Five Pillars of Islam The profession of Faith (Shahadah) Prayer (Salah) Alms (Zakat) Fasting (Sawm) Pilgrimage (Hajj) What are The Five Pillars of Islam Explained 5 pillars of Islam in English? 5 Pillars of Islam Prophet Muhammad Sallallahu Alayhi Wa Sallam came to teach us many things and the most important of them are the five pillars of Islam do you know the five pillars let's say them together with number one a Shahada to say ASH-HADU ANNA LA ILAHA ILLA ALLAHU WA ASH-HADU ANNA MUHAMMADAN ABDUHU WA RASULUHU which means there is no one worthy of worship except Allah and that Muhammad Sallallahu Alayhi Wa Sallam is his final messenger number two is salat the prayer the five daily prayers number three zakat to give the yearly charity number four ECM fast in the month of Ramadan and number five is Hajj going to Mecca and performing the pilgrimage Salah will be the first pillar that Allah will ask us about on the day of judgment so it is very important to pray on time and concen
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মাদানী জীবনকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে।-
এক. ১ম হিজরী সনের ১২ই রবীউল আউয়াল মোতাবেক ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে সেপ্টেম্বর সোমবার হ’তে ৬ষ্ঠ হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাসে অনুষ্ঠিত হোদায়বিয়ার সন্ধি পর্যন্ত প্রায় ছয় বছর। এই সময় কাফের ও মুনাফিকদের মাধ্যমে ভিতরে ও বাইরের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ও সশস্ত্র হামলা সমূহ সংঘটিত হয়। ইসলামকে সমূলে উৎপাটিত করার জন্য এ সময়ের মধ্যে সর্বমোট ৫০টি ছোট-বড় যুদ্ধ ও অভিযান সমূহ পরিচালিত হয়।
দুই. মক্কার মুশরিকদের সাথে সন্ধি চলাকালীন সময়। যার মেয়াদকাল ৬ষ্ঠ হিজরীর যুলক্বা‘দাহ হ’তে ৮ম হিজরীর রামাযান মাসে মক্কা বিজয় পর্যন্ত প্রায় দু’বছর। এই সময়ে প্রধানতঃ ইহূদী ও তাদের মিত্রদের সাথে বড়-ছোট ২২টি যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
তিন. ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের পর হ’তে ১১ হিজরীতে রাসূল (সাঃ)-এর মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় তিন বছর। এই সময়ে দলে দলে লোকেরা ইসলামে প্রবেশ করতে থাকে। চারদিক থেকে গোত্রনেতারা প্রতিনিধিদল নিয়ে মদীনায় এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বিদেশী রাজন্যবর্গের নিকটে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে দূত মারফত পত্র প্রেরণ করেন। এ সময় হোবল, লাত, মানাত, ‘উযযা, সুওয়া‘ প্রভৃতি প্রসিদ্ধ মূর্তিগুলি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এই সময়ে হোনায়েন যুদ্ধ এবং রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াসের বিরুদ্ধে তাবূক যুদ্ধে গমন ও সর্বশেষ সারিইয়া উসামা প্রেরণ সহ মোট ১৮টি মিলে মাদানী জীবনের ১০ বছরে ছোট-বড় প্রায় ৯০টি যুদ্ধ ও অভিযানসমূহ পরিচালিত হয়। অবশেষে সব বাধা অতিক্রম করে ইসলাম রাষ্ট্রীয় রূপ পরিগ্রহ করে এবং তৎকালীন বিশ্বের পরাশক্তি সমূহকে চ্যালেঞ্জ করে টিকে থাকার মত শক্তিশালী অবস্থানে উপনীত হয়।
এক্ষণে আমরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হিজরত কালীন সময়ে মদীনার সামাজিক অবস্থা ও সে প্রেক্ষিতে রাসূল (সাঃ)-এর গৃহীত কার্যক্রমসমূহ একে একে আলোচনা করব।
মদীনার সামাজিক অবস্থা (الحالة الإجةماعية فى المدينة)
খ্রিষ্টীয় ৭০ সালে প্রথমবার এবং ১৩২-৩৫ সালে দ্বিতীয়বার খ্রিষ্টান রোমকদের হামলায় বায়তুল মুক্বাদ্দাস অঞ্চল থেকে বিতাড়িত হয়ে ইহূদীরা ইয়াছরিব ও হিজায অঞ্চলে হিজরত করে (সীরাহ ছহীহাহ ১/২২৭)। মিষ্ট পানি, উর্বর অঞ্চল এবং শামের দিকে ব্যবসায়ী পথের গুরুত্বের কারণে ইহূদী বনু নাযীর ও বনু কুরায়যা গোত্রদ্বয় ইয়াছরিবের পূর্ব অংশ হাররাহ (حَرَّة) এলাকায় বসতি স্থাপন করে। তাদের অপর গোত্র বনু ক্বায়নুক্বা ইয়াছরিবের নিম্নভূমিতে বসতি স্থাপন করে। বনু ক্বায়নুক্বার শাখা গোত্রসমূহের আরবী নাম দেখে তাদেরকে আরব থেকে ধর্মান্তরিত ইহূদী বলে ঐতিহাসিকগণের অনেকে মত প্রকাশ করেছেন। যেমন বনু ইকরিমা, বনু মু‘আবিয়া, বনু ‘আওফ, বনু ছা‘লাবাহ প্রভৃতি নাম সমূহ। উপরোক্ত তিনটি প্রধান গোত্র ছাড়াও ছোট ছোট বিশটির অধিক ইহূদী শাখা গোত্রসমূহ ইয়াছরিবের বিভিন্ন অঞ্চলে এ সময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল।
অন্যদিকে আউস ও খাযরাজ, যারা ইসমাঈল-পুত্র নাবেত (نَابِت)-এর বংশধর ছিল এবং ইয়ামনের আযদ (الْأَزْدُ) গোত্রের দিকে সম্পর্কিত ছিল, তারা খ্রিষ্টীয় ২০৭ সালের দিকে ইয়ামন থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন সময়ে ইয়াছরিবে হিজরত করে। সেখানে পূর্ব থেকেই অবস্থানরত ইহূদীরা তাদেরকে ইয়াছরিবের অনুর্বর ও পরিত্যক্ত এলাকায় বসবাস করতে বাধ্য করে। আউসরা বনু নাযীর ও বনু কুরায়যার প্রতিবেশী হয় এবং খাযরাজরা বনু ক্বায়নুক্বার প্রতিবেশী হয়। আউসদের এলাকা খাযরাজদের এলাকার চাইতে অধিকতর উর্বর ছিল। ফলে তাদের মধ্যে নিয়মিত হানাহানি ও যুদ্ধ-বিগ্রহের এটাও একটা কারণ ছিল। ইহূদীরা উভয় গোত্রের উপর কর্তৃত্ব করত। তারা উভয় দলের মধ্যে যুদ্ধ লাগিয়ে দিত। আবার উভয় দলের মধ্যে সন্ধি করে দিত। তাদের মধ্যকার সবচেয়ে বড় ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ছিল হিজরতের পাঁচ বছর পূর্বে সংঘটিত বু‘আছ যুদ্ধ। যাতে আউসরা খাযরাজদের উপর জয়লাভ করে। কিন্তু উভয় গোত্র সর্বদা পুনরায় পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধের আশংকা করত। ফলে তারা নিজেদের মধ্যে মৈত্রী স্থাপন করে এবং উভয় গোত্রের ঐক্যমতে আব্দুল্লাহ বিন উবাই খাযরাজীকে তাদের নেতা নির্বাচন করে। এমতাবস্থায় আখেরী নবীর শুভাগমনে তারা উৎফুল্ল হয় এবং নিজেদের মধ্যকার সব তিক্ততা ভুলে শেষনবী (সাঃ)-কে স্বাগত জানাবার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়। যেমন হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, বু‘আছ যুদ্ধের দিনটিকে আল্লাহ তাঁর রাসূলের আগমনের এবং ‘ইয়াছরিব বাসীদের ইসলামে প্রবেশের অগ্রিম দিবস’ (يَوْمًا قَدَّمَهُ اللهُ لِرَسُولِهِ صـ فِى دُخُولِهِمْ فِى الإِسْلاَمِ) হিসাবে নির্ধারণ করেছিলেন।[1]
উল্লেখ্য যে, আউস ও খাযরাজ ছিলেন আপন দুই ভাই এবং ইসমাঈল-পুত্র নাবেত-এর বংশধর। যারা উত্তর হেজায শাসন করতেন। কিন্তু মালেক বিন ‘আজলান খাযরাজীর গোলাম হুর বিন সুমাইরকে হত্যার কারণে তাদের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায়। যা প্রায় ১২০ বছর যাবৎ চলে। পরে তারা ইয়াছরিবে হিজরত করেন। সেখানে তাদের মধ্যে সর্বশেষ বু‘আছ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যার পাঁচ বছর পর রাসূল (সাঃ)-এর হিজরতের মাধ্যমে ইসলামের বরকতে উভয় দলের মধ্যে দীর্ঘকালীন যুদ্ধের আগুন নির্বাপিত হয় এবং তারা পরস্পরে ভাই ভাই হয়ে যায়। যে বিষয়ে সূরা আলে ইমরান ১০৩ আয়াত নাযিল হয় (তাফসীর ত্বাবারী হা/১৪৭৩, ৭৫৮৯; তাফসীর ইবনু কাছীর)।
২০৭ খ্রিষ্টাব্দে একই সময় বনু খোযা‘আহ গোত্র ইয়ামন থেকে হিজরত করে মক্কার নিকটবর্তী মার্রুয যাহরানে বসতি স্থাপন করে। যারা পরবর্তীকালে মক্কার শাসন ক্ষমতা লাভ করে এবং দীর্ঘদিন উক্ত ক্ষমতায় থাকে। অবশেষে তাদের জামাতা কুরায়েশ নেতা কুছাই বিন কিলাব মক্কার ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেন। জামাতার বংশ হিসাবে বনু খোযা‘আহ সর্বদা বনু হাশেমকে সহযোগিতা করেছে। যা মক্কা বিজয় ও তার পরবর্তীকালেও অব্যাহত ছিল।[2]
মক্কা ও মদীনার সামাজিক অবস্থার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য ছিল এই যে, মক্কার সমাজ ব্যবস্থাপনায় কুরায়েশদের একক প্রভুত্ব ছিল। ধর্মীয় দিক দিয়ে তাদের অধিকাংশ মূর্তিপূজারী ছিল। যদিও সবাই আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী ছিল। হজ্জ ও ওমরাহ করত। ইবরাহীম (আঃ)-এর দ্বীনের উপরে কায়েম আছে বলে তারা নিজেদেরকে ‘হানীফ’ (حَنِيْفٌ) বা ‘আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ’ বলে দাবী করত। বিগত নেককার লোকদের মূর্তির অসীলায় তারা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করত। এই অসীলাপূজার কারণেই তারা মুশরিক জাতিতে পরিণত হয়েছিল এবং তাদের রক্ত হালাল গণ্য হয়েছিল। তারাও রাসূল (সাঃ)-এর প্রচারিত নির্ভেজাল তাওহীদকে তাদের কপট ধর্ম বিশ্বাস ও দুনিয়াবী স্বার্থের বিরোধী সাব্যস্ত করে রাসূল (সাঃ)-এর ও মুসলমানদের রক্তকে হালাল গণ্য করেছিল। মক্কায় মুসলমানরা ছিল দুর্বল ও মযলূম এবং বিরোধী কুরায়েশ নেতারা ছিল প্রবল ও পরাক্রমশালী।
পক্ষান্তরে মদীনায় সমাজ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কারু একক নেতৃত্ব ছিল না। ধর্মীয় দিক দিয়েও তারা এক ছিল না বা বংশধারার দিক দিয়েও এক ছিল না। সর্বশেষ বু‘আছের যুদ্ধে বিপর্যস্ত আউস ও খাযরাজ প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনায় হিজরত করেন। এর দ্বারা মদীনাবাসীদের আন্তরিক কামনা ছিল যে, তাঁর আগমনের মাধ্যমে তাদের মধ্যকার দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অবসান ঘটবে। ফলে এখানে রাসূল (সাঃ) ও মুহাজিরগণ ছিলেন শুরু থেকেই কর্তৃত্বের অধিকারী।
[1]. বুখারী হা/৩৭৭৭; সীরাহ ছহীহাহ ১/২২৭-৩১।
[2]. ইবনু হিশাম ১/৯১, ১১৭; সীরাহ ছহীহাহ ১/২২৯।
মদীনার দল ও উপদলসমূহ (الأحزاب والفرق فى المدينة)
হিজরতকালে যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইয়াছরিবে মূলতঃ দু’দল লোক বসবাস করত। একদল ছিল ইয়াছরিবের পৌত্তলিক মুশরিক সম্প্রদায়। যারা প্রধানতঃ আউস ও খাযরাজ দু’গোত্রে বিভক্ত ছিল। আউসদের নেতা ছিলেন সা‘দ বিন মু‘আয ও খাযরাজদের নেতা ছিলেন সা‘দ বিন ওবাদাহ। মুনাফিক সরদার আব্দুল্লাহ বিন উবাই ইবনে সুলূল ছিলেন খাযরাজ গোত্রভুক্ত। এরা ছিল বিশুদ্ধ আরবী ভাষী। রাসূল (সাঃ)-এর দাদার মাতুল গোষ্ঠী বনু নাজ্জারও ছিল এই গোত্রভুক্ত।
দ্বিতীয় ছিল ইহূদী সম্প্রদায়। খ্রিষ্টানরা যাদেরকে ফিলিস্তীন ও সিরিয়া অঞ্চল থেকে উৎখাত করে বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উপর দখল কায়েম করেছিল। ইহূদীরা শেষনবীর আগমনের অপেক্ষায় এবং তাঁর নেতৃত্বে তাদের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের আশায় ইয়াছরিবে হিজরত করে এসেছিল বহুদিন পূর্বে। এরা ছিল হিব্রুভাষী। কিন্তু পরে আরবীভাষী হয়। এদের প্রধান তিনটি গোত্র বনু ক্বায়নুক্বা‘, বনু নাযীর ও বনু কুরায়যা মদীনার উপকণ্ঠে তাদের তৈরী স্ব স্ব দুর্ভেদ্য দুর্গসমূহে বসবাস করত। দক্ষ ব্যবসায়ী ও সূদী কারবারী হওয়ার কারণে এরা ছিল সর্বাধিক সচ্ছল। চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ও কূট কৌশলের মাধ্যমে এরা আউস ও খাযরাজের মধ্যে সর্বদা যুদ্ধাবস্থা জিইয়ে রাখতো এবং ‘বিভক্ত কর ও শাসন কর’ নীতির মাধ্যমে উভয় গোত্রের উপরে নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতো। এই সূক্ষ্ম পলিসির কারণে তাদের বনু ক্বায়নুক্বা‘ গোষ্ঠী খাযরাজদের মিত্র ছিল এবং বনু নাযীর ও বনু কুরায়যা গোষ্ঠী আউসদের মিত্র ছিল। আসলে তারা উভয়েরই শত্রু ছিল। তাদেরকে তারা সূদী কারবার ও অস্ত্র ব্যবসার ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহার করত। তারা এভাবে আরবদের শোষণ করত। এজন্য তাদের মূর্খতার প্রতি তাচ্ছিল্য করে তারা বলত, لَيْسَ عَلَيْنَا فِي الأُمِّيِّيْنَ سَبِيْلٌ ‘মূর্খদের ব্যাপারে আমাদের কোন দায়িত্ব নেই’ (আলে ইমরান ৩/৭৫)। অর্থাৎ মূর্খদের সম্পদ হরণ করায় ও তাদের অধিকার নষ্ট করায় আমাদের কোন পাপ নেই। সেই সময় ইয়াছরিবে পৌত্তলিক ও ইহূদীদের বাইরে কিছু সংখ্যক খ্রিষ্টানও বসবাস করত। যারা ইহূদীদের ন্যায় ইয়াছরিবে হিজরত করে এসেছিল শেষনবীর আগমন প্রত্যাশায়।
বর্তমান বিশ্বের পরাশক্তিগুলি গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের শ্লোগানের আড়ালে উন্নয়নশীল ও বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে তাদের শোষণ-নির্যাতন, সূদী কারবার ও অস্ত্র ব্যবসা পূর্বের ন্যায় বজায় রেখে চলেছে। মুসলমানদের সম্পদ হরণ করায় ও তাদের অধিকার বিনষ্ট করায় কোন পাপ নেই বলে আজও তাদের আচরণে প্রমাণ পাওয়া যায়। ভূগর্ভের তৈল লুট করার জন্য তারা ভূপৃষ্ঠের মানুষের রক্ত পান করছে গোগ্রাসে। কিন্তু এই রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ারদের রক্ত নেশা মিটছে না মোটেই। এজন্যেই এরা ‘মাগযূব’ (অভিশপ্ত) ও ‘যোওয়াল্লীন’ (পথভ্রষ্ট) বলে কুরআনে অভিহিত হয়েছে।[1]
ইহূদীরা ভেবেছিল, শেষনবী হযরত ইসহাকের বংশে হবেন এবং তাদেরকে সাথে নিয়ে তিনি খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের প্রতি অত্যাচারের প্রতিশোধ নেবেন। তারা ইয়াছরিবের লোকদের হুমকি দিত এই বলে যে, سَيَخْرُجُ نَبِىُّ آخِرِ الزَّمَانِ فَنَتَّبِعُهُ وَنَقْتُلُكُمْ مَعَهُ قَتْلَ عَادٍ وَإِرَمَ ‘আখেরী যামানার নবী সত্বর আগমন করবেন। আমরা তাঁর অনুসারী হব এবং তোমাদের হত্যা করব (বিগত ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি) ‘আদ ও ইরামের ন্যায়’।[2] কিন্তু হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশে শেষনবীর আগমন ঘটায় এবং তিনি হযরত মূসা ও ঈসা (আঃ) উভয়ের সত্যায়ন করায় ইহূদীরা তাঁর শত্রু হয়ে যায়।
পক্ষান্তরে তৃতীয় দল খ্রিষ্টানরা ভেবেছিল যে, শেষনবী এসে তাদের লালিত বিশ্বাস অনুযায়ী কথিত ত্রিত্ববাদ, ঈসার পুত্রত্ববাদ, প্রায়শ্চিত্ববাদ, সন্ন্যাসবাদ ও পোপের ঐশী নেতৃত্ববাদ সমর্থন করবেন। কিন্তু এসবের বিপরীত হওয়ায় তারাও রাসূল (সাঃ)-এর বিরোধী হয়ে গেল। উল্লেখ্য যে, ইহূদী ও নাছারা কারু মধ্যে তাদের ধর্ম প্রচারের ব্যাপারে কোনরূপ সংগ্রামী চেতনা ছিল না। ধর্মের প্রতিপাদ্য তাদের মধ্যে যা লক্ষ্য করা যেত, সেটা ছিল কেবল জাদু-টোনা, ঝাড়-ফুঁক, শুভাশুভ লক্ষণ নির্ধারণ ও অনুরূপ কিছু ক্রিয়া-কর্ম। এ সকল কাজের জন্যই তারা নিজেদেরকে জ্ঞানী-গুণী এবং আধ্যাত্মিক গুরু ও নেতা মনে করত।
চতুর্থ আরেকটি উপদল গড়ে উঠেছিল খাযরাজ গোত্রের আব্দুল্লাহ বিন উবাই ইবনে সুলূলের নেতৃত্বে। বু‘আছ যুদ্ধের পর আউস ও খাযরাজ উভয় গোত্র মিলে তাকে নেতা নির্বাচিত করে। এজন্য তারা বহু মূল্যবান রাজমুকুট তৈরী করে এবং এই প্রথমবারের মত উভয় গোত্র একত্রিত হয়ে তাকে রাজ আসনে বসাতে যাচ্ছিল। এমনি সময়ে রাসূল (সাঃ)-এর আগমন ঘটে এবং উভয় গোত্র তাকে ছেড়ে রাসূল (সাঃ)-কে নেতারূপে বরণ করে। এতে আব্দুল্লাহ ও তার অনুসারীরা মনে মনে ক্ষুব্ধ হয় এবং তাদের সকল ক্ষোভ গিয়ে পড়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপরে। কিন্তু অবস্থা অনুকূল না দেখে তারা চুপ থাকে এবং বছর দেড়েক পরে বদর যুদ্ধের পর হতাশ হয়ে অবশেষে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইসলাম কবুলের ঘোষণা দেয়। তবে আদি বাসিন্দা আউস ও খাযরাজদের অনেকে পূর্বেই ইসলাম কবুল করায় এবং তারাই রাসূল (সাঃ)-কে ও মুহাজিরগণকে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আশ্রয় দেওয়ায় অন্যেরা সবাই চুপ থাকে এবং ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় রাসূল (সাঃ)-এর নেতৃত্ব মেনে নেয়।
উপরোক্ত চারটি দল তথা (১) পৌত্তলিক আউস ও খাযরাজ (২) ইহূদী। বনু ক্বায়নুক্বা, বনু নাযীর ও বনু কুরায়যা। (৩) নাছারা। যারা প্রধানতঃ নাবিত্ব বাজার(سوق النبط) এলাকায় বসবাস করত। তবে সমাজে তাদের তেমন কোন প্রভাব ছিল না। (৪) খাযরাজ গোত্রের আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের গ্রুপ। যারা গোপন ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তে সর্বদা তৎপর ছিল।
এতদ্ব্যতীত (৫) মুহাজির মুসলমানদের নানাবিধ সমস্যা মুকাবিলা করা রাসূল (সাঃ)-এর জন্য বলতে গেলে জ্বলন্ত সমস্যা ছিল। তবে মুহাজিরদের সমস্যা আনছাররাই মিটিয়ে দিত। কেননা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের পরস্পরে ধর্মীয় ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে দিয়েছিলেন। মক্কা থেকে কোন মুহাজির এলেই তারা তাকে সাদরে বরণ করে নিত। ফলে মুহাজিরগণের সমস্যা ছিল পজেটিভ। কিন্তু বিরুদ্ধবাদীদের সমস্যা ছিল নেগেটিভ। যা সর্বদা রাসূল (সাঃ)-কে চিন্তাগ্রস্ত করে রাখতো।
উপরোক্ত সমস্যাবলীর সাথে যোগ হয়েছিল আরেকটি কঠিন সমস্যা। সেটা ছিল (৬) মক্কার মুশরিকদের অপতৎপরতা। তারা মুহাজিরদের ফেলে আসা বাড়ী-ঘর ও ধন-সম্পত্তি জবরদখল করে নিল। তাদের আত্মীয়-স্বজনদের বন্দী ও নির্যাতন করতে লাগল। অধিকন্তু তাদের ধর্মীয় ও ব্যবসায়িক নেতৃত্বের প্রভাব খাটিয়ে আরব উপদ্বীপের অন্যান্য ব্যবসায়ী ও সাধারণ লোকদের উস্কানি দিতে লাগল, যাতে মদীনায় খাদ্য-শস্য ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ তারা বন্ধ করে দেয়। ফলে মদীনায় পণ্য আমদানী হ্রাস পেতে থাকল। যা মক্কার মুশরিকদের সাথে মদীনার মুসলমানদের মধ্যে ক্রমে যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরী করে ফেলল।
[1]. সূরা ফাতিহা ৭ আয়াত; তিরমিযী হা/২৯৫৪; ছহীহুল জামে‘ হা/৮২০২।
[2]. ইবনু হিশাম ১/৪২৯; আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ পৃঃ ১৪৬, সনদ হাসান।
মাক্কী ও মাদানী জীবনের প্রধান পার্থক্য সমূহ (الفروق الرئيسية بين الحياة المكية والمدنية)
মাক্কী ও মাদানী জীবনের মধ্যে প্রধান পার্থক্য ছিল এই যে, মক্কায় জন্মস্থান হ’লেও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও মুসলমানগণ সেখানে ছিলেন দুনিয়াবী শক্তির দিক দিয়ে দুর্বল ও নির্যাতিত। পক্ষান্তরে মাদানী জীবনের প্রথম থেকেই নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের বাগডোর ছিল রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও মুসলমানদের হাতে। এখানে বিরোধীরা স্থানীয় হ’লেও তারা ছিল নিষ্প্রভ। ফলে মদীনার অনুকূল সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশে ইসলামকে পূর্ণতা দানের সুযোগ আসে। আর সেকারণেই ইসলামের যাবতীয় হারাম-হালাল ও আর্থ-সামাজিক বিধি-বিধান একে একে মাদানী জীবনে অবতীর্ণ হয় ও তা বাস্তবায়িত হয়। অতঃপর বিদায় হজ্জের সময় আল্লাহর পক্ষ হ’তে পূর্ণতার সনদ হিসাবে আয়াত নাযিল হয়- اَلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِيْ وَرَضِيْتُ لَكُمُ الْإِسْلاَمَ دِيْنًا ‘আজকের দিনে আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপরে আমার অনুগ্রহকে সম্পূর্ণ করে দিলাম ও তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’ (মায়েদাহ ৫/৩)। বিদায় হজ্জের সময় ১০ম হিজরীর ৯ই যিলহাজ্জ শুক্রবার মাগরিবের পূর্বে মক্কায় আরাফা ময়দানে অবস্থানকালে এ আয়াত নাযিল হয়। এর মাত্র ৮৩ দিন পর ১১ হিজরীর ১লা রবীউল আউয়াল সোমবার মদীনায় রাসূল (সাঃ) মৃত্যু বরণ করেন।
আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, অত্র আয়াত নাযিলের পর বিধি-বিধান সম্পর্কিত আর কোন আয়াত নাযিল হয়নি। তবে উৎসাহ প্রদান ও ভীতি প্রদর্শন মূলক কয়েকটি মাত্র আয়াত নাযিল হয়। এভাবে আদি পিতা আদম (আঃ) থেকে আল্লাহর পক্ষ হ’তে সত্য দ্বীন নাযিল হওয়ার যে সিলসিলা জারী হয়েছিল, শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর মাধ্যমে মদীনায় তার পরিসমাপ্তি ঘটে এবং আল্লাহ প্রেরিত ইলাহী বিধানের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয়। ফালিল্লা-হিল হাম্দ।
ইহূদীদের কপট চরিত্র (النفاق الطبيعى لليهود) :
হিজরতের পূর্ব থেকেই ইহূদীরা মক্কায় রাসূল (সাঃ)-এর আবির্ভাব সম্পর্কে জানত। এখন যখন তিনি মদীনায় হিজরত করে এলেন এবং মানুষের পারস্পরিক ব্যবহার, লেন-দেন, ব্যবসা-বাণিজ্য সকল ক্ষেত্রে বিশ্বস্ততা ও পবিত্রতার পথ অবলম্বন করলেন। যার ফলে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ও হিংসা-হানাহানিতে বিপর্যস্ত ইয়াছরিবের গোত্র সমূহের মধ্যকার শীতল সম্পর্ক ক্রমেই উষ্ণ, মধুর ও শক্তিশালী হয়ে উঠতে লাগল, তখন তা ইহূদীদের মনে দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল। তাদের আশংকা হ’ল যে, এইভাবে যদি সবাই মুসলমান হয়ে যায় ও আপোষে ভাই ভাই হয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তাহ’লে তাদের ‘বিভক্ত কর ও শোষণ কর’ নীতি মাঠে মারা যাবে। এর ফলে তাদের সামাজিক নেতৃত্ব খতম হয়ে যাবে। সাথে সাথে ইসলামে সূদ হারাম হওয়ার কারণে তাদের রক্তচোষা সূদী কারবার একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে, যা তাদের পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় ধ্বস নামাবে। এমনকি চক্রবৃদ্ধি হারে ফেঁপে ওঠা সূদের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ার কারণে অত্যাচারমূলক চুক্তির ফলে ইয়াছরিব বাসীদের যে বিপুল ধন-সম্পদ তারা কুক্ষিগত করেছিল, তার সবই তাদেরকে ফেরৎ দিতে বাধ্য হ’তে হবে। ফলে তারা রাসূল (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে গোপনে শত্রুতা শুরু করে দেয়। পরে যা প্রকাশ্য রূপ ধারণ করে। তাদের কপট চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ রাসূল (সাঃ)-এর মদীনায় পদার্পণের প্রথম দিনেই ঘটে। নিম্নের দু’টি ঘটনা তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।-
দু’টি দৃষ্টান্ত (نظيران للنفاق) :
(১) আবু ইয়াসির বিন আখত্বাব-এর আগমন (قدوم ياسر بن أخطب) : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনায় আগমনের পর প্রথম তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বনু নাযীর গোত্রের অন্যতম নেতা আবু ইয়াসির বিন আখত্বাব। তিনি তার লোকদের নিকট ফিরে গিয়ে বলেন,أَطِيْعُوْنِىْ فَإِنَّ هَذَا هُوَ النَّبِىُّ الَّذِىْ كُنَّا نَنْتَظِرُ ‘তোমরা আমার আনুগত্য কর। কেননা ইনিই সেই নবী আমরা যার অপেক্ষায় ছিলাম’। কিন্তু হুয়াই বিন আখত্বাব, যিনি তার ভাই ও গোত্রের নেতা ছিলেন, তার বিরোধিতার কারণে সাধারণ ইহূদীরা ইসলাম কবুল করা হ’তে বিরত থাকে।[1]
উল্লেখ্য যে, ইহূদী আলেম ও সমাজনেতাদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছিলেন, لَوْ آمَنَ بِىْ عَشْرَةٌ مِنَ الْيَهُوْدِ لَآمَنَ بِى الْيَهُوْدُ ‘যদি আমার উপরে দশজন ইহূদী নেতা ঈমান আনত, তাহ’লে গোটা ইহূদী সম্প্রদায় আমার উপরে ঈমান আনতো’।[2] এতে বুঝা যায় যে, সমাজনেতা ও আলেমগণের দায়িত্ব সর্বাধিক। অতএব তাদের সাবধান হওয়া কর্তব্য।
(২) আব্দুল্লাহ বিন সালাম-এর ইসলাম গ্রহণে প্রতিক্রিয়া(رجعية من إسلام عبد الله بن سلام) : ক্বোবার পরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন ইয়াছরিবে তাঁর দাদার মাতুল গোষ্ঠী বনু নাজ্জার গোত্রে অবতরণ করেন, তখন সেখানে গিয়ে উপস্থিত হ’লেন ইহূদীদের সবচেয়ে বড় আলেম আব্দুল্লাহ বিন সালাম। তিনি ছিলেন বনু ক্বায়নুক্বা‘ ইহূদী গোত্রের অন্তর্ভুক্ত (আবুদাঊদ হা/৩০০৫)। তিনি রাসূল (সাঃ)-কে এমন কিছু প্রশ্ন করলেন, যার উত্তর নবী ব্যতীত কারু পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। সব প্রশ্নের সঠিক জবাব পেয়ে তিনি সাথে সাথে মুসলমান হয়ে গেলেন। অতঃপর তিনি রাসূল (সাঃ)-কে সাবধান করে দিলেন এই বলে যে, إِنَّ الْيَهُوْدَ قَوْمٌ بُهُتٌ إِنْ عَلِمُوْا بِإِسْلاَمِىْ قَبْلَ أَنْ تَسْأَلَهُمْ بَهَتُوْنِىْ عِنْدَكَ ‘ইহূদীরা হ’ল মিথ্যা অপবাদ দানকারী এক ঘৃণিত সম্প্রদায়। আপনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করার আগেই যদি তারা আমার ইসলাম গ্রহণ করার বিষয়টি জেনে ফেলে, তাহ’লে তারা আপনার নিকটে আমার সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ দিবে’। তখন তিনি আব্দুল্লাহকে পাশেই আত্মগোপন করতে বলে ইহূদীদের ডেকে পাঠালেন। তারা এলে তিনি তাদের নিকটে আব্দুল্লাহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। জবাবে তারা বলল,سَيِّدُنَا وَابْنُ سَيِّدِنَا، خَيْرُنَا وَابْنُ خَيْرِنَا ‘আমাদের নেতা এবং আমাদের নেতার পুত্র। আমাদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি এবং আমাদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির পুত্র’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, وَأَعْلَمُنَا وَابْنُ أَعْلَمِنَا ‘আমাদের মধ্যে সেরা জ্ঞানী ও সেরা জ্ঞানীর পুত্র’ (বুখারী হা/৩৯১১)। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, أَفَرَأَيْتُمْ إِنْ أَسْلَمَ عَبْدُ اللهِ؟ ‘আচ্ছা যদি আব্দুল্লাহ মুসলমান হয়ে যায়’? জবাবে তারা দু’বার বা তিনবার বলল, أَعَاذَهُ اللهُ مِنْ ذَلِكَ ‘আল্লাহ তাকে এ থেকে রক্ষা করুন’! অতঃপর আব্দুল্লাহ বিন সালাম গোপন স্থান থেকে বেরিয়ে এসে উচ্চকণ্ঠে কালেমা শাহাদাত পাঠ করলেন। এটা শোনামাত্র ইহূদীরা বলে উঠলো, شَرُّنَا وَابْنُ شَرِّنَا ‘আমাদের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি ও নিকৃষ্ট ব্যক্তির পুত্র’।[3] আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রাঃ) তখন তাদেরকে বললেন,يَا مَعْشَرَ الْيَهُوْدَ اتَّقُوا اللهَ فَوَ اللهِ الَّذِىْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ، إِنَّكُمْ لَتَعْلَمُوْنَ أَنَهُ رَسُوْلُ اللهِ وَأَنَّهُ جَاءَ بِحَقٍّ ‘হে ইহূদী সম্প্রদায়! আল্লাহকে ভয় কর। আল্লাহর কসম, যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, তোমরা ভালভাবেই জানো যে, ইনি আল্লাহর রাসূল এবং ইনি সত্যসহ আগমন করেছেন’। জবাবে তারা বলল, كَذَبْتَ ‘তুমি মিথ্যা বলছ’।[4] বলা বাহুল্য এটাই ছিল ইহূদীদের সম্পর্কে রাসূল (সাঃ)-এর প্রথম তিক্ত অভিজ্ঞতা, যা তিনি মদীনায় পদার্পণের শুরুতেই অর্জন করেন।
আজকেও ইহূদী-নাছারাদের উক্ত বদস্বভাব অব্যাহত আছে। তাদের মিডিয়াগুলি রাসূল (সাঃ) ও ইসলামের বিরুদ্ধে সর্বদা লাগামহীনভাবে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। সেদিন যেমন মদীনার মুনাফিকরা ইহূদীদের দোসর ছিল, আজও তেমনি মুসলিম নামধারী বস্ত্তবাদীরা তাদের দোসর হিসাবে কাজ করছে।
[1]. বুখারী ফৎহসহ হা/৩৯৩৯-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য, ৭/২৭৫ পৃঃ। উল্লেখ্য যে, ইহূদী নেতা হুয়াই বিন আখত্বাব সম্পর্কে তার কন্যা ছাফিইয়াহ, যিনি পরবর্তীতে রাসূল (সাঃ)-এর স্ত্রী হয়ে উম্মুল মুমেনীন রূপে বরিত হন, তিনি বলেন, আমি আমার বাপ-চাচাদের নিকটে তাদের সকল সন্তানের মধ্যে সর্বাধিক প্রিয় ছিলাম এবং সকলের আগেই আমাকে কোলে তুলে নিয়ে তারা আদর করতেন। যেদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রথম ইয়াছরিবে আগমন করেন ও ক্বোবায় বনু ‘আমর বিন ‘আওফের গোত্রে অবতরণ করেন, সেদিন অতি প্রত্যুষে আমার পিতা ও চাচা রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হন। অতঃপর সন্ধ্যার দিকে তারা ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থায় গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। আমি ছুটে তাদের কাছে গেলাম। কিন্তু আল্লাহর কসম তারা এত চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন যে, আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না। এ সময় আমি আমার চাচাকে বলতে শুনলাম তিনি আমার আববাকে বলছেন, أَهُوَ هُوَ؟ ‘ইনিই কি তিনি? আববা বললেন, نَعَمْ وَاللهِ ‘আল্লাহর কসম, ইনিই তিনি’। চাচা বললেন, فَمَا فِي نَفْسِكَ مِنْهُ؟ ‘এখন তাঁর সম্পর্কে আপনার চিন্তা কী’? আববা বললেন, عَدَاوَتُهُ وَاللهِ مَا بَقِيتُ ‘স্রেফ শত্রুতা। আল্লাহর কসম! যতদিন আমি বেঁচে থাকব’ (ইবনু হিশাম ১/৫১৯; আল-বিদায়াহ ৩/২১২, আর-রাহীক্ব ১৮১ পৃঃ)। বর্ণনাটির সনদ মুনক্বাতি‘ বা যঈফ (ঐ, তা‘লীক্ব ১২২ পৃঃ)।
অবশ্য মুসলমানদের প্রতি ইহূদীদের হিংসা ও শত্রুতা প্রমাণের জন্য এইরূপ যঈফ বর্ণনার আশ্রয় নেওয়ার প্রয়োজন নেই। এজন্য পবিত্র কুরআনের সূরা বাক্বারায় বর্ণিত ১০৯, ৮৯, ১৪৬, ১২০ ও সূরা মায়েদাহ ৫১ আয়াতগুলিই যথেষ্ট।
[2]. বুখারী হা/৩৯৪১, ‘আনছারদের মর্যাদা’ অধ্যায় ৫২ অনুচ্ছেদ।
[3]. বুখারী হা/৩৩২৯; মিশকাত হা/৫৮৭০, ‘রাসূল (সাঃ)-এর ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়-২৯, ‘মু‘জিযা’ অনুচ্ছেদ-৭।
[4]. বুখারী হা/৩৯১১ ‘আনছারদের মর্যাদা’ অধ্যায়, ৪৫ অনুচ্ছেদ।
ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার গোড়াপত্তন (تأسيس المجةمع الإسلامى فى المدينة)
পূর্বোক্ত সামগ্রিক অবস্থা সম্মুখে রেখে এক্ষণে আমরা মদীনায় নতুন সমাজ ব্যবস্থার রূপায়ণ প্রত্যক্ষ করব। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে একই সঙ্গে আভ্যন্তরীণ সংশোধন ও বাইরের অবস্থা সামাল দিয়ে চলতে হয়েছে। নতুন জাতি গঠনের প্রধান ভিত্তি হ’ল আধ্যাত্মিক কেন্দ্র স্থাপন। সেজন্য তিনি ক্বোবায় প্রথম মসজিদ নির্মাণের পর এবার মদীনায় প্রধান মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেন।
মসজিদে নববী নির্মাণ (بناء المسجد النبوى)
মদীনায় প্রবেশ করে রাসূল (সাঃ)-এর উটনী যে স্থানে প্রথম বসে পড়েছিল, সেই স্থানটিই হ’ল পরবর্তীতে মসজিদে নববীর দরজার স্থান। স্থানটির মালিক ছিল দু’জন ইয়াতীম বালক সাহল ও সোহায়েল বিন রাফে‘ বিন ‘আমর। এটি তখন তাদের খেজুর শুকানোর চাতাল ছিল (ইবনু হিশাম ১/৪৯৫)। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দশ দীনার মূল্যে স্থানটি খরীদ করলেন। আবুবকর (রাঃ) মূল্য পরিশোধ করলেন।[1] অতঃপর তার আশপাশের মুশরিকদের কবরগুলি উঠিয়ে ফেলা হয় এবং ভগ্নস্তূপগুলি সরিয়ে স্থানটি সমতল করা হয়। গারক্বাদের খেজুর গাছগুলি উঠিয়ে সেগুলিকে ক্বিবলার দিকে সারিবদ্ধভাবে পুঁতে দেওয়া হয়’ (বুখারী হা/৪২৮)। অতঃপর খেজুর গাছ ও তার পাতা দিয়ে মসজিদ তৈরী হয়। চার বছর পর এটি কাঁচা ইট দিয়ে নির্মাণ করা হয়।[2] ঐ সময় আল্লাহর হুকুমে ক্বিবলা ছিল বায়তুল মুক্বাদ্দাস, যা ছিল ইহূদীদের ক্বিবলা এবং মদীনা থেকে উত্তর দিকে। মসজিদের ভিত ছিল প্রায় তিন হাত উঁচু। দরজা ছিল তিনটি। যার দু’বাহুর স্তম্ভগুলি ছিল পাথরের, মধ্যের খাম্বাগুলি খেজুর বৃক্ষের, দেওয়াল কাঁচা ইটের, ছাদ খেজুর পাতার এবং বালু ও ছোট কংকর বিছানো মেঝে- এই নিয়ে তৈরী হ’ল মসজিদে নববী, যা তখন ছিল ৭০×৬০×৫ হাত মোট ৪২০০ বর্গ হাত আয়তন বিশিষ্ট। যেখানে বর্ষায় বৃষ্টি পড়ত। ১৬ বা ১৭ মাস পরে ক্বিবলা পরিবর্তিত হ’লে উত্তর দেওয়ালের বদলে দক্ষিণ দেওয়ালের দিকে ক্বিবলা ঘুরে যায়। ফলে পিছনে একমাত্র দরজাটিই এখন ক্বিবলা হয়েছে।[3] কেননা মক্কা হ’ল মদীনা থেকে দক্ষিণ দিকে।
‘উবাদাহ বিন ছামেত (রাঃ) বলেন, আনছারগণ মাল জমা করে রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে আসেন এবং বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এদিয়ে আপনি মসজিদটি আরও সুন্দরভাবে নির্মাণ করুন। কতদিন আমরা এই ছাপড়ার নীচে ছালাত আদায় করব? জবাবে রাসূল (সাঃ) বলেন,مَا بِيْ رَغْبَةٌ عن أخِي موسى، عَرِيْشٌ كَعَريشِ مُوسى ‘আমার ভাই মূসার ছাপড়ার ন্যায় ছাপড়া থেকে ফিরে আসতে আমার কোন আগ্রহ নেই’।[4]
[1]. আর-রাহীক্ব ১৮৪ পৃঃ; বুখারী ফৎহসহ হা/৩৯০৬-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।
[2]. বুখারী ফৎহসহ হা/৩৯০৬ ও ৩৫৩৪-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।
[3]. মুহাম্মাদ ইলিয়াস আব্দুল গণী, তারীখুল মাসজিদিন নববী আশ-শারীফ (মদীনা : ১ম সংস্করণ ১৪১৬/১৯৯৬ খৃ.) ৪১ পৃঃ।
[4]. বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত ২/৪১৩; মুরসাল ছহীহ, ছহীহাহ হা/৬১৬।
নির্মাণ কাজে রাসূল (সাঃ) (مشاركة الرسول صـ فى بناء المسجد النبوى)
মসজিদ নির্মাণে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সশরীরে অংশগ্রহণ করেন। তিনি নিজ হাতে ইট ও পাথর বহন করেন। এ সময় তিনি সাথীদের উৎসাহিত করে বলতেন, اللَّهُمَّ لاَ عَيْشَ إِلاَّ عَيْشُ الْآخِرَه + فَاغْفِرِ الْأَنْصَارَ وَالْمُهَاجِرَةَ ‘হে আল্লাহ! আখেরাতের আরাম ব্যতীত কোন আরাম নেই। অতএব তুমি আনছার ও মুহাজিরদের ক্ষমা কর’ (বুখারী হা/৪২৮)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, اللَّهُمَّ لاَ خَيْرَ إِلاَّ خَيْرُ الْآخِرَهْ + فَانْصُرِ الْأَنْصَارَ وَالْمُهَاجِرَةَ ‘হে আল্লাহ! আখেরাতের কল্যাণ ব্যতীত কোন কল্যাণ নেই। অতএব তুমি আনছার ও মুহাজিরদের সাহায্য কর’ (বুখারী হা/৩৯৩২)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, اللَّهُمَّ إِنَّ الأَجْرَ أَجْرُ الآخِرَهْ + فَارْحَمِ الأَنْصَارَ وَالْمُهَاجِرَهْ ‘হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই পুরস্কার হ’ল আখেরাতের পুরস্কার। অতএব তুমি আনছার ও মুহাজিরদের প্রতি অনুগ্রহ কর’ (বুখারী হা/৩৯০৬)।
মসজিদ নির্মাণের বরকতমন্ডিত কাজের প্রতি উজ্জীবিত করার জন্য তিনি বলেন, هَذَا الْحِمَالُ لاَ حِمَالَ خَيْبَرْ + هَذَا أَبَرُّ رَبَّنَا وَأَطْهَرْ ‘এই বোঝা খায়বরের বোঝা নয়। হে আমাদের প্রভু! একাজ অতীব পুণ্যময় ও পবিত্র’ (বুখারী হা/৩৯০৬)। রাসূল (সাঃ)-এর নিজ হাতে কাজ করায় উৎসাহিত হয়ে ছাহাবীগণ গেয়ে ওঠেন- لَئِنْ قَعَدْنَا وَالنَّبِيُّ يَعْمَلُ + لَذَاكَ مِنَّا الْعَمَلُ الْمُضَلَّلُ ‘যদি আমরা বসে থাকি, আর নবী কাজ করেন, তবে সেটা আমাদের পক্ষ থেকে হবে নিতান্তই ভ্রান্ত কাজ’ (বুখারী ফৎহসহ হা/৩৯০৬)।
আযানের প্রবর্তন (بدء الأذان)
মসজিদ নির্মিত হওয়ার পর মুছল্লীদের পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতে আহবানের জন্য পরামর্শসভা বসে। ছাহাবীগণ বিভিন্ন পরামর্শ দেন। কিন্তু কোনরূপ সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠক স্থগিত হয়ে যায়। পরদিন আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ বিন ‘আব্দে রবিবহী (রাঃ) প্রথমে এসে রাসূল (সাঃ)-কে বর্তমান আযানের শব্দ সমূহ সহ স্বপ্নবৃত্তান্ত শুনালে তিনি তার সত্যায়ন করেন। অতঃপর উচ্চকণ্ঠের অধিকারী বেলালকে আযান দেওয়ার নির্দেশ দেন। আযানের ধ্বনি শুনে কাপড় ঘেঁষতে ঘেঁষতে ওমর (রাঃ) দৌড়ে এসে বললেন ‘হে আল্লাহর রাসূল! যিনি আপনাকে সত্য সহ প্রেরণ করেছেন, সেই আল্লাহর কসম করে বলছি, আমিও একই স্বপ্ন দেখেছি’। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ফালিল্লা-হিল হামদ’ ‘আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা’।[1] একটি বর্ণনা মতে ঐ রাতে ১১ জন ছাহাবী একই আযানের স্বপ্ন দেখেন’।[2] উল্লেখ্য যে, ওমর ফারূক (রাঃ) ২০ দিন পূর্বে উক্ত স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ আগেই বলেছে দেখে লজ্জায় তিনি নিজের কথা প্রকাশ করেননি।[3]
বলা বাহুল্য, এই আযান কেবল ধ্বনি মাত্র ছিল না। বরং এ ছিল শিরকের অমানিশা ভেদকারী আপোষহীন তাওহীদের এক দ্ব্যর্থহীন আহবান। যা কেবল সে যুগে মদীনার মুশরিক ও ইহূদী-নাছারাদের হৃদয়কে ভীত-কম্পিত করেনি, বরং যুগে যুগে প্রতিষ্ঠিত শিরকী সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এ ছিল তাওহীদ ভিত্তিক সমাজ বিপ্লবের উদাত্ত ঘোষণা। এ আযান যুগে যুগে প্রত্যেক আল্লাহপ্রেমীর হৃদয়ে এনে দেয় এক অনন্য প্রেমের অনবদ্য মূর্ছনা। যার আহবানে সাড়া দিয়ে মুমিন পাগলপারা হয়ে ছুটে চলে মসজিদের পানে। লুটিয়ে পড়ে সিজদায় স্বীয় প্রভুর সকাশে। তনুমন ঢেলে দিয়ে প্রার্থনা নিবেদন করে আল্লাহর দরবারে। বাংলার কবি কায়কোবাদ (১৮৫৭-১৯৫১ খৃ.) তাই কত সুন্দরই না গেয়েছেন-
কে ঐ শুনালো মোরে আযানের ধ্বনি
মর্মে মর্মে সেই সুর বাজিল কি সুমধুর
আকুল হইল প্রাণ নাচিল ধমনী
কে ঐ শুনালো মোরে আযানের ধ্বনি’।-
ইহূদীদের বাঁশি, নাছারাদের ঘণ্টাধ্বনি ও পৌত্তলিকদের বাদ্য-বাজনার বিপরীতে মুসলমানদের আযান ধ্বনির মধ্যেকার পার্থক্য আসমান ও যমীনের পার্থক্যের ন্যায়। আযানের মধ্যে রয়েছে ধ্বনির সাথে বাণী, রয়েছে হৃদয়ের প্রতিধ্বনি, রয়েছে তাওহীদের বিচ্ছুরণ এবং রয়েছে আত্মনিবেদন ও আত্মকল্যাণের এক হৃদয়ভেদী অনুরণন। এমন বহুমুখী অর্থবহ মর্মস্পর্শী ও সুউচ্চ আহবানধ্বনি পৃথিবীর কোন ধর্মে বা কোন জাতির মধ্যে নেই। ১ম হিজরী সনে আযান চালু হওয়ার পর থেকে অদ্যাবধি তা প্রতি মুহূর্তে ধ্বনিত হচ্ছে পৃথিবীর দিকে দিকে অবিরামভাবে অপ্রতিহত গতিতে। আহ্নিক গতির কারণে ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর প্রতি স্থানে সর্বদা ছালাতের সময়ের পরিবর্তন হচ্ছে। সেই সাথে পরিবর্তন হচ্ছে আযানের সময়ের। ফলে পৃথিবীর সর্বত্র সর্বদা প্রতিটি মিনিটে ও সেকেন্ডে আযান উচ্চারিত হচ্ছে। আর সেই সাথে ধ্বনিত হচ্ছে তাওহীদ ও রিসালাতের সাক্ষ্যবাণী এবং উচ্চকিত হচ্ছে সর্বত্র আল্লাহর মহত্ত্ব ও বড়ত্বের অনন্য ধ্বনি। যার সাক্ষী হচ্ছে প্রতিটি সজীব ও নির্জীব বস্ত্ত ও প্রাণী। এমনকি পানির মধ্যে বিচরণকারী মৎস্যকুল। মানুষ যদি কখনো এ আহবানের মর্ম বুঝে এগিয়ে আসে, তবে পৃথিবী থেকে দূর হয়ে যাবে সকল প্রকার শিরকী জাহেলিয়াতের গাঢ় অমানিশা। টুটে যাবে মানুষের প্রতি মানুষের দাসত্ব নিগড়। প্রতিষ্ঠিত হবে আল্লাহর গোলামীর অধীনে সকল মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা। শৃংখলমুক্ত হবে সত্য, ন্যায় ও মানবতা। আযান তাই সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নিরংকুশ উলূহিয়াতের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা। বিশ্বমানবতার একক চেতনা ও কল্যাণের হৃদয়স্রাবী দ্যোতনা।
[1]. আবুদাঊদ হা/৪৯৯, সনদ হাসান ছহীহ; মিশকাত হা/৬৫০।
[2]. মিরক্বাত শরহ মিশকাত ‘আযান’ অনুচ্ছেদ ২/১৪৯ পৃঃ।
[3]. আবুদাঊদ (আওনুল মা‘বূদ সহ) হা/৪৯৪ ‘আযানের সূচনা’ অনুচ্ছেদ।
আহলে ছুফফাহ (أهل الصفة)
মক্কা থেকে আগত মুহাজিরগণ মদীনায় এসে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতেন। অতঃপর মসজিদে নববী নির্মাণ শেষে তার পিছনে একটি ছাপড়া দেওয়া হয়। যেখানে নিরাশ্রয় মুহাজিরগণ এসে বসবাস করতেন। ‘ছুফফাহ’ অর্থ ছাপড়া। যা দিয়ে ছায়া করা হয়। এভাবে মুহাজিরগণই ছিলেন আহলে ছুফফার প্রথম দল। যাঁদেরকেصُفَّةُ الْمُهَاجِرِينَ বলা হ’ত (আবুদাঊদ হা/৪০০৩)। এছাড়া অন্যান্য স্থান হ’তেও অসহায় মুসলমানরা এসে এখানে সাময়িকভাবে আশ্রয় নিতেন (আহমাদ হা/১৬০৩১)। পরবর্তীতে কোন ব্যবস্থা হয়ে গেলে তারা সেখানে চলে যেতেন। এখানে সাময়িক আশ্রয় গ্রহণকারীগণ ইতিহাসে ‘আহলে ছুফফাহ’ বা ’আছহাবে ছুফফাহ’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। বিখ্যাত হাদীছবেত্তা ছাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) এখানকার অন্যতম সদস্য ও দায়িত্বশীল ছিলেন। যিনি ওমর (রাঃ)-এর যুগে বাহরায়েন এবং মু‘আবিয়া (রাঃ) ও মারওয়ানের সময় একাধিকবার মদীনার গবর্ণর নিযুক্ত হন। তিনি ৫৭ হিজরীতে ৭৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।[1]
অনেক সময় মদীনার ছাহাবীগণও ‘যুহ্দ’ ও দুনিয়াত্যাগী জীবন যাপনের জন্য তাদের মধ্যে এসে বসবাস করতেন। যেমন কা‘ব বিন মালেক আনছারী, হানযালা বিন আবু ‘আমের ‘গাসীলুল মালায়েকাহ’, হারেছাহ বিন নু‘মান আনছারী প্রমুখ। চাতালটি যথেষ্ট বড় ছিল। কেননা এখানে যয়নব বিনতে জাহশের সাথে রাসূল (সাঃ)-এর বিবাহের ওয়ালীমা খানায় প্রায় তিনশ’র মত মানুষ(كَانُوا زُهَاءَ ثَلاثِمِائَةٍ) জমা হয়েছিলেন।[2] তাদের সংখ্যা কম-বেশী হ’ত। তবে সাধারণতঃ সর্বদা ৭০ জনের মত থাকতেন। কখনো অনেক বেড়ে যেত। খাযরাজ নেতা সা‘দ বিন ওবাদাহ (রাঃ) একবার তাদের মধ্যে থেকে একাই আশি জনকে মেহমানদারী করেছিলেন।
[1]. তাহযীবুত তাহযীব, ক্রমিক সংখ্যা ১২১৬, ১২/২৮৮ পৃঃ; মুসলিম হা/৮৭৭; মিশকাত হা/৮৩৯। যে সকল বিদ্বান আবু হুরায়রা (রাঃ)-কে ‘গায়ের ফক্বীহ’ বলেন, তারা বিষয়টি লক্ষ্য করুন। কেননা ঐরূপ কোন ব্যক্তি গবর্ণরের মত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আসীন হ’তে পারেন না। যেমন হানাফী উছূলে ফিক্বহ বা ব্যবহারিক আইন সূত্রে বলা হয়েছে, الرَّاوِى إن عُرِفَ بالفقه والةَّقَدُّم فى الإجةهاد كالخلفاء الراشدين والعَبَادِلَة كان حديثُهُ حُجَّةً يُةْرَكُ به القياسُ... وإن عُرِفَ بالعَدَالَةِ والضَّبْطِ دُون الفقه كأنس وأبى هريرة، إِنْ وَافَقَ حديثُهُ القياسَ عُمِلَ به وإن خالفه لم يُةْرَكْ الا بالضَّرُورة- ‘রাবী যদি ফিক্বহ ও ইজতিহাদে অগ্রগামী হওয়ার ব্যাপারে প্রসিদ্ধ হন, যেমন চার খলীফা ও চার আব্দুল্লাহ, তাহ’লে তাঁর হাদীছ দলীল হিসাবে গণ্য হবে এবং সে অবস্থায় ক্বিয়াস পরিত্যক্ত হবে।... আর যদি ফিক্বহ ব্যতীত কেবল ন্যায়নিষ্ঠা ও তীক্ষ্ণ স্মৃতির ব্যাপারে প্রসিদ্ধ হন, যেমন আনাস ও আবু হুরায়রা; যদি তাঁর হাদীছ ক্বিয়াসের অনুকূলে হয়, তাহ’লে তার উপরে আমল করা যাবে। আর যদি তার বিপরীত হয়, তাহ’লে তা পরিত্যাগ করা যাবে না বিশেষ প্রয়োজন ব্যতীত’ (আহমাদ মোল্লা জিয়ূন (মৃ. ১১৩০ হি.), নূরুল আনওয়ার (দেউবন্দ মাকতাবা থানবী, ইউপি, ভারত : এপ্রিল ১৯৮৩) ‘রাবীদের প্রকারভেদ’ অধ্যায়, ‘রাবীর অবস্থা সমূহ’ অনুচ্ছেদ ১৮২-৮৩ পৃঃ)। এ কথার প্রতিবাদ করেন হেদায়ার ভাষ্যকার প্রখ্যাত হানাফী ফক্বীহ কামাল ইবনুল হুমাম (৭৯০-৮৬১ হি.)। তিনি বলেন, كَيْفَ؟ وهو لا يَعْمَلُ بِفَتْوَى غيره وكان يُفْتِى فى زمان الصحابة رضوان الله تعالى عليهم وكان يُعَارِضُ أَجِلَّةَ الصحابة كإبن عباس... ‘এটা কিভাবে হ’তে পারে? অথচ তিনি অন্যের ফাৎওয়ার উপর আমল করতেন না। তিনি ছাহাবায়ে কেরামের যামানায় ফাৎওয়া দিতেন এবং তিনি ইবনু আববাসের ন্যায় বড় বড় ছাহাবীর ফাৎওয়ার বিরোধিতা করতেন... (ঐ, পৃঃ ১৮৩ টীকা -৪)।
উল্লেখ্য যে, আবু হুরায়রা (রাঃ) ছিলেন সর্বাধিক হাদীছবেত্তা ছাহাবী। অতএব ফাৎওয়া দেওয়ার অধিকার তাঁরই সবচেয়ে বেশী হওয়া উচিত। তিনি ছিলেন হাদীছ মুখস্থ করা বিষয়ে রাসূল (সাঃ)-এর বিশেষ দো‘আ প্রাপ্ত ছাহাবী (বুখারী হা/১১৯)। যাঁর মুখস্থকৃত হাদীছের সংখ্যা ছিল ৫৩৭৪। তিনি সহ ৭জন শ্রেষ্ঠ হাদীছ বর্ণনাকারী ছাহাবী হ’লেন যথাক্রমে আব্দুল্লাহ বিন ওমর ২৬৩০, আনাস বিন মালিক ২২৮৬, আয়েশা (রাঃ) ২২১০, আব্দুল্লাহ বিন আববাস ১৬৬০, জাবের বিন আব্দুল্লাহ ১৫৪০ এবং আবু সাঈদ খুদরী ১১৭০। বাকী ছাহাবীগণ এরপরের।
[2]. ইবনু আবী হাতেম হা/১৭৭৫৯, তাফসীর সূরা আহযাব ৫৩-৫৪ আয়াত; ইবনু কাছীর, তাফসীর ঐ।
সংখ্যা (عدد أهل الصفة)
আবু নু‘আইম তাঁর ‘হিলইয়াতুল আউলিয়া’ গ্রন্থে আছহাবে ছুফফাহর একশ’র অধিক নাম লিপিবদ্ধ করেছেন। যাদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিলেন, হযরত আবু হুরায়রা দাওসী, আবু যার গিফারী আনছারী, যিনি স্বেচ্ছায় সেখানে অবস্থান করতেন। ওয়াছেলা বিন আসক্বা‘, কা‘ব বিন মালেক, সালমান ফারেসী, হানযালা বিন আবু ‘আমের, হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান, রিফা‘আহ আবু লুবাবাহ আনছারী, আব্দুল্লাহ যুল-বাজাদাইন, খাববাব ইবনুল আরাত, আব্দুল্লাহ বিন মাস‘ঊদ, ছুহায়েব বিন সিনান রূমী, রাসূল (সাঃ)-এর মুক্তদাস শুক্বরান, সাফীনাহ ও ছাওবান। বেলাল বিন রাবাহ, ইরবায বিন সারিয়াহ, আবু সাঈদ খুদরী প্রমুখ।
আছহাবে ছুফফাহর সদস্যগণ অধিকাংশ সময় ই‘তিকাফ, ইবাদত ও তেলাওয়াতে লিপ্ত থাকতেন। একে অপরকে কুরআন শিক্ষা দিতেন ও লেখা-পড়া শিখাতেন। তাদের কেউ কেউ বিভিন্ন বিষয়ে প্রসিদ্ধি অর্জন করেন। যেমন আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হাদীছ বর্ণনার ক্ষেত্রে এবং হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান ফিৎনা সম্পর্কিত হাদীছসমূহ বর্ণনার ক্ষেত্রে।
অধিকাংশ সময় সমাজ থেকে দূরে থাকলেও তাদের কেউ কেউ বিভিন্ন জিহাদে অংশগ্রহণ করেছেন। এমনকি শহীদ হয়েছেন। যেমন বদরে শহীদদের মধ্যে ছিলেন ছাফওয়ান বিন বায়যা, খুরাইম বিন ফাতেক আসাদী, খোবায়েব বিন ইয়াসাফ, সালেম বিন উমায়ের প্রমুখ। ওহোদের শহীদদের মধ্যে ছিলেন হানযালা ‘গাসীলুল মালায়েকাহ’। কেউ হোদায়বিয়ার সন্ধিকালে উপস্থিত ছিলেন। যেমন জারহাদ বিন খুওয়াইলিদ, আবু সারীহাহ গিফারী। তাদের মধ্যে কেউ খায়বরে শহীদ হয়েছিলেন। যেমন ছাক্বফ বিন আমর। কেউ তাবূকে শহীদ হয়েছিলেন। যেমন আব্দুল্লাহ যুল বিজাদায়েন। কেউ ভন্ডনবীদের বিরুদ্ধে ইয়ামামাহর যুদ্ধে শহীদ হন। যেমন আবু হুযায়ফাহর মুক্তদাস সালেম ও যায়েদ ইবনুল খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম)। প্রকৃত প্রস্তাবে তারা ছিলেন রাতের বেলা ইবাদত গুযার ও দিনের বেলায় ঘোড় সওয়ার।
তাদের সম্পর্কে বিশেষভাবে কুরআনে কয়েকটি আয়াত নাযিল হয়। যেমন সূরা বাক্বারাহ ২৭৩ আয়াত ও সূরা তওবাহ ৯১ আয়াত। তাঁদের সম্পর্কে ওয়াক্বেদী, ইবনু সা‘দ, আবু নাঈম, তাক্বিউদ্দীন সুবকী, সামহূদী প্রমুখ বিদ্বানগণ পৃথক পৃথক গ্রন্থ সংকলন করেছেন (সীরাহ ছহীহাহ ১/২৫৭-৭১)। আয়াত দু’টি নিম্নরূপ:
لِلْفُقَرَاءِ الَّذِينَ أُحْصِرُوا فِي سَبِيلِ اللهِ لاَ يَسْتَطِيعُونَ ضَرْبًا فِي الْأَرْضِ يَحْسَبُهُمُ الْجَاهِلُ أَغْنِيَاءَ مِنَ التَّعَفُّفِ تَعْرِفُهُمْ بِسِيمَاهُمْ لاَ يَسْأَلُونَ النَّاسَ إِلْحَافًا وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ خَيْرٍ فَإِنَّ اللهَ بِهِ عَلِيمٌ
‘তোমরা ব্যয় কর ঐসব অভাবীদের জন্য, যারা আল্লাহর পথে আবদ্ধ হয়ে গেছে, যারা ভূ-পৃষ্ঠে বিচরণে সক্ষম নয়। না চাওয়ার কারণে অজ্ঞ লোকেরা তাদের অভাবমুক্ত মনে করে। তুমি তাদের চেহারা দেখে চিনতে পারবে। তারা মানুষের কাছে নাছোড়বান্দার মত প্রার্থী হয় না। আর তোমরা উত্তম মাল হ’তে যা কিছু ব্যয় কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা সম্যকভাবে অবহিত’ (বাক্বারাহ ২/২৭৩)।
দ্বিতীয় আয়াতটি হ’ল,
لَيْسَ عَلَى الضُّعَفَاءِ وَلاَ عَلَى الْمَرْضَى وَلاَ عَلَى الَّذِينَ لاَ يَجِدُونَ مَا يُنْفِقُونَ حَرَجٌ إِذَا نَصَحُوا لِلَّهِ وَرَسُولِهِ مَا عَلَى الْمُحْسِنِينَ مِنْ سَبِيلٍ وَاللهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ ‘কোন অভিযোগ নেই দুর্বলদের উপর, রোগীদের উপর ও ব্যয়ভার বহনে অক্ষমদের উপর, যদি তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি খালেছ ঈমান রাখে। বস্ত্ততঃ সৎকর্মশীলদের বিরুদ্ধে কোনরূপ অভিযোগ নেই। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (তওবাহ ৯/৯১)।
আনছার ও মুহাজিরগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন (المؤاخاة بين الأنصار والمهاجرين)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আনাস বিন মালেকের গৃহে আনছার ও মুহাজিরদের নেতৃস্থানীয় ৯০ জন ব্যক্তির এক আনুষ্ঠানিক বৈঠক আহবান করেন। যেখানে উভয় দলের অর্ধেক অর্ধেক সদস্য উপস্থিত ছিলেন’।[1] রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের পরস্পর দু’জনের মধ্যে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের (الْمَؤَاخَاةُ الْإِسْلاَمِيَّةُ) বন্ধন স্থাপন করেন এই শর্তে যে, ‘তারা একে অপরের দুঃখ-বেদনার সাথী হবেন এবং মৃত্যুর পরে পরস্পরের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন’। তবে উত্তরাধিকার লাভের শর্তটি ২য় হিজরীতে বদর যুদ্ধের পর অবতীর্ণ আয়াতের মাধ্যমে রহিত হয়ে যায়। যেখানে বলা হয়, وَأُوْلُوا الْأَرْحَامِ بَعْضُهُمْ أَوْلَى بِبَعْضٍ فِيْ كِتَابِ اللهِ إِنَّ اللهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيْمٌ ‘রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়গণ আল্লাহর কিতাবে পরস্পরের অধিক হকদার। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল বিষয়ে অধিক জ্ঞাত’ (আনফাল ৮/৭৫)। এর ফলে উত্তরাধিকার লাভের বিষয়টি রহিত হ’লেও তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ছিল অটুট এবং অনন্য। বিশ্ব ইতিহাসে যার কোন তুলনা নেই। ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের এই ঘটনা ১ম হিজরী সনেই ঘটেছিল মসজিদে নববী নির্মাণকালে অথবা নির্মাণ শেষে। তবে ঠিক কোন তারিখে ঘটেছিল, সেটা সঠিকভাবে জানা যায় না। ইবনু আব্দিল বার্র এটিকে হিজরতের ৫ মাস পরে বলেছেন। ইবনু সা‘দ এটিকে হিজরতের পরে এবং বদর যুদ্ধের পূর্বে বলেছেন (সীরাহ ছহীহাহ ১/২৪৩)। কয়েকটি দৃষ্টান্ত নিম্নে প্রদত্ত হ’ল।-
[1]. যাদুল মা‘আদ ৩/৫৬; বুখারী হা/৭৩৪০; সীরাহ ছহীহাহ ১/২৪৪।
ভ্রাতৃত্বের নমুনা (أمثلة المؤاخاة)
(১) আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুহাজির আব্দুর রহমান বিন ‘আওফকে আনছার সা‘দ বিন রবী‘-এর সাথে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন স্থাপন করে দেন। অতঃপর সা‘দ তার মুহাজির ভাইকে বললেন, ‘আনছারদের মধ্যে আমি সর্বাপেক্ষা ধনী। আপনি আমার সম্পদের অর্ধেক গ্রহণ করুন এবং আমার দু’জন স্ত্রীর মধ্যে যাকে আপনি পসন্দ করেন, তাকে আমি তালাক দিয়ে দিব। ইদ্দত শেষে আপনি তাকে বিবাহ করবেন’। আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ তার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে দো‘আ করলেন, بَارَكَ اللهُ لَكَ فِى أَهْلِكَ وَمَالِكَ ‘আল্লাহ আপনার পরিবারে ও সম্পদে বরকত দান করুন’! আপনি আমাকে আপনাদের বাজার দেখিয়ে দিন। অতঃপর তাঁকে বনু ক্বায়নুক্বা-র বাজার দেখিয়ে দেওয়া হ’ল। তিনি সেখানে গিয়ে পনীর ও ঘি-এর ব্যবসা শুরু করলেন এবং কিছুদিনের মধ্যে সচ্ছলতা লাভ করলেন। এক সময় তিনি বিয়ে-শাদীও করলেন।[1]
(২) খেজুর বাগান ভাগ করে দেবার প্রস্তাব : হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, আনছারগণ একদিন রাসূল (সাঃ)-এর কাছে এসে আবেদন করলেন যে, আপনি আমাদের খেজুর বাগানগুলি আমাদের ও মুহাজির ভাইগণের মধ্যে সমানভাবে বণ্টন করে দিন’। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এতে অসম্মতি জ্ঞাপন করলেন। তখন তারা বললেন, তবে এমন করুন যে, মুহাজির ভাইগণ আমাদের কাজ করে দিবেন এবং আমরা তাদের ফলের অংশ দিব’। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এতে সম্মত হ’লেন (বুখারী হা/৩৭৮২)।
(৩) জমি বণ্টনের প্রস্তাব : বাহরায়েন এলাকা বিজিত হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সেখানকার পতিত জমিগুলি আনছারদের অনুকূলে বরাদ্দ দিতে চাইলে তারা আপত্তি করে বললেন, আমাদের মুহাজির ভাইদের উক্ত পরিমাণ জমি দেওয়ার পরে আমাদের দিবেন। তার পূর্বে নয়।[2] আনছারদের এই অসাধারণ ত্যাগ ও মহত্ত্বের প্রশংসা করে আল্লাহ আয়াত নাযিল করেন (হাশর ৫৯/৯)। যা ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে।
[1]. বুখারী হা/৩৭৮০-৮১ ‘ছাহাবীগণের মর্যাদা’ অধ্যায়, ৩৩ অনুচ্ছেদ ও হা/২৬৩০ ‘হেবা’ অধ্যায়, ৩৫ অনুচ্ছেদ।
[2]. বুখারী হা/২৩৭৬ ‘জমি সেচ করা’ অধ্যায়, ১৪ অনুচ্ছেদ।
নবতর জাতীয়তা (القومية الجديدة)
মুহাজির ভাইদের জন্য আনছারগণের সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধন ছিল তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতির উপরে প্রতিষ্ঠিত। যার মাধ্যমে বংশ, বর্ণ, অঞ্চল, ভাষা প্রভৃতি আরবের চিরাচরিত বন্ধন সমূহের উপরে তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত ভিত্তিক নবতর এক জাতীয়তার বন্ধন স্থাপিত হয়। যা পরবর্তীতে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্ম দেয় এবং প্রতিষ্ঠিত হয় আল্লাহর দাসত্বের অধীনে সকল মানুষের সমানাধিকার ভিত্তিক ইসলামী খেলাফতের দৃঢ় ভিত্তি। উপ্ত হয় প্রকৃত অর্থে এক অসাম্প্রদায়িক ও উদারনৈতিক ইসলামী সমাজের বীজ।
‘আল্লাহর দাসত্বের অধীনে সকল মানুষের অধিকার সমান’- এই মহান সাম্যের বাণী ও তার বাস্তব প্রতিফলন দেখে আজীবন মানুষের দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ মযলূম জনতা এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে নিগৃহীত ও শোষিত মানবতা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। জান্নাত লাভের প্রতিযোগিতায় সর্বোত্তমরূপে বিকশিত মানবতা মদীনার আদি বাসিন্দাদের চমকিত করল। যা তাদের স্বার্থান্ধ জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। নোংরা দুনিয়াপূজা হ’তে মুখ ফিরিয়ে আখেরাতমুখী মানুষের বিজয় মিছিল এগিয়ে চলল। কাফির-মুশরিক, ইহূদী-নাছারা ও মুনাফিকদের যাবতীয় অপচেষ্টাকে নস্যাৎ করে দিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করল বিশ্বজয়ী ইসলামী খেলাফত। যা কয়েক বছরের মধ্যেই তৎকালীন বিশ্বের সকল পরাশক্তিকে দমিত করে অপরাজেয় বিশ্বশক্তিরূপে আবির্ভূত হ’ল। ফালিল্লা-হিল হাম্দ।
বস্ত্ততঃ আনছার ও মুহাজিরগণের মধ্যে যদি এইরূপ নিখাদ ভালবাসা ও ঐক্যের বন্ধন সৃষ্টি না হ’ত এবং স্থানীয় ও বহিরাগত দ্বন্দ্বের ফাটল দেখা দিত, তাহ’লে মদীনায় মুসলমানদের উঠতি শক্তি অংকুরেই বিনাশ হয়ে যেত। পরিণামে তাদেরকে চিরকাল ইহূদীদের শোষণের যাঁতাকলে নিষ্পিষ্ট হ’তে হ’ত। যেভাবে ইতিপূর্বে মক্কায় কুরায়েশ নেতাদের হাতে তারা পর্যুদস্ত হয়েছিল।
শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ -২০ (العبر -২০)
(১) সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার ও আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বায়‘আত গ্রহণের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে কর্মীদল সৃষ্টি হ’লেও তাদের কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ করা এবং অন্যান্য বিশ্বস্ত কর্মীদের পাঠিয়ে বাস্তবতা যাচাই শেষে পদক্ষেপ নেওয়াই দূরদর্শী নেতার কর্তব্য। ১ম বায়‘আতের পর মুছ‘আবকে পাঠিয়ে হিজরতের জন্য দীর্ঘ তিন বছর অপেক্ষা করার মধ্যে রাসূল (সাঃ)-এর সেই কর্মনীতি আমরা দেখতে পাই।
(২) নেতৃবৃন্দের অকপট আশ্বাস ও সাধারণ জনমত পক্ষে থাকলেও নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে সর্বদা কিছু শত্রু ও দ্বিমুখী চরিত্রের লোক অবশ্যই থাকবে, সংস্কারবাদী নেতাকে সর্বদা সে চিন্তা মাথায় রাখতে হবে এবং সে হিসাবেই পদক্ষেপ নিতে হবে। মাদানী জীবনের প্রথম থেকেই কিছু ইহূদী নেতার বিরুদ্ধাচরণ এবং আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের দ্বি-মুখী আচরণ তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
(৩) সমাজদরদী নেতা সাধ্যমত শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাজ গঠনে সচেষ্ট থাকবেন। সাথে সাথে শত্রুপক্ষের চক্রান্ত সম্পর্কেও হুঁশিয়ার থাকবেন ও যথাযোগ্য ব্যবস্থা নিবেন।
যুদ্ধের অনুমতি (إذن الجهاد)
কুরায়েশদের সন্ত্রাসমূলক অপতৎপরতা ও প্রকাশ্য হামলাসমূহ মুকাবিলার জন্য মুসলমানদেরকে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি দিয়ে ইতিপূর্বে হিজরতকালে সূরা হজ্জ ৩৯ ও ৪০ আয়াত নাযিল হয়[1], যা ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে।
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এটাই প্রথম আয়াত, যা কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অনুমতি দিয়ে হিজরতকালে নাযিল হয়।[2] আর জিহাদের উদ্দেশ্য হ’ল সমাজ থেকে যুলুম ও অন্যায়ের প্রতিরোধ করা। যা উক্ত আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
অন্যত্র আল্লাহ তালূত কর্তৃক অত্যাচারী বাদশাহ জালূতের ধ্বংস প্রসঙ্গে বলেন, وَلَوْلاَ دَفْعُ اللهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَّفَسَدَتِ الأَرْضُ وَلَـكِنَّ اللهَ ذُوْ فَضْلٍ عَلَى الْعَالَمِيْنَ ‘যদি আল্লাহ একজনকে আরেকজনের দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহ’লে দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যেত। কিন্তু বিশ্ববাসীর প্রতি আল্লাহ একান্তই করুণাময়’ (বাক্বারাহ ২/২৫১)।
[1]. তিরমিযী হা/৩১৭১; আহমাদ হা/১৮৬৫।
[2]. তিরমিযী হা/৩১৭১; নাসাঈ হা/৩০৮৫ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।
ইসলামে জিহাদ বিধান (حكم الجهاد فى الإسلام)
‘জিহাদ’ অর্থ সর্বাত্মক প্রচেষ্টা। শারঈ পরিভাষায় ‘জিহাদ’ হ’ল সমাজে ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর রাস্তায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো। কুফরী শক্তির বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করা যার চূড়ান্ত রূপ। জিহাদের উদ্দেশ্য হ’ল মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে আল্লাহর দাসত্বে ফিরিয়ে আনা এবং মানুষে মানুষে সাম্য ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
(ক) মাক্কী জীবনে কাফেরদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি ছিল না। বলা হয়েছিল, كُفُّوا أَيْدِيَكُمْ وَأَقِيمُوا الصَّلاَةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ ‘তোমরা হস্ত সংযত রাখ এবং ছালাত আদায় কর ও যাকাত প্রদান কর’... (নিসা ৪/৭৭)। এই নীতি সর্বদা প্রযোজ্য। যখন কুফরী শক্তি প্রবল হবে এবং ইসলামী শক্তি তার তুলনায় দুর্বল থাকবে।
(খ) অতঃপর দেশ থেকে বা গৃহ থেকে বিতাড়িত হওয়ার মত চূড়ান্ত যুলুমের অবস্থায় সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হয় দ্বীন ও জীবন রক্ষার্থে। বলা হয়, أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا وَإِنَّ اللهَ عَلَى نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ- ‘যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হ’ল তাদেরকে, যারা আক্রান্ত হয়েছে। কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আর আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদেরকে (যুদ্ধ ছাড়াই) সাহায্য করতে সক্ষম’ (হাজ্জ ২২/৩৯)।
(গ) এ সময় কেবল যুদ্ধকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়, وَقَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللهِ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَكُمْ وَلاَ تَعْتَدُوا إِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ ‘আর তোমরা লড়াই কর আল্লাহর পথে তাদের বিরুদ্ধে, যারা লড়াই করে তোমাদের বিরুদ্ধে এবং এতে বাড়াবাড়ি করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালংঘনকারীদের ভালবাসেন না’ (বাক্বারাহ ২/১৯০)। অর্থাৎ স্রেফ পরকালীন স্বার্থেই জিহাদ হবে, দুনিয়াবী কোন স্বার্থে নয় এবং যারা যুদ্ধ করে কেবল তাদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করবে।
(ঘ) যুদ্ধকালে নির্দেশ দেওয়া হয়, اغْزُوا بِاسْمِ اللهِ فِى سَبِيلِ اللهِ قَاتِلُوا مَنْ كَفَرَ بِاللهِ اغْزُوا وَلاَ تَغُلُّوا وَلاَ تَغْدِرُوا وَلاَ تُمَثِّلُوا وَلاَ تَقْتُلُوا الْوِلْدَانَ وَلاَ أَصْحَابَ الصَّوَامِعِ ‘তোমরা আল্লাহর নামে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ কর তাদের বিরুদ্ধে যারা আল্লাহর সাথে কুফরী করে। যুদ্ধ কর, কিন্তু গণীমতের মালে খেয়ানত করো না। চুক্তি ভঙ্গ করো না। শত্রুর অঙ্গহানি করো না। শিশুদের ও উপাসনাকারীদের হত্যা করো না’।[1]
(ঙ) অতঃপর কুফরী শক্তির সর্বব্যাপী হামলা থেকে দ্বীন ও জীবন রক্ষার্থে মৌলিক নির্দেশনা জারী করা হয়, وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لاَ تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ لِلَّهِ فَإِنِ انْتَهَوْا فَلاَ عُدْوَانَ إِلاَّ عَلَى الظَّالِمِينَ ‘আর তোমরা তাদের সাথে লড়াই কর যে পর্যন্ত না ফেৎনার (কুফরীর) অবসান হয় এবং আনুগত্য স্রেফ আল্লাহর জন্য হয়। অতঃপর যদি তারা নিবৃত্ত হয়, তবে যালেমদের ব্যতীত অন্যদের প্রতি কোন প্রতিশোধ নেই’ (বাক্বারাহ ২/১৯৩; আনফাল ৮/৩৯)।
(চ) সর্বক্ষেত্রে ও সর্বাবস্থায় ‘তাওহীদের ঝান্ডা উঁচু থাকবে ও শিরকের ঝান্ডা অবনমিত হবে’ মর্মে জিহাদের চিরন্তন নীতিমালা ঘোষণা করা হয়। যেমন আল্লাহ বলেন, وَجَعَلَ كَلِمَةَ الَّذِينَ كَفَرُوا السُّفْلَى وَكَلِمَةُ اللهِ هِيَ الْعُلْيَا وَاللهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ ‘এবং তিনি কাফেরদের (শিরকের) ঝান্ডা অবনত করে দিলেন ও আল্লাহর (তাওহীদের) ঝান্ডা সমুন্নত রাখলেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ মহা পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়’ (তওবা ৯/৪০)।
(ছ) যারা আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে মানুষের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায় এবং আল্লাহর দ্বীনকে ফুৎকারে নিভিয়ে দিতে চায়, সেইসব কাফের অপশক্তির বিরুদ্ধে ইসলামকে বিজয়ী করাই ছিল যুগে যুগে নবী ও রাসূল প্রেরণের উদ্দেশ্য। শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে প্রেরণের উদ্দেশ্যও ছিল তাই। যেমন আল্লাহ বলেন, يُرِيدُونَ لِيُطْفِئُوا نُورَ اللهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَاللهُ مُتِمُّ نُورِهِ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ- هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ‘তারা চায় তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর জ্যোতিকে নিভিয়ে দিতে। অথচ আল্লাহ স্বীয় জ্যোতিকে (ইসলামকে) পূর্ণতা দান করবেন। যদিও অবিশ্বাসীরা তা পসন্দ করে না’। ‘তিনিই তাঁর রাসূলকে প্রেরণ করেছেন হেদায়াত ও সত্য দ্বীন সহকারে। যাতে তিনি উক্ত দ্বীনকে সকল দ্বীনের উপরে বিজয়ী করতে পারেন। যদিও মুশরিকরা তা পসন্দ করে না’ (ছফ ৬১/৮-৯; তওবাহ ৯/৩২)।
(জ) কোন মুসলিম যদি কুফরী শক্তির দোসর হিসাবে কাজ করে, তাহ’লে তার বিরুদ্ধে ‘কঠোর’ হবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ جَاهِدِ الْكُفَّارَ وَالْمُنَافِقِينَ وَاغْلُظْ عَلَيْهِمْ وَمَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ ‘হে নবী! তুমি জিহাদ কর কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে এবং তাদের উপরে কঠোর হও। ওদের ঠিকানা হ’ল জাহান্নাম। আর কতইনা মন্দ ঠিকানা সেটি’ (তওবা ৯/৭৩; তাহরীম ৬৬/৯)। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ হবে অস্ত্রের দ্বারা এবং মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ হবে যবান দ্বারা এবং অন্যান্য পন্থায় কঠোরতা অবলম্বনের দ্বারা’।[2] মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইকে সকল নষ্টের মূল জেনেও রাসূল (সাঃ) তাকে হত্যার নির্দেশ দেননি তার বাহ্যিক ইসলামের কারণে।
(ঝ) মুসলমানদের পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা নিষিদ্ধ।[3] কোন কারণে যুদ্ধ লাগলে অন্যদের দায়িত্ব হবে উভয় পক্ষকে থামানো এবং তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়া’ (হুজুরাত ৪৯/৯)। নইলে বিরত থাকা। এ বিষয়ে আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন,يَمْنَعُنِى أَنَّ اللهَ حَرَّمَ دَمَ أَخِى ‘আমাকে যুদ্ধ থেকে বিরত রেখেছে এ বিষয়টি যে, আল্লাহ আমার উপর আমার ভাইয়ের রক্ত হারাম করেছেন’। লোকেরা বলল, আল্লাহ কি বলেননি, وَقَاتِلُوْهُمْ حَتَّى لاَ تَكُوْنَ فِتْنَةٌ وَيَكُوْنَ الدِّيْنُ ِللهِ ‘তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, যতক্ষণ না ফিৎনা অবশিষ্ট থাকে এবং দ্বীন সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য হয়ে যায়’ (বাক্বারাহ ২/১৯৩)। জবাবে তিনি বলেন,قَاتَلْنَا حَتَّى لَمْ تَكُنْ فِتْنَةٌ، وَكَانَ الدِّينُ ِللهِ، وَأَنْتُمْ تُرِيدُونَ أَنْ تُقَاتِلُوا حَتَّى تَكُونَ فِتْنَةٌ، وَيَكُونَ الدِّينُ لِغَيْرِ اللهِ ‘আমরা যুদ্ধ করেছি যাতে ফিৎনা (শিরক ও কুফর) না থাকে এবং দ্বীন সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য হয়ে যায়। আর তোমরা যুদ্ধ করছ যাতে ফিৎনা (বিপর্যয়) সৃষ্টি হয় এবং দ্বীন আল্লাহ ব্যতীত অন্যের (শত্রুর) জন্য হয়ে যায়’ (বুখারী হা/৪৫১৩)। তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, هَلْ تَدْرِى مَا الْفِتْنَةُ؟ كَانَ مُحَمَّدٌ صلى الله عليه وسلم يُقَاتِلُ الْمُشْرِكِينَ، وَكَانَ الدُّخُولُ عَلَيْهِمْ فِتْنَةً، وَلَيْسَ كَقِتَالِكُمْ عَلَى الْمُلْكِ ‘তুমি কি জানো ফিৎনা কি? মুহাম্মাদ (সাঃ) যুদ্ধ করতেন মুশরিকদের বিরুদ্ধে। আর তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধটাই ছিল ফিৎনা। তোমাদের মত শাসন ক্ষমতা লাভের জন্য যুদ্ধ নয়’ (বুখারী হা/৪৬৫১, ৭০৯৫)।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, سَتَكُونُ فِتَنٌ، الْقَاعِدُ فِيهَا خَيْرٌ مِنَ الْقَائِمِ، وَالْقَائِمُ فِيهَا خَيْرٌ مِنَ الْمَاشِى ... وَمَنْ وَجَدَ مَلْجَأً أَوْ مَعَاذًا فَلْيَعُذْ بِهِ ‘সত্বর তোমাদের মধ্যে ফিৎনাসমূহ সৃষ্টি হবে। তখন তোমাদের মধ্যেকার বসা ব্যক্তি দাঁড়ানো ব্যক্তির চাইতে উত্তম হবে এবং বসা ব্যক্তি হাঁটা ব্যক্তির চাইতে উত্তম হবে। আর হাঁটা ব্যক্তি দৌড়ানো ব্যক্তির চাইতে উত্তম হবে। যদি কেউ আশ্রয়স্থল বা বাঁচার কোন স্থান পায়, তবে সে যেন সেখানে গিয়ে আশ্রয় নেয়’।[4] ফিৎনার সময় করণীয় প্রসঙ্গে হযরত সা‘দ ইবনু আবী ওয়াকক্বাছ (রাঃ) রাসূল (সাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসূল! যখন আমাকে হত্যার জন্য আমার ঘরে ঢুকে কেউ আমার দিকে হাত বাড়াবে, তখন আমি কি করব? জবাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, كُنْ كَابْنِ آدَمَ ‘তুমি আদমের পুত্রের মত হও’ (অর্থাৎ হাবীলের মত মৃত্যুকে বরণ কর)। অতঃপর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মায়েদাহ ২৮ আয়াতটি পাঠ করে শুনালেন’। যেখানে হত্যাকারী ক্বাবীলের বিরুদ্ধে হাবীলের উক্তি উদ্ধৃত করে আল্লাহ বলেন, لَئِنْ بَسَطْتَ إِلَيَّ يَدَكَ لِتَقْتُلَنِي مَا أَنَا بِبَاسِطٍ يَدِيَ إِلَيْكَ لِأَقْتُلَكَ إِنِّي أَخَافُ اللهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ ‘যদি তুমি আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তোমার হাত বাড়াও, তবুও আমি তোমাকে হত্যার জন্য আমার হাত বাড়াবো না। আমি বিশ্বপ্রভু আল্লাহকে ভয় করি’ (মায়েদাহ ৫/২৮)।[5] আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, যখন তোমাদের কারু গৃহে ফেৎনা প্রবেশ করবে, তখন সে যেন আদমের দুই পুত্রের উত্তমটির মত হয়(فَلْيَكُنْ كَخَيْرِ ابْنَىْ آدَمَ)।[6]
[1]. মুসলিম হা/১৭৩১; আহমাদ হা/২৭২৮; মিশকাত হা/৩৯২৯।
[2]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা তওবা ৭৩ আয়াত।
[3]. মুসলিম হা/২৫৬৪; বুখারী হা/৪৮; মুসলিম হা/৬৪ (১১৬); মিশকাত হা/৪৮১৪।
[4]. বুখারী হা/৩৬০১; মুসলিম হা/২৮৮৬ (১০); মিশকাত হা/৫৩৮৪।
[5]. আহমাদ হা/১৬০৯; আবুদাঊদ হা/৪২৫৭ ‘ফিতান’ অধ্যায়, সনদ ছহীহ।
[6]. আবুদাঊদ হা/৪২৫৯; ইবনু মাজাহ হা/৩৯৬১ সনদ ছহীহ।
বিশ্বজয়ী লক্ষ্য (هدف الفتح العالمى)
বিশ্বব্যাপী কুফরী শক্তিকে অবনত করে তাওহীদকে সমুন্নত করা ও মানুষকে শয়তানী শাসন ও যুলুমের শৃংখলমুক্ত করে আল্লাহর বিধানের অনুগত করাই হ’ল জিহাদের বিশ্বজয়ী লক্ষ্য। যদিও এটি কষ্টকর। কিন্তু এটি আল্লাহ মুসলমানের উপর ফরয করেছেন মানবতার মুক্তির জন্য এবং বিশ্বে শান্তি ও শৃংখলা প্রতিষ্ঠার জন্য। আল্লাহ বলেন,قَاتِلُوا الَّذِينَ لاَ يُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَلاَ بِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَلاَ يُحَرِّمُونَ مَا حَرَّمَ اللهُ وَرَسُولُهُ وَلاَ يَدِينُونَ دِينَ الْحَقِّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ حَتَّى يُعْطُوا الْجِزْيَةَ عَنْ يَدٍ وَهُمْ صَاغِرُونَ ‘তোমরা যুদ্ধ কর আহলে কিতাবদের মধ্যকার ঐসব লোকের বিরুদ্ধে, যারা আল্লাহ ও বিচার দিবসের উপর ঈমান রাখে না এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা হারাম করেছেন তা হারাম করেনা ও সত্য দ্বীন (ইসলাম) কবুল করেনা, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা বিনীত হয়ে করজোড়ে জিযিয়া প্রদান করে’ (বাক্বারাহ ২/২৪৬; তওবাহ ৯/২৯)।
অবশ্যই এ জিহাদ কেবল অস্ত্রশক্তি দিয়ে নয়। বরং তা হবে মূলতঃ দ্বীনের শক্তি দিয়ে। অর্থাৎ কুরআন-সুন্নাহ ও যুক্তিপূর্ণ দলীল দ্বারা আক্বীদা পরিবর্তনের মাধ্যমে। যাকে ‘চিন্তার যুদ্ধ’ (الْغَزْوُ الْفِكْرِىُّ) বলা হয়। আর এটাই হ’ল দ্রুত ও স্থায়ীভাবে কার্যকর। আর এর মাধ্যমেই আসে সর্বাত্মক সমাজ বিপ্লব। ইসলামী জিহাদের এটাই হ’ল চূড়ান্ত লক্ষ্য।
জিহাদ প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরয। জিহাদকে ইসলামের চূড়া (ذِرْوَةُ سَنَامِهِ الْجِهَادُ) বলা হয়েছে’।[1] আর চূড়া না থাকলে ঘর থাকেনা। যে ব্যক্তি কুফরী আদর্শের সঙ্গে আপোষ করে এবং তাওহীদ প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদের আকাংখাও হৃদয়ে পোষণ করে না, সে ব্যক্তি মুনাফেকী হালতে মৃত্যুবরণ করে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, مَنْ مَاتَ وَلَمْ يَغْزُ وَلَمْ يُحَدِّثْ بِهِ نَفْسَهُ مَاتَ عَلَى شُعْبَةٍ مِنْ نِفَاقٍ ‘যে ব্যক্তি মারা গেল, অথচ জিহাদ করল না। এমনকি জিহাদের কথা মনেও আনলো না, সে ব্যক্তি মুনাফেকীর একটি শাখার উপর মৃত্যুবরণ করল’।[2] সেকারণ জিহাদের গুরুত্ব সর্বাধিক। এতে যুদ্ধের ময়দানে এমনকি বিছানায় মরলেও সে শহীদ হবে’।[3] জিহাদ ব্যতীত মুসলমান তার জান-মাল ও ইয্যত নিয়ে দুনিয়ায় সম্মানের সাথে বেঁচে থাকতে পারে না এবং আখেরাতেও মুক্তি পেতে পারে না।
বস্ত্ততঃ জিহাদ হয়ে থাকে সন্ত্রাস দমনের জন্য এবং সমাজে আল্লাহর বিধান কায়েমের মাধ্যমে শান্তি ও শৃংখলা প্রতিষ্ঠার জন্য। আল্লাহ বলেন, تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لاَ يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلَا فَسَادًا وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ ‘আখিরাতের ঐ গৃহ আমরা প্রস্ত্তত করেছি তাদের জন্য, যারা পৃথিবীতে ঔদ্ধত্য ও বিশৃংখলা কামনা করেনা। আর শুভ পরিণাম হ’ল আল্লাহভীরুদের জন্য’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৩)। বাস্তবিক পক্ষে জিহাদের মধ্যেই নিহিত রয়েছে মুসলমানদের শ্রেষ্ঠ উম্মত হওয়ার চাবিকাঠি। যেখানে আল্লাহ বলেছেন, كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللهِ ‘তোমরাই হ’লে শ্রেষ্ঠ জাতি। যাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে মানবজাতির কল্যাণের জন্য। তোমরা সৎকাজের আদেশ দিবে ও অন্যায় কাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখবে’ (আলে-ইমরান ৩/১১০)।
বস্ত্ততঃ আমর বিল মা‘রূফ ও নাহি ‘আনিল মুনকার-এর দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই মুসলমান বিশ্বজয়ী শক্তিতে পরিণত হবে। যা তরবারীর জোরে নয় বরং প্রতিষ্ঠিত হবে তার অন্তর্নিহিত তাওহীদী চেতনার অজেয় শক্তির জোরে। একদিন যা পৃথিবীর সকল প্রান্তে মাটির ঘরে ও গরীবের পর্ণকুটিরেও প্রবেশ করবে। সম্মানিত ব্যক্তির ঘরে (ইসলাম কবুলের মাধ্যমে) সম্মানের সাথে অথবা অসম্মানিত ব্যক্তির ঘরে (জিযিয়া প্রদানের মাধ্যমে) অসম্মানের সাথে’।[4] (বিস্তারিত পাঠ করুন ‘জিহাদ ও ক্বিতাল’ বই)।
[1]. তিরমিযী হা/২৬১৬; ইবনু মাজাহ হা/৩৯৭৩; মিশকাত হা/২৯; ছহীহাহ হা/১১২২।
[2]. মুসলিম হা/১৯১০; মিশকাত হা/৩৮১৩ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।
[3]. মুসলিম হা/১৯১৫; মিশকাত হা/৩৮১১।
[4]. আহমাদ হা/১৬৯৯৮; ছহীহাহ হা/৩; মিশকাত হা/৪২।
অনুমতি দানের কারণ সমূহ (أسباب الإذن بالقتال)
মদীনায় হিজরতের পর সশস্ত্র জিহাদের অনুমতি দানের কারণ ছিল তিনটি।-
(১) মুসলমানেরা ছিল মযলূম এবং হামলাকারীরা ছিল যালেম।
(২) মুহাজিরগণ ছিলেন নিজেদের জন্মস্থান ও আবাসভূমি থেকে বিতাড়িত এবং তাদের মাল-সম্পদ ছিল লুণ্ঠিত। তারা ছিলেন অপমানিত ও লাঞ্ছিত, স্রেফ তাওহীদী আক্বীদার কারণে। দুনিয়াবী কোন স্বার্থের কারণে নয় (হজ্জ ২২/৪০)।
(৩) মদীনা ও আশপাশের গোত্রসমূহের সাথে রাসূল (সাঃ)-এর সন্ধি চুক্তি ছিল। যাতে পরস্পরের ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছিল। এক্ষণে মুসলমান হওয়ার কারণে অথবা মুসলমানদের সহযোগী হওয়ার কারণে যদি তাদের উপরে হামলা করা হয়, তাহ’লে সন্ধিচুক্তি রক্ষার স্বার্থে তাদের জান-মালের হেফাযতের জন্য রাসূল (সাঃ)-কে যালেমদের হামলা প্রতিরোধে এগিয়ে যাওয়াটা নৈতিক বাধ্যবাধকতা ছিল।
জিহাদের অনুমতি লাভের পর ১ম হিজরীর রামাযান মাস থেকে কুরায়েশদের হামলা প্রতিরোধে মদীনার বাইরে নিয়মিত সশস্ত্র টহল অভিযান সমূহ প্রেরিত হ’তে থাকে। অতঃপর ২য় হিজরীর রজব মাসে নাখলা যুদ্ধের পর বদর যুদ্ধের প্রাক্কালে নিয়মিতভাবে জিহাদ ফরয করা হয় এবং উক্ত মর্মে সূরা বাক্বারাহ ১৯০-১৯৩ এবং সূরা মুহাম্মাদ ৪-৭ ও ২০ আয়াত সমূহ নাযিল হয়।
অভিযান ও যুদ্ধ সমূহ(السرايا والغزوات)
যুদ্ধের অনুমতি সংক্রান্ত আয়াত নাযিলের পর কুরায়েশ বাহিনীর মুকাবিলার জন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনা থেকে মক্কা অভিমুখী রাস্তাগুলিতে নিয়মিত টহল অভিযান প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় বাইরের বিভিন্ন গোত্রের সাথে তাঁর কৃত সন্ধি চুক্তিসমূহ খুবই ফলপ্রসূ প্রমাণিত হয়। যার এলাকাসমূহ মদীনা হ’তে মক্কার দিকে তিন মনযিল অর্থাৎ প্রায় পঞ্চাশ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এইসব অভিযানের যেগুলিতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বয়ং অংশ গ্রহণ করতেন, সেগুলিকে ‘গাযওয়াহ’ (غَزْوَةٌ) এবং যেগুলিতে নিজে যেতেন না, বরং অন্যদের পাঠাতেন, সেগুলিকে সারিইয়াহ (سَرِيَّةٌ) বলা হয়। এইসব অভিযানে যুদ্ধ প্রস্ত্ততি নিয়ে বের হ’লেও বলতে গেলে কোনটাতেই যুদ্ধ হয়নি। তবে মক্কায় খবর হয়ে গিয়েছিল যে, কুরায়েশদের হুমকিতে মুহাজিরগণ ভীত নন, বরং তারা সদা প্রস্ত্তত।
উল্লেখ্য যে, সকল অভিযানেই পতাকা থাকতো সাদা রংয়ের এবং পতাকাবাহী সেনাপতি থাকতেন পৃথক ব্যক্তি। এক্ষণে এই সময়ের মধ্যে প্রেরিত অভিযান সমূহ বিবৃত হ’ল, যা নিম্নরূপ।-
১. সারিইয়া সায়ফুল বাহর (سرية سيف البحر) বা সমুদ্রোপকুলে প্রেরিত বাহিনী: ১ম হিজরী সনের রামাযান মাস (মার্চ ৬২৩ খৃ.)। হযরত হামযাহ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিবের নেতৃত্বে ৩০ সদস্য বিশিষ্ট এই মুহাজির বাহিনী প্রেরিত হয় সিরিয়া হ’তে আবু জাহলের নেতৃত্বে প্রত্যাবর্তনকারী ৩০০ সদস্যের কুরায়েশ কাফেলার গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য। উভয় বাহিনী মদীনা থেকে ২৫০ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে লোহিত সাগরের তীরবর্তী ‘ঈছ’ (العِيْص) নামক স্থানে মুখোমুখি হয়। কিন্তু জুহায়না গোত্রের নেতা মাজদী বিন আমর, যিনি ছিলেন উভয় দলের মিত্র, তাঁর কারণে যুদ্ধ হয়নি। এ যুদ্ধে পতাকা বাহক ছিলেন আবু মারছাদ আল-গানাভী (রাঃ)।[1]
২. সারিইয়া রাবেগ (سرية رابغ) : ১ম হিজরীর শাওয়াল মাস। ওবায়দাহ ইবনুল হারেছ বিন মুত্ত্বালিব-এর নেতৃত্বে ৬০ জনের এই মুহাজির বাহিনী প্রেরিত হয়। মদীনা থেকে দক্ষিণে এবং জেদ্দা থেকে ১৪০ কি.মি. উত্তরে অবস্থিত ‘রাবেগ’ অঞ্চলটি বর্তমানে মক্কা প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত। এই অভিযানে রাবেগ উপত্যকায় আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে ২০০ জনের এক বাহিনীর মুখোমুখি হ’লে উভয় পক্ষে কিছু তীর নিক্ষেপ ব্যতীত তেমন কিছু ঘটেনি। তবে মাক্কী বাহিনী থেকে দু’জন দল ত্যাগ করে মুসলিম বাহিনীতে চলে আসেন। যারা গোপনে মুসলমান ছিলেন। যাদের একজন হ’লেন মিক্বদাদ বিন ‘আমর এবং অন্যজন হ’লেন উৎবাহ বিন গাযওয়ান। এই যুদ্ধে হযরত সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ (রাঃ) কাফেরদের প্রতি সর্বপ্রথম তীর নিক্ষেপ করেন। সেকারণ তিনি أَوَّلُ الْعَرَبِ رَمَى بِسَهْمٍ فِى سَبِيلِ اللهِ ‘আরবদের মধ্যে আল্লাহর রাস্তায় প্রথম তীর নিক্ষেপকারী’ হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।[2] রাসূল (সাঃ) তার জন্য দো‘আ করেছিলেন, اللَّهُمَّ سَدِّدْ سَهْمَهُ وَأَجِبْ دَعْوَتَهُ ‘হে আল্লাহ! তুমি তার তীরকে লক্ষ্যভেদী কর এবং তার দো‘আ কবুল কর’।[3] এ যুদ্ধের পতাকা বাহক ছিলেন মিসত্বাহ বিন আছাছাহ বিন মুত্ত্বালিব (রাঃ)।[4]
৩. সারিইয়া খাররার (سرية الخرّار) : ১ম হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাস। সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে ২০ জনের এই মুহাজির দল প্রেরিত হয় কুরায়েশদের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য। তারা জুহফার নিকটবর্তী ‘খাররার’ উপত্যকা পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসেন। কেননা মক্কার কাফেলা এখান থেকে একদিন আগেই চলে গিয়েছিল। এ যুদ্ধের পতাকা বাহক ছিলেন মিক্বদাদ বিন ‘আমর (রাঃ)।[5]
৪. গাযওয়া ওয়াদ্দান (غزوة ودّان أو الأبواء) : ২য় হিজরীর ছফর মাস (আগষ্ট ৬২৩ খৃঃ)। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সর্বপ্রথম এই অভিযানে নিজেই নেতৃত্ব দেন, যাতে ৭০ জন মুহাজির ছিলেন। মদীনা থেকে ২৫০ কি.মি. দক্ষিণে এই অভিযানে তিনি ১৫ দিন মদীনার বাইরে ছিলেন এবং যাওয়ার সময় খাযরাজ নেতা সা‘দ বিন ওবাদাহ (রাঃ)-কে মদীনার আমীর নিযুক্ত করে যান। এই অভিযানেরও উদ্দেশ্য ছিল কুরায়েশ কাফেলার পথ রোধ করা। কিন্তু বাস্তবে তাদের দেখা মেলেনি। তবে এই সফরে লাভ হয় এই যে, তিনি স্থানীয় বনু যামরাহ (بَنُو ضَمْرَة) গোত্রের সাথে সন্ধিচুক্তি সম্পাদনে সমর্থ হন (ইবনু হিশাম ১/৫৯১)। এ যুদ্ধের পতাকা বাহক ছিলেন হামযা বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব (রাঃ)।[6]
৫. গাযওয়া বুওয়াত্ব (غزوة بواط) : ২য় হিজরীর রবীউল আউয়াল মাস (সেপ্টেম্বর ৬২৩ খৃঃ)। ২০০ ছাহাবীকে নিয়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) স্বয়ং এ অভিযানে বের হন। মদীনা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে ১০০ কি.মি. দূরে এটি অবস্থিত। উমাইয়া বিন খালাফের নেতৃত্বে ১০০ জনের কুরায়েশ কাফেলার গতিরোধ করাই ছিল এ অভিযানের উদ্দেশ্য। কিন্তু কোন সংঘর্ষ হয়নি। এই অভিযানে বের হওয়ার সময় তিনি আউস নেতা সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ)-কে মদীনার আমীর নিযুক্ত করে যান। এ যুদ্ধের পতাকা বাহক ছিলেন সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ (রাঃ)।[7]
৬. গাযওয়া সাফওয়ান(غزوة سفوان) : একই মাসে মক্কার নেতা কুরয বিন জাবের আল-ফিহরী মদীনার চারণভূমি থেকে গবাদিপশু লুট করে নিয়ে গেলে ৭০ জন ছাহাবীকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার পশ্চাদ্ধাবন করেন এবং বদর প্রান্তরের কাছাকাছি সাফওয়ান উপত্যকা পর্যন্ত ধাওয়া করেন। কিন্তু লুটেরাদের ধরতে ব্যর্থ হন। এই অভিযানকে অনেকে গাযওয়া বদরে ঊলা(غَزْوَةُ بَدْرٍ الْأُولَى) বা বদরের প্রথম যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন। এই সময় মদীনার আমীর ছিলেন যায়েদ বিন হারেছাহ (রাঃ)।
উল্লেখ্য যে, এটাই ছিল মদীনার উপকণ্ঠে কুরায়েশদের প্রথম হামলা। এ যুদ্ধের পতাকা বাহক ছিলেন আলী ইবনু আবু ত্বালিব (রাঃ)।[8]
৭. গাযওয়া যুল-‘উশাইরাহ (غزوة ذى العُشيرة) : ২য় হিজরীর জুমাদাল ঊলা ও আখেরাহ মোতাবেক ৬২৩ খৃষ্টাব্দের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাস। ১৫০ বা ২০০ ছাহাবীর একটি দল নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একটি মূল্যবান রসদবাহী কুরায়েশ কাফেলার গতিরোধে বের হন। কিন্তু ইয়াম্বু‘-এর পার্শ্ববর্তী যুল-‘উশায়রা পর্যন্ত গিয়েও তাদের ধরতে ব্যর্থ হন। এ সময় মদীনার আমীর ছিলেন আবু সালামাহ (রাঃ)। আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে এই কুরায়েশ কাফেলাটি বহাল তবিয়তে মক্কায় ফিরে যায় এবং এর ফলেই বদর যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরী হয়। এই অভিযানকালে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বনু মুদলিজ ও তাদের মিত্রদের সাথে সন্ধি চুক্তি সম্পাদন করেন। এ যুদ্ধের পতাকা বাহক ছিলেন হামযা বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব (রাঃ)।[9]
৮. সারিইয়া নাখলা (سرية نخلة) : ২য় হিজরীর রজব মাস (জানুয়ারী ৬২৪ খৃঃ)। আব্দুল্লাহ বিন জাহশের নেতৃত্বে ৮ বা ১২ জন মুহাজির ছাহাবীর একটি ক্ষুদ্র দল প্রেরিত হয়। এ যুদ্ধে প্রেরণের সময় রাসূল (সাঃ) তার হাতে একটি পত্র দেন এবং বলেন, দু’দিন পথ চলার আগ পর্যন্ত যেন পত্রটি না খোলা হয়। দু’দিন চলার পর তিনি পত্র খোলেন এবং পাঠ করার পর সবাইকে বলেন, আমাদেরকে ত্বায়েফ ও মক্কার মধ্যবর্তী নাখলায় অবতরণ করতে বলা হয়েছে এবং সেখানে গিয়ে কুরায়েশ কাফেলার অপেক্ষায় থাকতে বলা হয়েছে। অতএব যিনি শহীদ হ’তে চান কেবল তিনিই আমার সাথে যাবেন। অথবা ইচ্ছা করলে ফিরে যাবেন। এ ব্যাপারে আমি কাউকে চাপ দিব না তবে আমি যেতে প্রস্ত্তত’। তখন সাথী মুহাজিরগণের সবাই তাঁর সঙ্গে থাকলেন, কেউই ফিরে আসলেন না। উক্ত মুহাজিরগণের মধ্যে ছিলেন আমীর আব্দুল্লাহ বিন জাহশ ছাড়াও সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ, আবু হুযায়ফা বিন উৎবা বিন রাবী‘আহ, উক্কাশা বিন মিহছান, উৎবা বিন গাযওয়ান, ওয়াক্বিদ বিন আব্দুল্লাহ, খালেদ বিন বুকাইর ও সোহায়েল বিন বায়যা’ প্রমুখ (ইবনু হিশাম ১/৬০১-০২)।
অতঃপর তাঁরা নাখলা উপত্যকায় পৌঁছে একটি কুরায়েশ কাফেলাকে আক্রমণ করেন ও তাদের নেতা আমর ইবনুল হাযরামীকে হত্যা করে দু’জন বন্দী সহ গণীমতের মাল নিয়ে মদীনায় ফিরে আসেন। এটাই ছিল ইসলামের ইতিহাসে প্রথম গণীমত লাভ এবং প্রথম নিহত হওয়ার ঘটনা ও প্রথম দু’ব্যক্তি বন্দী হওয়ার ঘটনা। ঘটনাটি ঘটে রজব মাসের শেষ দিনে। কেননা তারা দেখলেন যদি আমরা যুদ্ধ না করি, তাহ’লে শত্রু পালিয়ে যায়। এমতাবস্থায় তারা যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেন। সেকারণ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বন্দীদের মুক্তি দেন ও নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের রক্তমূল্য দেন। এ সময় মুসলমানেরা হারাম মাসের বিধান লংঘন করেছে বলে মুশরিকদের রটনার জবাবে সূরা বাক্বারাহ ২১৭ আয়াতটি নাযিল হয়। তাতে বলা হয়,
يَسْأَلُونَكَ عَنِ الشَّهْرِ الْحَرَامِ قِتَالٍ فِيهِ قُلْ قِتَالٌ فِيهِ كَبِيرٌ وَصَدٌّ عَنْ سَبِيلِ اللهِ وَكُفْرٌ بِهِ وَالْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَإِخْرَاجُ أَهْلِهِ مِنْهُ أَكْبَرُ عِنْدَ اللهِ وَالْفِتْنَةُ أَكْبَرُ مِنَ الْقَتْلِ وَلاَ يَزَالُونَ يُقَاتِلُونَكُمْ حَتَّى يَرُدُّوكُمْ عَنْ دِينِكُمْ إِنِ اسْتَطَاعُوا وَمَنْ يَرْتَدِدْ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَيَمُتْ وَهُوَ كَافِرٌ فَأُولَئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ-
‘লোকেরা তোমাকে প্রশ্ন করছে নিষিদ্ধ মাস ও তার মধ্যে যুদ্ধ করা সম্পর্কে। তুমি বল, এ মাসে যুদ্ধ করা মহাপাপ। তবে আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করা ও তাঁর সাথে কুফরী করা এবং মাসজিদুল হারামে প্রবেশে বাধা দেওয়া ও তার অধিবাসীদের বহিষ্কার করা আল্লাহর নিকটে আরও বড় পাপ। আর ফিৎনা (কুফরী) করা যুদ্ধ করার চাইতে বড় পাপ। বস্ত্ততঃ যদি তারা সক্ষম হয়, তবে তারা সর্বদা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, যতক্ষণ না তারা তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন থেকে ফিরাতে পারে। আর তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি স্বধর্ম ত্যাগ করবে, অতঃপর কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে, তাদের দুনিয়া ও আখেরাতের সকল কর্ম নিষ্ফল হবে। তারা জাহান্নামের অধিবাসী হবে এবং সেখানেই চিরকাল থাকবে’ (বাক্বারাহ ২/২১৭)।[10] অর্থাৎ মুসলমানদের এই কাজের তুলনায় মুশরিকদের অপকর্মসমূহ ছিল বহু গুণ বেশী অপরাধজনক। এই যুদ্ধে নিহতের বদলা নিতেই আবু জাহল বদরে যুদ্ধ করতে এসেছিল। এই অভিযান শেষে শা‘বান মাসে মুসলমানদের উপরে জিহাদ ফরয হয় (বাক্বারাহ ২/১৯০-৯৩; মুহাম্মাদ ৪৭/৪-৭, ২০)।
[1]. আর-রাহীক্ব ১৯৭ পৃঃ; ইবনু হিশাম ১/৫৯৫; আল-বিদায়াহ ৩/২৪৪।
[2]. বুখারী হা/৩৭২৮; আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৩১৯৬।
[3]. আর-রাহীক্ব ১৯৮ পৃঃ; হাকেম হা/৪৩১৪, হাদীছ ছহীহ; আল-বিদায়াহ ৮/৭৬।
[4]. যাদুল মা‘আদ ৩/১৪৬; ইবনু হিশাম ১/৫৯১; আল-বিদায়াহ ৩/২৩৪; হাকেম হা/৪৮৬১।
[5]. ওয়াক্বেদী, মাগাযী ১/১১; আর-রাহীক্ব ১৯৮ পৃঃ।
[6]. আর-রাহীক্ব ১৯৮ পৃঃ; আল-বিদায়াহ ৩/২৪৩।
[7]. আর-রাহীক্ব ১৯৯ পৃঃ; ইবনু হিশাম ১/৫৯৮; ইবনু সা‘দ, ত্বাবাক্বাতুল কুবরা ২/৫।
[8]. আর-রাহীক্ব ১৯৯ পৃঃ; আল-বিদায়াহ ৩/২৪৭।
[9]. আর-রাহীক্ব ১৯৯ পৃঃ; ইবনু হিশাম ১/৫৯৮-৫৯৯; ফাৎহুল বারী ‘মাগাযী’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১, ৭/২৮০; বুখারী হা/৩৯৪৯।
[10]. আর-রাহীক্ব ২০০-০১ পৃঃ; যাদুল মা‘আদ ৩/১৫০; ইবনু হিশাম ১/৬০১-০৫।
ক্বিবলা পরিবর্তন (تحويل القبلة)
নাখলা অভিযান শেষ হবার পর ২য় হিজরীর শা‘বান মাসে (ফেব্রুয়ারী ৬২৪ খৃ.) ক্বিবলা পরিবর্তনের আদেশ সূচক আয়াতটি (বাক্বারাহ ২/১৪৪) নাযিল হয়। যাতে ১৬/১৭ মাস পরে বায়তুল মুক্বাদ্দাস হ’তে কা‘বার দিকে মুখ ফিরিয়ে ছালাত আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়।[1] এই হুকুম নাযিলের মাধ্যমে কপট ইহূদীদের মুখোশ খুলে যায়। যারা মুসলমানদের কাতারে শামিল হয়েছিল স্রেফ ফাটল ধরানো ও বিশৃংখলা সৃষ্টির জন্য। এখন তারা তাদের নিজস্ব অবস্থানে ফিরে গেল এবং মুসলমানেরাও তাদের কপটতা ও খেয়ানত থেকে বেঁচে গেল। একই সময়ে রামাযানের ছিয়াম ও যাকাতুল ফিৎর ফরয করা হয়।[2]
[1]. কুরতুবী, ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা বাক্বারাহ ১৪৪ আয়াত; বুখারী হা/৪০; মুসলিম হা/৫২৫; ইবনু হিশাম ১/৬০৬।
[2]. ইবনু কাছীর, আল-ফুছূল ফী সীরাতির রাসূল (সাঃ); তাহকীক : মুহাম্মাদ আলী হালাবী আল-আছারী (শারজাহ : দারুল ফাৎহ, ১ম সংস্করণ ১৪১৬/১৯৯৬ খৃ.) ৪৩ পৃঃ।
সূক্ষ্ম ইঙ্গিত (الإشارة السرية لبداية الدور الجديد)
এর মধ্যে মুসলমানদের জন্য সূক্ষ্ম ইঙ্গিত ছিল যে, এখন থেকে একটি নতুন যুগের সূচনা হ’তে যাচ্ছে, যা ফেলে আসা ক্বিবলা কা‘বাগৃহের উপরে মুসলমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। একই সময়ে সূরা বাক্বারাহ ১৯০-১৯৩ আয়াত নাযিল হয়। যাতে বলা হয় وَأَخْرِجُوْهُم مِّنْ حَيْثُ أَخْرَجُوْكُمْ ‘যে স্থান হ’তে তারা তোমাদের বহিষ্কার করেছে, সে স্থান হ’তে তোমরাও তাদের বহিষ্কার কর’। অতঃপর যুদ্ধের নিয়মবিধি নাযিল হয় সূরা মুহাম্মাদ ৪-৭ আয়াতে। অতঃপর যুদ্ধ ভয়ে ভীতু কাপুরুষদের নিন্দা করে একই সূরার ২০ আয়াতটি নাযিল হয়। একই সময়ে পরপর এসব আয়াত নাযিলের মাধ্যমে এটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল যে, হক ও বাতিলের মধ্যে একটা চূড়ান্ত বুঝাপড়ার সময়কাল অত্যাসন্ন। কেননা আল্লাহ কখনোই চান না যে, তাঁর পবিত্র গৃহ নাপাক মুশরিক ও পৌত্তলিকদের দখলীভুক্ত হয়ে থাকুক। বলা বাহুল্য ক্বিবলা পরিবর্তনের হুকুম নাযিলের পর রাসূল (সাঃ)-এর মধ্যে এবং সাধারণভাবে সকল মুসলমানের মধ্যে আশা ও আনন্দের ঢেউ জেগে ওঠে এবং তাদের অন্তরে মক্কায় ফিরে যাওয়ার আকাংখা ও উদ্দীপনা তীব্র হয়ে ওঠে, যা উক্ত ঘটনার দেড় মাস পরে বদর যুদ্ধে তাদেরকে বিজয়ী হ’তে সাহায্য করে।
নাখলা যুদ্ধের ফলাফল (نةيجة سرية نخلة)
নাখলা অভিযানের ফলে কুরায়েশদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়। তারা নিশ্চিত হয় যে, অবশেষে তাদের আশংকাই সত্যে পরিণত হ’তে যাচ্ছে এবং মদীনা এখন তাদের জন্য বিপদসংকুল এলাকায় পরিণত হয়েছে। তারা এটাও বুঝে নিল যে, যেকোন সময় মুহাজিরগণ মক্কা আক্রমণ করতে পারে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তাদের হঠকারিতা ও উদ্ধত আচরণ থেকে তারা বিরত হ’ল না। তারা সন্ধির পথে না গিয়ে যুদ্ধের পথ বেছে নিল এবং মদীনায় হামলা করে মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলার উদ্দেশ্যে বদর যুদ্ধে রওয়ানা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। নাখলা যুদ্ধে আমর ইবনুল হাযরামী হত্যার প্রতিশোধ নেওয়াটা ছিল একটি অজুহাত মাত্র।
বদর যুদ্ধ (غزوة البدر الكبرى)
হিজরতের অনধিক ১৯ মাস পর ২য় হিজরীর ১৭ই রামাযান শুক্রবার সকালে (৬২৪ খৃ. ১১ই মার্চ) ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়।[1] এই যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে ৬ জন মুহাজির ও ৮ জন আনছারসহ মোট ১৪ জন শহীদ হন। কাফের পক্ষে ৭০ জন নিহত ও ৭০ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বন্দী হয় (আর-রাহীক্ব ২২৪ পৃঃ)। বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরূপ।-
বদর হ’ল মদীনা থেকে ১৬০ কি. মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত একটি প্রসিদ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্রের নাম। যেখানে পানির প্রাচুর্য থাকায় স্থানটির গুরুত্ব ছিল সর্বাধিক। এখানেই সংঘটিত হয় ইসলামের ইতিহাসে তাওহীদ ও শিরকের মধ্যকার প্রথম সশস্ত্র মুকাবিলা। ১৯ মাসের এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে কুরায়েশরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে মদীনা থেকে বের করে দেবার জন্য নানাবিধ অপচেষ্টা চালায়। যেমনভাবে তারা ইতিপূর্বে হাবশায় হিজরতকারী মুসলমানদের সেখান থেকে বের করে দেবার ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু সেখানে তারা ব্যর্থ হয়েছিল প্রধানতঃ তিনটি কারণে। (১) সেখানে ছিল একজন ধর্মপরায়ণ খ্রিষ্টান বাদশাহ আছহামা নাজাশীর রাজত্ব। যিনি নিজে ইনজীলে পন্ডিত ছিলেন এবং সেকারণে আখেরী নবী হিসাবে রাসূল (সাঃ)-এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। (২) মক্কা ও হাবশার মধ্যখানে ছিল আরব সাগরের একটি প্রশস্ত শাখা। যা পেরিয়ে ওপারে গিয়ে হামলা করা সম্ভব ছিল না। (৩) হাবশার লোকেরা ছিল হিব্রুভাষী। তাদের সাথে কুরায়েশদের ভাষাগত মিল ছিল না এবং কোনরূপ আত্মীয়তা বা পূর্ব পরিচয় ছিল না। ধর্ম ও অঞ্চলগত মিলও ছিল না।
পক্ষান্তরে ইয়াছরিব ছিল কুরায়েশদের খুবই পরিচিত এলাকা। যার উপর দিয়ে তারা নিয়মিতভাবে সিরিয়াতে ব্যবসার জন্য যাতায়াত করত। তাছাড়া তাদের সঙ্গে ভাষাগত মিল এবং আত্মীয়তাও ছিল। অধিকন্তু রাস্তা ছিল স্থলপথ, যেখানে নদী-নালার কোন বাধা নেই। দূরত্ব বর্তমানের হিসাবে প্রায় ৪৬০ কিলোমিটার হ’লেও সেখানে যাতায়াতে তারা অভ্যস্ত ছিল। এক্ষণে আমরা বদর যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পরোক্ষ কারণগুলি সংক্ষেপে বর্ণনা করব।-
[1]. ওয়াক্বেদী, মাগাযী ১/২; ইবনু সা‘দ ২/৮; ইবনু হিশাম ১/২৪০, ৬২৬; আর-রাহীক্ব ২১২ পৃঃ; মানছূরপুরী ১৭ই রমাযান মঙ্গলবার মোতাবেক ৩রা মার্চ ৬২৪ খ্রিঃ বলেছেন (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/৩৬৮ নকশা)।
পরোক্ষ কারণ সমূহ (الأسباب الضمنية لغزوة بدر)
মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের নিকটে কুরায়েশ নেতাদের পত্র প্রেরণ। উল্লেখ্য যে, আব্দুল্লাহ তখনও ইসলাম কবুল করেননি। রাসূল (সাঃ)-এর আগমনের কারণে ইয়াছরিবের নেতৃত্ব লাভের মোক্ষম সুযোগটি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় তিনি ছিলেন মনে মনে দারুণভাবে ক্ষুব্ধ। রাসূল (সাঃ)-এর প্রতি তার এই ক্ষোভটাকেই কুরায়েশরা কাজে লাগায় এবং নিম্নোক্ত ভাষায় কঠোর হুমকি দিয়ে তার নিকটে চিঠি পাঠায়।-
إِنَّكُمْ آوَيْتُمْ صَاحِبَنَا وَإِنَّا نُقْسِمُ بِاللهِ لَتُقَاتِلُنَّهُ أَوْ لَتُخْرِجُنَّهُ أَوْ لَنَسِيرَنَّ إِلَيْكُمْ بِأَجْمَعِنَا حَتَّى نَقْتُلَ مُقَاتِلَتَكُمْ وَنَسْتَبِيحَ نِسَاءَكُمْ
‘তোমরা আমাদের লোকটিকে (মুহাম্মাদকে) আশ্রয় দিয়েছ। এজন্য আমরা আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, হয় তোমরা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে ও তাকে বের করে দিবে নতুবা আমরা তোমাদের উপরে সর্বশক্তি নিয়ে হামলা করব। তোমাদের যোদ্ধাদের হত্যা করব ও নারীদের হালাল করব’।[1]
এই পত্র পেয়ে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই দ্রুত তার সমমনাদের সাথে গোপন বৈঠকে বসে গেল। কিন্তু সংবাদ রাসূল (সাঃ)-এর কানে পৌঁছে গেল। তিনি সরাসরি তাদের বৈঠকে এসে হাযির হ’লেন এবং তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, আমি দেখছি কুরায়েশদের হুমকিকে তোমরা দারুণভাবে গ্রহণ করেছ। অথচ এর মাধ্যমে তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে যে পরিমাণ ক্ষতির মুখে ঠেলে দিতে যাচ্ছ, কুরায়েশরা তোমাদের সেই পরিমাণ ক্ষতি করতে সক্ষম হবে না। أَتُرِيدُونَ أَنْ تُقَاتِلُوا أَبْنَاءَكُمْ وَإِخْوَانَكُمْ ‘তোমরা কি তোমাদের সন্তান ও ভাইদের সাথে (অর্থাৎ মুসলমানদের সাথে) যুদ্ধ করতে চাও’? রাসূল (সাঃ)-এর মুখে এ বক্তব্য শুনে বৈঠক ভেঙ্গে গেল ও দল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।[2] যদিও আব্দুল্লাহর অন্তরে হিংসার আগুন জ্বলতে থাকল। তবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুনাফিক ও ইহূদীদের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলতে থাকেন। যাতে হিংসার আগুন জ্বলে না ওঠে।
(২) আউস গোত্রের নেতা সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ) ওমরাহ করার জন্য মক্কায় যান ও কুরায়েশ নেতা উমাইয়া বিন খালাফের অতিথি হন। উমাইয়ার ব্যবস্থাপনায় দুপুরে নিরিবিলি ত্বাওয়াফ করতে দেখে আবু জাহল তাকে ধমকের সুরে বলেন, أَلاَ أَرَاكَ تَطُوفُ بِمَكَّةَ آمِنًا، وَقَدْ أَوَيْتُمُ الصُّبَاةَ؟ ‘তোমাকে দেখছি মক্কায় বড় নিরাপদে ত্বাওয়াফ করছ। অথচ তোমরা ধর্মত্যাগী লোকগুলোকে আশ্রয় দিয়েছ! ... আল্লাহর কসম! যদি তুমি আবু ছাফওয়ানের (উমাইয়া বিন খালাফের) সাথে না থাকতে, তবে নিরাপদে ফিরে যেতে পারতে না’। একথা শুনে সা‘দ চীৎকার দিয়ে বলে ওঠেন, তুমি আমাকে এখানে বাধা হয়ে দাঁড়ালে আমি তোমার জন্য এর চেয়ে কঠিন বাধা হয়ে দাঁড়াবো। আর তাতে মদীনা হয়ে তোমাদের ব্যবসায়ের রাস্তা বন্ধ হবে’।[3]
(৩) কুরায়েশ নেতারা ও তাদের দোসররা হর-হামেশা তৎপর ছিল মুহাজিরগণের সর্বনাশ করার জন্য। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এতই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, তিনি রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারতেন না। আয়েশা (রাঃ) বলেন, এ সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রায়ই বিনিদ্র রজনী কাটাতেন। এক রাতে তিনি বললেন,لَيْتَ رَجُلاً صَالِحًا مِنْ أَصْحَابِىْ يَحْرِسُنِى اللَّيْلَةَ ‘যদি আমার ছাহাবীগণের মধ্যে যোগ্য কেউ এসে আমাকে রাতে পাহারা দিত’! আয়েশা (রাঃ) বলেন, এমন সময় হঠাৎ অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, কে? জবাব এল, আমি সা‘দ ইবনু আবী ওয়াকক্বাছ। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, কি উদ্দেশ্যে আগমন? সা‘দ বললেন, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) সম্পর্কে আমার অন্তরে ভয় উপস্থিত হ’ল। তাই এসেছি তাঁকে পাহারা দেবার জন্য। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার জন্য কল্যাণের দো‘আ করলেন ও ঘুমিয়ে গেলেন। এমনকি আমরা তাঁর নাক ডাকানোর শব্দ শুনতে পেলাম’।[4] এরপর থেকে এরূপ পাহারাদারীর ব্যবস্থা নিয়মিত চলতে থাকে। যতক্ষণ না নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়- وَاللهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ ‘আল্লাহ তোমাকে লোকদের হামলা থেকে রক্ষা করবেন’ (মায়েদাহ ৫/৬৭)। উক্ত আয়াত নাযিলের পর রাসূল (সাঃ) ছাহাবীদের উদ্দেশ্যে বললেন, يَا أَيُّهَا النَّاسُ انْصَرِفُوْا عَنِّى فَقَدْ عَصَمَنِى اللهُ عَزَّ وَجَلَّ ‘হে লোক সকল! তোমরা ফিরে যাও! মহান আল্লাহ আমাকে নিরাপত্তা দান করেছেন’।[5] কুরায়েশদের অপতৎপরতা কেবল রাসূল (সাঃ)-এর বিরুদ্ধেই ছিল না; বরং সাধারণ মুহাজির মুসলমানের বিরুদ্ধেও ছিল। আর এটাই স্বাভাবিক।
[1]. আবুদাঊদ হা/৩০০৪ ‘খারাজ’ অধ্যায় ‘বনু নাযীর-এর বর্ণনা’ অনুচ্ছেদ-২৩।
[2]. আবুদাঊদ হা/৩০০৪; মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক্ব হা/৯৭৩৩, সনদ ছহীহ।
[3]. বুখারী হা/৩৯৫০ ‘মাগাযী’ অধ্যায় ২ পরিচ্ছেদ।
[4]. বুখারী হা/৭২৩১; মুসলিম হা/২৪১০ (৪০); মিশকাত হা/৬১০৫।
[5]. তিরমিযী হা/৩০৪৬, সনদ হাসান ‘তাফসীর’ অধ্যায়।
বদর যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ (الأسباب المباشرة لغزوة بدر)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সিরিয়া ফেরত মক্কার ব্যবসায়ী কাফেলার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও তাদের পুরা খবরাখবর সংগ্রহের জন্য তালহা বিন উবায়দুল্লাহ ও সাঈদ বিন যায়েদকে প্রেরণ করেন। তারা ‘হাওরা’ (الْحَوْرَاءُ) নামক স্থানে পৌঁছে জানতে পারেন যে, আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে বিরাট এক ব্যবসায়ী কাফেলা মক্কার পথে সত্বর ঐ স্থান অতিক্রম করবে। যাদেরকে ইতিপূর্বে যুল-‘উশায়রা পর্যন্ত গিয়েও ধরা যায়নি। যে কাফেলায় রয়েছে এক হাযার উট বোঝাই কমপক্ষে ৫০,০০০ স্বর্ণমুদ্রার মাল-সম্পদ এবং তাদের প্রহরায় রয়েছে আমর ইবনুল ‘আছ সহ ৩০ থেকে ৪০ জন সশস্ত্র জোয়ান। উল্লেখ্য যে, এই বাণিজ্যে মক্কার সকল নারী-পুরুষ অংশীদার ছিল। তারা দ্রুত মদীনায় ফিরে এসে রাসূল (সাঃ)-কে এই খবর দেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) চিন্তা করলেন, এই বিপুল সম্পদ মক্কায় পৌঁছে গেলে তার প্রায় সবই ব্যবহার করা হবে মদীনায় মুহাজিরগণকে ধ্বংস করার কাজে। অতএব আর মোটেই কালক্ষেপণ না করে তিনি তখনই বেরিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন ওই কাফেলাকে আটকানোর জন্য।[1]
[1]. ইবনু হিশাম ১/৬০৬, আর-রাহীক্ব ২০৪ পৃঃ, ওয়াক্বেদী, মাগাযী ১/২০০।
বদর যুদ্ধের বিবরণ (قصة غزوة بدر)
বিগত অভিযানগুলির ন্যায় এ অভিযানেরও উদ্দেশ্য ছিল কুরায়েশ কাফেলাকে আটকানো। তাই অন্যান্য অভিযানের মতই এটাকে ভাবা হয়েছিল। ফলে কেউ যোগ দিয়েছিল, কেউ দেয়নি এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কাউকে অভিযানে যেতে বাধ্য করেননি। অবশেষে ৮ই রামাযান সোমবার অথবা ১২ই রামাযান শনিবার ৩১৩, ১৪ বা ১৭ জনের একটি কাফেলা নিয়ে সাধারণ প্রস্ত্ততি সহ তিনি রওয়ানা হ’লেন। যার মধ্যে ৮২, ৮৩ অথবা ৮৬ জন ছিলেন মুহাজির এবং বাকীগণ ছিলেন আনছার। আনছারগণের মধ্যে ৬১ জন ছিলেন আউস এবং ১৭০ জন ছিলেন খাযরাজ গোত্রের।[1] বি’রে সুক্বইয়া নামক স্থানে এসে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ক্বায়েস বিন আবু ছা‘ছা‘আহকে সংখ্যা গণনা করতে বললেন। পরে সংখ্যা জানতে পেরে রাসূল (সাঃ) খুশী হয়ে আল্লাহর প্রশংসা করলেন এবং বললেন, তালূতের সৈন্য সংখ্যাও তাই ছিল’।[2] তিন শতাধিক লোকের এই বাহিনীতে মাত্র ২টি ঘোড়া ছিল যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম ও মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদের এবং ৭০টি উট ছিল। যাতে দু’তিন জন করে পালাক্রমে সওয়ার হয়ে চলতে হ’ত। রাসূল (সাঃ), আলী ও আবু লুবাবাহ এবং পরবর্তীতে তার বদলে মারছাদ বিন আবু মারছাদ গানাভীর জন্য একটি উট বরাদ্দ ছিল। যাতে পায়ে হাঁটার পালা আসলে রাসূল (সাঃ) নিজেও হাঁটতেন। এ সময় মদীনার আমীর নিযুক্ত হন অন্ধ ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূম (রাঃ)।
[1]. ইবনু হিশাম ২/৬১২; ইবনু সা‘দ ২/৮; আর-রাহীক্ব ২০৪-০৫ পৃঃ।
[2]. বুখারী হা/৩৯৫৯; মুসলিম হা/১৭৬৩; বায়হাক্বী-দালায়েল, ৩/৭৩; কুরতুবী হা/৩১৮৮।
ইবনু ইসহাক বলেন, বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ৩১৪ জন। তন্মধ্যে মুহাজির ছিলেন ৮৩ জন। বাকী আনছারগণের মধ্যে আউস গোত্রের ৬১ জন ও খাযরাজ গোত্রের ১৭০ জন (ইবনু হিশাম ১/৭০৬)।
মাদানী বাহিনীর অবস্থান ও পরামর্শ সভা (موقف الجيش المدنى وجلسة الاستشار)
আবু সুফিয়ানের বাণিজ্য কাফেলার নিরাপদে নিষ্ক্রমন এবং আবু জাহলের নেতৃত্বে মাক্কী বাহিনীর দ্রুত ধেয়ে আসা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যাফরানে (ذَفرَان) অবস্থানকালেই অবহিত হন। এই অনাকাংখিত পরিস্থিতি এবং অবশ্যম্ভাবী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মুকাবিলা কিভাবে করা যায়, এ নিয়ে তিনি মদীনা থেকে ৬৮ কি. মি. দক্ষিণে ‘রাওহা’ (الرَّوْحَاء)-তে অবতরণ করে উচ্চ পর্যায়ের পরামর্শ বৈঠক আহবান করলেন’ (ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা আনফাল ৭ আয়াত)। কেননা তিনি যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্ততি নিয়ে মদীনা থেকে বের হননি।
মুহাজিরগণের মধ্যে হযরত আবুবকর ও ওমর (রাঃ) তাদের মূল্যবান পরামর্শ প্রদান করলেন। অতঃপর মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ (রাঃ) দাঁড়িয়ে ওজস্বিনী ভাষায় বললেন, يَا رَسُولَ اللهِ، امْضِ لِمَا أَرَاكَ اللهُ فَنَحْنُ مَعَكَ، واللهِ لاَ نَقُولُ لَكَ كَمَا قَالَتْ بَنُو إسْرَائِيلَ لِمُوسَى: اذْهَبْ أَنْتَ وَرَبُّكَ فَقاتِلاَ، إِنَّا هَاهُنا قاعِدُونَ ‘হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর দেখানো পথে আপনি এগিয়ে চলুন। আমরা আপনার সঙ্গে আছি। আল্লাহর কসম! আমরা আপনাকে ঐরূপ বলব না, যেরূপ বনু ইস্রাঈল তাদের নবী মূসাকে বলেছিল যে, ‘তুমি ও তোমার রব যাও গিয়ে যুদ্ধ কর! আমরা এখানে বসে রইলাম’ (মায়েদাহ ৫/২৪)। বরং আমরা বলব, اِذْهَبْ أَنْتَ وَرَبُّكَ فَقَاتِلاَ إنَّا مَعَكُمَا مُقَاتِلُونَ ‘আপনি ও আপনার রব যান ও যুদ্ধ করুন, আমরা আপনাদের সাথে যুদ্ধরত থাকব’।فَوَ الَّذِيْ بَعَثَكَ بِالْحَقِّ لَوْ سِرْتَ بِنَا إلَى بِرْكِ الْغِمَادِ لَجَالَدْنَا مَعَكَ مِنْ دُونِهِ حَتَّى تَبْلُغَهُ ‘সেই সত্তার কসম, যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন, যদি আপনি আমাদেরকে নিয়ে ‘বারকুল গিমাদ’[1] পর্যন্ত চলে যান, তবে আমরা অবশ্যই আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে সেই পর্যন্ত পৌঁছে যাব’। মিক্বদাদের এই জোরালো বক্তব্য শুনে আললাহর রাসূল (সাঃ) খুবই প্রীত হ’লেন এবং তার জন্য কল্যাণের দো‘আ করলেন’(دَعَا لَهُ بِخَيْرٍ)।[2]
সংখ্যালঘু মুহাজিরগণের উপরোক্ত তিন নেতার বক্তব্য শোনার পর সংখ্যাগুরু আনছারদের পরামর্শ চাইলে আউস গোত্রের নেতা সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি হয়ত আশংকা করছেন যে, আমাদের সঙ্গে আপনার চুক্তি অনুযায়ী আনছারগণ কেবল (মদীনা) শহরে অবস্থান করেই আপনাদের সাহায্য করা কর্তব্য মনে করে। জেনে রাখুন, আমি আনছারদের পক্ষ থেকেই বলছি, যেখানে চান সেখানে আপনি আমাদের নিয়ে চলুন। যার সঙ্গে চান আপনি সন্ধি করুন বা ছিন্ন করুন- সর্বাবস্থায় আমরা আপনার সাথে আছি। যদি আপনি অগ্রসর হয়ে ‘বারকুল গিমাদ’ পর্যন্ত চলে যান, তবুও আমরা আপনার সাথেই থাকব।لَوْ اسْتَعْرَضْتَ بِنَا هَذَا الْبَحْرَ فَخُضْتَهُ لَخُضْنَاهُ مَعَكَ ‘যদি আমাদেরকে নিয়ে আপনি এই সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তবে আমরাও আপনার সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ব’। مَا تَخَلَّفَ مِنَّا رَجُلٌ وَاحِدٌ، فَسِرْ بِنَا عَلَى بَرَكَةِ اللهِ ‘আমাদের একজন লোকও পিছিয়ে থাকবে না। অতএব আপনি আমাদের নিয়ে আল্লাহর নামে এগিয়ে চলুন’। সা‘দের উক্ত কথা শুনে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) খুবই খুশী হ’লেন ও উদ্দীপিত হয়ে বললেন, سِيرُوا عَلَى بَرَكَةِ اللهِ وَأَبْشِرُوا، فَإِنَّ اللهَ تَعَالَى قَدْ وَعَدَنِي إحْدَى الطَّائِفَتَيْنِ واللهِ لَكَأَنِّي الْآنَ أَنْظُرُ إلَى مَصَارِعِ الْقَوْمِ‘আল্লাহর রহমতের উপর তোমরা বেরিয়ে পড়ো এবং সুসংবাদ গ্রহণ কর। কেননা আল্লাহ তা‘আলা আমাকে দু’টি দলের কোন একটির বিজয় সম্পর্কে ওয়াদা দান করেছেন। আল্লাহর কসম! আমি এখন ওদের বধ্যভূমিগুলো দেখতে পাচ্ছি’।[3]
একথাটি কুরআনে এসেছে এভাবে,
وَإِذْ يَعِدُكُمُ اللهُ إِحْدَى الطَّائِفَتِيْنِ أَنَّهَا لَكُمْ وَتَوَدُّوْنَ أَنَّ غَيْرَ ذَاتِ الشَّوْكَةِ تَكُوْنُ لَكُمْ وَيُرِيْدُ اللهُ أَنْ يُحِقَّ الحَقَّ بِكَلِمَاتِهِ وَيَقْطَعَ دَابِرَ الْكَافِرِيْنَ- لِيُحِقَّ الْحَقَّ وَيُبْطِلَ الْبَاطِلَ وَلَوْ كَرِهَ الْمُجْرِمُوْنَ- (الأنفال ৭-৮)
‘আর যখন আল্লাহ দু’টি দলের একটির ব্যাপারে তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, সেটি তোমাদের হস্তগত হবে। আর তোমরা কামনা করছিলে যে, যাতে কোনরূপ কণ্টক নেই, সেটাই তোমাদের ভাগে আসুক (অর্থাৎ বিনা যুদ্ধে তোমরা জয়ী হও)। অথচ আল্লাহ চাইতেন সত্যকে স্বীয় কালামের মাধ্যমে (প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে) সত্যে পরিণত করতে এবং কাফিরদের মূল কর্তন করে দিতে’। ‘যাতে তিনি সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে দেন, যদিও পাপাচারীরা এটাকে অপসন্দ করে’ (আনফাল ৮/৭-৮)।
পরামর্শ সভায় আবু আইয়ূব আনছারীসহ কিছু ছাহাবী বাস্তব অবস্থার বিবেচনায় এবং এই অপ্রস্ত্তত অবস্থায় যুদ্ধ না করে ফিরে যাওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। কেননা তাঁরা এসেছিলেন বাণিজ্য কাফেলা আটকানোর জন্য, বড় ধরনের কোন যুদ্ধ করার জন্য নয়। কিন্তু আল্লাহ এতে নাখোশ হয়ে আয়াত নাযিল করেন,
كَمَا أَخْرَجَكَ رَبُّكَ مِنْ بَيْتِكَ بِالْحَقِّ وَإِنَّ فَرِيْقًا مِّنَ الْمُؤْمِنِيْنَ لَكَارِهُوْنَ- يُجَادِلُوْنَكَ فِي الْحَقِّ بَعْدَ مَا تَبَيَّنَ كَأَنَّمَا يُسَاقُوْنَ إِلَى الْمَوْتِ وَهُمْ يَنْظُرُوْنَ- (الأنفال ৫-৬)-
‘যেমনভাবে তোমাকে তোমার গৃহ থেকে তোমার পালনকর্তা বের করে এনেছেন সত্য সহকারে। অথচ মুমিনদের একটি দল তাতে অনীহ ছিল’। ‘তারা তোমার সাথে বিবাদ করছিল সত্য বিষয়টি (অর্থাৎ যুদ্ধ) প্রকাশিত হওয়ার পর। তাদেরকে যেন মৃত্যুর দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং তারা যেন তা স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছে’।[4] অর্থাৎ অসত্যকে প্রতিহত করার জন্য ও সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নবীকে তার পালনকর্তা যেভাবে মদীনার গৃহ থেকে বের করে এনেছেন, তেমনিভাবে তিনি কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রস্ত্ততির জন্য এখন যা কিছু করছেন, সবই আল্লাহর হুকুমে করছেন। অতএব তোমাদের উচিত তাকে পূর্ণ সহযোগিতা করা। এভাবে আল্লাহ কোনরূপ পূর্ব ঘোষণা ও প্রয়োজনীয় প্রস্ত্ততি ছাড়াই উভয় বাহিনীকে মুখোমুখি করে দিলেন। যার মধ্যে ছিল তাঁর একটি অত্যন্ত দূরদর্শী পরিকল্পনা। যেমন আল্লাহ বলেন,
إِذْ أَنْتُمْ بِالْعُدْوَةِ الدُّنْيَا وَهُمْ بِالْعُدْوَةِ الْقُصْوَى وَالرَّكْبُ أَسْفَلَ مِنْكُمْ وَلَوْ تَوَاعَدْتُمْ لاَخْتَلَفْتُمْ فِي الْمِيعَادِ وَلَكِنْ لِيَقْضِيَ اللهُ أَمْرًا كَانَ مَفْعُولاً لِيَهْلِكَ مَنْ هَلَكَ عَنْ بَيِّنَةٍ وَيَحْيَى مَنْ حَيَّ عَنْ بَيِّنَةٍ وَإِنَّ اللهَ لَسَمِيعٌ عَلِيمٌ
‘স্মরণ কর, যখন তোমরা (মদীনার) নিকট প্রান্তে ছিলে এবং কাফের বাহিনী ছিল দূরপ্রান্তে। আর (আবু সুফিয়ানের ব্যবসায়ী) কাফেলা ছিল তোমাদের নিম্নভূমিতে। যদি তোমরা উভয় দল আগে থেকে যুদ্ধের ব্যাপারে ওয়াদাবদ্ধ হ’তে, তাহ’লে (সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে) তোমরা সে ওয়াদা রক্ষায় মতবিরোধ করতে। কিন্তু আল্লাহ (উভয় দলকে যুদ্ধে সমবেত করার) এমন একটি কাজ সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন, যা নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। এটা এজন্য যাতে যে ধ্বংস হয় সে যেন (ইসলামের) সত্যতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ধ্বংস হয় এবং যে বেঁচে থাকে সে যেন সত্য প্রতিষ্ঠার পর বেঁচে থাকে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও মহাজ্ঞানী’ (আনফাল ৮/৪২)।
পরামর্শ সভায় সবধরনের মতামত আসতে পারে। এটা কোন দোষের ছিল না। কিন্তু ছাহাবায়ে কেরামের উচ্চ মর্যাদার সঙ্গে এই সামান্যতম ভীরুতাকেও আল্লাহ পসন্দ করেননি। তাই উপরোক্ত ধমকিপূর্ণ আয়াত নাযিল হয়। যা ছাহাবায়ে কেরামের ঈমান শতগুণে বৃদ্ধি করে। তিরমিযী, হাকেম, আহমাদ প্রভৃতি হাদীছ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, বদর যুদ্ধে কাফেররা পরাজিত হবার পর রাসূল (সাঃ)-কে বলা হ’ল যে, আমাদের কেবল বাণিজ্য কাফেলার বিষয়ে বলা হয়েছিল। এর বেশী কিছু নয়। তখন ঐ ব্যক্তিকে উচ্চৈঃস্বরে ডেকে আববাস বলেন, (তখন তিনি বন্দী ছিলেন), আল্লাহ তাঁকে ওয়াদা করেছিলেন দু’টি দলের একটি সম্পর্কে (আনফাল ৭) এবং সেটি আল্লাহ তাঁকে দিয়েছেন। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, তুমি ঠিক বলেছ’।[5]
পরামর্শ সভায় যুদ্ধে অগ্রগমনের সিদ্ধান্ত হওয়ার পর আবু লুবাবাহ ইবনু আব্দিল মুনযিরকে ‘আমীর’ নিযুক্ত করে মদীনায় ফেরৎ পাঠানো হয়। অতঃপর কাফেলার মূল পতাকা বহনের দায়িত্ব দেওয়া হয় মদীনায় প্রথম দাঈ মুছ‘আব বিন ওমায়ের (রাঃ)-কে। ইতিপূর্বেকার সকল পতাকার ন্যায় আজকের এ পতাকাও ছিল শ্বেত বর্ণের। ডান বাহুর সেনাপতি নিযুক্ত হন যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম এবং বাম বাহুর জন্য মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ (রাঃ)। পুরা বাহিনীতে এ দু’জনেরই মাত্র দু’টি ঘোড়া ছিল। পশ্চাদ্ভাগের সেনাপতি নিযুক্ত হন ক্বায়েস বিন আবু ছা‘ছা‘আহ (রাঃ)। এতদ্ব্যতীত মুহাজিরগণের পতাকা বাহক হন আলী (রাঃ) এবং আনছারগণের সা‘দ ইবনু মু‘আয (রাঃ) অথবা হুবাব ইবনুল মুনযির। উভয় পতাকাই ছিল কালো রংয়ের। আর সার্বিক কম্যান্ডের দায়িত্বে থাকেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)।[6]
[1]. বারকুল গিমাদ : এটির অবস্থান নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন, স্থানটি ইয়ামন সীমান্তে অবস্থিত। কেউ বলেছেন, হিজরের শেষ প্রান্তে। তবে সুহায়লী বলেন, আমি কোন একটি তাফসীরের কিতাবে দেখেছি যে, এটি হাবশার একটি শহর (ইবনু হিশাম ১/৬১৫, টীকা-১)। তাফসীর ইবনু কাছীর সূরা আনফাল ৮ আয়াতের টীকায় বলা হয়েছে, এটি হল মক্কার আগে পাঁচ দিনের দূরত্বে সাগরের তীরবর্তী স্থান।
[2]. আহমাদ হা/১৮৮৪৭; ছহীহাহ হা/৩৩৪০।
[3]. ইবনু হিশাম ১/৬১৫; আহমাদ হা/১৮৮৪৭; ছহীহাহ হা/৩৩৪০; তাফসীর ত্বাবারী হা/১৫৭২০ সনদ ছহীহ; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা আনফাল ৮ আয়াত; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৫৯ পৃঃ।
[4]. আনফাল ৮/৫-৬; ঐ, তাফসীর ইবনে কাছীর; ফাৎহুল বারী হা/৩৭৩৬ ‘তাফসীর’ অধ্যায়; হায়ছামী বলেন, ত্বাবারাণী বলেছেন, সনদ হাসান।
[5]. তিরমিযী হা/৩০৮০; হাকেম হা/৩২৬১; আহমাদ হা/২০২২; আরনাঊত্ব বলেন, ইকরিমা থেকে সিমাক-এর বর্ণনায় ‘ইযতিরাব’ রয়েছে। এতদসত্ত্বেও হাদীছটি ইমাম তিরমিযী ‘হাসান ছহীহ’ বলেছেন। হাকেম ‘ছহীহ’ বলেছেন। যাহাবী তা সমর্থন করেছেন। ইবনু কাছীর ‘জাইয়িদ’ বলেছেন। তবে আলবানী সনদ ‘যঈফ’ বলেছেন। সনদ যঈফ হ’লেও ঘটনা ছিল বাস্তব। আর তা ছিল এই যে, কাফের পক্ষ পরাজিত হয়েছিল।
[6]. আর-রাহীক্ব ২০৪-০৫ পৃঃ; ইবনু হিশাম ১/৬১২-১৩; আল-বিদায়াহ ৩/২৬০; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৫৬।
কুরায়েশ বাণিজ্য কাফেলার অবস্থা (حالة عير قريش)
কুরায়েশ বাণিজ্য কাফেলার নেতা আবু সুফিয়ান অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পথ চলছিলেন। যাকেই পেতেন, তাকেই মদীনা বাহিনী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন। তিনি একটি সূত্রে জানতে পারলেন যে, কাফেলার উপরে হামলা করার জন্য মুহাম্মাদ নির্দেশ দিয়েছেন। এ সংবাদে ভীত হয়ে তিনি যামযাম বিন আমর আল-গিফারী(ضَمْضم بن عمرو) কে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মক্কায় পাঠিয়ে দিলেন, যাতে দ্রুত সাহায্যকারী বাহিনী পৌঁছে যায়। এরপর বদর প্রান্তর অতিক্রম করার আগেই তিনি কাফেলা থামিয়ে দিয়ে নিজে অগ্রসর হন এবং মাজদী বিন আমর(مَجْدِى بن عمرو) এর কাছে মদীনা বাহিনীর খবর নেন। তার কাছে জানতে পারেন যে, দু’জন উষ্ট্রারোহীকে তারা দেখেছিল, যারা টিলার পাশে তাদের উট বসিয়ে মশকে পানি ভরে নিয়ে চলে গেছে। সুচতুর আবু সুফিয়ান সঙ্গে সঙ্গে টিলার পাশে গিয়ে উটের গোবর থেকে খেজুরের অাঁটি খুঁজে বের করে বুঝে নেন যে, এটি মদীনার উটের গোবর। ব্যস! তখনই ফিরে এসে কাফেলাকে নিয়ে বদরকে বামে রেখে মূল রাস্তা ছেড়ে ডাইনে পশ্চিম দিকে উপকূলের পথ ধরে দ্রুত চলে গেলেন। এভাবে তিনি স্বীয় কাফেলাকে মদীনা বাহিনীর কবল থেকে বাঁচিয়ে নিতে সক্ষম হ’লেন। অতঃপর তিনি নিরাপদে পার হয়ে আসার খবর মক্কায় পাঠিয়ে দিলেন। যাতে ইতিপূর্বে পাঠানো খবরের কারণে তারা অহেতুক যুদ্ধে বের না হয়।[1]
[1]. আর-রাহীক্ব ২০৭ পৃঃ; ইবনু হিশাম ১/৬১৮।
এখানে রাসূল (সাঃ)-এর ফুফু আতেকাহ বিনতে আব্দুল মুত্ত্বালিব ও জুহাইম বিন ছালতের দু’টি স্বপ্ন সম্পর্কে বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। যেখানে বদর যুদ্ধে কুরায়েশ বাহিনীর সাক্ষাৎ পরাজয় ও তাদের নেতাদের নিহত হওয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে। আবু জাহল এগুলিকে বনু মুত্ত্বালিবের মিথ্যা রটনা বলে উড়িয়ে দেন। ঘটনা দু’টি বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয় (মা শা-‘আ ১০৪ পৃঃ)।
মাক্কী বাহিনীর অগ্রযাত্রা (مسيرة الجيش المكى)
আবু সুফিয়ানের প্রথম পত্র পেয়ে বাণিজ্য কাফেলা উদ্ধারের জন্য ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আবু জাহলের নেতৃত্বে ১৩০০ মাক্কী ফৌজ রওয়ানা হয়ে যায়। অতঃপর রাবেগ-এর পূর্ব দিকে জুহফা নামক স্থানে পৌঁছলে পত্রবাহকের মাধ্যমে আবু সুফিয়ানের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের খবর পেয়ে বাহিনীর সবাই মক্কায় ফিরে যেতে চাইল। কিন্তু আবু জাহলের দম্ভের সামনে কারু মতামত গ্রাহ্য হ’ল না। তবু তার আদেশ অমান্য করে আখনাস বিন শারীক্ব আছ-ছাক্বাফী(الْأَخْنَسُ بْنُ شَرِيق الثَّقَفِيُّ)-এর নেতৃত্বে বনু যোহরা(بَنُو زُهْرَة) গোত্রের ৩০০ লোক মক্কায় ফিরে গেল। আখনাস ছিলেন ত্বায়েফের ছাক্বীফ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু তিনি ছিলেন বনু যোহরা গোত্রের মিত্র ও নেতা। তাঁর এই দূরদর্শিতার কারণে তিনি উক্ত গোত্রে আজীবন সম্মানিত নেতা হিসাবে বরিত ছিলেন। বনু হাশেমও ফিরে যেতে চাইল। কিন্তু মুহাম্মাদ-এর স্বগোত্র হওয়ায় তাদের উপরে আবু জাহলের কঠোরতা ছিল অন্যদের চেয়ে বেশী। ফলে তারা ক্ষান্ত হন।
উল্লেখ্য যে, আলী (রাঃ)-এর বড় ভাই ত্বালিব বিন আবু ত্বালিব বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও জনৈক কুরায়েশ নেতার সাথে বাদানুবাদের প্রেক্ষিতে প্রত্যাবর্তনকারীদের সাথে মক্কায় ফিরে যান (ইবনু হিশাম ১/৬১৯)।
অতঃপর আবু জাহল বদর অভিমুখে রওয়ানা হন এবং দর্পভরে বলেন, আল্লাহর কসম! আমরা বদরে যাব ও সেখানে তিনদিন থাকব ও আমোদ-ফূর্তি করে পান ভোজন করব। এর ফলে সমগ্র আরব জাতির উপরে আমাদের শক্তি প্রকাশিত হবে ও সকলে ভীত হবে। এই সময় সব মিলিয়ে মাক্কী বাহিনীতে এক হাযার ফৌজ ছিল। তন্মধ্যে দু’শো অশ্বারোহী, ছয়শো লৌহবর্ম ধারী এবং গায়িকা বাঁদী দল তাদের বাদ্যযন্ত্রাদি সহ ছিল। প্রতি মনযিলে খাদ্যের জন্য তারা ৯টি বা ১০টি করে উট যবেহ করত।
উল্লেখ্য যে, আবু সুফিয়ানের বাণিজ্য কাফেলায় সকল গোত্রের লোকদের মালামাল ছিল। তাছাড়া মাক্কী বাহিনীতে বনু ‘আদী ব্যতীত কুরায়েশদের সকল গোত্রের লোক বা তাদের প্রতিনিধি যোগদান করেছিল। অথবা যোগদানে বাধ্য করা হয়েছিল। যেমন রাসূল (সাঃ)-এর চাচা আববাস, হযরত আলীর দু’ভাই ত্বালেব ও ‘আক্বীল। রাসূল (সাঃ)-এর জামাতা আবুল ‘আছ সহ বনু হাশেমের লোকেরা। তারা আসতে অনিচ্ছুক ছিলেন। নেতাদের মধ্যে কেবল আবু লাহাব যাননি। তিনি তার বদলে তার কাছে ঋণগ্রস্ত একজন ব্যক্তিকে পাঠিয়েছিলেন।[1]
[1]. ইবনু হিশাম ১/৬১৮-১৯; আল-বিদায়াহ ৩/২৬০।
রওয়ানাকালে আবু জাহল (أبو جهل عند المسير)
আবু জাহল মক্কা থেকে রওয়ানার সময় দলবল নিয়ে কা‘বাগৃহের গেলাফ ধরে কেঁদে কেঁদে প্রার্থনা করেছিল, اللَّهُمَّ انْصُرْ أَقْرَانَا لِلضَّيْفِ وَأَوْصَلَنَا لِلرَّحِمِ وَأَفَكَّنَا لِلْعَانِيْ، إِنْ كَانَ مُحَمَّدٌ عَلَى حَقٍّ فَانْصُرْهُ وَاِنْ كُنَّا عَلَى حَقٍّ فَانْصُرْنَا، وَرُوِي اَنَّهُمْ قَالُوْا : اللهُمَّ انْصُرْ أَعْلَى الْجُنْدَيْنِ وَأَهْدَى الْفِئَتَيْنِ وَاَكْرَمَ الْحِزْبَيْنِ ‘হে আল্লাহ! তুমি সাহায্য কর আমাদের মধ্যেকার সর্বাধিক অতিথি আপ্যায়নকারী, সর্বাধিক আত্মীয়তা রক্ষাকারী ও বন্দী মুক্তি দানকারী দলকে’। ‘হে আল্লাহ! মুহাম্মাদ যদি সত্যের উপরে থাকে, তবে তুমি তাকে সাহায্য কর। আর যদি আমরা সত্যের উপর থাকি, তবে আমাদেরকে সাহায্য কর’। ‘হে আল্লাহ! তুমি সাহায্য কর আমাদের দু’দলের মধ্যকার সেরা সেনাদলকে, সেরা হেদায়াতপ্রাপ্ত ও সেরা সম্মানিত দলকে’।[1]
এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আবু জাহল আল্লাহকে সর্বশক্তিমান হিসাবে বিশ্বাস করত। যাকে ‘তওহীদে রুবূবিয়াত’ বলা হয়। এর ফলে কেউ মুসলমান হ’তে পারে না। কেননা মুসলিম হওয়ার জন্য ‘তওহীদে ইবাদত’-এর উপর ঈমান আনা যরূরী। যার মাধ্যমে মানুষ সার্বিক জীবনে আল্লাহর দাসত্ব করতে স্বীকৃত হয়। সেই সাথে শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর উপর ঈমান ও তাঁর আনীত শরী‘আতের বিধানসমূহ পালন করা অপরিহার্য।
অতঃপর রওয়ানা হওয়ার সময় তাদের মনে পড়ল বনু বকর গোত্রের কথা। যাদের সঙ্গে তাদের শত্রুতা ছিল। পথিমধ্যে তারা হামলা করতে পারে। ফলে মাক্কী বাহিনী দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে গেল। কিন্তু শয়তানী প্ররোচনায় গর্বোদ্ধত হয়ে তারা বেরিয়ে পড়ল। উক্ত প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَكُونُوا كَالَّذِينَ خَرَجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ بَطَرًا وَرِئَاءَ النَّاسِ وَيَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللهِ وَاللهُ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطٌ ‘আর তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা তাদের ঘর (মক্কা) থেকে বের হয়েছিল দর্পভরে ও লোক দেখিয়ে এবং যারা আল্লাহর পথ থেকে লোকদের বাধা দিত। অথচ আল্লাহ তাদের সকল কাজ পরিবেষ্টন করে আছেন’ (আনফাল ৮/৪৭)। এভাবে শয়তান মানুষের অন্তরে ধোঁকা সৃষ্টি করে। যাতে তার স্বাভাবিক বোধশক্তি লুপ্ত হয় এবং সে পথভ্রষ্ট হয়। যেমন বদরের যুদ্ধে শয়তানের ভূমিকা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَإِذْ زَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ وَقَالَ لاَ غَالِبَ لَكُمُ الْيَوْمَ مِنَ النَّاسِ وَإِنِّي جَارٌ لَكُمْ فَلَمَّا تَرَاءَتِ الْفِئَتَانِ نَكَصَ عَلَى عَقِبَيْهِ وَقَالَ إِنِّي بَرِيءٌ مِنْكُمْ إِنِّي أَرَى مَا لاَ تَرَوْنَ إِنِّي أَخَافُ اللهَ وَاللهُ شَدِيدُ الْعِقَابِ ‘আর যখন শয়তান (বদরের দিন) কাফেরদের নিকট তাদের কাজগুলিকে শোভনীয় করে দেখিয়েছিল এবং বলেছিল আজ লোকদের মধ্যে তোমাদের উপর বিজয়ী হবার মত কেউ নেই। আর আমি তোমাদের সাথে আছি। কিন্তু যখন দু’দল মুখোমুখী হ’ল, তখন সে পিছন ফিরে পালালো এবং বলল, আমি তোমাদের থেকে মুক্ত। আমি যা দেখেছি তোমরা তা দেখোনি। আমি আল্লাহকে ভয় করি। আর আল্লাহ কঠিন শাস্তিদাতা’ (আনফাল ৮/৪৮)।
শয়তানের দোসর মুনাফিকদের সম্পর্কেও আল্লাহ অনুরূপ বলেন,إِذْ يَقُولُ الْمُنَافِقُونَ وَالَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ غَرَّ هَؤُلاَءِ دِينُهُمْ وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ فَإِنَّ اللهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ ‘যেদিন মুনাফিকরা এবং যাদের অন্তরে রোগ ছিল, তারা বলেছিল, এদের দ্বীন এদেরকে (মুসলমানদেরকে) প্রতারিত করেছে (অর্থাৎ ধর্মান্ধ করেছে)। অথচ যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে (আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট)। কেননা আল্লাহ মহা পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’ (আনফাল ৮/৪৯)। অতঃপর মানুষের বিরুদ্ধে শয়তানের চিরন্তন রীতি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
كَمَثَلِ الشَّيْطَانِ إِذْ قَالَ لِلْإِنْسَانِ اكْفُرْ فَلَمَّا كَفَرَ قَالَ إِنِّي بَرِيءٌ مِنْكَ إِنِّي أَخَافُ اللهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ- فَكَانَ عَاقِبَتَهُمَا أَنَّهُمَا فِي النَّارِ خَالِدَيْنِ فِيهَا وَذَلِكَ جَزَاءُ الظَّالِمِينَ
‘(মুনাফিকরা) শয়তানের মত। যে মানুষকে কাফের হ’তে বলে। অতঃপর যখন সে কাফের হয়, তখন শয়তান বলে, আমি তোমার থেকে মুক্ত। আমি বিশ্বপালক আল্লাহকে ভয় করি’। ‘অতঃপর উভয়ের পরিণতি হয় এই যে, তারা জাহান্নামে যাবে এবং সেখানে চিরকাল বসবাস করবে। আর এটাই হ’ল যালেমদের শাস্তি’ (হাশর ৫৯/১৬-১৭)।[2] বস্ত্ততঃ আবু জাহল শয়তানের ধোঁকায় পড়েই রাসূল (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে রওয়ানা হয়েছিল। অতঃপর কুরায়েশ বাহিনী যথারীতি দ্রুতবেগে এসে বদর উপত্যকার শেষপ্রান্তে টিলার অপর পার্শ্বে শিবির সন্নিবেশ করে।
[1]. তাফসীর কাশশাফ, বাহরুল মুহীত্ব, ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা আনফাল ১৯ আয়াত; ইবনু হিশাম ১/৬৬৮; বায়হাক্বী, দালায়েল ৩/৭৪ টীকা-৪ (৩); যাদুল মা‘আদ ৩/১৬০; আল-বিদায়াহ ৩/২৮২।
[2]. প্রসিদ্ধ আছে যে, ইবলীস এ সময় বনু কিনানাহ গোত্রের নেতা সুরাক্বাহ বিন মালেক বিন জু‘শুম আল-মুদলিজীর রূপ ধারণ করে এসে বলল, ‘আমি তোমাদের বন্ধু’ (أَنَا لَكُمْ جَارٌ)। আমি তোমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিচ্ছি। এই আশ্বাস পাওয়ার পর কুরায়েশগণ মদীনা অভিমুখে খুব দ্রুতবেগে বদর প্রান্তরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যায় (আর-রাহীক্ব ২০৬ পৃঃ; ইবনু হিশাম ১/৬১২)। বর্ণনাটি ‘মুরসাল’ বা যঈফ (মা শা-‘আ ১০৮ পৃঃ)।
মাদানী বাহিনীর বদরে উপস্থিতি (وصول الجيش المدنى فى بدر)
রাওহাতে অনুষ্ঠিত পরামর্শ সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ‘বদর’ অভিমুখে রওয়ানা হন। অতঃপর ‘ছাফরা’ টিলা সমূহ অতিক্রম করে বদর প্রান্তরের নিকটবর্তী স্থানে অবতরণ করেন। সেখান থেকে তিনি বাসবাস বিন আমর আল-জুহানী এবং ‘আদী বিন আবুয যাগবা আল-জুহানীকে বদরের খবরাখবর নেবার জন্য পাঠান’ (মুসলিম হা/১৯০১)।
এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আলী, যুবায়ের ও সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছের নেতৃত্বে একটি গোয়েন্দা দল পাঠান শত্রুপক্ষের আরও তথ্যাদি সংগ্রহের জন্য। তারা গিয়ে দেখেন যে, দু’জন লোক বদরের ঝর্ণাধারা থেকে পানির মশক ভরছে। তাঁরা তাদের পাকড়াও করে নিয়ে এলেন। অতঃপর জিজ্ঞাসাবাদে ও সামান্য পিটুনী দেওয়ার পরে জানতে পারলেন যে, এরা আবু সুফিয়ানের লোক নয়। বরং তারা কুরায়েশ বাহিনীর লোক। কুরায়েশ বাহিনী উপত্যকার শেষপ্রান্তে টিলার অপর পার্শ্বে শিবির গেড়েছে। তাদের জন্য সে উটের পিঠে করে পানি বহন করে নিয়ে যাচ্ছে’।[1] তারপর ওদের নেতৃবর্গের নাম জিজ্ঞেস করলে তিনি আবু জাহল, উৎবা, শায়বা, উমাইয়া বিন খালাফ প্রমুখ মক্কার সেরা ব্যক্তিবর্গের নামগুলি জানতে পারেন। অতঃপর রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘এইটি অমুকের নিহত হওয়ার স্থান, এইটি অমুকের নিহত হওয়ার স্থান’। রাবী আনাস (রাঃ) বলেন, ‘তাদের নিহতদের কেউই উক্ত ইশারার স্থান থেকে দূরে যেতে পারেনি’।[2] তবে তারা সঠিক সংখ্যা বলতে পারল না। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, দৈনিক কয়টা উট যবহ করা হয়? তারা বলল, নয়টা অথবা দশটা। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, তাহ’লে ওদের সংখ্যা নয়শত অথবা হাযার-এর মধ্যে হবে। কেননা একটি উট ১০০ জনের বা তার কাছাকাছিদের জন্য।[3]
এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নির্দেশে মুসলিম বাহিনী দ্রুত গিয়ে এশার সময় বদরের উপরে দখল নিল, যা ছিল ঝর্ণাধারার পাশেই। অতঃপর আউস নেতা সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ)-এর প্রস্তাবক্রমে যুদ্ধক্ষেত্রের উত্তর-পূর্ব পার্শ্বে একটি উঁচু টিলার উপরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্য তাঁবুর (عَرِيْشٌ) ব্যবস্থা করা হ’ল। সেখানে তাঁর সাথে কেবল আবুবকর (রাঃ) রইলেন এবং পাহারায় রইলেন সা‘দ বিন মু‘আয-এর নেতৃত্বে একদল আনছার যুবক। সা‘দ সেখানে বিশেষ সওয়ারীও প্রস্ত্তত রাখলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বললেন, যদি আমরা যুদ্ধে পরাজিত হই, তাহ’লে আপনি এই সওয়ারীতে করে দ্রুত মদীনায় চলে যাবেন। কেননা فَقَدْ تَخَلَّفَ عَنْكَ أَقْوَامٌ، يَا نَبِيَّ اللهِ، مَا نَحْنُ بِأَشَدَّ لَكَ حُبًّا مِنْهُمْ ... يَمْنَعُكَ اللهُ بِهِمْ، يُنَاصِحُونَكَ وَيُجَاهِدُونَ مَعَكَ ‘সেখানে রয়েছে হে আল্লাহর নবী! আপনার জন্য আমাদের চাইতে অধিক জীবন উৎসর্গকারী একদল ভাই। আপনাকে ভালোবাসায় আমরা তাদের চাইতে অধিকতর অগ্রগামী নই। যারা যুদ্ধে কখনোই আপনার থেকে পিছনে থাকবে না। আল্লাহ তাদের মাধ্যমে আপনাকে হেফাযত করবেন। তারা আপনার শুভাকাংখী এবং তারা আপনার সঙ্গে থেকে জিহাদ করবে’। সা‘দের এ বীরত্বব্যঞ্জক কথায় আল্লাহর রাসূল (সাঃ) অত্যন্ত প্রীত হ’লেন ও তার জন্য কল্যাণের দো‘আ করলেন(دَعَا لَهُ بِخَيْرٍ)।[4]
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যুদ্ধ কৌশল অনুযায়ী সেনাদলকে বিন্যস্ত করেন এবং সুষ্ঠুভাবে শিবির সন্নিবেশ করেন।
[1]. ইবনু হিশাম ১/৬১৬; যাদুল মা‘আদ ৩/১৫৬।
[2]. মুসলিম হা/১৭৭৯; আবুদাঊদ হা/২৬৮১।
[3]. আহমাদ হা/৯৪৮, সনদ ছহীহ; ইবনু হিশাম ১/৬১৬-১৭।
(১) প্রসিদ্ধ আছে যে, এ সময়ে রাসূল (সাঃ) বলে ওঠে هَذِهِ مَكَّةُ قَدْ أَلْقَتْ إلَيْكُمْ أَفْلاَذَ كَبِدِهَا-‘এই যে মক্কা তার কলিজার টুকরাগুলোকে তোমাদের কাছে নিক্ষেপ করেছে’ বর্ণনাটির সনদ ‘মুরসাল’ (আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ ২২২ পৃঃ; মা শা-‘আ ১০৬ পৃঃ)।
(২) আরও প্রসিদ্ধ আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বদরে পৌঁছে শত্রুবাহিনীর তথ্য জানার জন্য পায়ে হেঁটে নিজেই রওয়ানা হন আবুবকর (রাঃ)-কে সাথে নিয়ে। সেখানে এক বৃদ্ধের সঙ্গে সাক্ষাৎ হ’লে তিনি তার কাছে উভয় বাহিনী সম্পর্কে জানতে চান। বৃদ্ধ তাদেরকে তারা কোন বাহিনীর লোক সেকথা জানানোর শর্তে তথ্য দিল যে, আমি রওয়ানা হবার যে সংবাদ পেয়েছি, তাতে মুহাম্মাদের বাহিনী আজকে অমুক স্থানে রয়েছে এবং কুরায়েশ বাহিনী অমুক স্থানে রয়েছে। বৃদ্ধের অনুমান সঠিক ছিল। এবার শর্তানুযায়ী রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জবাব দিলেন, نَحْنُ مِنْ مَاءٍ ‘আমরা একই পানি হ’তে’ (অর্থাৎ একই বংশের)। রাসূল (সাঃ)-এর এই ইঙ্গিতপূর্ণ জবাবে বৃদ্ধ কিছুই বুঝতে না পেরে বিড় বিড় করতে করতে চলে গেল (ইবনু হিশাম ১/৬১৬; আর-রাহীক্ব ২১০ পৃঃ)। বর্ণনাটির সনদ মুনক্বাতি‘ (যঈফ), মা শা-‘আ ১০৫ পৃঃ।
[4]. ইবনু হিশাম ১/৬২০-২১; আর-রাহীক্ব ২১১-১২ পৃঃ; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৬২।
প্রসিদ্ধ আছে যে, এ সময় সামরিক বিষয়ে দক্ষ ছাহাবী হুবাব ইবনুল মুনযির ইবনুল জামূহ (حُباب بن المنذر ابن الجموح) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! এখানে কি আল্লাহর নির্দেশক্রমে অবতরণ করলেন, না-কি যুদ্ধকৌশল হিসাবে? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, যুদ্ধকৌশল মনে করে’। তখন তিনি বললেন, ‘এটি উপযুক্ত স্থান নয়। কেননা এখান থেকে আগে বা পিছে যাবার কোন সুযোগ নেই’। অতএব আরো এগিয়ে কুরায়েশ শিবিরের নিকটবর্তী প্রস্রবণটি আমাদের দখলে নিতে হবে এবং সবগুলি ঝর্ণাস্রোত ঘুরিয়ে এক জায়গায় এনে পানি এক স্থানে সঞ্চয় করতে হবে। কুরায়েশরা টিলার মাথায় উচ্চভূমিতে অবস্থান করছে। যুদ্ধ শুরু হ’লে পানির প্রয়োজনে ওরা নীচে এসে আর পানি পাবে না। তখন পানির সঞ্চয়টি থাকবে আমাদের দখলে’। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার পরামর্শ গ্রহণ করলেন এবং এগিয়ে গিয়ে কুরায়েশ বাহিনীর নিকটবর্তী পানির প্রস্রবণটি দখলে নিলেন। তারপর অন্যান্য সব ব্যবস্থা শেষ করলেন (ইবনু হিশাম ১/৬২০; আর-রাহীক্ব ২১১ পৃঃ; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৬০)। হুবাবের পরামর্শদানের পর জিব্রীল অবতরণ করেন ও রাসূল (সাঃ)-কে বলেন, আল্লাহ আপনাকে সালাম দিয়েছেন এবং বলেছেন যে, হুবাবের উক্ত রায় সঠিক’ (ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা আনফাল ৭ আয়াত)। উক্ত মর্মের বর্ণনাগুলির সনদ ‘মুনকার’ ও যঈফ (আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ ২২৪ পৃঃ; মা শা-‘আ ১১০ পৃঃ)। বরং ছহীহ হাদীছসমূহ দ্বারা এটাই প্রমাণিত যে, রাসূল (সাঃ) তাঁর ছাহাবীগণের সাথে পরামর্শক্রমেই যুদ্ধকৌশল নির্ধারণ করেছিলেন। ‘অহি’ বহির্ভূত সকল বিষয়ে তিনি এভাবেই সিদ্ধান্ত নিতেন।
বর্ষাস্নাত রাত্রি ও গভীর নিদ্রা (الليل الممطر والرقاد الطويل)
বদর যুদ্ধের পূর্বরাত। সৈন্যদের শ্রেণীবিন্যাস শেষ হয়েছে। সবাই ক্লান্ত-শ্রান্ত। হঠাৎ সামান্য বৃষ্টি এলো। মুসলিম বাহিনী কেউ গাছের নীচে কেউ ঢালের নীচে ঘুমে এলিয়ে পড়ল। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন বাহিনীর সকল ক্লান্তি দূর হয়ে গেল এবং যুদ্ধের জন্য দেহমন প্রস্ত্তত হয়ে গেল। বালু-কংকর সব জমে দৃঢ় হয়ে গেল। ফলে চলাফেরায় স্বাচ্ছন্দ্য এল। সেই সাথে অধিকহারে বৃষ্টির পানি সঞ্চয়ের ব্যবস্থা হয়ে গেল।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, إِذْ يُغَشِّيْكُمُ النُّعَاسَ أَمَنَةً مِّنْهُ وَيُنَزِّلُ عَلَيْكُم مِّنَ السَّمَاءِ مَاءً لِّيُطَهِّرَكُمْ بِهِ وَيُذْهِبَ عَنْكُمْ رِجْزَ الشَّيْطَانِ وَلِيَرْبِطَ عَلَى قُلُوبِكُمْ وَيُثَبِّتَ بِهِ الأَقْدَامَ ‘স্মরণ কর সে সময়ের কথা, যখন তিনি তাঁর পক্ষ থেকে প্রশান্তির জন্য তোমাদেরকে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন করেন এবং তোমাদের উপরে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন। এর মাধ্যমে তোমাদেরকে পবিত্র করার জন্য, তোমাদের থেকে শয়তানের কুমন্ত্রণা দূরীভূত করার জন্য, তোমাদের হৃদয়গুলি পরস্পরে আবদ্ধ করার জন্য এবং তোমাদের পাগুলিকে দৃঢ় রাখার জন্য’ (আনফাল ৮/১১)।
শয়তানের কুমন্ত্রণা এই যে, সে যেন দুর্বলচিত্ত মুসলমানদের মধ্যে এই প্রশ্ন ঢুকিয়ে দেবার সুযোগ না পায় যে, আমরা যদি ন্যায় ও সত্যের পথে থাকব এবং আমরা যদি আল্লাহর বন্ধু হই, তাহ’লে আমরা এই নিম্নভূমিতে ধূলি-কাদার মধ্যে কেন থাকব? এটি নিঃসন্দেহে আমাদের পরাজয়ের লক্ষণ। অথচ কুরায়েশরা কাফের হওয়া সত্ত্বেও উচ্চ ভূমিতে আছে। তারা উট যবেহ করে খাচ্ছে আর ফূর্তি করছে। এটা নিশ্চয়ই তাদের জন্য বিজয়ের লক্ষণ। সকালেই যেখানে যুদ্ধের সম্মুখীন হ’তে হবে, সেখানে রাতেই যদি সংখ্যালঘু মুসলিম বাহিনীর মধ্যে এ ধরনের বিভ্রান্তি ঢুকে যায়, তাহ’লে সেটা সমূহ ক্ষতির কারণ হবে। সেকারণ আল্লাহ বৃষ্টি বর্ষণের মাধ্যমে তাদেরকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন করে দিলেন। ফলে ঘুম থেকে উঠে প্রফুল্লচিত্তে সবাই যুদ্ধে জয়ের জন্য একাট্টা হয়ে দ্রুত প্রস্ত্তত হয়ে গেল।
আলী (রাঃ) বলেন যে, বদর যুদ্ধের রাতে এমন কেউ বাকী ছিল না যে, যিনি ঘুমাননি। কেবল রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ব্যতীত। তিনি সারা রাত জেগে ছালাতে রত থাকেন। তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বারবার স্বীয় প্রভুর নিকট দো‘আ করতে থাকেন, اللَّهُمَّ إِنَّكَ إِنْ تُهْلِكْ هَذِهِ الْعِصَابَةَ لاَ تُعْبَدْ فِى الأَرْضِ أَبَداً ‘হে আল্লাহ! যদি তুমি এই দলকে ধ্বংস করে দাও, তাহ’লে জনপদে তোমার ইবাদত করার আর কেউ থাকবে না’। অতঃপর সকাল হলে তিনি সবাইকে ডাকেন, الصَّلاَةَ عِبَادَ اللهِ ‘আল্লাহর বান্দারা! ছালাত’। অতঃপর সবাই জমা হ’লে তিনি ফজরের জামা‘আত শেষে সবাইকে যুদ্ধের জন্য উৎসাহিত করেন’।[1]
আলী (রাঃ) বলেন, لَقَدْ رَأَيْتُنَا يَوْمَ بَدْرٍ وَنَحْنُ نَلُوذُ بِرَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم- وَهُوَ أَقْرَبُنَا إِلَى الْعَدُوِّ وَكَانَ مِنْ أَشَدِّ النَّاسِ يَوْمَئِذٍ بَأْساً ‘বদরের যুদ্ধের দিন আমরা সকলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকটে আশ্রয় নিয়েছিলাম। তিনি আমাদের মধ্যে শত্রুর সর্বাধিক নিকটবর্তী ছিলেন এবং আমাদের সকলের চাইতে সর্বাধিক বড় যোদ্ধা ছিলেন’ (আহমাদ হা/৬৫৪, সনদ ছহীহ)।
[1]. আহমাদ হা/২০৮, ৯৪৮; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৬০ পৃঃ।
মাক্কী বাহিনীর দিশাহারা অবস্থা (الحالة المتحيرة للجيش المكى)
প্রত্যুষে কুরায়েশ বাহিনী পাহাড় থেকে নীচে অবতরণ করে হতবাক হয়ে গেল। পানির উৎসের উপরে রাতারাতি মুসলিম বাহিনীর দখল কায়েম হয়ে গেছে। হাকীম বিন হেযাম সহ অতি উৎসাহী কয়েকজন কুরায়েশ সেনা সরাসরি রাসূল (সাঃ)-এর টিলার সম্মুখস্থ পানির হাউযের দিকে অগ্রসর হ’ল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের ছেড়ে দেবার নির্দেশ দিলেন। ফলে যারা সেখান থেকে পানি পান করল, তারা সবাই পরে যুদ্ধে নিহত হ’ল। একমাত্র হাকীম পান করেননি। তিনি বেঁচে যান। পরে তিনি পাক্কা মুসলিম হয়ে যান। এ ঘটনাকে স্মরণ করে হাকীম বিন হেযাম শপথ করার সময় সর্বদা বলতেন لاَ وَالَّذِي نَجَّانِي يَوْمَ بَدْرٍ ‘ঐ সত্তার কসম! যিনি আমাকে বদরের দিন রক্ষা করেছেন’। ঘটনাটি বহু পূর্বেকার তালূত বাহিনীর ঘটনার সাথে তুলনীয়। সেদিন যারা নদীর পানি পান করেছিল, তাদের কেউই তালূতের সাথে জালূতের বিরুদ্ধে জিহাদে শরীক হ’তে পারেনি’।[1]
কুরায়েশ নেতারা অবস্থার ভয়াবহতা বুঝতে পারল এবং নিজেদের বোকামিতে দুঃখে-ক্ষোভে হাত-পা ছুঁড়তে লাগল। তারা মুসলিম বাহিনীর অবস্থা ও সংখ্যা নিরূপণের জন্য ওমায়ের বিন ওয়াহাব আল-জুমাহী নামক একজন অশ্বারোহীকে প্রেরণ করল। সে গিয়ে মুসলিম বাহিনীর চারদিক প্রদক্ষিণ করে এসে বলল, তিন শো বা তার কিছু কমবেশী হবে’। তবে আরেকটু সময় দাও, আমি দেখে আসি, ওদের পিছনে কোন সাহায্যকারী সেনাদল আছে কি-না। সে আবার ছুটলো এবং বহু দূর ঘুরে এসে বলল, ওদের পিছনে কাউকে দেখলাম না। তবে সে বলল,يَا مَعْشَرَ قُرَيْشٍ: الْبَلاَيَا تَحْمِلُ الْمَنَايَا ... لَيْسَ مَعَهُمْ مَنَعَةٌ وَلاَ مَلْجَأٌ إلاَّ سُيُوفُهُمْ ‘হে কুরায়েশগণ, বিপদ এসেছে মৃত্যুকে সাথে নিয়ে। ... তাদের সাথে কোন শক্তি নেই বা কোন আশ্রয় নেই কেবল তাদের তরবারি ছাড়া’। অতএব واللهِ مَا أَرَى أَنْ يُقْتَلَ رَجُلٌ مِنْهُمْ حَتّى يَقْتُلَ رَجُلاً مِنْكُمْ ... فَرُوا رَأْيَكُمْ ‘আল্লাহর কসম, তোমাদের একজন নিহত না হওয়া পর্যন্ত তাদের একজন নিহত হবে না’। ... অতএব তোমরা চিন্তা-ভাবনা কর’।[2] তার এ রিপোর্ট শুনে হাকীম বিন হেযাম বয়োজ্যেষ্ঠ কুরায়েশ নেতা উৎবা বিন রাবী‘আহর কাছে এসে যুদ্ধ না করে ফিরে যাবার ব্যাপারে বুঝাতে লাগলেন। তিনি রাযী হ’লেন। এমনকি ইতিপূর্বে নাখলা যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে রজবের শেষ দিনে হারাম মাসে নিহত আমর ইবনুল হাযরামীর রক্তমূল্য তিনি নিজ থেকে দিতে চাইলেন। উৎবা বললেন, সমস্যা হ’ল ইবনুল হানযালিয়াহকে নিয়ে (আবু জাহলের মায়ের নাম ছিল হানযালিয়াহ)। তুমি তার কাছে যাও।
অতঃপর উৎবা দাঁড়িয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, হে কুরায়েশগণ! মুহাম্মাদ ও তার সাথীদের সঙ্গে যুদ্ধ করায় তোমাদের কোন গৌরব নেই। কেননা তাতে তোমরা তোমাদের চাচাতো ভাই বা খালাতো ভাই বা মামাতো ভাইয়ের বা নিজ গোত্রের লোকদের রক্তাক্ত চেহারা দেখবে, যা তোমাদের কাছে মোটেই পসন্দনীয় হবে না।فَارْجِعُوا وَخَلُّوا بَيْنَ مُحَمَّدٍ وَبَيْنَ سَائِرِ الْعَرَبِ ‘অতএব তোমরা ফিরে চল এবং মুহাম্মাদ ও গোটা আরব দুনিয়াকে ছেড়ে দাও। যদি তারা তাকে মেরে ফেলে, তবে সেটা তাই-ই হবে, যা তোমরা চেয়েছিলে। আর যদি তা না হয়, তাহ’লে সে তোমাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে এজন্য যে, তোমরা তার সাথে সেরূপ ব্যবহার করোনি, যেরূপ তোমরা চেয়েছিলে’।
এদিকে হাকীম বিন হেযাম আবু জাহলের কাছে গিয়ে নিজের ও উৎবার মতামত ব্যক্ত করে মক্কায় ফিরে যাবার জন্য তাকে অনুরোধ করলেন। এতে আবু জাহল ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে বলে উঠলেন, انتفخَ واللهِ سَحْرُهُ ‘আল্লাহর কসম! উৎবার উপরে মুহাম্মাদের জাদু কার্যকর হয়েছে’।كَلاَّ واللهِ لاَ نَرْجِعُ حَتَّى يَحْكُمَ اللهُ بَيْنَنَا وَبَيْنَ مُحَمَّدٍ ‘কখনোই না। আল্লাহর কসম! আমরা ফিরে যাব না, যতক্ষণ না আল্লাহ আমাদের ও মুহাম্মাদের মাঝে একটা ফায়ছালা করে দেন’। তিনি বললেন, ‘এতক্ষণে বুঝলাম যে, উৎবার পুত্র আবু হুযায়ফা যে মুসলমান হয়ে হিজরত করে আগে থেকেই মুহাম্মাদের দলে রয়েছে এবং যুদ্ধ বাধলে সে নিহত হবে, সেই ভয়ে উৎবা যুদ্ধ না করেই ফিরে যেতে চাচ্ছে’।
হাকীমের কাছ থেকে আবু জাহলের এইসব কথা শুনে উৎবার বিচারবুদ্ধি লোপ পেল। তার সুপ্ত পৌরুষ জেগে উঠলো। ক্ষুব্ধ চিৎকারে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে ছুটে চললেন। ওদিকে আবু জাহল ‘আমের ইবনুল হাযরামীকে গিয়ে বললেন, দেখছ কি! তোমার ভাই আমরের রক্তের প্রতিশোধ আর নেওয়া হ’ল না। ঐ দেখ কাপুরুষ উৎবা পালাচ্ছে। শীঘ্র উঠে আর্তনাদ শুরু কর’। একথা শোনা মাত্র ‘আমের তার সারা দেহে ধুলো-বালি মাখতে মাখতে এবং গায়ের কাপড় ছিঁড়তে ছিঁড়তে নাখলা যুদ্ধে নিহত ভাই ‘আমর ইবনুল হাযরামীর নামে واعَمْراه واعَمْراه (হায় আমর! হায় আমর!) বলে আর্তনাদ করে বেড়াতে লাগল। আর যায় কোথায়। মুহূর্তের মধ্যে মুশরিক শিবিরে যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠল। রণোন্মত্ত কুরায়েশ বাহিনী যুদ্ধের ময়দানে ছুটে চলল।[3] হাকীম বিন হেযামের সকল প্রচেষ্টা ভন্ডুল হয়ে গেল কেবলমাত্র আবু জাহলের হঠকারিতা ও ধূর্তামির কারণে।[4]
এ সময় রাসূল (সাঃ) লাল উটের উপরে সওয়ার উৎবা বিন রাবী‘আহর দিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, إنْ يُطِيْعُوهُ يَرْشُدُوْا ‘যদি তার দল তার আনুগত্য করত, তাহ’লে তারা সঠিক পথে থাকতো’ (ইবনু হিশাম ১/৬২১)। অর্থাৎ যদি তারা উৎবাহর কথামত মক্কায় ফিরে যেত, তাহ’লে তাদের মঙ্গল হ’ত। এর মধ্যে রাসূল (সাঃ)-এর শান্তিবাদী নীতি ফুটে ওঠে।
[1]. ইবনু হিশাম ১/৬২২; আল-বিদায়াহ ৩/২৬৮; সূরা বাক্বারাহ ২/২৪৯ আয়াত।
[2]. ইবনু হিশাম ১/৬২২; সনদ জাইয়িদ; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৫৯ পৃঃ।
[3]. ইবনু হিশাম ১/৬২৩; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৩/২৬৯।
[4]. তারীখু ত্বাবারী ২/৪৪৩, ৪২৪-২৫; সনদ হাসান; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৫৯ পৃঃ।
আবু জাহলের দো‘আ (دعاء أبى جهل)
মাক্কী বাহিনী যখন মাদানী বাহিনীর নিকটবর্তী হ’ল, তখন আবু জাহল আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করে বললেন,اللَّهُمَّ أَقْطَعُنَا لِلرَّحِمِ وَآتَانَا بِمَا لاَ نَعْرِفُ فَأَحِنْهُ الْغَدَاةَ اي فأهلكه ‘হে আল্লাহ! আমাদের উভয়দলের মধ্যে যে দল অধিক আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী এবং আমাদের নিকট এমন বস্ত্ত (কুরআন) আনয়নকারী যা আমরা জানি না, তুমি তাকে ধ্বংস করে দাও’![1] অন্য বর্ণনায় এসেছে, যুদ্ধের শুরুতে তিনি বলেছিলেন, اللهُمَّ أَيَّنَا كَانَ أَحَبُّ إلَيْكَ وَأَرْضَى عِنْدَكَ فَانْصُرْهُ الْيَوْمَ اللَّهُمَّ اَوْلاَنَا بِالْحَقِّ فَانْصُرْهُ الْيَوْمَ ‘হে আল্লাহ! আমাদের মধ্যে যে তোমার নিকটে সর্বাধিক প্রিয় ও তুমি যার প্রতি সর্বাধিক সন্তুষ্ট, আজ তুমি তাকে সাহায্য কর। হে আল্লাহ! আমাদের মধ্যে যে দল সর্বাধিক হক-এর উপরে আছে, তুমি আজ তাকে সাহায্য কর’।[2]
এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন, إِنْ تَسْتَفْتِحُوا فَقَدْ جَاءَكُمُ الْفَتْحُ وَإِنْ تَنْتَهُوا فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَإِنْ تَعُودُوا نَعُدْ وَلَنْ تُغْنِيَ عَنْكُمْ فِئَتُكُمْ شَيْئًا وَلَوْ كَثُرَتْ وَأَنَّ اللهَ مَعَ الْمُؤْمِنِينَ ‘যদি তোমরা ফায়ছালা চাও, তবে সেটাতো তোমাদের সামনে এসেই গেছে। আর যদি ক্ষান্ত হও, তবে সেটাই তোমাদের জন্য উত্তম। কিন্তু যদি তোমরা ফের আগে বাড়ো, তাহ’লে আমরাও ফিরে আসব। (মনে রেখ) তোমাদের দল যত বড়ই হৌক, তা তোমাদের কোন কাজে আসবেনা। বস্ত্ততঃ আল্লাহ মুমিনদের সাথেই থাকেন’ (আনফাল ৮/১৯)।
[1]. হাকেম হা/৩২৬৪, ২/৩২৮; সনদ ছহীহ; ইবনু হিশাম ১/৬২৮; মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বা হা/৩৭৮২৯; তাফসীর কাশশাফ প্রভৃতি।
[2]. যাদুল মা‘আদ ৩/১৬৫; সীরাহ হালাবিইয়াহ ২/৪১৮; আর-রাহীক্ব পৃঃ ২১৬।
মুসলিম বাহিনী সারিবদ্ধ হ’ল (اصطف الجيش الإسلامى)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজের বাহিনীকে দ্রুত প্রস্ত্তত ও সারিবদ্ধ করে ফেললেন। এরি মধ্যে জনৈক সাউয়াদ ইবনু গাযিইয়াহ(سَوَّادُ بنُ غَزِيَّةَ) সারি থেকে কিছুটা আগে বেড়ে এল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার পেটে তীর দিয়ে টোকা মেরে পিছিয়ে যাবার ইঙ্গিত দিয়ে বললেন,اسْتَوِ يَا سَوَّادُ ‘সমান হয়ে যাও হে সাউয়াদ!’ সাথে সাথে সে বলে উঠলো, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি আমাকে কষ্ট দিয়েছেন। বদলা দিন! রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তখন নিজের পেট আলগা করে দেন ও বদলা নিতে বলেন। তখন সে ছুটে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরে পেটে চুমু খেতে লাগলো’। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে বললেন, কিজন্য তুমি এরূপ করলে? সে বলল, আমাদের সামনে যে অবস্থা আসছে তাতো আপনি দেখছেন। সেজন্য আমি চেয়েছিলাম যে, আপনার সাথে আমার শেষ আদান-প্রদান যেন এটাই হয় যে, আমার দেহচর্ম আপনার দেহচর্মকে স্পর্শ করুক’। তার এ মর্মস্পর্শী কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার জন্য কল্যাণের দো‘আ করলেন(دَعَا لَهُ بِخَيْرٍ)।[1] রাসূল (সাঃ)-এর এ কাজের মধ্যে মানবিক সাম্যের এক উত্তম নমুনা রয়েছে, যা নিঃসন্দেহে এক ঈর্ষণীয় বিষয়।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদেরকে বললেন, চূড়ান্ত নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কেউ যুদ্ধ শুরু করবে না। ব্যাপকহারে তীরবৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত কেউ তীর ছুঁড়বে না এবং তোমাদের উপরে তরবারি ছেয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তরবারি চালাবে না’। তিনি আরও বলেন, বনু হাশেমকে জোর করে যুদ্ধে আনা হয়েছে। তাদের সাথে আমাদের কোন যুদ্ধ নয়। অতএব তাদের কোন ব্যক্তি সামনে পড়ে গেলে তাকে যেন কেউ আঘাত না করে। আববাসকে যেন হত্যা না করা হয়। অনুরূপভাবে আবুল বাখতারী বিন হেশামকেও হত্যা করো না। কেননা এরা মক্কায় আমাদের কোনরূপ কষ্ট দিত না। বরং সাহায্যকারী ছিল।
উল্লেখ্য যে, বনু হাশিমের বিরুদ্ধে কুরায়েশদের বয়কটনামা যারা ছিঁড়ে ফেলেছিল, তাদের একজন ছিলেন আবুল বাখতারী। কিন্তু যুদ্ধে আবুল বাখতারী নিহত হয়েছিলেন তার নিজস্ব হঠকারিতার জন্য। তিনি তার সঙ্গী কাফের বন্ধুকে ছাড়তে চাননি। ফলে যুদ্ধে তারা উভয়ে নিহত হয়।[2] অতঃপর রাসূল (সাঃ) ও আবুবকর (রাঃ) টিলার উপরে সামিয়ানার নীচে নিজ স্থানে চলে যান।
[1]. ইবনু হিশাম ১/৬২৬; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৮৩৫; আল-বিদায়াহ ৩/২৭০-৭১।
[2]. ইবনু হিশাম ১/৬২৮-৩০; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৬৭ পৃঃ।
যুদ্ধ শুরু (بدء المعركة)
২য় হিজরীর ১৭ই রামাযান শুক্রবার সকালে যুদ্ধ শুরু হয় (ইবনু হিশাম ১/৬২৬)। ইতিমধ্যে কুরায়েশ পক্ষের জনৈক হঠকারী আসওয়াদ বিন আব্দুল আসাদ আল-মাখযূমী দৌড়ে এসে বলল, আমি এই হাউয থেকে পানি পান করব অথবা একে ভেঙ্গে ফেলব অথবা এখানেই মরব’। তখন হামযা (রাঃ) এসে তার পায়ে আঘাত করলেন। এমতাবস্থায় সে পা ঘেঁষতে ঘেঁষতে হাউযের দিকে এগোতে লাগল। হামযা তাকে দ্বিতীয় বার আঘাত করলে সে হাউযেই মরে পড়ল ও তার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হ’ল। এরপর যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠলো এবং সে যুগের নিয়ম অনুযায়ী কুরায়েশ পক্ষ মুসলিম পক্ষের বীর যোদ্ধাদের দ্বৈতযুদ্ধে আহবান করল। তাদের একই পরিবারের তিনজন সেরা অশ্বারোহী বীর উৎবা ও শায়বাহ বিন রাবী‘আহ এবং অলীদ বিন উৎবা এগিয়ে এল। জবাবে মুসলিম পক্ষ হ’তে মু‘আয ও মু‘আবিবয বিন ‘আফরা কিশোর দুই ভাই এবং আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহাসহ তিনজন আনছার তরুণ বীরদর্পে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু কুরায়েশ পক্ষ বলে উঠলো হে মুহাম্মাদ! আমাদের স্বগোত্রীয় সমকক্ষদের পাঠাও’। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, হে ওবায়দাহ, হে হামযাহ, হে আলী তোমরা যাও। অতঃপর আলী তার প্রতিপক্ষ অলীদ বিন উৎবাহকে, হামযাহ তার প্রতিপক্ষ শায়বাহ বিন রাবী‘আহকে এক নিমিষেই খতম করে ফেললেন। ওদিকে বৃদ্ধ ওবায়দাহ ইবনুল হারেছ তার প্রতিপক্ষ উৎবা বিন রাবী‘আহর সঙ্গে যুদ্ধে আহত হ’লেন। তখন আলী ও হামযাহ তার সাহায্যে এগিয়ে এসে উৎবাহকে শেষ করে দেন ও ওবায়দাহকে উদ্ধার করে নিয়ে যান। কিন্তু অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের ফলে যুদ্ধশেষে মদীনায় ফেরার পথে ৪র্থ বা ৫ম দিন ওবায়দাহ শাহাদাত বরণ করেন।[1]
প্রথম আঘাতেই সেরা তিনজন বীর যোদ্ধা ও গোত্র নেতাকে হারিয়ে কুরায়েশ পক্ষ মরিয়া হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এ সময় রাসূল (সাঃ) শত্রুদের যথাসম্ভব দূরে রাখার জন্য নির্দেশ দিলেন, إِذَا أَكْثَبُوكُمْ فَارْمُوهُمْ وَاسْتَبْقُوا نَبْلَكُمْ ‘যখন তারা তোমাদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে, তখন তোমরা তাদের প্রতি তীর নিক্ষেপ কর এবং এর মাধ্যমে প্রতিযোগিতা কর’ (বুখারী হা/৩৯৮৪)। অতঃপর তিনি এক মুষ্টি বালু হাতে নিয়ে শত্রুবাহিনীর দিকে ছুঁড়ে মারলেন এবং বললেন, شَاهَتْ الْوُجُوهُ ‘চেহারাগুলো বিকৃত হৌক’। ফলে শত্রুবাহিনীর মুশরিকদের এমন কেউ থাকলো না, যার চোখে ঐ বালু প্রবেশ করেনি। নিঃসন্দেহে এটি ছিল ফেরেশতাদের মাধ্যমে আল্লাহর বিশেষ সাহায্য। তাই আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, وَمَا رَمَيْتَ إِذْ رَمَيْتَ وَلَـكِنَّ اللهَ رَمَى ‘তুমি যখন বালু নিক্ষেপ করেছিলে, প্রকৃতপক্ষে তা তুমি নিক্ষেপ করোনি, বরং আল্লাহ নিক্ষেপ করেছিলেন’।[2]
নিঃসন্দেহে এটি ছিল রাসূল (সাঃ)-এর একটি মু‘জেযা ও অনন্য বৈশিষ্ট্য, যা তিনি হোনায়েন যুদ্ধেও করেছিলেন।[3] ফারসী কবি বলেন,
محمد عربى كابروئے ہر دو سراست
كسے كہ خاك درش نيست خاك برسرأو
‘মুহাম্মাদ আরাবী হ’লেন দুনিয়া ও আখেরাতের মর্যাদার উৎস। কেউ যদি তার পায়ের ধূলা হ’তে না পারে, তার মাথা ধূলি ধূসরিত হৌক!’
মুসলিম নামধারী একদল মুশরিক মা‘রেফতী পীর-ফকীর এই ঘটনা দ্বারা রাসূল (সাঃ)-কে আল্লাহ বানিয়ে ফেলেছে এবং তারা নিজেদেরকে ‘আল্লাহর অংশ’ বলে থাকে। তাদের দাবী, ‘যত কল্লা তত আল্লা’। তারা সূতায় অথবা পাতায় ফুঁক দিলে এবং তা দেহে বাঁধলে বা পকেটে রাখলে শত্রু তাকে দেখতে পাবে না বলে মিথ্যা ধারণা প্রচার করে। এভাবে তারা সরলমনা ও ভক্ত জনগণের ঈমান নষ্ট করে ও সেই সাথে ভক্তির চোরাগলি দিয়ে ভক্তের পকেট ছাফ করে।
বালু নিক্ষেপের পর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) স্বীয় বাহিনীকে নির্দেশ দেন, قُوْمُوا إلَى جَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ ‘তোমরা এগিয়ে চলো জান্নাতের পানে, যার প্রশস্ততা আসমান ও যমীন পরিব্যাপ্ত’ (মুসলিম হা/১৯০১)। রাসূল (সাঃ)-এর এই আহবান মুসলমানদের দেহমনে ঈমানী বিদ্যুতের চমক এনে দিল। অতঃপর তিনি বললেন, وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لاَ يُقَاتِلُهُمُ الْيَوْمَ رَجُلٌ فَيُقْتَلُ صَابِرًا مُحْتَسِبًا مُقْبِلاً غَيْرَ مُدْبِرٍ إلاَّ أَدْخَلَهُ اللهُ الْجَنَّةَ ‘যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন, তার কসম করে বলছি, যে ব্যক্তি আজকে দৃঢ়পদে নেকীর উদ্দেশ্যে লড়াই করবে, পিছপা হবে না, সর্বদা সম্মুখে অগ্রসর হবে, অতঃপর যদি সে নিহত হয়, তবে আল্লাহ তাকে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করাবেন’।[4]
[1]. আবুদাঊদ হা/২৬৬৫; আহমাদ হা/৯৪৮; মিশকাত হা/৩৯৫৭ সনদ ছহীহ; আল-বিদায়াহ ৩/২৭২।
[2]. ইবনু হিশাম ১/৬৬৮; আনফাল ৮/১৭; হাদীছটির সনদ ‘মুরসাল’। কিন্তু ইবনু কাছীর বলেন, আয়াতটি যে বদর যুদ্ধের ঘটনায় নাযিল হয়েছে, এতে কোন সন্দেহ নেই। বিদ্বানগণের নিকট যা মোটেই গোপন নয়। ঐ, তাফসীর সূরা আনফাল ১৭ আয়াত; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৬৩।
[3]. মুসলিম হা/১৭৭৭; মিশকাত হা/৫৮৯১; তাফসীর ত্বাবারী হা/১৫৮২৩, সনদ ‘মুরসাল’; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা আনফাল ১৭ আয়াত।
[4]. ইবনু হিশাম ১/৬২৭; হাদীছ ছহীহ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৭৪৯); আহমাদ হা/৮০৬১।
যুদ্ধের প্রতীক চিহ্ন (شعار المسلمين ببدر)
বিভিন্ন যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বিভিন্ন প্রতীক চিহ্ন ব্যবহার করতেন। যেমন (১) বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর প্রতীক চিহ্ন ছিল,أَحَدٌ أَحَدٌ (আহাদ, আহাদ)।[1] (২) ওহোদ যুদ্ধে ও সারিইয়া গালিব বিন লায়ছীর প্রতীক চিহ্ন ছিল, أَمِتْ، أَمِتْ (মেরে ফেল, মেরে ফেল)।[2] (৩) খন্দক ও বনু কুরায়যা যুদ্ধে ছিল,حم، لاَ يُنْصَرُونَ (হা-মীম। তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না’)।[3] (৪) বনু মুছত্বালিক্ব যুদ্ধে প্রতীক চিহ্ন ছিল,يَا مَنْصُورُ، أَمِتْ أَمِتْ (হে বিজয়ী! মেরে ফেল, মেরে ফেল’)।[4] (৫) মক্কা বিজয়, হোনায়েন এবং ত্বায়েফ যুদ্ধে মুহাজিরদের প্রতীক ছিলيَا بَنِي عَبْدِ الرَّحْمَنِ ‘হে বনু আব্দুর রহমান’! খাযরাজদের প্রতীক ছিলيَا بَنِي عَبْدِ اللهِ ‘হে বনু আব্দুল্লাহ’! এবং আউসদের প্রতীক ছিলيَا بَنِي عُبَيْدِ اللهِ ‘হে বনু ওবায়দুল্লাহ’![5]
এতে প্রমাণিত হয় যে, যুদ্ধের প্রধান পতাকা ছাড়াও অন্যান্য দলের বিশেষ পতাকা ছিল। এতে আরও প্রমাণিত হয় যে, পরিচিতির জন্য বিশেষ প্রতীক চিহ্ন ব্যবহার করা যায়। যাকে ‘ব্যাজ’ (Badge) কিংবা মনোগ্রাম (Monogram) ইত্যাদি বলা হয়।
জান্নাত পাগল মুমিন মৃত্যুকে পায়ে দলে শতগুণ শক্তি নিয়ে সম্মুখে আগুয়ান হ’ল ও তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। এমন সময় জনৈক আনছার ছাহাবী উমায়ের বিন হোমাম(عُمَيْرُ بْنُ حُمَامٍ) ‘বাখ বাখ’(بَخْ بَخْ) বলে উঠলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আমি জান্নাতবাসী হ’তে চাই’। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে সুসংবাদ দিয়ে বললেন,فَإِنَّكَ مِنْ أَهْلِهَا ‘নিশ্চয়ই তুমি তার অধিবাসী’। একথা শুনে ছাহাবী থলি হ’তে কিছু খেজুর বের করে খেতে লাগলেন। কিন্তু দ্রুত তিনি বলে উঠলেন, لَئِنْ أَنَا حَيِّيْتُ حَتَّى آكُلَ تَمَرَاتِيْ هَذِهِ إِنَّهَا لَحَيَاةٌ طَوِيْلَةٌ ‘যদি আমি এই খেজুরগুলি খেয়ে শেষ করা পর্যন্ত বেঁচে থাকি, তবে সেটাতো দীর্ঘ জীবন হয়ে যাবে’ বলেই সমস্ত খেজুর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ও বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করতে করতে এক পর্যায়ে তিনি শহীদ হয়ে গেলেন’।[6]
এ সময় রাসূল (সাঃ) আল্লাহর নিকটে আকুলভাবে নিম্নোক্ত প্রার্থনা করেন,
اللَّهُمَّ أَنْجِزْ لِىْ مَا وَعَدْتَنِىْ اللَّهُمَّ إِنِّيْ أَنْشُدُكَ عَهْدَكَ وَوَعْدَكَ ... اللَّهُمَّ إِنْ تَهْلِكْ هَذِهِ الْعِصَابَةُ لاَ تُعْبَدْ فِى الأَرْضِ بَعْدَ الْيَوْمِ أبَدًا-
‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে যে ওয়াদা করেছ তা পূর্ণ কর। হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে তোমার অঙ্গীকার ও ওয়াদা পূরণের প্রার্থনা জানাচ্ছি। ... হে আল্লাহ! যদি এই ক্ষুদ্র দলটি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহ’লে আজকের দিনের পর তোমার ইবাদত করার মত কেউ যমীনে আর থাকবে না’। তিনি প্রার্থনায় এমন আত্মভোলা ও বিনয়ী হয়ে ভেঙ্গে পড়লেন যে, তার স্কন্ধ হ’তে চাদর পড়ে গেল। এ দৃশ্য দেখে আবুবকর ছুটে এসে চাদর উঠিয়ে দিলেন। অতঃপর তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন,حَسْبُكَ يَا رَسُولَ اللهِ فَقَدْ أَلْحَحْتَ عَلَى رَبِّكَ ‘যথেষ্ট হয়েছে হে আল্লাহর রাসূল! আপনার পালনকর্তার নিকটে আপনি চূড়ান্ত প্রার্থনা করেছেন’।[7]
[1]. ইবনু হিশাম ১/৬৩৪। বর্ণনাটির সনদ যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৭৬৪)।
[2]. ইবনু হিশাম ২/৬৮, ৬১১; খবর ছহীহ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১০৯৭); আবুবকর (রাঃ)-এর নেতৃত্বে সংঘটিত যুদ্ধেও একই প্রতীক চিহ্ন ছিল (হাকেম হা/২৫১৬, হাদীছ ছহীহ; মিশকাত হা/৩৯৫০)। এছাড়া অন্যান্য যুদ্ধেও বিশেষ প্রতীক চিহ্নসমূহ ছিল।
[3]. ইবনু হিশাম ২/২২৬; ছহীহুল জামে‘ হা/২৩০৮; মিশকাত হা/৩৯৪৮।
[4]. ইবনু হিশাম ২/২৯৪; সনদ হাসান (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৪৭৯)।
[5]. ইবনু হিশাম ২/৪০৯ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৬৭৫)।
[6]. মুসলিম হা/১৯০১; মিশকাত হা/৩৮১০ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।
[7]. বুখারী হা/৪৮৭৫, মিশকাত হা/৫৮৭২।
ফেরেশতাগণের অবতরণ (نزول الملائكة)
এ সময় আয়াত নাযিল হ’ল -إِذْ تَسْتَغِيْثُوْنَ رَبَّكُمْ فَاسْتَجَابَ لَكُمْ أَنِّيْ مُمِدُّكُمْ بِأَلْفٍ مِّنَ الْمَلآئِكَةِ مُرْدِفِيْنَ ‘যখন তোমরা তোমাদের পালনকর্তার নিকটে কাতর প্রার্থনা করছিলে, তখন তিনি তোমাদের দো‘আ কবুল করলেন এই মর্মে যে, আমি তোমাদেরকে সাহায্য করব এক হাযার ফেরেশতা দিয়ে, যারা ধারাবাহিকভাবে অবতরণ করবে’ (আনফাল ৮/৯)।[1] ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, বদরের যুদ্ধে ব্যতীত অন্য কোন যুদ্ধে ফেরেশতারা যোগদান করেননি (ইবনু কাছীর)। উল্লেখ্য যে, সূরা আনফাল ৯ আয়াতে ‘এক হাযার’, আলে ইমরান ১২৪ ও ১২৫ আয়াতে যথাক্রমে ‘তিন হাযার’ ও ‘পাঁচ হাযার’ ফেরেশতা অবতরণের কথা বলা হয়েছে’। এর ব্যাখ্যায় ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, ‘এক হাযার’ সংখ্যাটি তিন হাযার বা তার অধিক সংখ্যাকে নিষেধ করে না। কেননা উক্ত আয়াতের শেষে مُرْدِفِيْنَ শব্দ এসেছে। যার অর্থ ‘ধারাবাহিকভাবে আগত’। অতএব আল্লাহর হুকুমে যত হাযার প্রয়োজন, তত হাযার ফেরেশতা নাযিল হবে’।[2] বস্ত্ততঃ সংখ্যায় বেশী বলার উদ্দেশ্য মুসলিম বাহিনীকে অধিক উৎসাহিত করা এবং বিজয়ের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত করা।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ছালাত অবস্থায় এক সময় সামান্য তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। অতঃপর তিনি জেগে উঠে বললেন, أَبْشِرْ يَا أَبَا بَكْرٍ أَتَاكَ نَصْرُ اللهِ، هَذَا جِبْرِيلُ آخِذٌ بِعِنَانِ فَرَسِهِ يَقُودُهُ عَلَى ثَنَايَاهُ النَّقْعُ ‘সুসংবাদ গ্রহণ কর হে আবুবকর! তোমার কাছে আল্লাহর সাহায্য এসে গেছে। এই যে জিব্রীল, তার ঘোড়ার লাগাম ধরে ধূলি উড়িয়ে এগিয়ে আসছেন’।[3]
ইবনু আব্বাস (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন,هَذَا جِبْرِيلُ آخِذٌ بِرَأْسِ فَرَسِهِ عَلَيْهِ أَدَاةُ الْحَرْبِ ‘ঐ যে জিব্রীল যুদ্ধসাজে সজ্জিত হয়ে তার ঘোড়ার লাগাম ধরে দাঁড়িয়ে আছেন’। অতঃপর তিনি তাঁবুর বাইরে এসে বললেন,سَيُهْزَمُ الْجَمْعُ وَيُوَلُّوْنَ الدُّبُرَ (‘সত্বর দলটি পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পালাবে’-ক্বামার ৫৪/৪৫)।[4] অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, তিনি বাইরে এসে আঙ্গুলের ইশারা করে করে বলেন, هَذَا مَصْرَعُ فُلاَنٍ ‘এটি অমুকের বধ্যভূমি’। এটি অমুকের, ওটি অমুকের’। রাবী আনাস (রাঃ) বলেন, তাদের কেউ ঐ স্থান অতিক্রম করতে পারেনি, যেখানে যেখানে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ইশারা করেছিলেন।[5]
[1]. তাফসীর সূরা আনফাল ৯ আয়াত; বুখারী হা/৪৮৭৫; তিরমিযী হা/৩০৮১, সনদ হাসান।
[2]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা আলে ইমরান ১২৫ আয়াত।
[3]. আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ ২২৫ পৃঃ, সনদ হাসান; ইবনু হিশাম ১/৬২৬-২৭, সনদ ‘মুরসাল’ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৭৪৭)।
[4]. ইবনু হিশাম ১/৬২৭; বুখারী হা/৩৯৫৩, ৩৯৯৫; মিশকাত হা/৫৮৭২-৭৩ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়, মু‘জেযা অনুচ্ছেদ-৭ ; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৬৫ পৃঃ।
[5]. মুসলিম হা/১৭৭৯ (৮৩); মিশকাত হা/৫৮৭১।
ফেরেশতাগণের যুদ্ধে যোগদান (قدوم الملائكة فى المعركة)
মুসলিম বাহিনীর এই হামলার প্রচন্ডতার সাথে সাথে যোগ হয় ফেরেশতাগণের আগমন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, إِذْ يُوحِي رَبُّكَ إِلَى الْمَلاَئِكَةِ أَنِّي مَعَكُمْ فَثَبِّتُوا الَّذِينَ آمَنُوا سَأُلْقِي فِي قُلُوبِ الَّذِينَ كَفَرُوا الرُّعْبَ فَاضْرِبُوا فَوْقَ الأَعْنَاقِ وَاضْرِبُوا مِنْهُمْ كُلَّ بَنَانٍ- ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ شَاقُّوا اللهَ وَرَسُولَهُ وَمَنْ يُشَاقِقِ اللهَ وَرَسُولَهُ فَإِنَّ اللهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ‘যখন তোমাদের পালনকর্তা ফেরেশতাদের নির্দেশ দিলেন যে, আমি তোমাদের সাথে রয়েছি। অতএব তোমরা ঈমানদারগণের চিত্তকে দৃঢ় রাখো। আমি সত্বর অবিশ্বাসীদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করে দেব। কাজেই তোমরা গর্দানের উপর আঘাত হানো এবং তাদের প্রত্যেক জোড়ায় জোড়ায় মারো’। ‘এটা এজন্য যে, তারা আল্লাহ ও তার রাসূলের অবাধ্য হয়েছে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসূলের অবাধ্য হয়, নিশ্চয়ই আল্লাহ (তার জন্য) কঠিন শাস্তিদাতা’ (আনফাল ৮/১২-১৩)। ইকরিমা বিন আবু জাহল (যিনি ঐ যুদ্ধে পিতার সাথে শরীক ছিলেন এবং মক্কা বিজয়ের পরে মুসলমান হন) বলেন, ঐদিন আমাদের লোকদের মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে যেত, অথচ দেখা যেতো না কে মারলো (তাবাক্বাত ইবনু সা‘দ)। আবুদাঊদ আল-মাযেনী বলেন, আমি একজন মুশরিক সৈন্যকে মারতে উদ্যত হব। ইতিমধ্যে তার ছিন্ন মস্তক আমার সামনে এসে পড়ল। আমি বুঝতেই পারলাম না, কে ওকে মারল’। রাসূল (সাঃ)-এর চাচা আববাস যিনি বাহ্যিকভাবে মুশরিক বাহিনীতে ছিলেন, জনৈক আনছার তাকে বন্দী করে আনলে তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! আমাকে এ ব্যক্তি বন্দী করেনি। বরং যে ব্যক্তি বন্দী করেছে, তাকে এখন দেখতে পাচ্ছি না। তিনি একজন চুল বিহীন মাথাওয়ালা ও সুন্দর চেহারার মানুষ এবং বিচিত্র বর্ণের একটি সুন্দর ঘোড়ায় তিনি সওয়ার ছিলেন। আনছার যোদ্ধা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমিই এনাকে বন্দী করেছি। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উক্ত আনছারকে বললেন, اسْكُتْ فَقَدْ أَيَّدَكَ اللهُ بِمَلَكٍ كَرِيمٍ ‘চুপ কর। আল্লাহ এক সম্মানিত ফেরেশতা দ্বারা তোমাকে সাহায্য করেছেন’ (আহমাদ হা/৯৪৮)। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, ফেরেশতারা কোন মুশরিকের উপরে আক্রমণ করার ইচ্ছা করতেই আপনা-আপনি তার মস্তক দেহ হ’তে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত।[1] ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ঐ দিন একজন মুসলিম সেনা তার সম্মুখের মুশরিককে মারতে গেলে শাণিত তরবারির ও ঘোড়ার আওয়ায শোনেন। তিনি ফেরেশতার আওয়ায শুনেছেন যে, তিনি বলছেনأَقْدِمْ حَيْزُوْمُ ‘হায়যূম আগে বাড়ো’ (‘হায়যূম’ হ’ল ফেরেশতার ঘোড়ার নাম)। অতঃপর ঐ মুশরিক সেনাকে তিনি সামনে চিৎ হয়ে পড়ে যেতে দেখেন। তিনি দেখলেন যে, তরবারির আঘাতের ন্যায় তার নাক ও মুখমন্ডল বিভক্ত হয়ে গেছে। উক্ত আনছার ছাহাবী রাসূল (সাঃ)-এর নিকট এসে উক্ত ঘটনা বর্ণনা করলে তিনি বলেন, صَدَقْتَ، ذَلِكَ مِنْ مَدَدِ السَّمَاءِ الثَّالِثَةِ ‘তুমি সত্য বলেছ। ওটি তৃতীয় আসমান থেকে সরাসরি সাহায্যের অংশ’।[2] কেউ কতক ফেরেশতাকে সরাসরি দেখেছেন। ঐদিন ফেরেশতাদের মাথার পাগড়ী ছিল সাদা। যা তাদের পিঠ পর্যন্ত ঝুলে ছিল। তবে জিব্রীলের মাথার পাগড়ী ছিল হলুদ বর্ণের।[3]
উপরোক্ত ঘটনাবলী এ কথারই সাক্ষ্য বহন করে যে, কিছু কিছু কাজের মাধ্যমে ফেরেশতাগণ মুসলমানদের আশ্বস্ত করেছেন যে, তারাও যেন যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন।
[1]. আহমাদ হা/৯৪৮, সনদ ছহীহ; মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩৬৬৭৯।
[2]. মুসলিম হা/১৭৬৩ (৫৮); মিশকাত হা/৫৮৭৪।
[3]. ইবনু হিশাম ১/৬৩৩।
প্রসিদ্ধ আছে যে, ইবলীস স্বয়ং বনু কিনানাহর নেতা সুরাক্বা বিন মালেক বিন জু‘শুম আল-মুদলেজীর রূপ ধারণ করে যুদ্ধে উপস্থিত থেকে আবু জাহলকে সর্বদা উৎসাহিত করেছে এবং রাসূল (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সর্বদা প্ররোচিত করেছে। কিন্তু এখন যুদ্ধের ময়দানে ফেরেশতাদের দেখতে পেয়ে সে ভয়ে পালাতে থাকে। হারেছ বিন হেশাম তাকে সুরাক্বা ভেবে আটকাতে চাইলে সে তার বুকে জোরে এক ঘুষি মেরে দ্রুত দৌড়ে গিয়ে সমুদ্রের মধ্যে ডুব দিয়ে হারিয়ে যায় (আর-রাহীক্ব ২১৯ পৃঃ)। বর্ণনাটির সনদ ‘মুরসাল’ বা যঈফ (মা শা-‘আ ১০৯ পৃঃ)। মূলতঃ শয়তান কারু রূপ ধরে নয়, বরং অন্তরে খটকা সৃষ্টির মাধ্যমে আবু জাহল ও তার সাথীদের প্ররোচিত করেছিল। যা সূরা আনফাল ৪৮-৪৯ এবং সূরা হাশর ১৬-১৭ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
ফেরেশতা নাযিলের উদ্দেশ্য (غرض نزول الملائكة)
এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَمَا جَعَلَهُ اللهُ إِلاَّ بُشْرَى لَكُمْ وَلِتَطْمَئِنَّ قُلُوبُكُمْ بِهِ وَمَا النَّصْرُ إِلاَّ مِنْ عِنْدِ اللهِ الْعَزِيْزِ الْحَكِيْمِ ‘(তোমাদের নিকটে ফেরেশতা প্রেরণের বিষয়টি ছিল) কেবল তোমাদের জন্য সুসংবাদ হিসাবে এবং যাতে তোমাদের অন্তরে প্রশান্তি আসে। বস্ত্ততঃ সাহায্য কেবলমাত্র মহাপরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময় আল্লাহর পক্ষ হ’তেই এসে থাকে’ (আলে ইমরান ৩/১২৬)।
এর দ্বারা একথা বুঝানো হয়েছে যে, মুসলিম বাহিনী যেন এ বিশ্বাস দৃঢ় রাখে যে, ফেরেশতারা তাদের সাহায্যার্থে প্রস্ত্তত হয়ে পাশেই আছে। সেজন্য আল্লাহর হুকুমে তারা যৎসামান্য সাহায্য করছে। প্রকৃতপক্ষে এর উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের মনোবলকে বর্ধিত করা, ফেরেশতাদের দ্বারা যুদ্ধ করানো নয়। কেননা তারা সরাসরি জিহাদ করলে মুমিনদের কোন ছওয়াব থাকে না। তাছাড়া সেটা হ’লে তো এক হাযার (আনফাল ৮/৯), তিন হাযার বা পাঁচ হাযার (আলে ইমরান ৩/১২৪-২৫) কেন, একজন ফেরেশতাই যথেষ্ট ছিল কুরায়েশ বাহিনীকে খতম করার জন্য। যেভাবে জিব্রীল (আঃ) একাই লূতের কওমকে তাদের নগরীসহ শূন্যে তুলে উপুড় করে ফেলে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলেন আল্লাহর হুকুমে (হূদ ১১/৮২; হিজর ১৫/৭৩-৭৪)।
এ জগতে যুদ্ধ ও জিহাদের দায়িত্ব মানুষকে অর্পণ করা হয়েছে। যাতে তারা তার ছওয়াব ও উচ্চ মর্যাদা লাভে ধন্য হয়। ফেরেশতা বাহিনী দ্বারা যদি দেশ জয় করা বা ইসলামী হুকূমত প্রতিষ্ঠা করা আল্লাহর ইচ্ছা হ’ত, তাহ’লে পৃথিবীতে কাফেরদের রাষ্ট্র দূরে থাক, তাদের অস্তিত্বই থাকতো না। বরং আল্লাহর বিধান এই যে, দুনিয়াতে কুফর ও ঈমানের সংঘর্ষ চলতেই থাকবে। ঈমানদারগণ সর্বদা আল্লাহর সাহায্য পাবেন। তারা ইহকালে ও পরকালে মর্যাদামন্ডিত হবেন। কিন্তু কাফেররা আল্লাহর সাহায্য থেকে বঞ্চিত হবে এবং ইহকালে ও পরকালে তারা ধিকৃত ও লাঞ্ছিত হবে। নমরূদ ও ইবরাহীম, ফেরাঊন ও মূসা কি এর বাস্তব উদাহরণ নয়? আজও ফেরাঊন ও মূসার দ্বন্দ্ব চলছে এবং ক্বিয়ামত অবধি তা চলবে।
মাক্কী বাহিনীর পলায়ন (فرار الجيش المكى)
মুসলিম বাহিনীর দুর্ধর্ষ আক্রমণে পর্যুদস্ত মুশরিক বাহিনী প্রাণভয়ে পালাতে থাকল। এ দৃশ্য দেখে তাদের ধরে রাখার জন্য আবু জাহল তার লোকদের উদ্দেশ্যে জোরালো ভাষণ দিয়ে বলেন, সোরাক্বার পলায়নে তোমরা ভেঙ্গে পড়ো না। সে আগে থেকেই মুহাম্মাদের চর ছিল। ওৎবা, শায়বা ও অলীদের মৃত্যুতেও ভীত হওয়ার কারণ নেই। কেননা তাড়াহুড়োর মধ্যে তারা মারা পড়েছেন। লাত ও ‘উযযার শপথ করে বলছি, ওদেরকে শক্ত করে রশি দিয়ে বেঁধে না ফেলা পর্যন্ত আমরা ফিরে যাব না। অতএব তোমরা ওদেরকে মেরো না। বরং ধরো এবং বেঁধে ফেল’।
কিন্তু আবু জাহলের এই তর্জন-গর্জন অসার প্রমাণিত হ’ল। বর্ষিয়ান ছাহাবী আব্দুর রহমান বিন ‘আওফকে আনছারদের বনু সালামাহ গোত্রের কিশোর দু’ভাই মু‘আয ও মু‘আউভিয বিন ‘আফরা পৃথকভাবে এসে জিজ্ঞেস করল يَا عَمِّ أَرِنِى أَبَا جَهْلٍ! أُخْبِرْتُ أَنَّهُ يَسُبُّ رَسُوْلَ الله صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘চাচাজী! আবু জাহল-কে দেখিয়ে দিন। সে নাকি আমাদের রাসূলকে গালি দেয়’? তারা প্রত্যেকে পৃথকভাবে গোপনে এসে চাচাজীর কানে কানে একই কথা বলল। আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ বলেন, আমি ওদের নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। কিন্তু ওরা নাছোড়বান্দা। ফলে বাধ্য হয়ে দেখিয়ে দিলাম। তখন ওরা দু’জন তীব্র বেগে ছুটে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ল এবং মু‘আয প্রথম আঘাতেই আবু জাহলের পা তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। এ সময় তার কাঁধে ইকরিমা বিন আবু জাহলের তরবারির আঘাতে মু‘আযের একটি হাত কেটে ঝুলতে থাকলে সে নিজের পা দিয়ে চেপে ধরে হেঁচকা টানে সেটাকে নিজ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। তারপর ছোট ভাই মু‘আউভিযের আঘাতে আবু জাহল ধরাশায়ী হ’লে তারা উভয়ে রাসূল (সাঃ)-এর কাছে এসে গর্বভরে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আবু জাহলকে আমি হত্যা করেছি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, তোমাদের তরবারি মুছে ফেলেছ কি? তারা বলল, না। তারপর উভয়ের তরবারি পরীক্ষা করে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, كِلاَكُمَا قَتَلَهُ ‘তোমরা উভয়ে তাকে হত্যা করেছ’।[1] অবশ্য এই যুদ্ধে মু‘আউভিয বিন ‘আফরা পরে শহীদ হন এবং মু‘আয বিন ‘আফরা হযরত ওছমান (রাঃ)-এর খেলাফতকাল (২৩-৩৫ হি.) পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন।[2]
পরে আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ গিয়ে দেখেন যে, আবু জাহলের তখনও নিঃশ্বাস চলছে। তিনি তার দাড়ি ধরে মাথা কেটে নেবার জন্য ঘাড়ে পা রাখলে সে বলে ওঠে,وَهَلْ فَوْقَ رَجُلٍ قَتَلْتُمُوهُ ‘তোমরা কি এই ব্যক্তির চাইতে বড় কোন ব্যক্তিকে হত্যা করতে পেরেছ?’فَلَوْ غَيْرَ أَكَّارٍ قَتَلَنِيْ ‘ওহ্! আমাকে যদি (মদীনার) ঐ চাষাদের বদলে অন্য কেউ হত্যা করতো’![3] উল্লেখ্য যে, ইবনু মাসঊদ (রাঃ) মক্কায় ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্বের বকরীর রাখাল ছিলেন (আল-বিদায়াহ ৬/১০২)। অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, ইবনু মাসঊদ তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,أَخْزَاكَ اللهُ يَا عَدُوَّ الله ‘আল্লাহ তোকে লাঞ্ছিত করুন রে আল্লাহর দুশমন!’ জবাবে আবু জাহল বলে ওঠে,وَبِمَاذَا أَخْزَانِي؟ هَلْ أَعْمَدُ مِنْ رَجُلٍ قَتَلْتُمُوهُ ‘কেন তিনি আমাকে লাঞ্ছিত করবেন? আমার চাইতে শ্রেষ্ঠ কোন ব্যক্তিকে তোমরা হত্যা করেছ কি?’[4] এখন বল, لِمَنِ الدّائِرَةُ الْيَوْمَ ‘আজ কারা জিতলো’। ইবনু মাসঊদ বললেন, للَّه وَلِرَسُولِهِ ‘আজকের জয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূল-এর জন্য’। বলেই তার মাথাটা কেটে নিয়ে রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে হাযির হ’লেন এবং বললেন, يَا رَسُولَ اللهِ، هَذَا رَأْسُ عَدُوِّ اللهِ أَبِي جَهْلٍ ‘হে আল্লাহর রাসূল! এটা হ’ল আল্লাহর দুশমন আবু জাহলের মাথা। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলে ওঠেন, آلله الَّذِي لاَ إلَهَ غَيْرُهُ ‘আল্লাহর কসম? যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই’। আমি বললাম, হ্যাঁ। আল্লাহর কসম! যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই’। অতঃপর আমি তাঁর সামনে মাথাটি রেখে দিলাম তখন তিনি ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বললেন।[5] এভাবে মক্কার বড় ত্বাগূতটা শেষ হয়।
[1]. বুখারী হা/৩১৪১; মুসলিম হা/১৭৫২; মিশকাত হা/৪০২৮।
[2]. উল্লেখ্য যে, মু‘আয ও মু‘আউভিয উভয়ে তাদের বীরমাতা বনু নাজ্জারের ‘আফরা’ বিনতে ওবায়েদ বিন ছা‘লাবাহ-র দিকে সম্বন্ধিত হয়ে ইবনু ‘আফরা (ابْنَا عَفْرَاء) নামে পরিচিত ছিলেন (ইবনু হিশাম ১/৬৩৫ টীকা-৫)। পিতা ছিলেন বনু নাজ্জার-এর হারেছ বিন রিফা‘আহ বিন সাওয়াদ (আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৮১৬৮)। ‘আফরা-র মোট ৭ ছেলের প্রত্যেকে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং সবাই তাদের মায়ের নামে ইবনু ‘আফরা (ابن عفراء) নামে পরিচিত ছিলেন। ‘আফরার প্রথম স্বামী হারেছ-এর ঔরসে মু‘আয ও মু‘আউভিয জন্ম গ্রহণ করেন। অতঃপর তালাকপ্রাপ্তা হয়ে তিনি মক্কায় গমন করেন। সেখানে গিয়ে তিনি বুকায়ের বিন ‘আব্দে ইয়ালীল লায়ছী-এর সাথে বিবাহিতা হন। তার ঔরসে ৪ পুত্র খালেদ, ইয়াস, ‘আক্বেল ও ‘আমের জন্মগ্রহণ করেন। সেখানে তালাকপ্রাপ্তা হ’লে তিনি মদীনায় ফিরে আসেন এবং পুনরায় পূর্ব স্বামী হারেছ-এর সাথে বিবাহিতা হন। তার ঔরসে ‘আওফ জন্মগ্রহণ করেন। এইভাবে তিনি মোট ৭টি পুত্র সন্তানের মা হন। যারা প্রত্যেকেই ছিলেন অত্যন্ত বীর ও বদরী ছাহাবী (ইবনু সা‘দ, আল-ইছাবাহ, উসদুল গাবাহ)। মু‘আয বিন ‘আফরার পিতা প্রখ্যাত আনছার নেতা ল্যাংড়া ছাহাবী ‘আমর ইবনুল জামূহ ছিলেন (আল-ইছাবাহ মু‘আয ক্রমিক ৮০৫৭; ইবনু হিশাম ১/৬৩৪, ৭১০) কথাটি সঠিক নয়। কেননা ঐ নামে বীর মাতা ‘আফরা বিনতে উবায়েদ-এর কোন স্বামী ছিলেন না (আল-ইছাবাহ ‘আফরা ক্রমিক ১১৪৮১)। সুহায়লী বলেন, এ ব্যাপারে সর্বাধিক বিশুদ্ধ হ’ল এই যে, তারা উভয়ে ছিলেন ‘আফরার পুত্র। কেননা রাসূল (সাঃ) বলেন, قَدْ ضَرَبَهُ ابْنَا عَفْرَاءَ ‘আফরার পুত্রদ্বয় তাকে হত্যা করেছে’ (মুসলিম হা/১৮০০; ইবনু হিশাম ১/৬৩৫ টীকা-৫)।
[3]. বুখারী হা/৪০২০; মুসলিম হা/১৮০০; মিশকাত হা/৪০২৯ ‘জিহাদ’ অধ্যায় ৭ অনুচ্ছেদ।
[4]. ইবনু হিশাম ১/৬৩৫; বুখারী হা/৩৯৬১; মুসলিম হা/১৮০০।
[5]. ইবনু হিশাম ১/৬৩৫-৩৬।
উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার মৃতদেহ দেখার পর বলেন,يَرْحَمُ اللهُ ابْنَيْ عَفْرَاءَ، فَهُمَا شُرَكَاءُ فِي قَتْلِ فِرْعَوْنَ هَذِهِ الْأُمَّةِ ‘আল্লাহ আফরার দুই পুত্রের উপর রহম করুন! তারা এই উম্মতের ফেরাঊনকে হত্যায় অংশীদার ছিল। আর ছিল ফেরেশতা এবং ইবনু মাসঊদ’ (আল-বিদায়াহ ৩/২৮৯)। বর্ণনাটির সনদ মুনক্বাতি‘ বা যঈফ। একইভাবে এ সময় রাসূল (সাঃ) খুশীতে দু’রাক‘আত শুকরিয়ার ছালাত আদায় করেছিলেন মর্মে বর্ণিত হাদীছটিও যঈফ (ইবনু মাজাহ হা/১৩৯১)। ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, সিজদায়ে শুক্র ওয়াজিব নয় এবং মুস্তাহাব হওয়ার ব্যাপারেও কথা রয়েছে’ (মজমূ‘ ফাতাওয়া ২১/২৯৩; মা শা-‘আ ১১৩-১৪ পৃঃ)।
জয়-পরাজয় (النصر والخسارة)
এই যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে ৬ জন মুহাজির ও ৮ জন আনছার মোট ১৪জন শহীদ হন। কাফের পক্ষে ৭০ জন নিহত ও ৭০ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বন্দী হন। তাদের বড় বড় ২৪ জন নেতাকে বদরের একটি পরিত্যক্ত কূয়ায় (القَلِيب) নিক্ষেপ করা হয়।[1] যাদের মধ্যে হিজরতের প্রাক্কালে রাসূল (সাঃ)-কে হত্যার ষড়যন্ত্রকারী আবু জাহলসহ ১৪জন নেতার ১১ জন ছিল। বাকী তিনজন আবু সুফিয়ান (মৃ. মদীনায় ৩০ অথবা ৩৪ হি.), জুবায়ের বিন মুত্ব‘ইম (মৃ. ৫৭ হি.) ও হাকীম বিন হেযাম (মৃ. ৫৪ হি.) মক্কা বিজয়ের পর মুসলমান হন এবং তাদের ইসলাম আমৃত্যু সুন্দর ছিল।
উল্লেখ্য যে, আবু সুফিয়ান, জুবায়ের বিন মুত্ব‘ইম ও আবু লাহাব বদর যুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলেন। আবু লাহাব বদর যুদ্ধের সপ্তাহকাল পরে মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
[1]. আল-বিদায়াহ ৩/২৯৩; আর-রাহীক্ব ২২৪-২৫ পৃঃ। মানছূরপুরী মুসলিম পক্ষে ২২ জন শহীদ বলেছেন (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/১৮৭)।
শুহাদায়ে বদর (شهداء بدر)
বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর যে ১৪ জন শহীদ হয়েছিলেন, তন্মধ্যে মুহাজির ছয় জন হ’লেন, (১) মিহজা‘ (مِهْجَعٌ), যিনি ওমর ইবনুল খাত্ত্বাবের মুক্তদাস ছিলেন এবং তিনি ছিলেন মুসলিম বাহিনীর প্রথম শহীদ। (২) বনু আব্দিল মুত্ত্বালিব থেকে উবায়দাহ ইবনুল হারিছ বিন মুত্ত্বালিব। শত্রু পক্ষের নেতা উৎবাহ বিন রাবী‘আহ তাঁর পা কেটে দেন। পরে ‘ছাফরা’ গিয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। (৩) বনু যোহরা থেকে উমায়ের বিন আবু ওয়াকক্বাছ। যিনি সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছের ভাই ছিলেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সের তরুণ হওয়ায় রাসূল (সাঃ) তাকে ফিরে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু তিনি কাঁদতে থাকেন। ফলে তাঁকে অনুমতি দেওয়া হয়। অতঃপর তিনি শহীদ হয়ে যান (আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৬০৬১)। (৪) মুহাজিরগণের মিত্র যুশ-শিমালাইন বিন ‘আব্দে আমর আল-খুযাঈ। (৫) বনু ‘আদীর মিত্র ‘আক্বেল বিন বুকায়ের। (৬) বনুল হারেছ বিন ফিহর থেকে ছাফওয়ান বিন বায়যা।
অতঃপর আনছারদের মধ্যেকার আট জন হ’লেন, (১) বনু নাজ্জার থেকে হারিছাহ বিন সুরাক্বাহ। (২-৩) বনু গানাম থেকে ‘আফরার দুই পুত্র ‘আওফ ও মু‘আউভিয। (৪) বনুল হারেছ বিন খাযরাজ থেকে ইয়াযীদ বিন হারেছ। (৫) বনু সালামাহ থেকে উমায়ের বিন হুমাম। (৬) বনু হাবীব থেকে রাফে‘ বিন মু‘আল্লা। (৭) বনু ‘আমর বিন ‘আওফ থেকে সা‘দ বিন খায়ছামা এবং (৮) মুবাশশির বিন আব্দুল মুনযির (ইবনু হিশাম ১/৭০৬-০৮)।
নিহত কুরায়েশ নেতৃবৃন্দের কয়েকজন (بعض المقتولين من سادات قريش)
বদর যুদ্ধে কুরায়েশ পক্ষের ৭০ জন নিহত ও ৭০ জন বন্দী হন (ইবনু হিশাম ১/৭১৪)। নিহতদের মধ্যে প্রসিদ্ধ কয়েকজন হ’লেন, (১-৫) বনু ‘আব্দে শামস গোত্রের উৎবাহ ও তার পুত্র অলীদ এবং ভাই শায়বাহ বিন রাবী‘আহ, হানযালা বিন আবু সুফিয়ান এবং উক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব। যাকে পরে হত্যা করা হয়। (৬) বনু মাখযূম গোত্রের আবু জাহল ‘আমর ইবনু হিশাম। (৭-৮) বনু জুমাহ গোত্রের উমাইয়া বিন খালাফ জুমাহী ও তার পুত্র আলী। (৯) বনু আসাদ গোত্রের আবুল বাখতারী ‘আছ বিন হিশাম ও (১০) নওফাল বিন খুওয়াইলিদ বিন আসাদ (কুরাইশের শয়তানদের অন্যতম)। (১১) বনু নওফাল গোত্রের তু‘আইমা বিন ‘আদী। জুবায়ের বিন মুত্ব‘ইম-এর চাচা। (১২) বনু ‘আব্দিদ্দার গোত্রের নযর বিন হারেছ। যাকে পরে হত্যা করা হয়। (১৩-১৪) বনু সাহম গোত্রের নুবাইহ ও মুনাবিবহ ইবনুল হাজ্জাজ দুই ভাই (ইবনু হিশাম ১/৭০৮-১৩)।
প্রসিদ্ধ কুরায়েশ বন্দীদের কয়েকজন (بعض الأسارى من سادات قريش)
(১) বনু হাশেম গোত্র থেকে রাসূল (সাঃ)-এর চাচা আববাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব। (২) চাচাতো ভাই ‘আক্বীল বিন আবু ত্বালিব (৩) নওফাল বিন হারেছ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব (৪) বনু ‘আব্দে শাম্স গোত্রের আমর বিন আবু সুফিয়ান (৫) রাসূল (সাঃ)-এর জামাতা ‘আব্দে শামস গোত্রের আবুল ‘আছ বিন রবী‘। ইনি যয়নাবের স্বামী ছিলেন। তার বিনিময় মূল্য হিসাবে বিবাহকালে খাদীজা (রাঃ)-এর দেওয়া কণ্ঠহার দেখে রাসূল (সাঃ) অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন। পরে তাঁকে যয়নাবকে ফেরত দেওয়ার শর্তে কোনরূপ বিনিময় মূল্য ছাড়াই মুক্তি দেওয়া হয় (ইবনু হিশাম ১/৬৫২-৫৩)। (৬) বনু জুমাহ গোত্রের আমর বিন উবাই বিন খালাফ (ইবনু হিশাম ২/৩-৮)। ইবনু হিশাম তার তালিকায় আববাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিবের নাম দেননি। কারণ তিনি আগে থেকেই ‘মুসলিম’ ছিলেন। কিন্তু সম্প্রদায়ের ভয়ে তাঁর ইসলাম গোপন রেখেছিলেন (ইবনু হিশাম ২/৩-টীকা)।
বদর যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী (بعض الوقائع فى غزوة بدر)
(১) বদর যুদ্ধে যাত্রা পথে দু’তিন জন করে পালাক্রমে সওয়ার হয়ে চলতে হ’ত। রাসূল (সাঃ), আলী ও আবু লুবাবা ইবনুল মুনযির এবং পরবর্তীতে তার বদলে মারছাদ বিন আবু মারছাদ গানাভীর জন্য একটি উট বরাদ্দ ছিল। যাতে পায়ে হাঁটার পালা আসলে রাসূল (সাঃ) নিজেও হাঁটতেন। এসময় সাথীগণ নিজেরা হেঁটে তাঁকে উটে সওয়ার থাকার অনুরোধ করেন। জবাবে রাসূল (সাঃ) বলেন, مَا أَنْتُمَا بِأَقْوَى مِنِّى وَلاَ أَنَا بِأَغْنَى عَنِ الأَجْرِ مِنْكُمَا ‘তোমরা দু’জন আমার চাইতে শক্তিশালী নও এবং আমিও নেকী পাওয়ার ব্যাপারে তোমাদের চাইতে কম মুখাপেক্ষী নই’।[1]
(২) বেলাল (রাঃ)-কে নির্যাতনকারী মনিব এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সম্মুখে ও পিছনে নিন্দাকারী নরাধম উমাইয়া বিন খালাফ-এর সাথে আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ (রাঃ)-এর জাহেলী যুগে চুক্তি ছিল যে, তিনি মক্কায় তার লোকদের রক্ষা করবেন এবং আব্দুর রহমান মদীনায় উমাইয়ার লোকদের রক্ষা করবেন। সেকারণ যুদ্ধ শেষে তিনি উমাইয়া ও তার ছেলেকে পাহাড়ের একটি গুহায় লুকিয়ে রাখেন। কিন্তু যেভাবেই হোক সেটি বেলালের নযরে পড়ে যায়। ফলে তিনি একদল আনছারের সামনে গিয়ে চীৎকার দিয়ে বলে উঠেন, ওহে আল্লাহর সাহায্যকারীগণ! শীর্ষ কাফের উমাইয়া এখানে। হয় আমি থাকব, নয় সে থাকবে’। তার ডাকের সাথে সাথে চারদিক থেকে সবাই এসে তাকে ঘিরে ফেলল। আব্দুর রহমান শত চেষ্টা করেও তাকে রক্ষা করতে পারলেন না। ফলে পিতা-পুত্র দু’জনেই সেখানে নিহত হ’ল। এতে আব্দুর রহমান-এর পা যখমী হয়।[2]
(৩) তিনদিন অবস্থানের পর বিদায়কালে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মক্কার মৃত নেতাদের উদ্দেশ্যে কূয়ার পাশে দাঁড়িয়ে একে একে পিতা সহ তাদের নাম ধরে ডেকে বলেন,
يَا فُلاَنُ بْنَ فُلاَنٍ، وَيَا فُلاَنُ بْنَ فُلاَنٍ، أَيَسُرُّكُمْ أَنَّكُمْ أَطَعْتُمُ اللهَ وَرَسُولَهُ فَإِنَّا قَدْ وَجَدْنَا مَا وَعَدَنَا رَبُّنَا حَقًّا، فَهَلْ وَجَدْتُمْ مَا وَعَدَ رَبُّكُمْ حَقًّا؟ قَالَ فَقَالَ عُمَرُ يَا رَسُولَ اللهِ، مَا تُكَلِّمُ مِنْ أَجْسَادٍ لاَ أَرْوَاحَ لَهَا فَقَالَ رَسُولُ اللهِ –صلى الله عليه وسلم – وَالَّذِى نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ، مَا أَنْتُمْ بِأَسْمَعَ لِمَا أَقُولُ مِنْهُمْ. قَالَ قَتَادَةُ أَحْيَاهُمُ اللهُ حَتَّى أَسْمَعَهُمْ قَوْلَهُ تَوْبِيخًا وَتَصْغِيرًا وَنَقِيمَةً وَحَسْرَةً وَنَدَمًا-
‘হে অমুকের পুত্র অমুক! হে অমুকের পুত্র অমুক! তোমরা কি এখন বুঝতে পারছ যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করলে তোমরা আজ খুশী হ’তে? নিশ্চয়ই আমরা আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে যে (বিজয়ের) ওয়াদা দিয়েছিলেন, আমরা তা সত্যরূপে পেয়েছি। তোমরা কি তা সত্যরূপে পেয়েছ যা তোমাদের প্রতিপালক তোমাদেরকে (আযাবের) ওয়াদা করেছিলেন? এ সময় ওমর বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এমন দেহগুলির সাথে কথা বলছেন, যাদের মধ্যে রূহ নাই। জবাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, যার হাতে আমার জীবন, তাঁর কসম করে বলছি, তোমরা তাদের চাইতে অধিক শ্রবণকারী নও, যা আমি বলছি’।
এর ব্যাখ্যায় ক্বাতাদাহ (রাঃ) বলেন, আল্লাহ তাদেরকে (সাময়িকভাবে) জীবিত করেন, যাতে তারা নবীর ধিক্কারবাণীগুলি শুনতে পায় ও লজ্জিত হয়’ (বুখারী হা/৩৯৭৬)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ওমর (রাঃ) বলেন, يَا رَسُولَ اللهِ كَيْفَ يَسْمَعُوا وَأَنَّى يُجِيبُوا وَقَدْ جَيَّفُوا قَالَ وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ مَا أَنْتُمْ بِأَسْمَعَ لِمَا أَقُولُ مِنْهُمْ وَلَكِنَّهُمْ لاَ يَقْدِرُونَ أَنْ يُجِيبُوا ‘ওরা কিভাবে শুনবে এবং ওরা কিভাবে জওয়াব দিবে। অথচ ওরা মরে পচে গেছে’। জওয়াবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, যার হাতে আমার জীবন, তাঁর কসম করে বলছি, তোমরা ওদের চাইতে অধিক শ্রবণকারী নও, যা আমি বলছি’। কিন্তু ওরা জওয়াব দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না’।[3] অন্য বর্ণনায় এসেছে, يَا رَسُولَ اللهِ أَتُنَادِيهِمْ بَعْدَ ثَلاَثٍ وَهَلْ يَسْمَعُونَ؟ يَقُولُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ (إِنَّكَ لاَ تُسْمِعُ الْمَوْتَى). فَقَالَ وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ مَا أَنْتُمْ بِأَسْمَعَ مِنْهُمْ وَلَكِنَّهُمْ لاَ يَسْتَطِيعُونَ أَنْ يُجِيبُوا ‘হে আল্লাহর রাসূল! তিন দিন পরে আপনি ওদের ডাকছেন। ওরা কি শুনতে পাবে? অথচ আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই তুমি শুনাতে পারো না কোন মৃতকে’ (নামল ২৭/৮০; রূম ৩০/৫২)। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, যার হাতে আমার জীবন, তাঁর কসম করে বলছি, তোমরা তাদের চাইতে অধিক শ্রবণকারী নও, যা আমি বলছি’। কিন্তু ওরা জওয়াব দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না’ (আহমাদ হা/১৪০৯৬, সনদ ছহীহ)।
উক্ত বিষয়ে ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, ক্বাতাদাহ (রাঃ) ঐসব ব্যক্তিগণের প্রতিবাদে উপরোক্ত কথা বলেছেন, যারা বদরে মৃত কাফিরদের রাসূল (সাঃ)-এর আহবান শুনতে পাওয়াকে অস্বীকার করে’ (ফাৎহুল বারী হা/৩৯৭৬-এর ব্যাখ্যা)। ছাহেবে মিরক্বাত বলেন, ক্বাতাদাহ (রাঃ)-এর ব্যাখ্যায় বুঝা যায় যে, ঐ সময় তাদেরকে জীবিত করার বিষয়টি রাসূল (সাঃ)-এর জন্য ‘খাছ’ ছিল। কিন্তু এটি জমহূর বিদ্বানগণের মতামতের বিরোধী (মিরক্বাত)।
উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় আয়েশা (রাঃ) বলেন,وَالنَّاسُ يَقُولُونَ لَقَدْ سَمِعُوا مَا قُلْتَ لَهُمْ وَإِنَّمَا قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لَقَدْ عَلِمُوا ‘লোকেরা বলে রাসূল (সাঃ) বলেছেন, তারা অবশ্যই শুনেছে যা তুমি তাদের বলছ। অথচ রাসূল (সাঃ) বলেছিলেন, নিশ্চয়ই তারা জানতে পারবে’ (আহমাদ হা/২৬৪০৪ সনদ হাসান)। তিনি বলেন, مَا قَالَ إِنَّهُمْ لَيَسْمَعُونَ مَا أَقُولُ إِنَّمَا قَالَ إِنَّهُمُ الآنَ لَيَعْلَمُونَ أَنَّ مَا كُنْتُ أَقُولُ لَهُمْ حَقٌّ. ثُمَّ قَرَأَتْ (إِنَّكَ لاَ تُسْمِعُ الْمَوْتَى)، (وَمَا أَنْتَ بِمُسْمِعٍ مَنْ فِى الْقُبُورِ). تَقُولُ: حِينَ تَبَوَّءُوا مَقَاعِدَهُمْ مِنَ النَّارِ ‘রাসূল (সাঃ) বলেননি, যা আমি বলছি তা অবশ্যই তারা শুনছে। বরং তিনি বলেছিলেন, অবশ্যই তারা এখুনি জানতে পারবে, যা আমি তাদেরকে বলতাম (কবরের আযাব বিষয়ে), তা সত্য। অতঃপর তিনি আয়াত দু’টি পাঠ করেন (নমল ২৭/৮০) এবং (ফাত্বির ৩৫/২২)। তিনি বলেন, (তারা জানবে) যখন তাদেরকে জাহান্নামে তাদের ঠিকানায় পৌছানো হবে’।[4] মূলতঃ জীবিতদের শোনানোই ছিল মূল উদ্দেশ্য। যাতে যুগ যুগ ধরে কাফির-মুনাফিকরা এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে।
(৪) আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেন, হারেছাহ বিন সুরাক্বা আনছারী তরুণ বয়সে বদর যুদ্ধে নিহত হন। তার মা এসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমাকে হারেছার অবস্থান সম্পর্কে বলবেন কি? যদি সে জান্নাতে থাকে, তাহ’লে আমি ছবর করব এবং ছবরের বিনিময়ে ছওয়াব কামনা করব। আর যদি অন্য কিছু হয়, তাহ’লে বলুন আমি কি করব? তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, কি বলছ তুমি? জান্নাত কি কেবল একটা? বহু জান্নাত রয়েছে। আর তোমার সন্তান রয়েছে সর্বোচ্চ জান্নাতুল ফেরদৌসে’ (বুখারী হা/২৮০৯, ৩৯৮২)।
[1]. আহমাদ হা/৩৯০১; হাকেম হা/৪২৯৯; মিশকাত হা/৩৯১৫, সনদ হাসান।
[2]. বুখারী হা/২৩০১ ‘দায়িত্ব অর্পণ’ (الوكالة) অধ্যায়-৪০ অনুচ্ছেদ-২।
এখানে প্রসিদ্ধ আছে যে, (১) যুদ্ধ শুরুর পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ছাহাবীদের উদ্দেশ্যে বলেন, অনেক লোককে আবু জাহল যবরদস্তি করে যুদ্ধে এনেছে। অথচ তারা মোটেই যুদ্ধে ইচ্ছুক ছিল না। অতএব তোমরা বনু হাশেমের কাউকে এবং বিশেষ করে আববাসকে কোনভাবেই আঘাত করবে না। অনুরূপভাবে আবুল বাখতারী বিন হেশামকে যেন হত্যা করো না। পরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জানতে পারেন যে, কুরায়েশ নেতা উৎবাহ বিন রাবী‘আহর পুত্র আবু হুযায়ফা, যিনি আগেই মুসলমান হয়ে মদীনায় হিজরত করেন এবং বদরের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, তিনি বলেছেন যে, আমরা আমাদের পিতা ও ভাইদের হত্যা করব, আর আববাসকে ছেড়ে দেব? তা হ’তে পারে না। আল্লাহর কসম! আমার সামনে পড়ে গেলে আমি অবশ্যই আববাসকে হত্যা করব’। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তখন ওমর (রাঃ)-কে ডেকে বললেন, হে আবু হাফ্ছ! রাসূলের চাচার মুখের উপর তরবারির আঘাত করা হবে? জবাবে ওমর (রাঃ) বলেন, আমাকে ছাড়ুন, আমি এখুনি ওর গর্দান উড়িয়ে দিয়ে আসি’। পরে আবু হুযায়ফা এতে অনুতপ্ত হন। তিনি বলতেন যে, ঐদিন মুখ ফসকে যে কথাটি বেরিয়ে গিয়েছিল, সেই থেকে আমি কোনদিন মনে স্বস্তি পাইনি। সর্বদা ভাবতাম, শাহাদাত লাভই এর একমাত্র কাফফারা হ’তে পারে। পরে তিনি আবুবকর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ভন্ডনবী মুসায়লামার বিরুদ্ধে ইয়ামামাহর যুদ্ধে শহীদ হন (আর-রাহীক্ব ২২২ পৃঃ; হাকেম হা/৪৯৮৮; ইবনু হিশাম ১/৬২৯)। বক্তব্যটির সনদ যঈফ। যাহাবী বলেন, ‘সনদ দুর্বল হওয়া ছাড়াও প্রথম দিকের ছাহাবীদের পক্ষে এমনকি পরবর্তীদের পক্ষেও এরূপ আচরণ অতীব দূরতম বিষয়’ (মা শা-‘আ ১১২ পৃঃ)। (২) এই যুদ্ধে আবুবকর (রাঃ) তার পুত্র আব্দুর রহমানকে ‘হে খবীছ! আমার মাল কোথায়? বলে ধমক দেন’ (ইবনু হিশাম ১/৬৩৮; আর-রাহীক্ব ২২৩ পৃঃ)। বর্ণনাটির সনদ মু‘যাল বা যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৭৭২)। (৩) ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) তার মামু ‘আছ বিন হিশাম বিন মুগীরাহকে হত্যা করেন’ (আর-রাহীক্ব ২২৩ পৃঃ, সূত্র বিহীন)। (৪) মুছ‘আব বিন উমায়ের (রাঃ) তার ভাই আবু আযীয বিন উমায়েরকে উদ্দেশ্য করে তাকে বন্দীকারী আনছার ছাহাবীকে বলেন, ওকে ভালোভাবে বেঁধে নিয়ে যাও। ওর মা বড় একজন ধনী মহিলা। অনেক রক্তমূল্য পাবে। অতঃপর ভাইকে উদ্দেশ্য করে উক্ত ছাহাবীর প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, إنَّهُ أَخِي دُونَكَ ‘উনিই আমার ভাই, তুমি নও’ (আর-রাহীক্ব ২২৪ পৃঃ; ইবনু হিশাম ১/৬৪৬)। বর্ণনাগুলি বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয়। বরং ‘মুরসাল’ বা যঈফ (তালীক্ব, আর-রাহীক্ব ১৩৩ পৃঃ; মা শা-‘আ ১১৮ পৃঃ)।
[3]. বুখারী হা/৩৯৭৬; মুসলিম হা/২৮৭৪; মিশকাত হা/৩৯৬৭, ‘জিহাদ’ অধ্যায়-১৯, ‘বন্দীদের হুকুম’ অনুচ্ছেদ-৫।
[4]. বুখারী হা/৩৯৭৯; মুসলিম হা/৯৩২।
(১) এ ব্যাপারে নিম্নোক্ত হাদীছটি প্রসিদ্ধ আছে, যা ছহীহ নয়।-
يَا أَهْلَ الْقَلِيبِ بِئْسَ عَشِيرَةُ النَّبِيِّ كُنْتُمْ لِنَبِيِّكُمْ كَذَّبْتُمُونِي وَصَدَّقَنِي النَّاسُ وَأَخْرَجْتُمُونِي وَآوَانِي النَّاسُ وَقَاتَلْتُمُونِي وَنَصَرَنِي النَّاسُ ثُمَّ قَالَ: هَلْ وَجَدْتُمْ مَا وَعَدَكُمْ رَبُّكُمْ حَقًّا؟ ‘হে কূয়ার অধিবাসীরা! কতইনা মন্দ আত্মীয় ছিলে তোমরা তোমাদের নবীর জন্য। তোমরা আমাকে মিথ্যাবাদী বলেছিলে, আর লোকেরা আমাকে সত্যবাদী বলেছিল। তোমরা আমাকে বের করে দিয়েছিলে, আর লোকেরা আমাকে আশ্রয় দিয়েছিল। তোমরা আমার সাথে লড়াই করেছ, অথচ লোকেরা আমাকে সাহায্য করেছে’। অতঃপর তিনি বলেন, তোমাদের প্রতিপালক তোমাদেরকে যে ওয়াদা দিয়েছিলেন, তা কি তোমরা সত্যরূপে পেয়েছ?
আর-রাহীক্ব ২২৪-২৫; ইবনু হিশাম ১/৬৩৯; আলবানী বলেন, এর সনদ মু‘যাল (যঈফ); মুসনাদে আহমাদ-এর বর্ণনায় এসেছে, جَزَاكُمُ اللهُ شَرًّا مِنْ قَوْمِ نَبِىٍّ ‘আল্লাহ তোমাদের মত নবীর কওমকে মন্দ প্রতিফল দিন!’ (আহমাদ হা/২৫৪১১ সনদ মুনক্বাতি‘ বা ছিন্ন সূত্র; মা শা-‘আ ১১৫ পৃঃ)।
(২) আরও প্রসিদ্ধ আছে যে, মুশরিক নেতাদের মৃতদেহগুলি কূয়ায় নিক্ষেপকালে উৎবা বিন রাবী‘আহর লাশ টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে তার পুত্র আবু হুযায়ফা-কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘হে আবু হুযায়ফা! তোমার পিতার এ অবস্থা দেখে নিশ্চয়ই তোমার অন্তরে খারাব লাগছে’? জবাবে আবু হুযায়ফা বললেন, ‘আল্লাহর কসম তা নয় হে আল্লাহর রাসূল! আমার পিতা ও তার নিহত হওয়ার ব্যাপারে আমার মনে কোন ভাবান্তর নেই। তবে আমি জানতাম যে, আমার পিতার মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, দূরদর্শিতা ও কল্যাণময়তা রয়েছে। আমি আশা করতাম এগুলি তাঁকে ইসলামের দিকে পথ দেখাবে। কিন্তু এখন তার কুফরী হালতে মৃত্যু দেখে দুঃখিত হয়েছি’। এ জবাব শুনে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তার জন্য কল্যাণের দো‘আ করলেন এবং তার সম্পর্কে ভাল মন্তব্য করলেন (আর-রাহীক্ব ২২৪ পৃঃ; হাদীছ যঈফ, ঐ, তালীক্ব ১৩৩ পৃঃ)।
(৩) এদিন উক্কাশা বিন মিহছান তার ভাঙ্গা তরবারি নিয়ে রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে আসেন। তখন তিনি তাকে একটি কাঠের টুকরা দিয়ে বলেন, তুমি এটা দিয়ে যুদ্ধ কর। অতঃপর যখন তিনি সেটি হাতে নিয়ে নড়াচড়া করেন তখন সেটি লম্বা, শক্ত ও ধবধবে সাদা তরবারিতে পরিণত হয়ে যায়। অতঃপর সেটি নিয়ে তিনি যুদ্ধ করেন। যতক্ষণ না আল্লাহ মুসলমানদের বিজয় দান করেন। সেদিন থেকে উক্ত তরবারিটির নাম হয় আল-‘আওন (العَوْن) বা সাহায্যকারী। এরপর থেকে তিনি রাসূল (সাঃ)-এর সাথে সকল যুদ্ধে উক্ত তরবারি নিয়ে যোগদান করেন। এমনকি আবুবকর (রাঃ)-এর খিলাফতকালে রিদ্দার যুদ্ধে উক্ত তরবারি নিয়েই তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং শহীদ হন। তুলায়হা বিন খুওয়াইলিদ আল-আসাদী তাঁকে হত্যা করেন’ (আর-রাহীক্ব ২২৪ পৃঃ; ইবনু হিশাম ১/৬৩৭)। ইবনু ইসহাক এটি বিনা সনদে উল্লেখ করেছেন। সেকারণ এটি যঈফ (তালীক্ব, আর-রাহীক্ব ১৩২ পৃঃ; মা শা-‘আ ১১৬ পৃঃ)।
ইবনু হাজার বলেন, উক্কাশা ছিলেন জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ছাহাবী। তাঁকে হত্যাকারী তুলায়হা ‘মুরতাদ’ ছিল। পরে সে ইসলামে ফিরে আসে। রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম (আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৫৬৪৮)।
(৪) এছাড়াও একটি মু‘জেযা প্রসিদ্ধ আছে যে, রেফা‘আহ বিন রাফে‘ বিন মালেক বলেন, বদরের যুদ্ধের দিন আমি তীরের আঘাতপ্রাপ্ত হই। ফলে আমার চোখ বেরিয়ে যায়। তখন রাসূল (সাঃ) সেখানে থুথু লাগিয়ে দেন এবং আমার জন্য দো‘আ করেন। ফলে আমি পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাই’ (হাকেম হা/৫০২৪; বায়হাক্বী দালায়েল ৩/১০০)। বর্ণনাটি যঈফ (মা শা-‘আ ১২২ পৃঃ)।
মক্কায় পরাজয়ের খবর ও তার প্রতিক্রিয়া (وصول نبأ الهزيمة فى مكة ورد فعلها)
হায়সুমান বিন আব্দুল্লাহ আল-খুযাঈ সর্বপ্রথম মক্কায় পরাজয়ের খবর পৌঁছে দেয়। এ খবর তাদের উপরে এমন মন্দ প্রভাব ফেলল যে, তারা শোকে-দুঃখে পাথর হয়ে গেল এবং সকলকে বিলাপ করতে নিষেধাজ্ঞা জারী করল। যাতে মুসলমানেরা তাদের দুঃখ দেখে আননিদত হবার সুযোগ না পায়। যুদ্ধ ফেরত ভাতিজা আবু সুফিয়ান বিন হারেছ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিবকে দেখে আবু লাহাব সাগ্রহে যুদ্ধের খবর কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, আল্লাহর কসম! আমরা এমন একটা দলের মুকাবিলা করেছি, যাদেরকে আমরা আমাদের কাঁধগুলি পেতে দিয়েছি। আর তারা ইচ্ছামত হত্যা করেছে ও বন্দী করেছে। এতদসত্ত্বেও আমি আমাদের লোকদের তিরষ্কার করছিনা এ কারণে যে, প্রকৃত প্রস্তাবে আমাদের মুকাবিলা এমন কিছু শুভ্রবসন লোকের সঙ্গে হয়েছিল, যারা আসমান ও যমীনের মাঝখানে সাদা-কালো মিশ্রিত(خَيْلٌ بُلْقٌ) ঘোড়ার উপরে সওয়ার ছিল। আল্লাহর কসম! না তারা কোন কিছুকে ছেড়ে দিচ্ছিল, না কেউ তাদের মুকাবিলায় দাঁড়াতে পারছিল’(وَاللهِ مَا تُلِيقُ شَيْئًا وَلاَ يَقُومُ لَهَا شَيْءٌ)। একথা শুনে পাশেই দাঁড়ানো আবু রাফে‘, যিনি আববাস-এর গোলাম ছিলেন এবং মুসলমান ছিলেন, তিনি বলে ওঠেন, تِلْكَ وَاللهِ الْمَلاَئِكَةُ ‘আল্লাহর কসম! ওঁরা ফেরেশতা’। একথা শুনে ক্ষুব্ধ নেতা আবু লাহাব তার গালে ভীষণ জোরে এক চড় বসিয়ে দিল। তখন উভয়ে লড়াই শুরু হয়ে গেল। আবু লাহাব আবু রাফে‘-কে মাটিতে ফেলে দিয়ে মারতে লাগল। তখন আববাস-এর স্ত্রী উম্মুল ফযল (রাঃ) এসে তাঁবুর একটা খুঁটি নিয়ে আবু লাহাবকে ভীষণ জোরে মার দিয়ে বললেন, اسْتَضْعَفْتَهُ أَنْ غَابَ عَنْهُ سَيِّدُهُ ‘ওর মনিব বাড়ী নেই বলে তুমি ওকে দুর্বল ভেবেছ?’ এতে লজ্জিত হয়ে আবু লাহাব উঠে গেল। এর মাত্র সাতদিনের মধ্যেই আল্লাহর হুকুমে সে আদাসাহ (عَدَسَة) নামক মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে সারা দেহ পচে গলে মারা গেল। গুটি বসন্তের ন্যায় এই রোগকে সেযুগে মানুষ কু-লক্ষণ ও সংক্রামক ব্যাধি বলে জানত। ফলে পরিবারের লোকেরা তাকে ছেড়ে যায় এবং সে নিঃসঙ্গভাবে মৃত্যুবরণ করে। এ অবস্থায় তিনদিন লাশ পড়ে থাকলেও কেউ তার কাছে যায়নি। অবশেষে একজন লোকের সহায়তায় তার দুই ছেলে তার লাশ পাহাড়ের মাথায় নিয়ে একটা লাঠি দিয়ে ঠেলে গর্তে ফেলে তার উপর মাটি ও পাথর ছুঁড়ে পুঁতে দিল দুর্গন্ধের ভয়ে।[1] এইভাবে এই দুরাচার দুনিয়া থেকে বিদায় হ’ল। ছাফা পাহাড়ের ভাষণের দিন রাসূল (সাঃ)-কে تَبًّا لَكَ سَائِرَ الْيَوْمِ ‘সর্বদা তুমি ধ্বংস হও’ (বুখারী হা/৪৭৭০) বলার ১৫ বছর পরে তার এই পরিণতি হয়।
[1]. হাকেম হা/৫৪০৩, যাহাবী চুপ থেকেছেন; ইবনু হিশাম ১/৬৪৭।
মদীনায় বিজয়ের খবর (وصول نبأ الفةح فى المدينة)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা আনছারীকে মদীনার উচ্চ ভূমিতে এবং যায়েদ বিন হারেছাহকে নিম্নভূমিতে পাঠিয়ে দেন মদীনায় দ্রুত বিজয়ের খবর পৌঁছানোর জন্য। ঐ সময় রাসূল (সাঃ)-এর কন্যা ও হযরত ওছমানের স্ত্রী রুক্বাইয়া (রাঃ)-কে দাফন করে মাটি সমান করা হচ্ছিল। যার অসুখের কারণে রাসূল (সাঃ) ওছমান ও উসামা বিন যায়েদকে মদীনায় রেখে গিয়েছিলেন তার সেবা-শুশ্রূষা করার জন্য।[1]
অন্য দিকে ইহূদী ও মুনাফিকরা রাসূল (সাঃ)-এর পরাজয় এমনকি তাঁর নিহত হবার খবর আগেই রটিয়ে দিয়েছিল। অতঃপর নিশ্চিত খবর জানতে পেরে মুহাজির ও আনছার ছাহাবীগণ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে মদীনা মুখরিত করে তোলেন এবং রাসূল (সাঃ)-কে অভ্যর্থনার জন্য রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন (আর-রাহীক্ব ২২৭ পৃঃ)।
[1]. ইবনু হিশাম ১/৬৪২; বায়হাক্বী হা/১৮৩৬৬; হাকেম হা/৪৯৫৯, যাহাবী চুপ থেকেছেন।
গণীমত বণ্টন (قسمة الغنائم من بدر)
যুদ্ধ শেষে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বদরে তিনদিন অবস্থান করেন। উবাদাহ বিন ছামেত (রাঃ) বলেন যে, এরি মধ্যে গণীমতের মাল নিয়ে সৈন্যদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয়, যা এক সময়ে চরমে ওঠে। যারা শত্রুদের পিছু ধাওয়া করেছিল ও কাউকে হত্যা ও কাউকে বন্দী করেছিল, তারা তার সব মাল দাবী করল। আরেক দল যারা গণীমত জমা করেছিল, তারা সব মাল তাদের বলে দাবী করল। আরেক দল যারা রাসূল (সাঃ)-কে পাহারা দিয়ে তাঁকে হেফাযত করেছিল, তারাও সব নিজেদের বলে দাবী করল। এ সময় সূরা আনফাল ১ম আয়াত নাযিল হয়। يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْأَنْفَالِ قُلِ الْأَنْفَالُ لِلَّهِ وَالرَّسُولِ فَاتَّقُوا اللهَ وَأَصْلِحُوا ذَاتَ بَيْنِكُمْ وَأَطِيعُوا اللهَ وَرَسُولَهُ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ ‘লোকেরা তোমাকে প্রশ্ন করছে যুদ্ধলব্ধ গণীমতের মাল বণ্টন সম্পর্কে। বলে দাও, গণীমতের মাল সবই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং পরস্পরে মীমাংসা করে নাও। আর তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক’ (আনফাল ৮/১)। অতঃপর সেমতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সব মাল তার নিকটে জমা করতে বলেন।
যুদ্ধবন্দী হত্যা (قتل الأسارى)
অতঃপর রাসূল (সাঃ) বদর থেকে রওয়ানা দিয়ে ‘ছাফরা’ (الصَّفْرَاء) গিরি সংকট অতিক্রম করে একটি টিলার উপরে গিয়ে বিশ্রাম করেন এবং সেখানে বসে গণীমতের সমস্ত মালের এক পঞ্চমাংশ বের করে নিয়ে বাকী মাল সৈন্যদের মধ্যে সমভাবে বণ্টন করে দেন।[1] এর পূর্বে ছাফরা গিরিসংকটে কুরায়েশ বাহিনীর পতাকাবাহী দুষ্টমতি নযর বিন হারিছকে রাসূল (সাঃ)-এর আদেশক্রমে হযরত আলী (রাঃ) হত্যা করেন। এই শয়তান ইরাকের ‘হীরা’ থেকে নাচগানে পারদর্শী সুন্দরী নর্তকীদের খরীদ করে এনে মক্কাবাসীদের বিভ্রান্ত করত। যাতে কেউ রাসূল (সাঃ)-এর কথা না শোনে ও কুরআন না শোনে। এরপর ‘ইরকুয যাবিয়াহ’(عِرْقُ الظَّبْيَة) নামক স্থানে পৌঁছে আরেক শয়তানের শিখন্ডী উক্ববা বিন আবু মু‘আইত্বকে হত্যার নির্দেশ দেন’।[2] যে ব্যক্তি রাসূল (সাঃ)-কে কা‘বাগৃহে ছালাতরত অবস্থায় গলায় চাদর পেঁচিয়ে এবং পরে মাথায় উটের ভুঁড়ি চাপিয়ে হত্যার চেষ্টা করেছিল (বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৬৩৭৮, ৫২০)। একে মারেন আছেম বিন ছাবিত আনছারী (রাঃ)। মতান্তরে হযরত আলী (রাঃ)। এই দু’জন ব্যক্তি বন্দীর মর্যাদা পাবার যোগ্য ছিল না। কেননা তারা ছিল আধুনিক পরিভাষায় শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী (مِنْ أَكَابِرِ مُجْرِمِى الْحَرْب)।
[1]. ইবনু হিশাম ১/৬৪৩; আহমাদ হা/২২৮১৪, হাসান লিগায়রিহী; আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ ২৩৪ পৃঃ সনদ ছহীহ।
[2]. ইবনু হিশাম ১/৬৪৪; আল-বিদায়াহ ৩/৩০৫।
মদীনায় অভ্যর্থনা (استقبال الجيش الإسلامى فى المدينة)
বিজয়ী কাফেলা রাওহা (الرَّوْحَاء) পৌঁছলে মদীনা থেকে আগমনকারী অগ্রবর্তী অভ্যর্থনাকারী দলের সাথে প্রথম মুলাকাত হয় (ইবনু হিশাম ১/৬৪৩)। তারা বিপুল উৎসাহে বিজয়ী রাসূলকে অভ্যর্থনা জানায়। তাদের উচ্ছ্বাস দেখে রাসূল (সাঃ)-এর সাথী ছাহাবী সালামা বিন সালামাহ(سَلَمَةُ بنُ سَلاَمَة) বলেন,مَا الَّذِي تُهَنِّئُونَنَا بِهِ وَاللهِ إِنْ لَقِينَا إِلاَّ عَجَائِزَ صُلْعًا كَالْبُدْنِ الْمُعَقَّلَةِ، فَنَحَرْنَاهَا ‘তোমরা কিজন্য আমাদের মুবারকবাদ দিচ্ছ’? ‘আল্লাহর কসম! আমরা তো কিছু টেকো মাথা বুড়োদের মুকাবিলা করেছি মাত্র, যারা ছিল বাঁধা উটের মত, যাদেরকে আমরা যবহ করেছি’। তার কথা বলার ঢং দেখে রাসূল (সাঃ) মুচকি হেসে বললেন, يَا ابْنَ أَخِي أُولَئِكَ الْمَلَأُ الأَكْبَرُ ‘হে ভাতিজা! ওরাই তো বড় বড় নেতা’।[1] এ সময় ছাহাবী উসায়েদ বিন হুযায়ের আনছারী(أُسَيدُ بنُ الْحُضَير) যিনি বদর যুদ্ধে শরীক ছিলেন না, তিনি সাক্ষাৎ করে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি আপনাকে বিজয় দান করেছেন ও আপনার চক্ষুকে শীতল করেছেন। আল্লাহর কসম! আমি একথা ভেবে বদরে গমন হ’তে পিছনে থাকিনি যে, আপনার মুকাবিলা শত্রুদের সাথে হবে। ظَنَنْتُ أَنَّهَا عِيرٌ وَلَوْ ظَنَنْتُ أَنَّهُ عَدُوٌّ مَا تَخَلَّفْتُ ‘আমি তো ভেবেছিলাম এটা স্রেফ বাণিজ্য কাফেলা আটকানোর বিষয়। যদি বুঝতাম যে, এটা শত্রুদের বিরুদ্ধে মুকাবিলা, তাহ’লে আমি কখনো পিছনে থাকতাম না’। রাসূল (সাঃ) বললেন, (صَدَقْتَ) ‘তুমি সত্য বলেছ’ (আল-বিদায়াহ ৩/৩০৫)। পরের বছর ওহোদ যুদ্ধে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাকে আনছার বাহিনীর মধ্যে আউসদের পতাকাবাহী নিযুক্ত করেন। অতঃপর একদিকে কন্যা হারানোর বেদনা অন্যদিকে যুদ্ধ বিজয়ের আনন্দ এরি মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনায় প্রবেশ করেন।
[1]. ইবনু হিশাম ১/৬৪৩-৪৪; ত্বাবারাণী, মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৬৪৪৫; হাকেম হা/৫৭৬৭, সনদ ‘ছহীহ মুরসাল’; যঈফাহ হা/২২৩৫।
যুদ্ধবন্দীদের বিষয়ে ফায়ছালা (الحكم فى أسارى بدر)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আগমনের একদিন পরে বন্দীদের কাফেলা মদীনায় পৌঁছে। রাসূল (সাঃ) তাদেরকে ছাহাবীগণের মধ্যে বণ্টন করে দেন এবং তাদের সাথে উত্তম ব্যবহারের নির্দেশ দেন। তাঁর আদেশ যথাযথভাবে পালিত হয় এবং ছাহাবীগণ নিজেরা খেজুর খেয়ে বন্দীদের রুটি খাওয়ান (ইবনু হিশাম ১/৬৪৪-৪৫)। কেননা ঐ সময় মদীনায় খেজুর ছিল সাধারণ খাদ্য এবং রুটি ছিল মূল্যবান খাদ্য। অতঃপর তিনি ছাহাবীগণের সাথে পরামর্শ করেন। আবুবকর (রাঃ) তাদেরকে রক্তমূল্য নিয়ে ছেড়ে দিতে বলেন। কেননা এর ফলে কাফেরদের বিরুদ্ধে আমাদের শক্তি বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া এর মাধ্যমে আল্লাহ তাদের হেদায়াত নছীব করতে পারেন এবং তারা আমাদের জন্য সাহায্যকারী হ’তে পারে। কিন্তু ওমর ফারূক (রাঃ) স্ব স্ব আত্মীয়কে স্ব স্ব হস্তে হত্যা করার পরামর্শ দেন। দয়ার নবী আবুবকরের পরামর্শ গ্রহণ করলেন এবং অধিকাংশ বন্দীকে রক্তমূল্য নিয়ে ছেড়ে দিলেন। জামাতা আবুল ‘আছ সহ কয়েকজনকে রক্তমূল্য ছাড়াই মুক্তি দেন। আবুল ‘আছ ছিলেন খাদীজার সহোদর বোনের ছেলে এবং রাসূল-কন্যা যয়নবের স্বামী। ফিদইয়া দিতে অক্ষম কয়েকজনকে মাথা প্রতি ১০ জনকে লেখাপড়া শিখানোর বিনিময়ে মদীনাতেই রেখে দেন। তাদের মেয়াদ ছিল উত্তম রূপে পড়া ও লেখা শিক্ষা দান করা পর্যন্ত। এর দ্বারা শিক্ষা বিস্তারের প্রতি রাসূল (সাঃ)-এর আকুল আগ্রহের প্রমাণ মেলে। যা কোন যুদ্ধবন্দী বিনিময়ের ইতিহাসে ছিল নযীরবিহীন। ওছমান (রাঃ)সহ নয় জন ছাহাবীকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করা সত্ত্বেও গণীমতের অংশ দেন তাদের যথার্থ ওযর ও অন্যান্য সহযোগিতার কারণে।
উল্লেখ্য যে, ঐ সময় রাসূল-কন্যা রুক্বাইয়া মৃত্যু শয্যায় থাকার কারণে ওছমান গণী (রাঃ) ও উসামা বিন যায়েদ-কে রাসূল (সাঃ) মদীনায় থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন’ (সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৭০)। রাসূল (সাঃ)-এর জামাতা আবুল ‘আছ বিন রবী‘-এর রক্তমূল্য বাবদ তাঁর কন্যা যয়নবের যে কণ্ঠহারটি পেশ করা হয়, তা ছিল হযরত খাদীজার দেওয়া। তা দেখে রাসূল (সাঃ) কেঁদে ফেলেন এবং বলেন, إِنْ رَأَيْتُمْ أَنْ تُطْلِقُوا لَهَا أَسِيرَهَا وَتَرُدُّوا عَلَيْهَا الَّذِى لَهَا ‘যদি তোমরা যয়নাবের জন্য তার বন্দীকে মুক্তি দিতে এবং তার কণ্ঠহারটিকে তার কাছে ফেরৎ দিতে’! তখন সবাই বলল, হ্যাঁ। অতঃপর কন্যা যয়নবকে মদীনায় পাঠিয়ে দেওয়ার শর্ত করা হয়। অতঃপর বদর যুদ্ধের কাছাকাছি এক মাস পর যায়েদ বিন হারেছাহ ও একজন আনছার ছাহাবীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং তাঁকে মদীনায় ফিরিয়ে আনা হয়।[1] উক্ত কণ্ঠহার বিষয়ে ‘অনন্য কণ্ঠহার’ (الْعِقْدُ الْفَرِيدُ) নামে অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় লিখিত আরবী নিবন্ধ বাংলাদেশের সরকারী ডিগ্রী কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য হিসাবে রয়েছে।
হিজরতকালে হাববার ইবনুল আসওয়াদ বিন মুত্ত্বালিব(هَبَّارُ بْنُ الْأَسْوَدِ) যয়নাবকে তার হাওদায় বর্শা দিয়ে আঘাত করে। তাতে তিনি উটের পিঠ থেকে একটি পাথরের উপর পতিত হ’লে তাঁর গর্ভপাত হয়ে যায়। যাতে গর্ভস্থ সন্তান নষ্ট হয়ে যায় ও প্রচুর রক্তক্ষরণ হ’তে থাকে। এসময় আবু সুফিয়ান দলবল নিয়ে এসে উটচালক তাঁর দেবর কেনানাহ বিন রবী‘-কে বললেন, মুহাম্মাদের আহত মেয়েটিকে নিয়ে দিনের বেলায় প্রকাশ্যে যাওয়াটা আমাদের জন্য হীনকর। তাকে আটকিয়ে রাখা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। তুমি ওকে নিয়ে ফেরৎ যাও। অতঃপর রাতের বেলা গোপনে গিয়ে তার বাপের হাতে মেয়েকে পৌঁছে দাও। তার কথামতে কিনানাহ ফিরে যান এবং কয়েকদিন মক্কায় অবস্থান শেষে একটু সুস্থ হ’লে রাতের বেলা তাকে নিয়ে যায়েদ বিন হারেছাহর নিকট পৌঁছে দেন। এভাবে ইসলামের কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে যয়নব মদীনায় পিতৃগৃহে এবং আবুল ‘আছ মক্কায় বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করতে থাকেন। এ মর্মান্তিক ঘটনায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলেছিলেন,هِيَ أَفْضَلُ بَنَاتِي أُصِيبَتْ فِيَّ ‘সে আমার সেরা মেয়ে। আমার জন্য সে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে’।[2]
পরবর্তীতে ৮ম হিজরীর রামাযান মাসে মক্কা বিজয়ের কিছু পূর্বে আবুল ‘আছ মুসলমান হয়ে মদীনায় এলে যয়নবকে ছয় বছর পরে তার স্বামীর কাছে ন্যস্ত করা হয় এবং তাদের পূর্ব বিবাহ বহাল রাখা হয়।[3] যয়নব ৮ হিজরীর প্রথম দিকে এবং আবুল ‘আছ ১২ হিজরীর যিলহাজ্জ মাসে মৃত্যুবরণ করেন।[4]
উল্লেখ্য যে, হাববার মক্কা বিজয়ের পর মুসলমান হ’লে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে ক্ষমা করে দেন (যাদুল মা‘আদ ৩/৩৬২)।
বন্দীমুক্তির পরের দিনই সূরা আনফালের ৬৭ ও ৬৮ আয়াত নাযিলের মাধ্যমে ওমর (রাঃ)-এর পরামর্শের প্রতি আল্লাহর সমর্থন প্রকাশ পায়। যার ফলে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ও আবুবকর (রাঃ) ক্রন্দন করতে থাকেন। উক্ত আয়াতে বলা হয়,
مَا كَانَ لِنَبِيٍّ أَنْ يَكُوْنَ لَهُ أَسْرَى حَتَّى يُثْخِنَ فِي الأَرْضِ تُرِيْدُوْنَ عَرَضَ الدُّنْيَا وَاللهُ يُرِيْدُ الآخِرَةَ وَاللهُ عَزِيْزٌ حَكِيْمٌ- لَوْلاَ كِتَابٌ مِّنَ اللهِ سَبَقَ لَمَسَّكُمْ فِيْمَا أَخَذْتُمْ عَذَابٌ عَظِيْمٌ-
‘দেশে ব্যাপকভাবে শত্রুকে পরাভূত না করা পর্যন্ত বন্দী রাখা কোন নবীর জন্য সঙ্গত নয়। তোমরা কামনা কর পার্থিব সম্পদ আর আল্লাহ চান আখেরাতের কল্যাণ। আল্লাহ মহাপরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’। ‘আল্লাহর পক্ষ হ’তে পূর্ব বিধান না থাকলে তোমরা যা গ্রহণ করেছ, তজ্জন্য তোমাদেরকে ভয়ংকর শাস্তি পাকড়াও করত’ (আনফাল ৮/৬৭-৬৮)।
উপরোক্ত আয়াতে উল্লেখিত পূর্ব বিধানটি ছিল নিম্নরূপ:
فَإِذا لَقِيْتُمُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا فَضَرْبَ الرِّقَابِ حَتَّى إِذَا أَثْخَنْتُمُوْهُمْ فَشُدُّوا الْوَثَاقَ فَإِمَّا مَنّاً بَعْدُ وَإِمَّا فِدَاءً حَتَّى تَضَعَ الْحَرْبُ أَوْزَارَهَا-
‘অতঃপর যখন তোমরা কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হও, তখন তাদের গর্দান মার। অবশেষে যখন তাদেরকে পূর্ণরূপে পরাভূত কর, তখন তাদেরকে শক্ত করে বেঁধে ফেল। অতঃপর হয় তাদের প্রতি অনুগ্রহ কর, না হয় তাদের থেকে মুক্তিপণ নাও। তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে, যতক্ষণ না শত্রু অস্ত্র সমর্পণ করে.. (মুহাম্মাদ ৪৭/৪)।
উল্লেখ্য যে, নাখলা যুদ্ধের পরে ও বদর যুদ্ধের পূর্বে শা‘বান মাসে যুদ্ধ ফরয করে সূরা মুহাম্মাদ ৪-৭ ও ২০ আয়াত সমূহ নাযিল হয়। যাতে যুদ্ধের বিধি-বিধান সমূহ বর্ণিত হয়। এজন্য এ সূরাকে ‘সূরা ক্বিতাল’(سُوْرَةُ الْقِتَالِ) বলা হয়। তবে যুদ্ধের অনুমতি দিয়ে সূরা হজ্জের ৩৯ আয়াতটি নাযিল হয় হিজরতের সময়কালে, কুরায়েশদের অব্যাহত সন্ত্রাস ও হামলা মুকাবিলার জন্য।
উক্ত সূরা মুহাম্মাদ ৪ আয়াতে অনুগ্রহ অথবা মুক্তিপণের কথা বলা হয়েছে। সেই বিধান মতেই বন্দীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সূরা আনফালে বর্ণিত ধমকির আয়াত দু’টি (৬৭-৬৮) সঙ্গে সঙ্গে নাযিল না হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরে নাযিল হওয়ার মধ্যে আল্লাহর অশেষ করুণা নিহিত ছিল। যাতে বনু হাশেম সহ মুসলমানদের অনেক হিতাকাংখী বন্দী মুক্তি পান ও পরে তারা প্রকাশ্যে মুসলমান হয়ে যান। এই সময় বন্দী বিনিময়ের ঘটনাও ঘটে। যেমন হযরত সা‘দ বিন নু‘মান (রাঃ) ওমরাহ করার জন্য মক্কায় গেলে আবু সুফিয়ান তাকে আটকে দেন। পরে বদর যুদ্ধে বন্দী তার পুত্র আমর বিন আবু সুফিয়ানকে মুক্তি দেওয়ার বিনিময়ে তাকে মুক্ত করা হয়।[5]
[1]. আহমাদ হা/২৬৪০৫; আবুদাঊদ হা/২৬৯২; মিশকাত হা/৩৯৭০; সনদ হাসান।
[2]. হাকেম হা/৬৮৩৬; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩০৭১; আল-বিদায়াহ ৩/৩৩১।
[3]. ইবনু হিশাম ১/৬৫৭-৫৯; তিরমিযী হা/১১৪৩; আবুদাঊদ হা/২২৪০; ইবনু মাজাহ হা/২০০৯, সনদ ছহীহ। যে হাদীছে নতুন বিবাহ ও নতুন মোহরের কথা এসেছে, সেটি যঈফ (তিরমিযী হা/১১৪২; ইবনু মাজাহ হা/২০১০)। অন্য বর্ণনায় ‘দুই বছর’ পরের কথা এসেছে (আবুদাঊদ হা/২২৪০ সনদ ছহীহ)। তার অর্থ হ’ল ৬ষ্ঠ হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাসে হোদায়বিয়ার সন্ধির পর কাফির ও মুসলিমে বিবাহ ছিন্ন হওয়ার যে নির্দেশ আসে, তার দু’বছর পরে (ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা মুমতাহিনা ১০ আয়াত)।
[4]. আল-ইছাবাহ, যয়নব ক্রমিক ১১২১৭; ঐ, আবুল ‘আছ ক্রমিক ১০১৭৬।
[5]. ইবনু হিশাম ১/৬৫০-৫৩।
(১) প্রসিদ্ধ আছে যে, বদর যুদ্ধে ‘খতীবু কুরায়েশ’ বলে খ্যাত বন্দী সুহায়েল বিন ‘আমরকে মুক্ত করার জন্য কুরায়েশরা যখন লোক পাঠায়, তখন ওমর (রাঃ) রাসূল (সাঃ)-কে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে ছেড়ে দিন, আমি সুহায়েল-এর দু’টি দাঁত উপড়ে ফেলি এবং জিহবা টেনে বের করে ফেলি। যাতে সে আপনার বিরুদ্ধে কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে কখনো বক্তৃতা করতে না পারে। জওয়াবে রাসূল (সাঃ) বলেন, আমি কখনোই তার অঙ্গহানি করব না। তাহ’লে আল্লাহ আমার অঙ্গহানি করবেন। যদিও আমি নবী’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি ওমরকে এ কথাও বলেন, সত্তর সে এমন স্থানে দাঁড়াবে যে, তুমি তাকে তিরষ্কার করবে না’ ( ইবনু হিশাম ১/৬৪৯)। বর্ণনাটি মু‘যাল বা যঈফ (মা শা-‘আ ১১৭ পৃঃ)। উল্লেখ্য যে, সুহায়েল ও রাসূল (সাঃ)-এর মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা শেষে হোদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তি সম্পন্ন হয়। মক্কা বিজয়ের দিন তিনি ইসলাম কবুল করেন। বলা হয়েছে যে, তিনি ১৮ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
(২) বদর যুদ্ধের কয়েক দিন পরে মক্কার নেতা ছাফওয়ান বিন উমাইয়ার কুপরামর্শে দুষ্টমতি ওমায়ের বিন ওয়াহাব আল-জুমাহী (عُمَيْرُ بن وَهْبٍ الْجُمَحِي) তীব্র বিষ মিশ্রিত তরবারি নিয়ে মদীনায় আগমন করে। তখন তার পুত্র ওয়াহাব বিন ওমায়ের মদীনায় বদর যুদ্ধে বন্দী হিসাবে ছিল। ছাফওয়ান তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, মুহাম্মাদকে হত্যা করতে পারলে সে তার সকল ঋণ পরিশোধ করে দিবে এবং তার সন্তান-সন্ততির ভরণ-পোষণের ব্যয়ভার বহন করবে। অতঃপর সে মদীনায় আসে এবং রাসূল (সাঃ)-কে জাহেলী যুগের রীতি অনুযায়ী انْعَمُوا صَبَاحًا (সুপ্রভাত) বলে অভিবাদন করে। তখন রাসূল (সাঃ) তাকে বলেন, আল্লাহ আমাদেরকে তোমার চাইতে সুন্দর জান্নাতবাসীদের পারস্পরিক অভিবাদন السَّلام (সালাম) দ্বারা সম্মানিত করেছেন। অতঃপর সে তার ছেলের প্রতি সহনুভূতি দেখানোর অনুরোধ জানায়। রাসূল (সাঃ) তাকে বললেন, তোমার কাঁধে তরবারি কেন? জবাবে সে আসল উদ্দেশ্য লুকাতে চাইল। তখন রাসূল (সাঃ) তার নিকট মক্কায় বসে ছাফওয়ান ও তার মধ্যকার গোপন পরামর্শ এবং তাঁকে হত্যা পরিকল্পনার কথা ফাঁস করে দেন। এতে সে হতবাক ও ভীত হয়ে আত্মসমর্পণ করে ও মুসলমান হয়ে যায়। পরে মক্কায় ফিরে গিয়ে তার দাওয়াতে বহু লোক ইসলাম কবুল করে’ (ইবনু হিশাম ১/৬৬১; আল-বিদায়াহ ৩/৩১৩; আর-রাহীক্ব ২৩৫-৩৬ পৃঃ)। ঘটনাটির সনদ ‘মুরসাল’ বা যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৮২৬)।
১ম ঈদুল ফিৎর (أول عيد الفطر)
ইবনু ইসহাক বলেন, রামাযানের শেষে বা শাওয়াল মাসে রাসূল (সাঃ) বদর যুদ্ধ থেকে ফারেগ হন (ইবনু হিশাম ২/৪৩)। অতঃপর এমাসেই অর্থাৎ ২য় হিজরী সনে রামাযানের ছিয়াম ও যাকাতুল ফিৎর ফরয করা হয়। যাতে যাকাতের নিছাবসমূহ বর্ণিত হয় (মির‘আত ৬/৩৯৯, ৩)। এটি আশ্রিত ও দুস্থ মুসলমানদের জন্য আশীর্বাদ হিসাবে দেখা দেয়। অতঃপর এ বছর ১লা শাওয়াল প্রথম ঈদুল ফিৎরের উৎসব পালিত হয়, যা মুসলমানদের নিকটে সত্যিকারের বিজয়োৎসবে পরিণত হয় (আর-রাহীক্ব ২৩১-৩২ পৃঃ)।
কুরআনী বর্ণনা (القرآن فى قصة بدر)
বদর যুদ্ধ বিষয়ে সূরা আনফাল নাযিল হয়। যার মধ্যে ১-৪৯ পর্যন্ত আয়াতগুলি কেবল বদর যুদ্ধ সম্পর্কেই নাযিল হয়েছে। উক্ত সূরার ১ ও ৪১ আয়াতে গণীমত বণ্টনের নীতিমালা বর্ণিত হয়। তাছাড়া সেখানে মুসলমানদের দুর্বলতা এবং আল্লাহর গায়েবী মদদের কথা যেমন বর্ণিত হয়েছে, তেমনি উক্ত যুদ্ধের মহৎ উদ্দেশ্যের কথাও বর্ণিত হয়েছে। যার দ্বারা জাহেলী যুগের যুদ্ধের সাথে এ যুদ্ধের পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায়। সেখানে যুদ্ধবন্দী বিষয়ক নীতি, চুক্তিবদ্ধ গোষ্ঠী ও চুক্তি বহির্ভূত মুমিনদের সাথে ব্যবহার বিধি যেমন বর্ণিত হয়েছে, তেমনি ইসলাম যে কেবল একটি বিশ্বাসের নাম নয়, বরং একটি বাস্তব রীতি-নীতি সমৃদ্ধ সমাজ দর্শনের নাম, সেটাও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। উক্ত সূরায় আল্লাহ মুসলমানদের প্রতি তাঁর বিশেষ অনুগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন,
وَاذْكُرُوْا إِذْ أَنْتُمْ قَلِيْلٌ مُّسْتَضْعَفُوْنَ فِي الأَرْضِ تَخَافُوْنَ أَنْ يَّتَخَطَّفَكُمُ النَّاسُ فَآوَاكُمْ وَأَيَّدَكُمْ بِنَصْرِهِ وَرَزَقَكُم مِّنَ الطَّيِّبَاتِ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ- (الأنفال ২৬)-
‘আর স্মরণ কর যখন তোমরা ছিলে সংখ্যায় অল্প ও পৃথিবীতে তোমরা দুর্বল বলে গণ্য হ’তে। আর তোমরা আশংকা করতে যে, লোকেরা তোমাদের যেকোন সময়ে উঠিয়ে নিয়ে যাবে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের আশ্রয় দেন ও তোমাদেরকে নিজ সাহায্য দ্বারা শক্তিশালী করেন। আর তোমাদেরকে উত্তম বস্ত্ত সমূহ জীবিকারূপে দান করেন, যাতে তোমরা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হও’ (আনফাল ৮/২৬)।
বদর যুদ্ধ পর্যালোচনা (المراجعة فى غزوة بدر)
এই যুদ্ধ পূর্ব পরিকল্পিত ছিল না। বরং আল্লাহর দূরদর্শী পরিকল্পনায় ও বিশেষ ব্যবস্থাপনায় সুনিপূণভাবে সংঘটিত হয় ও বিজয় লাভ হয়। যা পরবর্তী ইসলামী বিজয়ের ভিত্তি হিসাবে পরিগণিত হয়। কারণ ঐদিন মুসলমানরা ছিল নিতান্তই দুর্বল ও কাফেররা ছিল সবল। যেমন আল্লাহ বলেন, وَلَقَدْ نَصَرَكُمُ اللهُ بِبَدْرٍ وَأَنْتُمْ أَذِلَّةٌ فَاتَّقُوا اللهَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ ‘আর আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছিলেন বদরের যুদ্ধে। যেদিন তোমরা দুর্বল ছিলে। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হ’তে পার’ (আলে ইমরান ৩/১২৩)। এমনকি মুসলমানরা যুদ্ধ করবে, না মদীনায় ফিরে যাবে, এ বিষয়েও ছিল পরামর্শ সভায় মতভেদ। পরে আল্লাহর নির্দেশে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয় ও তাঁর বিশেষ অনুগ্রহে এ যুদ্ধে বিজয় লাভ হয়। যেমন আল্লাহ বলেন, إِذْ أَنْتُمْ بِالْعُدْوَةِ الدُّنْيَا وَهُمْ بِالْعُدْوَةِ الْقُصْوَى وَالرَّكْبُ أَسْفَلَ مِنْكُمْ وَلَوْ تَوَاعَدْتُمْ لَاخْتَلَفْتُمْ فِي الْمِيعَادِ وَلَكِنْ لِيَقْضِيَ اللهُ أَمْرًا كَانَ مَفْعُولاً لِيَهْلِكَ مَنْ هَلَكَ عَنْ بَيِّنَةٍ وَيَحْيَى مَنْ حَيَّ عَنْ بَيِّنَةٍ وَإِنَّ اللهَ لَسَمِيعٌ عَلِيمٌ ‘স্মরণ কর, যখন তোমরা (মদীনার) নিকট প্রান্তে ছিলে এবং কাফের বাহিনী ছিল দূরপ্রান্তে। আর (আবু সুফিয়ানের ব্যবসায়ী) কাফেলা ছিল তোমাদের নিম্ন ভূমিতে। যদি তোমরা আগে থেকে যুদ্ধের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চাইতে, তাহ’লে (সংখ্যায় অল্প হওয়ার কারণে) তোমরা সে প্রতিশ্রুতি রক্ষায় মতবিরোধ করতে। কিন্তু আল্লাহ (উভয় দলকে যুদ্ধে সমবেত করার) এমন একটি কাজ সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন, যা নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। এটা এজন্য যাতে যে ধ্বংস হবে সে যেন (ইসলামের) সত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ধ্বংস হয় এবং যে বেঁচে থাকবে, সে যেন সত্য প্রতিষ্ঠার পর বেঁচে থাকে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (আনফাল ৮/৪২)।
উক্ত আয়াতে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, বদরের যুদ্ধ আল্লাহর রাসূল (সাঃ)-এর কোন পরিকল্পিত বিজয়াভিযান ছিল না।
জানা আবশ্যক যে, আল্লাহর রাসূল (সাঃ)-এর জীবনে প্রায় সকল যুদ্ধই ছিল আত্মরক্ষামূলক কিংবা প্রতিরোধমূলক। কাফির-মুশরিক ও মুনাফিকদের অবিরাম ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ও হামলা মুকাবিলা করতে গিয়েই তাঁকে যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়েছিল।
বদর যুদ্ধের গুরুত্ব (أهمية غزوة بدر)
(১) এটাই ছিল মুসলমানদের সাথে মুশরিকদের সর্বপ্রথম ব্যাপকভিত্তিক সশস্ত্র সংঘর্ষ। (২) এটি ছিল ইসলামের টিকে থাকা না থাকার ফায়ছালাকারী যুদ্ধ (৩) এটি ছিল হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী। সেকারণ এ যুদ্ধের দিনটিকে পবিত্র কুরআনে ‘ইয়াওমুল ফুরক্বান’ (يَوْمُ الْفُرْقَانِ) বা কুফর ও ইসলামের মধ্যে ‘ফায়ছালাকারী দিন’ (আনফাল ৮/৪১) বলে অভিহিত করা হয়েছে। (৪) বদরের এ দিনটিকে আল্লাহ স্মরণীয় হিসাবে উল্লেখ করে বলেন, وَلَقَدْ نَصَرَكُمُ اللهُ بِبَدْرٍ وَأَنْتُمْ أَذِلَّةٌ فَاتَّقُوْا اللهَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছেন বদরের যুদ্ধে। অথচ তোমরা ছিলে দুর্বল। অতএব আল্লাহকে ভয় কর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হ’তে পার’ (আলে ইমরান ৩/১২৩)। উল্লেখ্য যে, ‘বদর’ নামটি কুরআনে মাত্র একটি স্থানেই উল্লেখিত হয়েছে।
(৫) এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সম্পর্কে হাদীছে অত্যন্ত উচ্চ মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে। এমনকি মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে গোপন কথা ফাঁস করে মক্কায় প্রেরিত হাতেব বিন আবু বালতা‘আহ-এর পত্র ধরা পড়ার পর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে খেয়ানত করার অপরাধে ওমর (রাঃ) তাকে হত্যা করার অনুমতি চাইলে রাসূল (সাঃ) বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সম্পর্কে বলেছেন, اعْمَلُوا مَا شِئْتُمْ فَقَدْ وَجَبَتْ لَكُمُ الْجَنَّةُ ‘তোমরা যা খুশী কর। তোমাদের জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে গেছে’। এ কথা শুনে ওমর (রাঃ) কাঁদতে থাকেন’ (বুখারী হা/৬২৫৯)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না’ বলে জনৈক ব্যক্তি মন্তব্য করলে তার উদ্দেশ্যে রাসূল (সাঃ) বলেন, كَذَبْتَ لاَ يَدْخُلُهَا فَإِنَّهُ شَهِدَ بَدْرًا وَالْحُدَيْبِيَةَ ‘তুমি মিথ্যা বললে। সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। কেননা সে বদরে ও হুদায়বিয়াতে অংশগ্রহণ করেছে’।[1] অন্য বর্ণনায় এসেছে, لَنْ يَدْخُلَ النَّارَ رَجُلٌ شَهِدَ بَدْراً وَالْحُدَيْبِيَةَ ‘কখনোই জাহান্নামে প্রবেশ করবে না ঐ ব্যক্তি যে বদরে ও হুদায়বিয়াতে অংশগ্রহণ করেছে’।[2]
[1]. মুসলিম হা/২৪৯৫; মিশকাত হা/৬২৪৩।
[2]. আহমাদ হা/১৫২৯৭; ছহীহাহ হা/২১৬০।
ফলাফল (ثمرة غزوة بدر)
(১) বদরের যুদ্ধ ছিল কাফেরদের মূল কর্তনকারী ও সত্যকে প্রতিষ্ঠা দানকারী।
এ যুদ্ধের পরে কাফের সমাজে এমন আতংক প্রবেশ করে যে, তারা আর কখনো বিজয়ের মুখ দেখেনি। যেমন আল্লাহ বলেন, وَإِذْ يَعِدُكُمُ اللهُ إِحْدَى الطَّائِفَتِيْنِ أَنَّهَا لَكُمْ وَتَوَدُّوْنَ أَنَّ غَيْرَ ذَاتِ الشَّوْكَةِ تَكُوْنُ لَكُمْ وَيُرِيْدُ اللهُ أَنْ يُّحِقَّ الحَقَّ بِكَلِمَاتِهِ وَيَقْطَعَ دَابِرَ الْكَافِرِيْنَ- لِيُحِقَّ الْحَقَّ وَيُبْطِلَ الْبَاطِلَ وَلَوْ كَرِهَ الْمُجْرِمُوْنَ ‘আর যখন আল্লাহ দু’টি দলের একটির ব্যাপারে তোমাদের সাথে ওয়াদা করেছিলেন যে, সেটি তোমাদের হস্তগত হবে আর তোমরা কামনা করছিলে যাতে কোনরূপ কণ্টক ছাড়াই সেটা তোমাদের হাতে আসে। অথচ আল্লাহ চাইতেন সত্যকে স্বীয় সাহায্যের মাধ্যমে সত্যে পরিণত করতে এবং কাফেরদের মূল কর্তন করে দিতে’। ‘যাতে করে তিনি সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে দেন, যদিও পাপীরা তাতে নাখোশ হয়’ (আনফাল ৮/৭-৮)।
(২) এ যুদ্ধে বিজয়ের ফলে মুসলমানদের শক্তি ও সাহস বৃদ্ধি পায়। দলে দলে লোকেরা ইসলামে প্রবেশ করতে থাকে। এমনকি মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই খাযরাজী ও তার সাথীরা প্রকাশ্যে ইসলাম কবুলে বাধ্য হয় এবং শত্রুরা ভীত হয়ে চুপসে যায়।
(৩) বদরের যুদ্ধে বিজয় ছিল মক্কা বিজয়ের সোপান স্বরূপ। এর কিছু দিন পূর্বে শা‘বান মাস থেকে কা‘বার দিকে কিবলা পরিবর্তিত হয় এবং বদর যুদ্ধের মাত্র ছয় বছর পরেই ৮ম হিজরীর ১৭ই রামাযান তারিখে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে যা পূর্ণতা লাভ করে।
(৪) যুদ্ধটি ছিল অভাবনীয়। কেননা বদর যুদ্ধ পূর্ব পরিকল্পিত ছিল না (আনফাল ৮/৪২)। তেমনি বিজয়টিও ছিল অভাবনীয়। যা স্রেফ আল্লাহর বিশেষ রহমতে সাধিত হয়। যুগে যুগে ইসলামী বিজয় এভাবেই হয়ে থাকে।
(৫) বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর অভূতপূর্ব বিজয়ে ৪টি পক্ষ দারুণভাবে ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হয়। মক্কার কুরায়েশরা, মদীনার ইহূদী ও মুনাফিকরা এবং মদীনার আশপাশের নাজদ প্রভৃতি এলাকার বেদুঈনরা। যারা ছিল স্রেফ দস্যুশ্রেণীর লোক। ঈমান ও কুফর কোনটির প্রতি তাদের কোন আকর্ষণ ছিল না। উপরোক্ত চারটি শ্রেণীর প্রত্যেকেই নিশ্চিত ছিল যে, মদীনায় ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হ’লে তা অবশ্যই তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে। সেকারণ তারা সাধ্যমত সকল উপায়ে মদীনায় একটি স্থিতিশীল ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করতে থাকে।
(৬) এ যুদ্ধের ফলে ইহূদী গোত্রগুলির মধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধিশালী গোত্র বনু ক্বাইনুক্বা‘ ভীষণভাবে ভীত ও ক্রুদ্ধ হয়। তাদের ষড়যন্ত্র তুঙ্গে উঠে। ফলে মদীনা থেকে তাদের বহিষ্কার অবশ্যম্ভাবী হয়। বদর যুদ্ধের পরেই ২য় হিজরীর শাওয়াল মাসে যা কার্যকর হয়।
শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ -২১ (العبر -২১)
(১) মক্কায় সামাজিক পরিবেশ প্রতিকূলে থাকায় সেখানে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হয়নি। পক্ষান্তরে মদীনায় পরিবেশ অনুকূলে থাকায় এবং এখানে সবাই রাসূল (সাঃ)-এর নেতৃত্ব মেনে নিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়ায় রাসূল (সাঃ)-কে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হয়। এতে বুঝা যায় যে, বিজয়ের সম্ভাবনা ও পরিবেশ না থাকলে যুদ্ধের ঝুঁকি না নিয়ে ছবর করতে হবে। যেমনটি মাক্কী জীবনে করা হয়েছিল।
(২) বদরের যুদ্ধ ছিল মূলতঃ আত্মরক্ষামূলক। আবূ জাহলকে বদরে মুকাবিলা না করলে সে সরাসরি মদীনায় হামলা করার দুঃসাহস দেখাত। যা ইতিপূর্বে তাদের একজন নেতা কুরয বিন জাবের আল-ফিহরী সরাসরি মদীনার উপকণ্ঠে হামলা করে গবাদিপশু লুট করে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে জানিয়ে গিয়েছিল। এতে বুঝা যায় যে, আত্মরক্ষা এবং ইসলামের স্বার্থ ব্যতীত অন্য কোন কারণে কাফেরদের সাথে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি নেই।
(৩) সংখ্যা ও যুদ্ধ সরঞ্জামের আধিক্য বিজয়ের মাপকাঠি নয়। বরং দৃঢ় ঈমান ও আল্লাহর উপরে একান্ত নির্ভরশীলতাই হ’ল বিজয়ের মূল হাতিয়ার। পরামর্শ সভায় কয়েকজন ছাহাবী বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে যুদ্ধ না করে ফিরে যাবার পরামর্শ দিলে আল্লাহ ধমক দিয়ে আয়াত নাযিল করেন (আনফাল ৮/৫-৬)। এতে বুঝা যায়, আল্লাহর গায়েবী মদদ লাভই হ’ল বড় বিষয়।
(৪) যুদ্ধের উদ্দেশ্য হ’তে হবে জান্নাত লাভ। যেটা যুদ্ধ শুরুর প্রথম নির্দেশেই আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ছাহাবীগণের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন। অতএব চিন্তাক্ষেত্রের যুদ্ধ হৌক বা ময়দানের সশস্ত্র মুকাবিলা হৌক ইসলামের সৈনিকদের একমাত্র লক্ষ্য থাকতে হবে আখেরাত। কোন অবস্থাতেই দুনিয়া হাছিলের জন্য মুসলমানের চিন্তাশক্তি বা অস্ত্রশক্তি ব্যয়িত হবে না।
(৫) স্রেফ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যুদ্ধে নামলে আল্লাহ স্বীয় ফেরেশতামন্ডলী পাঠিয়ে সাহায্য করে থাকেন। যেমন বদর যুদ্ধে করা হয়েছিল (আনফাল ৮/৯)।
(৬) যুদ্ধে গণীমত লাভের মাধ্যমে দুনিয়া অর্জিত হ’লেও তা কখনোই মুখ্য হবে না। বরং সর্বাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী আমীরের অনুগত থাকতে হবে। বদর যুদ্ধে গণীমত বণ্টন নিয়ে বিবাদ উপস্থিত হ’লেও তা সাথে সাথে নিষ্পত্তি হয়ে যায় রাসূল (সাঃ)-এর নির্দেশে (আনফাল ৮/১)।
(৭) কাফিররা মূলতঃ মুসলমানদের ঈমানী শক্তিকে ভয় পায়। এ কারণেই পরবর্তী ওহোদের যুদ্ধে তারা মহিলাদের সাথে করে এনেছিল। যাতে পুরুষেরা যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালিয়ে না যায়।
(৮) বদর যুদ্ধের বড় শিক্ষা এই যে, কুফর ও ইসলামের মুকাবিলায় মুসলমান নিজের সীমিত শক্তি নিয়ে আল্লাহর উপরে ভরসা করে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর এভাবেই চিরকাল ঈমানদার সংখ্যালঘু শক্তি বেঈমান সংখ্যাগুরু শক্তির উপরে বিজয়ী হয়ে থাকে (বাক্বারাহ ২/২৪৯)। এ ধারা ক্বিয়ামত পর্যন্ত জারী থাকবে ইনশাআল্লাহ।
বদর পরবর্তী অভিযানসমূহ (السرايا والغزوات بعد بدر)
১০. সারিইয়া ওমায়ের বিন ‘আদী আল-খিত্বমী (سرية عمير بن عدي الخطمي) : ২য় হিজরীর ২৫শে রামাযান। একাকী স্বীয় সম্পর্কিত বোন ‘আছমা (عَصْمَاء) বিনতে মারোয়ান খিত্বমিয়াকে হত্যা করেন। কেননা মহিলাটি সর্বদা তার গোত্রকে রাসূল (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্ররোচনা দিত। সে ইসলাম ও ইসলামের নবী (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে কুৎসা গেয়ে কবিতা বলত। ওমায়ের ছিলেন তার গোত্রের প্রধান এবং সর্বপ্রথম ইসলাম কবুলকারী। তার পিতা ‘আদী বিন খারশাহ ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ কবি। ওমায়ের অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও রাত্রির অন্ধকারে একাকী ঐ মহিলার বাড়ীতে গিয়ে তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় এক আঘাতে শেষ করে দেন। ফিরে এসে ফজরের ছালাত শেষে তিনি রাসূল (সাঃ)-কে উক্ত খবর দেন। তিনি তার জন্য দো‘আ করেন ও ‘আল-বাছীর’ বলে আখ্যায়িত করেন। এরপর থেকে ওমায়ের ‘আয-যারীর’-এর বদলে ‘আল-বাছীর’ নামে প্রসিদ্ধ হন। আয-যারীর (الضرير) অর্থ অন্ধ এবং আল-বাছীর (البصير) অর্থ দৃষ্টি সম্পন্ন।[1]
১১. সারিইয়া সালেম বিন ওমায়ের আনছারী (سرية سالم بن عمير) : ২য় হিজরীর শাওয়াল মাস। তিনি একাকী ১২০ বছরের বৃদ্ধ ইহূদী কবি আবু ‘আফাক(أبو عَفَك)-কে হত্যা করেন। কারণ সে সর্বদা ইহূদীদেরকে রাসূল (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে কবিতার মাধ্যমে যুদ্ধের উস্কানী দিত। সালেম বিন ওমায়ের (রাঃ) তাকে হত্যা করার মানত করেন। তিনি বদর, ওহোদ ও খন্দকসহ রাসূল (সাঃ)-এর সাথে সকল যুদ্ধে শরীক ছিলেন। এছাড়া তাবূক যুদ্ধে যানবাহনের অভাবে যেতে না পারায় ‘ক্রন্দনকারীদের’ (وَهُوَ أحدُ الْبَكَّاءِين) অন্যতম ছিলেন। মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর খেলাফতকালে মৃত্যুবরণ করেন।[2]
১২. গাযওয়া বনু সুলায়েম(غزوة بني سليم) : ২য় হিজরীর শাওয়াল মাস। বদর যুদ্ধ হ’তে প্রত্যাবর্তনের মাত্র সাতদিন পরে এটি সংঘটিত হয়। বনু গাত্বফান গোত্রের শাখা বনু সুলায়েম মদীনায় হামলার প্রস্ত্ততি নিচ্ছে জানতে পেরে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) স্বয়ং ২০০ উষ্ট্রারোহীকে নিয়ে মক্কা ও সিরিয়ার বাণিজ্যপথে ‘কুদ্র’ (الْكُدْرُ) নামক ঝর্ণাধারার নিকটে পৌঁছে তাদের উপরে আকস্মিক হামলা চালান। তারা হতবুদ্ধি হয়ে ৫০০ উট রেখে পালিয়ে যায়। ইয়াসার (يسار) নামে একটি গোলাম আটক হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে মুক্ত করে দেন। অতঃপর তিনি সেখানে তিনদিন অবস্থান করে মদীনায় ফিরে আসেন। এই সময় মদীনার দায়িত্বে ছিলেন সিবা‘ বিন উরফুত্বাহ আল-গিফারী অথবা আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূম (রাঃ)।[3]
১৩. সারিইয়া গালিব বিন আব্দুল্লাহ লায়ছী(سرية غالب بن عبد الله الليثي) : ২য় হিজরীর শাওয়াল মাসে আগ্রাসী বনু সুলায়েম বাহিনীকে তাড়িয়ে দিয়ে সেখানে তিন দিন অবস্থান শেষে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনায় ফিরে আসেন। পরে শত্রুরা পুনরায় সংগঠিত হয়েছিল। তখন তাদের বিরুদ্ধে এই অভিযান প্রেরিত হয়। যাতে শত্রুপক্ষের কয়েকজন এবং মুসলিম পক্ষের তিন জন মারা যায়।[4]
১৪. গাযওয়া বনু ক্বায়নুক্বা(غزوة بني قينقاع) : ২য় হিজরীর ১৫ই শাওয়াল শনিবার থেকে ১৫ দিন অবরোধ করে রাখার পর এই বিশ্বাসঘাতক ও সমৃদ্ধিশালী ইহূদী গোত্রটি ১লা যিলক্বা‘দ আত্মসমর্পণ করে। এরা ছিল খাযরাজ গোত্রের মিত্র। ফলে মাত্র একমাস পূর্বে ইসলাম কবুলকারী খাযরাজ গোত্রভুক্ত মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের একান্ত অনুরোধে ও পীড়াপীড়িতে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাদের প্রাণদন্ড মওকুফ করে মদীনা থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ দেন। এদের মধ্যে ৭০০ জন ছিল সশস্ত্র যোদ্ধা এবং মদীনার সেরা ইহূদী বীর। এরা সবকিছু ফেলে সিরিয়ার দিকে চলে যায় এবং অল্পদিনের মধ্যেই তাদের অধিকাংশ সেখানে মৃত্যুবরণ করে। মানছূরপুরী বলেন, তারা খায়বরে যেয়ে বসতি স্থাপন করে।[5]
১৫. গাযওয়া সাভীক্ব(غزوة سويق) : ২য় হিজরীর ৫ই যিলহাজ্জ রবিবার। বদর যুদ্ধে লজ্জাকর পরাজয়ে কুরায়েশ নেতা আবু সুফিয়ান শপথ করেছিলেন যে, মুহাম্মাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে এর প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত তার মস্তক নাপাকীর গোসলের পানি স্পর্শ করবে না। সেই প্রতিজ্ঞা পূরণের জন্য তিনি ২০০ উষ্ট্রারোহী নিয়ে রাতের বেলায় গোপনে মদীনায় এসে ইহূদী গোত্র বনু নাযীর নেতা ও তাদের কোষাধ্যক্ষ সাল্লাম বিন মিশকামের সঙ্গে শলা পরামর্শ শেষে রাতেই মক্কায় রওয়ানা হয়ে যান। কিন্তু যাওয়ার আগে একটি দল পাঠিয়ে দেন। যারা মদীনার উপকণ্ঠে ‘উরাইয’ (العُرَيض) নামক স্থানে একটি খেজুর বাগান জ্বালিয়ে দেয় এবং সেখানে দায়িত্বরত একজন আনছার ও তার এক মিত্রকে হত্যা করে ফিরে যায়।
এখবর জানতে পেরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দ্রুত গতিতে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করেন। আবু সুফিয়ান ভয়ে এত দ্রুত পলায়ন করেন যে, বোঝা হালকা করার জন্য তাদের বহু রসদ সম্ভার এবং ছাতুর বস্তা রাস্তার পাশে ফেলে দেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ক্বারক্বারাতুল কুদর(قَرْقَرَةُ الْكُدْر) পর্যন্ত ধাওয়া করে ফিরবার পথে তাদের ফেলে যাওয়া পাথেয় ও ছাতুর বস্তাগুলো নিয়ে আসেন। ছাতুকে আরবীতে ‘সাভীক্ব’ (السَّوِيق) বলা হয়। সেজন্য এই অভিযানটি ‘গাযওয়া সাভীক্ব’ বা ছাতুর যুদ্ধ নামে পরিচিত হয়েছে। এ সময় মদীনার দায়িত্বে ছিলেন আবু লুবাবাহ বাশীর বিন মুনযির (রাঃ)।[6]
১৬. গাযওয়া যী আমর(غزوة ذي أمر) : ৩য় হিজরীর ছফর মাস। উদ্দেশ্য নাজদের বনু গাত্বফান গোত্র। তাদের বনু ছা‘লাবাহ ও বনু মুহারিব গোত্রদ্বয় বিরাট এক বাহিনী নিয়ে মদীনা আক্রমন করবে মর্মে খবর পেয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাড়ে চারশ’ সৈন্য নিয়ে মুহাররম মাসেই তাদের মুকাবিলায় বের হন। পথিমধ্যে বনু ছা‘লাবাহ গোত্রের জাববার (جَبَّار) নামক জনৈক ব্যক্তি গ্রেফতার হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলে সে মুসলমান হয়ে যায় এবং মুসলিম বাহিনীর পথপ্রদর্শক হিসাবে কাজ করে। শত্রুপক্ষ পালিয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের ঘাঁটি এলাকায় পৌঁছে যী আমর(ذي أمر) নামক ঝর্ণাধারার পাশে অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি সেখানে পুরা ছফর মাস বা তার কাছাকাছি সময় অতিবাহিত করেন। যাতে মুসলিম শক্তির প্রভাব ও প্রতিপত্তি শত্রুদের অন্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এ সময় মদীনার দায়িত্বে ছিলেন হযরত ওছমান বিন ‘আফফান (রাঃ)।[7]
১৭. সারিইয়া মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ(سرية محمد بن مسلمة فى قتل كعب بن الأشرف) (কা‘ব বিন আশরাফের হত্যাকান্ড); হিজরতের ২৫ মাস পরে ৩য় হিজরীর ১৪ই রবীউল আউয়াল) :
মদীনার নামকরা ইহূদী পুঁজিপতি ও কবি কা‘ব বিন আশরাফ সর্বদা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইহূদীদেরকে যুদ্ধে প্ররোচনা দিত। তার পিতা ছিল বনু ত্বাঈ গোত্রের এবং মা ছিল মদীনার ইহূদী বনু নাযীর গোত্রের। বদর যুদ্ধে পরাজয়ের পর সে মক্কায় গিয়ে কুরায়েশ নেতাদের পুনরায় যুদ্ধে উস্কে দেয়। তারপর মদীনায় ফিরে এসে ছাহাবায়ে কেরামের স্ত্রীদের নামে কুৎসা গেয়ে কবিতা বলতে থাকে। তাতে অতিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাকে হত্যার নির্দেশ দেন। সেমতে আউস গোত্রের মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহর নেতৃত্বে পাঁচজনের একটি দল ১৪ই রবীউল আউয়াল চাঁদনী রাতে তার বাড়ীতে গিয়ে তাকে হত্যা করে।[8] এই ঘটনার পর ইহূদীরা সম্পূর্ণরূপে হিম্মত হারিয়ে ফেলে এবং রাসূল (সাঃ)-এর সাথে সন্ধিচুক্তি করে (আবুদাঊদ হা/৩০০০)। এর ফলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আভ্যন্তরীণ গোলযোগের আশংকা হ’তে মুক্ত হন এবং বহিরাক্রমণ মুকাবিলার দিকে পূর্ণ মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ পান। বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরূপ।-
কা‘ব বিন আশরাফ ছিল একজন খ্যাতনামা ইহূদী পুঁজিপতি, কবি ও চরম মুসলিম বিদ্বেষী। তার দুর্গটি ছিল মদীনার পূর্ব-দক্ষিণে দু’মাইল দূরে বনু নাযীর গোত্রের পশ্চাদভূমিতে। বদর যুদ্ধে কুরায়েশ নেতাদের চরম পরাজয়ে সে রাগে-দুঃখে ফেটে পড়ে। অতঃপর রাসূল (সাঃ) ও মুসলমানদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে ও কুরায়েশ নেতাদের প্রশংসা করে সে কবিতা বলতে থাকে। কিন্তু তাতে তার ক্ষোভের আগুন প্রশমিত না হওয়ায় সে মক্কায় চলে যায় এবং কুরায়েশ নেতাদের কবিতার মাধ্যমে উত্তেজিত করতে থাকে। সে যুগে কবিতাই ছিল সাহিত্যের বাহন এবং কারু প্রশংসা বা ব্যঙ্গ করার প্রধান হাতিয়ার। কোন বংশে কোন কবি জন্মগ্রহণ করলে সে বংশ তাকে নিয়ে গর্ব করত এবং তাকে সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করা হ’ত। আবু সুফিয়ান এবং মক্কার নেতারা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, أَدِينُنَا أَحَبُّ إِلَى اللهِ أَمْ دِينُ مُحَمَّدٍ وَأَصْحَابِهِ وأَيُّ الْفَرِيقَينِ أَهْدَى سَبيلاً؟ ‘আমাদের দ্বীন আল্লাহর নিকটে অধিক প্রিয় না মুহাম্মাদ ও তার সাথীদের দ্বীন? আর এ দু’টি দলের মধ্যে কোন দলটি অধিক সুপথপ্রাপ্ত? সে বলল, أَنْتُمْ أَهْدَى مِنْهُمْ سَبِيلاً ‘তোমরাই তাদের চাইতে অধিক সুপথপ্রাপ্ত’।[9]
উক্ত প্রসঙ্গে সূরা নিসা ৫১-৫২ আয়াত দু’টি নাযিল হয়। যেখানে বলা হয়,أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ أُوتُوا نَصِيبًا مِنَ الْكِتَابِ يُؤْمِنُونَ بِالْجِبْتِ وَالطَّاغُوتِ وَيَقُولُونَ لِلَّذِينَ كَفَرُوا هَؤُلاَءِ أَهْدَى مِنَ الَّذِينَ آمَنُوا سَبِيلاً- أُولَئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللهُ وَمَنْ يَلْعَنِ اللهُ فَلَنْ تَجِدَ لَهُ نَصِيرًا ‘তুমি কি তাদের (ইহূদীদের) দেখোনি, যাদেরকে ইলাহী কিতাবের কিছু অংশ দেওয়া হয়েছে। যারা প্রতিমা ও শয়তানের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং (মক্কার) কাফিরদের বলে যে, তারাই মুমিনদের চাইতে অধিক সুপথপ্রাপ্ত’। ‘এদের প্রতি আল্লাহ অভিসম্পাৎ করেছেন। আর আল্লাহ যাকে অভিসম্পাৎ করেন, তুমি তার জন্য কোন সাহায্যকারী পাবে না’ (ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা নিসা ৫১-৫২ আয়াত)।
এরপর সে মদীনায় ফিরে এসে একই রূপ আচরণ করতে থাকে। এমনকি ছাহাবায়ে কেরামের স্ত্রীদের নামে কুৎসা রটনা করতে থাকে ও নানাবিধ ব্যঙ্গাত্মক কবিতা বলতে থাকে। এতে অতিষ্ঠ হয়ে একদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, مَنْ لِكَعْبِ بْنِ الأَشْرَفِ فَإِنَّهُ قَدْ آذَى اللهَ وَرَسُولَهُ‘কা‘ব বিন আশরাফকে হত্যা করার জন্য কে আছ? কেননা সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দিয়েছে’। তখন আউস গোত্রের মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ বললেন, يَا رَسُولَ اللهِ أَتُحِبُّ أَنْ أَقْتُلَهُ ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি চান আমি তাকে হত্যা করি? রাসূল (সাঃ) বললেন, হ্যাঁ। তখন মুহাম্মাদ বললেন, আমাকে কিছু উল্টা-পাল্টা কথা বলার অনুমতি দিন’। রাসূল (সাঃ) তাকে অনুমতি দিলেন। অতঃপর তার নেতৃত্বে ‘আববাদ বিন বিশর ও কা‘ব বিন আশরাফের দুধভাই আবু নায়েলাহ সহ পাঁচ জন প্রস্ত্তত হয়ে গেলেন। সে মোতাবেক প্রথমে মুহাম্মাদ ও পরে আবু নায়েলাহ কা‘বের কাছে গিয়ে রাসূল (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে অনেক কথার মধ্যে একথাও বলেন যে, এ ব্যক্তি আমাদের কাছে ছাদাক্বা চাচ্ছে। এ লোক আমাদেরকে দারুণ কষ্টের মধ্যে ফেলেছে। অতএব আমরা আমাদের পরিবার-পরিজনের কষ্ট নিবারণের জন্য আপনার নিকটে কিছু খাদ্য-শস্য কামনা করছি। কা‘ব কিছু বন্ধকের বিনিময়ে দিতে রাযী হ’ল। প্রথমে নারী বন্ধক, অতঃপর পুত্র বন্ধক, অবশেষে অস্ত্র বন্ধকের ব্যাপারে নিষ্পত্তি হ’ল। আবু নায়েলাহ বলল, আমারই মত কষ্টে আমার কয়েকজন বন্ধু আছে। আমি তাদেরকেও আপনার কাছে নিয়ে আসব। আপনি তাদেরও কিছু খাদ্য-শস্য দিয়ে অনুগ্রহ করুন। অতঃপর পূর্ব সিদ্ধান্ত মতে (৩য় হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসের ১৪ তারিখের) চাঁদনী রাতে মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ তার দলবল নিয়ে কা‘বের বাড়ীতে গেলেন (বুখারী হা/৪০৩৭, জাবের (রাঃ) হ’তে)। কা‘ব বিন মালেক (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (সাঃ) আউস নেতা সা‘দ বিন মু‘আযকে তার বিরুদ্ধে একদল লোক পাঠাতে বললেন, যেন তারা তাকে হত্যা করে। তখন তিনি মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহকে পাঠালেন (আবুদাউদ হা/৩০০০)। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদেরকে বাকী‘ গারক্বাদ পর্যন্ত এগিয়ে দেন এবং বলেন,انْطَلِقُوا عَلَى اسْمِ اللهِ وَقَالَ: اللهُمَّ أَعِنْهُمْ ‘তোমরা আল্লাহর নামে অগ্রসর হও। হে আল্লাহ তুমি এদের সাহায্য কর’ (আহমাদ হা/২৩৯১)।
দুধভাই আবু নায়েলাহ কা‘বের দুর্গদ্বারে দাঁড়িয়ে ডাক দিল। এ সময় কা‘বের নববধূ তাকে বাধা দিয়ে বলল, أَسْمَعُ صَوْتًا كَأَنَّهُ يَقْطُرُ مِنْهُ الدَّمُ ‘আমি এমন এক ডাক শুনলাম, মনে হ’ল তা থেকে রক্তের ফোঁটা ঝরছে’। কিন্তু কা‘ব কোনরূপ সন্দেহ না করে বলল, এরা তো আমার ভাই। তাছাড়াإِنَّ الْكَرِيمَ لَوْ دُعِىَ إِلَى طَعْنَةٍ بِلَيْلٍ لأَجَابَ ‘সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি রাত্রিতে যদি তরবারির দিকেও আহুত হন, তথাপি তিনি তাতে সাড়া দিয়ে থাকেন’।
মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ অপর দু’জনকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন এবং তাদেরকে বলেছিলেন, যখন সে আসবে তখন আমি তার মাথার চুল ধরে শুঁকতে থাকব। যখন তোমরা আমাকে দেখবে যে, খুব শক্তভাবে আমি তার মাথা অাঁকড়িয়ে ধরেছি, তখন তোমরা তরবারি দিয়ে তাকে আঘাত করবে।
অতঃপর কা‘ব চাদর গায়ে দিয়ে নীচে নেমে আসলে তার শরীর থেকে সুঘ্রাণ বের হচ্ছিল। তখন মুহাম্মাদ বললেন, আজকের মতো এত উত্তম সুগন্ধি আমি আর কখনো দেখিনি। উত্তরে কা‘ব বলল, আমার নিকট আরবের সম্ভ্রান্ত ও মর্যাদাসম্পন্ন সুগন্ধি ব্যবহারকারী মহিলা আছে। তখন মুহাম্মাদ বললেন, আমাকে আপনার মাথা শুঁকতে অনুমতি দিবেন কি? সে বলল, হ্যাঁ। এরপর তিনি তার মাথা শুঁকলেন এবং এরপর তার সাথীদেরকে শুঁকালেন। তারপর তিনি আবার বললেন, ‘আমাকে আর একবার শুঁকবার অনুমতি দিবেন কি? সে বলল, হ্যাঁ। এরপর তিনি তাকে কাবু করে ফেলে সাথীদেরকে বললেন, তোমরা একে হত্যা করো। তারা তাকে হত্যা করলেন এবং রাসূল (সাঃ)-কে খবর দিলেন’।[10] অন্য বর্ণনায় এসেছে, এ সময় রাসূল (সাঃ) তাদেরকে দো‘আ করে বলেন, أفلَحَتِ الوجوهُ ‘তোমাদের চেহারাগুলি সফল থাকুক’ (হাকেম হা/৫৮৪০, সনদ ছহীহ)।
কা‘ব বিন আশরাফকে গোপনে হত্যা করায় প্রমাণিত হয় যে, ইসলামের স্বার্থে এরূপ দুশমনকে গুপ্তহত্যা করা চলে। দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনাকারী ও অপপ্রচারকারীর শাস্তি মৃত্যুদন্ড (তাওবাহ ৯/৬৫-৬৬)। মুসলিম মহিলাদের ইয্যত নিয়ে কুৎসা রটনাকারীদের জন্য একই শাস্তি নির্ধারিত। এই ধরনের দুশমন নির্মূল করার জন্য প্রয়োজন বোধে যেকোন কৌশলের আশ্রয় নেয়া যাবে। তবে এর জন্য সর্বোচ্চ সরকারী নির্দেশ আবশ্যিক হবে। এককভাবে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের জন্য এরূপ করা সিদ্ধ নয়। কেননা এখানে রাসূল (সাঃ) ছিলেন সর্বোচ্চ নির্দেশদাতা।
[1]. ওয়াক্বেদী, মাগাযী ১/২-৩; ইবনু সা‘দ ২/২০-২১; আল-ইছাবাহ, উমায়ের ক্রমিক ৬০৪৭; আল-ইস্তী‘আব; মানছূরপুরী এটা ধরেছেন। মুবারকপুরী ধরেননি।
[2]. ওয়াক্বেদী, মাগাযী ১/৩; ইবনু সা‘দ ২/২১; আল-ইছাবাহ, সালেম ক্রমিক ৩০৪৮; রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/১৮৭। মুবারকপুরী এটা ধরেননি।
ইবনু হিশাম এখানে সারিইয়া সালেম বিন ওমায়েরকে আগে এনেছেন। তিনি বলেন, হারেছ বিন সুওয়াইদ বিন ছামেতকে হত্যা করার পর আবু ‘আফাক-এর মুনাফেকী স্পষ্ট হয়ে যায় এবং সে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা গেয়ে কবিতা বলে। তখন রাসূল (সাঃ) তাকে হত্যার আদেশ দেন (ইবনু হিশাম ২/৬৩৫-৩৬)। অতঃপর আবু ‘আফাক-এর হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ‘আছমা বিনতে মারওয়ান আল-খিত্বমিয়াহ মুনাফিক হয়ে যান এবং ইসলাম ও ইসলামের নবী (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে কুৎসা গেয়ে কবিতা বলেন। তখন রাসূল (সাঃ)-এর নির্দেশে ওমায়ের বিন ‘আদী তাকে হত্যা করেন (ইবনু হিশাম ২/৬৩৬-৩৭)।
[3]. ইবনু হিশাম ২/৪৩; আল-বিদায়াহ ৩/৩৪৪; যাদুল মা‘আদ ৩/১৬৯; আর-রাহীক্ব ২৩৪ পৃঃ।
[4]. রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/১৮৮। এটি অন্য কেউ ধরেননি।
[5]. যাদুল মা‘আদ ৩/১৭০; ইবনু হিশাম ২/৪৭-৪৯; ইবনু সা‘দ ২/২১-২২; আর-রাহীক্ব ২৩৬ পৃঃ; রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/১৩০, ২/১৮৭।
(১) প্রসিদ্ধ আছে যে, বনু ক্বায়নুক্বার শাস বিন ক্বায়েস (شَاسُ بْنُ قَيْسٍ) নামক জনৈক বৃদ্ধ ইহূদী মুসলমানদের প্রতি চরম বিদ্বেষ পোষণ করত। একদিন সে ছাহাবায়ে কেরামের একটি মজলিসের নিকট দিয়ে যাচ্ছিল, যেখানে আউস ও খাযরাজ উভয় গোত্রের ছাহাবী ছিলেন। দুই গোত্রের লোকদের মধ্যকার এই প্রীতিপূর্ণ বৈঠক তার নিকটে অসহ্য ছিল। কেননা উভয় গোত্রের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা টিকিয়ে রেখে উভয় গোত্রের নিকটে অস্ত্র বিক্রি ও সূদ ভিত্তিক ঋণদান ব্যবসা চালিয়ে আসছিল তারা দীর্ঘদিন ধরে। ইসলাম আসার পর এসব বন্ধ হয়েছে এবং তারা পুনরায় ভাই ভাই হয়ে গেছে। যাতে দারুণ আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়ে যায় মদীনার কুসিদজীবী ইহূদী গোত্রগুলি।
ঐ বৃদ্ধ একজন যুবক ইহূদীকে উক্ত মজলিসে পাঠাল এই নির্দেশ দিয়ে যে, সে যেন সেখানে গিয়ে উভয় গোত্রের মধ্যে পাঁচ বছর পূর্বে সংঘটিত বু‘আছ (بعاث) যুদ্ধ ও তার পূর্ববর্তী অবস্থা আলোচনা করে এবং ঐ সময়ে উভয় পক্ষ হ’তে যেসব বিদ্বেষমূলক ও আক্রমণাত্মক কবিতা সমূহ পঠিত হ’ত, তা থেকে কিছু কিছু পাঠ করে শুনিয়ে দেয়। যুবকটি যথারীতি তাই-ই করল এবং উভয় গোত্রের মুসলমানদের মধ্যে লড়াইয়ের অবস্থা তৈরী হয়ে গেল। এমনকি উভয় পক্ষ ‘হার্রাহ’ (الْحَرَّةُ) নামক স্থানের দিকে ‘অস্ত্র অস্ত্র’ (السَّلاح السَّلاح) বলতে বলতে বেরিয়ে গেল।
এ খবর পেয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কয়েকজন মুহাজির ছাহাবীকে সাথে নিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হ’লেন এবং সবাইকে শান্ত করলেন। তখন সবাই বুঝলেন যে, এটা শয়তানী প্ররোচনা (نَزْغَةٌ مِنْ الشَّيْطَانِ) ব্যতীত কিছুই নয়। তারা তওবা করলেন ও পরস্পরে বুক মিলিয়ে ক্রন্দন করতে লাগলেন। এভাবে শাস বিন ক্বায়েস ইহূদী শয়তানের জ্বালানো আগুন দ্রুত নিভে গেল। উক্ত ঘটনা উপলক্ষ্যে আলে ইমরান ৯৮-১০০ আয়াতগুলি নাযিল হয়’ (ইবনু হিশাম ১/৫৫৫-৫৫৭)। ঘটনাটি ইবনু ইসহাক বিনা সনদে উল্লেখ করেছেন। ফলে এর সনদ ‘মু‘যাল’ বা যঈফ (মা শা-‘আ ১৩৫-৩৬ পৃঃ)।
(২) প্রসিদ্ধ আছে যে, বদর যুদ্ধের পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একদিন বনু ক্বায়নুক্বার বাজারে উপস্থিত হ’লেন ও তাদের ডেকে নানাভাবে উপদেশ দিলেন। অবশেষে বললেন, يَا مَعْشَرَ يَهُودَ أَسْلِمُوا قَبْلَ أَنْ يُصِيبَكُمْ مِثْلُ مَا أَصَابَ قُرَيْشًا- ‘হে ইহূদী সম্প্রদায়! তোমরা অনুগত হও কুরায়েশদের ন্যায় অবস্থা প্রাপ্ত হওয়ার আগেই’। এতে তারা উত্তেজিত হয়ে বলল, হে মুহাম্মাদ! তুমি কিছু কুরায়েশকে হত্যা করে ধোঁকায় পড়ো না। ওরা আনাড়ী। ওরা যুদ্ধবিদ্যার কিছুই জানে না। যদি তুমি আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ কর, তবে তুমি আমাদের মত কাউকে পাবে না’। উক্ত ঘটনা উপলক্ষ্যে আলে ইমরান ১২ আয়াতটি নাযিল হয়’ (ইবনু হিশাম ১/৫৫২; আবুদাঊদ হা/৩০০১ সনদ যঈফ; মা শা-‘আ ১৩৪ পৃঃ)।
(৩) আরও প্রসিদ্ধ আছে যে, একদিন জনৈকা মুসলিম মহিলা বনু ক্বায়নুক্বার বাজারে দুধ বিক্রি করে বিশেষ কোন প্রয়োজনে এক ইহূদী স্বর্ণকারের দোকানে গিয়ে বসেন। তখন কতগুলো দুষ্টমতি ইহূদী তার মুখের অবগুণ্ঠন খুলতে চায়। কিন্তু তিনি অস্বীকার করেন। তখন ঐ স্বর্ণকার ঐ মহিলার অগোচরে তার কাপড়ের এক প্রান্ত তার পিঠের দিকে গিরা দেয়। কাজ শেষে মহিলা উঠে দাঁড়াতেই কাপড়ে টান পড়ে বিবস্ত্র হয়ে পড়েন। দুর্বৃত্তরা তখন অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। এতে মহিলাটি লজ্জায় ও ক্ষোভে চিৎকার করে ওঠেন। এমতাবস্থায় একজন মুসলমান ঐ স্বর্ণকারের উপরে লাফিয়ে পড়ে তাকে হত্যা করে ফেলেন। প্রত্যুত্তরে এক ইহূদী ঝাঁপিয়ে পড়ে মুসলমানটিকে হত্যা করে। ফলে সংঘাত বেধে যায়’ (ইবনু হিশাম ২/৪৮)। ঘটনাটির সনদ ‘যঈফ’। প্রকৃত প্রস্তাবে বনু ক্বাইনুক্বার বহিষ্কারের প্রত্যক্ষ কোন কারণ পাওয়া যায় না। বরং তাদের লাগাতার ষড়যন্ত্র থেকে নিষ্কৃতি পাওয়াই ছিল এর মূল কারণ’ (মা শা-‘আ ১৩৩-৩৪ পৃঃ)।
[6]. ইবনু সা‘দ ২/২২-২৩; ইবনু হিশাম ২/৪৪-৪৫; যাদুল মা‘আদ ৩/১৬৯-৭০; আর-রাহীক্ব ২৪০ পৃঃ।
[7]. ইবনু হিশাম ২/৪৬; আর-রাহীক্ব ২৪১ পৃঃ।
[8]. ইবনু সা‘দ ২/২৪; ইবনু হিশাম ২/৫১; বুখারী হা/৪০৩৭ ‘কা‘ব বিন আশরাফ হত্যাকান্ড’ অনুচ্ছেদ।
[9]. ইবনু কাছীর, সীরাহ নববিইয়াহ (বৈরূত : দারুল মা‘রিফাহ ১৩৯৫/১৯৭৬ খৃ.) ৩/১২।
[10]. বুখারী হা/৪০৩৭, ‘যুদ্ধ-বিগ্রহ’ অধ্যায় ১৫ অনুচ্ছেদ; আহমাদ হা/২৩৯১; আবুদাঊদ হা/২৭৬৮; ইরওয়া হা/১১৯১ সনদ ছহীহ; ইবনু হিশাম ২/৫১-৫৭; যাদুল মা‘আদ ৩/১৭১; আর-রাহীক্ব ২৪২-৪৫ পৃঃ।
প্রসিদ্ধ আছে যে, কাজ সেরে তার মাথা নিয়ে বাক্বী‘ গারক্বাদে ফিরে এসে তারা জোরে তাকবীর ধ্বনি করেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)ও তাকবীর ধ্বনি করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন এবং খুশী হয়ে বলেন, أفلَحَتِ الوجوهُ ‘তোমাদের চেহারাগুলি সফল থাকুক’। তারাও বললেন, وَوَجْهُكَ يا رسولَ الله ‘এবং আপনার চেহারাও হে আল্লাহর রাসূল’! এ সময় ঐ দুষ্টের কাটা মাথাটা তার সামনে রাখা হ’লে তিনি ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পাঠ করেন (আর-রাহীক্ব ২৪৪-৪৫ পৃঃ)। ঘটনাটি ওয়াক্বেদী ও ইবনু সা‘দ স্ব স্ব গ্রন্থে বিনা সনদে উল্লেখ করেছেন। অতএব তা গ্রহণযোগ্য নয়।
মদীনার সনদ (ميثاق المدينة)
মদীনার সংখ্যাগরিষ্ঠ আউস ও খাযরাজ নেতাগণ আগেই ইসলাম কবুল করায় এবং আউস ও খাযরাজ দুই প্রধান গোত্রের আমন্ত্রণ থাকায় তাদের সাথে সন্ধিচুক্তির কোন প্রশ্নই ছিল না। খাযরাজ গোত্রের আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই নেতৃত্বের অভিলাষী থাকলেও গোত্রের সংখ্যাগুরু মুসলমানদের বিরুদ্ধে গিয়ে প্রকাশ্যে কিছু করার ক্ষমতা তার ছিল না। বদর যুদ্ধের পর সে এবং তার অনুসারীরা প্রকাশ্যে ইসলাম কবুল করে। তবে সেসময় মদীনার সংখ্যালঘু ইহূদী সম্প্রদায় মুসলমানদের নবতর জীবনধারার প্রতি এবং বিশেষভাবে রাসূল (সাঃ)-এর প্রতি ঈর্ষান্বিত থাকলেও অতি ধূর্ত হওয়ার কারণে প্রকাশ্য বিরোধিতায় লিপ্ত হয়নি। সমস্যা ছিল কেবল কুরায়েশদের নিয়ে। তারা পত্র প্রেরণ ও অন্যান্য অপতৎপরতার মাধ্যমে মুনাফিক ও ইহূদীদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে রাসূল (সাঃ) ও তার সাথীদেরকে মদীনা থেকে বহিষ্কারের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে থাকে। একাজে তারা যাতে সফল না হয় সেজন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সর্বপ্রথম মদীনার পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকদের সাথে সহযোগিতা চুক্তি সম্পাদনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।
সেকারণ তিনি পার্শ্ববর্তী নিকট ও দূরের এলাকাসমূহের বিভিন্ন গোত্রের সাথে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেন। যেমন, (১) ২য় হিজরীর ছফর মাসে মদীনা হ’তে ২৯ মাইল দূরবর্তী ওয়াদ্দান (ودَّان) এলাকায় এক অভিযানে গেলে রাসূল (সাঃ) সেখানকার বনু যামরাহ(بَنُو ضَمْرَة) গোত্রের সঙ্গে সন্ধিচুক্তি করেন। (২) অতঃপর ২য় হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে বুওয়াত্ব (بُواط) এলাকায় এক অভিযানে গিয়ে রাসূল (সাঃ) তাদের সাথেও সন্ধিচুক্তি করেন। (৩) একই বছরের জুমাদাল আখেরাহ মাসে ইয়াম্বু‘ ও মদীনার মধ্যবর্তী যুল-‘উশায়রা(ذُو الْعُشَيْرَة) এলাকায় গিয়ে তিনি বনু মুদলিজ(بَنُو مُدْلِج) গোত্রের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। এভাবে রাসূল (সাঃ) চেয়েছিলেন, যেন যুদ্ধাশংকা দূর হয় এবং সর্বত্র শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এসময় মদীনায় ইহূদী চক্রান্ত চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। যার নেতৃত্বে ছিল তাদের ধনশালী নেতা ও ব্যঙ্গ কবি কা‘ব বিন আশরাফ। রাসূল (সাঃ), ছাহাবায়ে কেরাম ও তাঁদের স্ত্রীদের নিয়ে কটূক্তি করাই ছিল তার বদস্বভাব।
এ বিষয়ে ছহীহ সনদে কা‘ব বিন মালেক আনছারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, ইহূদী নেতা কা‘ব বিন আশরাফ রাসূল (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ কবিতা বলত এবং কাফের কুরায়েশদেরকে তাঁর বিরুদ্ধে উস্কানী দিত। অতঃপর রাসূল (সাঃ) যখন মদীনায় আসেন, তখন এখানে মিশ্রিত বাসিন্দারা ছিল। তাদের মধ্যে মুসলমানেরা ছিল। মুশরিকরা ছিল, যারা মূর্তিপূজা করত। ইহূদীরা ছিল, যারা রাসূল (সাঃ) ও তাঁর ছাহাবীদের কষ্ট দিত। এমতাবস্থায় আল্লাহ স্বীয় নবীকে ছবর ও মার্জনার আদেশ দিয়ে আয়াত নাযিল করেন,لَتُبْلَوُنَّ فِي أَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ وَلَتَسْمَعُنَّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَمِنَ الَّذِينَ أَشْرَكُوا أَذًى كَثِيرًا وَإِنْ تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا فَإِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ ‘অবশ্যই তোমরা পরীক্ষায় পতিত হবে তোমাদের ধন-সম্পদে ও তোমাদের নিজেদের জীবনে। আর তোমরা অবশ্যই শুনবে তোমাদের পূর্ববর্তী আহলে কিতাব ও মুশরিকদের কাছ থেকে অনেক কষ্টদায়ক কথা। যদি তোমরা তাতে ধৈর্য ধারণ কর এবং আল্লাহভীরুতা অবলম্বন কর, তবে সেটাই হবে দৃঢ় সংকল্পের কাজ’ (আলে ইমরান ৩/১৮৬)। অতঃপর যখন কা‘ব বিন আশরাফ রাসূল (সাঃ)-কে কষ্টদানে বিরত থাকতে অস্বীকার করল, তখন রাসূল (সাঃ) আউস নেতা সা‘দ বিন মু‘আযকে তার বিরুদ্ধে একদল লোক পাঠাতে বললেন, যেন তারা তাকে হত্যা করে। তখন তিনি মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহকে পাঠালেন। অতঃপর তিনি (রাবী) তার হত্যার কাহিনী বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, এ ঘটনায় ইহূদী ও মুশরিকরা ভীত হয়ে পড়ে। ফলে পরদিন তারা রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে হাযির হয়ে বলল, আমাদের নেতাকে রাতের বেলায় তার বাড়ীতে গিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তখন রাসূল (সাঃ) তাদেরকে তার ব্যঙ্গ কবিতার কথা বললেন। অতঃপর তিনি তাদের বললেন তাঁর ও তাদের মধ্যে একটা লিখিত চুক্তি সম্পাদন করতে। যাতে তারা যেসব গালি ও কষ্ট দেয়, তা থেকে বিরত হয়। অতঃপর নবী (সাঃ) তাঁর ও তাদের মধ্যে এবং মুসলমানদের মধ্যে একটা চুক্তিনামা (صَحِيفَة) লিখে দিলেন’।[1]
অত্র হাদীছ দৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, চুক্তি লিখনের এই বিষয়টি হিজরতের পরেই নয়, বরং ৩য় হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে কা‘ব বিন আশরাফের হত্যাকান্ডের পরে হয়েছিল। যা অধিকাংশ জীবনীকার ও ইতিহাসবিদগণের বক্তব্যের বিরোধী। যেমন মুবারকপুরী বলেন, ‘মদীনায় হিজরতের পরপরই নবগঠিত ইসলামী সমাজের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য’ রাসূল (সাঃ) মদীনার সনদ রচনা করেন (আর-রাহীক্ব ১৯২ পৃঃ)। অথচ বিষয়টি ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত নয়। নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক বর্ণনার চাইতে ছহীহ হাদীছের গুরুত্ব সর্বাধিক।
জীবনীকারগণ উপরোক্ত ছহীহ হাদীছের জওয়াবে বলেন, এটি ‘১ম চুক্তির নবায়ন’ (تَجْدِيْدٌ لِلْمَوْثِقِ الْأَوَّلِ) হ’তে পারে।[2] চুক্তিটি বিস্তারিতভাবে এসেছে ইবনু ইসহাকের বর্ণনায় সনদবিহীনভাবে (ইবনু হিশাম ১/৫০১-০৪ পৃঃ)। শায়খ আলবানী বলেন, এভাবে ইবনু ইসহাক সনদ ছাড়াই এটি বর্ণনা করেছেন। অতএব বর্ণনাটি মু‘যাল (যঈফ)। ইবনুল ক্বাইয়িম (৬৯১-৭৫১ হি.) তাঁর বিখ্যাত জীবনীগ্রন্থ যাদুল মা‘আদে কেবল এটুকু লিখেছেন, وَوَادَعَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ بِالْمَدِينَةِ مِنَ الْيَهُودِ وَكَتَبَ بَيْنَهُ وَبَيْنَهُمْ كِتَابًا ‘রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনায় অবস্থানকারী ইহূদীদের সাথে চুক্তি করেন এবং তিনি তাঁর ও তাদের মধ্যে একটি দলীল লিপিবদ্ধ করেন’ (যাদুল মা‘আদ ৩/৫৮ পৃঃ)। এতটুকু ব্যতীত আগে-পিছে কোন বক্তব্য বা মন্তব্য নেই। ইবনু কাছীর (৭০১-৭৪ হি.) কোনরূপ মন্তব্য ছাড়াই ইবনু ইসহাকের বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন (আল-বিদায়াহ ৩/২২৪-২৬)। যেটি তাঁর স্বভাব বিরোধী। এতদ্ব্যতীত ইমাম আহমাদ (হা/২৪৪৩), ইবনু আবী খায়ছামাহ, আবু ওবায়েদ ক্বাসেম বিন সাল্লাম, বায়হাক্বী, ইবনু আবী হাতেম, ইবনু হাযম প্রমুখ যারাই উক্ত চুক্তি সংক্ষেপে বা বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করেছেন, কোনটাই বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয়। সম্ভবতঃ একারণেই বিখ্যাত মুহাদ্দিছ ও ঐতিহাসিক ইমাম যাহাবী (৬৭৩-৭৪৮ হি.) তাঁর ‘তারীখুল ইসলাম’ গ্রন্থে এবং ইমাম নববী (৬৩১-৬৭৬ হি.) স্বীয় ‘তাহযীবুল আসমা ওয়াল লুগাত’ গ্রন্থে বিভিন্ন হিজরী সনে ‘প্রসিদ্ধ ঘটনাবলী’র তালিকায় এটি আনেননি। এ চুক্তিনামা সঠিক হ’লে তিনি তা ১ম হিজরী সনের ঘটনাবলীর মধ্যে অবশ্যই আনতেন। অতএব ঘটনাটি প্রসিদ্ধ হ’লেও বিশুদ্ধ নয় (মা শা-‘আ ৯১-৯৮ পৃঃ)।
ছহীহ হাদীছের বর্ণনা অনুযায়ী কেবল এটুকুই পাওয়া যায় যে, ৩য় হিজরী সনে তিনি ইহূদীদের ও অন্যান্যদের মধ্যে একটা ‘চুক্তিনামা’ লিখে দিয়েছিলেন। সেটিই ‘মদীনার সনদ’ নামে খ্যাত। তবে সেখানে তখনকার সময়ে প্রয়োজনীয় সবকিছুই লেখা ছিল বলে ধরে নেওয়া যায়। তাতে কি লেখা ছিল, তা জানা যায় না।
মদীনার সনদের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা শেষে ড. আকরাম যিয়া উমারী (জন্ম: ১৯৪২ খৃ.) বলেন, আমার নিকট অগ্রগণ্য এই যে, চুক্তিনামা ছিল দু’টি। প্রথমটি ছিল ইহূদীদের সাথে রাসূল (সাঃ)-এর মদীনায় আগমনের পর এবং দ্বিতীয়টি ছিল মুহাজির ও আনছারদের মাঝে বদর যুদ্ধের পর’। কিন্তু ঐতিহাসিকগণ দু’টি চুক্তি একত্রিত করেছেন’ (সীরাহ ছহীহাহ ১/২৮১)।
আকরাম যিয়া উমারী যে উক্ত চুক্তিটিকে দুই সময়ে দুইভাগে ভাগ করেছেন, তার পিছনে কোন প্রমাণ নেই। কেননা তাঁর ও সকল জীবনীকারের এ বিষয়ে বর্ণনার ভিত্তি হ’ল ইবনু ইসহাক (৮৫-১৫১ হি.)-এর সনদবিহীন বর্ণনা। যা তিনি একবারেই এবং একসাথে বর্ণনা করেছেন (ইবনু হিশাম ১/৫০১-০৪)। আকরাম যিয়া উক্ত দীর্ঘ বর্ণনার বাক্যগুলিকে ৪৭টি ধারায় পরিণত করেছেন মাত্র (সীরাহ ছহীহাহ ১/২৮২-৮৫)।
তিনি হাদীছ ও ইতিহাসের বর্ণনাগুলির সমন্বয় করতে গিয়ে বলেছেন, উভয়ের মধ্যে হাদীছের বর্ণনা ইতিহাসের বর্ণনাসমূহের চাইতে অধিক শক্তিশালী। কিন্তু সেজন্য ইতিহাসের বর্ণনাসমূহকে নাকচ করার কোন কারণ নেই। কেননা কা‘ব বিন আশরাফের হত্যার পরে আগের চুক্তিটির তাকীদ কিংবা নবায়ন হিসাবে পুনরায় চুক্তি করায় কোন বাধা নেই’ (সীরাহ ছহীহাহ ১/২৭৮)।
বস্ত্ততঃ এগুলি স্রেফ ধারণা ও কল্পনা মাত্র। অতএব আমরা ছহীহ হাদীছের আলোকে কেবল এটুকুই বলব যে, ইহূদীরা তাদের নেতা কা‘ব বিন আশরাফের হত্যাকান্ডে ভীত হয়েই চুক্তিতে রাযী হয়েছিল এবং যা ছিল ৩য় হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসের পরের ঘটনা। নিঃসন্দেহে সে চুক্তিটি ছিল পারস্পরিক সন্ধিচুক্তি। কিন্তু চুক্তিটি কি ছিল, তার ভাষা কি ছিল, সেখানে কয়টি ধারা ছিল, কিছুই সঠিকভাবে বলার উপায় নেই।[3]
পার্শ্ববর্তী নিকট ও দূরের গোত্রসমূহের সাথে সন্ধিচুক্তিসমূহ সম্পাদনের পর ইহূদীদের সাথে অত্র চুক্তি সম্পাদনের ফলে প্রকৃত প্রস্তাবে ইসলামী খিলাফতের ভিত্তি স্থাপিত হয় এবং মদীনা তার রাজধানীতে পরিণত হয়। অতএব বলা চলে যে, মদীনার সনদ ছিল একটি আন্তঃধর্মীয় ও আন্তঃসাম্প্রদায়িক চুক্তি, যার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ স্বার্থে ও একক লক্ষ্যে একটি উম্মাহ বা জাতি গঠিত হয়। আধুনিক পরিভাষায় যাকে ‘রাষ্ট্র’ বলা হয়। এই সনদ ছিল আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার সর্বপ্রথম ভিত্তি স্বরূপ।
[1]. আবুদাঊদ হা/৩০০০, ‘খারাজ ও ফাই’ অধ্যায়, ‘কিভাবে মদীনা থেকে ইহূদীদের বহিষ্কার করা হয়’ অনুচ্ছেদ, হাদীছ ছহীহ।
[2]. সীরাহ ছহীহাহ ১/২৭৮ পৃঃ; মা শা-‘আ ৯৯ পৃঃ।
[3]. পাঠকদের জ্ঞাতার্থে আমরা মুহাম্মাদ বিন ইসহাক-এর ধারাবিহীন ও সনদবিহীনভাবে বর্ণিত চুক্তিনামাটি ড. আকরাম যিয়াকৃত ধারা অনুযায়ী বিন্যস্ত করে অনুবাদসহ উল্লেখ করলাম। বর্ণনার মধ্যে ভুলক্রমে একটি বাক্য দু’বার আনা সত্ত্বেও তাকে ২৪ ও ৩৮ দু’টি ধারা হিসাবে গণ্য করা হয়েছে (সীরাহ ছহীহাহ ১/২৮৪)। ধারা বিন্যাসে তিনি কিছু আগ-পিছ করেছেন। আমরা ইবনু হিশামের বর্ণনার অনুসরণ করেছি এবং একই বক্তব্য বারবার থাকায় আমরা মতনে ও অনুবাদে ৪-১১ ধারাগুলি সংক্ষিপ্ত করেছি।-
قَالَ ابْنُ إسْحَاقَ: وَكَتَبَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كِتَابًا بَيْنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ، وَادَعَ فِيهِ يَهُودَ وَعَاهَدَهُمْ، وَأَقَرَّهُمْ عَلَى دِينِهِمْ وَأَمْوَالِهِمْ، وَشَرَطَ لَهُمْ، وَاشْتَرَطَ عَلَيْهِمْ:
(1) بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ، هَذَا كِتَابٌ مِنْ مُحَمَّدٍ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، بَيْنَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُسْلِمِينَ مِنْ قُرَيْشٍ وَيَثْرِبَ، وَمَنْ تَبِعَهُمْ، فَلَحِقَ بِهِمْ، وَجَاهَدَ مَعَهُمْ، (2) إنَّهُمْ أُمَّةٌ وَاحِدَةٌ مِنْ دُونِ النَّاسِ، (3) الْمُهَاجِرُونَ مِنْ قُرَيْشٍ عَلَى رِبْعَتِهِمْ يَتَعَاقَلُونَ، بَيْنَهُمْ، وَهُمْ يَفْدُونَ عَانِيَهُمْ بِالْمَعْرُوفِ وَالْقِسْطِ بَيْنَ الْمُؤْمِنِينَ، (4) وَبَنُو عَوْفٍ عَلَى رِبْعَتِهِمْ ... (5) وَبَنُو سَاعِدَةَ عَلَى رِبْعَتِهِمْ ... (6) وَبَنُو الْحَارِثِ عَلَى رِبْعَتِهِمْ ... (7) وَبَنُو جُشَمٍ عَلَى ... (8) وَبَنُو النَّجَّارِ عَلَى رِبْعَتِهِمْ ... (9) وَبَنُو عَمْرِو بْنِ عَوْفٍ عَلَى رِبْعَتِهِمْ ... (10) وَبَنُو النَّبِيتِ عَلَى ... (11) وَبَنُو الْأَوْسِ عَلَى رِبْعَتِهِمْ ... (12) وَإِنَّ الْمُؤْمِنِينَ لاَ يَتْرُكُونَ مُفْرَحًا بَيْنَهُمْ أَنْ يُعْطُوهُ بِالْمَعْرُوفِ فِي فِدَاءٍ أَوْ عَقْلٍ. وَأَنْ لاَ يُحَالِفَ مُؤْمِنٌ مَوْلَى مُؤْمِنٍ دُونَهُ، (13) وَإِنَّ الْمُؤْمِنِينَ الْمُتَّقِينَ عَلَى مَنْ بَغَى مِنْهُمْ، أَوْ ابْتَغَى دَسِيعَةَ ظُلْمٍ، أَوْ إثْمٍ، أَوْ عُدْوَانٍ، أَوْ فَسَادٍ بَيْنَ الْمُؤْمِنِينَ، وَإِنَّ أَيْدِيَهُمْ عَلَيْهِ جَمِيعًا، وَلَوْ كَانَ وَلَدَ أَحَدِهِمْ، (14) وَلاَ يَقْتُلُ مُؤْمِنٌ مُؤْمِنًا فِي كَافِرٍ، وَلاَ يَنْصُرُ كَافِرًا عَلَى مُؤْمِنٍ، (15) وَإِنَّ ذِمَّةَ اللهِ وَاحِدَةٌ، يُجِيرُ عَلَيْهِمْ أَدْنَاهُمْ، وَإِنَّ الْمُؤْمِنِينَ بَعْضُهُمْ مَوَالِي بَعْضٍ دُونَ النَّاسِ، (16) وَإِنَّهُ مَنْ تَبِعَنَا مِنْ يَهُودَ فَإِنَّ لَهُ النَّصْرَ وَالْأُسْوَةَ، غَيْرَ مَظْلُومِينَ وَلاَ مُتَنَاصَرِينَ عَلَيْهِمْ، (17) وَإِنَّ سِلْمَ الْمُؤْمِنِينَ وَاحِدَةٌ، لاَ يُسَالَمُ مُؤْمِنٌ دُونَ مُؤْمِنٍ فِي قِتَالٍ فِي سَبِيلِ اللهِ، إلاَّ عَلَى سَوَاءٍ وَعَدْلٍ بَيْنَهُمْ، (18) وَإِنَّ كُلَّ غَازِيَةٍ غَزَتْ مَعَنَا يُعْقِبُ بَعْضُهَا بَعْضًا، (19) وَإِن الْمُؤمنِينَ يُبِيْءُ بَعْضُهُمْ عَلَى بَعْضٍ بِمَا نَالَ دِمَاءَهُمْ فِي سَبِيلِ اللهِ، (20) وَإِنَّ الْمُؤْمِنِينَ الْمُتَّقِينَ عَلَى أَحْسَنِ هُدًى وَأَقْوَمِهِ، وَإِنَّهُ لاَ يُجِيرُ مُشْرِكٌ مَالاً لقريش وَلاَ نفسا، وَلاَ يَحُولُ دُونَهُ عَلَى مُؤْمِنٍ، (21) وَإِنَّهُ مَنْ اعْتَبَطَ مُؤْمِنًا قَتْلًا عَنْ بَيِّنَةٍ فَإِنَّهُ قَوَدٌ بِهِ إلاَّ أَنْ يَرْضَى وَلِيُّ الْمَقْتُولِ، وَإِنَّ الْمُؤْمِنِينَ عَلَيْهِ كَافَّةٌ، وَلاَ يَحِلُّ لَهُمْ إلاَّ قِيَامٌ عَلَيْهِ، (22) وَإِنَّهُ لاَ يَحِلُّ لِمُؤْمِنٍ أَقَرَّ بِمَا فِي هَذِهِ الصَّحِيفَةِ، وَآمَنَ بالله وَالْيَوْمِ الْآخِرِ، أَنْ يَنْصُرَ مُحْدِثًا وَلاَ يُؤْوِيهِ، وَأَنَّهُ مَنْ نَصَرَهُ أَوْ آوَاهُ، فَإِنَّ عَلَيْهِ لَعْنَةَ اللهِ وَغَضَبَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَلاَ يُؤْخَذُ مِنْهُ صَرْفٌ وَلاَ عَدْلٌ، (23) وَإِنَّكُمْ مَهْمَا اخْتَلَفْتُمْ فِيهِ مِنْ شَيْءٍ، فَإِنَّ مَرَدَّهُ إلَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ، وَإِلَى مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، (24) وَإِنَّ الْيَهُودَ يُنْفِقُونَ مَعَ الْمُؤْمِنِينَ مَا دَامُوا مُحَارَبِينَ، (25) وَإِنَّ يَهُودَ بَنِي عَوْفٍ أُمَّةٌ مَعَ الْمُؤْمِنِينَ، لِلْيَهُودِ دِينُهُمْ، وَلِلْمُسْلِمَيْنِ دِينُهُمْ، مَوَالِيهِمْ وَأَنْفُسُهُمْ، إلاَّ مَنْ ظَلَمَ وَأَثِمَ، فَإِنَّهُ لاَ يُوتِغُ إلاَّ نَفْسَهُ، وَأَهْلَ بَيْتِهِ، (26) وَإِنَّ لِيَهُودِ بَنِي النَّجَّارِ مِثْلَ مَا لِيَهُودِ بَنِي عَوْفٍ، (27) وَإِنَّ لِيَهُودِ بَنِي الْحَارِثِ مِثْلَ مَا لِيَهُودِ بَنِي عَوْفٍ، (28) وَإِنَّ لِيَهُودِ بَنِي سَاعِدَةَ مِثْلَ مَا لِيَهُودِ بَنِي عَوْفٍ، (29) وَإِنَّ لِيَهُودِ بَنِي جُشَمٍ مِثْلَ مَا لِيَهُودِ بَنِي عَوْفٍ، (30) وَإِنَّ لِيَهُودِ بَنِي الْأَوْسِ مِثْلَ مَا لِيَهُودِ بَنِي عَوْفٍ، (31) وَإِنَّ لِيَهُودِ بَنِي ثَعْلَبَةَ مِثْلَ مَا لِيَهُودِ بَنِي عَوْفٍ، إلَّا مَنْ ظَلَمَ وَأَثِمَ، فَإِنَّهُ لَا يُوتِغُ إلاَّ نَفْسَهُ وَأَهْلَ بَيْتِهِ، (32) وَإِنَّ جَفْنَةَ بَطْنٌ مِنْ ثَعْلَبَةَ كَأَنْفُسِهِمْ، (33) وَإِنَّ لِبَنِي الشَّطِيبَةِ مِثْلَ مَا لِيَهُودِ بَنِي عَوْفٍ، وَإِنَّ الْبِرَّ دُونَ الْإِثْمِ، (34) وَإِنَّ مَوَالِيَ ثَعْلَبَةَ كَأَنْفُسِهِمْ، (35) وَإِنَّ بِطَانَةَ يَهُودَ كَأَنْفُسِهِمْ، (36) وَإِنَّهُ لَا يَخْرَجُ مِنْهُمْ أَحَدٌ إلاَّ بِإِذْنِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَإِنَّهُ لاَ يُنْحَجَزُ عَلَى ثَأْرٍ جُرْحٌ، وَإِنَّهُ مَنْ فَتَكَ فَبِنَفْسِهِ فَتَكَ، وَأَهْلِ بَيْتِهِ، إلاَّ مِنْ ظَلَمَ، وَإِنَّ اللهَ عَلَى أَبَرِّ هَذَا، (37) وَإِنَّ عَلَى الْيَهُودِ نَفَقَتَهُمْ وَعَلَى الْمُسْلِمِينَ نَفَقَتَهُمْ، وَإِنَّ بَيْنَهُمْ النَّصْرَ عَلَى مَنْ حَارَبَ أَهْلَ هَذِهِ الصَّحِيفَةِ، وَإِنَّ بَيْنَهُمْ النُّصْحَ وَالنَّصِيحَةَ، وَالْبِرَّ دُونَ الْإِثْمِ، وَإِنَّهُ لَمْ يَأْثَمْ امْرُؤٌ بِحَلِيفِهِ، وَإِنَّ النَّصْرَ لِلْمَظْلُومِ، (38-مكرر) وَإِنَّ الْيَهُودَ يُنْفِقُونَ مَعَ الْمُؤْمِنِينَ مَا دَامُوا مُحَارَبِينَ، (39) وَإِنَّ يَثْرِبَ حَرَامٌ جَوْفُهَا لِأَهْلِ هَذِهِ الصَّحِيفَةِ، (40) وَإِنَّ الْجَارَ كَالنَّفْسِ غَيْرَ مُضَارٍّ وَلاَ آثِمٌ، (41) وَإِنَّهُ لاَ تُجَارُ حُرْمَةٌ إلاَّ بِإِذْنِ أَهْلِهَا، (42) وَإِنَّهُ مَا كَانَ بَيْنَ أَهْلِ هَذِهِ الصَّحِيفَةِ مِنْ حَدَثٍ أَوْ اشْتِجَارٍ يُخَافُ فَسَادُهُ، فَإِنَّ مَرَدَّهُ إلَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ، وَإِلَى مُحَمَّدٍ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَإِنَّ اللهَ عَلَى أَتْقَى مَا فِي هَذِهِ الصَّحِيفَةِ وَأَبَرِّهِ، (43) وَإِنَّهُ لاَ تُجَارُ قُرَيْشٌ وَلَا مَنْ نَصَرَهَا، (44) وَإِنَّ بَيْنَهُمْ النَّصْرَ عَلَى مَنْ دَهَمَ يَثْرِبَ، (45) وَإِذَا دُعُوا إلَى صُلْحٍ يُصَالِحُونَهُ وَيَلْبَسُونَهُ، فَإِنَّهُمْ يُصَالِحُونَهُ وَيَلْبَسُونَهُ، وَإِنَّهُمْ إذَا دُعُوا إلَى مِثْلِ ذَلِكَ فَإِنَّهُ لَهُمْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ، إلاَّ مَنْ حَارَبَ فِي الدِّينِ، عَلَى كُلِّ أُنَاسٍ حِصَّتُهُمْ مِنْ جَانِبِهِمْ الَّذِي قِبَلَهُمْ، (46) وَإِنَّ يَهُودَ الْأَوْسِ، مَوَالِيَهُمْ وَأَنْفُسَهُمْ، عَلَى مِثْلِ مَا لِأَهْلِ هَذِهِ الصَّحِيفَةِ. مَعَ الْبِرِّ الْمَحْضِ؟ مِنْ أَهْلِ هَذِهِ الصَّحِيفَةِ. قَالَ ابْنُ هِشَامٍ: وَيُقَالُ: مَعَ الْبِرِّ الْمُحْسِنُ مِنْ أَهْلِ هَذِهِ الصَّحِيفَةِ. قَالَ ابْنُ إسْحَاقَ: وَإِنَّ الْبِرَّ دُونَ الْإِثْمِ، لاَ يَكْسِبُ كَاسِبٌ إلاَّ عَلَى نَفْسِهِ، وَإِنَّ اللهَ عَلَى أَصْدَقِ مَا فِي هَذِهِ الصَّحِيفَةِ وَأَبَرِّهِ، (47) وَإِنَّهُ لاَ يَحُولُ هَذَا الْكِتَابُ دُونَ ظَالِمٍ وَآثِمٍ، وَإِنَّهُ مَنْ خَرَجَ آمِنٌ، وَمَنْ قَعَدَ آمِنٌ بِالْمَدِينَةِ، إلاَّ مَنْ ظَلَمَ أَوْ أَثِمَ، وَإِنَّ اللهَ جَارٌ لِمَنْ بَرَّ وَاتَّقَى، وَمُحَمَّدٌ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- السيرة التبوية لابن هشام 1/501-504، السيرة النبوية الصحيحة لأكرم ضياء العمري 1/282-285-
(১) এটি লিখিত হচ্ছে নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর পক্ষ হ’তে মুমিন ও মুসলমানদের মধ্যে যারা কুরায়শী ও ইয়াছরেবী এবং তাদের অনুগামী, যারা তাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে জিহাদে অংশগ্রহণ করে থাকে। (২) এরা অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র একটি জাতি হিসাবে গণ্য হবে। (৩) কুরায়েশ মুহাজিরগণ তাদের নিজ অবস্থায় থাকবে। তারা তাদের বন্দী বিনিময়ে মুমিনদের মাঝে ন্যায়সঙ্গতভাবে ফিদইয়া দিবে। একইভাবে (৪) বনু ‘আওফ, (৫) বনু সা‘এদাহ, (৬) বনুল হারেছ, (৭) বনু জুশাম, (৮) বনু নাজ্জার, (৯) বনু ‘আমর বিন ‘আওফ, (১০) বনু নাবীত, (১১) বনু আউস সবাই স্ব স্ব পূর্বের অবস্থায় থাকবে এবং তাদের স্ব স্ব গোত্র ও শাখাসমূহ বন্দী বিনিময়ে মুমিনদের মাঝে ন্যায়সঙ্গতভাবে ফিদইয়া দিবে। (১২) মুমিনগণ তাদের মধ্যকার কোন ঋণগ্রস্ত বা অভাবগ্রস্ত পরিবারকে ছেড়ে যাবে না, ন্যায়সঙ্গতভাবে তাকে ফিদইয়া বা রক্তমূল্য না দেয়া পর্যন্ত। কোন মুমিন কোন মুমিনের গোলামের সাথে কোনরূপ চুক্তি করবে না। (১৩) মুমিন-মুত্তাক্বীগণ তাদের মধ্যে কেউ বিদ্রোহ করলে বা বড় কোন যুলুম করলে, পাপ করলে, শত্রুতা করলে কিংবা মুমিনদের মধ্যে বিশৃংখলা সৃষ্টি করলে তার বিরোধিতা করবে এবং সকলে তার বিরুদ্ধে একত্রিত হবে। যদিও ঐ ব্যক্তি তাদের কোন একজনের সন্তান হয়। (১৪) কোন মুমিন কাফিরের বিনিময়ে কোন মুমিনকে হত্যা করবে না এবং মুমিনের বিরুদ্ধে কোন কাফিরকে সাহায্য করবে না। (১৫) আল্লাহর যিম্মা এক। তারা তাদের অধীনস্তদের আশ্রয় দিবে। আর মুমিনগণ একে অপরের বন্ধু অন্যদের থেকে। (১৬) যেসব ইহূদী আমাদের অনুসারী হবে তাদের জন্য থাকবে সাহায্য ও উত্তম আচরণ। তারা অত্যাচারিত হবে না এবং তাদের উপরে কেউ প্রতিশোধ নিতে পারবে না। (১৭) মুমিনদের সন্ধিচুক্তি একই। কোন মুমিন আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধের সময় মুমিন ব্যতীত অন্যের সাথে সন্ধি করবে না, নিজেদের মধ্যে সমভাবে বা ন্যায়সঙ্গতভাবে ব্যতীত। (১৮) প্রত্যেক যুদ্ধ যা আমাদের সাথে হবে, সেখানে একে অপরের পিছে আসবে। (১৯) মুমিনগণ একে অপরকে রক্ষা করবে, যখন আল্লাহর রাস্তায় তাদের রক্ত প্রবাহিত হবে। (২০) মুমিন-মুত্তাক্বীগণ সুন্দর ও সরল পথে থাকবে। কোন মুশরিক কোন কুরায়েশ-এর জান ও মালের হেফাযত করবে না এবং মুমিনের বিরুদ্ধে বাধা হবে না। (২১) যদি কেউ কোন মুমিনকে বিনা দোষে হত্যা করে এবং তার প্রমাণ থাকে, তাহ’লে সে তার বদলা নেবে। তবে যদি নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীগণ ক্ষমা করে দেয় (রক্ত মূল্যের বিনিময়ে)। সকল মুমিন এ চুক্তির উপরে থাকবে। এর উপরে দৃঢ় থাকা ব্যতীত তাদের জন্য অন্য কিছু সিদ্ধ হবে না। (২২) আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী যে মুমিন এই চুক্তিতে স্বীকৃত হবে, তার জন্য সিদ্ধ হবে না কোন বিদ‘আতীকে সাহায্য করা বা আশ্রয় দেওয়া। যে ব্যক্তি তাকে সাহায্য করবে বা আশ্রয় দিবে, কিয়ামতের দিন তার উপরে আল্লাহর লা‘নত ও গযব থাকবে। তার থেকে কোনরূপ বিনিময় কবুল করা হবে না। (২৩) যখনই তোমরা এতে মতভেদ করবে, তখনই সেটা আল্লাহ ও মুহাম্মাদের দিকে ফিরে যাবে। (২৪) ইহূদীরা মুমিনদের সাথে খরচ বহন করবে, যতক্ষণ তারা একত্রে যুদ্ধ করবে। (২৫) বনু ‘আওফের ইহূদীগণ মুসলমানদের সাথে একই জাতিরূপে গণ্য হবে। ইহূদীদের জন্য তাদের দ্বীন এবং মুসলমানদের জন্য তাদের দ্বীন। এটা তাদের দাস-দাসীদের জন্য এবং তাদের নিজেদের জন্য সমভাবে গণ্য হবে। একইভাবে বনু ‘আওফ ব্যতীত অন্য ইহূদীদের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য হবে। তবে যে যুলুম করবে ও পাপ করবে, সে নিজেকে ও তার পরিবারকে ছাড়া কাউকে ধ্বংস করবে না। (২৬) আর বনু নাজ্জার, (২৭) বনুল হারেছ, (২৮) বনু সা‘এদাহ, (২৯) বনু জুশাম, (৩০) বনুল আউস, (৩১) বনু ছা‘লাবাহর ইহূদীদের জন্য ঐরূপ চুক্তি যেরূপ থাকবে বনু ‘আওফের ইহূদীদের জন্য। তবে যে ব্যক্তি যুলুম করবে ও পাপ করবে, সে নিজেকে ও নিজের পরিবারকে ছাড়া কাউকে ধ্বংস করবে না। (৩২) ছা‘লাবাহর জাফনাহ গোত্রটি তাদের মতই গণ্য হবে। (৩৩) বনু শুত্বাঈবাহর জন্য বনু ‘আওফের ইহূদীদের মতই চুক্তি থাকবে। কেবল সদ্ব্যবহার থাকবে, অন্যায় নয়। (৩৪) ছা‘লাবাহর দাস-দাসীগণ তাদের মতই গণ্য হবে। (৩৫) ইহূদীদের মিত্রগণ ইহূদীদের মতই গণ্য হবে। (৩৬) মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর অনুমতি ব্যতীত তাদের কেউ বাইরে যেতে পারবে না। কোন যখমের বদলা নিতে বিরত থাকবে না। যে ব্যক্তি বাড়াবাড়ি করে, সে তার নিজের উপর ও নিজ পরিবারের উপর বাড়াবাড়ি করে। তবে যে ব্যক্তি অত্যাচারিত হয়, আল্লাহ তার ব্যাপারে খুশী থাকেন। (৩৭) ইহূদীদের উপর তাদের ব্যয় এবং মুসলমানদের উপর তাদের ব্যয়। যারা এই চুক্তিকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, তাদের বিরুদ্ধে তারা পরস্পরকে সাহায্য করবে। তারা পরস্পরের প্রতি সুধারণা রাখবে, উপদেশ দিবে ও সদাচরণ করবে। অন্যায় করবে না। মিত্রের অন্যায়ের কারণে ব্যক্তি দায়ী হবে না। মযলূমকে সাহায্য করা হবে। (৩৮-পুনরুক্ত) ইহূদীরা মুমিনদের সাথে খরচ বহন করবে, যতক্ষণ তারা একত্রে যুদ্ধ করবে (এটিতে ধারা ২৪-এর পুনরুক্তি হয়েছে)। (৩৯) চুক্তিভুক্ত সকলের জন্য ইয়াছরিবের অভ্যন্তরভাগ হারাম অর্থাৎ নিরাপদ এলাকা হিসাবে গণ্য হবে। (৪০) প্রতিবেশীগণ চুক্তিবদ্ধ পক্ষের ন্যায় গণ্য হবে। যদি সে ক্ষতিকারী ও অন্যায়কারী না হয়। (৪১) কোন নারীকে আশ্রয় দেওয়া যাবে না, তার পরিবারের অনুমতি ব্যতীত। (৪২) চুক্তিবদ্ধ পক্ষগুলোর মধ্যে কোন সমস্যা ও ঝগড়ার সৃষ্টি হ’লে এবং তাতে বিপর্যয়ের আশংকা দেখা দিলে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নিকটে পেশ করা হবে। এই চুক্তিনামায় যা আছে, আল্লাহ তার উপর সর্বাধিক সতর্কতা ও সন্তুষ্টিতে আছেন। (৪৩) কুরায়েশ ও তাদের সহায়তাকারীদের আশ্রয় দেওয়া হবে না। (৪৪) ইয়াছরিবের উপরে কেউ হামলা চালালে সম্মিলিতভাবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। (৪৫) যখন তারা কোন সন্ধির দিকে আহুত হবে, যেখানে তারা পরস্পরে মীমাংসা করবে ও নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য তা কবুল করবে, তারা সেটাতে সাড়া দিবে। মুমিনদের উপর এটা প্রযোজ্য হবে। তবে যারা ধর্মের কারণে যুদ্ধ করে, তাদের উপর নয়। প্রত্যেকের জন্য তার নিজ পক্ষের অংশ নির্ধারিত হবে। (৪৬) আউসের (মিত্র) ইহূদীদের নিজেদের ও তাদের দাস-দাসীদের উপর অনুরূপ প্রযোজ্য হবে, যেরূপ অত্র চুক্তিকারীদের উপর প্রযোজ্য হবে। (আর তা হ’ল) স্রেফ সদাচরণ এই চুক্তিকারীদের পক্ষ হ’তে। ইবনু ইসহাক বলেন, সদাচরণ সেটাই যাতে পাপ নেই। অর্জনকারী কেবল নিজের জন্যই তা অর্জন করে থাকে। এই চুক্তিনামায় যা আছে, আল্লাহ তার উপর সর্বাধিক সত্যতা ও সন্তুষ্টিতে আছেন। (৪৭) কোন অত্যাচারী ও পাপীর জন্য এ চুক্তিনামা কোনরূপ সহায়ক হবে না। যে ব্যক্তি বের হয়ে যাবে, সে নিরাপদ থাকবে এবং যে ব্যক্তি বসে থাকবে, সে ও মদীনায় নিরাপদ থাকবে। ঐ ব্যক্তি ব্যতীত যে যুলুম ও অন্যায় করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ঐ ব্যক্তির সাথী, যে সদাচরণ করে ও আল্লাহভীরুতা অবলম্বন করে। আর মুহাম্মাদ হলেন আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম’। (ইবনু হিশাম ১/৫০১-০৪; সীরাহ নববীইয়াহ ছহীহাহ ১/২৮২-৮৫; আল- বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৩/২২৪ পৃঃ)।
শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ -২২ (العبر -২২)
(১) বংশীয়, গোত্রীয় এবং ধর্মীয় পরিচয় ও স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ণ রেখেও বৃহত্তর ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রীয় খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা যায়, রাসূল (সাঃ)-এর মাদানী জীবনের কর্মনীতি তার বাস্তব সাক্ষী।
(২) ইসলামী বিধানের অনুসরণের মাধ্যমেই কেবল বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব, মদীনার সনদ তার বাস্তব দলীল।
গাযওয়া বাহরান (غزوة بحران)
৩য় হিজরীর রবীউল আখের। একটি কুরায়েশ বাণিজ্য কাফেলাকে আটকানোর জন্য আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ৩০০ সৈন্য নিয়ে হেজাযের ‘ফুরু‘ (الفُرُع) সীমান্তের ‘বাহরান’ অঞ্চলে গমন করেন। সেখানে তিনি রবীউল আখের ও জুমাদাল ঊলা দু’মাস অবস্থান করেন। কিন্তু কোন যুদ্ধ হয়নি। এ সময় মদীনার দায়িত্বে ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূম (রাঃ)।[1]
[1]. যাদুল মা‘আদ ৩/১৭০; ইবনু হিশাম ২/৪৬; ইবনু সা‘দ ২/২৭; আর-রাহীক্ব ২৪৫ পৃঃ। মানছূরপুরী এটা ধরেননি।
সারিইয়া যায়েদ বিন হারেছাহ (سرية زيد بن حارثة)
৩য় হিজরীর জুমাদাল আখেরাহ। মদীনার পথে ব্যবসায়ের প্রতিবন্ধকতার কথা ভেবে কুরায়েশ বাণিজ্য কাফেলা মদীনার পূর্বদিক দিয়ে দীর্ঘ পথ ঘুরে সম্পূর্ণ অজানা পথে নাজদ হয়ে সিরিয়া যাবার মনস্থ করে। এ খবর মদীনায় পৌঁছে গেলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যায়েদ বিন হারেছাহর নেতৃত্বে ১০০ জনের একটি অশ্বারোহী দল প্রেরণ করেন। তারা অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে অগ্রসর হয়ে ‘ক্বারদাহ’ (قَرْدة) নামক প্রস্রবণের কাছে পৌঁছে তাদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অতর্কিতে এই হামলার মুকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে কাফেলা নেতা ছাফওয়ান বিন উমাইয়া সবকিছু ফেলে পালিয়ে যান। মজুরীর বিনিময়ে নেওয়া কুরায়েশদের পথ প্রদর্শক ফুরাত বিন হাইয়ান(فُرَاتُ بنُ حَيَّانَ) এবং বলা হয়েছে যে, আরও অন্য দু’জন বন্দী হয়ে মদীনায় নীত হয়। অতঃপর তারা রাসূল (সাঃ)-এর হাতে বায়‘আত করে ইসলাম কবুল করেন। এই সফরে বড় বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। যাদের মধ্যে কুরায়েশ নেতা আবু সুফিয়ান ইবনু হারবের নিকটেই ছিল সর্বাধিক রৌপ্য ও রৌপ্য সামগ্রীসমূহ। ফলে আনুমানিক এক লক্ষ দেরহামের রৌপ্য সহ বিপুল পরিমাণ গণীমতের মাল হস্তগত হয়। এই পরাজয়ে কুরায়েশরা হতাশ হয়ে পড়ে। এখন তাদের সামনে মাত্র দু’টি পথই খোলা রইল। যিদ ও অহংকার পরিত্যাগ করে মুসলমানদের সাথে সন্ধি করা অথবা যুদ্ধের মাধ্যমে হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করা। বলা বাহুল্য, তারা শেষটাই গ্রহণ করে এবং যা ওহোদ যুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলে। সোজাপথে না গিয়ে পালানো পথে সিরিয়া গমনের কাপুরুষতাকে কটাক্ষ করে রাসূল (সাঃ)-এর সভাকবি হাসসান বিন ছাবেত আনছারী (রাঃ) কুরায়েশ নেতাদের বিরুদ্ধে এ সময় কবিতা পাঠ করেন।[1]
[1]. ইবনু সা‘দ ২/২৭; ইবনু হিশাম ২/৫০।
ওহোদ যুদ্ধ (غزوة أحد) (৩য় হিজরীর ৭ই শাওয়াল শনিবার সকাল)
কুরায়েশরা আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে ৩০০০ সৈন্যের সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে মদীনার তিন মাইল উত্তরে ওহোদ পাহাড়ের পাদদেশে শিবির সন্নিবেশ করে। এই বাহিনীর সাথে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে ওৎবার নেতৃত্বে ১৫ জনের একটি মহিলা দল ছিল, যারা নেচে-গেয়ে ও উত্তেজক কবিতা পাঠ করে তাদের সৈন্যদের উত্তেজিত করে। এই যুদ্ধে রাসূল (সাঃ)-এর নেতৃত্বে প্রায় ৭০০ সৈন্য ছিলেন। প্রচন্ড যুদ্ধ শেষে একটি ভুলের জন্য মুসলমানদের সাক্ষাৎ বিজয় অবশেষে বিপর্যয়ে পরিণত হয়। মুসলিম পক্ষে ৭০ জন শহীদ ও ৪০ জন আহত হন। তার মধ্যে মুহাজির ৪ জন, আনছার ৬৫ জন। যাদের মধ্যে আউস ২৪, খাযরাজ ৪১ এবং ইহূদী ১ জন। কুরায়েশ পক্ষে ৩৭ জন নিহত হয়। তবে এই হিসাব চূড়ান্ত নয়। বরং কুরায়েশ পক্ষে হতাহতের সংখ্যা ছিল অনেক বেশী (‘জয়-পরাজয় পর্যালোচনা’ অনুচ্ছেদ দ্রষ্টব্য)।
এই যুদ্ধে মুসলমানরা ক্ষতিগ্রস্ত হ’লেও কুরায়েশরা বিজয়ী হয়নি। বরং তারা ভীত হয়ে ফিরে যায়। এ যুদ্ধ প্রসঙ্গে সূরা আলে ইমরানের ১২১-১৭৯ পর্যন্ত ৬০টি আয়াত নাযিল হয়। বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরূপ।-
ওহোদ-এর পরিচয় (تعارف أحد)
মদীনার ওহোদ পাহাড়ের নামে এই যুদ্ধের নামকরণ হয়েছে। পাহাড়টি অন্য পাহাড়ের সাথে যুক্ত না থেকে ‘একক’ হওয়ায় এর নাম ওহোদ (أُحُدٌ) হয়েছে। যার পর থেকে ত্বায়েফের পাহাড় (جَبَلُ الطائف) শুরু হয়েছে। এটি মসজিদে নববীর ‘মাজীদী দরজা’ (باب الْمَجِيدى) থেকে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। এই পাহাড়ের কতগুলি চূড়া রয়েছে। এর সরাসরি দক্ষিণে ছোট্ট পাহাড়টির নাম ‘আয়নায়েন’(عَيْنَين) যা পরবর্তীতে ‘জাবালুর রুমাত’ (جَبَلُ الرُّمَاة) বা তীরন্দাযদের পাহাড় বলে পরিচিত হয়। এ দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী বৃহৎ উপত্যকার নাম ‘কুনাত’ (وَادِى قُنَاة)। যেখানে ওহোদ যুদ্ধ সংঘটিত হয় বদর যুদ্ধের প্রায় ১১ মাস পরে’ (সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৭৮)।
যুদ্ধের কারণ (سبب المعركة)
মক্কা থেকে শামে কুরায়েশদের ব্যবসায়ের পথ নিরংকুশ ও নিরাপদ করাই ছিল তাদের এই যুদ্ধের মূল কারণ।
অতঃপর প্রত্যক্ষ কারণ ছিল, বদর যুদ্ধে কুরায়েশদের শোচনীয় পরাজয়, ‘সাভীক্ব’ যুদ্ধে ছাতুর বস্তাসহ অন্যান্য সাজ-সরঞ্জাম ফেলে আবু সুফিয়ানের পালিয়ে আসার গ্লানিকর অভিজ্ঞতা এবং সবশেষে ছাফওয়ান বিন উমাইয়ার নেতৃত্বে মদীনার সোজা পথ ছেড়ে নাজদের ঘোরা পথ ধরে সিরিয়া গমনকারী কুরায়েশ বাণিজ্য কাফেলা মুসলিম বাহিনী কর্তৃক লুট হওয়া এবং দলনেতা ছাফওয়ানের কোনমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসার লজ্জাকর ঘটনা। যার প্রেক্ষাপটে কুরায়েশ নেতারা মুসলমানদের সাথে কালবিলম্ব না করে একটা চূড়ান্ত ফায়ছালাকারী যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে। সঙ্গত কারণেই এ ব্যাপারে বদর যুদ্ধে নিহত নেতা আবু জাহলের পুত্র ইকরিমা, উৎবাহর ভাই আব্দুল্লাহ ও সাভীক যুদ্ধে পালিয়ে আসা আবু সুফিয়ান এবং সর্বশেষ বাণিজ্য কাফেলা ফেলে পালিয়ে আসা ছাফওয়ান বিন উমাইয়া অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
যুদ্ধের পুঁজি (رأسمال لقريش فى الحرب)
বদর যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ হিসাবে বিবেচিত কুরাইশের যে বাণিজ্য কাফেলা আবু সুফিয়ান স্বীয় বুদ্ধিবলে মুসলিম বাহিনীর কবল থেকে বাঁচিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন, সেই বাণিজ্য সম্ভারের সবটুকুই মালিকদের সম্মতিক্রমে ওহোদ যুদ্ধের পুঁজি হিসাবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত হয়’ (ইবনু হিশাম ২/৬০)।[1]
[1]. মুবারকপুরী লিখেছেন, যার পরিমাণ ছিল ১,০০০ উট ও ৫০,০০০ স্বর্ণমুদ্রা (ইবনু সা‘দ ২/২৮; আর-রাহীক্ব ২৪৮ পৃঃ)। কিন্তু এ হিসাবের কোন প্রমাণ নেই। তাছাড়া এ প্রসঙ্গে সূরা আনফাল ৩৬ আয়াতটি নাযিল হয়েছে বলে ইবনু সা‘দ যা বলেছেন, সেটিও বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয়। যাতে বলা হয়, إِنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا يُنْفِقُوْنَ أَمْوَالَهُمْ لِيَصُدُّوْا عَنْ سَبِيْلِ اللهِ فَسَيُنْفِقُوْنَهَا ثُمَّ تَكُوْنُ عَلَيْهِمْ حَسْرَةً ثُمَّ يُغْلَبُوْنَ وَالَّذِيْنَ كَفَرُوْا إِلَى جَهَنَّمَ يُحْشَرُوْنَ- ‘আল্লাহর রাস্তা হ’তে লোকদের ফিরানোর জন্য কাফেররা যত ধন-সম্পদ ব্যয় করুক না কেন, সবই ওদের মনস্তাপের কারণ হবে। ওরা পরাভূত হবে। অতঃপর কাফেররা জাহান্নামে একত্রিত হবে’ (আনফাল ৮/৩৬)। বরং সকল যুগের কাফের-মুনাফিকরা তাদের মাল-সম্পদ সর্বদা ইসলামের বিজয় ও অগ্রগতির বিরুদ্ধে ব্যয় করবে এটাই স্বাভাবিক।
মাক্কীদের যুদ্ধ প্রস্ত্ততি(استعداد قريش للحرب)
মুসলিম শক্তিকে সমূলে উৎখাত করার জন্য তারা সাধারণ বিজ্ঞপ্তি জারী করে দিল যে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছায় যুদ্ধে যেতে ইচ্ছুক বেদুঈন, কেনানা ও তেহামার অধিবাসীদের মধ্যকার যেকোন ব্যক্তি যেন এই যুদ্ধে কুরায়েশ বাহিনীতে শরীক হয়। লোকদের উত্তেজিত ও উৎসাহিত করার জন্য দু’জন কবি আবু ‘আযযাহ(أَبُو عَزَّةَ) এবং মুসাফে‘ বিন ‘আব্দে মানাফ আল-জুমাহী(مُسَافِعُ بْنُ عَبْدِ مَنَافِ الْجُمَحِيُّ) কে কাজে লাগানো হয়। প্রথমজন বদর যুদ্ধে বন্দী হয়েছিল। পরে রাসূল (সাঃ)-এর বিরোধিতা করবে না, এই শর্তে কোনরূপ মুক্তিপণ ছাড়াই সে মুক্তি পায়। তাকে গোত্রনেতা ছাফওয়ান বিন উমাইয়া প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, যুদ্ধ থেকে নিরাপদে ফিরে আসলে তাকে ধনশালী করে দিবেন। আর নিহত হ’লে তার কন্যাদের লালন-পালনের দায়িত্ব নেবেন’। ফলে উক্ত দুই কবি অর্থ-সম্পদের লোভে সর্বত্র যুদ্ধের উন্মাদনা সৃষ্টিতে তৎপর হয়ে উঠলো। দেখতে দেখতে বছর ঘুরে আসতেই মক্কায় তিন হাযার সুসজ্জিত সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী প্রস্ত্তত হয়ে গেল। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হেন্দার নেতৃত্বে ১৫ জন মহিলাকেও সঙ্গে নেওয়া হ’ল, যাতে তাদের দেওয়া উৎসাহে সৈন্যরা অধিক উৎসাহিত হয় এবং তাদের সম্ভ্রম রক্ষার্থে সৈন্যরা জীবনপণ লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ হয়।
যুদ্ধ সম্ভারের মধ্যে ছিল বাহন হিসাবে ৩০০০ উট, ২০০ যুদ্ধাশ্ব এবং ৭০০ লৌহবর্ম। খালেদ ইবনু অলীদ ও ইকরিমা বিন আবু জাহলকে অশ্বারোহী বাহিনীর অধিনায়ক ও সহ-অধিনায়ক করা হয়। আবু সুফিয়ান হ’লেন পুরা বাহিনীর অধিনায়ক এবং যুদ্ধের পতাকা অর্পণ করা হয় প্রথা অনুযায়ী বনু ‘আব্দিদ্দার গোত্রের হাতে।[1]
[1]. ওয়াক্বেদী, মাগাযী ১/২০৮; আর-রাহীক্ব ২৪৯ পৃঃ।
মদীনায় সংবাদ প্রাপ্তি (وصول خبر الاستعداد فى المدينة)
কুরায়েশ নেতাদের এই ব্যাপক যুদ্ধ প্রস্ত্ততির খবর রাসূল (সাঃ)-এর চাচা আববাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব (যিনি তখনো প্রকাশ্যে মুসলমান হননি) একজন বিশ্বস্ত পত্রবাহকের মাধ্যমে দ্রুত মদীনায় পাঠিয়ে দেন এবং তাতে তিনি সবকিছুর বিস্তারিত বিবরণ জানিয়ে দেন। ৪৬০ কিলোমিটার রাস্তা মাত্র তিনদিনে অতিক্রম করে পত্রবাহক সরাসরি গিয়ে রাসূল (সাঃ)-এর হাতে পত্রটি পৌঁছে দেয়। তিনি তখন ক্বোবায় অবস্থান করছিলেন। উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) পত্রটি রাসূল (সাঃ)-কে পাঠ করে শুনান। তিনি উবাইকে পত্র প্রাপ্তির বিষয়টি গোপন রাখতে বলেন ও দ্রুত মদীনায় এসে মুহাজির ও আনছার নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পরামর্শ বৈঠকে বসেন। অন্যদিকে মদীনার চারপাশে পাহারা দাঁড় করানো হ’ল। স্বয়ং রাসূল (সাঃ)-এর দ্বাররক্ষী হিসাবে রাত্রি জেগে পাহারা দেবার জন্য আউস নেতা সা‘দ বিন মু‘আয, খাযরাজ নেতা সা‘দ বিন ওবাদাহ এবং উসায়েদ বিন হুযায়ের প্রমুখ আনছার নেতৃবৃন্দ নিজেদেরকে নিয়োজিত করলেন। চারদিকে গোয়েন্দা প্রেরণ করা হ’ল মাক্কী বাহিনীর অগ্রযাত্রার খবর নেওয়ার জন্য। গোয়েন্দাগণ নিয়মিতভাবে রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে তাদের খবর পৌঁছে দিতে থাকেন।
পরামর্শ বৈঠকের বিবরণ (تقرير مجلس الاستشارى للرسول صـ)
মুহাজির ও আনছার নেতৃবৃন্দের উক্ত পরামর্শ বৈঠকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রথমে নিজের দেখা একটি স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেন। জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) বলেন,
رَأَيْتُ كَأَنِّى فِى دِرْعٍ حَصِينَةٍ وَرَأَيْتُ بَقَراً مُنَحَّرَةً فَأَوَّلْتُ أَنَّ الدِّرْعَ الْحَصِينَةَ الْمَدِينَةُ وَأَنَّ الْبَقَرَ هُوَ وَاللهِ خَيْرٌ. قَالَ فَقَالَ لأَصْحَابِهِ لَوْ أَنَّا أَقَمْنَا بِالْمَدِينَةِ فَإِنْ دَخَلُوا عَلَيْنَا فِيهَا قَاتَلْنَاهُمْ. فَقَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ وَاللهِ مَا دُخِلَ عَلَيْنَا فِيهَا فِى الْجَاهِلِيَّةِ فَكَيْفَ يُدْخَلُ عَلَيْنَا فِيهَا فِى الإِسْلاَمِ قَالَ عَفَّانُ فِى حَدِيثِهِ فَقَالَ شَأْنَكُمْ إِذاً. قَالَ فَلَبِسَ لأْمَتَهُ قَالَ فَقَالَتِ الأَنْصَارُ َرَدَدْنَا عَلَى رَسُولِ اللهِ –صلى الله عليه وسلم- رَأْيَهُ فَجَاءُوا فَقَالُوا يَا نَبِىَّ اللهِ شَأْنَكَ إِذاً. فَقَالَ إِنَّهُ لَيْسَ لِنَبِىٍّ إِذَا لَبِسَ لأْمَتَهُ أَنْ يَضَعَهَا حَتَّى يُقَاتِلَ-
‘আমি নিজেকে দেখলাম একটি সুরক্ষিত বর্মের মধ্যে এবং একটি গাভীকে দেখলাম যবহকৃত অবস্থায়। আমি এর ব্যাখ্যা করছি, বর্ম হ’ল ‘সুরক্ষিত মদীনা’। আর গাভী আল্লাহর কসম! এটি মঙ্গল (অর্থ ‘কিছু ছাহাবী নিহত হবে’ -ফাৎহুল বারী)। অতঃপর তিনি বললেন, যদি আমরা মদীনায় থেকেই যুদ্ধ করতাম! তাহ’লে যদি তারা আমাদের উপর হামলা করে, তবে আমরা তাদের বিরুদ্ধে এখান থেকেই যুদ্ধ করতে পারতাম’। তখন ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর কসম! জাহেলী যুগে এখানে কেউ প্রবেশ করতে পারেনি। তাহ’লে ইসলামী যুগে কিভাবে তারা আমাদের উপর প্রবেশ করবে? রাবী ‘আফফান বলেন, তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, এখন তোমাদের ইচ্ছা। তিনি বলেন, অতঃপর রাসূল (সাঃ) বর্ম ও অস্ত্র সজ্জিত হ’লেন। তিনি বলেন, তখন আনছারগণ বললেন, আমরা রাসূল (সাঃ)-এর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছি। অতঃপর তারা এসে বললেন, হে আল্লাহর নবী! আপনি যেটা বললেন সেটাই হৌক। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, কোন নবীর জন্য এটা সঙ্গত নয় যে, যুদ্ধের পোষাক পরিধানের পর তিনি তা খুলে ফেলেন, যুদ্ধ না করা পর্যন্ত’।[1] ইবনু আববাস (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে যে, রাসূল (সাঃ) তাঁর ‘যুলফিক্বার’ তরবারির মাথা স্বপ্নে ভাঙ্গা দেখতে পান। তিনি বলেন, আমি এর ব্যাখ্যা করছি এই যে, তোমাদের মধ্যে (অর্থাৎ আমার পরিবারের মধ্যে) কেউ নিহত হবে। আমি দেখলাম যে, আমি একটি দুম্বার পিছনে আছি। আমি দুম্বার ব্যাখ্যা করছি ‘মুসলিম সেনাবাহিনী’...।[2] আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, رَأَيْتُ فِى رُؤْيَاىَ أَنِّى هَزَزْتُ سَيْفًا فَانْقَطَعَ صَدْرُهُ، فَإِذَا هُوَ مَا أُصِيبَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ أُحُدٍ ، ثُمَّ هَزَزْتُهُ أُخْرَى فَعَادَ أَحْسَنَ مَا كَانَ، فَإِذَا هُوَ مَا جَاءَ بِهِ اللهُ مِنَ الْفَتْحِ وَاجْتِمَاعِ الْمُؤْمِنِينَ ، وَرَأَيْتُ فِيهَا بَقَرًا وَاللهُ خَيْرٌ، فَإِذَا هُمُ الْمُؤْمِنُونَ يَوْمَ أُحُدٍ ‘আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, আমি একটি তরবারি ঝাঁকুনি দিচ্ছি। তাতে তার মাথা ভেঙ্গে গেল। আর সেটি হ’ল, মুসলমানরা ওহোদের দিন যে বিপদগ্রস্ত হয়েছিল সেটা। অতঃপর আমি পুনরায় ঝাঁকুনি দিলাম। তখন তরবারিটি সুন্দর অবস্থায় ফিরে এল। সেটি হ’ল আল্লাহ যে বিজয় দান করেছেন এবং মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন সেটা। আমি সেখানে দেখলাম একটি গাভীকে। আল্লাহর কসম! সেটি মঙ্গল। আর সেটি হ’ল ওহোদের দিনের (বিপদগ্রস্ত) মুসলমানেরা’।[3]
উল্লেখ্য যে, রাসূল (সাঃ)-এর পরিবার থেকে তাঁর চাচা হামযাহ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব উক্ত যুদ্ধে শহীদ হন।
উপরোক্ত ঘটনায় প্রমাণিত হয় যে, বৈষয়িক ব্যাপারে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের পরামর্শ গ্রহণ ও তা মেনে নেওয়া আমীরের জন্য সঙ্গত। কিন্তু তাঁকে বাধ্য করা যাবে না। বরং তাঁর সিদ্ধান্ত সকলকে নির্দ্বিধায় মেনে নিতে হবে। তবে বিধানগত বিষয়ে আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশের বাইরে অধিকাংশের রায় মেনে নেওয়া বৈধ নয়’ (আন‘আম ৬/১১৫-১১৬)।
[1]. আহমাদ হা/১৪৮২৯, সনদ ছহীহ লেগায়রিহী-আরনাঊত্ব; ফাৎহুল বারী হা/৭০৩৫-এর আলোচনা।
[2]. আহমাদ হা/২৪৪৫, সনদ হাসান; হাকেম হা/২৫৮৮; ছহীহাহ হা/১১০০।
এখানে প্রসিদ্ধ আছে যে, আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই ও তার সাথীরা এবং একদল ছাহাবী রাসূল (সাঃ)-কে মদীনায় থেকে যুদ্ধ করার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। অন্যেরা বিশেষ করে হামযা (রাঃ) সহ যারা বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেন নি, তারা বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করতে চাপ সৃষ্টি করেন’ (সীরাহ হালাবিইয়াহ ২/২৯৮; ইবনু হিশাম ২/৬৩; আর-রাহীক্ব ২৫১-৫২ পৃঃ)। কথাগুলি বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়। ইবনু ইসহাক এগুলি বিনা সনদে বর্ণনা করেছেন। সনদ ‘মুরসাল’ (তাহকীক ইবনু হিশাম, ক্রমিক ১০৮৪)।
[3]. বুখারী হা/৪০৮১; মুসলিম হা/২২৭২ (২০)।
মাক্কী বাহিনীর অবস্থান ও শ্রেণীবিন্যাস (موقف الجيش المكى وتنسيقهم)
মাক্কী বাহিনী ৩য় হিজরীর ৬ই শাওয়াল শুক্রবার মদীনার উত্তরে ওহোদ পাহাড়ের কাছাকাছি ‘আয়নায়েন’ (عَيْنَيْن) টীলার নিকটবর্তী স্থানে শিবির সন্নিবেশ করে।[1] তাদের ডান বাহুর অধিনায়ক ছিলেন খালেদ বিন অলীদ এবং বাম বাহুর অধিনায়ক ছিলেন ইকরিমা বিন আবু জাহল। তীরন্দায বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনু রাবী‘আহ এবং পদাতিক বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন ছাফওয়ান বিন উমাইয়া। আবু সুফিয়ান ছিলেন সর্বাধিনায়ক এবং তিনি মধ্যভাগে অবস্থান নেন’ (আর-রাহীক্ব ২৫০-৫১ পৃঃ)।
[1]. মুবারকপুরী এখানে সূত্রবিহীনভাবে উল্লেখ করেছেন যে, আসার পথে ‘আবওয়া’ (الْأَبْوَاءِ) নামক স্থানে পৌছলে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উৎবাহ রাসূল (সাঃ)-এর আম্মা বিবি আমেনার কবর উৎপাটন করার প্রস্তাব করেন। কিন্তু বাহিনীর নেতৃবৃন্দ তার এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এর ভয়ংকর পরিণতির কথা চিন্তা করে’ (আর-রাহীক্ব ২৫০ পৃঃ)। ঘটনাটি সূত্রবিহীনভাবে উল্লেখ করা হয়েছে’ (আলী বিন ইবরাহীম, সীরাহ হালাবিইয়াহ (বৈরূত : ২য় সংস্করণ ১৪২৭ হিঃ) ২/২৯৭ পৃঃ)। অতএব বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। ‘আবওয়া’ মদীনা থেকে মক্কার পথে ২৫০ কি. মি. দূরে অবস্থিত একটি শহরের নাম।
ইসলামী বাহিনীর বিন্যাস ও অগ্রযাত্রা (تنسيق الجيش الإسلامى ومسيرتهم)
দক্ষ গোয়েন্দা বাহিনীর মাধ্যমে মাক্কী বাহিনীর যাবতীয় খবর রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে পৌঁছে যায়। তিনি তাদেরকে বিশ্রামের সুযোগ না দিয়ে ত্বরিৎ আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন এবং ৬ই শাওয়াল শুক্রবার বাদ আছর রওয়ানা হন। ইতিপূর্বে তিনি জুম‘আর খুৎবায় লোকদেরকে ধৈর্য ও দৃঢ়তার উপদেশ দেন এবং তার বিনিময়ে জান্নাত লাভের সুসংবাদ শুনান। অন্ধ ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূমকে তিনি মদীনার দায়িত্বে রেখে যান, যাতে তিনি মসজিদে ছালাতের ইমামতি করেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর এক হাযার ফৌজকে মুহাজির, আউস ও খাযরাজ- তিন বাহিনীতে ভাগ করেন। এ সময় যুদ্ধের প্রধান পতাকা ছিল কালো রংয়ের এবং ছোট পতাকা ছিল সাদা রংয়ের।[1] তিনি মুহাজির বাহিনীর পতাকা দেন মুছ‘আব বিন ওমায়ের-এর হাতে। তিনি শহীদ হবার পর দেন আলী (রাঃ)-এর হাতে। আউসদের পতাকা দেন উসায়েদ বিন হুযায়ের-এর হাতে এবং খাযরাজদের পতাকা দেন হুবাব ইবনুল মুনযির-এর হাতে’ (আর-রাহীক্ব ২৫২ পৃঃ)। তবে এই বিন্যাস বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয় (ঐ, তা‘লীক্ব ১৪৪ পৃঃ)। এক হাযারের মধ্যে ১০০ ছিলেন বর্ম পরিহিত। রাসূল (সাঃ) উপরে ও নীচে দু’টি লৌহবর্ম পরিধান করেন (আবুদাঊদ হা/২৫৯০)। অশ্বারোহী কেউ ছিলেন কি-না সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে।
আল্লাহ তাঁকে শত্রু থেকে রক্ষা করবেন (মায়েদাহ ৫/৬৭), এটা জেনেও রাসূল (সাঃ) নিজের জন্য দ্বিগুণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন স্বীয় উম্মতকে এটা শিক্ষা দেওয়ার জন্য যে, সকল কাজে দুনিয়াবী রক্ষা ব্যবস্থা পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে হবে। অতঃপর আল্লাহর উপর পরিপূর্ণভাবে ভরসা করতে হবে। আর সর্বোচ্চ নেতার জন্য সর্বোচ্চ রক্ষাব্যবস্থা রাখতে হবে। আর এটি আল্লাহর উপরে তাওয়াক্কুলের বিরোধী নয়।
মদীনা থেকে বাদ আছর আউস ও খাযরাজ নেতা দুই সা‘দকে সামনে নিয়ে রওয়ানা দিয়ে ‘শায়খান’ (الشَّيْخَان) নামক স্থানে পৌঁছে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বীয় বাহিনী পরিদর্শন করেন। বয়সে ১৫ বছরের কম ও অনুপযুক্ত বিবেচনা করে তিনি কয়েকজনকে বাদ দেন। ইবনু হিশাম ও ইবনু সাইয়িদিন নাস-এর হিসাব মতে এরা ছিলেন ১৩ জন। তারা হ’লেন, (১) উসামাহ বিন যায়েদ, (২) আব্দুল্লাহ বিন ওমর, (৩) যায়েদ বিন ছাবেত, (৪) উসায়েদ বিন যুহায়ের (أُسَيد بْن ظُهَير) (৫) ‘উরাবাহ বিন আউস (عُرابة بن أوس) (৬) বারা বিন ‘আযেব, (৭) আবু সাঈদ খুদরী, (৮) যায়েদ বিন আরক্বাম, (৯) সা‘দ বিন উক্বায়েব (سَعْد بن عُقَيْب) (১০) সা‘দ ইবনু জাবতাহ(سَعْد بن جَبْةة) (১১) যায়েদ বিন জারীয়াহ আনছারী (ইনি যায়েদ বিন হারেছাহ নন), (১২) জাবের বিন আব্দুল্লাহ (১৩) ‘আমর ইবনু হাযম।
১৫ বছর বয়স না হওয়া সত্ত্বেও রাফে‘ বিন খাদীজ ও সামুরাহ বিন জুনদুবকে নেওয়া হয়। এর কারণ ছিল এই যে, দক্ষ তীরন্দায হিসাবে রাফে‘ বিন খাদীজকে নিলে সামুরাহ বলে উঠেন যে, আমি রাফে‘ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী। আমি তাকে কুস্তিতে হারিয়ে দিতে পারি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে সুযোগ দিলে সত্য সত্যই তিনি কুস্তিতে জিতে যান। ফলে দু’জনেই যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি পান।[2] এর মাধ্যমে জিহাদ ও শাহাদাতের প্রতি মুসলিম তরুণদের আগ্রহ পরিমাপ করা যায় এবং এটাও প্রমাণিত হয় যে, জিহাদের জন্য কেবল আকাংখাই যথেষ্ট নয়, বরং দৈহিক শক্তি ও যোগ্যতা এবং আনুষঙ্গিক প্রস্ত্ততি আবশ্যক।[3]
‘শায়খানে’ সন্ধ্যা নেমে আসায় আল্লাহর রাসূল (সাঃ) সেখানেই রাত্রি যাপনের সিদ্ধান্ত নেন। অতঃপর মাগরিব ও এশার ছালাত আদায় করেন। অতঃপর মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহর নেতৃত্বে পঞ্চাশ জনকে পাহারায় রেখে বাকী সবাই ঘুমিয়ে যান। এ সময় যাকওয়ান বিন ‘আব্দে ক্বায়েসকে খাছভাবে কেবল রাসূল (সাঃ)-এর পাহারায় নিযুক্ত করা হয়’ (আর-রাহীক্ব ২৫৩ পৃঃ)। শেষ রাতে ফজরের কিছু পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বাহিনীসহ আবার চলতে শুরু করেন এবং শাওত্ব (الشوط) নামক স্থানে পৌঁছে ফজর ছালাত আদায় করেন। এখান থেকে মাক্কী বাহিনীকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। বিশাল কুরায়েশ বাহিনীকে দেখে মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই তার তিনশ’ অর্থাৎ প্রায় এক তৃতীয়াংশ সেনাদলকে ফিরিয়ে নিয়ে এই কথা বলতে বলতে চলে গেল যে,مَا نَدْرِي عَلاَمَ نَقْتُل أَنْفُسَنَا ‘জানি না আমরা কিসের জন্য জীবন বিসর্জন দিতে যাচ্ছি’? তারপর সে এ যুক্তি পেশ করল যে, إن الرسول صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَرَكَ رَأْيَهُ وَأَطَاعَ غَيْرَهُ ‘রাসূল (সাঃ) তাঁর সিদ্ধান্ত পরিত্যাগ করেছেন ও অন্যদের কথা মেনে নিয়েছেন’ (আর-রাহীক্ব ২৫৩ পৃঃ)। অর্থাৎ তিনি আমাদের মূল্যায়ন করেননি। অথচ এখানে তার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম বাহিনীতে ফাটল ধরানো। যাতে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং মক্কার আগ্রাসী বিশাল বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে মুহাম্মাদ (সাঃ) ও তাঁর সাথীরা ধ্বংস হয়ে যায়। তাতে তার নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বী খতম হয়ে যাবে ও তার জন্য পথ পরিষ্কার হয়ে যাবে। ইসলামী সংগঠনে ফাটল সৃষ্টিকারী কপট ও সুবিধাবাদী নেতাদের চরিত্র সকল যুগে প্রায় একই রূপ।
আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ও তার দলের পশ্চাদপসরণ দেখে আউস গোত্রের বনু হারেছাহ এবং খাযরাজ গোত্রের বনু সালামারও পদস্খলন ঘটবার উপক্রম হয়েছিল এবং তারাও মদীনায় ফিরে যাবার চিন্তা করছিল। কিন্তু আল্লাহর বিশেষ রহমতে তাদের চিত্ত চাঞ্চল্য দূরীভূত হয় এবং তারা যুদ্ধের জন্য সংকল্পবদ্ধ হয়। এ দু’টি দলের প্রতি ইঙ্গিত করেই নাযিল হয়, إِذْ هَمَّت طَّآئِفَتَانِ مِنْكُمْ أَنْ تَفْشَلاَ وَاللهُ وَلِيُّهُمَا وَعَلَى اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُوْنَ ‘যখন তোমাদের মধ্যকার দু’টি দল সাহস হারাবার উপক্রম করেছিল, অথচ আল্লাহ ছিলেন তাদের অভিভাবক। অতএব আল্লাহর উপরেই যেন বিশ্বাসীগণ ভরসা করে’ (আলে ইমরান ৩/১২২)। এ সময় মুনাফিকদের ফিরানোর জন্য জাবিরের পিতা আব্দুল্লাহ বিন হারাম তাদের পিছে পিছে চলতে থাকেন ও বলতে থাকেন যে,تَعالَوْا قاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللهِ أَوِ ادْفَعُوا ‘এসো আল্লাহর পথে যুদ্ধ কর অথবা প্রতিরোধ কর’। কিন্তু তারা বলল,لَوْ نَعْلَمُ أَنَّكُمْ تُقَاتِلُونَ لَمْ نَرْجِعْ ‘যদি আমরা জানতাম যে, তোমরা প্রকৃতই যুদ্ধ করবে, তাহ’লে আমরা ফিরে যেতাম না’। একথা শুনে আব্দুল্লাহ তাদের বলেন, أَبْعَدَكُمْ اللهُ أَعْدَاءَ اللهِ، فَسَيُغْنِي اللهُ عَنْكُمْ نَبِيَّهُ ‘দূর হ আল্লাহর শত্রুরা। সত্বর আল্লাহ তাঁর নবীকে তোদের থেকে মুখাপেক্ষীহীন করবেন’। এ প্রসঙ্গেই নাযিল হয়,وَلِيَعْلَمَ الْمُؤْمِنِينَ، وَلِيَعْلَمَ الَّذِيْنَ نَافَقُوا ‘এর দ্বারা তিনি মুমিনদের বাস্তবে জেনে নেন’ ‘এবং মুনাফিকদেরও জেনে নেন’ (আলে ইমরান ৩/১৬৬-৬৭)। অর্থাৎ মুনাফিকদের উক্ত জওয়াব ছিল কেবল মুখের। ওটা তাদের অন্তরের কথা ছিল না। এভাবেই আল্লাহ মুসলিম সেনাদলকে ইহূদী ও মুনাফিক থেকে মুক্ত করে নেন এবং অবশিষ্ট প্রায় ৭০০ সেনাদল নিয়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ওহোদের দিকে অগ্রসর হন।[4]
[1]. তিরমিযী হা/১৬৮১; ইবনু মাজাহ হা/২৮১৮; মিশকাত হা/৩৮৮৭।
[2]. ইবনু সাইয়িদিন নাস, উয়ূনুল আছার ২/১১-১৩ পৃঃ; ইবনু হিশাম ২/৬৬। সনদ যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম, ক্রমিক ১০৯১)। আকরাম যিয়া উমারী ইবনু সাইয়িদিন নাস-এর বরাতে ১৪ জন বালকের কথা বলেছেন (সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৮৩)। কিন্তু আমরা সেখানে ১২ জনের নাম পেয়েছি। বাড়তি আরেকজন ‘আমর ইবনু হাযম-এর নাম ইবনু হিশাম উল্লেখ করেছেন (ইবনু হিশাম ২/৬৬)।
[3]. মুবারকপুরী (রহঃ) এখানে লিখেছেন যে, ছানিয়াতুল বিদা‘ (ثَنِيَّةُ الْوَدَاع) পৌঁছে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত একটি বাহিনী দেখতে পেয়ে তাদের সম্পর্কে জানতে চান। সাথীরা বললেন যে, ওরা আমাদের পক্ষে যুদ্ধে যাবার জন্য বেরিয়েছে। ওরা খাযরাজ গোত্রের মিত্র বনু ক্বায়নুক্বার ইহূদী। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুশরিকদের বিরুদ্ধে কাফিরদের সাহায্য নিতে অস্বীকার করলেন (فأبى أن يستعين بأهل الكفر على أهل الشرك) (আর-রাহীক্ব ২৫৩ পৃঃ)। জানা আবশ্যক যে, বদর যুদ্ধের পরে বনু ক্বায়নুক্বার ইহূদীদেরকে মদীনা থেকে শামের দিকে বহিষ্কার করা হয়। অতএব ইসলাম গ্রহণ ছাড়াই এবং রাসূল (সাঃ)-এর অনুমতি ছাড়াই ওহোদ যুদ্ধে মুসলমানদের পক্ষে তাদের যোগদানের বিষয়টি অযৌক্তিক এবং অকল্পনীয় বটে।
[4]. এ সময় এক অন্ধ মুনাফিক মিরবা‘ বিন ক্বাইযী (مِرْبع بن قَيْظي)-এর বাগানের মধ্য দিয়ে যেতে গেলে সে মুসলিম বাহিনীর মুখের দিকে ধূলো ছুঁড়ে মেরে রাসূল (সাঃ)-এর উদ্দেশ্যে বলে, তুমি যদি সত্যিকারের রাসূল হও, তবে তোমার জন্য আমার এ বাগানে প্রবেশ করার অনুমতি নেই’। মুসলিম সেনারা তাকে হত্যা করতে উদ্যত হ’লে রাসূল (সাঃ) নিষেধ করে বলেন, ওকে হত্যা করো না। فَهَذَا أَعْمَى الْقَلْبِ، أَعْمَى الْبَصَرِ ‘সে হৃদয়ে অন্ধ, চোখেও অন্ধ’ (যাদুল মা‘আদ ৩/১৭২; ইবনু হিশাম ২/৬৫; আর-রাহীক্ব ২৫৫ পৃঃ)। বক্তব্যটি ‘মুরসাল’ বা যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম, ক্রমিক ১০৮৮)।
ইসলামী বাহিনীর শিবির সন্নিবেশ ও শ্রেণীবিন্যাস (موقف الجيش الإسلامى وتصافّهم)
অতঃপর অগ্রসর হয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ওহোদ পাহাড়ের পাদদেশে অবতরণ করেন ও সেখানে শিবির স্থাপন করেন। শত্রুসেনারা যাতে পিছন দিক থেকে হামলা করতে না পারে, সেজন্য তিনি দক্ষিণ-পূর্বে প্রায় ১৫০ মিটার দূরে সংকীর্ণ ও স্বল্পোচ্চ গিরিপথে আউস গোত্রের বদরী ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু জুবায়ের আনছারীর নেতৃত্বে ৫০ জনের একটি তীরন্দায দলকে নিযুক্ত করেন’ (আর-রাহীক্ব ২৫৫ পৃঃ)। যে স্থানটি এখন ‘জাবালুর রুমাত’(جَبَلُ الرُّمَاةِ) বা ‘তীরন্দাযদের পাহাড়’ বলে পরিচিত। তাদেরকে বলে দেওয়া হয় যে, জয় বা পরাজয় যাই-ই হৌক, তারা যেন পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ঐ স্থান ত্যাগ না করে এবং শত্রুপক্ষ যেন কোনভাবেই এপথ দিয়ে প্রবেশ করতে না পারে। তিনি বলেন, إِنْ رَأَيْتُمُونَا تَخْطَفُنَا الطَّيْرُ، فَلاَ تَبْرَحُوا مَكَانَكُمْ هَذَا حَتَّى أُرْسِلَ إِلَيْكُمْ، وَإِنْ رَأَيْتُمُونَا هَزَمْنَا الْقَوْمَ وَأَوْطَأْنَاهُمْ فَلاَ تَبْرَحُوا حَتَّى أُرْسِلَ إِلَيْكُمْ ‘এমনকি তোমরা যদি আমাদের মৃত লাশে পক্ষীকুলকে ছোঁ মারতে দেখ, তথাপি আমি তোমাদের কাছে কাউকে না পাঠানো পর্যন্ত তোমরা উক্ত স্থান ছেড়ে আসবে না। যদি তোমরা দেখ যে, আমরা তাদেরকে পরাজিত করেছি এবং তাদের পদদলিত করছি, তথাপি তোমরা উক্ত স্থান ছেড়ে আসবে না। যতক্ষণ না আমি তোমাদের কাছে কাউকে পাঠাই’।[1] কেননা শত্রুপক্ষ পরাজিত হ’লে কেবলমাত্র এপথেই তাদের পুনরায় হামলা করার আশংকা ছিল। দূরদর্শী সেনানায়ক রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সেটা বুঝতে পেরেই তাদেরকে এমন কঠোর হুঁশিয়ারী প্রদান করেন। তিনি পাহাড়কে আড়াল করে পিছন ও দক্ষিণ বাহুকে নিরাপদ করেন। আর যে গিরিপথ দিয়ে শত্রুপক্ষের প্রবেশের আশংকা ছিল, সেপথটি তীরন্দাযদের মাধ্যমে সুরক্ষিত করে নেন। অতঃপর শিবির স্থাপনের জন্য একটি উঁচু জায়গা নির্বাচন করেন। যাতে পরাজিত হ’লেও শত্রুপক্ষ সেখানে পৌঁছতে না পারে এবং তেমন কোন ক্ষতি করতে না পারে। এভাবে তিনি অত্যন্ত দূরদর্শিতার সাথে শিবির সন্নিবেশ করেন। অতঃপর তিনি মুনযির বিন ‘আমরকে ডান বাহুর এবং যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়ামকে বাম বাহুর অধিনায়ক নিযুক্ত করেন। মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদকে তার সহকারী নিয়োগ করেন। বাম বাহুর প্রধান দায়িত্ব ছিল কুরায়েশ অশ্বারোহী বাহিনী ও তাদের অধিনায়ক খালেদ বিন অলীদকে ঠেকানো। তিনি বড় বড় যোদ্ধাদের সম্মুখ বাহিনীতে রাখেন’ (আর-রাহীক্ব ২৫৬ পৃঃ)। অতঃপর নয়জন দেহরক্ষী নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পিছনে অবস্থান নেন ও যুদ্ধ পরিস্থিতি অবলোকন করতে থাকেন, যাদের মধ্যে ৭ জন ছিলেন আনছার ও ২ জন ছিলেন মুহাজির’।[2]
[1]. বুখারী হা/৩০৩৯, ‘জিহাদ’ অধ্যায় ১/৪২৬; ফাৎহুল বারী ৭/৪০৩।
[2]. মুসলিম হা/১৭৮৯ (১০০); আর-রাহীক্ব ২৬৪ পৃঃ।
কুরায়েশদের রাজনৈতিক চাল (الخداع السياسى لقريش)
(১) যুদ্ধ শুরুর কিছু পূর্বে আবু সুফিয়ান আনছারদের কাছে এই মর্মে পয়গাম পাঠান যে, তোমরা আমাদের ও আমাদের স্বগোত্রীয়দের মাঝখান থেকে সরে দাঁড়াও। আমরা তোমাদের থেকে সরে আসব। তোমাদের সাথে আমাদের যুদ্ধের কোন প্রয়োজন নেই’। কিন্তু আনছারগণ তাদের কূটচাল বুঝতে পেরে তাদেরকে ভীষণভাবে তিরষ্কার করে বিদায় দেন।
(২) প্রথম প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে কুরায়েশ পক্ষ দ্বিতীয় পন্থা গ্রহণ করল। ইসলামের পূর্বে আউস গোত্রের অন্যতম নেতা ও পুরোহিত ছিলেন আবু ‘আমের আর-রাহেব’। আউস গোত্র ইসলাম কবুল করলে তিনি মক্কায় চলে যান এবং কুরায়েশদের সঙ্গে মিলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। কুরায়েশদের ধারণা ছিল যে, তিনি ময়দানে উপস্থিত হ’লে আনছাররা ফিরে যাবে। সেমতে তিনি ময়দানে এসে আনছারদের উচ্চকণ্ঠে ডাক দেন ও তাদেরকে ফিরে যেতে বলেন। কিন্তু তাতে কোন কাজ হ’ল না (যাদুল মা‘আদ ৩/১৭৫)। সংখ্যার আধিক্য ও সরঞ্জামের প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও মুসলমানদের ব্যাপারে কুরায়েশরা কিরূপ ভীত ছিল, উপরোক্ত ঘটনায় তার কিছুটা অাঁচ করা যায়।
উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মদীনায় হিজরতের দিন থেকে হোনায়েন যুদ্ধ পর্যন্ত বড় বড় সকল রণাঙ্গনে আবু ‘আমের আর-রাহেব মুসলমানদের বিরুদ্ধে অংশ নেয়। সেই-ই ওহোদের যুদ্ধে গোপনে গর্ত খুঁড়ে রাখে। যাতে পড়ে গিয়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আহত হন এবং তিনি মারা গেছেন বলে রটিয়ে দিয়ে মুসলিম বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা চালানো হয়। তারই চক্রান্তে ক্বোবায় ‘মসজিদে যেরার’ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তারই প্ররোচনায় রোম সম্রাট সরাসরি মদীনায় হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেন। যা প্রতিরোধ করার জন্য প্রচন্ড দুর্ভিক্ষাবস্থার মধ্যেও রাসূল (সাঃ)-কে রোম সীমান্ত অভিমুখে ৯ম হিজরীতে ‘তাবূক’ অভিযান করতে হয়। অবশেষে সে খ্রিষ্টানদের কেন্দ্রস্থল সিরিয়ার ক্বিন্নাসরীন এলাকায় আত্মীয়-স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। অথচ তার পুত্র হানযালা ছিলেন বিখ্যাত ছাহাবী এবং ওহোদ যুদ্ধের খ্যাতিমান শহীদ ‘গাসীলুল মালায়েকাহ’। আবু ‘আমের-এর ক্ষোভের কারণ ছিল তার ধর্মীয় নেতৃত্ব হারানো। যেমন ইবনু উবাইয়ের ক্ষোভের কারণ ছিল তার রাজনৈতিক নেতৃত্ব হারানো।
ইতিমধ্যে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উৎবাহর নেতৃত্বে কুরায়েশ মহিলারা বাদ্য বাজিয়ে নেচে গেয়ে নিজেদের সৈন্যদের উত্তেজিত করে তুলল। এক পর্যায়ে তারা গেয়ে উঠল,
إنْ تُقْبِلوا نُعانِقْ + ونَفْرِشُ النَّمارِقْ
او تُدْبِروا نُفارِقْ + فِراقَ غيرَ وَامِقْ
‘যদি তোমরা অগ্রসর হও, তবে আমরা তোমাদের আলিঙ্গন করব ও তোমাদের জন্য শয্যা রচনা করব’। ‘আর যদি তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করো, তবে আমরা পৃথক হয়ে যাব তোমাদের থেকে চিরদিনের মত’।[1] এ কবিতা শুনে তাদের সবাই একযোগে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
[1]. ইবনু হিশাম ২/৬৭-৬৮; আর-রাহীক্ব ২৫৮ পৃঃ।
প্রতীক চিহ্ন (شعار الجيش الإسلامى)
ওহোদের দিন মুসলিম বাহিনীর সম্মিলিত প্রতীক চিহ্ন ছিলيا مَنْصُورُ أَمِتْ ‘হে বিজয়ী! মেরে ফেল’। মুহাজিরদের প্রতীক চিহ্ন ছিলيا بني عَبْد الرَّحْمَن ‘হে বনু আব্দুর রাহমান’। খাযরাজদের প্রতীক চিহ্ন ছিলيا بني عَبْد الله ‘হে বনু আব্দুল্লাহ’। আউসদের প্রতীক চিহ্ন ছিলيا بني عُبَيْد الله ‘হে বনু ওবায়দুল্লাহ’ (ইবনু সা‘দ ২/১০)।
যুদ্ধ শুরু (بدء القتال)
৩য় হিজরীর ৭ই শাওয়াল শনিবার সকালে যুদ্ধ শুরু হয়। সে যুগের রীতি অনুযায়ী কুরায়েশ বাহিনীর পতাকাবাহী এবং তাদের সেরা অশ্বারোহী বীরদের অন্যতম তালহা বিন আবু তালহা আব্দুল্লাহ আল-আবদারী উটে সওয়ার হয়ে এসে প্রথমে দ্বৈরথ যুদ্ধে মুকাবিলার আহবান জানান। মুসলিম বাহিনীর বামবাহুর প্রধান যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম (রাঃ) তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে এগিয়ে যান এবং সিংহের ন্যায় এক লাফে উটের পিঠে উঠে তাকে সেখান থেকে মাটিতে ফেলে যবেহ করে হত্যা করেন। এ অভাবনীয় দৃশ্য দেখে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ও ছাহাবীগণ খুশীতে তাকবীর ধ্বনি করেন।[1]
প্রধান পতাকাবাহীর পতনের পর তার পরিবারের আরও পাঁচ জন পরপর নিহত হয় এবং এভাবে দশ/বারো জন পতাকাবাহী মুসলিম বাহিনীর হাতে খতম হয়। যার মধ্যে একা কুযমান ৪ জনকে এবং আলী (রাঃ) ৮ জনকে হত্যা করেন। আউস গোত্রের বনু যাফর(بنو ظَفَر) বংশের কুযমান(قُزْمَان) ইবনুল হারেছ ছিল একজন মুনাফিক। সে এসেছিল নিজ বংশের গৌরব রক্ষার্থে, ইসলামের স্বার্থে নয়।
মাক্কী বাহিনীর পতাকাবাহীরা একে একে নিহত হওয়ার পর মুসলিম সেনাদল বীরদর্পে এগিয়ে যান ও মুশরিকদের সঙ্গে হাতাহাতি লড়াই শুরু হয়ে যায়। এই সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সকলকে আহবান করে বলেন,مَنْ يَأْخُذُ مِنِّى هَذَا؟ ‘কে আছ আমার এই তরবারি গ্রহণ করবে’? তখন সকলে আমি আমি বলে একযোগে এগিয়ে এলেন তরবারি নেবার জন্য। অতঃপর রাসূল (সাঃ) বললেন,فَمَنْ يَأْخُذُهُ بِحَقِّهِ ‘কে এটির হক সহ গ্রহণ করবে’? তখন লোকেরা ভিড় করল। এ সময় আবু দুজানাহ সিমাক বিন খারাশাহ(أَبُو دُجَانَةَ سِمَاكُ بْنُ خَرَشَةَ) বলে উঠলেন,أَنَا آخُذُهُ بِحَقِّهِ ‘আমি একে তার হক সহ গ্রহণ করব’। তখন রাসূল (সাঃ) তাকে তরবারিটি প্রদান করেন। অতঃপর তিনি মুশরিকদের মাথা বিদীর্ণ করতে লাগলেন’।[2]
এই যুদ্ধে হযরত হামযাহ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিবের বীরত্ব ছিল কিংবদন্তীতুল্য। প্রতিপক্ষের মধ্যভাগে প্রবেশ করে তিনি সিংহ বিক্রমে লড়াই করছিলেন। তাঁর অস্ত্রচালনার সামনে শত্রুপক্ষের কেউ টিকতে না পেরে সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। কিন্তু আল্লাহর এই সিংহকে কাপুরুষের মত গোপন হত্যার মাধ্যমে শহীদ করা হয়। তাকে হত্যাকারী ওয়াহ্শী বিন হারব ছিল মক্কার নেতা জুবায়ের বিন মুত্ব‘ইমের হাবশী গোলাম। যার চাচা তু‘আইমা বিন ‘আদী বদর যুদ্ধে নিহত হয়েছিল। ওয়াহ্শী ছিল বর্শা নিক্ষেপে পারদর্শী, যা সাধারণতঃ লক্ষ্যভ্রষ্ট হ’ত না। মনিব তাকে বলেছিল, তুমি আমার চাচা হত্যার বিনিময়ে যদি মুহাম্মাদের চাচা হামযাকে হত্যা করতে পার, তাহ’লে তুমি মুক্ত হয়ে যাবে’। ওয়াহশী বলেন যে, আমি কেবল আমার নিজের মুক্তির স্বার্থেই যুদ্ধে আসি এবং সর্বক্ষণ কেবল হামযার পিছনে লেগে থাকি। আমি একটি বৃক্ষ বা একটি পাথরের পিছনে ওঁৎ পেতে ছিলাম। ইতিমধ্যে যখন তিনি আমার সম্মুখে জনৈক মুশরিক সেনাকে এক আঘাতে দ্বিখন্ডিত করে ফেলেন এবং তাকে আমার আওতার মধ্যে পেয়ে যাই, তখনই আমি তাঁর অগোচরে তাঁর দিকে বর্শাটি ছুঁড়ে মারি, যা তাঁর নাভীর নীচ থেকে ভেদ করে ওপারে চলে যায়। তিনি আমার দিকে তেড়ে আসেন। কিন্তু পড়ে যান ও কিছুক্ষণ পরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আমি তাঁর দেহ থেকে বর্শাটি বের করে নিয়ে চলে আসি। এরপর মক্কায় ফিরে গেলে আমাকে আযাদ করে দেওয়া হয়।[3]
উল্লেখ্য যে, মক্কা বিজয়ের পর ওয়াহ্শী ত্বায়েফে পালিয়ে যান। অতঃপর সেখানকার প্রতিনিধি দলের সাথে ৯ম হিজরী সনে মদীনায় এসে রাসূল (সাঃ)-এর নিকট ইসলাম কবুল করেন। রাসূল (সাঃ) তাকে ভবিষ্যতে পুনরায় সামনে আসতে নিষেধ করেন। ফলে তিনি রাসূল (সাঃ)-এর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আর কখনো মদীনায় আসেননি। আবুবকর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ভন্ডনবী মুসায়লামা কাযযাবকে ইয়ামামার যুদ্ধে ঐ বর্শা দিয়েই তিনি হত্যা করেন এবং বলেন, فَإِنْ كُنْتُ قَتَلْتَهُ، فَقَدْ قَتَلْتُ خَيْرَ النَّاسِ بَعْدَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَقَدْ قَتَلْتُ شَرَّ النَّاسِ ‘যদি আমি তাকে হত্যা করে থাকি, তবে আমি রাসূল (সাঃ)-এর পরে শ্রেষ্ঠ মানুষটিকে হত্যা করেছিলাম। আর এখন আমি নিকৃষ্টতম মানুষটিকে হত্যা করলাম’।[4] রোমকদের বিরুদ্ধে ইয়ারমূকের যুদ্ধেও তিনি শরীক হন। তিনি ওছমান (রাঃ) অথবা আমীর মু‘আবিয়ার খেলাফতকালে ইরাকের হিমছে বসবাস করেন ও সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন’ (আল-ইছাবাহ ক্রমিক সংখ্যা ৯১১৫)।
‘সাইয়িদুশ শুহাদা’ হযরত হামযা বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত ওহোদ যুদ্ধে তিনি একাই ৩০ জনের অধিক শত্রুসেনাকে হত্যা করেন।[5] কেবল আবু দুজানা ও হামযা নন, অন্যান্য বীরকেশরী ছাহাবীগণের অতুলনীয় বীরত্বের সম্মুখে কাফির বাহিনী কচুকাটা হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এমনকি তারা তাদের সেনা শিবির ছেড়ে সবকিছু ফেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালাতে থাকে। বারা ইবনু ‘আযেব (রাঃ) বলেন, মুশরিক বাহিনীর মধ্যে পালানোর হিড়িক পড়ে গেল। তাদের নারীরা পায়ের গোছা বের করে ছুটতে লাগল। মুসলিম বাহিনী তাদের পিছনে তরবারি নিয়ে ধাওয়া করল। অতঃপর সবাই তাদের পরিত্যক্ত গণীমতের মাল জমা করতে শুরু করল’ (বুখারী হা/৪০৪৩)।
[1]. আর-রাহীক্ব ২৫৯ পৃঃ। মুবারকপুরী বলেন, এ সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যুবায়েরের প্রশংসায় বলেন,إِنَّ لِكُلِّ نَبِيٍّ حَوَارِيًّا، وَحَوَارِيَّ الزُّبَيْرُ ‘নিশ্চয়ই প্রত্যেক নবীর একজন নিকট সহচর থাকেন। আমার সহচর হ’ল যুবায়ের’। এই কথাটি রাসূল (সাঃ) খন্দকের যুদ্ধে বনু কুরায়যা কুরায়েশদের সাথে চুক্তি ভঙ্গ করেছে কি না, তার খবর সংগ্রহের কাজে তাকে নিযুক্তিকালে বলেছিলেন’ (বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৪১১৩), ওহোদের যুদ্ধে নয়।
[2]. মুসলিম হা/২৪৭০; ইবনু হিশাম ২/৬৬।
প্রসিদ্ধ আছে যে, এ সময় আবু দুজানাহ বলেন, وَمَا حَقُّهُ يَا رَسُولَ اللهِ؟ হে আল্লাহর রাসূল! এ তরবারির হক কি? জবাবে রাসূল (সাঃ) বললেন, أَن تَشْرَبَ بِهِ الْعَدُوَّ حَتَّى يَنْحَنِيَ ‘তুমি এর দ্বারা শত্রু খতম করবে, যাতে ওরা দূরে সরে যায়’। তখন আবু দুজানাহ বললেন, أَنَا آخُذُهُ يَا رَسُولَ اللهِ بِحَقِّهِ ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি এর হক সহ গ্রহণ করব। অতঃপর রাসূল (সাঃ) তাকে তরবারি প্রদান করলেন’ (ইবনু হিশাম ২/৬৬; আর-রাহীক্ব ২৫৬ পৃঃ)। ইবনু ইসহাক বর্ণনা করেন যে, এ সময় আবু দুজানার গর্বিত পদক্ষেপ দেখে রাসূল (সাঃ) বলেন, إِنَّهَا لَمِشْيَةٌ يُبَغِضُهَا اللهُ إِلاَّ فِي مِثْلِ هَذَا الْمَوْطِنِ ‘নিশ্চয়ই এরূপ চলনকে আল্লাহ অপসন্দ করেন। কিন্তু এইরূপ স্থান ব্যতীত’ (ইবনু হিশাম ২/৬৭; আর-রহাীক্ব ২৫৭)। এটি সহ উপরের বর্ণনাটি ‘মুরসাল’ ও ‘মুনক্বাতি‘ বা যঈফ (মা শা-‘আ ১৫৩ পৃঃ)। এক্ষেত্রে সঠিক অতটুকুই যা উপরে ছহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে।
যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ)-এর তরবারি চেয়েও না পাওয়াতে আমি দুঃখিত ছিলাম। আমি রাসূল (সাঃ)-এর ফুফু ছাফিয়ার পুত্র এবং কুরায়েশ বংশীয়। তাছাড়া আমি তার পূর্বেই তরবারিটি চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি ওটি তাকে দিলেন, আমাকে দিলেন না। অতএব আল্লাহর কসম! আমি অবশ্যই দেখব সে তরবারিটি নিয়ে কি করে? অতঃপর আমি তার পিছু নিলাম। দেখলাম সে লাল পাগড়ীটি বের করল এবং মাথায় বাঁধল। তখন আনছাররা বলল, আবু দুজানাহ এবার মৃত্যুর পাগড়ী (عِصَابَةُ الْمَوْتِ) বের করল। এভাবেই তারা বলত, যখন সে ঐ পাগড়ী বাঁধত। অতঃপর সে নিম্নোক্ত কবিতা পড়তে পড়তে বের হ’ল।-
أَنَا الَّذِي عَاهَدَنِي خَلِيلِي + وَنَحْنُ بِالسَّفْحِ لَدَى النَّخِيلِ
أَلاَّ أَقَوْمَ الدَّهْرَ فِي الْكَيُّولِ + أَضْرِبُ بِسَيْفِ اللهِ وَالرَّسُولِ
‘আমি সেই ব্যক্তি যার নিকট থেকে আমার বন্ধু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অঙ্গীকার নিয়েছেন, যখন আমরা খেজুর বাগানের প্রান্তে ছিলাম’। এই মর্মে যে, ‘কখনোই আমি পিছনের সারিতে থাকবো না। বরং সর্বদা সম্মুখ সারিতে থেকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের তরবারি দ্বারা প্রতিপক্ষকে মারব’। অতঃপর সে শত্রুপক্ষের যাকেই পেল, তাকেই শেষ করে ফেলল। এভাবে দেখলাম একজন মুশরিক তাকে মারতে উদ্যত হ’ল। তখন আবু দুজানাহ তাকে পাল্টা মার দিয়ে শেষ করে দিল। অতঃপর দেখলাম হিন্দ বিনতে উৎবার মাথার উপরে সে তরবারি উঠালো। অতঃপর ফিরিয়ে নিল। আবু দুজানাহ বলেন, আমি মানুষের ভিড়ে একজনের উপরে তরবারি উঠালে সে হায়! হায়! করে ওঠে। বুঝলাম সে একজন নারী। তখন আমি রাসূল (সাঃ)-এর তরবারির সম্মানে তাকে মারা থেকে বিরত হই’ (ইবনু হিশাম ২/৬৮-৬৯; আর-রাহীক্ব ২৬০-৬১ পৃঃ)। বর্ণনাগুলি সনদবিহীন বা ‘যঈফ’ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১০৯৮-৯৯, ১১০০)।
উক্ত নারী ছিলেন আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উৎবাহ। বদর যুদ্ধে তার পিতা উৎবাহ, চাচা শায়বাহ, ভাই অলীদ ও পুত্র হানযালা বিন আবু সুফিয়ান নিহত হয় এবং যার প্রতিশোধ নিতেই তিনি ওহোদ যুদ্ধে এসেছিলেন ও নর্তকী দলের নেতৃত্ব দিয়ে নিজ দলের সৈন্যদের উত্তেজিত করছিলেন (ইবনু হিশাম ২/৬৮; আর-রাহীক্ব ২৫৮ পৃঃ)।
[3]. বুখারী হা/৪০৭২; ইবনু হিশাম ২/৭১-৭২।
[4]. ইবনু হিশাম ২/৭২-৭৩; বায়হাক্বী হা/১৭৯৬৭, ৯/৯৭-৯৮; ফাৎহুল বারী হা/৪০৭২-এর আলোচনা।
[5]. আল-ইছাবাহ, হামযা বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব, ক্রমিক ১৮২৮।
তীরন্দাযদের ভুল ও তার খেসারত (خطأ الرماة وخسارته)
কাফিরদের পলায়ন ও মুসলিম বাহিনীর গণীমত জমা করার হিড়িক দেখে গিরিপথ রক্ষী তীরন্দায দল ভাবল যে, যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। অতএব আর এখানে থাকার কি প্রয়োজন? গণীমতের মাল ও দুনিয়ার লোভরূপী শয়তান সাময়িকভাবে তাদের মাথায় চেপে বসল। ‘গণীমত’ ‘গণীমত’(الْغَنِيمَةَ الْغَنِيمَةَ) বলতে বলতে তারা ময়দানের দিকে ছুটে চলল’। দলপতি আব্দুল্লাহ ইবনু জুবায়ের আনছারী (রাঃ) তাদেরকে বলেন, أَنَسِيتُمْ مَا قَالَ لَكُمْ رَسُولُ اللهِ- صلى الله عليه وسلم- قَالُوا وَاللهِ لَنَأْتِيَنَّ النَّاسَ فَلَنُصِيبَنَّ مِنَ الْغَنِيمَةِ ‘তোমরা কি ভুলে গেলে রাসূল (সাঃ) তোমাদেরকে কি বলেছিলেন? জবাবে তারা বলল, আল্লাহর কসম! আমরা অবশ্যই লোকদের সঙ্গে গণীমত কুড়াব’ (বুখারী হা/৩০৩৯)। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, অতঃপর তিনি ও তাঁর সাথী একদল শহীদ হয়ে যান।[1] ওয়াক্বেদী বলেন, তাদের সংখ্যা অনধিক দশ জন ছিল (ওয়াক্বেদী ১/২৩০)।
শত্রুপক্ষের অশ্বারোহী বাহিনীর ধুরন্ধর সেনাপতি খালেদ বিন অলীদ সুযোগ বুঝে নক্ষত্র বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে এসে ঐ ক্ষুদ্র বাহিনীর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আব্দুল্লাহ ইবনু জুবায়ের ও তাঁর সাথীগণ সকলে প্রাণপণ লড়াই করে শহীদ হয়ে গেলেন। অতঃপর খালেদ ও তার পশ্চাদবর্তী কুরায়েশ সেনাদল অতর্কিতে এসে অপ্রস্ত্তত মুসলিম বাহিনীর উপরে হামলা করল। ঐ সময় ‘আমরাহ বিনতে ‘আলক্বামা(عَمْرة بنتُ عَلْقمةَ الحارثِيَّةُ) নাম্মী জনৈকা কুরায়েশ মহিলা তাদের ভূলুণ্ঠিত পতাকা তুলে ধরলে চারদিক থেকে মাক্কী বাহিনী পুনরায় ময়দানে ছুটে আসে এবং অগ্র-পশ্চাৎ সবদিক থেকে মুসলিম বাহিনীকে ঘিরে ফেলে। শুরু হয় মহা পরীক্ষা। নেমে আসে মহা বিপর্যয়। এই সময় রাসূল (সাঃ)-এর সঙ্গে ছিলেন মাত্র ১২জন ছাহাবী (বুখারী হা/৩০৩৯)। পতাকাবাহী মুছ‘আব বিন ওমায়ের শহীদ হন। তার শাহাদাতের পর রাসূল (সাঃ) যুদ্ধের পতাকা আলী (রাঃ)-এর হাতে তুলে দেন (ইবনু হিশাম ২/৭৩)। অতঃপর তিনি সুকৌশলে স্বীয় বাহিনীকে উচ্চভূমিতে তাঁর ঘাঁটিতে ফিরিয়ে নিতে সক্ষম হন। তীরন্দাযদের ভুলের কারণে মুসলিম বাহিনীর নিশ্চিত বিজয় এভাবে বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে শেষ হয়।
[1]. সুহায়লী, আর-রাউযুল উনুফ ৩/৩০৩; ইবনু হিশাম ২/১১৩ টীকা-১।
জয়-পরাজয় পর্যালোচনা (مراجعة الغلبة والهزيمة)
ওহোদ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী প্রথম দিকে বিজয়ী হয় এবং শত্রুবাহিনী ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু তীরন্দাযগণের মারাত্মক ভুলের কারণে অরক্ষিত গিরিসংকট দিয়ে শত্রুবাহিনী অতর্কিতে ময়দানে ঢুকে পড়ে। যাতে মুসলিম বাহিনী চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজে আহত হন। তাঁর দান্দান মুবারক শহীদ হয়। এছাড়া মুসলিম বাহিনীর সর্বমোট ৭০ জন শাহাদাত বরণ করেন। যার মধ্যে মুহাজির ৪ জন, ইহূদী ১ জন, বাকী ৬৫ জন আনছারের মধ্যে আউস গোত্রের ২৪ জন ও খাযরাজ গোত্রের ৪১ জন ছিলেন। কুরায়েশ বাহিনীর নিহতের সংখ্যা সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ মতভেদ করেছেন। কেউ বলেছেন ২২ জন, কেউ বলেছেন ৩৭ জন। কিন্তু এ হিসাব মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা তারাই বলছেন যে, একা হামযা (রাঃ) ৩০ জনের অধিক শত্রুসৈন্য খতম করেছেন’। তাছাড়া আলী (রাঃ) হত্যা করেছেন ৮ জনকে, কুযমান ৭ অথবা ৮ জনকে। এতদ্ব্যতীত যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম, মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ, আবু দুজানা, আবুবকর, ওমর, আছেম বিন ছাবেত, হাতেব বিন আবু বালতা‘আহ, আবু তালহা, তালহা বিন উবায়দুল্লাহ, মুছ‘আব বিন উমায়ের, উসায়েদ বিন হুযায়ের, হুবাব ইবনুল মুনযির, সা‘দ বিন মু‘আয, সা‘দ বিন ওবাদাহ, সা‘দ ইবনু আবী ওয়াকক্বাছ, সা‘দ বিন রাবী‘, নযর বিন আনাস, আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ, হানযালাহ, হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান ও তাঁর পিতা ইয়ামান, আবু সাঈদ খুদরীর পিতা মালিক ইবনু সিনান, জাবের-এর পিতা আব্দুল্লাহ বিন হারাম, হারিছ ইবনু ছিম্মাহ, উছায়রিম, মুখাইরীক্ব, আব্দুল্লাহ বিন জাহ্শ, রাফে‘ বিন খাদীজ, সামুরাহ বিন জুনদুব, মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ, ক্বাতাদাহ বিন নু‘মান, আনাস বিন নাযার, ছাবিত বিন দাহদাহ ও তার সঙ্গীরা, আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ, সাহল বিন হুনাইফ প্রমুখ বীর যোদ্ধাদের হাতে কত শত্রুসৈন্য খতম হয়েছে, তার হিসাব কোথায়? তিন হাযারের দুর্ধর্ষ কুরায়েশ বাহিনী কোনরূপ চরম মূল্য না দিয়েই কি ময়দান ছেড়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালিয়েছিল? অতএব মুসলিম বীরদের হাতে তাদের যে অগণিত সৈন্য হতাহত হয়েছিল, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকার কথা নয়।
দ্বিতীয়তঃ কুরায়েশ বাহিনী বিজয়ী হ’লে মুসলিম বাহিনীর ঘাঁটি দখল করল না কেন? তাদের মালামাল লুট করল না কেন? তারা মদীনার উপরে চড়াও হ’ল না কেন? সে যুগের প্রথানুযায়ী বিজয়ী দল হিসাবে তারা সেখানে ৩ দিন অবস্থান করল না কেন? কেন একজন মুসলিম সৈন্যও তাদের হাতে বন্দী হ’ল না? অথচ কাফের বাহিনীর দু’জন কবির অন্যতম আবু ‘আযযাহ মুসলিম বাহিনীর হাতে বন্দী হয় এবং ইতিপূর্বে বদরের যুদ্ধে বন্দী হওয়ার পর মুক্তিপণ হিসাবে কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করায় তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। অতএব এটাকে ‘অমীমাংসিত যুদ্ধ’ বলা চলে। তবে আখেরাতের হিসাবে মুসলমানেরাই বিজয়ী এবং সর্বদা লাভবান তারাই। এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَهِنُوْا فِي ابْتِغَاءِ الْقَوْمِ إِنْ تَكُوْنُوْا تَأْلَمُوْنَ فَإِنَّهُمْ يَأْلَمُوْنَ كَمَا تَأْلَمُوْنَ وَتَرْجُوْنَ مِنَ اللهِ مَا لاَ يَرْجُوْنَ وَكَانَ اللهُ عَلِيْماً حَكِيْمًا ‘শত্রুদলের পশ্চাদ্ধাবনে তোমরা শৈথিল্য প্রদর্শন করো না। যদি তোমরা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে থাক, তবে তারাও আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে যেমন তোমরা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছ। (পার্থক্য এই যে,) তোমরা আল্লাহর নিকট থেকে (জান্নাত) আশা কর, যা তারা করে না। আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়’ (নিসা ৪/১০৪)।
তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত (الرماة الخطّاؤون مغفورون)
আল্লাহ তীরন্দাযদের সাময়িক পদস্খলনকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেন, إِنَّ الَّذِينَ تَوَلَّوْا مِنْكُمْ يَوْمَ الْتَقَى الْجَمْعَانِ إِنَّمَا اسْتَزَلَّهُمُ الشَّيْطَانُ بِبَعْضِ مَا كَسَبُوا وَلَقَدْ عَفَا اللهُ عَنْهُمْ إِنَّ اللهَ غَفُورٌ حَلِيمٌ ‘তোমাদের মধ্যে যারা (ওহোদের যুদ্ধে) দু’দলের মুখোমুখি হবার দিন ঘাঁটি থেকে ফিরে গিয়েছিল, তাদের নিজেদের কিছু কৃতকর্মের দরুন শয়তান তাদের প্রতারিত করেছিল, আল্লাহ তাদের ক্ষমা করেছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও সহনশীল’ (আলে ইমরান ৩/১৫৫)।
সেই সাথে তাদেরকে সাবধান করে দেওয়া হ’ল যে, উম্মতের সামষ্টিক স্বার্থ জড়িত কোন কাজে শরীক হ’লে কেউ যেন আমীরের অনুমতি ছাড়া চলে না যায়। আল্লাহ বলেন,
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آمَنُوا بِاللهِ وَرَسُولِهِ وَإِذَا كَانُوا مَعَهُ عَلَى أَمْرٍ جَامِعٍ لَمْ يَذْهَبُوا حَتَّى يَسْتَأْذِنُوهُ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَأْذِنُونَكَ أُولَئِكَ الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَرَسُولِهِ فَإِذَا اسْتَأْذَنُوكَ لِبَعْضِ شَأْنِهِمْ فَأْذَنْ لِمَنْ شِئْتَ مِنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمُ اللهَ إِنَّ اللهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ- (نور 62)-
‘মুমিন তো কেবল তারাই, যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং যখন তারা তার সঙ্গে কোন সমষ্টিগত গুরুত্বপূর্ণ কাজে সাথী হয়, তখন যেন তারা চলে না যায় তার কাছ থেকে অনুমতি না নেওয়া পর্যন্ত। নিশ্চয়ই যারা তোমার কাছে অনুমতি প্রার্থনা করে, তারাই আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি বিশ্বাসী। অতএব তারা তাদের কোন কাজে তোমার নিকট অনুমতি চাইলে তাদেরকে তুমি অনুমতি দাও যাকে চাও। আর তাদের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (নূর ২৪/৬২)।
‘হামরাউল আসাদ’ (حمراء الأسد)
মদীনা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে মক্কার দিকে ৮ মাইল বা ১২ কি. মি. দূরে অবস্থিত। কুরায়েশ বাহিনী পুনরায় হামলা করতে পারে এই আশংকায় ওহোদ যুদ্ধের পরদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ৮ই শাওয়াল রবিবার তাদের পশ্চাদ্ধাবনের জন্য পুনরায় যুদ্ধ যাত্রা করেন কেবলমাত্র ঐসব সেনাদের নিয়ে যারা আগের দিন ওহোদ যুদ্ধে শরীক ছিলেন। যাদের সংখ্যা ছিল ৭০ জন। পরে যোগদানকারী ছাহাবীগণ সহ মোট সংখ্যা দাড়ায় ৬৩০ জন।[1] আয়েশা (রাঃ) আলে ইমরান ১৭২ আয়াত নাযিলের কারণ হিসাবে ভাগিনা উরওয়া বিন যুবায়েরকে বলেন, তোমার পিতা যুবায়ের ও নানা আবুবকর ঐ দলের মধ্যে ছিলেন। যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ওহোদের দিন বিপদগ্রস্ত হ’লেন এবং মুশরিকরা ফিরে গেল, তখন তিনি আশংকা করলেন যে, ওরা ফিরে আসতে পারে। রাসূল (সাঃ) বললেন, কারা ওদের পিছু ধাওয়া করবে? অতঃপর তিনি লোকদের মধ্য থেকে সত্তুর জনকে বাছাই করলেন। উরওয়া বলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন, আবুবকর ও যুবায়ের’ (বুখারী হা/৪০৭৭)। অর্থাৎ তোমার পিতা ও আমার পিতা। ইবনু কাছীর বলেন, এটি ছিল হামরাউল আসাদ-এর দিন’। আয়াতটি ছিল, الَّذِينَ اسْتَجَابُوا لِلَّهِ وَالرَّسُولِ مِنْ بَعْدِ مَا أَصَابَهُمُ الْقَرْحُ لِلَّذِينَ أَحْسَنُوا مِنْهُمْ وَاتَّقَوْا أَجْرٌ عَظِيمٌ- الَّذِينَ قَالَ لَهُمُ النَّاسُ إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيمَانًا وَقَالُوا حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ‘যারা নিজেরা যখমপ্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ ও রাসূলের ডাকে সাড়া দিয়েছিল, তাদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করেছে ও আল্লাহভীরুতা অবলম্বন করেছে, তাদের জন্য রয়েছে মহান পুরস্কার’। ‘যাদেরকে লোকেরা বলেছিল, নিশ্চয়ই তারা (কুরায়েশ বাহিনী) তোমাদের বিরুদ্ধে সমবেত হয়েছে। অতএব তোমরা তাদের থেকে ভীত হও। একথা শুনে তাদের ঈমান আরও বৃদ্ধি পায় এবং তারা বলে ‘আমাদের জন্য আল্লাহ যথেষ্ট। তিনি কতই না সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক!’ (আলে ইমরান ৩/১৭২-৭৩)।[2] মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই অনুমতি চেয়েও ব্যর্থ হয়। তবে সঙ্গত কারণে রাসূল (সাঃ) জাবের বিন আব্দুল্লাহকে অনুমতি দেন এবং ৮ মাইল দূরে ‘হামরাউল আসাদ’(حَمْرَاء الْأَسَد) নামক স্থানে গিয়ে শিবির সন্নিবেশ করেন। অতঃপর চারদিন সেখানে অবস্থান শেষে ১২ই শাওয়াল মদীনায় ফিরে আসেন।
ঘটনা ছিল এই যে, হামরাউল আসাদ পৌঁছে মা‘বাদ বিন আবু মা‘বাদ আল-খুযাঈ নামক জনৈক ব্যক্তি মুসলমান হন। তিনি রাসূল (সাঃ)-এর হিতাকাংখী ছিলেন। তাছাড়া বনু হাশেম ও বনু খুযা‘আহর মধ্যে জাহেলী যুগ থেকেই মৈত্রীচুক্তি ছিল। তিনি রাসূল (সাঃ)-এর নিকট থেকে অনুমতি নিয়ে আবু সুফিয়ানের নিকট গমন করেন। আবু সুফিয়ানের বাহিনী তখন মদীনা থেকে ৬৮ কি. মি. দক্ষিণে ‘রাওহা’ (الروحاء)-তে অবতরণ করেছে। সে সময় সাথীদের চাপে আবু সুফিয়ান পুনরায় মদীনায় হামলার প্রস্ত্ততি নিচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় মা‘বাদ সেখানে পৌঁছে যান এবং আবু সুফিয়ানকে রাসূল (সাঃ)-এর পশ্চাদ্ধাবন বিষয়ে অবহিত করেন। অতঃপর তাকে দারুণভাবে ভীত করে ফেলেন। এমনকি এ কথাও বলেন যে, মুহাম্মাদের বিশাল বাহিনী টিলার পিছনে এসে গেছে। তোমরা এখুনি পালাও। আবু সুফিয়ান তার ইসলাম গ্রহণের কথা জানতেন না। ফলে তার কথায় বিশ্বাস করে দ্রুত মক্কায় ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। তবে মা‘বাদকে বলে দিলেন তুমি মুহাম্মাদকে জানিয়ে দিয়ো যে, আমরা অতি সত্বর পুনরায় তাদের উপর হামলা করব এবং তাকে ও তার সাথীদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলব’। মা‘বাদ রাযী হলেন। অতঃপর তিনি রাসূল (সাঃ)-এর নিকট এসে উক্ত খবর জানালে মুসলিম বাহিনীর ঈমানী তেজ আরো বেড়ে যায় এবং তারা বলে ওঠেন, حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ ‘আমাদের জন্য আল্লাহ যথেষ্ট’। আর তিনি কতই না সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক’। এর মাধ্যমে দুই ঈমানী কণ্ঠের মিল হয়ে যায়। (প্রায় আড়াই হাযার বছর পূর্বে) নমরূদের আগুনে নিক্ষেপকালে পিতা ইবরাহীম (আঃ) একই কথা বলেছিলেন।
আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, (حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ) قَالَهَا إِبْرَاهِيمُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ حِينَ أُلْقِىَ فِى النَّارِ، وَقَالَهَا مُحَمَّدٌ- صلى الله عليه وسلم - حِينَ قَالُوا إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيمَانًا وَقَالُوا حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ ‘হাসবুনাল্লাহ... কথাটি ইবরাহীম (আঃ) বলেছিলেন যখন তিনি আগুনে নিক্ষিপ্ত হন। আর একই কথা মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছিলেন যখন লোকেরা তাঁকে বলল যে, শত্রুরা তোমাদের বিরুদ্ধে সমবেত হচ্ছে। অতএব তাদেরকে তোমরা ভয় কর। একথা তাদের ঈমান আরও বৃদ্ধি করে দেয় এবং তারা বলে ওঠে হাসবুনাল্লাহ ‘আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। আর তিনি কতইনা সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক’।[3] বস্ত্ততঃ সকল যুগের ঈমানদারগণ চূড়ান্ত বিপদে সর্বদা একই কথা বলে থাকেন।
অন্য দিকে আবু সুফিয়ানের গুপ্তচর মু‘আবিয়া বিন মুগীরাহ বিন আবুল ‘আছ যে ব্যক্তি উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ানের নানা ছিল, মদীনায় পৌঁছে তার চাচাতো ভাই ওছমান (রাঃ)-এর নিকটে আশ্রয় নেয়। ওছমানের আবেদনক্রমে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে তিন দিনের জন্য অনুমতি দেন এবং বলেন, এর পরে পাওয়া গেলে তাকে হত্যা করা হবে। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মদীনা ছেড়ে গেলে সে গোপন সংবাদ সংগ্রহে লিপ্ত হয় এবং ৪ দিন পর রাসূল (সাঃ) ফিরে আসার সাথে সাথে পালিয়ে যায়। তখন তিনি যায়েদ বিন হারেছাহ ও ‘আম্মার বিন ইয়াসিরকে পাঠান এবং তার পিছু ধাওয়া করে তাকে পাকড়াও করে হত্যা করেন (ইবনু হিশাম ২/১০৪)। এভাবে ওহোদ যুদ্ধের পরবর্তী চক্রান্ত সমূহ শেষ করে দিয়ে রাসূল (সাঃ) নিশ্চিন্ত হন।
[1]. আল-বিদায়াহ ৪/৪৮-৪৯; ইবনু সা‘দ ২/৩৭-৩৮; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৯৭।
[2]. ইবনু কাছীর, তাফসীর আলে ইমরান ১৭২-৭৩ আয়াত।
[3]. বুখারী হা/৪৫৬৩; ইবনু হিশাম ২/১০৩।
(১) প্রসিদ্ধ আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আলী ইবনু আবী ত্বালেবকে মুশরিক বাহিনীর পিছু ধাওয়া করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, দেখ তারা কি করছে? যদি তারা ঘোড়া একপাশ করে বা উট প্রস্ত্তত করে, তাহ’লে বুঝতে হবে যে, ওরা মক্কায় ফিরে যাবে। আর যদি ওরা ঘোড়ায় সওয়ার হয় ও উট হাঁকায়, তাহ’লে বুঝতে হবে যে, ওরা মদীনা মুখে যাবে। যার হাতে আমার জীবন, তার কসম! করে বলছি, যদি তারা মদীনার সংকল্প করে, তাহ’লে আমি অবশ্যই তাদের প্রতি সৈন্য পরিচালনা করব এবং অবশ্যই তাদের মুকাবিলা করব’। আলী বললেন, অতঃপর আমি তাদের পশ্চাদ্ধাবন করলাম এবং দেখলাম যে, তারা মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হ’ল’ (ইবনু হিশাম ২/৯৪; আর-রাহীক্ব ২৭৯ পৃঃ)।
ইবনু ইসহাক এটি বিনা সনদে বর্ণনা করেছেন। ইবনু হাজার পিছু ধাওয়াকারীর নাম বলেছেন, সা‘দ ইবনু আবী ওয়াকক্বাছ। এটি ওয়াক্বেদী স্বীয় মাগাযীতে উল্লেখ করেছেন। ইবনু আবী হাতেম, ইকরিমা থেকে বর্ণনা করেন যে, যখন মুশরিকরা ওহোদ থেকে ফিরে যায়, তখন তারা বলেছিল, না মুহাম্মাদকে তোমরা হত্যা করতে পারলে, না তাদের নারীদের তোমরা হালাল করতে পারলে? কত মন্দ কাজই না তোমরা করলে? ফিরে চল! এ কথা রাসূল (সাঃ) শুনতে পেলেন। অতঃপর তিনি মুসলমানদেরকে উৎসাহিত করলেন। তখন তারা এতে সাড়া দিয়ে পিছু ধাওয়া করল এবং হামরাউল আসাদ অথবা আবু উয়াইনার কূয়ার নিকটে (রাবী সুফিয়ানের সন্দেহ) পৌঁছে গেল। তখন মুশরিকরা বলল, আমরা আগামী বছর পুনরায় আসব। অতঃপর রাসূল (সাঃ) ফিরে এলেন। সেকারণ এটিকে ‘গাযওয়া’ হিসাবে গণ্য করা হয়। অতঃপর উক্ত উপলক্ষ্যে আল্লাহ আলে ইমরান ১৭২ আয়াত নাযিল করেন (ইবনু কাছীর, তাফসীর উক্ত আয়াত)। বর্ণনাটির সনদ ‘মুরসাল’ বা যঈফ (মা শা-‘আ ১৫৫-৫৬ পৃঃ)।
(২) এখানে আরও একটি ঘটনা প্রসিদ্ধ আছে যে, ওহোদ যুদ্ধ শেষে আবু সুফিয়ান যখন মক্কার দিকে ফিরে যান, তখন রাসূল (সাঃ) মু‘আবিয়া বিন মুগীরা ইবনুল ‘আছ এবং আবু ‘আযযাহ আল-জুমাহীকে গ্রেফতার করেন। এ দু’জন ব্যক্তি ইতিপূর্বে বদর যুদ্ধে বন্দী হয়েছিল। অতঃপর রাসূল (সাঃ) তাদের উপরে অনুকম্পা দেখান এবং আর কখনো মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেনা বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু তারা মক্কায় ফিরে গিয়ে কাফিরদের সঙ্গে মিশে যায় এবং ওহোদের যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যোগদান করে। অতঃপর বন্দী হয়ে তারা আগের মতই বলে, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদেরকে আশ্রয় দিন। তখন রাসূল (সাঃ) আবু ‘আযযাহকে বলেন, আল্লাহর কসম! তুমি এরপরে মক্কায় গিয়ে তোমার দু্ই ভ্রূতে হাত দিয়ে আর বলতে পারবে না যে, আমি মুহাম্মাদকে দু’বার ধোঁকা দিয়েছি। হে যুবায়ের! ওর গর্দান উড়িয়ে দাও। অতঃপর তিনি তার গর্দান উড়িয়ে দিলেন’। ইবনু হিশাম বলেন, আমার কাছে সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব থেকে খবর পৌঁছেছে যে, তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) অতঃপর বলেন, لاَ يُلْدَغُ الْمُؤْمِنُ مِنْ جُحْرٍ وَاحِدٍ مَرَّتَيْنِ ‘নিশ্চয়ই মুমিন এক গর্তে দু’বার দংশিত হয় না’। হে ‘আছেম বিন ছাবিত! ওর গর্দান উড়িয়ে দাও। অতঃপর তিনি তার গর্দান উড়িয়ে দিলেন’ (ইবনু হিশাম ২/১০৪)। বর্ণনাটি সনদবিহীন। অতএব যঈফ (মা শা-‘আ ১৫৭-৫৮)। তবে ‘মুমিন এক গর্তে দু’বার দংশিত হয় না’ হাদীছটি ‘ছহীহ’ (বুখারী হা/৬১৩৩; মুসলিম হা/২৯৯৮; মিশকাত হা/৫০৫৩)।
(৩) আরও প্রসিদ্ধ আছে যে, ওহোদ যুদ্ধের পরদিন সকালে রাসূল (সাঃ) লোকদের মধ্যে ঘোষণা জারী করে দেন যে, لاَ يَخْرُجْ مَعَنَا إلاَّ مَنْ شَهِدَ الْقِتَالَ ‘আমাদের সঙ্গে কেউ বের হবে না কেবল তারা ব্যতীত, যারা (গতকাল) যুদ্ধে যোগদান করেছিল’। তখন আব্দুল্লাহ বিন উবাই বললেন, আমাকে আপনার সাথে নিন’। জবাবে রাসূল (সাঃ) বললেন, না’। ... পরে জাবের বিন আব্দুল্লাহ তাঁর নিকটে অনুমতি চাইলেন এবং বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি চাই আপনার সাথে সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি’...। তখন রাসূল (সাঃ) তাকে অনুমতি দিলেন’ (আর-রাহীক্ব ২৮৪ পৃঃ)। বর্ণনাটি ‘মুরসাল’ (ঐ, তা‘লীক্ব ১৫৫ পৃঃ)।
ওহোদ যুদ্ধের বিষয়ে কুরআন ও বিপর্যয়ের রহস্য (القرآن فى غزوة أحد وسر النكبة)
ওহোদ যুদ্ধ সম্পর্কে সূরা আলে ইমরানের ১২১ হ’তে ১৭৯ পর্যন্ত পরপর ৬০টি আয়াত নাযিল হয়। যার মধ্যে যুদ্ধের এক একটি পর্বের আলোচনা করা হয়েছে। অতঃপর ঐসব কারণগুলি চিহ্নিত করা হয়েছে যেগুলির ফলে মুসলিম বাহিনী মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সেখানে মুনাফিকদের অপতৎপরতার কথাও উল্লেখিত হয়েছে। অতঃপর যুদ্ধের ফলাফল ও এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের উপরে আলোকপাত করে বলা হয়েছে, مَا كَانَ اللهُ لِيَذَرَ الْمُؤْمِنِيْنَ عَلَى مَا أَنتُمْ عَلَيْهِ حَتَّىَ يَمِيْزَ الْخَبِيْثَ مِنَ الطَّيِّبِ وَمَا كَانَ اللهُ لِيُطْلِعَكُمْ عَلَى الْغَيْبِ ‘অপবিত্রকে পবিত্র হ’তে পৃথক করে না দেয়া পর্যন্ত আল্লাহ এমন নন যে, ঈমানদারগণকে সে অবস্থাতেই ছেড়ে দিবেন, যে অবস্থায় তোমরা আছ। আর আল্লাহ এমন নন যে, তোমাদেরকে গায়েবের খবর জানাবেন...’ (আলে ইমরান ৩/১৭৯)।
অর্থাৎ মুনাফিকদের পৃথক করা ও মুমিনদের ঈমানের দৃঢ়তা পরখ করা ছিল এ যুদ্ধের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। আর একথাগুলি অহীর মাধ্যমে না জানিয়ে বাস্তব প্রমাণের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়াই ছিল ওহোদ যুদ্ধে বিপর্যয়ের অন্যতম রহস্য।
ইবনু হাজার বলেন, বিদ্বানগণ বলেন যে, ওহোদ যুদ্ধে মুসলমানদের বিপর্যয়ের মধ্যে আল্লাহর বিশেষ তাৎপর্য সমূহ নিহিত ছিল। যেমন- (১) রাসূল (সাঃ)-এর অবাধ্যতার পরিণাম সম্পর্কে মুসলমানদের হুঁশিয়ার করা। কেননা তীরন্দাযগণের অবাধ্যতার ফলে আকস্মিক এই বিপর্যয় নেমে আসে (২) রাসূলগণের জন্য সাধারণ নিয়ম এই যে, তারা প্রথমে বিপদগ্রস্ত হন এবং শেষে বিজয়ী হন। কেননা যদি তাঁরা সর্বদা কেবল বিজয়ী হ’তে থাকেন, তাহ’লে মুমিনদের মধ্যে এমন লোকও ঢুকে পড়বে, যারা তাদের নয়। আবার যদি তারা কেবল পরাজিত হ’তেই থাকেন, তাহ’লে রাসূল প্রেরণের উদ্দেশ্যই হাছিল হবে না। সেকারণ জয় ও পরাজয় দু’টিই একত্রে রাখা হয়, যাতে প্রকৃত বিশ্বাসী ও কপট বিশ্বাসীদের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায়। (৩) কোন কোন ক্ষেত্রে আল্লাহর সাহায্য দেরীতে আসলে মুমিনদের হৃদয়ে অধিক নম্রতার সৃষ্টি হয় এবং অহংকার চূর্ণ হয়। তারা অধিক ধৈর্যশীল হয়। পক্ষান্তরে মুনাফিকগণ দিশেহারা হয়। (৪) আল্লাহ মুমিন বান্দাদের জন্য জান্নাতে উচ্চ মর্যাদার এমন স্তরসমূহ নির্ধারণ করেছেন, যেখানে পৌঁছানোর জন্য কেবল তাদের আমলসমূহ যথেষ্ট হয় না। তখন আল্লাহ তাদের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা ও বিপদাপদ সমূহ নির্ধারণ করেন। যাতে তারা সেখানে পৌঁছতে সক্ষম হন। (৫) আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণের জন্য সবচেয়ে বড় মর্যাদা হ’ল শাহাদাত লাভ করা। সেকারণ আল্লাহ তাদের নিকটে সে সুযোগ পৌঁছে দেন। (৬) আল্লাহ তার শত্রুদের ধ্বংস করতে চান। সেকারণ তিনি এমন কার্যকারণ সমূহ নির্ধারণ করে থাকেন, যা তাদের কুফরী, সীমালংঘন ও আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের কষ্ট দেওয়ার মাধ্যমে রূপ লাভ করে। এর দ্বারা তিনি মুমিনদের গোনাহ সমূহ দূর করে দেন ও কাফির-মুনাফিকদের সংকুচিত ও ধ্বংস করেন।[1]
বলা বাহুল্য যে, উপরোক্ত রহস্য ও তাৎপর্য সমূহ কেবল ওহোদ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুমিনগণের জন্যই নয়, বরং যুগে যুগে আল্লাহর পথে জীবন উৎসর্গকারী সকল মুমিনের জন্য প্রযোজ্য।
[1]. যাদুল মা‘আদ ২/৯৯-১০৮; ফাৎহুল বারী হা/৪০৪০-এর পরে ‘ওহোদ যুদ্ধ’ অনুচ্ছেদ আলোচনা দ্রষ্টব্য।
ওহোদ যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য বিষয়সমূহ- ১. ‘আব্দুল্লাহ’ নামের কাফেরগণ (الكفار باسم عبد الله)
(ক) কুরায়েশ বাহিনীর পতাকাবাহী বনু ‘আব্দিদ্দার-এর নিহত ১০জন পতাকাবাহীর প্রথম ৬ জনের সকলেই ছিল আব্দুল্লাহ বিন ওছমান ইবনু ‘আব্দিদ্দারের পুত্র অথবা পৌত্র।
(খ) কুরায়েশ তীরন্দায বাহিনীর অধিনায়ক ছিল বদর যুদ্ধে নিহত উৎবাহর ভাই আব্দুল্লাহ বিন রাবী‘আহ।
(গ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপরে সরাসরি আঘাতকারী তিনজন কাফের সৈন্যের দ্বিতীয় জন ছিল আব্দুল্লাহ ইবনে শিহাব যুহরী, যার আঘাতে রাসূল (সাঃ)-এর ললাট রক্তাক্ত হয়। ইনি ছিলেন পরবর্তীকালে বিখ্যাত তাবেঈ মুহাম্মাদ ইবনে শিহাব যুহরী (৫০-১২৪ হি.)-এর দাদা (আল-ইছাবাহ, ক্রমিক ৪৭৫৫)। তৃতীয় জন ছিল আব্দুল্লাহ বিন ক্বামিআহ লায়ছী, যার আঘাতে শিরস্ত্রাণের দু’টি কড়া রাসূল (সাঃ)-এর চোখের নীচে হাঁড়ের মধ্যে ঢুকে যায়। শেষোক্ত ব্যক্তি একই সময়ে মুহাজিরগণের পতাকাবাহী মুছ‘আব বিন ওমায়েরকে হত্যা করে এবং চেহারায় মিল থাকার কারণে তাকেই রাসূল ভেবে ‘মুহাম্মাদ নিহত হয়েছেন’ বলে সে সর্বত্র রটিয়ে দেয়। মুছ‘আব শহীদ হওয়ার পরে রাসূল (সাঃ) যুদ্ধের পতাকা হযরত আলী (রাঃ)-এর হাতে অর্পণ করেন।
(ঘ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন তাঁর সৈন্যদের শিবিরে ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন, তখন তাঁর উপরে হামলাকারী প্রথম কাফের সৈন্যটির নাম ছিল ওছমান বিন আব্দুল্লাহ বিন মুগীরাহ। দ্বিতীয় কাফির সৈন্যটির নাম ছিল আব্দুল্লাহ বিন জাবের। প্রথমজন হারেছ ইবনুছ ছিম্মাহর আঘাতে এবং দ্বিতীয় জন আবু দুজানার হাতে নিহত হয়। এইসব আব্দুল্লাহগণ আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও এরা আল্লাহর বিধান মানতে ও রিসালাত-এর উপরে ঈমান আনতে রাযী ছিল না। এক কথায় তারা তাওহীদে রুবূরিয়াতে বিশ্বাসী ছিল। কিন্তু তওহীদে ইবাদতে বিশ্বাসী ছিল না। মুমিন হওয়ার জন্য যা অপরিহার্য শর্ত। এ যুগেও এমন আব্দুল্লাহদের অভাব নেই।
ওহোদ যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য বিষয়সমূহ- ২. পিতা ও পুত্র পরস্পরের বিপক্ষে (الوالد والولد معارض للآخر)
হিজরতের পূর্বে মদীনার আউস গোত্রের সর্দার ও ধর্মযাজক ছিলেন আবু ‘আমের আর-রাহেব’। হিজরতের পরে তিনি মক্কায় চলে যান এবং কুরায়েশদের পক্ষে ওহোদ যুদ্ধে যোগদান করেন। সেজন্য রাসূল (সাঃ) তার লকব দেন আবু ‘আমের আল-ফাসেক্ব’। পক্ষান্তরে তার পুত্র ‘হানযালা’ ছিলেন মুসলিম বাহিনীর সেই তরুণ সৈন্য যিনি সবেমাত্র বিয়ে করে বাসর যাপন করছিলেন। অতঃপর যুদ্ধের ঘোষণা শুনেই নাপাক অবস্থায় ময়দানে চলে আসেন এবং ভীষণ তেজে যুদ্ধ করে শহীদ হন। ফেরেশতাগণ তাকে গোসল দেন। এজন্য তাঁকে ‘গাসীলুল মালায়েকাহ’ বলা হয়’।[1]
[1]. ইবনু হিশাম ২/৭৫; যাদুল মা‘আদ ৩/১৭২; আর-রাহীক্ব ২৮১ পৃঃ।
ওহোদ যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য বিষয়সমূহ- ৩. দুই ভাই পরস্পরের বিপক্ষে (الإخوان خصم للآخر)
ওহোদ যুদ্ধে রাসূল (সাঃ)-এর উপরে হামলাকারী তিন জনের প্রথম জন ছিল উৎবাহ বিন আবু ওয়াকক্বাছ। তার নিক্ষিপ্ত পাথরের আঘাতেই রাসূল (সাঃ)-এর ডান দিকের নীচের রুবাঈ দাঁত ভেঙ্গে যায়। এই উৎবাহর ভাই ছিলেন ‘ইসলামে প্রথম রক্ত প্রবাহিতকারী’ এবং মুসলিম বাহিনীর খ্যাতনামা বীর ও পরবর্তীকালে ইরাক বিজেতা সেনাপতি হযরত সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ (রাঃ)।[1]
[1]. সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ ১৯ বছর বয়সে মক্কায় ৭ম ব্যক্তি হিসাবে ইসলাম কবুল করেন। তিনি ৪র্থ নববী বর্ষে মক্কায় আল্লাহর পথে কাফেরদের বিরুদ্ধে উটের চোয়ালের শুকনা হাড্ডি নিক্ষেপ করে রক্ত প্রবাহিত করেন। এজন্য তাঁকে ‘ইসলামে প্রথম রক্ত প্রবাহিতকারী’ (أَوّلَ دَمٍ هُرِيقَ فِي الْإِسْلاَمِ) বলা হয়’ (ইবনু হিশাম ১/২৬৩; আল-ইছাবাহ ৩১৯৬)। এ সময় তিনি তার সাথীদের নিয়ে মক্কার একটি সংকীর্ণ স্থানে গোপনে ছালাত আদায় করছিলেন। তখন কাফেররা তাদের উপর হামলা করে। ফলে তিনি তাদের প্রতি উক্ত আঘাত ক