, মিশকাত হা/১১৯৮।
[22]. বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত হা/২৩৮, ১/২৭০ পৃঃ।
[23]. বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত ১/৩০১; কানযুল ‘উম্মাল হা/১৮৫৭০; ছাখাবী, আল-ওয়াফী বিল অফায়াত ২৯ পৃঃ।
[24]. বুখারী হা/৩৫৫৬; মিশকাত হা/৫৭৯৮ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায় ২ অনুচ্ছেদ।
[25]. তিরমিযী হা/৩৬৩৭; মিশকাত হা/৫৭৯০; ইবনু হিশাম ১/৪০২।
শায়খ ছফিউর রহমান মুবারকপুরী (রহঃ) আলী (রাঃ)-এর বরাতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দেহ সৌষ্ঠব বর্ণনায় যে দীর্ঘ হাদীছটি এনেছেন, সেটি যঈফ (তিরমিযী হা/৩৬৩৮; আর-রাহীক্ব ৪৭৯-৮০ পৃঃ; ঐ, তা‘লীক্ব ১৯৩ পৃঃ)। (২) একইভাবে আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে ‘রাসূল (সাঃ)-এর চেহারায় যেন সূর্য খেলা করত’ মর্মে যে হাদীছ এনেছেন, সেটিও যঈফ (তিরমিযী হা/৩৬৪৮, আর-রাহীক্ব ৪৮১; ঐ, তা‘লীক্ব ১৯৩-৯৪ পৃঃ)। (৩) জাবের বিন সামুরাহ (রাঃ) থেকে ‘তাঁর পায়ের নলা সরু ছিল’... বলে যে হাদীছ এনেছেন, তা যঈফ (তিরমিযী হা/৩৬৪৫, আর-রাহীক্ব ৪৮২ পৃঃ, ঐ, তালীক্ব ১৯৪ পৃঃ)। (৪) জাবের (রাঃ) থেকে ‘তিনি রাস্তায় চলার সময় পিছনের ব্যক্তি তার দেহ থেকে সুগন্ধি পেত’... বলে যে হাদীছটি এনেছেন, তা যঈফ (দারেমী হা/৬৬; আর-রাহীক্ব ৪৮২ পৃঃ; ঐ, তালীক্ব ১৯৪ পৃঃ)। তবে রাসূল (সাঃ) যখন সামনে আসতেন, তখন তাঁর দেহ থেকে সুগন্ধি বের হ’ত, মর্মে বর্ণিত হাদীছটি ‘হাসান’ (আলবানী, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২১৩৭)। (৫) ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে ‘তার সামনের উপরস্থ দু’টি দাঁতের মাঝে ফাঁক ছিল। কথা বলার সময় সেখান থেকে নূর চমকাতো, মর্মে বর্ণিত হাদীছটি ‘খুবই যঈফ’ (দারেমী, মিশকাত হা/৫৭৯৭, যঈফাহ হা/৪২২০; আর-রাহীক্ব ৪৮২ পৃঃ; ঐ, তালীক্ব ১৯৫ পৃঃ)। (৬) হিন্দ বিন আবু হালাহ (রাঃ) থেকে রাসূল (সাঃ)-এর গুণাবলী বর্ণনায় যে দীর্ঘ হাদীছ এনেছেন, সেটিও যঈফ (আলবানী, মুখতাছার শামায়েলে তিরমিযী হা/৬; আর-রাহীক্ব ৪৮৬-৮৭ পৃঃ; ঐ, তা‘লীক্ব ১৯৬-৯৭ পৃঃ)।
لَوْ كُنْتَ مِنْ شَيْءٍ سِوَى بَشَرٍ + كُنْتَ الْمُضِيَّ لِلَيْلَةِ الْبَدْرِ
‘যদি আপনি মানুষ ব্যতীত অন্য কিছু হ’তেন, তাহ’লে আপনিই পূর্ণিমার রাত্রির জন্য আলো দানকারী হ’তেন’।[23]
(গ) কা‘ব বিন মালেক (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন আনন্দিত হ’তেন, তখন তাঁর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে যেন চন্দ্রের টুকরা (قِطْعَةُ قَمَرٍ) হয়ে যেত’।[24]
(ঘ) হযরত আলী (রাঃ) এবং অন্যান্য প্রশংসাকারীর ভাষায় রাসূল (সাঃ) ছিলেন, لَمْ أَرَ قَبْلَهُ وَلاَ بَعْدَهُ مِثْلَهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘তাঁর পূর্বে ও পরে তাঁর ন্যায় সুন্দর কাউকে আমি দেখিনি’।[25] ফারসী কবির ভাষায়,
حسن يوسف دم عيسى يد بيضا دارى + آنچہ خوبہ ہم دارند توتنها دارى
‘ইউসুফের রূপ, ঈসার ফুঁক ও মূসার শুভ্র তালু
সবই আছে তোমার মাঝে হে প্রিয় রাসূল’।
[1]. বুখারী হা/৩৫৪৭; মুসলিম হা/২৩৪০, ২৩৪৭। আনাস ও আবুত তুফায়েল (রাঃ) হ’তে।
[2]. মুসলিম হা/২৩৩৯; মিশকাত হা/৫৭৮৪। জাবের (রাঃ) হ’তে। বায়হাক্বী, ছহীহুল জামে‘ হা/৪৬২১। আলী (রাঃ) হ’তে।
[3]. তিরমিযী হা/৩৬৩৭, মিশকাত হা/৫৭৯০। আনাস (রাঃ) হ’তে।
[4]. বুখারী হা/৩৫৪৭; মুসলিম হা/২৩৪৭। আনাস (রাঃ) হ’তে।
[5]. মুসলিম হা/২৩৩৮, মিশকাত হা/৫৭৮২। জাবের (রাঃ) হ’তে।
[6]. বুখারী হা/৩৫৪৫, মুসলিম হা/২৩৪১, নাসাঈ হা/৫০৮৭। আনাস (রাঃ) হ’তে।
[7]. আহমাদ হা/১৩৩৯৬, সনদ ছহীহ। আনাস (রাঃ) হ’তে।
[8]. বুখারী হা/৩৫৪৭; মুসলিম হা/২৩৪৭। আনাস (রাঃ) হ’তে।
[9]. বুখারী হা/৩৫৫৮; মুসলিম হা/২৩৩৬; মিশকাত হা/৪৪২৫, ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে।
[10]. মুসলিম হা/২৩৪৪, নাসাঈ হা/৫২৩২, মিশকাত হা/৫৭৭৯। জাবের (রাঃ) হ’তে।
[11]. বুখারী হা/৩৫৫১, মুসলিম হা/২৩৩৭, মিশকাত হা/৫৭৮৩। বারা বিন ‘আযেব (রাঃ) হ’তে।
[12]. মুসলিম হা/২৩৪৪, ২৩৪৬, মিশকাত হা/৫৭৮০, আব্দুল্লাহ বিন সারজিস (রাঃ) হ’তে।
[13]. তিরমিযী হা/৩৬৩৭, মিশকাত হা/৫৭৯০। আলী (রাঃ) হ’তে।
[14]. তিরমিযী হা/৩৬৩৭, মিশকাত হা/৫৭৯০। আলী (রাঃ) হ’তে।
[15]. বুখারী হা/৩৫৬১, ৫৯০৭। আনাস (রাঃ) হ’তে।
[16]. মুসলিম হা/২৩৩৯। জাবের (রাঃ) হ’তে।
[17]. তিরমিযী হা/৩৬৩৭, মুসলিম হা/২৩৩০; মিশকাত হা/৫৭৮৭, ৫৭৯০। আলী ও আনাস (রাঃ) হ’তে।
[18]. বুখারী হা/১৯৭৩, মুসলিম হা/২৩৩০, মিশকাত হা/৫৭৮৭। আনাস (রাঃ) হ’তে।
একবার গ্রীষ্মের দুপুরে ঘুমন্ত রাসূল (সাঃ)-এর দেহনিঃসৃত ঘর্মসমূহ বাটিতে জমা করেছিলেন খালা উম্মে সুলায়েম (রাঃ)। রাসূল (সাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি এগুলি আমাদের সুগন্ধির সাথে মিশাবো। কেননা এগুলি অধিক সুগন্ধিময়’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এর ব্যবহারের দ্বারা আমরা আমাদের বাচ্চাদের জন্য বরকত আশা করি। রাসূল (সাঃ) বললেন, তুমি ঠিকই করেছ’ (মুসলিম হা/২৩৩১, মিশকাত হা/৫৭৮৮, উম্মে সুলায়েম (রাঃ) হ’তে)।
[19]. বুখারী হা/৩৫৫৬, মুসলিম হা/২৭৬৯, মিশকাত হা/৫৭৯৮।
[20]. তিরমিযী হা/২১৩৩, মিশকাত হা/৯৮।
[21]. মুসলিম হা/৭৩২, মিশকাত হা/১১৯৮।
[22]. বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত হা/২৩৮, ১/২৭০ পৃঃ।
[23]. বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত ১/৩০১; কানযুল ‘উম্মাল হা/১৮৫৭০; ছাখাবী, আল-ওয়াফী বিল অফায়াত ২৯ পৃঃ।
[24]. বুখারী হা/৩৫৫৬; মিশকাত হা/৫৭৯৮ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায় ২ অনুচ্ছেদ।
[25]. তিরমিযী হা/৩৬৩৭; মিশকাত হা/৫৭৯০; ইবনু হিশাম ১/৪০২।
শায়খ ছফিউর রহমান মুবারকপুরী (রহঃ) আলী (রাঃ)-এর বরাতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দেহ সৌষ্ঠব বর্ণনায় যে দীর্ঘ হাদীছটি এনেছেন, সেটি যঈফ (তিরমিযী হা/৩৬৩৮; আর-রাহীক্ব ৪৭৯-৮০ পৃঃ; ঐ, তা‘লীক্ব ১৯৩ পৃঃ)। (২) একইভাবে আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে ‘রাসূল (সাঃ)-এর চেহারায় যেন সূর্য খেলা করত’ মর্মে যে হাদীছ এনেছেন, সেটিও যঈফ (তিরমিযী হা/৩৬৪৮, আর-রাহীক্ব ৪৮১; ঐ, তা‘লীক্ব ১৯৩-৯৪ পৃঃ)। (৩) জাবের বিন সামুরাহ (রাঃ) থেকে ‘তাঁর পায়ের নলা সরু ছিল’... বলে যে হাদীছ এনেছেন, তা যঈফ (তিরমিযী হা/৩৬৪৫, আর-রাহীক্ব ৪৮২ পৃঃ, ঐ, তালীক্ব ১৯৪ পৃঃ)। (৪) জাবের (রাঃ) থেকে ‘তিনি রাস্তায় চলার সময় পিছনের ব্যক্তি তার দেহ থেকে সুগন্ধি পেত’... বলে যে হাদীছটি এনেছেন, তা যঈফ (দারেমী হা/৬৬; আর-রাহীক্ব ৪৮২ পৃঃ; ঐ, তালীক্ব ১৯৪ পৃঃ)। তবে রাসূল (সাঃ) যখন সামনে আসতেন, তখন তাঁর দেহ থেকে সুগন্ধি বের হ’ত, মর্মে বর্ণিত হাদীছটি ‘হাসান’ (আলবানী, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২১৩৭)। (৫) ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে ‘তার সামনের উপরস্থ দু’টি দাঁতের মাঝে ফাঁক ছিল। কথা বলার সময় সেখান থেকে নূর চমকাতো, মর্মে বর্ণিত হাদীছটি ‘খুবই যঈফ’ (দারেমী, মিশকাত হা/৫৭৯৭, যঈফাহ হা/৪২২০; আর-রাহীক্ব ৪৮২ পৃঃ; ঐ, তালীক্ব ১৯৫ পৃঃ)। (৬) হিন্দ বিন আবু হালাহ (রাঃ) থেকে রাসূল (সাঃ)-এর গুণাবলী বর্ণনায় যে দীর্ঘ হাদীছ এনেছেন, সেটিও যঈফ (আলবানী, মুখতাছার শামায়েলে তিরমিযী হা/৬; আর-রাহীক্ব ৪৮৬-৮৭ পৃঃ; ঐ, তা‘লীক্ব ১৯৬-৯৭ পৃঃ)।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য (أخلاق الرسول صـ وخصوصياته)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ছিলেন সকল প্রকার মানবিক গুণে গুণান্বিত এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। বন্ধু ও শত্রু সকলের মুখে সমভাবে তাঁর অনুপম চরিত্র মাধুর্যের প্রশংসা বর্ণিত হয়েছে। কঠোর প্রতিপক্ষ আবু সুফিয়ান সম্রাট হেরাক্লিয়াসের সম্মুখে অকুণ্ঠ চিত্তে তাঁর সততা, আমানতদারী ও সচ্চরিত্রতার উচ্চ প্রশংসা করেছেন (বুখারী হা/৭)। আল্লাহপাক নিজেই স্বীয় রাসূলের প্রশংসায় বলেন, وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيْمٍ ‘নিশ্চয়ই তুমি মহান চরিত্রের অধিকারী’ (ক্বলম ৬৮/৪)। রাসূল (সাঃ) বলেন, بُعِثْتُ لأُتَمِّمَ مَكَارِمَ الأَخْلاَقِ ‘আমি প্রেরিত হয়েছি সর্বোত্তম চরিত্রের পূর্ণতা দানের জন্য’।[1] তাই দেখা যায়, নবুঅত-পূর্ব জীবনে সকলের নিকটে প্রশংসিত হিসাবে তিনি ছিলেন ‘আল-আমীন’ (বিশ্বস্ত, আমানতদার) এবং নবুঅত পরবর্তী জীবনে চরম শত্রুতাপূর্ণ পরিবেশেও তিনি ছিলেন ধৈর্য ও সহনশীলতা, সাহস ও দৃঢ়চিত্ততা, দয়া ও সহমর্মিতা, পরোপকার ও পরমত সহিষ্ণুতা, লজ্জা ও ক্ষমাশীলতা প্রভৃতি অনন্য গুণাবলীর জীবন্ত প্রতীক। আল্লাহ বলেন, لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيُ رَسُوْلِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللهَ كَثِيْرًا ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসকে কামনা করে ও অধিকহারে আল্লাহকে স্মরণ করে’ (আহযাব ৩৩/২১)। তাঁর অনুপম চরিত্রমাধুর্য ও অতুলনীয় বৈশিষ্ট্যসমূহ পূর্ণভাবে বর্ণনা করা ঐরূপ অসম্ভব, যেরূপ পূর্ণচন্দ্রের সৌন্দর্য বর্ণনা করা এবং খালি চোখে আকাশের তারকারাজি গণনা করা অসম্ভব। তবুও দৃষ্টান্ত স্বরূপ কিছু চারিত্রিক নমুনা ও বৈশিষ্ট্য নিম্নে তুলে ধরা হ’ল।-
(১) বাকরীতি (تعبير الكلام) : তিনি হাসিমুখে বিশুদ্ধ, মার্জিত ও সুন্দরভাবে কথা বলতেন। যা দ্রুত শ্রোতাকে আকৃষ্ট করত। আর একেই লোকেরা ‘জাদু’ বলত। তাঁর উন্নত ও শুদ্ধভাষিতায় মুগ্ধ হয়েই ইয়ামনের যেমাদ আযদী মুসলমান হয়ে যান।[2] নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও ‘তিনি ছিলেন আরব ও অনারবের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ভাষাবিদ’।[3] এমনকি ‘হাদীছ জাল হওয়ার অন্যতম নিদর্শন হ’ল তার শব্দসমূহের উচ্চ মানবিশিষ্ট না হওয়া’ (ফাৎহুল মুগীছ)। একারণেই আরবী সাহিত্যে কুরআন ও হাদীছের প্রভাব সবার উপরে। বরং বাস্তব কথা এই যে, এই ভাষার বুকে কুরআন ও হাদীছের অবস্থানের কারণেই তা বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। আর কুরআন ও হাদীছের সর্বোচ্চ বাকরীতি ও আলংকরিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই আরবী ভাষা ও সাহিত্য সর্বোচ্চ মর্যাদায় আসীন হ’তে পেরেছে এবং ক্রমোন্নতির দিকে এগিয়ে চলেছে। অথচ হিব্রু, খালেদী, ল্যাটিন, সংস্কৃত প্রভৃতি পৃথিবীর প্রাচীন ভাষা সমূহ বিলুপ্ত হয়ে গেছে অথবা বিলুপ্তির পথে।
(২) ক্রোধ দমন শৈলী (أسلوب كظم الغيظ) : ক্রোধ দমনের এক অপূর্ব ক্ষমতা ছিল তাঁর মধ্যে। তিনি বলতেন, প্রকৃত বীর সেই, যে ক্রোধের সময় নিজেকে দমন করতে পারে।[4] আয়েশা (রাঃ) বলেন, তিনি কখনো কাউকে নিজের স্বার্থে নিজ হাতে মারেননি। কোন মহিলা বা খাদেমকে কখনো প্রহার করেননি’।[5]
(৩) হাসি-কান্না (الضحك والبكاء) : তিনি মৃদু হাস্য করতেন। কখনোই অট্টহাস্য করতেন না। সদা প্রফুল্ল থাকতেন। কখনোই গোমড়ামুখো থাকতেন না। তবে দুশ্চিন্তায় পড়লে তার ছাপ চেহারায় পড়ত এবং তখন তিনি ছালাতে রত হ’তেন।[6] ছোটখাট হালকা রসিকতা করতেন। যেমন, (ক) একদিন স্ত্রী আয়েশার নিকটে এসে তার এক বৃদ্ধা খালা রাসূল (সাঃ)-কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার জন্য আল্লাহর নিকটে দো‘আ করুন যেন তিনি আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করান। জবাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, হে অমুকের মা! কোন বৃদ্ধা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। একথা শুনে উক্ত মহিলা কাঁদতে শুরু করল। তখন আয়েশা বললেন, তাদের কি দোষ? জবাবে রাসূল (সাঃ) বললেন, তুমি কি কুরআনে পড়োনি যে আল্লাহ বলেছেন,إِنَّا أَنْشَأْنَاهُنَّ إِنْشَاءً- فَجَعَلْنَاهُنَّ أَبْكَارًا- عُرُبًا أَتْرَابًا- لِأَصْحَابِ الْيَمِينِ ‘আমরা জান্নাতী নারীদের বিশেষরূপে সৃষ্টি করেছি’। ‘অতঃপর তাদের চিরকুমারী করেছি’। সদা সোহাগিনী, সমবয়স্কা’। ‘ডান সারির লোকদের জন্য’ (ওয়াক্বি‘আহ ৫৬/৩৫-৩৮)।[7] অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘জান্নাতবাসী নারী-পুরুষ সবাই ৩০ থেকে ৩৩ বছর বয়সী হবে’।[8]
(খ) এক সফরে তিনি দেখেন যে, মহিলাদের নিয়ে তাঁর কৃষ্ণকায় উষ্ট্রচালক গোলাম আনজাশাহ দ্রুত গতিতে উট হাঁকিয়ে চলেছে। তখন রাসূল (সাঃ) তাকে বললেন,رُوَيْدَكَ يَا أَنْجَشَةُ، لاَ تَكْسِرِ الْقَوَارِيرَ ‘ধীরে চালাও হে আনজাশা! কাঁচের পাত্রগুলি ভেঙ্গে ফেল না’।[9] (গ) আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) আমাদের সঙ্গে মিশতেন। এমনকি আমার ছোট ভাই আবু ওমায়ের একটি ‘নুগায়ের’ অর্থাৎ লাল ঠোট ওয়ালা চড়ুই জাতীয় পাখি পুষত। যা নিয়ে সে খেলা করত। রাসূল (সাঃ) যখন এসে তাকে খেলতে দেখতেন, তখন বলতেন, يَا أَبَا عُمَيْرٍ مَا فَعَلَ النُّغَيْرُ ‘হে আবু ওমায়ের! কি করছে তোমার নুগায়ের?[10]
ছালাতের মধ্যে বিশেষ করে তাহাজ্জুদের ছালাতে তিনি আল্লাহর ভয়ে কাঁদতেন। অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিকে দেখলে তার অন্তর কেঁদে উঠতো এবং তার অভাব দূরীকরণে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। চাচা হামযা, কন্যা যয়নব ও পুত্র ইবরাহীমের মৃত্যুতে তিনি শিশুর মত হু হু করে কেঁদেছিলেন। তিনি অন্যের মুখে কুরআন শুনতে পসন্দ করতেন। একবার ইবনু মাসঊদের মুখে সূরা নিসা শুনে তাঁর চোখ বেয়ে অবিরল ধারে অশ্রু প্রবাহিত হয়। অতঃপর ৪১ আয়াতে পৌঁছলে তিনি তাকে থামতে বলেন।[11]
(৪) বীরত্ব ও ধৈর্যশীলতা (الشجاعة والصبر) : কঠিন বিপদের মধ্যেও তিনি দৃঢ় হিমাদ্রির ন্যায় ধৈর্যশীল থাকতেন। মাক্কী জীবনের আতংকময় পরিবেশে এবং মাদানী জীবনের প্রতি মুহূর্তে জীবনের হুমকির মধ্যেও তাঁকে কখনো ভীত-বিহবল ও অধৈর্য হ’তে দেখা যায়নি। হযরত আলী (রাঃ) বলেন, ঘনঘোর যুদ্ধের বিভীষিকার মধ্যে আমরা রাসূল (সাঃ)-এর পিছনে গিয়ে আশ্রয় নিতাম। তিনিই সর্বদা শত্রুর নিকটবর্তী থাকতেন (আহমাদ হা/৬৫৪, সনদ ছহীহ)। শত্রুর ভয়ে যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যাবার কোন ঘটনা তাঁর জীবনে নেই। অভাবে-অনটনে, দুঃখে-বেদনায়, সর্বাবস্থায় তিনি কঠিন ধৈর্য অবলম্বন করতেন। এমনকি তিনদিন না খেয়ে পেটে পাথর বেঁধে সৈন্যদের সাথে অবর্ণনীয় কষ্টে খন্দক খোঁড়ার কাজে অংশ নিলেও চেহারায় তার প্রকাশ ঘটতো না। বরং সৈন্যদের সাথে আখেরাতের কবিতা পাঠের মধ্য দিয়েই খুশীমনে নিজ হাতে খন্দক খুঁড়েছেন। শত্রুদের শত্রুতা যতই বৃদ্ধি পেত তাঁর ধৈর্যশীলতা ততই বেড়ে যেত। ওহোদ ও হোনায়েন যুদ্ধে তাঁর বীরত্ব ও অসম সাহসিকতা ছিল অচিন্তনীয়।
আনাস (রাঃ) বলেন, আমি একদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে চলছিলাম। এসময় তাঁর উপর মোটা জরিদার একটি নাজরানী চাদর শোভা পাচ্ছিল। হঠাৎ এক বেদুঈন এসে তাঁর চাদর ধরে এমন হেচকা টান দিল যে, তিনি বেদুঈনের বুকে গিয়ে পড়েন। এতে আমি দেখলাম যে, জোরে টান দেওয়ার কারণে রাসূল (সাঃ)-এর ঘাড়ের উপর চাদরের দাগ পড়ে গেল। অতঃপর লোকটি বলল, হে মুহাম্মাদ! আল্লাহর মাল যা তোমার কাছে আছে, তা থেকে আমাকে দেবার নির্দেশ দাও (يَا مُحَمَّدُ مُرْ لِى مِنْ مَالِ اللهِ الَّذِيْ عِنْدَكَ)। তখন রাসূল (সাঃ) তার দিকে তাকালেন ও হাসলেন। অতঃপর তাকে কিছু দান করার জন্য আদেশ দিলেন’।[12]
উক্ত ঘটনায় রাসূল (সাঃ)-এর অতুলনীয় ধৈর্য ও দানশীলতার প্রমাণ পাওয়া যায়। এরূপ অসংখ্য ঘটনা তাঁর জীবনে রয়েছে।
(৫) সেবা পরায়ণতা (عيادة المرضى) : কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি তার বাড়ীতে গিয়ে সেবা করতেন ও সান্ত্বনা দিতেন। তার জন্য দো‘আ করতেন। কি খেতে মন চায় শুনতেন। ক্ষতিকর না হ’লে তা দেবার ব্যবস্থা করতেন। নিজের ইহূদী কাজের ছেলেটি অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি তার বাড়ীতে গিয়ে তাকে সান্ত্বনা দেন ও পরিচর্যা করেন। এ সময় তিনি বলেন, তুমি ইসলাম কবুল কর। তখন ছেলেটি তার বাপের দিকে তাকাল যে তার নিকটে বসা ছিল। বাপ তাকে বলল, أَطِعْ أَبَا الْقَاسِمِ ‘তুমি আবুল ক্বাসেম-এর কথা মেনে নাও। তখন ছেলেটি কালেমা শাহাদাত পাঠ করে ইসলাম কবুল করল। অতঃপর মারা গেল। এরপর রাসূল (সাঃ) বের হবার সময় বললেন الْحَمْدُ للهِ الَّذِى أَنْقَذَهُ بِىْ مِنَ النَّارِ ‘আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা, যিনি তাকে আমার মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিলেন’।[13]
(৬) সহজ পন্থা অবলম্বন (اةخاذ الطريقة السهلة) : হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ)-কে যখনই দু’টি কাজের এখতিয়ার দেওয়া হ’ত, তখন তিনি সহজটি বেছে নিতেন। যদি তাতে গুনাহের কিছু না থাকত। তিনি নিজের জন্য কোন অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতেন না। কিন্তু আল্লাহর জন্য হ’লে প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়তেন না’।[14] ওয়ায-নছীহত করতেন, যতক্ষণ না মানুষ বিব্রতবোধ করে।[15] নফল ছালাত চুপে চুপে আদায় করতেন, যাতে অন্যের কষ্ট না হয়। তিনি বলতেন, فَاكْلَفُوْا مِنَ الْعَمَلِ مَا تُطِيْقُوْنَ ‘তোমরা এমন আমল কর, যা তোমাদের সাধ্যে কুলায়’।[16]
(৭) দানশীলতা (الجود) : যতক্ষণ তাঁর কাছে কিছু থাকত, ততক্ষণ তিনি দান করতেন। রামাযান মাসে তা হয়ে যেত كَالرِّيْحِ الْمُرْسَلَةِ ‘প্রবহমাণ বায়ুর মত’। তিনি ছাদাক্বা গ্রহণ করতেন না। কিন্তু হাদিয়া নিতেন। অথচ তা নিজের প্রয়োজনে যৎসামান্য ব্যয় করে সবই দান করে দিতেন। তিনি বলতেন,لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لأَخِيْهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ ‘কেউ অতক্ষণ প্রকৃত মুমিন হ’তে পারবে না, যতক্ষণ না সে অপরের জন্য তাই-ই ভালবাসবে, যা সে নিজের জন্য ভালবাসে’।[17] তিনি বলতেন,وَلاَ يَجْتَمِعُ الشُّحُّ وَالإِيْمَانُ فِيْ قَلْبِ عَبْدٍ أَبَدًا ‘একজন বান্দার হৃদয়ে ঈমান ও কৃপণতা কখনো একত্রিত হ’তে পারে না’।[18]
(৮) লজ্জাশীলতা (الحياء) : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সর্বদা দৃষ্টি অবনত রাখতেন। কখনোই অন্যের উপরে নিজের দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেন না। তিনি কারু মুখের উপর কোন অপসন্দনীয় কথা বলতে লজ্জা পেতেন। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, كَانَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَشَدَّ حَيَاءً مِنَ الْعَذْرَاءِ فِى خِدْرِهَا وَكَانَ إِذَا كَرِهَ شَيْئًا عَرَفْنَاهُ فِى وَجْهِهِ- ‘তিনি পর্দানশীন কুমারী মেয়েদের চাইতে অধিক লজ্জাশীল ছিলেন। যখন তিনি কিছু অপসন্দ করতেন, তখন তাঁর চেহারা দেখে আমরা বুঝে নিতাম’।[19] কারু কোন মন্দ কাজ দেখলে সরাসরি তাকে মন্দ না বলে সাধারণভাবে নিষেধ করতেন, যাতে লোকটি লজ্জা না পায়। অথচ বিষয়টি বুঝতে পেরে সে নিজেই সংশোধন হয়ে যায়।
(৯) বিনয় ও নম্রতা (التواضع والتذلل) : তিনি ছিলেন বিনয়ী ও নিরহংকার চরিত্রের মানুষ। তিনি সবাইকে মানুষ হিসাবে সমান জ্ঞান করতেন। উঁচু-নীচু ভেদাভেদ করতেন না। তাঁকে দেখে সম্মানার্থে দাঁড়াতে ছাহাবীগণকে নিষেধ করতেন।[20] দাস-দাসীদের নিকটে কখনোই অহংকার প্রকাশ করতেন না। তাদের কোন কাজে অসন্তুষ্ট হয়ে উহ্ শব্দটি করতেন না। বরং তাদের কাজে নিজে সাহায্য করতেন। আনাস (রাঃ) বলেন, আমি ১০ বছর রাসূল (সাঃ)-এর খিদমত করেছি। কিন্তু তিনি কখনো আমাকে কোন কাজের জন্য কৈফিয়ত তলব করেননি।[21] অবশ্য তার অর্থ এটা নয় যে, অন্যায় কথা বা কাজের জন্য তিনি কাউকে ধমকাতেন না বা ভৎর্সনা করতেন না। যেমন তিনি উসামা ও খালেদকে ধমকিয়েছেন এবং তাদের ব্যাপারে তিনি দায়ী নন বলে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চেয়েছেন।[22] তিনি সর্বদা আগে সালাম দিতেন ও মুছাফাহার জন্য আগে হাত বাড়িয়ে দিতেন। ছাহাবীগণকে সম্মান করে অথবা আদর করে কখনো কখনো তাদের উপনামে ডাকতেন। যেমন আব্দুল্লাহ বিন ওছমানকে তার উপনামে ‘আবুবকর’, আব্দুর রহমান বিন ছাখারকে ‘আবু হুরায়রা’ (ছোট বিড়ালের বাপ), আলীকে ‘আবু তোরাব’ (ধূলি ধুসরিত), হুযায়ফাকে ‘নাওমান’ (ঘুম কাতর), অতি সতর্ক ও সাবধানী হওয়ার কারণে আনাসকে ‘যুল উযনাইন’ (দুই কান ওয়ালা), সফরে অধিক বোঝা বহনকারী হিসাবে মুক্তদাস মিহরান বিন ফার্রূখ-কে ‘সাফীনাহ’ (নৌকা) বলে ডাকতেন।[23] উল্লেখ্য যে, খুশী অবস্থায় উপনামে ডাকা আরবীয় রীতি হিসাবে প্রসিদ্ধ।
(ক) দুগ্ধদায়িনী মা, রোগী, বৃদ্ধ, মুসাফির ইত্যাদি বিবেচনায় তিনি জামা‘আতে ছালাত সংক্ষেপ করতেন।[24]
(খ) রাসূল (সাঃ)-এর ‘আযবা’ (الْعَضْبَاءُ) নাম্নী একটা উষ্ট্রী ছিল। সে এতই দ্রুতগামী ছিল যে, কোন বাহন তাকে অতিক্রম করতে পারত না। কিন্তু একদিন এক বেদুঈনের সওয়ারী আযবা-কে অতিক্রম করে গেল। বিষয়টি মুসলমানদের কাছে কষ্টদায়ক মনে হ’ল। তখন রাসূল (সাঃ) তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বলেন,إِنَّ حَقًّا عَلَى اللهِ أَنْ لاَ يَرْفَعَ شَيْئًا مِنَ الدُّنْيَا إِلاَّ وَضَعَهُ ‘দুনিয়াতে আল্লাহর নীতি এটাই যে, কাউকে উঁচু করলে তাকে নীচুও করে থাকেন’।[25]
(গ) জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে خَيْرُ الْبَرِيَّةِ (সৃষ্টির সেরা) বলে সম্বোধন করলে তিনি তাকে বলেন, ذَاكَ إِبْرَاهِيْمُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ ‘তিনি হ’লেন ইবরাহীম (আঃ)’।[26]
(ঘ) একবার এক ব্যক্তি রাসূল (সাঃ)-এর সামনে এসে ভয়ে বিহবল হয়ে পড়ে। তখন তিনি তাকে বলেন,هَوِّنْ عَلَيْكَ فَإِنِّىْ لَسْتُ بِمَلِكٍ إِنَّمَا أَنَا ابْنُ امْرَأَةٍ مِنْ قُرَيْشٍ تَأْكُلُ الْقَدِيْدَ ‘স্থির হও! আমি কোন বাদশাহ নই। আমি একজন কুরায়েশ মহিলার সন্তান মাত্র। যিনি শুকনা গোশত ভক্ষণ করতেন’।[27] উল্লেখ্য যে, আরবের গরীব লোকেরা শুকনা গোশত খেতেন। এ সকল ঘটনায় বাস্তব জীবনে রাসূল (সাঃ)-এর বিনয় ও নম্রতা অবলম্বনের ও নিরহংকার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে।
(১০) সংসার জীবনে (فى حياته العائلية) : হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) নিজের জুতা নিজেই সেলাই করতেন ও কাপড়ে তালি লাগাতেন। নিজের কাপড় নিজেই সেলাই করতেন, সংসারের কাজ নিজ হাতে করতেন, নিজে বকরী দোহন করতেন, কাপড় ছাফ করতেন ও নিজের কাজ নিজে করতেন’।[28]
স্ত্রীদের মধ্যে আয়েশা (রাঃ) ছিলেন কুমারী ও সবচেয়ে কম বয়স্কা। তাই রাসূল (সাঃ) কখনো কখনো সাথীদের এগিয়ে দিয়ে নিজে তার সাথে দৌড়ে পাল্লা দিতেন। তাতে আয়েশা জিতে যেতেন। আবার আয়েশা ভারী হয়ে গেলে প্রতিযোগিতায় তিনি হেরে যান’।[29] তাকে নিয়ে বিয়ে বাড়ীতে বেদুঈন মেয়েদের নাচ-গান শুনেছেন।[30] রাসূল (সাঃ) যে কত বাস্তববাদী ও সংস্কৃতিমনা ছিলেন, এতে তার প্রমাণ মেলে। খায়বর যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে নব পরিণীতা স্ত্রী ছাফিইয়াকে উটে সওয়ার করার জন্য তিনি নীচু হয়ে নিজের হাঁটু পেতে দেন। অতঃপর ছাফিইয়াহ নবীর হাঁটুর উপরে পা রেখে উটে সওয়ার হন’।[31]
(১১) সমাজ জীবনে (فى حياةه الإجةماعية) : বন্ধুদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন। নিজের ও স্ত্রী সম্পর্কিত আত্মীয়-স্বজনের সাথে দৃঢ় সম্পর্ক রক্ষা করতেন। কারু ক্ষতি হতে পারে এমন কাজ হ’তে দূরে থাকতেন। পরনিন্দা ও পরচর্চা হতে বেঁচে থাকতেন। সঙ্গী-সাথীদের খোঁজ-খবর নিতেন। তিনি শত্রুদের দেওয়া কষ্টে ও মূর্খদের বাড়াবাড়িতে ধৈর্য ধারণ করতেন। তিনি মন্দকে মন্দ বলতেন ও ভালকে ভাল বলতেন। কিন্তু সর্বদা মধ্যপন্থী আচরণ করতেন।[32] তিনি সকলের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকতেন। তাঁর নিকটে লোকেদের মর্যাদার ভিত্তি ছিল তাক্বওয়া বা আল্লাহভীরুতা (আহমাদ হা/২৩৫৩৬)। সমাজের দুর্বল শ্রেণীর প্রতি তাঁর করুণা ছিল সর্বাধিক। তিনি বলতেন,اَبْغُونِىْ فِي الضُّعَفَاءِ فَإِنَّمَا تُرْزَقُوْنَ وَتُنْصَرُوْنَ بِضُعَفَائِكُمْ ‘তোমরা আমাকে দুর্বল শ্রেণীর মধ্যে তালাশ করো। কেননা তোমরা রূযিপ্রাপ্ত হয়ে থাক এবং সাহায্যপ্রাপ্ত হয়ে থাক দুর্বল শ্রেণীর মাধ্যমে’।[33] অর্থাৎ তাদের প্রতি সদাচরণের মাধ্যমে তোমরা আমার সন্তুষ্টি তালাশ কর।
সমাজ সংস্কারে তিনি জনমতের মূল্যায়ন করতেন। যেমন-
(১) কুরায়েশদের নির্মিত কা‘বাগৃহে ইবরাহীম (আঃ) নির্মিত কা‘বাগৃহ থেকে কিছু অংশ ছেড়ে রাখা হয়েছিল। ছাড়া অংশটিকে ‘রুকনে হাত্বীম’ বলা হয়। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) চেয়েছিলেন ওটাকে ইবরাহীমী ভিতের উপর কা‘বাগৃহের মধ্যে শামিল করতে এবং কা‘বাগৃহের দু’টো দরজা করতে। কিন্তু জনমত বিগড়ে যাবার ভয়ে তিনি তা করেননি। এবিষয়ে তিনি একদিন আয়েশা (রাঃ)-কে বলেন,لَوْلاَ قَوْمُكِ حَدِيْثٌ عَهْدُهُمْ بِكُفْرٍ لَنَقَضْتُ الْكَعْبَةَ فَجَعَلْتُ لَهَا بَابَيْنِ بَابٌ يَدْخُلُ النَّاسُ وَبَابٌ يَخْرُجُوْنَ، ‘যদি তোমার কওম নওমুসলিম না হ’ত, তাহ’লে আমি কা‘বা ভেঙ্গে দিতাম এবং এর দু’টি দরজা করতাম। একটি দিয়ে মুছল্লীরা প্রবেশ করত এবং অন্যটি দিয়ে বেরিয়ে যেত। কিন্তু কুরায়েশরা তা না করে অনেক উঁচুতে দরজা নির্মাণ করে। যাতে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ সেখানে প্রবেশ করতে না পারে। পরবর্তীতে আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (৬৪-৭৩ হি.) সেটি করেন’।[34]
(২) তিনি সাধ্যপক্ষে উম্মতের ঐক্য রক্ষার চেষ্টা করতেন। যেমন মুনাফিকদের অপতৎপরতা সীমা ছাড়িয়ে গেলে ওমর ফারূক (রাঃ) রাসূল (সাঃ)-কে বলেন, আমাকে অনুমতি দিন এই মুনাফিকটাকে (ইবনু উবাইকে) শেষ করে দিই। জবাবে রাসূল (সাঃ) বলেন, না। তাতে লোকেরা বলবে যে, মুহাম্মাদ তার সাথীদের হত্যা করছেন’।[35]
(৩) তিনি লোকদের সাথে নম্র আচরণ করতেন। বৈঠকে তিনি কোনরূপ অহেতুক ও অপ্রয়োজনীয় কথা বলতেন না। বেদুঈনদের রূঢ় আচরণে তিনি ধৈর্য অবলম্বন করতেন। বলা চলে যে, তাঁর এই বিনয়ী ব্যবহার ও অতুলনীয় ব্যক্তি মাধুর্যের প্রভাবেই রুক্ষ স্বভাবের মরুচারী আরবরা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করেছিল। আল্লাহ বলেন, فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيْظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوْا مِنْ حَوْلِكَ ‘আর আল্লাহর রহমতেই তুমি তাদের প্রতি (অর্থাৎ স্বীয় উম্মতের প্রতি) কোমলহৃদয় হয়েছ। যদি তুমি কর্কশভাষী ও কঠোর হৃদয়ের হ’তে, তাহ’লে তারা তোমার পাশ থেকে সরে যেত’ (আলে ইমরান ৩/১৫৯)। রাসূল (সাঃ)-এর এই অনন্য চরিত্র মাধুর্য ছিল নিঃসন্দেহে আল্লাহর বিশেষ দান।
[1]. হাকেম হা/৪২২১; ছহীহাহ হা/৪৫, রাবী আবু হুরায়রা (রাঃ)।
[2]. মুসলিম হা/৮৬৮ (৪৬); মিশকাত হা/৫৮৬০।
[3]. মুক্বাদ্দামা ফাৎহুল মুলহিম শারহু মুসলিম ১৬ পৃঃ।
[4]. বুখারী হা/৬১১৪; মুসলিম হা/২৬০৯ (১০৭); মিশকাত হা/৫১০৫ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায় ২০ অনুচ্ছেদ।
[5]. মুসলিম হা/২৩২৮ (৭৯); মিশকাত হা/৫৮১৮।
[6]. আবুদাঊদ হা/১৩১৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৭০৩; মিশকাত হা/১৩২৫।
[7]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা ওয়াক্বি‘আহ ৩৫-৩৮ আয়াত; রাযীন, মিশকাত হা/৪৮৮৮, সনদ ছহীহ ‘শিষ্টাচার সমূহ’ অধ্যায় ‘ঠাট্টা করা’ অনুচ্ছেদ।
[8]. তিরমিযী হা/২৫৪৫; আহমাদ হা/২২১৫৯; ছহীহাহ হা/২৯৮৭; মিশকাত হা/৫৬৩৯।
[9]. বুখারী হা/৬২১১; মুসলিম হা/২৩২৩; মিশকাত হা/৪৮০৬।
[10]. বুখারী হা/৬১২৯; মুসলিম হা/২১৫০ (৩০); মিশকাত হা/৪৮৮৪ ‘ঠাট্টা করা’ অনুচ্ছেদ।
[11]. বুখারী হা/৫০৫০; মুসলিম হা/৮০০; মিশকাত হা/২১৯৫।
[12]. বুখারী হা/৬০৮৮; মুসলিম হা/১০৫৭; মিশকাত হা/৫৮০৩ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায় ১ অনুচ্ছেদ।
[13]. আবুদাঊদ হা/৩০৯৫; বুখারী হা/১৩৫৬; মিশকাত হা/১৫৭৪ ‘জানায়েয’ অধ্যায় ১ অনুচ্ছেদ।
[14]. বুখারী হা/৬১২৬; মুসলিম হা/২৩২৭; মিশকাত হা/৫৮১৭ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায় ৩ অনুচ্ছেদ।
[15]. বুখারী হা/৬৪১১; মুসলিম হা/২৮২১; মিশকাত হা/২০৭।
[16]. বুখারী হা/১৯৬৬ ‘ছওম’ অধ্যায়-৩০ ‘ছওমে বেছালে বাড়াবাড়ির শাস্তি’ অনুচ্ছেদ-৪৯।
[17]. বুখারী হা/১৩; মুসলিম হা/৪৫ (৭২); মিশকাত হা/৪৯৬১ ‘শিষ্টাচার সমূহ’ অধ্যায় ১৫ অনুচ্ছেদ।
[18]. তিরমিযী হা/১৬৩৩; নাসাঈ হা/৩১০৮; মিশকাত হা/৩৮২৮ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।
[19]. বুখারী হা/৬১০২; মুসলিম হা/২৩২০; মিশকাত হা/৫৮১৩ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায় ৩ অনুচ্ছেদ।
[20]. তিরমিযী হা/২৭৫৪; মিশকাত হা/৪৬৯৮।
[21]. বুখারী হা/৬০৩৮; মুসলিম হা/২৩০৯; মিশকাত হা/৫৮০১।
[22]. মুসলিম হা/৯৬; বুখারী হা/৪৩৩৯।
[23]. আবু হুরায়রা (তিরমিযী হা/৩৮৪০); আবু তোরাব (বুখারী হা/৬২০৪); নাওমান (মুসলিম হা/১৭৮৮ (৯৯); যুল-উযনাইন (আবুদাঊদ হা/৫০০২; তিরমিযী হা/১৯৯২; মিশকাত হা/৪৮৮৭); সাফীনাহ (আহমাদ হা/২১৯৭৮, সনদ হাসান; হাদীছের প্রথমাংশ মিশকাত হা/৫৩৯৫)।
[24]. বুখারী হা/৭০৩; মুসলিম হা/৪৬৭ (১৮৩); মিশকাত হা/১১৩১, ৩৪, ২৯।
[25]. বুখারী হা/৬৫০১ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়-৮১ ‘নম্রতা’ অনুচ্ছেদ-৩৮।
[26]. মুসলিম হা/২৩৬৯; মিশকাত হা/৪৮৯৬ ‘শিষ্টাচারসমূহ’ অধ্যায় ১৩ অনুচ্ছেদ।
[27]. ইবনু মাজাহ হা/৩৩১২; ছহীহাহ হা/১৮৭৬।
[28]. আহমাদ হা/২৬২৩৭; মিশকাত হা/৫৮২২ সনদ ছহীহ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়।
[29]. ইবনু মাজাহ হা/১৯৭৯; ছহীহাহ হা/১৩১।
[30]. বুখারী হা/৫১৯০; মুসলিম হা/৮৯২ (১৮); মিশকাত হা/৩২৪৪; বুখারী হা/৫১৪৭; মিশকাত হা/৩১৪০।
[31]. বুখারী হা/৪২১১ ‘খায়বর যুদ্ধ’ অনুচ্ছেদ ।
[32]. বুখারী হা/৩৯; মিশকাত হা/১২৪৬।
[33]. আবুদাঊদ হা/২৫৯৪; মিশকাত হা/৫২৪৬; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৭৭৯।
[34]. বুখারী হা/১২৬ ‘ইলম’ অধ্যায়-৩, অনুচ্ছেদ-৪৮; ঐ, হা/১৫৮৪ ‘হজ্জ’ অধ্যায়-২৫, অনুচ্ছেদ-৪২।
[35]. তিরমিযী হা/৩৩১৫ সনদ ছহীহ ।
পর্যালোচনা (المراجعة)
অতি বড় দুশমনও রাসূল (সাঃ)-কে কখনো অসৎ বলেনি। কিন্তু তারা কুরআনী বিধানকে মানতে রাযী হয়নি। স্বেচ্ছাচারিতায় অভ্যস্ত পুঁজিবাদী গোত্রনেতারা ইসলামের পুঁজিবাদ বিরোধী ও ন্যায়বিচারভিত্তিক অর্থনীতি, মানবিক সমাজনীতি এবং আখেরাতভিত্তিক জীবন নীতিকে মেনে নিতে পারেনি। আর সে কারণেই তো আবু জাহল রাসূল (সাঃ)-কে বলেছিল, إِنَّا لاَ نُكَذِّبُكَ وَلَكِنْ نُكَذِّبُ بِمَا جِئْتَ بِهِ ‘আমরা তোমাকে মিথ্যা বলি না। বরং তুমি যে ইসলাম নিয়ে এসেছ, তাকে মিথ্যা বলি’। এ প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়,
فَإِنَّهُمْ لاَ يُكَذِّبُوْنَكَ وَلَكِنَّ الظَّالِمِيْنَ بِآيَاتِ اللهِ يَجْحَدُوْنَ- (الأنعام 33)-
‘বস্ত্ততঃ ওরা তোমাকে মিথ্যা বলে না। বরং এইসব যালেমরা আল্লাহর আয়াত সমূহকে অস্বীকার করে’ (আন‘আম ৬/৩৩)।[1]
বাতিলপন্থীরা চিরকাল ন্যায় ও সত্যকে ভয় পায়। তাই মক্কার মুশরিক নেতারা কুরআনকে সত্য বলে স্বীকার করার পরেও রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে এসে কুরআন পরিবর্তনের দাবী করেছিল। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَإِذَا تُتْلَى عَلَيْهِمْ آيَاتُنَا بَيِّنَاتٍ قَالَ الَّذِيْنَ لاَ يَرْجُوْنَ لِقَاءنَا ائْتِ بِقُرْآنٍ غَيْرِ هَـذَا أَوْ بَدِّلْهُ قُلْ مَا يَكُوْنُ لِيْ أَنْ أُبَدِّلَهُ مِن تِلْقَاء نَفْسِيْ إِنْ أَتَّبِعُ إِلاَّ مَا يُوْحَى إِلَيَّ إِنِّيْ أَخَافُ إِنْ عَصَيْتُ رَبِّيْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيْمٍ- (يونس ১৫)-
‘আর যখন তাদের কাছে আমাদের স্পষ্ট আয়াত সমূহ পাঠ করা হয়, তখন যারা আমাদের সাক্ষাৎ কামনা করে না তারা বলে যে, এটি ব্যতীত অন্য কুরআন নিয়ে এসো অথবা এটাকেই পরিবর্তন কর। তুমি বলে দাও যে, নিজের পক্ষ থেকে এতে পরিবর্তন আনার কোন সাধ্য আমার নেই। আমি তো কেবল সেটারই অনুসরণ করি যা আমার নিকটে অহী করা হয়। আমি যদি আমার পালনকর্তার অবাধ্যতা করি, তাহ’লে আমি ভয়ংকর দিবসের শাস্তির আশংকা করি’ (ইউনুস ১০/১৫)।
আল্লাহ তাঁর রাসূলকে বলেন, إِنَّكَ لَعَلَى هُدًى مُسْتَقِيمٍ ‘নিশ্চয়ই তুমি সরল পথের উপরে আছ’ (হজ্জ ২২/৬৭)।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পুরা জীবন ছিল কুরআনের বাস্তব চিত্র। সেকারণ একদা মা আয়েশাকে রাসূল (সাঃ)-এর চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেছিলেন, كَانَ خُلُقُهُ الْقُرْآنَ ‘তাঁর চরিত্র ছিল কুরআন’।[2] অর্থাৎ তিনি ছিলেন কুরআনের বাস্তব রূপকার। হাদীছের পাতায় পাতায় যার দৃষ্টান্ত সমূহ স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে। কুরআন ও হাদীছ তাই মুসলিম জীবনের চলার পথের একমাত্র আলোকবর্তিকা। আল্লাহ আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জীবন চরিত যথাযথভাবে অনুসরণের তাওফীক দান করুন। আমীন!
[1]. তিরমিযী হা/৩০৬৪; মিশকাত হা/৫৮৩৪, সনদ মুরসাল।
[2]. আহমাদ হা/২৫৩৪১, ২৫৮৫৫; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৮১১।
দু’টি জীবন্ত মু‘জেযা : কুরআন ও হাদীছ (معجزتان خالدتان : القرآن والحديث)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জীবনে আমরা বহু মু‘জেযার কথা জেনেছি। যার সবই ছিল তাঁর জীবদ্দশায় এবং তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে সেগুলির বিলুপ্তি ঘটেছে। যেমন পূর্বের নবীগণের বেলায় ঘটেছে। তাওরাত, যবূর, ইনজীল প্রভৃতি পূর্বেকার কিতাব সমূহ পরিবর্তিত ও বিকৃত হয়ে গেছে। কিন্তু রাসূল (সাঃ)-এর ইন্তেকালের পরেও যে মু‘জেযা জীবন্ত হয়ে আছে এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত থাকবে, তা হ’ল তাঁর আনীত কালামুল্লাহ আল-কুরআনুল হাকীম। বিশ্ব মানবতার চিরন্তন পথপ্রদর্শক হিসাবে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ যা দুনিয়াবাসীর জন্য তাঁর শেষনবীর মাধ্যমে প্রেরণ করেছেন। যতদিন মানুষ ঐ আলোক স্তম্ভ থেকে আলো নিবে, ততদিন তারা পথভ্রষ্ট হবে না। যা মানব জাতির আমানত হিসাবে রক্ষিত আছে এবং চিরকাল থাকবে। যতদিন পৃথিবী থাকবে, মানবজাতি থাকবে, ততদিন কুরআন থাকবে অবিকৃত ও অক্ষুণ্ণভাবে। একে বিকৃত করার বা বিলুপ্ত করার ক্ষমতা কারু হবে না। রাসূল (সাঃ)-এর ২৩ বছরের নবুঅতী জীবনের বাঁকে বাঁকে বাস্তবতার নিরিখে আসমানী তারবার্তা হিসাবে কুরআন নাযিল হয়েছে পরম্পরাগতভাবে। নুযূলে কুরআনের শুরু থেকে নবুঅতের শুরু এবং নুযূলে কুরআনের সমাপ্তিতে নবী জীবনের সমাপ্তি। তাই নবীচরিত আলোচনায় কুরআনের আলোচনা অবশ্যম্ভাবীরূপে এসে পড়ে। শেষনবী (সাঃ) চলে গেছেন। রেখে গেছেন কুরআন। কিন্তু কি আছে সেখানে? এক্ষণে আমরা কুরআনের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্যাবলী সংক্ষেপে তুলে ধরার প্রয়াস পাব।
কুরআনের পরিচয় (تعارف القرآن)
কুরআনের মূল পরিচয় হ’ল এই যে, এটি ‘কালামুল্লাহ’ (كَلاَمُ اللهِ) বা আল্লাহর কালাম। যা সরাসরি আল্লাহর নিকট থেকে এসেছে।[1] সৃষ্টিজগত দুনিয়াবী চোখে কখনোই তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে দেখতে পাবে না (আন‘আম ৬/১০৩)। তবে তাঁর ‘কালাম’ দেখে, পড়ে, শুনে ও বুঝে হেদায়াত লাভ করতে পারবে। কুরআনের ভাব ও ভাষা, এর প্রতিটি বর্ণ, শব্দ ও বাক্য আল্লাহর। জিব্রীল ছিলেন বাহক[2] এবং রাসূল (সাঃ) ছিলেন এর প্রচারক ও ব্যাখ্যাতা।[3] কুরআন লওহে মাহফূযে (সুরক্ষিত ফলকে) লিপিবদ্ধ ছিল’ (বুরূজ ৮৫/২১-২২)। সেখান থেকে আল্লাহর হুকুমে ক্রমে ক্রমে নাযিল হয়েছে।[4]
শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর আগমনের পর বিগত সকল নবীর নবুঅত শেষ হয়ে গিয়েছে এবং কুরআন অবতরণের পর বিগত সকল ইলাহী কিতাবের হুকুম রহিত হয়ে গেছে। ঈসা (আঃ) সহ বিগত সকল নবীই শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর আগমনের সুসংবাদ দিয়ে গেছেন (ছফ ৬১/৬) এবং তাঁরা শেষনবীর আমল পেলে তাঁকে সর্বান্তঃকরণে সাহায্য করবেন বলে আল্লাহর নিকটে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছিলেন (আলে ইমরান ৩/৮১)। এমনকি তওরাত ও ইনজীলে সর্বশেষ উম্মী নবীর আগমনের সুসংবাদ লিপিবদ্ধ ছিল (আ‘রাফ ৭/১৫৭)। সে হিসাবে মুহাম্মাদ (সাঃ) কেবল আখেরী যামানার নবী নন, বরং তিনি ছিলেন বিগত সকল নবীর নবী। অনুরূপভাবে তাঁর আনীত কিতাব ও শরী‘আত বিগত সকল কিতাব ও শরী‘আতের সত্যায়নকারী[5] এবং পূর্ণতা দানকারী (মায়েদাহ ৫/৩)। অতএব কুরআন বর্তমান পৃথিবীর একমাত্র ইলাহী কিতাব এবং সকল মানুষের জন্য একমাত্র পথপ্রদর্শক ইলাহী গ্রন্থ।
এর সর্বাধিক প্রসিদ্ধ নাম হ’ল ‘কুরআন’। যার অর্থ ‘পরিপূর্ণ’ যেমন বলা হয়, قَرَأتِ الْحَوْضُ ‘হাউয কানায় কানায় পূর্ণ হয়েছে’। সমস্ত জ্ঞানের ভান্ডার পূর্ণভাবে সঞ্চিত হওয়ার কারণে কালামুল্লাহকে ‘কুরআন’ বলা হয়েছে। ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) একথা বলেন (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ৩/২৪১)। আল্লাহ বলেন, وَتَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ صِدْقًا وَّعَدْلاً ‘তোমার প্রভুর কালাম সত্য ও ন্যায় দ্বারা পূর্ণ’ (আন‘আম ৬/১১৫)। অর্থাৎ কুরআনের প্রতিটি কথাই সত্য এবং প্রতিটি বিধানই ন্যায় ও ইনছাফপূর্ণ। ذَلِكَ الْكِتَابُ لاَ رَيْبَ فِيهِ এই কিতাবে কোনরূপ ত্রুটি বা সন্দেহ নেই (বাক্বারাহ ২/২)। কুরআন ব্যতীত পৃথিবীতে এমন কোন ধর্মগ্রন্থ নেই, যা তার শুরুতেই নিজেকে সন্দেহমুক্ত বলে ঘোষণা করেছে।
[1]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৭৭৪; নিসা ৪/৮২; আন‘আম ৬/১১৫; আ‘রাফ ৭/৩৫; হামীম সাজদাহ ৪১/৪২; ওয়াক্বি‘আহ ৫৬/৭৭-৮২; হাক্কাহ ৬৯/৪৩; দাহর ৭৬/২৩।
[2]. বাক্বারাহ ২/৯৭; শু‘আরা ২৬/১৯৪; তাকভীর ৮১/১৯।
[3]. মায়েদাহ ৫/৬৭; নাহল ১৬/৪৪, ৬৪।
[4]. আলে ইমরান ৩/৩; ইসরা ১৭/১০৬; ফুরক্বান ২৫/৩২; যুমার ৩৯/২৩।
[5]. বাক্বারাহ ২/৪১, ৯১, ৯৭; আলে ইমরান ৩/৩, ৫০; নিসা ৪/৪৭; মায়েদাহ ৫/৪৮; ফাত্বের ৩৫/৩১; আহক্বাফ ৪৬/৩০।
কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার প্রমাণ সমূহ - ১. কুরআনের অপরিবর্তনীয়তা (عدم تغيير القرآن) :
কুরআন তার অবতরণকাল থেকে এযাবত একইভাবে অপরিবর্তিত অবস্থায় রয়েছে। দেড় হাযার বছর পূর্বে যে কুরআন পাঠ করা হ’ত, এখনো সেই কুরআনই পাঠ করা হয়। যার একটি শব্দ ও বর্ণ পরিবর্তিত হয়নি বা মুছে যায়নি। অথচ তাওরাত, যবূর, ইনজীল প্রভৃতির মূল গ্রন্থের অস্তিত্ব দুনিয়াতে নেই।
কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার প্রমাণ সমূহ- ২. বিশ্বময়তা (عالمية القرآن)
যে রাতে নুযূলে কুরআনের সূচনা হয়, সে রাতে একজনই মাত্র শ্রোতা ছিলেন সৌভাগ্যবতী নারী হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রাঃ)। অথচ সেই কুরআন ক্রমে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। আজ পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে কোটি কোটি মানবসন্তান পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতে ও ছালাতের বাইরে কুরআনের কিছু না কিছু অংশ হরহামেশা পাঠ করে থাকে। কুরআন বর্তমান বিশ্বের সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ হিসাবে সমাদৃত। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, সূরা ফাতিহা প্রতিদিন যতবার পাঠ করা হয়, বিশ্বের কোন ভাষার কোন পাঠ্যাংশের সেই সৌভাগ্য আজ পর্যন্ত হয়নি’। অনেক খ্রিষ্টান দার্শনিকের মতে ২০৫০ সালের মধ্যেই ইসলাম বিশ্বের বৃহত্তম ধর্ম হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে’।[1] কুরআনই যে তার প্রধান কারণ তা বলাই বাহুল্য।
[1]. দৈনিক আমার দেশ, ঢাকা, ৮ জানুয়ারী’২০০৮, লেখক : মামুনুর রশীদ।
কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার প্রমাণ সমূহ- ৩. নিজ ভাষাতেই পঠিত (متلو فى لغته)
যে আরবী ভাষাতে কুরআন নাযিল হয়েছে, সেই ভাষাতেই কুরআন সর্বত্র পঠিত হয়। খ্রিষ্টানরা বাইবেলের কথিত অনুবাদ পাঠ করে থাকে। তাও পাঠকারীর সংখ্যা অতি নগণ্য। যেকারণে বিশিষ্ট ইভানজেলিষ্ট জর্জ গ্যালাপের মতে, ‘আমেরিকানরা হ’ল বাইবেল অন্ধ জাতি’ (দৈনিক আমার দেশ)। অর্থাৎ আসল বাইবেল সম্পর্কে তারা অন্ধ। যা কখনোই তারা দেখেনি। বস্ত্ততঃ তওরাত, যবূর, ইনজীল প্রভৃতি ইলাহী গ্রন্থ যে ভাষায় নাযিল হয়েছিল, সেই ভাষা বা বর্ণমালা এমনকি বেদ, যিন্দাবেস্তা প্রভৃতির ভাষা ও বর্ণমালা এবং সেসবের ভাষাভাষী কোন মানুষের অস্তিত্ব বর্তমান পৃথিবীতে নেই। পক্ষান্তরে আরবী ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে কোটি কোটি এবং তা ক্রমবর্ধমান। আরবী বর্তমানে জাতিসংঘের ৬ষ্ঠ আন্তর্জাতিক ভাষা হিসাবে বরিত।
উল্লেখ্য যে, হিব্রু (الْعِبْرَانِى) যা তওরাতের ভাষা ছিল, খালেদী (خَالِدِي) যা মসীহ ঈসার ভাষা ছিল, দুররাই (دُرَّي) যা যিন্দাবিস্তার ভাষা ছিল, সংস্কৃত (سَنْسكِرِت) যা বেদ-এর ভাষা ছিল, তা পৃথিবীর কোন দেশ এমনকি কোন যেলা বা মহল্লাতেও জনগণের মুখের ভাষা হিসাবে এখন চালু নেই। আল্লাহর পক্ষ থেকেই ঐসব ভাষা উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু রেখে দেওয়া হয়েছে আরবী ভাষাকে। যা কুরআন-হাদীছের স্বার্থে ক্বিয়ামত পর্যন্ত জীবন্ত থাকবে। উল্লেখ্য যে, বাইবেলের যে ‘নতুন নিয়ম’ (New Testament) পাওয়া যায়, তাতে লেখা আছে Translated out of the original Greek known as the authorised version (মূল গ্রীক থেকে অনূদিত। যা অনুমোদিত ভাষান্তর হিসাবে পরিচিত)। এতে বুঝা যায় যে, বাইবেলের আরও version আছে। যা কোন কারণ বশতঃ অনুমোদিত হয়নি। দ্বিতীয়তঃ বর্তমান বাইবেল গ্রীক ভাষা থেকে অনূদিত। কিন্তু প্রশ্ন হ’ল ঈসা (আঃ) তো গ্রীসের বাসিন্দা ছিলেন না। তার মাতৃভাষাও গ্রীক ছিল না। তিনি ফিলিস্তীনে জন্ম গ্রহণ করেন ও নিজ এলাকায় প্রচলিত খালেদী ভাষায় তিন বছর ধর্ম প্রচার করেন। তাহ’লে ইনজীলের মূল ভাষা গ্রীক হ’ল কিভাবে?
আধুনিক সেক্যুলারিজমের কুপ্রভাব কুরআনের প্রতি মানুষের তীব্র আকর্ষণ বিন্দুমাত্র কমাতে পারেনি। কেননা কুরআনের ভাষা সরাসরি আল্লাহর ভাষা। এটি হ’ল জান্নাতের ভাষা। কুরআনের প্রতিটি বাক্য, শব্দ ও বর্ণ আল্লাহর নূরে আলোকিত। যা বিশ্বাসী মুসলমানের হৃদয় জগতকে আলোকিত করে। জাহেলিয়াতের গাঢ় অন্ধকার দূরীভূত করে। বিষাদিত অন্তরকে আমোদিত করে। জর্জরিত অন্তরকে সুশীতল করে। মুমিনের হৃদয়ে কুরআনের প্রভাব তাই অতুলনীয় ও অনির্বচনীয়। যার প্রতি হরফে মুসলমান কমপক্ষে দশটি করে নেকী পায়। যা তার পরকালকে সমৃদ্ধ করে। মানছূরপুরীর হিসাব মতে কুরআনের সর্বমোট হরফের সংখ্যা ৩,৪৬,৯৯৮টি (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ৩/২৭৬)। বিশিষ্ট কুরআন গবেষক কনস্ট্যান্স প্যাডউইক তাই বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, ‘কুরআন তার অনুসারীদের অন্তরে জাগ্রত। তাদের কাছে এটি নিছক কিছু শব্দ বা কথামালা নয়। এগুলি আল্লাহর নূরে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখার জ্বালানী’ (দৈনিক আমার দেশ)। তুরস্কের প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ শাসক কামাল পাশা অতি উৎসাহী হয়ে আরবী আযান বাতিল করে তুর্কী আযান চালু করেন। পরে জনরোষে পড়ে পুনরায় আরবী আযান চালু করতে বাধ্য হন।
কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার প্রমাণ সমূহ- ৪. কুরআনের হেফাযতকারী আল্লাহ (الله حافظ للقرآن)
কুরআন একমাত্র ইলাহী গ্রন্থ যার হেফাযতের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ নিয়েছেন। তিনি বলেন, إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُوْنَ ‘আমরা কুরআন নাযিল করেছি এবং আমরাই এর হেফাযতকারী (হিজর ১৫/৯)। তিনি বলেন, إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآنَهُ، فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآنَهُ، ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا بَيَانَهُ ‘এর সংরক্ষণ ও পঠন-পাঠন আমাদেরই দায়িত্বে’। ‘সুতরাং যখন আমরা তা (জিব্রীলের মাধ্যমে) পাঠ করাই, তখন তুমি সেই পাঠের অনুসরণ কর’। ‘অতঃপর এর ব্যাখ্যা করা (হাদীছ) আমাদেরই দায়িত্বে’ (ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৭-১৯)। অতএব আল্লাহ কেবল কুরআন ও হাদীছের হেফাযতের দায়িত্ব নিয়েছেন। তাই তা ক্বিয়ামত অবধি টিকে থাকবে। কিন্তু অন্যান্য এলাহী গ্রন্থের দায়িত্ব আল্লাহ নেননি। তাই সেসব হারিয়ে গেছে এবং যেতে বাধ্য।
কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার প্রমাণ সমূহ- ৫. কুরআন সকল জ্ঞানের উৎস (مصدر كل علم)
কুরআন যারা মানেন এবং যারা মানেন না, সকলে কুরআনের বিভিন্নমুখী হেদায়াত থেকেই আলো নিয়েছেন। বরং আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল উৎসই হ’ল কুরআন। অন্য কোন ধর্মগ্রন্থের এই বৈশিষ্ট্য নেই। বিজ্ঞানীদের মতে কুরআনের প্রতি ১১টি আয়াত বিজ্ঞান বহন করে। এর দ্বারা তারা হয়ত কেবল বস্ত্তগত বিজ্ঞান সমূহের হিসাব করেছেন। কিন্তু এছাড়াও সেখানে রয়েছে সমাজ বিজ্ঞান, অধ্যাত্ম বিজ্ঞান, ভাষা বিজ্ঞান, সমর বিজ্ঞান, ভূতত্ত্ব ও নভো বিজ্ঞান প্রভৃতি। তাছাড়া রয়েছে জীবনের বিভিন্ন শাখা ও প্রশাখাগত বিষয়ক বিজ্ঞান। সে হিসাবে কুরআনের প্রতিটি আয়াতই বিজ্ঞান বহন করে। কুরআনী বিজ্ঞানের চর্চা করেই মুসলমানেরা কয়েক শতাব্দীব্যাপী বিশ্ব বিজ্ঞানের অগ্রনায়ক ছিল। অতঃপর বাগদাদ ও স্পেনের রাজনৈতিক পতনের ফলে বিজ্ঞানেরও পতন ঘটে এবং তাদেরই রেখে যাওয়া বিজ্ঞানের অনুসরণ করে বস্ত্তবাদী ইউরোপ আজ ক্রমে মুসলমানদের শূন্যস্থান পূরণ করে চলেছে।
মনুষ্য বিজ্ঞানের উৎস হ’ল অনুমিতি। যা যেকোন সময় ভুল প্রমাণিত হয়। যেমন বিজ্ঞানীরা বলেন, Science gives us but a partial knowledge of reality ‘বিজ্ঞান আমাদেরকে কেবল আংশিক সত্যের সন্ধান দেয়’।[1] তারা স্রেফ অনুমানের ভিত্তিতে কাজ শুরু করে থাকেন। তারা বলেন, ‘আমরা কতিপয় বাহ্য প্রকাশকে দেখি মাত্র, মূল বস্ত্তকে দেখিনা’। যেমন ধোঁয়া দেখে মানুষ আগুনের সন্ধানে ছুটে থাকে। কিন্তু কুরআনী বিজ্ঞানের উৎস হ’ল আল্লাহর অহী। যেখানে ভুলের কোন অবকাশ নেই। যেমন আল্লাহ বলেন, لاَ يَأْتِيهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَلاَ مِنْ خَلْفِهِ تَنْزِيلٌ مِنْ حَكِيمٍ حَمِيدٍ ‘সম্মুখ থেকে বা পিছন থেকে এর মধ্যে মিথ্যার কোন প্রবেশাধিকার নেই। এটি ক্রমান্বয়ে অবতীর্ণ হয়েছে প্রজ্ঞাময় ও প্রশংসিত সত্তার পক্ষ হ’তে’ (হামীম সাজদাহ ৪১/৪২)। আজকের যেসব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার আমরা দেখছি তার প্রায় সবেরই উৎস রয়েছে কুরআনে। যা সর্বপ্রথম উচ্চারিত হয়েছিল চৌদ্দশ’ বছর পূর্বে একজন মরুচারী নিরক্ষর নবীর মুখ দিয়ে- যা ছিল আল্লাহর কালাম। উদাহরণ স্বরূপ-
(১) জগত সৃষ্টির বৈজ্ঞানিক তথ্য হিসাবে বলা হয়, ‘কোটি কোটি বছর পূর্বে বিশ্বজগত একটি অখন্ড জড়বস্ত্ত রূপে বিদ্যমান ছিল। পরে তার কেন্দ্রে একটি মহাবিস্ফোরণ ঘটে, যাকে Big-Bang বলা হয়। সেই মহা বিস্ফোরণের ফলে আমাদের সৌরজগত, ছায়াপথ, তারকারাজি ইত্যাদি সৃষ্টি হ’ল এবং বিনা বাধায় সর্বত্র সন্তরণ করে চলল’। অথচ কুরআন বহু পূর্বেই এ তথ্য প্রদান করেছে। আল্লাহ বলেন, أَوَلَمْ يَرَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا أَنَّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ كَانَتَا رَتْقاً فَفَتَقْنَاهُمَا ‘অবিশ্বাসীরা কি দেখে না যে, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী পরস্পরে মিলিত ছিল। অতঃপর আমরা উভয়কে পৃথক করে দিলাম’ (আম্বিয়া ২১/৩০)। প্রশ্ন হ’ল, বিস্ফোরণ ঘটালো কে? সেখানে প্রাণের সঞ্চার হ’ল কিভাবে? অতঃপর বিশাল সৃষ্টি সমূহ অস্তিত্বে আনল কে? যদি কেউ বলে যে, প্রেস মেশিনে বিস্ফোরণ ঘটেছে এবং তা ধ্বংস হয়ে টুকরা টুকরা হয়ে গেছে। অতঃপর সেখানে তৈরী হয়েছে বড় বড় গবেষণাগ্রন্থ। একথা কেউ বিশ্বাস করবে কি?
(২) প্রাণের উৎস কি? এ বিষয়ে বিজ্ঞানীরা বলছেন, পানি থেকেই প্রাণীজগতের উদ্ভব। অথচ কুরআন একথা আগেই বলেছে, وَجَعَلْنَا مِنَ الْمَاءِ كُلَّ شَيْءٍ حَيٍّ أَفَلاَ يُؤْمِنُونَ ‘আমরা প্রাণবান সবকিছু সৃষ্টি করেছি পানি হতে। তবুও কি তারা বিশ্বাস স্থাপন করবে না?’ (আম্বিয়া ২১/৩০; নূর ২৪/৪৫)। প্রশ্ন হ’ল, পানি সৃষ্টি করল কে? অতঃপর তার মধ্যে প্রাণ শক্তি এনে দিল কে?
(৩) বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রতিটি প্রাণসত্তার মধ্যে রয়েছে বিপরীতধর্মী দু’টি শক্তির জোড়। যার একটি পজেটিভ বা প্রোটন এবং অপরটি নেগেটিভ বা ইলেকট্রন। এমনকি বিদ্যুতের ন্যায় প্রাণহীন বস্ত্তর মধ্যেও রয়েছে এই জোড়ার সম্পর্ক। অথচ কুরআন বহু পূর্বেই এর তথ্য দিয়েছে, سُبْحَانَ الَّذِيْ خَلَقَ الْأَزْوَاجَ كُلَّهَا مِمَّا تُنبِتُ الْأَرْضُ وَمِنْ أَنفُسِهِمْ وَمِمَّا لاَ يَعْلَمُوْنَ ‘মহাপবিত্র সেই সত্তা, যিনি ভূ-উৎপন্ন সকল বস্ত্ত এবং মানুষ ও তাদের অজানা সবকিছুকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন’ (ইয়াসীন ৩৬/৩৬)। (৪) উদ্ভিদের জীবন আছে, একথা বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু (১৮৫৮-১৯৩৭ খৃ.) মাত্র সেদিন আবিষ্কার করলেন। অথচ বহু পূর্বেই একথা কুরআন বলে দিয়েছে। وَالنَّجْمُ وَالشَّجَرُ يَسْجُدَانِ ‘নক্ষত্ররাজি ও উদ্ভিদরাজি আল্লাহকে সিজদা করে’ (রহমান ৫৫/৬; ইসরা ১৭/৪৪; নূর ২৪/৪১ প্রভৃতি)। স্বয়ং রাসূল (সাঃ)-এর সম্মানে পাথর ও বৃক্ষসমূহ ঝুঁকে পড়ে তাঁকে সম্মান জানিয়েছে। আকাশের মেঘমালা তাঁকে ছায়া করেছে।[2] এমনকি তাঁর হুকুমে ছায়াদার বৃক্ষ নিজের স্থান থেকে উঠে এসে তার নিকটে দাঁড়িয়ে তাঁকে ছায়া করেছে। আবার তাঁর হুকুমে স্বস্থানে ফিরে গেছে।[3] এগুলো সবই উদ্ভিদের যে প্রাণ আছে, তার প্রমাণ বহন করে। (৫) এমনকি এর চাইতে বড় তথ্য কুরআন প্রকাশ করেছে, বিজ্ঞানীরা আজও যা প্রমাণ করতে পারেনি। আর তা হ’ল, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর প্রাণ আছে এবং আছে বোধশক্তি। যেমন আল্লাহ বলেন, ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاء وَهِيَ دُخَانٌ فَقَالَ لَهَا وَلِلْأَرْضِ اِئْتِيَا طَوْعاً أَوْ كَرْهاً قَالَتَا أَتَيْنَا طَائِعِيْنَ ‘অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করেন, যা ছিল ধূম্রবিশেষ। অনন্তর তিনি ওটাকে ও পৃথিবীকে বললেন, তোমরা উভয়ে এসো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। তারা বলল, আমরা এলাম অনুগত হয়ে’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/১১)।
(৬) নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল ও তন্মধ্যকার সবকিছু সর্বদা আল্লাহর গুণগান করে। কিন্তু মানুষ তা বুঝতে পারে না। যেমন আল্লাহ বলেন, تُسَبِّحُ لَهُ السَّمَاوَاتُ السَّبْعُ وَالأَرْضُ وَمَن فِيهِنَّ وَإِن مِّن شَيْءٍ إِلاَّ يُسَبِّحُ بِحَمْدَهِ وَلَـكِن لاَّ تَفْقَهُونَ تَسْبِيْحَهُمْ إِنَّهُ كَانَ حَلِيْماً غَفُوْراً ‘সপ্ত আকাশ ও পৃথিবী এবং ওদের মধ্যকার সবকিছু তাঁরই গুণগান করে। আর এমন কিছু নেই যা তাঁর প্রশংসা সহ পবিত্রতা বর্ণনা করে না। কিন্তু ওদের গুণগান তোমরা বুঝতে পারো না। নিশ্চয়ই তিনি সহনশীল ও ক্ষমাপরায়ণ’ (ইসরা ১৭/৪৪)। এগুলি সবই আল্লাহর আয়াত বা নিদর্শন সমূহের অন্তর্ভুক্ত। যে তথ্য কেবলমাত্র কুরআনই আমাদেরকে প্রদান করেছে। ফালিল্লাহিল হাম্দ।
[1]. মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম, মহাসত্যের সন্ধানে (ঢাকা : খায়রুন প্রকাশনী ৫ম প্রকাশ ১৪১৯হি./১৯৯৮) ৬১ পৃঃ।
[2]. তিরমিযী হা/৩৬২০; মিশকাত হা/৫৯১৮ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়-২৯, ‘মু‘জেযা সমূহ’ অনুচ্ছেদ-৭।
[3]. মুসলিম হা/৩০১২; দারেমী হা/২৩; মিশকাত, ঐ, হা/৫৮৮৫, ৫৯২৪।
কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার প্রমাণ সমূহ- ৬. বিশ্বমানবতার জন্য ইসলাম প্রেরণের সুসংবাদদাতা (مبشر إرسال الإسلام للإنسانية العالمية)
কুরআনই একমাত্র ইলাহী গ্রন্থ, যা মানবজাতিকে আল্লাহর মনোনীত দ্বীন ও পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসাবে ইসলামকে প্রেরণের সুসংবাদ দিয়েছে। যেমন বিদায় হজ্জের দিন আয়াত নাযিল করে আল্লাহ বলেন, الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلاَمَ دِينًا ‘আজকের দিনে আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নে‘মতকে সম্পূর্ণ করলাম। আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’ (মায়েদাহ ৫/৩)। অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ তার অনুসারীদের এরূপ কথা শুনাতে ব্যর্থ হয়েছে।
কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার প্রমাণ সমূহ- ৭. অনন্য প্রভাবশালী গ্রন্থ (الكتاب المؤثر الوحيد)
কুরআনের অপূর্ব সাহিত্যিক মান, তুলনাহীন আলংকরিক বৈশিষ্ট্য, অনন্য সাধারণ বর্ণনাভঙ্গি এবং এর অলৌকিক প্রভাব যেকোন মানুষকে মুহূর্তের মধ্যে মোহিত করে ফেলে। পৃথিবীর কোন ধর্মগ্রন্থে এমন প্রভাবের কোন নযীর নেই।
(১) আবু জাহল, আবু সুফিয়ান, আখনাস বিন শারীক্ব-এর মত নেতারাও রাতের বেলা একে অপরকে লুকিয়ে গোপনে এসে রাসূল (সাঃ)-এর তাহাজ্জুদে পঠিত কুরআন মুগ্ধ মনে শ্রবণ করত। পরপর তিনদিন একই ঘটনার পর আখনাস বিন শারীক্ব লাঠি হাতে হাঁটতে হাঁটতে আবু সুফিয়ানের বাড়ীতে এসে বললেন, হে আবু হানযালা! মুহাম্মাদের মুখ দিয়ে যা শুনলাম, সে বিষয়ে আপনার মতামত কি? তিনি বললেন, আমি ঐ কালাম বুঝতে পেরেছি এবং সেখানে যা চাওয়া হয়েছে, তাও বুঝেছি’। আখনাস বললেন, আমিও আপনার সাথে একমত। এবার তিনি হাঁটতে হাঁটতে আবু জাহলের বাড়ীতে গেলেন ও তাকে একই প্রশ্ন করলেন। জবাবে আবু জাহল বললেন, আসল কথা হ’ল, تَنَازَعْنَا نَحْنُ وَبَنُو عَبْدِ مَنَافٍ الشَّرَفَ... مِنَّا نَبِيٌّ يَأْتِيهِ الْوَحْيُ مِنَ السَّمَاءِ، فَمَتَى نُدْرِكُ مِثْلَ هَذِهِ؟ وَاللهِ لاَ نُؤْمِنُ بِهِ أَبَدًا وَلاَ نُصَدِّقُهُ ‘বনু ‘আব্দে মানাফের সাথে আমাদের বংশ মর্যাদাগত ঝগড়া আছে।... তারা বলে, আমাদের বংশে একজন নবী আছেন, যার নিকটে আসমান থেকে ‘অহি’ আসে। কবে আমরা এই মর্যাদা পাব? অতএব আল্লাহর কসম! আমরা কখনোই তার উপরে ঈমান আনব না এবং তাকে সত্য বলে বিশ্বাস করব না’। একথা শুনে আখনাস চলে এলেন’।[1] এতে বুঝা যায় যে, অতি বড় দুশমনও কুরআন দ্বারা প্রভাবিত হয়। কিন্তু যিদ ও হঠকারিতা বশে তারা পথভ্রষ্ট হয়।
(২) প্রসিদ্ধ কুরায়েশ নেতা উৎবা বিন রাবী‘আহ একদিন আবু জাহল ও অন্য নেতাদের পরামর্শ মতে রাসূল (সাঃ)-এর কাছে এলেন। ইনি একই সাথে জাদুবিদ্যা, ভবিষ্যদ্বাণী ও কবিতায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি এসে রাসূল (সাঃ)-এর অনেক প্রশংসা করলেন। অতঃপর তাকে তাওহীদ প্রচার বন্ধের বিনিময়ে নেতৃত্ব, দশজন সুন্দরী স্ত্রী ও বিপুল ধন-সম্পদ দানের লোভনীয় প্রস্তাব দিলেন। রাসূল (সাঃ) সবকিছু শোনার পর তাকে সূরা হা-মীম সাজদাহ ১-১৩ আয়াত পর্যন্ত শুনালেন। এ সময় ওৎবা আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে তার মুখে হাত দিয়ে কুরআন পাঠ বন্ধ করতে বললেন। ফিরে আসার পর তিনি নেতাদের কাছে বলেন, আল্লাহর কসম! আমি এমন কথা শুনেছি, যা আমার দু’টি কান কখনো শোনেনি। আল্লাহর কসম! এটি জাদু নয়, এটি কবিতা নয়, এটি কোন ভবিষ্যৎ কথন নয়। হে কুরায়েশগণ! তোমরা আমার কথা শোন! তোমরা এ মানুষটিকে ছেড়ে দাও। যদি তিনি আরবদের উপর বিজয়ী হন, তাহ’লে তার রাজত্ব তোমাদের রাজত্ব। তার সম্মান তোমাদের সম্মান। তার মাধ্যমে তোমরা হবে সৌভাগ্যবান। তোমরা জানো মুহাম্মাদ কখনো মিথ্যা বলেন না। আমি ভয় পাচ্ছি তোমাদের উপর আল্লাহর গযব নাযিল না হয়’। জবাবে আবু জাহল বলল, আল্লাহর কসম! আপনাকে সে তার কথা দিয়ে জাদু করেছে’।[2]
(৩) একদিন কা‘বা চত্বরে উপস্থিত মক্কার মুশরিকদের একজন বাদে সকলে রাসূল (সাঃ)-এর মুখে সূরা নাজম শুনতে শুনতে বিভোর হয়ে সূরার শেষ ৬২তম সিজদার আয়াত শুনে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে সিজদায় পড়ে যায়। রাবী ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, একজন বৃদ্ধ কেবল সিজদা করেনি। সে এক মুষ্টি মাটি তুলে নিজের কপালে ঠেকিয়ে বলেছিল, এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। পরে তাকে আমি (বদরের যুদ্ধে) কাফের অবস্থায় নিহত হ’তে দেখেছি।’ ঐ বৃদ্ধটি ছিল মক্কার অন্যতম নেতা উমাইয়া বিন খালাফ।[3]
(৪) রাসূল (সাঃ)-এর দো‘আর বরকতে এবং কুরআনী সূরার অতুলনীয় প্রভাবে রাসূল (সাঃ)-কে হত্যার উদ্দেশ্যে আগত ওমর নিমেষে কুরআনের খাদেমে পরিণত হয়ে যান’ (ইবনু হিশাম ১/৩৪২-৪৬)।
(৫) জা‘ফর বিন আবু ত্বালিবের মুখে সূরা মারিয়ামের সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলি শুনে হাবশার বাদশাহ আছহামা নাজাশী ও তাঁর সভাসদ খ্রিষ্টান নেতাদের চক্ষু দিয়ে অবিরল ধারে অশ্রু প্রবাহিত হয়েছিল। অতঃপর মদীনায় নাজাশী প্রেরিত পন্ডিতগণের সত্তুর জনের এক শাহী প্রতিনিধিদল রাসূল (সাঃ)-এর মুখে সূরা ইয়াসীন শুনে কেঁদে আত্মহারা হয়ে পড়েন ও সেখানেই মুসলমান হয়ে যান। পরে বাদশাহ নাজাশীও মুসলমান হন।[4]
(৬) কুরায়েশ-এর সবচেয়ে বড় ধনী ও বড় কবি অলীদ বিন মুগীরাহ একদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে গিয়ে কুরআন শুনতে চাইলেন। তখন আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাকে সূরা নাহলের ৯০ আয়াতটি শুনিয়ে দেন।[5] অলীদ বিন মুগীরাহ আবার শুনতে চাইলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পুনরায় পড়লেন। আয়াতটি শুনে হয়রান হয়ে তিনি বলে ওঠেন وَاللهِ إِنَّ لَهُ لَحَلاَوَةً، وَإِنَّ عَلَيْهِ لَطَلاَوَةً، وَإِنَّ أَعْلاَهُ لَمُثْمِرٌ، وَإِنَّ أَسْفَلَهُ لَمُغْدِقٌ وَمَا يَقُوْلُ هَذَا بَشَرٌ ‘আল্লাহর কসম! এর রয়েছে এক বিশেষ মাধুর্য, এর মধ্যে রয়েছে বিশেষ সজীবতা, এর শাখা-প্রশাখা সমূহ ফলবন্ত। এর জড়দেশ সদা সরস। আর মানুষ কখনো এরূপ বলতে পারে না’ (আল-ইস্তী‘আব)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, وَإِنَّهُ لَيَعْلُوَ وَلاَ يُعْلَى، وَإِنَّهُ لَيَحْطِمُ مَا تَحْتَه ‘নিশ্চয় এটি বিজয়ী হবে, বিজিত হবে না। আর নিশ্চয় এটি তার নীচের সবকিছুকে চূর্ণ করে দিবে’। তার এরূপ প্রশংসাগীতি শুনে আবু জাহল বলল, আপনি যতক্ষণ মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে কিছু না বলবেন, ততক্ষণ আপনার কওম আপনার উপর খুশী হবে না। তখন তিনি বললেন, ছাড়! আমাকে একটু ভাবতে দাও। অতঃপর ভেবে-চিন্তে তিনি বললেন, هَذَا سِحْرٌ يُؤْثَرُ يَأْثُرُهُ عَنْ غَيْرِهِ ‘এটি অন্য থেকে প্রাপ্ত জাদু! (আল-বিদায়াহ ৩/৬১)। বস্ত্ততঃ অলীদের প্রথম কথাগুলি ছিল তার মনের কথা। আর শেষের কথাগুলি ছিল রাজনৈতিক। এ প্রসঙ্গে সূরা মুদ্দাছছির ১১-২৬ আয়াতগুলি নাযিল হয়।[6]
(৭) এর প্রভাব এত বেশী যে, ৩৬০টি দেবদেবীর পূজারী নিমেষে সবকিছু ছেড়ে এক আল্লাহর ইবাদতকারী বনে যান। কোন আইন মানতে যারা কখনোই বাধ্য ছিল না, সেই অবাধ্য মরু আরব নিমেষে আল্লাহর আইনের সামনে এসে মাথা পেতে দেয়। পুলিশ বা কোন বাহিনীর প্রয়োজন হয়নি, নিজেরা এসে মৃত্যুদন্ড গ্রহণের জন্য রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে এসে পীড়াপীড়ি করে। মা‘এয আসলামী, গামেদী মহিলা প্রমুখদের ঘটনা যার জাজ্বল্যমান প্রমাণ।[7]
(৮) বদরের যুদ্ধে বন্দীদের মুক্তির ব্যাপারে আলোচনার জন্য কুরায়েশ নেতা জুবায়ের বিন মুত্ব‘ইম মদীনায় উপনীত হয়ে মাগরিবের জামা‘আতে রাসূল (সাঃ)-এর মুখে সূরা তূরের আয়াতগুলি শুনে দারুণভাবে প্রভাবিত হন। তিনি বলেন, এর দ্বারা আমার হৃদয়ে প্রথম ঈমান প্রবেশ করে’ (আল-ইছাবাহ, জুবায়ের ক্রমিক ১০৯৩)।
(৯) জাহেলী যুগের মু‘আল্লাক্বা খ্যাত কবি লাবীদ বিন রাবী‘আহ ‘আমেরী ইসলাম কবুল করার পর কবিতা লেখা বন্ধ করে দিলেন। খলীফা ওমর (রাঃ) কূফার গবর্ণরের মাধ্যমে তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, مَا كُنْتُ لِأَقُولَ بَيْتًا مِنَ الشِّعْرِ بَعْدَ إِذْ عَلَّمَنِي اللهُ الْبَقَرَةَ وَآلَ عِمْرَانَ ‘আমি এক লাইন কবিতাও আর বলতে চাই না যখন থেকে আল্লাহ আমাকে সূরা বাক্বারাহ ও আলে ইমরান শিক্ষা দিয়েছেন’। এ কথা শুনে ওমর (রাঃ) তার বার্ষিক ভাতা বৃদ্ধি করে দেন।[8]
(১০) আবু ত্বালহা আনছারী যখন কুরআনের আয়াত لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوْا مِمَّا تُحِبُّوْنَ ‘তোমরা কখনই কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমাদের প্রিয় বস্ত্ত তোমরা দান করবে’ (আলে ইমরান ৩/৯২) শোনার পর রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে এসে নিজের সর্বাপেক্ষা মূল্যবান খেজুর বাগিচাটি আল্লাহর রাহে দান করে দিলেন। অতঃপর রাসূল (সাঃ)-এর হুকুমে উক্ত বাগিচা আবু ত্বালহার নিকটাত্মীয় এবং চাচাতো ভাইদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হ’ল।[9]
(১১) শায়খ আব্দুল ক্বাহির জুরজানী (মৃ. ৪৭৪ হি./১০৭৮ খৃ.) বলেন, আরবরা কুরআনের সর্বোচ্চ আলংকরিক বৈশিষ্ট্য ছাড়াও তারা এর গভীর তাৎপর্যপূর্ণ আয়াত সমূহের কারণে প্রভাবান্বিত হয়েছিল। যেমন وَلَكُمْ فِي الْقِصَاصِ حَيَاةٌ يَا أُولِي الأَلْبَابِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ ‘সম পরিমাণ শাস্তি দানের মধ্যে তোমাদের জীবন নিহিত রয়েছে হে জ্ঞানীগণ! যাতে তোমরা সতর্ক হ’তে পারো’ (বাক্বারাহ ২/১৭৯)।[10]
[1]. ইবনু হিশাম ১/৩১৫-১৬; বর্ণনাটির সনদ মুনক্বাতি‘ ঐ, তাহকীক ক্রমিক ৩০৪; বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত ২/২০৬; আল-বিদায়াহ ৩/৬৪।
[2]. বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত ২/২০৩-০৬; ইবনু হিশাম ১/২৯৪; আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ পৃঃ ১০৭; সনদ হাসান; আল-বিদায়াহ ৩/৬৩-৬৪।
[3]. বুখারী হা/৪৮৬৩; মুসলিম হা/৫৭৬; মিশকাত হা/১০৩৭ ‘কুরআনের সিজদা সমূহ’ অনুচ্ছেদ।
[4]. ইবনু কাছীর, সূরা মায়েদাহ ৮২ ও ক্বাছাছ ৫৩ আয়াতের তাফসীর; ইবনু হিশাম ১/৩৩৬।
[5]. إِنَّ اللهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَالْبَغْيِ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ এবং আত্মীয়-স্বজনকে দান করার নির্দেশ দেন এবং অশ্লীলতা, অন্যায় কাজ ও অবাধ্যতা হতে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর’ (নাহল ১৬/৯০)।
[6]. বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত ২/১৯৮-৯৯; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৩/৬১।
[7]. মুসলিম হা/১৬৯৫; মিশকাত হা/৩৫৬২ ‘দন্ডবিধিসমূহ’ অধ্যায়।
[8]. আল-ইছাবাহ, লাবীদ বিন রাবি‘আহ ক্রমিক ৭৫৪৭; আল-ইস্তী‘আব।
[9]. বুখারী হা/২৩১৮; মুসলিম হা/৯৯৮; মিশকাত হা/১৯৪৫ ‘যাকাত’ অধ্যায়।
[10]. ড. মুজীবুর রহমান, কুরআনের চিরন্তন মু‘জেযা, (ইফাবা, ঢাকা : ৪র্থ সংস্করণ ২০০৬) ১৩৫ পৃঃ।
কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার প্রমাণ সমূহ- ৮. কুরআনের আহবান সমগ্র মানব জাতির প্রতি (دعوة القرآن إلى الإنسان عاما)
তওরাত, যবূর, ইনজীল প্রভৃতি কিতাবের আহবান ছিল কেবল বনু ইস্রাঈল গোত্রের প্রতি। কিন্তু কুরআনের আহবান জিন-ইনসান তথা সকল সৃষ্টিজগতের প্রতি। আল্লাহ বলেন, إِنْ هُوَ إِلاَّ ذِكْرٌ وَقُرْآنٌ مُبِيْنٌ، لِيُنْذِرَ مَنْ كَانَ حَيًّا وَيَحِقَّ الْقَوْلُ عَلَى الْكَافِرِينَ ‘এটা তো উপদেশ ও প্রকাশ্য কুরআন’। ‘যাতে তিনি সতর্ক করেন জীবিতদেরকে এবং যাতে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়’ (ইয়াসীন ৩৬/৬৯-৭০)।
কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার প্রমাণ সমূহ- ৯. কুরআন সকল শিক্ষা ও কল্যাণের সার-নির্যাস (القرآن زبدة كل تعليم وخير)
তওরাতে রয়েছে আখবার ও আহকাম, যবূরে কেবল প্রার্থনা, ইনজীলে রয়েছে দৃষ্টান্ত এবং কিছু আহকাম ও উপদেশ। অথচ কুরআনে রয়েছে ঐগুলি ছাড়াও বিগত জাতি সমূহের ইতিহাস, বিজ্ঞান ও সৃষ্টিতত্ত্ব, দ্বীনী ও দুনিয়াবী জীবন পরিচালনার নীতিমালা ও বিধান সমূহ, জান্নাতের বিবরণ ও তার সুসংবাদ এবং জাহান্নামের বিবরণ ও তার ভয় প্রদর্শন, রয়েছে আল্লাহ ও আখেরাতের পরিচয় এবং রয়েছে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক উন্নতির সকল প্রকার হেদায়াতের সমষ্টি ও কল্যাণের চাবিকাঠি।
কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার প্রমাণ সমূহ- ১০. কুরআন যাবতীয় ত্রুটি ও স্ববিরোধিতা হ’তে মুক্ত(القرآن سالم من جميع العيوب والتنافض الذاتى)
আল্লাহ বলেন, أَفَلاَ يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ وَلَوْ كَانَ مِنْ عِندِ غَيْرِ اللهِ لَوَجَدُواْ فِيهِ اخْتِلاَفاً كَثِيراً ‘তারা কেন কুরআন নিয়ে গবেষণা করে না? যদি ওটা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারু নিকট থেকে আসত, তাহ’লে ওরা তাতে অনেক গরমিল দেখতে পেত’ (নিসা ৪/৮২)। কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ, যা শুরুতেই নিজেকে لاَ رَيْبَ فِيْهِ ‘সকল প্রকার ত্রুটি ও সন্দেহমুক্ত’ বলে ঘোষণা করেছে (বাক্বারাহ ২/২)।
কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার প্রমাণ সমূহ- ১১. কুরআন ভবিষ্যদ্বাণী, অতীত ইতিহাস ও ঘটনা সমূহের বর্ণনা সমৃদ্ধ এক জ্বলন্ত মু‘জেযা (القرآن معجزة شارقة ذات التنبؤات والتواريخ والأحداث الغابرة)
বিগত দেড় হাযার বছরে পৃথিবীতে বহু কিছু ওলট-পালট হয়েছে। কিন্তু কুরআনের কোন বক্তব্য, অতীত ইতিহাস বা কোন ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়নি। যেমন, (১) পারসিকরা রোমকদের উপর বিজয়ী হ’ল। রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াস সিরিয়া ছেড়ে রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে যেতে বাধ্য হলেন। এতে মক্কার মুশরিকরা খুশী হ’ল। কেননা পারসিকরা অগ্নি উপাসক ও মূর্তিপূজারী ছিল। পক্ষান্তরে মুসলমানেরা এতে দুঃখিত হ’ল। কেননা রোমকরা ছিল আহলে কিতাব। বিষয়টি আবুবকর (রাঃ) রাসূল (সাঃ)-কে বললেন। জবাবে তিনি বললেন, রোমকরা সত্বর বিজয়ী হবে। এ বিষয়ে সূরা রূম ১-৬ আয়াত নাযিল হ’ল। এর বিরুদ্ধে কাফের নেতা উবাই বিন খালাফ আবুবকর (রাঃ)-এর সঙ্গে ১০০ উটের বাজি ধরলেন। দেখা গেল ৯ বছর পর বদর যুদ্ধের দিন রোমকরা বিজয়ী হ’ল। এভাবে কুরআনের ভবিষ্যদ্বাণী কার্যকর হ’ল। তাতে বহু লোক মুসলমান হয়ে গেল।[1] (২) অতীত ইতিহাস হিসাবে কওমে ছামূদ-এর ধ্বংসস্থল সঊদী আরবের হিজর এলাকা, যা এখন ‘মাদায়েনে ছালেহ’ নামে পরিচিত। সমতলভূমিতে বিশালকায় অট্টালিকা নির্মাণ ছাড়াও পর্বতগাত্র খোদাই করে তারা উন্নতমানের প্রকোষ্ঠসমূহ তৈরী করত। এগুলির গায়ে ইরামী ও ছামূদী বর্ণমালার শিলালিপি আজও অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। ২০০৮ সালে ইউনেস্কো এ স্থানটিকে World heritage বা ‘বিশ্ব ঐতিহ্য ’ হিসাবে ঘোষণা করেছে।
৯ম হিজরীতে তাবূক অভিযানে যাওয়ার পথে মুসলিম বাহিনী এখানে অবতরণ করলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদেরকে সেখানে প্রবেশ করতে নিষেধ করে বলেন, তোমরা ঐ অভিশপ্ত এলাকায় প্রবেশ করোনা ক্রন্দনরত অবস্থায় ব্যতীত। নইলে তোমাদের উপর ঐ গযব আসতে পারে, যা তাদের উপর এসেছিল’ (বুখারী হা/৪৩৩)। (৩) লূতের কওমের ধ্বংসের ঘটনা, যা কুরআনে বিধৃত হয়েছে (হিজর ১৫/৭৫, ৭৭; আনকাবূত ২৩/৩৫)। বর্তমান ফিলিস্তীন ও জর্ডান নদীর মধ্যবর্তী ৭৭ * ১২ ব. কি. এলাকা ব্যাপী ৪০০ মিটার গভীরতার ‘মৃত সাগর’ যার বাস্তব প্রমাণ বহন করছে।[2] (৪) মূসার বিরুদ্ধে ফেরাঊনের সাগরডুবির পর তার লাশ অক্ষত থাকবে বলে কুরআন যে ঘোষণা দিয়েছিল (ইউনুস ১০/৯২), তার মমিকৃত লাশ ১৯০৭ সালে সিনাই উপদ্বীপের পশ্চিম তীরে ‘জাবালে ফেরাঊন’ নামক পাহাড় থেকে উদ্ধার হওয়ার পর এখন তা দিবালোকের ন্যায় সত্যে পরিণত হয়েছে। যা এখন কায়রোতে পিরামিডে রক্ষিত আছে’ (নবীদের কাহিনী ২/১১ পৃঃ)। এটি কুরআনের অকাট্য ও অভ্রান্ত সত্য হওয়ার জ্বলন্ত প্রমাণ বহন করে।
[1]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা রূম ১-৬ আয়াত; তিরমিযী হা/৩১৯৩; আহমাদ হা/২৪৯৫।
[2]. দ্রঃ লেখক প্রণীত নবীদের কাহিনী ১/১৬০, টীকা-১১৬।
কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার প্রমাণ সমূহ- ১২. শাশ্বত সত্য বাণী (الكلام الصادق الخالد)
বিজ্ঞান ও দর্শনের বহু তত্ত্ব ও তথ্য যুগে যুগে পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু কুরআনের কোন তত্ত্ব ও তথ্যের মধ্যে বৈপরীত্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। কুরআনের শত্রুরা শত চেষ্টা করেও এ ব্যাপারে ব্যর্থ হয়েছে।
যেমন (১) সূর্য ঘোরে, না পৃথিবী ঘোরে, এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে এক সময় ছিল বিস্তর মতভেদ। খৃষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে গ্রীক বিজ্ঞানী পিথাগোরাস (খৃঃ পূঃ ৫৭০-৪৯৫) বলেন, পৃথিবী ঘোরে, সূর্য স্থির। তার প্রায় সাতশ’ বছর পর মিসরীয় বিজ্ঞানী টলেমী (৯০-১৬৮ খৃ.) বলেন, সূর্য ঘোরে পৃথিবী স্থির। তার প্রায় চৌদ্দশ’ বছর পর পোলিশ বিজ্ঞানী কোপারনিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩ খৃ.) বলেন, টলেমীর ধারণা ভুল। বরং পৃথিবীই ঘোরে, সূর্য স্থির। কিন্তু এখন সবাই বলছেন, আকাশে সবকিছুই ঘোরে। অথচ আজ থেকে প্রায় দেড় হাযার বছর পূর্বে খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে কুরআন ঘোষণা করেছে, كُلٌّ فِي فَلَكٍ يَّسْبَحُوْنَ ‘নভোমন্ডলে যা কিছু আছে, সবই সন্তরণশীল’ (আম্বিয়া ২১/৩৩; ইয়াসীন ৩৬/৪০)। (২) সমাজ বিজ্ঞানীদের অনেকে বলেন, নারী ও পুরুষ সবক্ষেত্রে সমান। এজন্য চলছে বিশ্বব্যাপী অনেক রাজনৈতিক হৈ চৈ। অথচ জীব বিজ্ঞান বলছে নারী ও পুরুষের মধ্যে আদপেই কোন সমতা নেই। দু’টি সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী সত্তা। উভয়ের ইচ্ছা-আকাংখা-কর্মক্ষেত্র সবই পৃথক। কুরআন বহু পূর্বেই এ সত্য বর্ণনা করেছে (নিসা ৪/১ ও অন্যান্য)। যা নিতান্তই বাস্তব ও বিজ্ঞান সম্মত। (৩) কার্ল মার্কস তার ‘গতিতত্ত্ব’ বলে পরিচিত বিপ্লবের দর্শনে বলেছেন, সদা গতিশীল প্রাকৃতিক বিধান সামাজিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটায়। যার ফলে মানবজীবনেও বিপ্লব ও পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে থাকে। এ দর্শন প্রচারের সাথে সাথে তিনি ‘দুনিয়ার মযদুর এক হও’ বলে ডাক দিলেন। যা ছিল তার দর্শনের সাথে সাংঘর্ষিক।[1] কেননা সামাজিক বিপ্লব যদি ঐতিহাসিক কার্যকারণের অনিবার্য পরিণতি হয়, তাহ’লে সেজন্য রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রয়োজন হবে কেন? আর রাজনৈতিক সংগ্রামের ফলেই যদি বিপ্লব আনতে হয়, তাহ’লে ঐতিহাসিক কার্যকারণের অনিবার্য দর্শন নিতান্তই অমূলক গণ্য হয়। অথচ কুরআন বহু পূর্বেই মানুষকে কর্মদর্শন প্রদান করে বলেছে, إِنَّ اللهَ لاَ يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُواْ مَا بِأَنْفُسِهِمْ ‘আল্লাহ কোন জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে’ (রা‘দ ১৩/১১)।
এভাবে কুরআন প্রদত্ত দর্শনের সাথে বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদের তুলনামূলক আলোচনা করলে বৈপরিত্য ও স্ববিরোধিতার প্রচুর দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। অথচ কুরআন এসব থেকে মুক্ত।
অতএব যুগে যুগে বিজ্ঞান যত অগ্রগতি লাভ করবে, কুরআনের বিভিন্ন অলৌকিক বিষয় তেমনি মানুষের সামনে খুলে যাবে। তবে সাবধান থাকতে হবে, এর দ্বারা যেন কোন ভ্রান্ত আক্বীদা জন্ম না নেয়। কেননা বিশুদ্ধ আক্বীদা কেবল সেটাই, যা ছাহাবায়ে কেরামের যুগে ছিল। তাঁদের যুগে যেটি দ্বীন ছিল না, এখন সেটি দ্বীন হিসাবে গৃহীত হবে না।
[1]. মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম, মহাসত্যের সন্ধানে (ঢাকা : ১৯৯৮) ৩৭ পৃঃ।
কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার প্রমাণ সমূহ- ১৩. কুরআনের বাহক ও প্রচারক মাত্র একজন (حامل القرآن ومبلغه واحد فقط)
কুরআনই একমাত্র ইলাহী গ্রন্থ, যার বাহক ও প্রচারক মাত্র একজন। যিনি হ’লেন শেষনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহে ওয়া সাল্লাম। মানছূরপুরী বলেন, অথচ হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ বেদ-এর পেশকারী ঋষিদের সংখ্যা শতাধিক এবং তাদের পরস্পরের মধ্যে সময়ের ব্যবধান শতাধিক বছরের। বাইবেলের অবস্থাও তথৈবচ। এ কিতাবের পেশকারী হিসাবে তিনি ত্রিশজনের নামের তালিকা দিয়েছেন। যাদের মধ্যে হযরত মূসা, দাঊদ, সুলায়মান, যাকারিয়া (আঃ) প্রমুখ আম্বিয়ায়ে কেরাম ছাড়াও রয়েছে অন্যান্যদের নাম। যারা যুগে যুগে বাইবেল পেশ করেছেন। অথচ কোনটার সাথে কোনটার পুরোপুরি মিল নেই। এমনকি হযরত মূসা (আঃ) যে দশটি ফলকে (عَشَرَةُ أَلْوَاحٍ) লিখিত তওরাত নিয়ে এসেছিলেন, তার উম্মত তাতে প্রথমেই সন্দেহ প্রকাশ করেছিল (বাক্বারাহ ২/৫৫-৫৬, ৯৩)। অনুরূপভাবে ইনজীলের অবস্থা। সেখানে হযরত ঈসা (আঃ)-এর শাগরিদদের রচিত বিভিন্ন গ্রন্থ পাওয়া যায়। যার কোনটির সঙ্গে কোনটির পুরোপুরি মিল নেই। বরং প্রায় সবটাই কথিত সেন্ট (Saint) তথা সাধুদের কপোলকল্পিত। যাকে আল্লাহর কেতাব বলে চালানো হচ্ছে। যেদিকে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইঙ্গিত করেছেন (বাক্বারাহ ২/৭৯)।
উল্লেখ্য যে, মসীহ ঈসা নিজের জন্য ১২ জন শাগরিদ বাছাই করেছিলেন, যারা বনু ইস্রাঈলের বারোটি গোত্রের সামনে তাঁর দ্বীনের প্রচার করবে। কিন্তু এতবড় একজন কামেল উস্তাদের সঙ্গে থেকেও তারা এমন অযোগ্য প্রমাণিত হন যে, মসীহকে তাদের উদ্দেশ্যে একাধিকবার একথা বলতে হয়েছিল যে, তোমাদের মধ্যে এক সরিষাদানা পরিমাণ ঈমান থাকলেও তোমরা এরূপ করতে পারতে না’। মসীহ তাদেরকে বারবার তিরষ্কার করতেন এজন্য যে, তাঁর সঙ্গে জেগে থেকেও তারা কখনো দো‘আ-ইস্তেগফারে শরীক হ’ত না। মসীহের আসমানে উঠে যাবার পর উক্ত বারো জন শাগরিদের মধ্যে আক্বীদা ও আমলগত বিষয়ে তীব্র মতভেদ দেখা দেয়। যেমন (১) শরী‘আতের (তাওরাতের) বিধান সমূহ মান্য করা যরূরী কি-না (২) অন্য জাতির নিকটে ঈসায়ী ধর্মের প্রচার সিদ্ধ হবে কি-না (৩) খাৎনা করা কেবল ইসরাঈলীদের জন্য না ঈসায়ী ধর্মে আগত সকলের জন্য আবশ্যক ইত্যাদি। এরপর তাদের মধ্যে আল্লাহ, মারিয়াম ও ঈসার নামে ত্রিত্ববাদের প্রসার ঘটে। যাতে অনেকে ভিন্নমত পোষণ করেন। ঈসা (আঃ) ৩০ বছর বয়সে দাওয়াত শুরু করেন এবং ৩৩ বছর বয়সে তাঁকে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়। তিন বছরে মাত্র ১২ জন শাগরিদ হয়। যার মধ্যে একজন গাদ্দার প্রমাণিত হয়। অবশ্য ‘কিতাবুল আ‘মাল-এর লেখক সাধু লূক-এর মতে তাঁর সমর্থকের সংখ্যা ছিল ১২৪ জন।[1]
পক্ষান্তরে কুরআন শুরু হয়েছে যাঁর মাধ্যমে, শেষও হয়েছে তাঁর মাধ্যমে। এর একটি শব্দ ও বর্ণেও অন্য কোন ব্যক্তি যুক্ত নন। কুরআন বুঝার জন্য অন্য কোন সহায়ক কুরআনও নাযিল হয়নি। যেমন হিন্দুদের ঋগ্বেদ বুঝতে গেলে সাম বেদ, অথবর্ব বেদ ইত্যাদির মুখাপেক্ষী হ’তে হয়। অনুরূপভাবে ইহূদী-খৃষ্টানদের নিউ টেষ্টামেন্ট পূর্ণতা পায় না ওল্ড টেষ্টামেন্ট ব্যতীত। আবার চারটি ইনজীল (أَنَاجِيلُ أَرْبعَة) অপূর্ণ থাকে সেন্ট লূক-এর কিতাবুল আ‘মাল ব্যতীত। অথচ কুরআন নিজেই সবকিছুর ব্যাখ্যা تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍ (নাহল ১৬/৮৯)। এরপরেও প্রয়োজনীয় ও বিস্তৃত ব্যাখ্যার জন্য কুরআনের বাহক রাসূল (সাঃ)-এর হাদীছ সমূহ মওজুদ রয়েছে। যা আল্লাহ কর্তৃক প্রত্যাদিষ্ট (নাজম ৫৩/৩-৪; ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৯)।
উল্লেখ্য যে, হিন্দুরা চারটি বেদ-এর কথা বললেও মনু তিনটি বেদ-এর কথা বলেন, যাতে অথবর্ব বেদ নেই। সংস্কৃতের কোন কোন প্রাচীন গ্রন্থে প্রায় ৩২টি বইয়ের উপরে বেদ-এর নাম ব্যবহার করা হয়েছে। তাছাড়া সাধারণ হিন্দুরা বেদকে ‘ঈশ্বরের বাণী’ মনে করলেও তাদের বহু বিদ্বান একে ‘মানুষের কথা’ বলে থাকেন এবং প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ লোক বর্তমান বেদ-কে আসল বেদ মনে করেন না।[2] পক্ষান্তরে কুরআনের অনুসারী হৌন বা না হৌন সকলেই কুরআনকে আল্লাহর কালাম এবং তাকে অবিকৃত বলে বিশ্বাস করে থাকেন।
[1]. মানছূরপুরী, রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ৩/১১২।
[2]. মানছূরপুরী, রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ৩/২৭৪-৭৫।
কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার প্রমাণ সমূহ- ১৪. অত্যন্ত উঁচু মান ও মার্জিত রুচিসম্পন্ন (ذو المستوى الأعلى وحسن الذوق المهذب)
কুরআনের ভাষা অত্যন্ত উঁচুমানের এবং মার্জিত রুচি সম্পন্ন। এতে কোনরূপ লজ্জাকর ভাষা ও ঘটনার স্পর্শ নেই। অথচ বেদ ও প্রচলিত বাইবেল নানা যৌন রসাত্মক উপমা ও রচনায় ভরা। যা ধর্মীয় পবিত্রতা ও ভাবগাম্ভীর্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। এর মৌলিক কারণ হ’ল এই যে, ঐসব গ্রন্থাবলীর রচয়িতা হ’ল মানুষ। আর কুরআনের ভাষা হ’ল সরাসরি আল্লাহর। তাই বান্দার ভাষা কখনোই আল্লাহর ভাষার ধারে-কাছে যেতে পারে না। এজন্যই বলা হয়ে থাকে كلامُ الملوكِ ملوكُ الكلامِ ‘বাদশাহদের ভাষা হয় শাহী ভাষা’। কুরআনের ভাষা তাই যাবতীয় মানবীয় দুর্বলতা ও আবিলতার ঊর্ধ্বে এক অতুলনীয় সৌকর্যমন্ডিত ভাষা। সেই সাথে কুরআনের ভাষা অতুলনীয় এবং সর্বোচ্চ অলংকার সমৃদ্ধ। কুরআন নাযিলের সময়কালের বরেণ্য আরবী কবিগণ যেমন কুরআনী বালাগাত-ফাছাহাত ও অলংকারের কাছে অসহায় ছিলেন, আধুনিক যুগের কবি-সাহিত্যিকগণ একইভাবে রয়েছেন অসহায়।
মিসরের খ্যাতনামা মুফাসসির তানতাভী জাওহারী বলেন, ১৯৩২ সালের ১৩ই জুন তারিখে মিসরীয় অধ্যাপক কামেল কীলানী আমাকে একটি বিষ্ময়কর ঘটনা শুনিয়ে বলেন যে, আমার খ্যাতনামা আমেরিকান প্রাচ্যবিদ ফিনকেল একদিন আমাকে বলেন, কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার ব্যাপারে তোমার রায় বর্ণনা কর। তখন আমি বললাম, তাহ’লে আসুন আমরা জাহান্নামের প্রশস্ততার ব্যাপারে অন্ততঃ বিশটি বাক্য তৈরী করি। অতঃপর আমরা উক্ত মর্মে বাক্যগুলি তৈরী করলাম। যেমন, إنَّ جَهَنَّمَ وَاسِعَةٌ جِدًّا، إنَّ جَهَنَّمَ لَأَوْسَعُ مِمَّا تَظُنُّونَ، إنَّ سِعَةَ جَهَنَّمَ لاَ يَتَصَوَّرُهَا عَقْلُ إِنْسَانٍ ইত্যাদি। অতঃপর তিনি বললেন, কুরআন কি উক্ত মর্মে এর চাইতে উন্নত অলংকারবিশিষ্ট কোন বাক্য প্রয়োগ করতে পেরেছে? জবাবে আমি বললাম, আমরা কুরআনের সাহিত্যের কাছে শিশু মাত্র। শুনে তিনি হতবাক হয়ে বললেন, সেটা কি? আমি তখন সূরা ক্বাফ-এর ৩০ আয়াতটি পাঠ করলাম, يَوْمَ نَقُوْلُ لِجَهَنَّمَ هَلِ امْتَلَأْتِ وَتَقُوْلُ هَلْ مِنْ مَزِيْدٍ ‘যেদিন আমরা জাহান্নামকে বলব, ভরে গেছ কি? সে বলবে, আরো আছে কি?’ (ক্বাফ ৫০/৩০)। আয়াতটি শুনে তিনি হতভম্ব হয়ে বললেন, তুমি সত্য বলেছ, হ্যাঁ, তুমি সত্য বলেছ।[1] আমরা মনে করি এর পরবর্তী আয়াতে জান্নাতীদের পুরস্কার সম্পর্কে যে বর্ণনা এসেছে তা একইভাবে অনন্য ও অসাধারণ। যেমন বলা হয়েছে لَهُمْ مَا يَشَاءُوْنَ فِيْهَا وَلَدَيْنَا مَزِيْدٌ ‘সেখানে তারা যা চাইবে তাই পাবে এবং আমাদের কাছে রয়েছে আরও অধিক’ (ক্বাফ ৫০/৩৫)। অমনিভাবে জাহান্নামীদের শাস্তি সম্পর্কে আল্লাহ অন্যত্র বলেন, فَذُوقُوا فَلَنْ نَزِيدَكُمْ إِلاَّ عَذَابًا ‘অতএব তোমরা স্বাদ আস্বাদন করো। এখন আমরা তোমাদের কিছুই বৃদ্ধি করব না শাস্তি ব্যতীত’ (নাবা ৭৮/৩০)।
বস্ত্ততঃ অল্প কথায় সুন্দরতম আঙ্গিকে এমন আকর্ষণীয় বাক্যশৈলী আল্লাহ ব্যতীত কারু পক্ষে সম্ভব নয়। আর এভাবেই আরবদের উপরে কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যারা ছিল সেযুগে শুদ্ধভাষিতায় বিশ্বসেরা। সেজন্য তারা নিজেদেরকে ‘আরব’ (عَرَب) অর্থাৎ শুদ্ধভাষী বলত এবং অনারবদেরকে ‘আজম’ (عَجَم) অর্থাৎ ‘বোবা’ বলে অভিহিত করত।
আল্লাহ পাক তাঁর নবীদেরকে স্ব স্ব যুগের উপরে এভাবেই শ্রেষ্ঠত্ব দান করেন। যেমন জাদুবিদ্যায় সেরা মিসরীয়দের পরাস্ত করার জন্য আল্লাহ নবী মূসাকে লাঠি ও প্রদীপ্ত হস্ততালুর মো‘জেযা দান করেন। চিকিৎসা বিদ্যায় সেরা শাম দেশের অহংকারী নেতাদের পরাস্ত করার জন্য আল্লাহ নবী ঈসাকে অন্ধকে চক্ষু দান, কুষ্ঠ রোগীকে আরোগ্য দান, এমনকি মৃতকে জীবিত করার মো‘জেযা প্রদান করেন। অনুরূপভাবে ভাষাগর্বী আরবদের কাছে শেষনবীকে মো‘জেযা স্বরূপ অলংকারময় কুরআন দান করেন। যার সামনে আরব পন্ডিতেরা কুরআন নাযিলের যুগে ও পরে সর্বদা মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়। ফালিল্লাহিল হাম্দ।
[1]. ত্বানত্বাভী জাওহারী (১৮৫৯-১৯৪০ খৃ.), আল-জাওয়াহের ফী তাফসীরিল কুরআনিল কারীম (বৈরূত : দারুল ফিকর, তাবি) তাফসীর সূরা ক্বাফ ৩০ আয়াত, ১২/১০৭-০৮।
কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার প্রমাণ সমূহ- ১৫. একজন উম্মী নবীর মুখনিঃসৃত বাণী (الكلام المخرج من فم نبى أمى)
কুরআনই একমাত্র ইলাহী গ্রন্থ, যা তাওরাত ইত্যাদির ন্যায় ফলকে লিপিবদ্ধ আকারে দুনিয়াতে আসেনি। বরং সরাসরি উম্মী নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। সাথে সাথে মুহাম্মাদ (সাঃ)-ই একমাত্র নবী, যিনি النَّبِيُّ الْأُمِّيُّ বা ‘নিরক্ষর নবী’ হিসাবে অভিহিত হয়েছেন (আ‘রাফ ৭/১৫৭, ১৫৮)। কুরআন আল্লাহর কালাম হওয়ার এটাও একটি বড় প্রমাণ যে, যার মুখ দিয়ে দুনিয়াবাসী বিজ্ঞানময় কুরআন শুনেছে, তিনি নিজে ছিলেন ‘উম্মী’ অর্থাৎ নিরক্ষর ব্যক্তি এবং মানুষ হয়েছিলেন নিরক্ষর সমাজে (জুম‘আ ৬২/২)। এমনকি আল্লাহ বলেন, وَمَا كُنْتَ تَتْلُو مِنْ قَبْلِهِ مِنْ كِتَابٍ وَلاَ تَخُطُّهُ بِيَمِيْنِكَ إِذًا لاَرْتَابَ الْمُبْطِلُوْنَ ‘আর তুমি তো এর আগে কোন বই পড়োনি এবং স্বহস্তে কোন লেখাও লেখোনি, যাতে বাতিলপন্থীরা সন্দেহ করতে পারে’ (আনকাবূত ২৯/৪৮)। তিনি অন্যত্র বলেন, مَا كُنْتَ تَدْرِيْ مَا الْكِتَابُ وَلاَ الْإِيْمَانُ ‘তুমি জানতে না কিতাব কি বা ঈমান কি?’ (শূরা ৪২/৫২)। তাই কুরআনের ভাষা ও বক্তব্যে নিজের থেকে যোগ-বিয়োগ করার সকল প্রকার সন্দেহের তিনি ঊর্ধ্বে ছিলেন।
বস্ত্ততঃ মুহাম্মাদ (সাঃ) ব্যতীত দুনিয়াতে এমন কোন নবী আসেননি, যার পবিত্র যবান দিয়ে সরাসরি আল্লাহর কালাম বের হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর শ্রেষ্ঠত্বের একটি বড় দলীল ও একটি বড় মু‘জেযা। মানছূরপুরী বলেন, খ্রিষ্টানদের সকলে এ বিষয়ে একমত যে, তাদের চারটি ইনজীলের একটিও মসীহ ঈসার উপরে আল্লাহর পক্ষ হ’তে সরাসরি নাযিল হয়নি। বরং এগুলি স্ব স্ব লেখকদের দিকে সম্পর্কিত। উক্ত প্রসিদ্ধ চারটি ইনজীল হ’ল, মথি (إِنْجِيلُ مَتَّى), মুরকুস (مُرْقُس), লূক (لُوقَا) এবং ইউহান্না (يُوحَنَّا)। এগুলির পবিত্রতার পক্ষে খ্রিষ্টানদের যুক্তি হ’ল এই যে, এগুলি পবিত্র রূহ মসীহ ঈসা (আঃ)-এর সাহায্য নিয়ে লেখা হয়েছে’। তাদের এ দাবী যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহ’লে চারটি ইনজীলের পরস্পরের মধ্যে এত গরমিল কেন? যেগুলির বক্তব্যের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করতে খৃষ্টান পন্ডিতগণ চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। এমনকি আদম ক্লার্ক, নূরটিন ও হারূণ প্রমুখ খ্রিষ্টান বিদ্বানগণের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত এই যে, ইনজীলগুলির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের কোন সুযোগ নেই। পাদ্রী ফ্রেঞ্চ স্বীকার করেছেন যে, ইনজীলগুলির মধ্যে ছোট-বড় ৩০ হাযার ভুল রয়েছে। কথা হ’ল, চারটি ইনজীলের মিলিত পৃষ্ঠা সংখ্যা একশ’-এর বেশী হবে না’ (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ৩/২৭৩)। অথচ তার মধ্যেই যদি ত্রিশ হাযার ভুল থাকে, তাহ’লে বিশুদ্ধ কতটুকু আছে? আর ঐসব বইয়ের গ্রহণযোগ্যতাই বা কি? একেই তো বলে ‘সাত নকলে আসল খাস্তা’।
খ্রিষ্টান ধর্মনেতাদের এইসব দুষ্কৃতির প্রতি ইঙ্গিত করেই আল্লাহ বলেন,
فَوَيْلٌ لِلَّذِينَ يَكْتُبُونَ الْكِتَابَ بِأَيْدِيهِمْ ثُمَّ يَقُولُونَ هَذَا مِنْ عِنْدِ اللهِ لِيَشْتَرُوا بِهِ ثَمَنًا قَلِيلاً فَوَيْلٌ لَهُمْ مِمَّا كَتَبَتْ أَيْدِيهِمْ وَوَيْلٌ لَهُمْ مِمَّا يَكْسِبُونَ- ‘ধ্বংস ঐসব লোকদের জন্য, যারা স্বহস্তে পুস্তক রচনা করে। অতঃপর বলে যে, এটি আল্লাহর নিকট থেকে আগত। যাতে তারা এর মাধ্যমে সামান্য অর্থ উপার্জন করতে পারে। অতএব ধ্বংস হৌক তারা যা স্বহস্তে লেখে এবং ধ্বংস হৌক তারা যা কিছু উপার্জন করে’ (বাক্বারাহ ২/৭৯)।
কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার প্রমাণ সমূহ- ১৬. সকলের পাঠযোগ্য (قابل القراءة للجميع)
কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ যা আল্লাহর কালাম হিসাবে কেবল নবী পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং উম্মতে মুহাম্মাদীর সবাই তা পাঠ করে ধন্য হ’তে পারে। মানুষ দুনিয়াতে তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে দেখতে পাবে না ঠিকই। কিন্তু তাঁর কালাম পাঠ করে ও শ্রবণ করে এক অনির্বচনীয় ভাবানুভূতিতে ডুবে যেতে পারে। ঠিক যেমন পিতার রেখে যাওয়া হস্তলিখিত পত্র বা লেখনী পাঠ করে প্রিয় সন্তান তার হারানো পিতার মহান স্মৃতিতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তাই কুরআনের পাঠক ও অনুসারী উম্মতে মুহাম্মাদীর চাইতে সৌভাগ্যবান জাতি পৃথিবীতে আর কেউ নেই। মূসা (আঃ)-এর সাথে আল্লাহ কথা বলেছিলেন ঠিকই। কিন্তু তওরাত সে কথার সমষ্টি নয়। তাই বাইবেলের অনুসারীরা আল্লাহর সরাসরি কালাম থেকে বঞ্চিত। আর বর্তমান বাইবেল তো আদৌ প্রকৃত তওরাত নয়। অন্যদিকে হিন্দুদের বেদ তো কেবল ব্রাহ্মণদেরই পাঠের অনুমতি রয়েছে, সাধারণ হিন্দুদের নেই।
কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার প্রমাণ সমূহ- ১৭. স্মৃতিতে সুরক্ষিত (المحفوظ فى الذاكرة)
কুরআনই একমাত্র ইলাহী কিতাব, যা মানুষের স্মৃতিতে সংরক্ষিত হয়েছে। কুরআনের পূর্বে কোন এলাহী গ্রন্থ মুখস্থ করা হয়নি। কুরআন আল্লাহ কর্তৃক হেফাযতের এটি একটি বড় প্রমাণ। পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে শহরে-গ্রামে, এমনকি নির্জন কারা কক্ষে বসে অগণিত মুসলমান কুরআনের হাফেয হচ্ছে এবং এইসব হাফেযে কুরআনের মুখে সর্বদা কুরআন পঠিত হচ্ছে। অন্যেরা সবাই পুরা কুরআনের হাফেয না হ’লেও এমন কোন মুসলমান দুনিয়াতে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে যে, কুরআনের কিছু অংশ তার মুখস্থ নেই। ২০০৫ সালের একটি হিসাবে জানা যায় যে, প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুঝুঁকির মধ্যে বসবাসকারী ফিলিস্তীনীদের মধ্যে সে বছর চল্লিশ হাযার কিশোর-কিশোরী কুরআনের হাফেয হয়েছে’ (মাজাল্লা আল-ফুরক্বান (কুয়েত : জামঈয়াতু এহইয়াইত তুরাছিল ইসলামী) ....)। আলহামদুলিল্লাহ।
কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার প্রমাণ সমূহ- ১৮. সহজে মুখস্থ হবার যোগ্য (قابل الحفظ باليسر)
কুরআন এমনই এক গ্রন্থ যা সহজে মুখস্থ হয়ে যায়। একটু চেষ্টা করলেই তা মানুষের স্মৃতিতে গেঁথে যায়। মাতৃভাষা বাংলায় একশ’ পৃষ্ঠার একটা গদ্য বা পদ্যের বই হুবহু কেউ মুখস্থ করতে পারবে কি-না সন্দেহ। অথচ ছয়শো পৃষ্ঠার অধিক পুরো কুরআন মুখস্থকারী বাংলাভাষীর সংখ্যা নিঃসন্দেহে লাখ লাখ হবে।
ইহূদী, নাছারা, ফার্সী, হিন্দু, বৌদ্ধ কেউ কি একথা দাবী করতে পারবে যে, তাদের কেউ তাদের ধর্মগ্রন্থ আগাগোড়া মুখস্থ বলতে পারে? এ দাবী কেবল মুসলমানেরাই করতে পারে। আর কেউ নয়। ফালিল্লাহিল হাম্দ। বস্ত্ততঃ কুরআনকে হেফাযতের জন্য প্রদত্ত আল্লাহর ওয়াদার এটাও একটি জ্বলন্ত প্রমাণ।
কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার প্রমাণ সমূহ- ১৯. সর্বাধিক পঠিত ইলাহী গ্রন্থ (الكةاب الإلهى الأكثر قراءة)
কুরআন পৃথিবীর সর্বাধিক পঠিত ও প্রচারিত ইলাহী গ্রন্থ। আল্লাহ বলেন, وَكِتَابٍ مَسْطُوْرٍ، فِيْ رَقٍّ مَنْشُوْرٍ ‘কসম ঐ কেতাবের যা লিখিত হয়েছে’ ‘বিস্তৃত পত্রে’ (তূর ৫২/২-৩)। এখানে কুরআন মজীদের তিনটি বিশেষণ বর্ণিত হয়েছে- ‘কিতাব’ (গ্রন্থ), ‘মাসতূর’ (লিখিত) এবং ‘মানশূর’ (বিস্তৃত)। বস্ত্ততঃ কুরআন সর্বাধিক উচ্চারিত ও বিস্তৃত গ্রন্থ এ কারণে যে, তা মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত হয়েছে। কুরআন প্রচারের জন্য কোন প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া অপরিহার্য নয়। যেকোন মুমিন কুরআন মুখস্থ করে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারে। ফলে যতদিন পৃথিবীতে মুসলমান থাকবে, ততদিন পৃথিবীতে কুরআন থাকবে ইনশাআল্লাহ।
কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার প্রমাণ সমূহ- ২০. সত্য ও ন্যায় দ্বারা পূর্ণ (المملوء بالصدق والعدل)
কুরআন এমনই একটি গ্রন্থ, যার প্রতিটি কথাই চূড়ান্ত সত্য ও ন্যায় দ্বারা পূর্ণ। পরিস্থিতির কারণে যে সত্যের কোন পরিবর্তন হয় না। আল্লাহ বলেন, وَتَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ صِدْقًا وَّعَدْلاً لاَ مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِهِ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ ‘তোমার প্রভুর কালাম সত্য ও ন্যায় দ্বারা পূর্ণ। তাঁর কালামের পরিবর্তনকারী কেউ নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (আন‘আম ৬/১১৫)।
মানুষ সাধারণতঃ অধিকাংশের মত অনুযায়ী চলে। তাই অধিকাংশের দোহাই দিয়ে মানুষ যেন সত্যকে এড়িয়ে না যায়, সে বিষয়ে সাবধান করে পরের আয়াতেই আল্লাহ স্বীয় নবীকে বলেন, وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَنْ سَبِيلِ اللهِ إِنْ يَتَّبِعُونَ إِلاَّ الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلاَّ يَخْرُصُونَ ‘অতএব যদি তুমি জনপদের অধিকাংশ লোকের কথা মেনে চল, তাহ’লে ওরা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। তারা তো কেবল ধারণার অনুসরণ করে এবং তারা তো কেবল অনুমান ভিত্তিক কথা বলে’ (আন‘আম ৬/১১৬)।
কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার প্রমাণ সমূহ- ২১. সিদ্ধান্তকারী গ্রন্থ (الكتاب الفيصل)
মানুষ যত সিদ্ধান্তই গ্রহণ করুক, তা যুগে যুগে পরিবর্তনশীল। কারণ সে তার ভবিষ্যৎ মঙ্গলামঙ্গলের খবর রাখে না। কিন্তু আল্লাহ কালের স্রষ্টা। তাঁর জ্ঞান অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ কোন কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি মানুষের ভূত ও ভবিষ্যৎ মঙ্গলামঙ্গলের খবর রাখেন। তাই তাঁর বিধান অভ্রান্ত ও চূড়ান্ত। মানুষ যতদিন আল্লাহর বিধান মতে চলবে, ততদিন কল্যাণের মধ্যে থাকবে। বস্ত্ততঃ কোন ধর্মগ্রন্থই নিজেকে إِنَّهُ لَقَوْلٌ فَصْلٌ ‘নিশ্চয়ই এটি সিদ্ধান্তকারী বাণী’ (ত্বারেক ৮৬/১৩) বলে ঘোষণা দেয়নি। এটা কেবল কুরআনেরই বৈশিষ্ট্য। কেননা কুরআন মানবজাতির জন্য আল্লাহর সর্বশেষ প্রেরিত কিতাব।
কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার প্রমাণ সমূহ- ২২. ব্যাপক অর্থবোধক গ্রন্থ (الكتاب ذو معنى شامل)
কুরআনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, এর কোন আয়াত কোন বিশেষ উপলক্ষ্যে নাযিল হ’লেও তার অর্থ হয় ব্যাপক ও সর্বযুগীয়। যাতে সকল যুগের সকল মানুষ এর দ্বারা উদ্বুদ্ধ ও উপকৃত হয়। যেমন (১) সূরা ‘আলাক্ব’-এর ৬ থেকে ১৯ আয়াত পর্যন্ত মক্কার মুশরিক নেতা আবু জাহ্ল সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। কিন্তু এর বক্তব্য সকল যুগের ইসলামদ্রোহী নেতাদের প্রতি প্রযোজ্য। অমনিভাবে (২) আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, সূরা আহক্বাফ ১৫ আয়াতটি হযরত আবুবকর (রাঃ) সম্পর্কে নাযিল হয়। যেখানে আল্লাহ বলেন, حَتَّى إِذَا بَلَغَ أَشُدَّهُ وَبَلَغَ أَرْبَعِيْنَ سَنَةً قَالَ رَبِّ أَوْزِعْنِيْ أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِيْ أَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَعَلَى وَالِدَيَّ وَأَنْ أَعْمَلَ صَالِحًا تَرْضَاهُ وَأَصْلِحْ لِيْ فِيْ ذُرِّيَّتِي إِنِّيْ تُبْتُ إِلَيْكَ وَإِنِّيْ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ ‘... অবশেষে যখন সে পূর্ণ বয়স্ক হয় এবং চল্লিশ বছরে উপনীত হয় তখন সে বলে, হে আমার পালনকর্তা! তুমি আমাকে শক্তি দাও, যাতে আমি তোমার নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করতে পারি, যা তুমি আমাকে ও আমার পিতামাতাকে দান করেছ এবং আমি তোমার পসন্দনীয় সৎকর্ম সমূহ করতে পারি। তুমি আমার জন্য আমার সন্তানদের মধ্যে কল্যাণ দান কর। আমি তোমার দিকে ফিরে গেলাম (তওবা করলাম) এবং আমি তোমার আজ্ঞাবহদের অন্যতম’ (কুরতুবী, তাফসীর সূরা আহক্বাফ ৪৬/১৫)।
এই দো‘আ কবুল করে আল্লাহ তাকে এমন তাওফীক দান করেন যে, তাঁর চার পুরুষ অর্থাৎ তিনি নিজে, তাঁর পিতা-মাতা, সন্তানাদি ও পৌত্রাদি ক্রমে সবাই মুসলমান হয়ে যান। ছাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কেবল আবুবকর (রাঃ)-কেই আল্লাহ এই সৌভাগ্য দান করেন। কিন্তু আয়াতের উদ্দেশ্য হ’ল সকল মুসলমানকে এই নির্দেশনা দেওয়া যে, বয়স চল্লিশ বছর হয়ে গেলে তার মধ্যে পরকাল চিন্তা প্রবল হওয়া উচিত এবং বিগত গোনাহসমূহ হ’তে তওবা করা উচিত। আর সন্তান-সন্ততিকে দ্বীনদার ও সৎকর্মশীল করার জন্য সাধ্যমত চেষ্টার সাথে সাথে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা উচিত। নির্দিষ্ট ও ব্যাপক অর্থবোধক এই দ্বৈত ভাবধারা কুরআনী ভাষা ও বর্ণনাভঙ্গির এক অনন্য দিক, যা অন্য কোন ধর্মগ্রন্থে নেই।
(২) কুরআনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হ’ল এর ‘মাছানী’ (مَثَانِي) নীতি। অর্থাৎ যেখানেই জান্নাতের সুসংবাদ। তার পরেই জাহান্নামের ভয় প্রদর্শন। যেমন আল্লাহ বলেন, أَمَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ فَلَهُمْ جَنَّاتُ الْمَأْوَى نُزُلًا بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ- وَأَمَّا الَّذِينَ فَسَقُوا فَمَأْوَاهُمُ النَّارُ كُلَّمَا أَرَادُوا أَنْ يَخْرُجُوا مِنْهَا أُعِيدُوا فِيهَا وَقِيلَ لَهُمْ ذُوقُوا عَذَابَ النَّارِ الَّذِي كُنْتُمْ بِهِ تُكَذِّبُونَ- ‘যারা ঈমান আনে ও সৎকর্মসমূহ সম্পাদন করে, তাদের জন্য তাদের কৃতকর্মের আপ্যায়ন স্বরূপ রয়েছে বসবাসের জান্নাত’। ‘আর যারা অবাধ্যতা করে, তাদের ঠিকানা হ’ল জাহান্নাম। যখনই তারা সেখান থেকে বের হ’তে চাইবে, তখনই তাদেরকে সেখানে ফিরিয়ে দেওয়া হবে এবং বলা হবে, জাহান্নামের যে শাস্তিকে তোমরা মিথ্যা বলতে, তার স্বাদ আস্বাদন করো’ (সাজদাহ ৩২/১৯-২০)। কুরআনের প্রায় প্রতি পৃষ্ঠায় এরূপ প্রমাণ মিলবে। যাতে পাঠকের মনে বারবার জান্নাত ও জাহান্নামের দোলা দেয়। যাতে তার মধ্যে জাহান্নাম থেকে বাঁচার আকুতি সৃষ্টি হয় ও জান্নাতের প্রতি আকাংখা প্রবল হয়। এভাবে সে প্রকাশ্য ও গোপন সকল পাপ থেকে ফিরে আসতে উদ্বুদ্ধ হয়।
কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার প্রমাণ সমূহ- ২৩. পূর্ববর্তী সকল ইলাহী কিতাবের সত্যায়নকারী (المصدق لجميع الكةب الإلهية السابقة)
কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ, যা পূর্ববর্তী সকল এলাহী কিতাবের সত্যায়ন করেছে এবং সেগুলির সুন্দর শিক্ষাসমূহের প্রশংসা করেছে। এজন্য কুরআনের একটি নাম হ’ল مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ ‘পূর্ববর্তী কিতাব সমূহের সত্যায়নকারী’।[1]
[1]. বাক্বারাহ ২/৯৭; আলে ইমরান ৩/৩; মায়েদাহ ৫/৪৬; ফাত্বির ৩৫/৩১; আহক্বাফ ৪৬/৩০।
কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার প্রমাণ সমূহ- ২৪. জিন ও ইনসানকে চ্যালেঞ্জকারী (متحدى إلى الجن والإنس)
কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ যা জিন ও ইনসান উভয় জাতিকে চ্যালেঞ্জ করেছে অনুরূপ একটি গ্রন্থ রচনার জন্য এবং তারা যে ব্যর্থ হবে, সে কথাও বলে দিয়েছে। আল্লাহ বলেন, قُلْ لَئِنِ اجْتَمَعَتِ الْإِنْسُ وَالْجِنُّ عَلَى أَنْ يَأْتُوْا بِمِثْلِ هَذَا الْقُرْآنِ لاَ يَأْتُوْنَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيْرًا ‘তুমি বলে দাও, যদি মানুষ ও জিন জাতি একত্রিত হয়ে পরস্পরের সহযোগিতায় কুরআনের ন্যায় একটি কিতাব নিয়ে আসতে চায়, তবুও তারা তা পারবে না’ (ইসরা ১৭/৮৮)। এমনকি তারা অনুরূপ একটি ‘সূরা’ (বাক্বারাহ ২/২৩-২৪) বা ১০টি আয়াতও (হূদ ১১/১৩-১৪) রচনা করতে পারবে না। অর্থাৎ একটিও নয়। এভাবে কুরআন মক্কায় মুশরিকদের চারবার[1] এবং মদীনায় ইহূদী-নাছারাদের একবার (বাক্বারাহ ২/২৩-২৪) চালেঞ্জ করেছে। কিন্তু ঐ চ্যালেঞ্জ গ্রহণের সাহস তখনও কারু হয়নি, আজও হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে না। এটা কুরআনের জীবন্ত মু‘জেযা হওয়ার অন্যতম দলীল। যা পৃথিবীর সর্বযুগের সকল বিদ্বানকে পরাজিত করেছে ও তাদেরকে মাথা নত করতে বাধ্য করেছে।
[1]. ইউনুস ১০/৩৮; হূদ ১১/১৩; ইসরা ১৭/৮৮; ক্বাছাছ ২৮/৪৯।
কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার প্রমাণ সমূহ- ২৫. বাতিল হ’তে নিরাপদ (السالم من الأباطيل)
কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ, যা সর্বাবস্থায় বাতিল ও মিথ্যা হ’তে নিরাপদ। কুরআনের শত্রুরা এতে একটি বর্ণও ঢুকাতে পারেনি বা বের করতে পারেনি এবং পারবেও না কখনো। যেমন আল্লাহ বলেন, لاَ يَأْتِيْهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَلاَ مِنْ خَلْفِهِ تَنْزِيْلٌ مِنْ حَكِيْمٍ حَمِيْدٍ ‘তার সম্মুখ দিয়ে বা পিছন দিয়ে কখনোই বাতিল প্রবেশ করে না। এটি প্রজ্ঞাময় ও মহা প্রশংসিত সত্তার পক্ষ হ’তে অবতীর্ণ’ (হামীম সাজদাহ ৪১/৪২)। তিনি বলেন, وَبِالْحَقِّ أَنْزَلْنَاهُ وَبِالْحَقِّ نَزَلَ وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلاَّ مُبَشِّرًا وَنَذِيْرًا ‘আমরা সত্যসহ এ কুরআন নাযিল করেছি এবং সত্যসহ এটা নাযিল হয়েছে। আমরা তো তোমাকে কেবল সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে প্রেরণ করেছি’ (বনু ইসরাঈল ১৭/১০৫)।
কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার প্রমাণ সমূহ- ২৬. কুরআন থেকে মুখ ফিরানোই হ’ল জাতির অধঃপতনের মূল কারণ(الإعراض عن القرآن هو السبب الحقيقى لانحطاط الأمة)
কুরআন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়াকেই উম্মতের অধঃপতনের কারণ বলে ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর রাসূল (সাঃ) স্বীয় পালনকর্তার নিকটে ওযর পেশ করে বলবেন, وَقَالَ الرَّسُوْلُ يَا رَبِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوْا هَذَا الْقُرْآنَ مَهْجُوْرًا ‘হে আমার পালনকর্তা! আমার কওম এই কুরআনকে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছিল’ (ফুরক্বান ২৫/৩০)। অন্যদিকে যালেমদের কৈফিয়ত হবে আরও করুণ।
যেমন আল্লাহ বলেন, وَيَوْمَ يَعَضُّ الظَّالِمُ عَلَى يَدَيْهِ يَقُولُ يَا لَيْتَنِي اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُولِ سَبِيلاً- يَا وَيْلَتَى لَيْتَنِي لَمْ أَتَّخِذْ فُلاَنًا خَلِيلاً- لَقَدْ أَضَلَّنِي عَنِ الذِّكْرِ بَعْدَ إِذْ جَاءَنِي وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِلْإِنْسَانِ خَذُولاً- ‘যেদিন যালেম নিজের দু’হাত কামড়িয়ে বলবে, হায়! যদি আমি (দুনিয়াতে) রাসূল-এর সাথে সৎপথ অবলম্বন করতাম’! ‘হায়! যদি আমি অমুককে (শয়তানকে) বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম’! ‘আমাকে তো সে বিভ্রান্ত করেছিল আমার নিকটে উপদেশ (কুরআন) এসে যাবার পর। বস্ত্ততঃ শয়তান মানুষের জন্য মহা প্রতারক’ (ফুরক্বান ২৫/২৭-২৯)।
হাদীছের পরিচয় (تعارف الحديث النبوى صــ)
আল্লাহ বলেন, وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا ‘আমার রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত হও’ (হাশর ৫৯/৭)। তিনি বলেন, وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى، إِنْ هُوَ إِلاَّ وَحْيٌ يُوْحَى ‘তিনি নিজ থেকে (দ্বীন বিষয়ে) কোন কথা বলেন না’। ‘যা বলেন অহী করা হ’লেই তবে বলেন’ (নাজম ৫৩/৩-৪)। সেকারণ রাসূল (সাঃ)-এর হাদীছ হেফাযতের দায়িত্বও আল্লাহ নিয়েছেন। যেমন তিনি বলেন, ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا بَيَانَهُ ‘অতঃপর কুরআনের ব্যাখ্যা দানের দায়িত্ব আমাদেরই’ (ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৯)। তিনি বলেন وَمَا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ إِلاَّ لِتُبَيِّنَ لَهُمُ الَّذِي اخْتَلَفُوا فِيهِ وَهُدًى وَرَحْمَةً لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ ‘আমরা তোমার প্রতি কুরআন নাযিল করেছি কেবল এজন্য যে, তুমি তাদেরকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে দিবে যেসব বিষয়ে তারা মতভেদ করে এবং (এটি নাযিল করেছি) মুমিনদের জন্য হেদায়াত ও রহমত স্বরূপ’ (নাহল ১৬/৬৪)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَاناً لِّكُلِّ شَيْءٍ ‘আর আমরা তোমার উপর কুরআন নাযিল করেছি সকল বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা হিসাবে’.. (নাহল ১৬/৮৯)। ইমাম আওযাঈ (৮৮-১৫৭ হি.) বলেন, এর অর্থ بِالسُّنَّةِ ‘সুন্নাহ দ্বারা’ (ইবনু কাছীর)। অর্থাৎ সুন্নাহ সহ কুরআন সকল বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা স্বরূপ। যেমন কুরআনে ছালাত, ছিয়াম, যাকাত ও হজ্জ ফরয করা হয়েছে। কিন্তু হাদীছে তার নিয়ম-কানূন ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সেকারণ আল্লাহ বলেন, مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ ‘যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল’ (নিসা ৪/৮০)। আর সেটাই হ’ল রাসূল প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য। যেমন আল্লাহ বলেন, وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلاَّ لِيُطَاعَ بِإِذْنِ اللهِ ‘আর আমরা রাসূল প্রেরণ করেছি কেবল এজন্য যে, তাদের আনুগত্য করা হবে আল্লাহর অনুমতিক্রমে (নিসা ৪/৬৪)।
একদা আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) হাদীছ শুনিয়ে বলেন, আল্লাহ লা‘নত করেছেন ঐসব মহিলাদের প্রতি, যারা অপরের অঙ্গে উল্কি করে ও নিজেদের অঙ্গে উল্কি করে। যারা (কপাল বা ভ্রুর) চুল উপড়িয়ে ফেলে এবং সৌন্দর্যের জন্য দাঁত সরু ও তার ফাঁক বড় করে। যারা আল্লাহর সৃষ্টিকে বদলিয়ে ফেলে। এ কথা বনু আসাদ গোত্রের জনৈকা মহিলা উম্মে ইয়াকূবের কর্ণগোচর হ’লে তিনি এসে ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-কে বলেন, আপনি নাকি এরূপ এরূপ কথা বলেছেন? জবাবে তিনি বলেন, আমি কেন তাকে লা‘নত করব না, যাকে আল্লাহর রাসূল লা‘নত করেছেন এবং যা আল্লাহর কিতাবে আছে? মহিলা বললেন, আমি কুরআনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েছি। কিন্তু কোথাও একথা পাইনি। ইবনু মাসঊদ বললেন, আপনি মনোযোগ দিয়ে পড়লে অবশ্যই পেতেন। আপনি কি পড়েননি যে আল্লাহ বলেছেন, ‘রাসূল তোমাদেরকে যা দেন তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন তা বর্জন কর’ (সূরা হাশর ৫৯/৭)। মহিলা বললেন, হ্যাঁ, পড়েছি। তখন তিনি বললেন, রাসূল (সাঃ) এটি নিষেধ করেছেন। এরপর মহিলাটি বললেন, সম্ভবতঃ আপনার পরিবারে এটি করা হয়। ইবনু মাসঊদ বললেন, তাহ’লে যেয়ে দেখে আসুন। অতঃপর মহিলাটি ভিতরে গেলেন। কিন্তু সেরূপ কিছু না পেয়ে ফিরে এসে বললেন, আমি কিছুই পেলাম না। তখন ইবনু মাসঊদ বললেন, এরূপ কিছু থাকলে আমরা কখনোই একত্রিত থাকতাম না (অর্থাৎ তালাক দিতাম)।[1]
বস্ত্ততঃ রাসূল (সাঃ) হ’লেন মানদন্ড। যেমন তিনি বলেন, فَمَنْ أَطَاعَ مُحَمَّدًا صلى الله عليه وسلم فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ، وَمَنْ عَصَى مُحَمَّدًا فَقَدْ عَصَى اللهَ، وَمُحَمَّدٌ فَرْقٌ بَيْنَ النَّاسِ- ‘যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল এবং যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের অবাধ্যতা করল, সে আল্লাহর অবাধ্যতা করল। মুহাম্মাদ হ’লেন মানুষের মধ্যে পার্থক্যকারী মানদন্ড’।[2] প্রখ্যাত তাবেঈ সুফিয়ান ইবনু উয়ায়না (১০৭-১৯৮ হিঃ) বলেন, الْمِيزَانُ الْأَكْبَرُ هُوَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، تُعْرَضُ الْأَشْيَاءُ كُلُّهَا عَلَيْهِ ... فَمَا وَافَقَهُ فَهُوَ حَقٌّ، وَمَا خَالَفَهُ فَهُوَ بَاطِلٌّ ‘শ্রেষ্ঠতম মানদন্ড হ’লেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)। সকল বিষয় তার উপরেই ন্যস্ত হবে।... অতঃপর যেটি তার অনুকূলে হবে, সেটি সত্য এবং যেটি তার বিরোধী হবে, সেটি মিথ্যা’।[3]
কুরআন সংক্ষিপ্ত ও মৌলিক বিধান সম্বলিত। সেকারণ তা সবার মুখস্থ এবং তা অবিরত ধারায় বর্ণিত (মুতাওয়াতির)। কিন্তু হাদীছ হ’ল শাখা-প্রশাখা সহ বিস্তারিত ব্যাখ্যা সম্বলিত। তাই কেবল শ্রোতার নিকটেই তা মুখস্থ। শ্রোতার সংখ্যা একাধিক হ’লে ও সকল যুগে বহুল প্রচারিত হ’লে তা হয় ‘মুতাওয়াতির’। যা সব হাদীছের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। কুচক্রীরা তাই সুযোগ নিয়েছিল জাল হাদীছ বানানোর। কিন্তু আল্লাহ সে চক্রান্ত নস্যাৎ করে দিয়েছেন এবং তাঁর রাসূলের হাদীছসমূহকে হেফাযত করেছেন। ইমাম মালেক, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম প্রমুখের ন্যায় অনন্য প্রতিভাধর ব্যক্তি সৃষ্টি করে আল্লাহ ছহীহ হাদীছগুলিকে পৃথক করে নিয়েছেন। ফলে জাল-যঈফের হামলা থেকে হাদীছ শাস্ত্র নিরাপদ হয়ে গেছে। পৃথিবীর কোন নবী-রাসূলের বাণী ও কর্মের হেফাযতের জন্য এমন নিখুঁত ব্যবস্থাপনা কেউ কখনো দেখেনি বা শোনেনি।
রাসূল বিদ্বেষী জার্মান প্রাচ্যবিদ ড. স্প্রেঙ্গার (১৮১৩-১৮৯৩) হাফেয ইবনু হাজারের আল-ইছাবাহ গ্রন্থ রিভিউ করে তার ভূমিকায় নিরুপায় হয়ে বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, ‘পৃথিবীতে এমন কোন জাতি অতীতে ছিল না এবং বর্তমানেও নেই, যারা মুসলমানদের ন্যায় রিজাল শাস্ত্রের অনুরূপ কোন শাস্ত্র সৃষ্টি করেছে। যার ফলে আজ প্রায় পাঁচ লক্ষ জীবন চরিত সম্পর্কে জানা যায়’ (মর্মার্থ)।[4] বলা বাহুল্য, এগুলি কেবল বর্ণনাকারী ছাহাবীদের হিসাব নয়, বরং তাঁদের নিকট থেকে যারা শুনেছেন, সেই সকল সূত্র সমূহের সামষ্টিক হিসাব হ’তে পারে। রাসূল (সাঃ)-এর হাদীছকে হেফাযতের জন্য এত বিরাট সংখ্যক মানুষের এই অতুলনীয় প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে তার জীবন্ত মো‘জেযা হওয়ার অন্যতম দলীল।
[1]. বুখারী হা/৪৮৮৬; মুসলিম হা/২১২৫; মিশকাত হা/৪৪৩১ ‘পোষাক’ অধ্যায়, ‘চুল আঁচড়ানো’ অনুচ্ছেদ।
[2]. বুখারী হা/৭২৮১; মিশকাত হা/১৪৪।
[3]. খত্বীব বাগদাদী, আল-জামে‘ লি আখলাক্বির রাবী হা/৮ (মর্মার্থ)।
[4]. সুলায়মান নাদভী, Muhammad The Ideal Prophet পৃঃ ৪০; গৃহীত : Al-Isabah, I, P. 1.
There is no nation, nor there has been any which like them has during twelve centuries recorded the life of every man of letters. If the biographical records of the Mohammadans were collected, we should probably have accounts of the lives of half a million of distinguished persons, and it would be found that there is not a decennium of their history, not a place of importance which has not its representatives. Al-Isabah, I, P. 1.
ছেড়ে যাওয়া দুই আলোকস্তম্ভ (المنارتان المتروكتان)
বিদায় হজ্জের ভাষণসমূহের এক স্থানে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, تَرَكْتُ فِيْكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوْا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ ‘আমি তোমাদের মাঝে ছেড়ে যাচ্ছি দু’টি বস্ত্ত। যতদিন তোমরা এ দু’টি বস্ত্ত অাঁকড়ে থাকবে, ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। আল্লাহর কিতাব ও তার নবীর সুন্নাহ’।[1] তিনি বলেন,الأَنْبِيَاءُ لَمْ يَرِثُوا دِينَاراً وَلاَ دِرْهَماً وَإِنَّمَا وَرَّثُوا الْعِلْمَ ‘নবীগণ কোন দীনার ও দিরহাম ছেড়ে যান না। ছেড়ে যান কেবল ইল্ম’।[2] আর শেষনবী (সাঃ)-এর ছেড়ে যাওয়া সেই ইল্ম হ’ল কুরআন ও হাদীছ। দীনার ও দিরহামের ক্ষয় আছে, লয় আছে। কিন্তু ইল্মের কোন ক্ষয় নেই লয় নেই। ইল্ম চির জীবন্ত। যে ঘরে হাদীছের পঠন-পাঠন হয়, সে ঘরে যেন স্বয়ং শেষনবী (সাঃ) কথা বলেন। যেমন ইমাম তিরমিযী স্বীয় হাদীছগ্রন্থ সম্পর্কে বলেন, مَنْ كَانَ فِي بَيْتِهِ هَذَا الْكِتَابُ فَكَأَنَّمَا فِي بَيْتِهِ نَبِيٌّ يَتَكَلَّمُ ‘যার ঘরে এই কিতাব থাকে, তার গৃহে যেন স্বয়ং নবী কথা বলেন’।[3] যিনি হাদীছ বর্ণনা করেন, স্বয়ং রাসূল (সাঃ)-এর বাণী তার মুখ দিয়ে বের হয়।
যিনি হাদীছ অনুযায়ী আমল করেন, তিনি স্বয়ং নবীর আনুগত্য করেন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি হাদীছকে অগ্রাহ্য করে, সে স্বয়ং নবীকে অগ্রাহ্য করে। আল্লাহ বলেন, فَلْيَحْذَرِ الَّذِيْنَ يُخَالِفُوْنَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيْبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيْبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ ‘অতএব যারা রাসূল-এর আদেশ-নিষেধের বিরোধিতা করবে, তারা এ বিষয়ে সাবধান হৌক যে, ফিৎনা তাদেরকে গ্রেফতার করবে এবং যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করবে’ (নূর ২৪/৬৩)। শুধু তাই নয় তার সমস্ত আমল আল্লাহর নিকটে বাতিল বলে গণ্য হবে (মুহাম্মাদ ৪৭/৩৩)। রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘জগদ্বাসীকে জান্নাতের প্রতি আল্লাহর পক্ষ হ’তে আহবানকারী (الدَّاعِى) হলেন মুহাম্মাদ! যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের আনুগত্য করল, সে ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্য করল। আর যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের অবাধ্যতা করল, সে ব্যক্তি আল্লাহর অবাধ্যতা করল। মুহাম্মাদ হলেন مُحَمَّدٌ فَرْقٌ بَيْنَ النَّاسِ ‘মানুষের মধ্যে পার্থক্যকারী মানদন্ড’।[4] রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, أَلاَ إِنِّى أُوتِيتُ الْكِتَابَ وَمِثْلَهُ مَعَهُ ‘জেনে রেখ, আমি কুরআন প্রাপ্ত হয়েছি এবং তার ন্যায় আরেকটি বস্ত্ত (অর্থাৎ হাদীছ)।[5]
عَنْ أَبِىْ رَافِعٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لاَ أُلْفِيَنَّ أَحَدَكُمْ مُتَّكِئًا عَلَى أَرِيكَتِهِ يَأْتِيْهِ الأَمْرُ مِنْ أَمْرِى مِمَّا أَمَرْتُ بِهِ أَوْ نَهَيْتُ عَنْهُ فَيَقُوْلُ لاَ أَدْرِى مَا وَجَدْنَا فِى كِتَابِ اللهِ اتَّبَعْنَاهُ ، رَوَاهُ أَحْمَدُ وَأَبُوْ دَاؤُدَ وَالتِّرْمِذِىُّ-
‘আবু রাফে‘ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহে ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, ‘আমি যেন তোমাদের কাউকে এরূপ না দেখি যে, সে তার গদীতে ঠেস দিয়ে বসে থাকবে, আর তার কাছে আমার কোন আদেশ বা নিষেধাজ্ঞা পৌঁছলে সে বলবে যে, আমি এসব কিছু জানিনা। যা আল্লাহর কিতাবে পাব, তারই আমরা অনুসরণ করব’।[6]
কুরআন ও হাদীছ হ’ল রাসূল (সাঃ)-এর রেখে যাওয়া দুই অনন্য উত্তরাধিকার, দুই জীবন্ত মু‘জেযা। যা মানবজাতির জন্য চিরন্তন মুক্তির দিশা। অতএব ইহকালে ও পরকালে সফলকাম হওয়ার জন্য সর্বাবস্থায় সেদিকেই আমাদের ফিরে যেতে হবে। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক দান করুন- আমীন!
[1]. মুওয়াত্ত্বা হা/৩৩৩৮, সনদ হাসান; মিশকাত হা/১৮৬।
[2]. আহমাদ হা/২১৭৬৩; তিরমিযী হা/২৬৮২; আবুদাঊদ হা/৩৬৪১; মিশকাত হা/২১২।
[3]. শামসুদ্দীন যাহাবী (৬৭৩-৭৪৮ হি.), তাযকেরাতুল হুফফায ২/৬৩৪ পৃঃ ক্রমিক সংখ্যা ৬৫৮; সুনান তিরমিযী, তাহকীক : আহমাদ মুহাম্মাদ শাকির (বৈরূত : ১ম সংস্করণ, ১৪০৮/১৯৮৭) পৃঃ ৩।
[4]. বুখারী হা/৭২৮১; মিশকাত হা/১৪৪।
[5]. আবুদাঊদ হা/৪৬০৪; মিশকাত হা/১৬৩।
[6]. আবুদাঊদ হা/৪৬০৫; তিরমিযী হা/২৬৬৩; মিশকাত হা/১৬২।
রাসূল চরিত পর্যালোচনা (مراجعة سيرة الرسول صــ)
সাধারণতঃ লোকেরা নবী-রাসূলগণকে ধর্মনেতা হিসাবেই ভাবতে অভ্যস্ত। যারা দুনিয়াদারী থেকে সর্বদা দূরে থাকেন ও কেবল আল্লাহর যিকরে মশগূল থাকেন। আসলে ব্যাপারটি ঠিক তা নয়। বরং তাঁরা মানুষকে তার সার্বিক জীবনে শয়তানের দাসত্ব হ’তে মুক্ত করে আল্লাহর দাসত্বে ফিরিয়ে নিতে সর্বদা প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। বিভিন্ন যুগে নবী-রসূলগণ যে নির্যাতিত হয়েছেন, তা ছিল মূলতঃ তাদের আনীত ধর্ম বিশ্বাসের সাথে মানুষের মনগড়া ধারণা ও রীতি-নীতি সমূহের মধ্যে বিরোধ হওয়ার কারণেই। তবে হযরত মূসা (আঃ)-এর সঙ্গে ফেরাঊনের সংঘর্ষ ধর্মবিশ্বাসগত হওয়া ছাড়াও নির্যাতিত বনু ইস্রাঈলদের মুক্তির মত রাজনৈতিক বিষয়টিও জড়িত ছিল। কেননা বনু ইস্রাঈলকে ফেরাঊনের গোত্র ক্বিবতীরা দাস-দাসী হিসাবে ব্যবহার করত এবং তাদের উপরে অমানুষিক নির্যাতন চালাত। মূসা (আঃ) তাদেরকে ফেরাঊনের কবল থেকে মুক্ত করে তাদের আদি বাসস্থান শামে ফেরৎ নিতে চেয়েছিলেন। হযরত ঈসা (আঃ)-এর দাওয়াতের মধ্যে রাজনীতির নাম-গন্ধ না থাকলেও সমসাময়িক রাজা তাঁর জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে এবং ইহূদীদের চক্রান্তে তাঁকে হত্যা করার প্রয়াস চালান। কেননা ইহূদীরা হযরত ঈসা (আঃ)-কে নবী হিসাবে মানেনি। উপরন্তু তাওরাতের কিছু বিধান পরিবর্তন করায় তারা তাঁর ঘোর দুশমন ছিল। ফলে আল্লাহ ঈসা (আঃ)-কে আসমানে জীবিত উঠিয়ে নেন (আলে ইমরান ৩/৫৫; নিসা ৪/১৫৭)।
পক্ষান্তরে শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ) দুনিয়াতে প্রেরিত হয়েছিলেন মানবজাতির জন্য উসওয়ায়ে হাসানাহ বা ‘সর্বোত্তম নমুনা’ হিসাবে (আহযাব ৩৩/২১)। সেকারণ মানবজীবনে প্রয়োজনীয় সকল কল্যাণকর বিষয়ে সর্বোত্তম আদর্শ হিসাবে আল্লাহ তাঁকে প্রেরণ করেন। ফলে তিনি একাধারে ধর্মনেতা, রাজনৈতিক নেতা, সমাজনেতা, অর্থনৈতিক বিধানদাতা, সমরনেতা, বিচারপতি এবং বিচার বিভাগীয় নীতি ও দর্শনদাতা- এক কথায় বিশ্ব পরিচালনার সামগ্রিক পথপ্রদর্শক হিসাবে আল্লাহ তাঁকে প্রেরণ করেছিলেন এবং সেটা তিনি বাস্তবে দেখিয়ে গিয়েছিলেন। সেদিক দিয়ে বিচার করলে মুহাম্মাদ (সাঃ) বিগত সকল নবী থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, গুণাবলী ও বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।
একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তি নিয়মিত তাহাজ্জুদগোযার এবং নফল ছিয়াম ও ই‘তিকাফকারী রাসূলকে পাবেন শ্রেষ্ঠতম আধ্যাত্মিক নেতা হিসাবে। আগে-পিছে সব গোনাহ মাফ হওয়া সত্ত্বেও নৈশ ইবাদতে মগ্ন থাকা ও ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, أَفَلاَ أَكُوْنُ عَبْدًا شَكُوْرًا؟ ‘আমি কি একজন কৃতজ্ঞ বান্দা হব না’?[1] একজন রাজনীতিক তার পথ খুঁজে পাবেন হোদায়বিয়ার সন্ধিতে ও মক্কা বিজয়ী রাসূল (সাঃ)-এর কুশাগ্রবুদ্ধি ও দূরদর্শী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মধ্যে। একজন অকুতোভয় সেনাপতি তার আদর্শ দেখতে পাবেন বদর-খন্দক-হোনায়েন বিজেতা সেনাপতি মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর সমর কুশলতার মধ্যে। একজন সমাজনেতা তার আদর্শ খুঁজে পাবেন মক্কা ও মদীনার কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ সংশোধনে দক্ষ সমাজনেতা মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর মধ্যে। একজন বিচারপতি তার আদর্শ খুঁজে পাবেন আল্লাহর দন্ডবিধিসমূহ বাস্তবায়নে দৃঢ়চিত্ত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নিরপেক্ষ বিচারের মধ্যে। যিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّمَا أَهْلَكَ الَّذِينَ قَبْلَكُمْ أَنَّهُمْ كَانُوا إِذَا سَرَقَ فِيهِمُ الشَّرِيفُ تَرَكُوهُ وَإِذَا سَرَقَ فِيهِمُ الضَّعِيفُ أَقَامُوا عَلَيْهِ الْحَدَّ وَايْمُ اللهِ لَوْ أَنَّ فَاطِمَةَ بِنْتَ مُحَمَّدٍ سَرَقَتْ لَقَطَعْتُ يَدَهَا ‘হে জনগণ! তোমাদের পূর্বেকার উম্মতেরা ধ্বংস হয়েছে এ কারণে যে, তাদের মধ্যে উঁচু শ্রেণীর কোন লোক চুরি করলে তারা তাকে ছেড়ে দিত এবং দুর্বল শ্রেণীর কেউ চুরি করলে তার উপরে দন্ডবিধি প্রয়োগ করত। আল্লাহর কসম! যদি মুহাম্মাদের কন্যা ফাতেমাও চুরি করে, আমি অবশ্যই তার হাত কেটে দেব’।[2]
এমনিভাবে মানবজীবনের সকল দিক ও বিভাগে একজন পূর্ণাঙ্গ আদর্শের মানুষ হিসাবে তাঁকে আমরা দেখতে পাই। অতএব জীবনের কোন একটি বা দু’টি বিভাগে রাসূল (সাঃ)-কে আদর্শ মেনে অন্য বিভাগে অন্য কোন মানুষকে আদর্শ মানলে পূর্ণ মুমিন হওয়া যাবে না। পরকালে জান্নাতও আশা করা যাবে না। মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর জীবনচরিত তাই একজন কল্যাণকামী সমাজনেতার জন্য আদর্শ জীবনচরিত। যা যুগে যুগে মানবজাতিকে সত্য ও ন্যায়ের আলোকস্তম্ভ রূপে পথ দেখাবে। মযলূম মানবতাকে যালেমদের হাত থেকে মুক্তির দিশা দিবে।
মুহাম্মাদ (সাঃ) অস্ত্র নিয়ে ময়দানে আসেননি। এসেছিলেন একটি অভ্রান্ত আদর্শ নিয়ে। যার মাধ্যমে তিনি মানুষের ভ্রান্ত আক্বীদা ও কপোল-কল্পিত ধারণা-বিশ্বাসে পরিবর্তন এনেছিলেন। আর তাতেই সৃষ্টি হয়েছিল সর্বাত্মক সমাজ বিপ্লব। দুনিয়াপূজারী মানুষকে তিনি আল্লাহ ও আখেরাতে দৃঢ় বিশ্বাসী করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত বিশ্বাসের ভিত্তিতে তিনি সমাজের আমূল পরিবর্তনে সক্ষম হয়েছিলেন। আজও যদি সেই দৃঢ় বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা যায়, তাহ’লে আবারো সেই হারানো মানবতা ও হারানো ইসলামী খেলাফত ফিরে পাওয়া সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন একদল যিন্দাদিল নিবেদিত প্রাণ মুর্দে মুমিন। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন- আমীন!
[1]. বুখারী হা/১১৩০, মুসলিম হা/২৮১৯-২০; মিশকাত হা/১২২০ ‘ছালাত’ অধ্যায়, ‘রাত্রি জাগরণে উৎসাহ প্রদান’ অনুচ্ছেদ-৩৩।
[2]. মুসলিম হা/১৬৮৮; বুখারী হা/৬৭৮৭-৮৮; মিশকাত হা/৩৬১০ ‘দন্ড হ্রাসে সুফারিশ’ অনুচ্ছেদ।
পরিশিষ্ট-১ - ১. অহি লেখকগণ (كتّاب الوحى)
যায়েদ বিন ছাবিত (রাঃ) ছিলেন অহি লেখকগণের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য। সেকারণ কুরআন জমা করার সময় ওছমান (রাঃ) তাঁকেই এ গুরুদায়িত্ব প্রদান করেন (বুখারী হা/৪৬৭৯, ৪৯৭৯)। তিনি ব্যতীত আরও অনেক ছাহাবী বিভিন্ন সময়ে এ মহান দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছেন।
ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, অহি নাযিলের শুরু থেকে মক্কায় অহি লেখকদের মধ্যে সর্বপ্রথম ছিলেন ওছমান (রাঃ)-এর দুধভাই (১) আব্দুল্লাহ বিন সা‘দ বিন আবু সারাহ। ইনি পরে ‘মুরতাদ’ হয়ে যান। অতঃপর মক্কা বিজয়ের দিন পুনরায় মুসলমান হন। অতঃপর বিভিন্ন সময়ে অহি লেখক ছিলেন (২) আবুবকর (৩) ওমর (৪) ওছমান (৫) আলী (৬) যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম (৭) খালেদ বিন সাঈদ ইবনুল ‘আছ ও তাঁর ভাই (৮) আবান বিন সাঈদ ইবনুল ‘আছ (৯) হানযালা বিন রবী‘ আসাদী (১০) মু‘আইক্বীব বিন আবু ফাতেমা দাওসী (১১) আব্দুল্লাহ বিন আরক্বাম যুহরী (১২) শুরাহবীল বিন হাসানাহ কুরায়শী (১৩) আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা আনছারী।
মদীনায় প্রথম অহি লেখক ছিলেন (১৪) উবাই বিন কা‘ব। অতঃপর (১৫) যায়েদ বিন ছাবিত। তিনি অনুপস্থিত থাকলে অন্যেরা লিখতেন’ (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম)।[1] (১৬) এছাড়া বনু নাজ্জারের জনৈক ব্যক্তি, যে খ্রিষ্টান হয়ে যায়। অতঃপর মুসলমান হন।[2]
[1]. ফাৎহুল বারী হা/৪৯৯০-এর পূর্বে ‘নবী (সাঃ)-এর লেখক’ অনুচ্ছেদ, ৯/২২ পৃঃ।
[2]. বুখারী হা/৩৬১৭; মুসলিম হা/২৭৮১।
পরিশিষ্ট-১ - ২. অন্যান্য বিষয়ে লেখকগণ (كتّاب النبى صـ فى أمور أخرى)
(১) আবু সালামাহ মাখযূমী (২) আরক্বাম বিন আবুল আরক্বাম (৩) ‘আমের বিন ফুহায়রাহ (৪) ত্বালহা বিন ওবায়দুল্লাহ (৫) হাত্বেব বিন ‘আমর আবু বালতা‘আহ (৬) আব্দুল্লাহ বিন আবুবকর (৭) আবু আইয়ূব আনছারী (৮) বুরায়দাহ বিন হুছাইব আসলামী (৯) হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (১০) মু‘আয বিন জাবাল (১১) জনৈক আনছার আবু ইয়াযীদ (১২) ছাবেত বিন ক্বায়েস বিন শাম্মাস (১৩) আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ বিন ‘আব্দে রবিবহি (১৪) মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ (১৫) আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল্লাহ বিন উবাই (১৬) খালেদ বিন অলীদ (১৭) ‘আমর ইবনুল ‘আছ (১৮) মুগীরাহ বিন শো‘বা ছাক্বাফী (১৯) জুহাম বিন সা‘দ (২০) জুহাইম বিন ছালত (২১) হুছায়েন বিন নুমায়ের (২২) হুয়াইত্বিব বিন আব্দুল ‘উযযা (২৩) সাঈদ বিন সাঈদ ইবনুল ‘আছ (২৪) জা‘ফর বিন আবু ত্বালিব (২৫) হানযালা বিন রবী‘ ও তার ভাই (২৬) রাবাহ ও চাচা (২৭) আকছাম বিন ছায়ফী তামীমী (২৮) ‘আলা ইবনুল হাযরামী (২৯) ‘আলা বিন উক্ববাহ (৩০) আববাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব (৩১) আবু সুফিয়ান বিন হারব (৩২) ঐ পুত্র ইয়াযীদ বিন আবু সুফিয়ান ও (৩৩) মু‘আবিয়া বিন আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম।[1] এতদ্ব্যতীত (৩৪) আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল ‘আছ যিনি হাদীছ লিখনে প্রসিদ্ধ ছিলেন।
লেখকগণের মধ্যে মদীনায় যাঁরা বিশেষ বিশেষ কাজে প্রসিদ্ধ ছিলেন তাঁরা হ’লেন, (১) অহি লিখনে আলী, ওছমান, উবাই বিন কা‘ব এবং যায়েদ বিন ছাবেত। (২) বাদশাহ ও আমীরদের নিকটে পত্র লিখনে যায়েদ বিন ছাবেত। (৩) চুক্তি লিখনে আলী ইবনু আবী তালেব। (৪) মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজন সমূহ লিখনে মুগীরাহ বিন শো‘বা। (৫) ঋণচুক্তিসমূহ লিখনে আব্দুল্লাহ বিন আরক্বাম। (৬) গণীমতসমূহ নিবন্ধনে মু‘আইকীব। কোন লেখক অনুপস্থিত থাকলে হানযালা বিন রবী‘ লেখকের দায়িত্ব পালন করতেন। সেজন্য তিনি হানযালা আল-কাতেব নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন।[2]
এঁদের মধ্যে (১) খালেদ বিন সাঈদ ছিলেন আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ)-এর পরে ইসলাম কবুলকারী ৩য়, ৪র্থ অথবা ৫ম ব্যক্তি। কারণ হিসাবে বর্ণিত হয়েছে যে, একদিন তিনি স্বপ্নে দেখেন যে, তিনি জাহান্নামের কিনারে দাঁড়িয়ে আছেন। তার পিতা তাকে সেদিকে ঠেলে দিচ্ছেন। পক্ষান্তরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার হাত টেনে ধরেছেন, যাতে তিনি জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত না হন। পরদিন এ স্বপ্ন আবুবকর (রাঃ)-কে বললে তিনি বলেন, এটি শুভ স্বপ্ন। ইনিই আল্লাহর রাসূল। অতএব তুমি তাঁর অনুসরণ কর। তাহ’লে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে। যার ভয় তুমি করছ’। অতঃপর তিনি রাসূল (সাঃ)-এর নিকট আসেন ও ইসলাম কবুল করেন। এ খবর জানতে পেরে তার পিতা তাকে লাঠিপেটা করেন, খানা-পিনা বন্ধ করে দেন ও তাকে বাড়ী থেকে বের করে দেন। পরবর্তীতে তিনি হাবশায় হিজরত করেন। অতঃপর হাবশা থেকে জা‘ফরের সাথে খায়বরে আসেন ও রাসূল (সাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি ত্বায়েফবাসীদের সাথে সন্ধির সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। পরে সেখান থেকে আগত ছাক্বীফ প্রতিনিধি দলের সাথে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পক্ষে চুক্তিনামা লিপিবদ্ধ করেন। আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ)-এর খেলাফতকালে তিনি শামের আজনাদাইন যুদ্ধে শহীদ হন।
(২) ‘আমের বিন ফুহায়রা আবুবকর (রাঃ)-এর মুক্তদাস ছিলেন। হিজরতকালে তিনি রাসূল (সাঃ)-এর সাথী ছিলেন। পথিমধ্যে পিছু ধাওয়াকারী সুরাক্বাহ বিন মালেক মুদলেজী-কে রাসূল (সাঃ)-এর নির্দেশে তিনি একটি ‘নিরাপত্তানামা’ (كِتَابُ أَمْنٍ) লিখে দেন। ৪র্থ হিজরীতে বি’রে মাঊনা-র মর্মান্তিক ঘটনায় তিনি শহীদ হন।
(৩) আরক্বাম বিন আবুল আরক্বাম মাখযূমী (রাঃ) প্রথম দিকের ৭ম বা ১০ম মুসলমান ছিলেন। ছাফা পাহাড়ে তাঁর গৃহে রাসূল (সাঃ) ইসলামের প্রচার কেন্দ্র স্থাপন করেন। যা ‘দারুল আরক্বাম’ (دَارُ الْأَرْقَمِ) নামে পরিচিত হয়। তিনি ৫৩ অথবা ৫৫ হিজরীতে ৮৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন (আল-ইছবাহ, আরক্বাম ক্রমিক ৭৩)।
(৪) আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ বিন ‘আব্দে রবিবহী বায়‘আতে কুবরা-য় শরীক ছিলেন। তাঁর সবচেয়ে উচ্চ মর্যাদা ছিল এই যে, তিনিই প্রথম আযানের স্বপ্ন দেখেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে ‘সত্যস্বপ্ন’ (إِنَّهَا لَرُؤْيَا حَقٌّ) বলে আখ্যায়িত করেন এবং আল্লাহর প্রশংসা জ্ঞাপন করে বলেন, ফালিল্লাহিল হাম্দ(فََلِلَّهِ الْحَمْدُ) । অতঃপর বেলালের মাধ্যমে তা চালু করে দেন (আবুদাঊদ হা/৪৯৯)। তিনি ৩২ হিজরীতে ৬৪ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। খলীফা ওছমান (রাঃ) স্বয়ং তাঁর জানাযায় ইমামতি করেন (আল-ইছাবাহ, আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ ক্রমিক ৪৬৮৯)।
(৫) আব্দুল্লাহ সা‘দ বিন আবু সারাহ ওছমান বিন ‘আফফান (রাঃ)-এর দুধভাই ছিলেন। ওছমানের মা তাঁকে দুধ পান করিয়েছিলেন। তিনি অহি লিখতেন। কিন্তু পরে ‘মুরতাদ’ হয়ে যান। মক্কা বিজয়ের দিন রাসূল (সাঃ) যাদের রক্ত বৃথা ঘোষণা করেন, তিনি ছিলেন তাদের অন্তর্ভুক্ত। পরে তিনি ওছমান (রাঃ)-এর নিকটে এসে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। ফলে রাসূল (সাঃ) তাকে আশ্রয় দেন। এরপর থেকে মৃত্যু অবধি তাঁর ইসলাম খুবই সুন্দর ছিল। ওছমান (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ২৫ হিজরীতে তাঁকে মিসরের গবর্ণর নিযুক্ত করা হয় এবং আফ্রিকা জয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়। অতঃপর তাঁর আমলেই আফ্রিকা বিজিত হয়। উক্ত যুদ্ধে বিখ্যাত তিন ‘আবাদেলাহ’ অর্থাৎ আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের, আব্দুল্লাহ বিন ওমর এবং আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর যোগদান করেন। ৩৫ হিজরীতে ওছমান (রাঃ)-এর শাহাদাতকালে তিনি মিসরের ‘আসক্বালান’ শহরে ছিলেন। তিনি আল্লাহর নিকট দো‘আ করেন যেন ছালাতরত অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। অতঃপর একদিন ফজরের ছালাত আদায়কালে শেষ বৈঠকে প্রথম সালাম ফিরানোর পর দ্বিতীয় সালাম ফিরানোর আগেই তাঁর মৃত্যু হয়ে যায়। এটি ছিল ৩৬ অথবা ৩৭ হিজরীর ঘটনা।[3]
(৬) উবাই বিন কা‘ব আনছারী (রাঃ) বায়‘আতে কুবরা এবং বদর-ওহোদ সহ সকল যুদ্ধে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন সাত জন শ্রেষ্ঠ ক্বারীর নেতা। আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উবাই বিন কা‘বকে বললেন, إِنَّ اللهَ أَمَرَنِىْ أَنْ أَقْرَأَ عَلَيْكَ (لَمْ يَكُنِ الَّذِينَ كَفَرُوْا) قَالَ وَسَمَّانِىْ لَكَ؟ قَالَ: نَعَمْ، فَبَكَى ‘আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন আমি তোমার উপরে সূরা বাইয়েনাহ পাঠ করি। উবাই বললেন, আল্লাহ আপনার নিকটে আমার নাম বলেছেন? রাসূল (সাঃ) বললেন, হ্যাঁ। তখন উবাই (খুশীতে) কাঁদতে লাগলেন’।[4] তিনিই প্রথম রাসূল (সাঃ)-এর অহি লেখক ছিলেন এবং অন্যতম ফৎওয়া দানকারী ছাহাবী ছিলেন। অধিকাংশের মতে তিনি ওমর (রাঃ)-এর খিলাফতকালে ২২ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে ওমর (রাঃ) বলেন, আজ মুসলমানদের নেতা মৃত্যুবরণ করল (আল-ইছাবাহ, উবাই ক্রমিক ৩২)।
(৭) যায়েদ বিন ছাবেত আনছারী (রাঃ) বয়স কম থাকায় বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণে ব্যর্থ হন। এরপর থেকে সকল যুদ্ধে রাসূল (সাঃ)-এর সাথী ছিলেন। তিনি অহি লিখতেন এবং শিক্ষিত ছাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন (مِنْ عُلَمَاءِ الصَّحَابَةِ)। আবুবকর (রাঃ)-এর সময় কুরআন সংকলনের দায়িত্ব তাঁর উপরেই প্রদান করা হয়। হিজরতের পর রাসূল (সাঃ)-এর নিকট বনু নাজ্জারের এই তরুণকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হ’লে তিনি তাঁকে কুরআনের ১৭টি সূরা মুখস্থ শুনিয়ে দেন। তাতে বিস্মিত হয়ে রাসূল (সাঃ) বলেন, তুমি ইহূদীদের পত্র পাঠ করা শিখ। তখন আমি ১৫ দিনের মধ্যেই ইহূদীদের ভাষা শিখে ফেলি। অতঃপর রাসূল (সাঃ)-এর পক্ষ থেকে তাদের নিকট আমি পত্র লিখতাম এবং তারা লিখলে আমি তাঁকে তা পড়ে শুনাতাম’ (আল-ইছাবাহ, যায়েদ বিন ছাবেত ক্রমিক ২৮৮২)।
(৮) আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর ইবনুল ‘আছ সাহমী কুরায়শী (রাঃ) অত্যন্ত ‘আবেদ ও যাহেদ ছাহাবী ছিলেন। রাসূল (সাঃ) এই তরুণ ছাহাবীকে একদিন অন্তর একদিন ছিয়াম রাখার ও সাতদিনে বা সর্বনিম্নে তিনদিনে কুরআন খতম করার অনুমতি দেন (বুখারী হা/৫০৫২)। তিনি রাসূল (সাঃ)-এর হাদীছসমূহ লিপিবদ্ধ করতেন। তিনি বলেন, আমি নিয়মিত হাদীছ লিখতাম। তাতে কুরায়েশরা আমাকে নিষেধ করে এবং বলে যে, তুমি সব কথা লিখ না। কেননা রাসূল (সাঃ) একজন মানুষ। তিনি ক্রোধের সময় ও খুশীর সময় কথা বলেন। তখন আমি লেখা বন্ধ করি এবং রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে উক্ত বিষয়টি উত্থাপন করি। জবাবে রাসূল (সাঃ) বলেন, اكْتُبْ فَوَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ مَا خَرَجَ مِنِّى إِلاَّ حَقٌّ ‘তুমি লেখ। যার হাতে আমার জীবন তার কসম করে বলছি, আমার থেকে হক ব্যতীত কিছুই বের হয় না’ (আহমাদ হা/৬৫১০, হাদীছ ছহীহ)। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, مَا أَجِدُ مِنْ أَصْحَابِ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه و سلم أَكْثَرَ حَدِيْثًا مِنِّي إِلاَّ مَا كَانَ مِنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو فَإِنَّهُ كَانَ يَكْتُبُ ‘রাসূল (সাঃ)-এর ছাহাবীগণের মধ্যে আমি আমার চাইতে অধিক হাদীছ বর্ণনাকারী কাউকে পাইনি আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর ব্যতীত। কেননা তিনি হাদীছ লিখতেন’। তিনি ৬৫ হিজরীতে ৭২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর স্থান নিয়ে মতভেদ আছে। কেউ বলেছেন শামে বা ত্বায়েফে বা মিসরে বা মক্কায়’ (আল-ইছাবাহ, আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর ক্রমিক ৪৮৫০)। তাঁর লিখিত হাদীছের সংখ্যা অন্যূন সাতশত।
(৯) অনুরূপভাবে বনু নাজ্জারের জনৈক ব্যক্তি খ্রিষ্টান হয়ে যায়। পরে সে মুসলমান হয়ে ‘অহি’ লেখার দায়িত্ব পায়। অতঃপর সে পালিয়ে গিয়ে পুনরায় খ্রিষ্টান হয়ে যায় এবং অপবাদ দেয় যে, মুহাম্মাদ সেটুকুই জানে, যতটুকু আমি লিখি (مَا يَدْرِى مُحَمَّدٌ إِلاَّ مَا كَتَبْتُ لَهُ)। পরে আল্লাহ তাকে মৃত্যু দান করেন। লোকেরা তাকে দাফন করে। কিন্তু সকালে দেখা গেল যে, মাটি তাকে উগরে ফেলে দিয়েছে। তখন লোকেরা বলল, এসব মুহাম্মাদ ও তাঁর সাথীদের কাজ। অতঃপর তারা খুব গভীর করে তাকে দাফন করল। কিন্তু পরদিন সকালে একইভাবে নিক্ষিপ্ত অবস্থায় তাকে পাওয়া গেল। তখন লোকেরা বলল, এটি মানুষের কাজ নয়। অতঃপর তারা তাকে ফেলে রাখল’ (বুখারী হা/৩৬১৭)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, সে বলেছিল, আমি মুহাম্মাদের চাইতে বেশী জানি। আমি চাইলে এরূপ লিখতে পারি’(أَنَا أَعْلَمُكُمْ بِمُحَمَّدٍ إِنْ كُنْتُ لأَكْتُبُ مَا شِئْتُ)। অতঃপর সে মৃত্যুবরণ করে। তার উপরোক্ত কথা জানতে পেরে রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘মাটি তাকে কখনই কবুল করবে না’ (إِنَّ الأَرْضَ لَنْ تَقْبَلَهُ)। রাবী আনাস (রাঃ) বলেন, আবু ত্বালহা (রাঃ) আমাকে বলেছেন যে, আমি তার মৃত্যুর স্থানে গিয়ে দেখি যে, তার লাশ মাটির উপরে পড়ে আছে। তিনি লোকদের জিজ্ঞেস করলেন। তারা বলল, আমরা তাকে বারবার দাফন করেছি। কিন্তু মাটি তাকে বারবার উপরে ফেলে দিয়েছে’।[5]
[1]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৫/৩৩৯-৩৫৫; মুছত্বফা আ‘যামী, কুত্তাবুন নবী (বৈরূত : ১৩৯৮/১৯৭৮ খৃঃ)।
[2]. মাহমূদ শাকের, আত-তারীখুল ইসলামী (বৈরূত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, তাবি) ২/৩৫৫ পৃঃ।
[3]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৫/৩৩৯-৩৫৫, ‘অহি লেখকগণ’ অনুচ্ছেদ।
[4]. বুখারী হা/৪৯৫৯, মুসলিম হা/৭৯৯; মিশকাত হা/২১৯৬।
[5]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৭৪৪; আহমাদ হা/১২২৩৬, সনদ ছহীহ। মিশকাত হা/৫৮৯৮ ‘মু‘জিযা সমূহ’ অনুচ্ছেদ। মিশকাতে বর্ণিত হাদীছে তার মুরতাদ হওয়ার খবর শুনে রাসূল (সাঃ) ‘মাটি তাকে কবুল করবে না’ (إن الأرض لا تقبله) বলেন। অতঃপর শেষে ‘মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ’ লেখা হয়েছে। কিন্তু বুখারী ও মুসলিমে কোথাও উক্ত বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বরং তার মৃত্যুর পরে তিনি বলেছিলেনإِنَّ الأَرْضَ لَنْ تَقْبَلَهُ (ছহীহ ইবনু হিববান হা/৭৪৪) অথবা إِنَّ الأَرْضَ لَمْ تَقْبَلَهُ (আহমাদ হা/১২২৩৬)।
পরিশিষ্ট-১ - ৩. মুক্তদাস ও দাসীগণ (موالى النبى صــ وإمائه)
ইমাম নববী বলেন, বিভিন্ন সময়ে রাসূল (সাঃ)-এর মোট ৫০ জন গোলাম ছিল। যেমন, (১) যায়েদ বিন হারেছাহ (২) ছাওবান বিন বুজদুদ (ثوبان بن بجدد) (৩) আবু কাবশাহ সুলায়েম। ইনি বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। (৪) বাযাম (৫) রুওয়াইফে‘ (৬) ক্বাছীর (৭) মায়মূন (৮) আবু বাকরাহ (৯) হুরমুয (১০) আবু ছাফিইয়াহ উবায়েদ (১১) আবু সালমা (১২) আনাসাহ (১৩) ছালেহ (১৪) শুক্বরান (১৫) রাবাহ (১৬) আসওয়াদ আন-নূবী (১৭) ইয়াসার আর-রা‘ঈ (১৮) আবু রাফে‘ আসলাম (১৯) আবু লাহছাহ (أبو لهثة)। (২০) ফাযালাহ ইয়ামানী (২১) রাফে‘ (২২) মিদ‘আম (২৩) আসওয়াদ (২৪) কিরকিরাহ (২৫) যায়েদ, যিনি হেলাল বিন ইয়াসার-এর দাদা ছিলেন। (২৬) ওবায়দাহ (২৭) ত্বাহমান (অথবা কায়সান, মিহরান, যাকওয়ান, মারওয়ান)। (২৮) মা’বূর আল-ক্বিবত্বী (২৯) ওয়াক্বেদ (৩০) আবু ওয়াক্বেদ (৩১) হিশাম (৩২) আবু যুমাইরাহ (৩৩) হোনায়েন (৩৪) আবু ‘আসীব আহমার (৩৫) আবু ওবায়দাহ (৩৬) মিহরান ওরফে সাফীনাহ (৩৭) সালমান ফারেসী (৩৮) আয়মান বিন উম্মে আয়মান (৩৯) আফলাহ (৪০) সাবেক্ব (৪১) সালেম (৪২) যায়েদ বিন বূলা (زيد بن بولا)। (৪৩) সাঈদ (৪৪) যুমাইরাহ বিন আবু যুমাইরাহ (ضُمَيرة بن أبى ضميرة) (৪৫) ওবায়দুল্লাহ বিন আসলাম (৪৬) নাফে‘ (৪৭) নাবীল (৪৮) ওয়ারদান (৪৯) আবু উছাইলাহ (أبو أثيلة)। (৫০) আবুল হামরা রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম।
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) আরও কয়েকজন মুক্তদাসের নাম বলেছেন। যেমন (১) আনজাশাহ (২) সানদার (سندر) (৩) ক্বাসাম (قسام) (৪) আবু মুওয়াইহিবাহ (যাদুল মা‘আদ ১/১১১-১৩)।
মুক্তদাসী ছিল ১২ জন। যেমন, (১) সালমা (২) উম্মে রাফে‘ (৩) উম্মে আয়মান বারাকাহ (৪) মায়মূনাহ বিনতে সাঈদ (৫) খাযেরাহ (خَضِرَةُ)। (৬) রাযওয়া (رَضْوَى)। (৭) উমাইমাহ (৮) রায়হানা (৯) উম্মে যুমাইরাহ (১০) মারিয়াহ বিনতে শাম‘ঊন আল-ক্বিবত্বিয়াহ (১১) তার বোন শীরীন (১২) উম্মে আববাস। এরা কেউ একসঙ্গে ছিলেন না। বরং বিভিন্ন সময়ে ছিলেন।[1] ইবনুল ক্বাইয়িম আর একজনের নাম বলেছেন, রাযীনাহ (رَزِينَةُ) (যাদুল মা‘আদ ১/১১৩)।
মারিয়াহ ও শীরীন দুই বোনকে মিসর রাজ মুক্বাউক্বিস রাসূল (সাঃ)-এর জন্য উপঢৌকন হিসাবে প্রেরণ করেন। পরে রাসূল (সাঃ) মারিয়াকে রাখেন ও শীরীনকে হাসসান বিন ছাবিত আনছারী-কে হাদিয়া দেন। মারিয়ার গর্ভে রাসূল (সাঃ)-এর শেষ সন্তান ইবরাহীমের জন্ম হয় ও শীরীন-এর গর্ভে আব্দুর রহমান বিন হাসসান-এর জন্ম হয় (আল-বিদায়াহ ৫/৩০৭-০৮)।
[1]. ইমাম নববী (৬৩১-৬৭৬ হি.), তাহযীবুল আসমা ওয়াল লুগাত, তাহকীক : মুছত্বফা আব্দুল ক্বাদের ‘আত্বা ১/৩৮-৩৯ পৃঃ; যাদুল মা‘আদ ১/১১১-১৩।
পরিশিষ্ট-১ - ৪. খাদেমগণ (مخدام النبى صــ)
(১) আনাস বিন মালেক (২) হিন্দ ও তার ভাই (৩) আসমা বিন হারেছাহ আসলামী (৪) রাবী‘আহ বিন কা‘ব আসলামী (৫) আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ। ইনি রাসূল (সাঃ)-এর জুতা ও মিসওয়াক বহন করতেন। যখনই তিনি উঠতেন জুতা পরিয়ে দিতেন এবং যখনই তিনি বসতেন জুতা জোড়া খুলে নিজ হাতে নিয়ে নিতেন। (৬) ওক্ববাহ বিন ‘আমের আল-জুহানী। সফরকালে তাঁর খচ্চর চালনা করতেন। (৭) বেলাল বিন রাবাহ, মুওয়াযযিন (৮) সা‘দ। দু’জনেই ছিলেন আবুবকর ছিদ্দীক-এর মুক্তদাস। (৯) বাদশাহ নাজাশীর ভাতিজা যূ-মিখমার। যাকে রাসূল (সাঃ)-এর খিদমতের জন্য ৭ম হিজরীতে বাদশাহ পাঠিয়েছিলেন। (১০) বুকায়ের বিন সারাহ লায়ছী (১১) আবু যার গিফারী (১২) আসলা‘ বিন শারীক আ‘রাজী। সওয়ারী পালন করতেন। (১৩) মুহাজির। উম্মে সালামাহ (রাঃ)-এর মুক্তদাস। (১৪) আবুস সাজা‘ (أبو السجع) রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম (টীকা-পূর্বোক্ত)।
(১৫) এছাড়া একটি ইহূদী বালক তাঁর খাদেম ছিল। যে তাঁর ওযূর পানি ও জুতা এগিয়ে দিত। হঠাৎ সে অসুস্থ হয়ে পড়লে রাসূল (সাঃ) তাকে দেখতে যান। তার আসন্ন মৃত্যু বুঝতে পেরে তিনি তাকে ইসলাম কবুলের দাওয়াত দেন। সে তার পিতার দিকে তাকালে পিতা তাকে বললেন, أَطِعْ أَبَا الْقَاسِمِ ‘তুমি আবুল ক্বাসেমের আনুগত্য কর’। তখন ছেলেটি কালেমা শাহাদাত পড়ে ইসলাম কবুল করল। অতঃপর মারা গেল। তখন রাসূল (সাঃ) বেরিয়ে আসার সময় বললেন, الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِى أَنْقَذَهُ بِى مِنَ النَّارِ ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি আমার মাধ্যমে ছেলেটিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিলেন’।[1]
[1]. আহমাদ হা/১২৮১৫,১৩৩৯৯; আবুদাঊদ হা/৩০৯৫; বুখারী হা/১৩৫৬; মিশকাত হা/১৫৭৪।
পরিশিষ্ট-১ - ৫. উট, ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা(من دوابة صــ)
উট (الإبل) : (১) ‘ক্বাছওয়া’ (الْقَصْوَاءُ)। যাতে সওয়ার হয়ে তিনি মক্কা বিজয়ের সফরে গমন করেন এবং হজ্জের সময় আরাফাতের ময়দানে ভাষণ দেন (বুখারী হা/৪৪০০; তিরমিযী হা/৩৭৮৬)। (২) ‘আযবা’ (الْعَضْبَاءُ) ও (৩) ‘জাদ‘আ’(الْجَدْعَاءُ) নামে তাঁর আরও দু’টি উষ্ট্রী ছিল। ‘আযবা’ ছিল অত্যন্ত দ্রুতগামী। যাকে কেউ হারাতে পারত না । একবার জনৈক বেদুঈন সওয়ারী আযবা-কে অতিক্রম করে গেলে রাসূল (সাঃ) সাথীদের সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘দুনিয়াতে আল্লাহর নীতি এটাই যে, কাউকে উঁচু করলে তাকে নীচুও করে থাকেন’ (বুখারী হা/৬৫০১)। বিদায় হজ্জে ঈদুল আযহার দিন এর পিঠে বসে তিনি কংকর মারেন। অতঃপর ভাষণ দেন।[1] জাদ‘আ (الْجَدْعَاءُ) হিজরতের সময় আবুবকর (রাঃ) তাঁকে প্রদান করেন (বুখারী হা/৪০৯৩)। আইয়ামে তাশরীক্বের সময় এর পিঠে সওয়ার হয়ে তিনি ভাষণ দেন।[2] (৪) আরেকটি অত্যন্ত দ্রুতগামী উট ছিল। যাকে কেউ অতিক্রম করতে পারত না। যা তিনি বদরের যুদ্ধে নিহত আবু জাহলের গণীমত হিসাবে পেয়েছিলেন। যার নাকে রূপার নোলক ছিল। এটাকে তিনি হোদায়বিয়ার দিন নহর করেন মুশরিকদের ক্রুদ্ধ করার জন্য’।[3]
ঘোড়া (الخيل) : তাঁর ঘোড়া ছিল ৭টি। (১) ‘সাক্ব’ (السَّكْبُ)। যার রং ছিল কালো ও কপালচিতা। (২) ‘মুরতাজিয’ (الْمُرْتَجِزُ) (৩) ‘লুহাইফ’ (اللُّحَيْفُ) (৪) ‘লেযায’ (اللِّزَازُ) (৫) ‘যারিব’ (الظَّرِبُ) (৬) ‘সাবহাহ’ (السَّبْحَةُ) এবং (৭) ‘ওয়ার্দ’ (الْوَرْدُ)। ঘোড়ার পালানের নাম ছিল ‘দাজ’ (الدَّاجُ)। অনেকে বলেছেন তাঁর ঘোড়া ছিল ১৫টি। তবে এতে মতভেদ আছে।
খচ্চর (البغال) : তাঁর খচ্চর ছিল ৩টি। (১) ‘দুলদুল’ (دُلْدُلُ)। যা ছিল সাদা-কালো ডোরা কাটা। যা মিসর রাজ মুক্বাউক্বিস হাদিয়া পাঠিয়েছিলেন। (২) ‘ফায্যাহ’ (فَضَّةٌ)। যা ছিল সাদা। যা রোম সম্রাটের পক্ষে মা‘আন (مَعَان)-এর গবর্ণর ফারওয়া আল-জুযামী ইসলাম কবুলের পর তাঁকে হাদিয়া পাঠিয়েছিলেন। (৩) আরেকটি ডোরা কাটা খচ্চর ছিল, যা আয়লার অধিপতি হাদিয়া পাঠিয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে যে, নাজাশীও তাঁর জন্য একটি খচ্চর পাঠিয়েছিলেন, যাতে তিনি সওয়ার হতেন।
গাধা (الحمير) : তাঁর গাধা ছিল ২টি। (১) ইয়া‘ফূর (يَعْفُورٌ) বা ‘উফায়ের (عُفَيْرٌ)। যা ছিল সাদা-কালো ডোরা কাটা। মিসর রাজ মুক্বাউক্বিস তাঁকে হাদিয়া পাঠিয়েছিলেন। (২) অন্যটি ফারওয়া আল-জুযামী হাদিয়া পাঠিয়েছিলেন। বলা হয়েছে যে, সা‘দ বিন উবাদাহ (রাঃ) তাঁকে আরেকটি গাধা হাদিয়া দিয়েছিলেন। যাতে তিনি সওয়ার হতেন।
[1]. আহমাদ হা/২০০৮৬-৮৭; আবুদাঊদ হা/১৯৫৪।
[2]. বায়হাক্বী ৫/১৫২, হা/৯৪৬৪; আবুদাঊদ হা/১৯৫২ ‘মানাসিক’ অধ্যায় ৭১ অনুচ্ছেদ; আলবানী, সনদ ছহীহ; ‘আওনুল মা‘বূদ হা/১৯৫২-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
[3]. বায়হাক্বী হা/৯৬৭৪; তিরমিযী হা/ ৮১৫; আবুদাঊদ হা/১৭৪৯; ইবনু মাজাহ হা/৩০৭৬; যাদুল মা‘আদ ১/১২৯-৩০।
পরিশিষ্ট-১ - ৬. অস্ত্র-শস্ত্র (السلاح)
তরবারী (السيف) : রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ৯টি তরবারী ছিল। (১) মা’ছূর (مَأْثُورٌ)। যা তিনি পৈত্রিক উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। (২) ‘আয্ব (الْعَضْبُ)। (৩) ‘যুল-ফিক্বার’ (ذُو الْفِقَارِ)। এটি তিনি ছাড়তেন না। যার বাঁট ছিল লোহার তৈরী ও রূপা দিয়ে মোড়ানো। (৪) ক্বালাঈ (الْقَلَعِيّ)। (৫) বাত্তার (الْبَتَّارُ)। (৬) হাত্ফ (الْحَتْفُ)। (৭) রাসূব (الرَّسُوبُ)। (৮) মিখযাম (الْمِخْذَمُ)। (৯) ক্বাযীব (الْقَضِيبُ)।
বর্ম (الدرع) : তাঁর বর্ম ছিল ৭টি : (১) ‘যাতুল ফুযূল’(ذَاتُ الْفُضُولِ)। লোহার তৈরী এই বর্মটি মৃত্যুর পূর্বে স্বীয় পরিবারের জন্য রাসূল (সাঃ) জনৈক আবু শাহম (أَبو الشَّحْم) ইহূদীর নিকট ৩০ ছা‘ (৭৫ কেজি) যবের বিনিময়ে এক বছরের জন্য বন্ধক রেখেছিলেন। (২) ‘যাতুল বিশাহ’ (ذَاتُ الْوِشَاحِ)। (৩) ‘যাতুল হাওয়াশী’ (ذَاتُ الْحَوَاشِي)। (৪) সা‘দিয়াহ (السَّعْدِيَّةُ)। (৫) ফিযযাহ (فِضَّةٌ)। (৬) বাতরা (الْبَتْرَاءُ)। (৭) খিরনিক্ব (الْخِرْنِقُ)। (যাদুল মা‘আদ ১/১২৬)।
এতদ্ব্যতীত তাঁর (১) তীরের নাম ছিল ‘সাদাদ’ (السَّدَادُ)। (২) শরাধারের নাম ছিল ‘আল-জাম‘উ’ (الْجَمْعُ)। (৩) বর্শার নাম ছিল ‘সাগা’ (السَّغَاء)। (৪) তাঁর শিরস্ত্রানের নাম ছিল ‘যাক্বান’ (الذَّقَنُ)। (৫) ঢালের নাম ছিল ‘মূজেয’ (الْمُوجِزُ)।[1]
ব্যবহৃত বস্ত্তসমূহের বিষয় পর্যালোচনা (الملاحظة فى أثاثه المسةعملة) :
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ব্যবহৃত বস্ত্তসমূহকে বরকতের বস্ত্ত হিসাবে পূজা করার কোনরূপ নির্দেশনা শরী‘আতে নেই। তেমন কিছু থাকলে ছাহাবায়ে কেরাম নিজেরাই সেগুলি সংরক্ষণ করতেন। বরং এর বিপরীত তাঁর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতে এবং তাঁর কবরে পূজা করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে।[2] তাঁর ব্যবহৃত পোষাক, জুতা এমনকি তাঁর চুল ইত্যাদি নিয়ে মুসলিম বিশ্বের কোন কোন অঞ্চলে যেভাবে অতি ভক্তি দেখানো হয়, এমনকি অনেক স্থানে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও যুদ্ধ-বিগ্রহ পর্যন্ত হয়ে থাকে। এগুলি স্রেফ বাড়াবাড়ি বৈ কিছুই নয়।
[1]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ৬/৯।
[2]. বুখারী হা/৩৪৪৫, ১৩৯০; মুওয়াত্ত্বা হা/৫৯৩; মিশকাত হা/৭৫০।
পরিশিষ্ট-১ - ৭. দূতগণ (رسله صــ إلى الملوك)
(১) ‘আমর বিন উমাইয়া যামরী : বাদশাহ নাজাশীর নিকট প্রেরিত হন। তিনি রাসূল (সাঃ)-এর পত্র হাতে নিয়ে সিংহাসন থেকে নীচে নেমে মাটিতে বসেন। অতঃপর জা‘ফর বিন আবু ত্বালিবের নিকটে কালেমা পাঠ করে ইসলাম কবুল করেন। তাঁর ইসলাম আমৃত্যু সুন্দর ছিল। (২) দেহিইয়াহ বিন খালীফাহ কালবী : রোম সম্রাট হেরাক্বল-এর নিকট প্রেরিত হন। (৩) আব্দুল্লাহ বিন হুযাফাহ সাহমী : পারস্য সম্রাট কিসরার নিকট। (৪) হাত্বেব বিন আবু বালতা‘আহ লাখমী : মিসর রাজ মুক্বাউক্বিস-এর নিকট। (৫) আমর ইবনুল ‘আছ : ওমানের সম্রাট দুই ভাইয়ের নিকট। (৬) সালীত্ব বিন আমর ‘আলাবী : ইয়ামামার শাসক হাওযাহ বিন আলী-এর নিকট। (৭) শুজা‘ বিন ওয়াহাব আল-আসাদী : শামের বালক্বা-এর শাসক হারেছ বিন আবু শিম্র আল-গাসসানীর নিকট। (৮) মুহাজির বিন আবু উমাইয়াহ মাখযূমী : হারেছ আল-হিমইয়ারীর নিকট। (৯) ‘আলা ইবনুল হাযরামী : বাহরায়েনের শাসক মুনযির বিন সাওয়া আল-‘আব্দীর নিকট। (১০) আবু মূসা আশ‘আরী ও মু‘আয বিন জাবাল : ইয়ামনবাসী ও তাদের শাসকদের নিকট প্রেরিত হন। তাদের শাসকবর্গসহ অধিকাংশ জনগণ ইসলাম কবুল করেন।[1]
[1]. নববী, তাহযীবুল আসমা ওয়াল লুগাত, তাহকীক : মুছত্বফা আব্দুল ক্বাদের ‘আত্বা ১/৩৯ পৃঃ।
পরিশিষ্ট-১ - ৮. তাঁর মুওয়াযযিনগণ (مؤذنوه صــ)
মোট চারজন। তন্মধ্যে দু’জন (১) বেলাল বিন রাবাহ ও (২) আমর ইবনু উম্মে মাকতূম (রাঃ) মদীনায়, ‘আম্মার বিন ইয়াসিরের মুক্তদাস (৩) সা‘দ আল-ক্বারয ক্বোবায় এবং (৪) আবু মাহযূরাহ আউস বিন মুগীরাহ আল-জুমাহী ছিলেন মক্কায় (যাদুল মা‘আদ ১/১২০)।
পরিশিষ্ট-১ - ৯. তাঁর আমীরগণ (أمرا ائه صــ)
(১) বাযান বিন সামান। পারস্য সম্রাট কিসরা নিহত হওয়ার পর রাসূল (সাঃ) তাকে ইয়ামনের গবর্ণর নিয়োগ করেন। ইনিই ছিলেন ইয়ামনে ইসলামী যুগের প্রথম আমীর ও প্রথম অনারব মুসলিম। বাযানের মৃত্যুর পর তার পুত্র শাহর বিন বাযানকে আমীর নিযুক্ত হন। পরে তিনি নিহত হ’লে রাসূল (সাঃ) খালেদ বিন সাঈদ ইবনুল ‘আছ (রাঃ)-কে সেখানকার আমীর নিয়োগ করেন।
(২) মুহাজির বিন উমাইয়া মাখযূমীকে রাসূল (সাঃ) কিন্দাহ ও ছাদিফ (الصَّدِف) এলাকার আমীর নিযুক্ত করেন। রাসূল (সাঃ)-এর মৃত্যুর পর আবুবকর (রাঃ) সেখানকার কিছু মুরতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য অভিযান প্রেরণ করেন।
(৩) যিয়াদ বিন উমাইয়া আনছারীকে হাযরামাঊত (৪) আবু মূসা আশ‘আরীকে যাবীদ (زَبِيد), আদন ও সাগর তীরবর্তী এলাকা (৫) মু‘আয বিন জাবালকে জান্দ (الْجَنْد) এলাকা (৬) আবু সুফিয়ান ছাখর বিন হারবকে নাজরান এবং তাঁর পুত্র (৭) ইয়াযীদকে তায়মা (৮) আত্তাব বিন আসীদকে মক্কা (৯) আলী ইবনু আবী ত্বালেবকে ইয়ামন (১০) আমর ইবনুল ‘আছকে ওমান এলাকার প্রশাসক নিয়োগ করেন। এতদ্ব্যতীত (১১) আবুবকর (রাঃ)-কে ৯ম হিজরীতে হজ্জের আমীর নিযুক্ত করেন। যদিও আল্লাহর শত্রু রাফেযী শী‘আরা বলে থাকে যে, আলীকে পাঠিয়ে আবুবকরকে বরখাস্ত করা হয়’ (যাদুল মা‘আদ ১/১২১-২২)।
পরিশিষ্ট-১ - ১০. হজ্জ ও ওমরাহসমূহ (حجه وعُمُراته صــــ)
আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) মাত্র ১টি হজ্জ করেন এবং হিজরতের পরে মোট চারটি ওমরাহ করেন। (১) ৬ষ্ঠ হিজরীতে হোদায়বিয়ার ওমরাহ (عُمْرَةُ الْحُدَيْبِيَةِ), যা পূর্ণ না হওয়ায় তিনি সন্ধি করে ফিরে যান (২) ৭ম হিজরীতে গত বছরের সন্ধি মতে ওমরাহ (عُمْرَةُ الْقَضَاءِ) আদায় (৩) ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয় ও হোনায়েন যুদ্ধের পর গণীমত বণ্টন শেষে জি‘ইর্রা-নাহ হ’তে ওমরাহ (عُمْرَةِ الْجِعِرَّانَةِ) আদায় এবং (৪) সবশেষে ১০ম হিজরীতে বিদায় হজ্জের সাথে একত্রিতভাবে ওমরাহ আদায়। সবগুলিই তিনি করেছিলেন যুলক্বা‘দাহ মাসে’।[1] উক্ত হিসাবে দেখা যায় যে, তিনি পৃথক ও স্বতন্ত্রভাবে কেবল দু’টি ওমরাহ করেছেন। একটি ৭ম হিজরীতে ওমরাতুল ক্বাযা এবং অন্যটি ৮ম হিজরীতে ওমরাতুল জি‘ইর্রানাহ। সম্ভবতঃ একারণেই ছাহাবী বারা বিন আযেব (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর হজ্জের পূর্বে দু’টি ওমরাহ করেছেন যুলক্বা‘দাহ মাসে’।[2]
[1]. যাদুল মা‘আদ ২/৮৬; বুখারী হা/৪১৪৮; মুসলিম হা/১২৫৩; মিশকাত হা/২৫১৮।
[2]. বুখারী হা/১৭৮১; মিশকাত হা/২৫১৯।
পরিশিষ্ট-১ - ১১. মু‘জেযা সমূহ (معجزاته صــــ)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মু‘জেযা সমূহ গণনা করা সম্ভব নয়। প্রসিদ্ধগুলি নিম্নরূপ:
(১) চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করণ।[1] (২) মি‘রাজের ঘটনা।[2] (৩) কা‘বাগৃহে ছালাতরত অবস্থায় মাথায় উটের ভুঁড়ি চাপানো যে সাত জনের বিরুদ্ধে তিনি বদ দো‘আ করেছিলেন, তাদের বদর যুদ্ধে নিহত হওয়া।[3] (৪) কা‘বাগৃহে ছালাতরত অবস্থায় রাসূল (সাঃ)-এর মাথা পা দিয়ে পিষে দেওয়ার জন্য এগিয়ে এলে আবু জাহল সম্মুখে অগ্নিগহবর দেখে ভয়ে পিছিয়ে যায়।[4] (৫) ইয়ামনের যেমাদ আযদী রাসূল (সাঃ)-কে জিনে ধরা রোগী মনে করে ঝাড়-ফুঁক করতে এলে তিনি তাঁর মুখে ইন্নাল হামদা লিল্লাহ, নাহমাদুহূ... শুনে ইসলাম কবুল করেন।[5] (৬) মক্কায় একদিন আবুবকরকে সাথে নিয়ে রাসূল (সাঃ) কোথাও যাচ্ছিলেন। ইবনু মাসঊদ বলেন, তখন আমি উক্ববা বিন আবু মু‘আইতের বকরী চরাচ্ছিলাম। তিনি বললেন, হে বৎস! দুধ আছে কি? আমি বললাম, আছে। কিন্তু আমি তো আমানতদার মাত্র।
তখন তিনি বললেন, বাচ্চা (নাবালিকা) ছাগীটি নিয়ে এস। অতঃপর আমি নিয়ে গেলে তিনি তার বাঁট ছুঁয়ে দিলেন। তখন দুধ নেমে আসে। ফলে তিনি ও আবুবকর পেট ভরে পান করেন। অতঃপর তিনি পুনরায় বাঁটে হাত দেন ও দুধ বন্ধ হয়ে যায়। যাওয়ার সময় তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, হে বৎস! আল্লাহ তোমাকে অনুগ্রহ করুন’।[6] (৭) হিজরতের শুরুতে ছওর গিরিগুহায় অবস্থানকালে শত্রুর আগমন টের পেয়ে তিনি বলেন, আমরা দু’জন নই, তৃতীয় জন আমাদের সাথে আল্লাহ আছেন।[7] (৮) হিজরতকালে উম্মে মা‘বাদের রুগ্ন বকরীর শুষ্ক পালান দুধে ভরে যাওয়া।[8] (৯) পিছু ধাওয়াকারী সুরাক্বা বিন মালেকের ঘোড়ার পাগুলি মাটিতে দেবে যাওয়া। অতঃপর ফিরে যাওয়া।[9] (১০) হিজরতের পরপরই ইহূদী পন্ডিত আব্দুল্লাহ বিন সালামের তিনটি প্রশ্নের জওয়াব দেওয়া।
যা নবী ব্যতীত কারু পক্ষে সম্ভব ছিল না।[10] (১১) হোদায়বিয়ার কূয়া থেকে এবং তাবূকের সফরে হাতের আঙ্গুল সমূহ থেকে শুষ্ক ঝর্ণায় পানির প্রবাহ নির্গমন।[11] (১২) অন্য এক সফরে তৃষ্ণার্ত হ’লে সওয়ারী এক মহিলার দু’টি মশক থেকে পানি নিয়ে একটি পাত্রে ঢালেন। অতঃপর তা থেকে সাথী ৪০ জন ও সওয়ারীর পশুগুলি পান করে। অতঃপর সমস্ত পাত্র ভরে নেওয়া হয়। এরপরেও মহিলাকে তার মশক দু’টি পূর্ণভাবে পানি ভর্তি অবস্থায় ফেরৎ দেওয়া হয়।[12] (১৩) একবার মদীনার ‘যাওরা’ বাজারে রাসূল (সাঃ) একটি পানির পাত্রে হাত রাখলে আঙ্গুল সমূহের ফাঁক দিয়ে এত বেশী পানি প্রবাহিত হয় যে, ৩০০ বা তার কাছাকাছি মানুষ তা পান করে পরিতৃপ্ত হয়।[13] (১৪) মসজিদে নববীতে দূরাগত মুছল্লীদের ওযূর পানিতে কমতি হ’লে রাসূল (সাঃ) ছোট্ট একটি পাত্রে হাত ডুবিয়ে দেন।
অতঃপর তা থেকে ৮০ জনের অধিক মুছল্লী ওযূ করেন।[14] (১৫) মসজিদে নববীতে মিম্বর স্থাপিত হ’লে রাসূল (সাঃ) ইতিপূর্বে খেজুর গাছের যে খুঁটিতে ঠেস দিয়ে খুৎবা দিতেন, সেটি ত্যাগ করে মিম্বরে বসেন। তখন খুঁটিটি শিশুর মত চিৎকার দিয়ে কাঁদতে থাকে। রাসূল (সাঃ) নীচে নেমে তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিলে সে থেমে যায়।[15] তিনি বলেন, যদি আমি তাকে বুকে টেনে আদর না করতাম, তাহ’লে সে ক্বিয়ামত পর্যন্ত এভাবেই কাঁদতে থাকত।[16] (১৬) গাছ ও পাথরের সিজদা করা।[17] (১৭) বৃক্ষের হেঁটে চলে আসা ও পুনরায় তার স্থানে ফিরে যাওয়া[18] এবং দু’টি গাছ একত্রিত হয়ে তাঁর জন্য নীচু হয়ে তাঁর হাজত সারার জন্য আড়াল করা।[19] (১৮) বদর যুদ্ধের দিন মুশরিক নেতাদের নিহত হওয়ার স্থান সমূহ নির্দেশ করা।[20] (১৯) ঐ দিন ঘোড় সওয়ার ফেরেশতা কর্তৃক তার ঘোড়ার প্রতি নির্দেশ ‘হায়যূম! আগে বাড়ো’ বলার পরেই নিহত শত্রুর পতন হওয়া।[21] (২০) ওহোদের যুদ্ধে রাসূল (সাঃ)-এর ডাইনে ও বামে সাদা পোষাকধারী দু’জন ব্যক্তির যুদ্ধ করা’। যারা ছিলেন জিবরাঈল ও মীকাঈল।[22] (২১) তাঁর উম্মৎ সাগরে নৌযুদ্ধে গমন করবে এবং উম্মে হারাম হবেন তাদের অন্যতম।
মু‘আবিয়া (রাঃ) ও ইয়াযীদের মাধ্যমে তা বাস্তবায়িত হয়।[23] (২২) রোমকরা পরাজিত হ’লে তিনি বলেন, কয়েক বছরের মধ্যেই রোমকরা বিজয়ী হবে (২৩) রোম ও পারস্য সাম্রাজ্য বিজিত হবে। ওমর ও ওছমান (রাঃ)-এর সময় যা বাস্তবায়িত হয়। (২৪) হাসান বিন আলীর মাধ্যমে মুসলমানদের বিবদমান দু’টি বড় দলের মধ্যে সন্ধি হবে। হাসান (রাঃ)-এর খেলাফত ত্যাগ ও মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর খেলাফত গ্রহণের মাধ্যমে যা বাস্তবায়িত হয়। (২৫) নাজাশীর মৃত্যুর দিন মদীনায় ছাহাবীদের উক্ত খবর দেওয়া এবং গায়েবানা জানাযা পড়া (২৬) ভন্ডনবী আসওয়াদ ‘আনাসী আজ রাতে ইয়ামনে নিহত হবে এবং তা বাস্তবায়িত হওয়া (২৭) খন্দক যুদ্ধে পরিখা খননকালে শক্ত পাথর তাঁর কোদালের আঘাতে গুঁড়া হয়ে বালুর স্তূপে পরিণত হওয়া।[24] (২৮) আরেকটি পাথরে আঘাত করার পর তার একাংশ ভেঙ্গে পড়লে তিনি বলেন ওঠেন, আল্লাহু আকবর! আমাকে পারস্যের সাম্রাজ্য দান করা হয়েছে... (২৯) তিন দিন না খেয়ে পেটে পাথর বাঁধা ক্ষুধার্ত রাসূল-কে খাওয়ানোর জন্য ছাহাবী জাবের (রাঃ) একটি বকরীর বাচ্চা যবেহ করলেন এবং তাঁর স্ত্রী এক ছা‘ (আড়াই কেজি) যব পিষে আটা তৈরী করেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তখন ঐ সময় পরিখা খননরত ১০০০ ছাহাবীর সবাইকে সাথে নিয়ে আসেন।
অতঃপর সকলে তৃপ্তির সাথে খাওয়ার পরেও আগের পরিমাণ আটা ও গোশত অবশিষ্ট থেকে যায়।[25] (৩০) ক্ষুধার কষ্টে রাসূল (সাঃ)-এর কণ্ঠস্বর দুর্বল বুঝতে পেরে ছাহাবী আবু ত্বালহা স্ত্রী উম্মে সুলায়েম-কে বললে তিনি তাঁর জন্য কয়েকটি রুটি কাপড়ে জড়িয়ে পুত্র আনাসকে দিয়ে গোপনে পাঠিয়ে দেন। পরে রাসূল (সাঃ) সকল সাথীকে নিয়ে আবু ত্বালহার বাড়ীতে আসেন। অতঃপর রুটিগুলি টুকরা টুকরা করেন এবং বিসমিল্লাহ বলে ১০ জন করে সবাইকে খেতে বলেন। দেখা গেল ৮০ জন খাওয়ার পরেও আরও উদ্বৃত্ত রইল’।[26] মুসনাদে আহমাদের বর্ণনায় এসেছে, রুটিগুলি দুই মুদ বা অর্ধ মুদ যবের আটার তৈরী ছিল।[27] (৩১) ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, আমরা রাসূল (সাঃ)-এর সাথে খাদ্য ভক্ষণ অবস্থায় (কখনো কখনো) তার তাসবীহ শুনতে পেতাম’।[28] (৩২) (ক) এক সফরে একটি উট এসে রাসূল (সাঃ)-এর নিকট অভিযোগ পেশ করে। তখন তিনি মালিককে ডেকে বলেন, এই উটের কাছ থেকে অধিক কাজ নেওয়া হয় এবং তাকে খাদ্য কম দেওয়া হয়। অতএব এর সঙ্গে সদাচরণ কর। (খ) কিছু দুর গিয়ে এক স্থানে রাসূল (সাঃ) ঘুমিয়ে পড়লেন।
তখন মাটি ফুঁড়ে একটি গাছ উঠে এসে তাঁকে ছায়া করল। অতঃপর চলে গেল। (গ) অতঃপর কিছু দুর গিয়ে একটি ঝর্ণার নিকটে একজন মহিলা তার জিনে ধরা ছেলেকে নিয়ে আসল। রাসূল (সাঃ) তার নাক ধরে বললেন, বেরিয়ে যাও! আমি আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ’। ফেরার পথে উক্ত মহিলাটি তার ছেলের সুস্থতার কথা জানালো’।[29] আনাস (রাঃ) কর্তৃক অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, আনছারদের একটি বাগিচায় গেলে উট এসে তাঁর সামনে সিজদায় পড়ে যায়।[30] (৩৩) ৫ম হিজরীতে খন্দক যুদ্ধে পরিখা খননের সময় ‘আম্মার বিন ইয়াসিরকে তিনি বলেন, ‘হে ‘আম্মার! জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর। তোমাকে বিদ্রোহী দল হত্যা করবে’।[31] অতঃপর তিনি ৩৭ হিজরীতে আলী ও মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর মধ্যে সংঘটিত ছিফফীন যুদ্ধে আলী (রাঃ)-এর পক্ষে যুদ্ধ করা অবস্থায় ৯৩ বছর বয়সে শহীদ হন’।[32] (৩৪) ইহূদী নেতা সালাম ইবনুল হুক্বাইক্ব-কে হত্যা শেষে আবু রাফে‘ দুর্গ থেকে ফেরার সময় আব্দুল্লাহ বিন আতীকের এক পা ভেঙ্গে যায়।
পরে তাতে হাত বুলিয়ে দেওয়ার পর তিনি সাথে সাথে পূর্ণ সুস্থ হয়ে যান।[33] (৩৫) তোমরা সত্ত্বর মাসজিদুল হারামে বিজয়ী বেশে প্রবেশ করবে বলে স্বপ্ন বর্ণনা। যা হোদায়বিয়ার সন্ধি ও পরবর্তীতে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। (৩৬) পারস্যরাজ কিসরা তাঁর চিঠি ছিঁড়ে ফেললে তিনি বলেন, তার সাম্রাজ্যকে ছিন্নভিন্ন করুন। (৩৭) কিসরার গবর্ণর প্রেরিত দূতদ্বয়কে তাদের সম্রাট আজ রাতেই নিহত হবে বলে খবর দেওয়া এবং তা সত্যে পরিণত হওয়া (ছহীহাহ হা/১৪২৯)। (৩৮) খায়বর যুদ্ধে আহত সালামা বিন আকওয়া‘ পায়ে আঘাত প্রাপ্ত হ’লে রাসূল (সাঃ) সেখানে তিনবার থুক মারেন। তাতে তিনি সঙ্গে সঙ্গে সুস্থ হয়ে যান।[34] (৩৯) খায়বর যুদ্ধে বিজয়ের দিন সকালে তিনি বলেন, আজ আমি যার হাতে পতাকা দিব, তার হাতেই বিজয় আসবে। পরে চোখের অসুখে কাতর আলীকে ডেকে এনে তার চোখে হাত বুলিয়ে দেন। তাতে তিনি সুস্থ হয়ে যান।
অতঃপর খায়বরের শ্রেষ্ঠ না‘এম দুর্গ জয় করেন।[35] (৪০) মুতার যুদ্ধে গমনের সময় তিনি সেনাপতি যায়েদ, জা‘ফর ও আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা-এর আগাম শাহাদাতের খবর দেন। অতঃপর যুদ্ধের ময়দানে তাঁদের শাহাদাতের পর মদীনায় দাঁড়িয়ে অশ্রুসজল চোখে সবাইকে তিনি খবর দেন এবং খালেদ বিন অলীদের হাতে যুদ্ধ জয়ের সুসংবাদ দেন।[36] (৪১) হোনায়েন যুদ্ধে সংকটকালে তিনি এক মুষ্ঠি বালু শত্রুদের দিকে ছুঁড়ে মারেন। তাতে সবাই পালিয়ে যায়।[37] (৪২) একই যুদ্ধে মুসলিম পক্ষের জনৈক দুর্ধর্ষ যোদ্ধাকে তিনি বলেন, এই ব্যক্তি জাহান্নামী। পরে দেখা গেল তিনি আত্মহত্যা করে মারা গেলেন।[38] (৪৩) মদীনার লাবীদ বিন আ‘ছাম তার মাথার চুল ও চিরুনীতে জাদু করেন। পরে ঘুমন্ত অবস্থায় তার নিকটে দু’জন ব্যক্তি এসে বলেন, ‘যারওয়ান’ কূয়ার নীচে সেটি পাথর চাপা দেওয়া আছে। পরে সেখান থেকে সেটি বের করা হয়।[39] (৪৪) হোনায়েন যুদ্ধে গণীমত বণ্টনকালে তাঁর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশকারী যুল-খুওয়াইছেরাহ-কে লক্ষ্য করে তিনি বলেন, তার অনুসারী একদল লোক হবে, যাদের ছালাত, ছিয়াম ও তেলাওয়াত তোমাদের চাইতে উত্তম হবে।
এরা ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাবে, যেমন তীর ধনুক থেকে বেরিয়ে যায়।[40] পরবর্তীতে চরমপন্থী খারেজী দলের উদ্ভব উক্ত ছিল ভবিষ্যদ্বাণীরই বাস্তবতা। (৪৫) আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর দাবীক্রমে তিনি বলেন, চাদর বিছিয়ে দাও। অতঃপর তিনি তাতে দো‘আ করে ফুঁক দিলেন। তাতে তিনি আর কোনদিন হাদীছ ভুলে যাননি।[41] (৪৬) খরায় আক্রান্ত মদীনায় বৃষ্টির জন্য দো‘আ চাইলে তিনি দো‘আ করেন। ফলে প্রচুর বৃষ্টিতে মদীনার রাস্তা-ঘাট ডুবে যেতে থাকে। তখন তিনি পুনরায় দো‘আ করেন। ফলে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যায়।[42] (৪৭) তাবূক যুদ্ধে গমনের সময় যুল-বিজাদায়েনকে তিনি বলেন, তুমি যদি প্রচন্ড জ্বরে মারা যাও, তাতেও তুমি শহীদ হিসাবে গণ্য হবে। পরে তাবূক পৌঁছে তিনি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।[43] (৪৮) ফাযালাহ বিন ওবায়েদ (রাঃ) বলেন, তাবূক থেকে ফেরার পথে আমাদের উটগুলি কষ্টে হাসফাস করতে থাকে। তখন রাসূল (সাঃ) দো‘আ করেন।
ফলে মদীনায় আসা পর্যন্ত তারা সবল থাকে’।[44] (৪৯) আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, নেকড়ে একটি বকরীকে ধরে নিল। তখন রাখাল সেটি ছিনিয়ে নিল। নেকড়ে বলল, তুমি কি আল্লাহকে ভয় কর না? তুমি আমার রিযিক ছিনিয়ে নিলে। যা আল্লাহ আমার জন্য পাঠিয়েছিলেন। রাখাল বলল, কি আশ্চর্য! আমার সঙ্গে নেকড়ে মানুষের মত কথা বলছে। তখন নেকড়ে বলল, আমি কি তোমার নিকটে এর চাইতে বিস্ময়কর খবর দিব না? মুহাম্মাদ ইয়াছরিবে এসেছেন। তিনি মানুষকে গায়েবের খবর দিচ্ছেন। তখন রাখালটি দ্রুত মদীনায় প্রবেশ করল এবং এসে দেখল রাসূল (সাঃ) সমবেত মুছল্লীদের উদ্দেশ্যে বলছেন, অতদিন ক্বিয়ামত হবে না, যতদিন না পশুরা মানুষের সাথে কথা বলবে...।[45] (৫০) একদিন তিনি আবুবকর, ওমর ও ওছমানকে সাথে নিয়ে ওহোদ পাহাড়ে ওঠেন। ফলে পাহাড়টি কেঁপে ওঠে। তখন তিনি পা দিয়ে আঘাত করে বলেন, হে পাহাড়! থাম। তোমার উপরে একজন নবী, একজন ছিদ্দীক্ব ও দু’জন শহীদ আছেন’।[46] অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (সাঃ) ওছমানকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আল্লাহ তোমাকে পোষাক পরাবেন। যদি মুনাফিকরা সেই পোষাক খুলে নিতে চায়, তাহ’লে তুমি কখনই তা তাদেরকে খুলে দিয়ো না। একথা তিনি তিনবার বলেন’।[47] বস্ত্ততঃ এই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে যায়।
[1]. বুখারী হা/৩৮৬৮-৬৯; মুসলিম হা/২৮০০; মিশকাত হা/৫৮৫৪-৫৫।
[2]. বুখারী হা/৩৮৮৭; মুসলিম হা/১৬২; মিশকাত হা/৫৮৬২-৬৬।
[3]. বুখারী হা/২৪০, ৫২০; মুসলিম হা/১৭৯৪; মিশকাত হা/৫৮৪৭।
[4]. মুসলিম হা/২৭৯৭; মিশকাত হা/৫৮৫৬।
[5]. মুসলিম হা/৮৬৮; মিশকাত হা/৫৮৬০।
[6]. আহমাদ হা/৩৫৯৮, সনদ ‘হাসান’।
[7]. বুখারী হা/৩৬৫৩; মুসলিম হা/২৩৮১; মিশকাত হা/৫৮৬৮।
[8]. হাকেম হা/৪২৭৪; মিশকাত হা/৫৯৪৩।
[9]. বুখারী হা/৩৬১৫; মুসলিম হা/২০০৯ (৭৫); মিশকাত হা/৫৮৬৯।
[10]. বুখারী হা/৪৪৮০; মিশকাত হা/৫৮৭০।
[11]. বুখারী হা/৩৫৭৬, ৪১৫০; মিশকাত হা/৫৮৮৩-৮৪; মুসলিম হা/৭০৬ (১০)।
[12]. বুখারী হা/৩৫৭১; মিশকাত হা/৫৮৮৪।
[13]. বুখারী হা/৩৫৭২; মুসলিম হা/২২৭৯ (৬); মিশকাত হা/৫৯০৯।
[14]. বুখারী হা/১৯৫।
[15]. বুখারী হা/৩৫৮৪-৮৫; মিশকাত হা/৫৯০৩।
[16]. ইবনু মাজাহ /১৪১৫; ছহীহাহ হা/২১৭৪।
[17]. তিরমিযী হা/৩৬২০; মিশকাত হা/৫৯১৮।
[18]. দারেমী হা/২৩; আহমাদ হা/১২১৩৩; মিশকাত হা/৫৯২৪।
[19]. মুসলিম হা/৩০১২; মিশকাত হা/৫৮৮৫।
[20]. মুসলিম হা/১৭৭৯ (৮৩); মিশকাত হা/৫৮৭১।
[21]. মুসলিম হা/১৭৬৩ (৫৮); মিশকাত হা/৫৮৭৪।
[22]. বুখারী হা/৫৮২৬; মুসলিম হা/২৩০৬ (৪৬); মিশকাত হা/৫৮৭৫।
[23]. বুখারী হা/২৭৮৮-৮৯; মুসলিম হা/১৯১২; মিশকাত হা/৫৮৫৯।
[24]. বুখারী হা/৪১০২; মুসলিম হা/২০৩৯; মিশকাত হা/৫৮৭৭।
[25]. বুখারী হা/৪১০২; মুসলিম হা/২০৩৯; মিশকাত হা/৫৮৭৭।
[26]. বুখারী হা/৫৪৫০; মুসলিম হা/২০৪০; মিশকাত হা/৫৯০৮।
[27]. আহমাদ হা/১৩৪৫২, ১২৫১৩ হাদীছ ছহীহ। উল্লেখ্য যে, চার মুদে এক ছা‘ হয়। যার পরিমাণ আড়াই কেজি চাউলের সমান।
[28]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৩৫৭৯; মিশকাত হা/৫৯১০।
[29]. দারেমী হা/১৭; মাজমাউয যাওয়ায়েদ হা/১৪১৬৮, সনদ ‘হাসান’; মিশকাত হা/৫৯২২, আলবানী বলেন, শাওয়াহেদ-এর কারণে হাদীছ ছহীহ, ঐ, টীকা-১; ছহীহাহ হা/৪৮৫।
[30]. আহমাদ হা/১২৬৩৫, সনদ ‘ছহীহ লে গায়রিহী’; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪১৬২।
[31]. মুসলিম হা/২৯১৫; মিশকাত হা/৫৮৭৮।
[32]. আল-ইছাবাহ, ‘আম্মার ক্রমিক ৫৭০৮; আল-ইস্তী‘আব, ‘আম্মার ক্রমিক ১৮৬৩।
[33]. বুখারী হা/৪০৩৯ ‘যুদ্ধ বিগ্রহ’ অধ্যায়-৬৪, ‘আবু রাফে‘ হত্যা’ অনুচ্ছেদ-১৬।
[34]. বুখারী হা/৪২০৬ ‘খায়বর যুদ্ধ’ অনুচ্ছেদ; মিশকাত হা/৫৮৮৬।
[35]. বুখারী হা/২৯৪২, ৩৭০১; মুসলিম হা/২৪০৬; মিশকাত হা/৬০৮০।
[36]. মিশকাত হা/৫৮৮৭; বুখারী হা/৪২৬২।
[37]. মুসলিম হা/১৭৭৭ (৮১); মিশকাত হা/৫৮৯১।
[38]. বুখারী হা/৬৬০৬; মিশকাত হা/৫৮৯২।
[39]. বুখারী হা/৫৭৬৫; মুসলিম হা/২১৮৯ (৪৩); মিশকাত হা/৫৮৯৩।
[40]. বুখারী হা/৩৩৪৪; মুসলিম হা/১০৬৪; মিশকাত হা/৫৮৯৪।
[41]. বুখারী হা/২৩৫০; মুসলিম হা/২৪৯৩; মিশকাত হা/৫৮৯৬।
[42]. বুখারী হা/১০১৩; মুসলিম হা/৮৯৭ (৯); মিশকাত হা/৫৯০২।
[43]. হাদীছ ‘হাসান’, তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৮৮৭।
[44]. আহমাদ হা/২৪০০১, হাদীছ ছহীহ।
[45]. আহমাদ হা/১১৮০৯, হাদীছ ছহীহ।
[46]. বুখারী হা/৩৬৮৬; তিরমিযী হা/৩৬৯৭; মিশকাত হা/৬০৭৪।
[47]. তিরমিযী হা/৩৭০৫; ইবনু মাজাহ হা/১১২; মিশকাত হা/৬০৬৮ ‘ওছমানের মর্যাদা’ অনুচ্ছেদ।
মু‘জিযা সমূহ পর্যালোচনা (مراجعت على المعجزات)
মু‘জেযা সমূহ মূলতঃ নবুঅতের প্রমাণ স্বরূপ। যা দু’ভাগে বিভক্ত। (১) আধ্যাত্মিক (معنوية) এবং (২) বাহ্যিক (حسية)। আধ্যাত্মিক বিষয়গুলির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মু‘জেযা হ’ল তাঁর উপরে কুরআন নাযিল হওয়া। অতঃপর তাঁর মাধ্যমে কুরআনের ব্যাখ্যা হিসাবে হাদীছ বর্ণিত হওয়া।[1] অন্যান্য মু‘জেযা সমূহ তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে বিলুপ্ত হ’লেও কুরআন ও হাদীছ ক্বিয়ামত পর্যন্ত জীবন্ত মু‘জেযা হিসাবে অব্যাহত থাকবে। কুরআনের মত অনুরূপ একটি গ্রন্থ প্রণয়নের জন্য বা অনুরূপ একটি আয়াত আনয়নের জন্য জিন ও ইনসানের অবিশ্বাসী সমাজের প্রতি মক্কায় পাঁচবার ও মদীনায় একবার চ্যালেঞ্জ করে আয়াতসমূহ নাযিল হয়।[2] কিন্তু কেউ সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেনি। বস্ত্ততঃ কুরআনের প্রতিটি বাক্য, শব্দ ও বর্ণ আল্লাহ কর্তৃক সুরক্ষিত। ক্বিয়ামত পর্যন্ত যা নিরাপদ থাকবে।
আধ্যাত্মিক মু‘জেযার দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ বিষয়টি হ’ল রাসূল (সাঃ)-এর জীবন ও চরিত্র। যা অন্য যেকোন মানুষ থেকে অনন্য এবং সকল মানুষের জন্য অনুকরণীয়।[3]
তাঁর নবুঅতের বাহ্যিক প্রমাণ সমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম হ’ল, চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হওয়া এবং মে‘রাজের ঘটনা।[4] এছাড়াও অন্যতম আসমানী প্রমাণ হ’ল, তাঁর দো‘আ করার সাথে সাথে মদীনা শহরে বৃষ্টি বর্ষিত হওয়া। অতঃপর লোকদের দাবীর প্রেক্ষিতে পুনরায় দো‘আ করার সাথে সাথে বৃষ্টি বন্ধ হওয়া।[5]
অতঃপর ইহজাগতিক মু‘জেযা সমূহের মধ্যে কিছু রয়েছে (ক) জড় জগতের সাথে সম্পর্কিত। যেমন পানির পাত্রে হাত দেওয়ার মাধ্যমে পানির প্রবাহ নির্গত হওয়া। খাদ্যের তাসবীহ পাঠ করা। বৃক্ষ হেটে আসা ও ছায়া করা। গাছ ও পাথর সিজদা করা। খাদ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হওয়া। মরা খেজুর গাছের খুঁটি ক্রন্দন করা ইত্যাদি।
অতঃপর (খ) প্রাণী জগতের সাথে সম্পর্কিত মু‘জেযা সমূহের মধ্যে রয়েছে বাচ্চা বকরীর পালানে দুধ আসা, নেকড়ের কথা বলা, উট কর্তৃক অভিযোগ পেশ করা ও সিজদা করা ইত্যাদি। এমনকি তাঁর ভক্ত গোলামের প্রতিও আল্লাহর হুকুমে ‘কারামত’ প্রকাশিত হয়েছে। যেমন তাঁর মৃত্যু পরবর্তীকালে রোমকদের বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধে তাঁর মুক্তদাস সাফীনাহ বন্দী হ’লে সেখান থেকে পালিয়ে এসে অথবা যেকোন কারণে মূল বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হ’লে নিজের সেনাবাহিনীর সন্ধানে তিনি গভীর জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলেন। এমন সময় একটি বাঘ তাঁর দিকে ধেয়ে আসে। তখন তিনি বলেন, হে আবুল হারেছ! ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর গোলাম। আমি এই এই সমস্যায় আছি’। তিনি বলেন, একথা শুনে বাঘটি মাথা নীচু করল এবং আমার পাশে এসে গা ঘেঁষতে লাগল। অতঃপর সে আমাকে পথ দেখিয়ে দীর্ঘ পথ হেঁটে সেনাবাহিনীর নিকট পৌঁছে দিল। বিদায়ের সময় সে হামহুম শব্দের মাধ্যমে আমাকে বিদায় জানিয়ে চলে গেল’।[6] যুগে যুগে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অনুসারী প্রকৃত আল্লাহভীরু মুমিনগণকে আল্লাহ এভাবে হেফাযত করবেন ও সম্মানিত করবেন ইনশাআল্লাহ।
[1]. আল্লাহ বলেন, ‘রাসূল নিজ থেকে কোন কথা বলেন না’। ‘এটি তো কেবল অহি, যা তাঁর নিকটে প্রত্যাদেশ করা হয়’ (নাজম ৫৩/৩-৪)। কুরআন হেফাযতের প্রতিশ্রুতি রয়েছে সূরা হিজর ১৫/৯ আয়াতে। অতঃপর কুরআন ও হাদীছ উভয়টির হেফাযতের প্রতিশ্রুতি রয়েছে সূরা ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৬-১৯ আয়াতে।
[2]. মক্কায় পাঁচবার হ’ল, সূরা ইউনুস ১০/৩৮; হূদ ১১/১৩; ইসরা ১৭/৮৮; ক্বাছাছ ২৮/৪৯; তূর ৫২/৩৪। মদীনায় একবার হ’ল, সূরা বাক্বারাহ ২/২৩।
[3]. আল্লাহ বলেন, إِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ ‘নিশ্চয় তুমি মহান চরিত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত’ (ক্বলম ৬৮/৪)। তিনি আরও বলেন,لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيُ رَسُوْلِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللهَ كَثِيْرًا ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসকে কামনা করে ও অধিকহারে আল্লাহকে স্মরণ করে’ (আহযাব ৩৩/২১)।
[4]. বুখারী হা/৩৮৬৮-৬৯; মুসলিম হা/২৮০০; মিশকাত হা/৫৮৫৪-৫৫; বুখারী হা/৩৮৮৭; মুসলিম হা/১৬২; মিশকাত হা/৫৮৬২-৬৬।
[5]. বুখারী হা/১০১৩; মুসলিম হা/৮৯৭ (৯); মিশকাত হা/৫৯০২।
[6]. হাকেম হা/৪২৩৫, সনদ ছহীহ; মিশকাত হা/৫৯৪৯ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়-২৯, ‘কারামত সমূহ’ অনুচ্ছেদ-৮।
Comments
Post a Comment
Please do not enter any spam link in the comment box.